জিজ্ঞেস করলাম, - তুই কি এখনও পুনেতেই?
--নারে, গোয়ায় আছি। দুদিন পরেই ফিরছি।
কথা শেষ। আমি ইদানীং জাগতিক ব্যাপারে নিস্পৃহ। তাছাড়া আমাদের সম্পর্কটা এমনই যে কেন আধার কার্ড প্রশ্ন করা বাহুল্য মাত্র। অশোক আদেশ করলে আমি এবং আমি আদেশ করলে অশোক, বিনা প্রশ্নে তামিল করাই নিয়ম। বাকি কথা তুলে রাখতে হয়। সেই কথাটা অশোক জানাল দিন তিনেক পরে, - জিম করবেট যাওয়া হবে। ১০ এপ্রিল যাত্রা, ১৭ তারিখ ফেরা। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বি না একদম। ওখানে গিয়ে অসুস্থ হলে সমস্যা নেই। শুভব্রত থাকছে, ও চাঙ্গা করে দেবে।
কে শুভব্রত, কীভাবে সে চাঙ্গা-বিশারদ – এসব প্রশ্ন যথারীতি ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
অবসরের বয়স পার হওয়ার পর থেকেই অশোক প্রায়-অবসরভোগীর মতোই জীবনযাপন করে; যদিও ব্যাবসার মূল কাণ্ডারিকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়নি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যোগাযোগের ভার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দেওয়ার মত ভরসা তৈরি হয়নি। তার জন্য অবশ্য তার শারীরিক উপস্থিতির খুব বেশি দরকার পড়ে না। ফলে সে বছরের ছ’মাস থাকে তার গ্রামে নিজের তৈরি বাগানবাড়িতে, তিন মাস নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, বাকি তিন মাস অফিসের জন্য বরাদ্দ। ওই ঘোরার তিন মাস সময়ে তার সঙ্গি থাকে বিভিন্ন ধরনের মানুষজন। তারা হতে পারে পরিবারের সদস্য বা বন্ধুজন। তার বন্ধুত্বের পরিধি এমনই বিস্তৃত যে এই ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে মিলের চাইতে অমিলই বিস্তর। কেউ খাদ্যবিলাসী তো কেউ পানবিলাসী, কেউ বিশুদ্ধ ব্যবসায়ী তো কেউ সাহিত্য বা শিল্প-পাগল।
তো শুভব্রত, জানলাম, এর কোনটাই নয়। সে মূলত কেন্দ্রীয় সরকার-অধিগৃহীত এক ওষুধ কোম্পানির চাকুরে, নিজের কাজে সুনিপুণ। ব্যাবসাও সে করে ঠিকই, তবে তা নেহাতই আংশিক – অনেকটা পড়ে পাওয়া ষোল আনার মতো। একদা সে অপ্রত্যাশিতভাবে অশোককে তার ব্যবসায়ে সাহায্য করেছিল; প্রতিদানে অশোক তাকে প্রায় জোর করে নিজের ব্যাবসার বিশেষ একটি ক্ষেত্রে তাকে সহযোগী করে নিয়েছে। ফলত, ইদানীং তার ব্যাবসা থেকে আয় তার বেতনকে ছাড়িয়ে অনেকটাই উপরে অবস্থান করছে। শুভব্রত খাদ্যবিলাসী তবে মদ্যপান থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। সাহিত্য বা শিল্পপাগল না হলেও অধুনা সে আলোকচিত্র নিয়ে পাগলপ্রায়। জিম করবেট ভ্রমণের পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ তারই। বন্যজীবনের আলোকচিত্র গ্রহণই এই পরিকল্পনার উদ্দীপক। অশোক তার সখা, দর্শনালোক এবং পথ-প্রদর্শক। সে জঙ্গলপ্রেমীও। অতএব এই ভ্রমণে সে তার কাছে অপরিহার্য। আর অশোকের পণ, আরও কিছুদিন সে মামাকে বাঁচিয়ে রাখবেই। সুতরাং আমিও।
শুভব্রতর চরিত্রের আরও কিছু দিক উল্লেখ না করলে তার ছবিটি সম্পূর্ণ হবে না। সে ভয়ংকর জেদি, প্রতিটি বিষয়ে তার নিজস্ব যুক্তিশৃঙ্খলে বাঁধা মতামত আছে, প্রতিপক্ষকে সে একচুলও জায়গা ছাড়তে রাজি নয়; তা সে প্রতিপক্ষ যদি হয় অশোকও। তবে বলতেই হবে যে, যে-কাজ সে হাতে নেয়, সুসম্পন্ন না করে ছাড়ে না।
দমদম থেকে দিল্লি এয়ারপোর্ট, ইন্ডিগোর ফ্লাইট। ছাড়ার সময় সকাল দশটা বেজে পাঁচ। হোয়াটসঅ্যাপে টিকিট আসতে দেখি সেখানে অশোক নেই। শুভব্রত, তার অর্ধেক আকাশ, মেয়ে এবং তাদের পারিবারিক বন্ধু এক মহিলা আমার উড়ানযাত্রায় সঙ্গি হবেন। অশোক তার আগেই ব্যাবসার কাজে পুনে যাবে। সেখান থেকে দিল্লি এয়ারপোর্টে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। তখন পর্যন্ত শুভব্রতর সঙ্গে আমার ফোনালাপ হয়েছে মাত্র, তাকে চোখে দেখিনি, যদিও অশোক তাকে নিয়ে এত গল্প শুনিয়েছে যে তাকে অচেনা বলা অনৃতবচন প্রায় – বাকিরা অবশ্যই সম্পূর্ণ অচেনা। নতুন জায়গা দেখার চেয়ে, আমার কাছে অন্তত, নতুন মানুষকে দেখা কম রোমাঞ্চকর নয়। সেই দেখাটাই শুরু হল এয়ারপোর্টে পৌঁছে। চিনে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। শুভব্রতর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর, ছটফটে চলাফেরা দেখে তাকে মনে হল অনেকদিনের চেনা। পরে বুঝেছিলাম, অশোকেরই আত্মীয় একজনের সঙ্গে ভীষণই সাদৃশ্য শুভব্রতর স্বরক্ষেপণ ভঙ্গিমার। মামাকে আশ্বস্ত করেই সে লাগেজপত্র, বিশেষত তার দামি ক্যামেরাটি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। টুম্পা, তার বউ গালভরা হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে আমার বাহুমূলে হাত রাখল। সেই স্পর্শে সহজ আন্তরিকতার ছোঁয়া। দীঘল, নির্মেদ, এক ঢাল চুল নিয়ে এই মধ্যবয়সেও যথেষ্ট লাবণ্যময়ী টুম্পা। তার হৃদয়টিও যে নির্মল – তা টের পেতে শুরু করলাম তখনই, পরবর্তী সাত দিনে যা ক্রমশ দৃঢ়মূল হবে। তার মেয়ে পূজা এবং টুম্পার জেঠতুতো দিদির মেয়ে, যে আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে এক অতি আপনজন - সেই পিউকে জানাটা বাকি রইল তখনকার মতো।
আমাদের বোর্ডিং পাশ এবং ডিগি যাত্রা অনলাইনেই সম্পন্ন করা ছিল। কাজেই লাগেজ বুকিং এবং সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সে খুব একটা সময় লাগল না। শুভব্রতর ক্যামেরার স্ট্যান্ড নিয়ে সামান্য ঝামেলা হচ্ছিল। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে সে-ঝামেলা মিটিয়ে ফেলল সে। অবশেষে নিশ্চিন্ত হয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে ক্যান্টিনে প্রবেশ। প্রায় মাগনাতেই উপবাসভঙ্গের তোফা ব্যবস্থা করে রেখেছিল শুভব্রত। বিমানের টিকিটের সঙ্গে সম্পর্কিত সেই ব্যবস্থাটা কী – বলেছিল সে, কিন্তু আমি সেটা তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করিনি।
একেবারে সঠিক সময়েই বোর্ডিং শুরু হল। আমরা জুত করে সিট বেল্ট বাগিয়ে নিজের নিজের আসনে বসে পড়লাম। ঘড়ির কাঁটা নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেল, বিমান আর নড়ে না। শুরু হল সাসপেন্স। বিমানবালারা বার বার প্যাসেঞ্জার কাউন্ট করছে, সম্ভবত সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স হয়ে যাওয়া কোনো এক যাত্রী নিখোঁজ। কিছুক্ষণ পরে বোধহয় হাঁকাহাঁকি করে বিমানবন্দর থেকে লোকটিকে পাকড়াও করে এনে তার সিটে বসিয়ে দেওয়া হল। আমাশার রুগি নিশ্চয়, টয়লেটে গিয়ে বসে ছিল! তারপরেও দেখি বিমানের দরজা বন্ধ হয় না। এবার বিমানবালারা লাগেজের র্যাক থেকে এক একটা ব্যাগ বের করে এনে ‘এটা কার ব্যাগ ওটা কার ব্যাগ’ প্রশ্ন করে যাচ্ছে। যাব্বাবা, বিমানে বোমা আছে বলে কেউ উড়ো ফোন করেছে নাকি! এক বিমানবালা অবশেষে একটা বেওয়ারিশ ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারস্যাপার দেখে প্যসেজে, ওয়াশরুমে যাত্রী চলাচল বেড়ে গেছে। একটু পরেই দেখি সেই বিমানবালা সেই-ব্যাগ হাতে বিমানে ঢুকে পড়ল। সেটা নাকি এক ক্রু-মেম্বারেরই ব্যাগ! এ তো দেখি কমেডি অব এররস! বোমার ফয়সালা ঝুলেই থাকল, বিমানের দরজাও খোলা থাকল।
ইতোমধ্যে বিমান ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় আমরা আধ ঘণ্টা হয়ে গেল পেরিয়ে এসেছি। এ-যাত্রায় আমাদের ক্যাপ্টেন এক মহিলা। তাঁর কাছ থেকে কোনো ঘোষণাও শোনা যায়নি। সেটা শোনা গেল আরও দশ মিনিট পরে। বিমানে নাকি কিছু টেকনিক্যাল কমপ্লিকেসি দেখা দিয়েছে, সেটা ঠিক করার কাজ চলছে। ক্যাপ্টেন দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন অল্প সময়ের মধ্যে উড়ান দেবেন আশা করছেন। সেই অল্প সময় যোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের মোট এক ঘণ্টা পরে বিমান ডানা মেলল।
দিল্লি বিমানবন্দরে নেমে মালপত্র সংগ্রহ করে বাইরে বেরোতে বেরোতে আড়াইটে বেজে গেল। অশোক অপেক্ষা করছিল গাড়ির স্ট্যান্ডে। আমাদের গাড়ি রওনা দিল আরও পনের মিনিট পরে। আজকের গন্তব্য রামনগর, জেলা নৈনিতাল, কুমায়ুন ডিভিসন, উত্তরাখন্ড।
ব্রেকফাস্টের পর তেমন কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। মহিলাদের কাছে কিছু না কিছু তো থাকেই, সেসবই টুকটাক চলছিল। মোরাদাবাদ পৌঁছে হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকের একটা রাস্তায় কয়েক গজ এগিয়েই একটা ঝাঁ-চকচকে ফুড প্লাজায় গাড়ি পার্ক করল। দিশি, চাইনিজ মিলিয়ে কয়েক রকম খাবারের অর্ডার দেওয়া হল। তার বেশিটাই পড়ে রইল। খাবার ভালোই ছিল কিন্তু খাওয়ার রুচি কারোরই তেমন নেই বোঝা গেল। শুভব্রত ও পিউ ছাড়া সকলেই পথের শ্রমে ক্লান্ত। পিউকে তখন পর্যন্ত যা দেখলাম, বয়স তিরিশের কোঠার মাঝামাঝি কিন্তু চঞ্চলতায় পূজাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উচ্চকিত কথা, মালিন্যহীন হাসিতে না আছে বয়সের লক্ষণ, না আছে তার সম্পূর্ণ একাকী জীবনের ছাপ। বয়সের বাধা মুছে পূজার সঙ্গেই তার সখ্যের গাঁটছড়া। তুলনায় পূজা শান্ত, ঈষৎ গম্ভীর।
পাঁচটা বাজে। তখনও যথেষ্ট চড়া রোদ্দুর। আমরা খাওয়া সেরে গাড়িতে ওঠার উদ্যোগ নিচ্ছি। হঠাৎ কালো মেঘ ছেয়ে এল আকাশে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল বৃষ্টিপাত। ড্রাইভার বেচারা গাড়ির ছাদে রাখা আমাদের লাগেজে ত্রিপল ঢাকা দিয়ে বাঁধতে বাঁধতেই ভিজে একশা হল। আমরাও কমবেশি ভিজলাম গাড়িতে উঠতে গিয়ে। আবার যাত্রা শুরু করতে প্রায় ছটা বাজল। তখনও রাস্তা শেষ হতে দেড়শ কিলোমিটারের বেশি বাকি। ভাবা হচ্ছিল নটা-সাড়ে নটার মধ্যে রামনগর পৌঁছে যাব। কিন্তু বৃষ্টির জন্য হাইওয়ের গতি তুলতে পারছিল না ড্রাইভার। বৃষ্টি যখন থামল তখন আমাদের গাড়ি দিল্লি-নৈনিতাল হাইওয়ে ছেড়ে রামগড়-গামী সিঙ্গল-লেন রাস্তা ধরেছে। তার উপর একের পর এক বালি-ভর্তি ভারী লরি উলটো দিক থেকে আসছে। মাঝে মাঝেই জ্যাম-জট সৃষ্টি হয়েছে। বিরক্তিকর সাড়ে আট ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা যখন রামগড় শহরে ঢোকার মুখে ‘ট্র্যাভার্ন ইন’ নামে এক বিলাসবহুল রিসর্টে গাড়ি থেকে নামছি, তখন নতুন করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
মালপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে হোটেলের কর্মচারীদের বুঝিয়ে দিয়ে আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। রাত সাড়ে এগারোটাতেও ফুটবল মাঠের মতো বিশাল, সুসজ্জিত ডাইনিং হল জমজমাট। একটু পরেই প্রাণঘাতী ডিজের আওয়াজে হিন্দি গানের সুরে বোঝা গেল তার কারণ। ডাইনিং-এর পাশেই একটি ছোট হলে জেল্লাদার পোশাকে সজ্জিত সব বয়সের নারী-পুরুষের বিভিন্ন ভঙ্গিতে কোমর দুলানো দেখে হৃদয়ঙ্গম হল যে আমরা সনাতন ভারতবর্ষের আধুনিক হিন্দি-সংস্কৃতির বলয়ে প্রবেশ করেছি। সম্ভবত শাদি বা শাদির বরাত সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান চলছে। চমৎকার, সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে এই উপদ্রব খানিক সহ্য হয়ে এল।
লিফট বেয়ে চারতলায় আমাদের রুমে উঠলাম। পাশাপাশি তিনটে ঘর। আমি আর অশোক এক ঘরে। অন্য দুই ঘরে সস্ত্রীক শুভব্রত এবং পূজা-পিউ। লাগেজ পৌঁছে গিয়েছিল রুমে। খুলে দেখলাম বেশ কিছু জামাকাপড় ভিজেছে। সেসব বের করে ফ্যানের তলায় রেখে শুয়ে পড়লাম।
খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখেমুখে জল দিয়ে নীচে নেমে এলাম। চারিদিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ! সাজানো চত্বর ছাড়াও এই রিসর্টের দুই পাশ জুড়ে বিশাল এলাকা। একপাশে বড় ফুটবল মাঠের আকারে স্যুইমিং পুল। পিছনের দিকে ফলের বাগান। সামনে থেকে তার শেষ দেখা যায় না। পুলে, বাগানে ব্যস্তসমস্ত কর্মচারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিমেষে কল্পনার চোখে ভেসে এল উনিশ শতকের কলকাতার জমিদারদের রঙিন বাগানবাড়ি। তফাত এই যে সেখানে প্রতি রাতে বাইজীর নিক্কণে আর মদের ফোয়ারায় সোনাচাঁদি উড়ে যেত, আর এই কর্পোরেট জমিদারি রিসর্টে প্রতি রাতে উড়ে আসে লক্ষ লক্ষ ডিজিটাল কারেন্সি।
আমাদের জিম করবেটের বিজরানি বনকুটিরে যাত্রা করার সময় সকাল আটটা। তার আগে অবশ্য আমাদের রামনগরে অবস্থিত ‘মুরো হসপিটালিটি’ নামক ভ্রমণ-পরিচালকের অফিসে একবার হাজিরা দিতে হবে। আটটা বাজার আগেই তাদের পাঠানো ‘দ্য বিগ ক্যাট সাফারি’র দুটি জিপসি গাড়ি রিসর্ট চত্বরে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরিই ছিলাম। গাড়িতে উঠে বসলাম। একটা গাড়িতে শুভ-দম্পতি আর আমাদের টিমের সবচেয়ে মহার্ঘ সদস্য, শুভব্রতর ক্যামেরা। জিপের উপর সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই জঙ্গল সাফারিতে যাবে। এই কারণেই দুটি গাড়ি নেওয়া হয়েছে। নইলে একটা গাড়িতেই আমার ছ’জন দিব্যি এঁটে যেতাম।
রামনগরের প্রধান রাস্তা ছেড়ে একটু ভেতরে ঢুকে একটা গলির মধ্যে ‘মুরো’র ছোট্ট অফিস। অফিস ছোট হলেও আধুনিক সমস্ত উপকরণ সেখানে মজুত। এই ট্যুর অপারেটরের মালকিন রুহি খান নাম্নী এক ঝকঝকে মহিলা। পশ্চিমী পোশাকে আভরণহীন এবং মেদহীন ছিপছিপে চেহারা রুহির। সামান্য কথাবার্তাতেই তাঁর মনোরম ব্যক্তিত্বের আভাস পাওয়া গেল। তাঁর অফিসের চারজন কর্মীও মহিলা। তাঁরা যে-যার কম্পিউটারে কাজে মগ্ন। ভারতের যেকোনো প্রান্তে এবং ভারতের বাইরেও তিনি দায়িত্বের সঙ্গে ভ্রমণ পরিচালনা করেন। এবং সেটা যে তিনি সাফল্যের সঙ্গেই করছেন তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হলো না। তাঁর অফিসে পুরুষ বলতে একজনই, তিনি রুহির স্বামী। আমাদেরকে যথাযোগ্য আপ্যায়িত করা হল। অবশেষে বাইরে বেরিয়ে সকলের গ্রুপ ফটো তুলে নিয়ে আমাদের বিদায় জানালেন রুহি।
রামনগর বেশ ব্যস্ত শহর। প্রধান রাস্তার দুপাশে আধুনিক কায়দায় সাজানো সারি সারি বিপণী। খানিক এগোতেই চোখে পড়ল শোন নদী। তখনই বোঝা গেল শোন নদীর তীরেই এই শহর অবস্থিত। এখান থেকে সাত কিলোমিটার গেলে আমডান্ডা গেট। এই গেট দিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করব আমরা। জঙ্গলের ভিতরে আরও বারো কিলোমিটার উজিয়ে গেলে তবে বিজরানি ফরেস্ট রেস্ট হাউস। ভারতবর্ষের বিশালতম অরণ্য এই জিম করবেট। রামগঙ্গা ও কোশি তাদের শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত করে লালন করে চলেছে এই প্রাণময় অরণ্যকে। এদেরকে বলা যায় এই অরণ্যের শিরা উপশিরা। লক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ, তরুগুল্ম, পাখি ছাড়াও আছে ছোটবড় নানান প্রাণী। জিম করবেট যখন পায়ে হেঁটে এই জঙ্গলে বিচরণ করতেন তখন ছোট ছোট কিছু গ্রাম ছিল অরণ্যের ভেতরে। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যে এই গ্রামের অধিবাসীরা এবং জিম ছিলেন পরস্পরের সহায়। সংরক্ষিত অরণ্য ঘোষণা করার পর গ্রামগুলিকে সরিয়ে আনা হয়েছে অরণ্য এলাকার বাইরে। জঙ্গলের ভেতরে প্রচুর জিপসি চলাচলের পথ তৈরি হয়েছে ট্যুরিজিমের স্বার্থে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ডজনখানেক অরণ্য কুটির রয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এই জঙ্গলের মধ্যে। সেইসব কুটিরের খাওয়ার ক্যান্টিন অরণ্য দপ্তর লিজ দিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার অধিগৃহীত কুমায়ুন বিকাশ মণ্ডল নিগমকে। এই গল্প কম চিত্তাকর্ষক নয় কিন্তু সেই প্রসঙ্গে পরে আসব। আমাদের আজকের গন্তব্য যে বিজরানি বনকুটির, সেটি অবস্থিত অরণ্যের পূর্ব প্রান্তে।
বিজরানি পৌঁছতে আমাদের এগারোটা বেজে গেল। গেটে ঢোকার মুখে একটি তরুণ বটগাছ, তার উলটো দিকে পাবলিক টয়লেট। গেট পেরিয়ে ডান দিকে বনদপ্তরের অফিস। সেখানে পরিচয়পত্রসহ নামধাম লেখানো হচ্ছে, আমি দেখছি পিছনের দেওয়ালে কাচ দিয়ে ঘেরা একটি কাঠের র্যাক। সেখানে জিম করবেট রচনাসংগ্রহের সব কয়টি খণ্ড শোভা পাচ্ছে। এছাড়াও এই অরণ্য-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বই। আমাকে লোভী চোখে তাকাতে দেখে অফিসের কর্মীটি বললেন, ইচ্ছে হলে বই নিয়ে গিয়ে আপনার ঘরে পড়তে পারেন, ফেরার আগে ফেরত দিতে হবে। সেই মুহূর্তে লোভ সম্বরণ করলাম। জঙ্গল উপভোগ করতে গিয়ে বইয়ে ডুব দিলে মনোযোগ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা।
বিজরানিতে অতিথিদের জন্য দুই খণ্ড আবাস। সামনের খণ্ডে ছোটবড় ছয়টি ঘর। পিছনের খণ্ডে আনকোরা নতুন দুটি ঘর। সামনের খণ্ডে তিনটি বড় ঘর আমরা দখল করলাম। আবাস খণ্ড দুটিকে প্রায় মাঝখানে রেখে বর্গাকৃতি ঘাসে ঢাকা কুটিরচত্বর বিদ্যুৎবাহিত তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। অফিস ঘরের উলটো দিকে বেশ খানিক এগিয়ে গেলে পূর্ব প্রান্তে রসুই ঘর আর খাবার ঘর। রসুই ঘরের পিছনে দু-দিক খোলা চালার মধ্যে দুটি হাতি শিকল দিয়ে বাঁধা আছে। তার সামনেই মাহুতের সপরিবার থাকার ঘর। আমরা যখন খাবারের বরাত দিতে রান্নাঘরে গেলাম, দেখি যে মাহুত একটি হাতির সামনে ভাতের থালা রেখেছে। আর হাতি শুঁড় দিয়ে থালা থেকে ভাত তুলে নিয়ে দিব্যি মুখে ভরছে। মাহুত জানাল, আগে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে ট্যুরিস্টদের জঙ্গল সাফারি করানো হত। কয়েক বছর আগে থেকে সরকারি আইনে তা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু হাতি দুটোকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। তাদের দেখাশুনা করার জন্য আপাতত তার চাকরিটিও বজায় আছে। তার লক্ষ্য যতদিন সম্ভব যত্নআত্তি করে হাতিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা। এরা মরে গেলে তার চাকরিটি বেঁচে থাকবে কিনা কে জানে! একবেলা সে বনদপ্তর থেকে পাওয়া খাবারের সঙ্গে হাতির পছন্দের গাছপালা জঙ্গল থেকে যোগাড় করে নিয়ে এসে খাওয়ায়। বিকেলে তাদের সামনের দু-পায়ে আলগা শিকল পরিয়ে সামনের জঙ্গলে চরতে পাঠিয়ে দেয়।
এই পূর্বপ্রান্তেই বেড়া ঘেঁসে বনদপ্তরের কর্মচারীদের জন্য কয়েকটি ছোট ছোট কোয়ার্টার আছে। তার সামনে পরিত্যক্ত একটি সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকেই হাতির পিঠে আরোহণ করত ভ্রমণার্থীরা। তার বদলে এখন আমরা জিপসি জিপের পিঠে উঠে জঙ্গল সফর করব। রোজ দুবার – সকাল ছটা থেকে নটা আর বিকেল তিনটে থেকে ছটা।
স্নান সেরে আমরা খাবার ঘরে গেলাম দুপুর একটা নাগাদ। এই জঙ্গলে খাবারের মেনু দেখলাম আমার বেশ মনোমত। মাছ-মাংস নিষিদ্ধ। ভাত রুটি ডাল সবজি ভাজি স্যালাড আচার। রান্নাও প্রায় বাড়ির মতোই। এখানে ডিমটা অবশ্য আমিষ পদবাচ্য নয়। কাজেই আমি বাদে আমাদের দলের আর সবাই দুবেলা ডিম চালাতে লাগল – সেদ্ধ কিংবা ভাজা। ব্রেকফাস্টে টোস্ট, রুটি-পরোটা-লুচি, চাও – যার যা খুশি খেতে পারে। সকালে সাফারিতে বেরনোর আগে বরাত দিয়ে যেতে হবে। নিষেধ কেবল মাছমাংসে থেমে যায়নি, ধূমপানও নিষিদ্ধ। কী হবে তাহলে - পুং-জাতীয় আমরা তিনজনেই যে অল্পবিস্তর ধূম্রপ্রেমী! বায়বীয় ব্যাপারটায় কি একটুও ফাঁকফোকর নেই? অচিরেই জানা গেল, রসুইঘরের পিছনটায় গিয়ে সুখটান দেওয়ায় ছাড় আছে। থাকতেই হবে। এই বনকুটিরের এতজন কর্মী – সবাই কি নৈকষ্য নিকোটিনহীন থাকতে পারে!
দুপুরে খাওয়ার পর সামান্য বিশ্রাম নিয়েই প্রথম সাফারির জন্য তৈরি হয়ে জিপসিতে উঠে বসলাম। আমাদের দুই গাড়ির দুই চালক ওসমান আর ভরত এই ছদিন আমাদের সঙ্গেই থাকবে। ভিন্ন চরিত্রের এই দুই চালকের পরিচয় ক্রমশ প্রকাশ্য। ছয়দিন সকাল বিকেল মিলিয়ে মোট বারোটি অভিযান হবে। বিজরানিতে ছটি, এবং আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গৈরালা বনকুটির থেকে ছটি।
আমাদের প্রথম অভিযানই ষণ্ডচক্ষু বিদ্ধ করল। প্রথমটায় কিচ্ছু আঁচ পাওয়া যায়নি। তাতেও খারাপ লাগছিল না বিশেষ। যে কোনো জঙ্গলে ঢুকলেই একটা মনোহরণ গন্ধ পাওয়া যায়। মাটি এবং গাছপালার, তার পত্রপুষ্পের মিশ্রিত গন্ধ। আর এ তো এক সুপ্রাচীন অরণ্য। প্রাচীন বৃক্ষের বল্কলে ধরা আছে আদিম পৃথিবীর ঘ্রাণ। পাখির ডাকাডাকি ছাড়া প্রাণের স্পর্শ প্রথম পাওয়া গেল ওসমান যখন গাড়ির গতি প্রায় শূন্য করে আমাদের তাকাতে বলল গাড়ির ডানদিকে। সেখানে এক ঝোপের গোড়ায় এক বন্যকুক্কুট-দম্পতি নেচে নেচে মাটি খুঁটে খাবারের সন্ধান করছিল। ক্রমশই প্রাণীর উপস্থিতির সংখ্যা বেশি বেশি করে নজরে আসছিল। বহুরকমের পাখি – পাখি চেনায় আমরা সকলেই প্রায় সমান পণ্ডিত, ওসমান তাদের নাম বলে চলেছিল, বেশির ভাগই অচেনা, কেবল কয়েকটি ইংরাজি নাম চেনা মনে হল। চেনা বলতে ময়ূর আর উঁচু ডালে বসে থাকা ঈগল। চেষ্টা করলে কয়েকটি নাম উল্লেখ করা যায়। সে-চেষ্টা আর করলাম না, গুগলে খোঁজ করলেই এই অরণ্যের যাবতীয় পাখির ছবিসহ নাম পেয়ে যাবেন পাঠক। গাছে পাখি ছাড়াও আছে বহু প্রজাতির বাঁদর আর মাটিতে দেখা গেল নানা প্রজাতির হরিণ। হাতি কিংবা বাঘের মতো রাজকীয় দর্শন বহুক্ষণ আমাদের নয়নের আড়ালেই থেকে গেল। বড় প্রাণী বলতে সম্বর দেখা গেল, প্রায় গরুর মতোই আকার। বোকার মতো ড্যাবড্যাবে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। নড়াচড়ার নাম নেই। ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা গেল চিতল হরিণ। আর ছোট আকারের বার্কিং ডিয়ার বা কাকর হরিণ। হগ ডিয়ার বা বরা হরিণও আছে এই জঙ্গলে। তবে তারা নিশাচর। তাদের দর্শন পাওয়া অসম্ভব।
সমগ্র ভারতে ভূপ্রকৃতির যা বৈচিত্র্য, তার সব কটিই আছে এই বিশাল জঙ্গলে। কোথাও শক্ত কাঁকুরে মাটি, কোথাও পলিমিশ্রিত বালুচর, কোথাও স্যাঁৎস্যাঁতে বাদা অঞ্চল আবার কোথাও বা উর্বর দোয়াস মাটি। ফলে এখানে সব ধরনের উদ্ভিদেরই প্রাচুর্য। উল্লেখ করার মতো আছে জাম গাছের জঙ্গল। ছোট ছোট বুনো জাম, গাছের আকার বিশাল। এমন এমন জায়গা দিয়ে ঘুরছি যেখানে কেবল জাম গাছেরই রাজত্ব। বর্ষায় যখন জাম পাকবে তখন হরিণ বাঁদর আর পাখির পিকনিক কেমন জমে যাবে সেটাই ভাবার চেষ্টা করছিলাম।
এই জঙ্গলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গাছের সমারোহ দেখলাম যার স্থানীয় নাম সিন্দুর গাছ। দেখলাম গাছভর্তি খুদে খুদে লাল ফল। ওসমান বলল, এই ফল শুকিয়ে গুঁড়ো করে নাকি সিঁদুর তৈরি হয়। তখন পর্যন্ত জানি সিঁদুরের একমাত্র গৌরব হিন্দু এয়োস্ত্রীর সিঁথি রঞ্জিত করা। কারণ তখনও পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে ভারতের সফল মিসাইল অভিযানের নাম সিঁদুর দেননি বিশ্বগুরু মোদি। ওসমান জানাল এই জঙ্গলে এই গাছের আসল গুরুত্ব একেবারেই ভিন্ন। হাতির খুব প্রিয় খাবার এই গাছের ডালপালা। এই জঙ্গলে হাতির প্রাচুর্যের একটা কারণও হয়ত এই গাছ।
দূর থেকে দেখে যদিও তেমন মন ভরল না, তবুও প্রথম অভিযানেই মহারাজের দেখা পেয়ে আমরা মহানন্দে কুটিরে ফিরলাম। সেদিনের সান্ধ্য আড্ডায় পিউয়ের বিষাদময় জীবনের গল্প শুনলাম টুম্পার মুখ থেকে। আই টি সেক্টরে সে সবে চাকরিতে যোগ দেবে, আচমকাই মৃত্যু হল তার বাবার। বাবার চাকরির সূত্রেই তাদের বাস ছিল কোয়েম্বাটুরে। মায়ের শরীরে শর্করার আধিক্য। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। চেন্নাইতে চাকরিতে যোগ দিয়ে মাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে এল পিউ। মাকে দেখাশোনা এবং ঘরের কাজের জন্য একজন সহায়িকা রাখল। একদিন পিউ যখন অফিসে, সে আলমারির তালা খুলে টাকাপয়সা আর মূল্যবান জিনিসপত্র বের করে নিতে যাবে, টের পেয়ে তার মা বাধা দিতে গেলেন। সহায়িকা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট, ভেতরে রক্তক্ষরণ, কোমায় চলে গেলেন মা। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর মৃত্যু হল। একা হয়ে গেল পিউ। পঁচিশ বছর বয়সে সেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হল। ইনসুলিন নিতে হয় নিয়মিত। ভাগ্যের হাতে মার খেয়েও পিউ দিব্যি হাসিচঞ্চল, চাকরিতে দ্রুত উন্নতি করে চলেছে। টুম্পা তাকে নিজের পরিবারের অংশ করে নিয়েছে। তার বিয়ের চেষ্টাও করে যাচ্ছে। ভয় একটাই। সব জেনেবুঝেও কেবল তার লোভনীয় চাকরির কারণে কোনো লোভী ছেলে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়, সেটা পিউয়ের ভবিষ্যতের পক্ষে অভিশাপ হয়ে যেতে পারে। এই সতর্কতার কারণে মধ্যতিরিশেও তার বিয়েটা হয়ে ওঠেনি।
পূজাকে জানার সহজ রাস্তা তার সঙ্গে তার পড়াশোনা নিয়ে আলাপ শুরু করা। তাই করলাম। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছে পূজা। সবে ফার্স্ট সেমিস্টার হয়েছে। আমারও বিষয় ছিল ইংরাজি সাহিত্য। কিন্তু এখন পরীক্ষার ধরনধারণ, পাঠ্যসূচিতে বদল হয়ে গেছে বহু। বলতে বলতে সহজ হয়ে হয়ে এল পূজা। যেমনটা ভেবেছিলাম সেরকম নয়। যথেষ্ট আলাপী এবং বুদ্ধিমতী। তবে সাহিত্যে যে খুব আগ্রহ আছে তেমন মনে হল না। বাবামায়ের যত্নে বেড়ে ওঠা আত্মবিশ্বাসী কিশোরী।
বিজরানি কুটিরের খাওয়াদাওয়ায় শুভব্রতর মন ভরেনি বিশেষ। তবে জঙ্গলের ছবি তোলার স্বার্থে ভোজনবিলাসের আপাত- বিসর্জন সে খুশিমনেই মেনে নিয়েছে। আমাদের পাশের ছোট ঘরটিতে এসেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে সৌরভ বিশ্বাস নামে এক যুবক। শুভব্রতর মতই সে ক্যামেরা-পাগল। মুহূর্তেই জমে গেল দুজনে। কথার আর শেষ নেই। শুভব্রত পুরনো ঘরানার আলোকচিত্রী, নিজের চোখ এবং ক্যামেরার উপরেই ভরসা। সৌরভ সে-তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ছবির উপর কারিকুরি চালায়। এই নিয়ে মৃদু তর্কবিতর্কও হচ্ছে মাঝে মাঝে।
আমি নড়বড়ে শরীরের কারণে তিনটে সফর ফাঁকি দিলাম। পিউ-পূজাও একটা সফর বাদ দিল। অশোকও শেষ সফরটা বাদ দেওয়া মনস্থ করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চলেই গেল শুভব্রত-টুম্পার মুখ চেয়ে।
১১ থেকে ১৩ এপ্রিল – তিন দিনের বিজরানি সফর শেষ হল। ১৪ থেকে ১৬ – এই তিন দিন আমরা থাকব গৈরালা বনকুটিরে। এর অবস্থান আরও পশ্চিমে। পশ্চিমতম প্রান্তের ঢিকালা ফরেস্ট রেস্ট হাউস গৈরালা থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে। রামগঙ্গা নদীর তীরে ঢিকালা-ই সৌন্দর্যে এবং বন্যপ্রাণীর উপস্থিতির প্রাচুর্যে সর্বোত্তম। নদীটির সেই অংশে স্বাস্থ্যের লাবণি। কিছুটা দূরেই বাঁধ দেওয়া আছে। সেকারণেই অন্যথা-অগভীর রামগঙ্গার সেই অংশে জলের গভীরতা। সহজবোধ্য কারণেই এই কুটিরে জায়গা পাওয়া খুব কঠিন। আমরা অবশ্য গৈরালা থেকে ছটি সফরে গৈরালা থেকে ঢিকালা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করব।
গৈরালার প্রবেশপথে ধনঘরি গেট। সেখানে আমাদের পরিচয়পত্র লিপিবদ্ধ করানোর জন্য থামতে হল। শুভব্রত সকলের আধার কার্ড নিয়ে ভরতের সঙ্গে অফিসে গেল। একটু দূর থেকে দেখছি আমাদের অন্য চালক ওসমানকে দুই চল্লিশোর্ধ্ব এলেবেলে পোশাক পরা লোক কিছু একটা ব্যাপারে রাজি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটু পরেই সব পরিষ্কার হল। তারা দুজনে আমাদের গাড়িতে উঠে দুটো মাঝারি আকারের ব্যাটারির বাক্স সিটের তলায় ঢোকানোর কসরত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সফলও হল। আমাদের দুটো জিপসিতে বারো জন বসার জায়গা, লোক সাকুল্যে ছ’জন। অতএব গাড়িতে তারাও উঠে বসল। জানা গেল গৈরালায় বিদ্যুৎ নেই, সূর্যালোক থেকে সৌরশক্তিই সেখানে আলো-হাওয়া-জল যোগায়। তার ব্যাটারি রিচার্জ করতে ধনঘরি আসতে হয়। এই দুজন গৈরালা কুটিরে কর্মরত বনদপ্তরের কর্মী। দুজনের মধ্যে একজন বলিয়েকইয়ে, অন্যজন চুপচাপ। প্রথম জন বনদপ্তরে চাকরি পাওয়ার ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। বনবিভাগে দৈনিক মজুরির ক্যাজুয়াল কর্মী হিসাবে ঢুকেছিল ২০০৯ সালে। ২০১৬ সালে স্থায়ী হয়েছে। এখন সে গৈরালা বনকুটিরের দায়িত্বে। তার অধীনে আরও জনা তিনেক কর্মী আছে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিবারেই কি তারা টুরিস্টদের গাড়িতে আসাযাওয়া করে?
--গাড়ি তো প্রায় রোজই আসাযাওয়া করে। কিন্তু সব সময় কি ভ্রমণার্থীদের গাড়িতে জায়গা খালি থাকে! তখন হাঁটতে হয়।
--বারো কিলোমিটার রাস্তা – বাঘ ও হাতির মতো বিপজ্জনক প্রাণী-অধ্যুষিত জঙ্গলের রাস্তায় কেবল লাঠি হাতে হেঁটে যাওয়া। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে তো।
--সে ভয় তো আছেই, তবে সতর্ক থাকলে সচরাচর বিপদ হয় না। হাতি মাঝে মাঝে রাস্তা পারাপার করে বটে, অন্যমনস্ক না থাকলে জঙ্গলের পরিবেশে অভ্যস্ত আমরা আগে থেকেই টের পেয়ে যাই। তাদের কাছাকাছি গিয়ে না পড়লে তারা কখনও দূর থেকে তেড়ে আসে না। আমার এই ষোল বছরের অভিজ্ঞতায় মাত্র একজন সাইকেল আরোহীকে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাতে দেখেছি।
গৈরালা বনবাংলোতে ঢোকার আগে একটুখানি রাস্তা খুবই খারাপ। জিপসি নাচতে নাচতে সেই রাস্তা পেরিয়ে একটা নালার উপর ছোট পোল পেরোতেই চোখে পড়ল কুটিরের পিছন দিকটা। সামান্য এগোতেই গেট। গেট পেরিয়ে জিপসি থেকে নামা মাত্রই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। রামগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে এই বাংলো ও তার প্রশস্ত চত্বর। নদীর দিকে চত্বরের শেষ প্রান্তে খাটো উচ্চতার চওড়া প্রাচীর। স্রোতস্বিনী অবিরাম গান গেয়ে চলেছে। পাখির ডাক যোগ্য সঙ্গত করে চলেছে গানের সঙ্গে। কুটিরের চত্বর থেকে একটা বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে রামগঙ্গায়। কিন্তু হায়! বৈদ্যুতিক তারের বেড়া আটকে রেখেছে নামার পথ। কোনও একদিন নিশ্চয় ভ্রমণার্থীরা নেমে যেত এই সিঁড়ি বেয়ে রামগঙ্গার বুকে। বুনো পশুদের চত্বরে প্রবেশের সম্ভাবনা রোধ করতেই এই বেড়া। কেবল এই কুটিরই নয়, নিরাপত্তার খাতিরে এই অরণ্যের প্রতিটি অতিথিনিবাসই তার বিস্তৃত প্রাঙ্গণসহ বৈদ্যুতিক তারের ঘেরে আবদ্ধ।
এই কুটির দুই খণ্ডে বিভক্ত। একদিকে আছে ভিআইপি-দের জন্য সংরক্ষিত কয়েকটি ঘর। মাঝখানে কুটিরের অফিস, পাকশাল ও খাবার ঘর, অন্যদিকে অতিথিদের জন্য দুই শয্যা-বিশিষ্ট দুটি ঘর এবং একটি আট শয্যা-বিশিষ্ট জনতা-ঘর (ডর্মিটারি)। প্রথম দুটি ঘরের একটিতে আমরা দুই বুড়ো – আমি আর অশোক, অন্যটিতে দুই তরুণী – পিউ আর পূজা। বেচারা শুভব্রত বউ নিয়ে জনতা-ঘরে। সেদিন অবশ্য কুটিরে অন্য কোনো অতিথি ছিল না। পরের দিনে তিনজন আসার কথা এক দিন এক রাত্রির জন্য। সেদিন হয়তো শুভ-টুম্পাকে এই ঘর ওই ঘর করে চালিয়ে নিতে হবে।
আমি ঠিক করেছি এখানেও ছটা সফরের মধ্যে তিনটে করব। এখানে রামগঙ্গার তীরে চত্বরের সিমেন্টের চওড়া প্যারাপেটে বসে বসে সময় কাটালে সেটাও সফরের চেয়ে খুব একটা কম আনন্দদায়ক হবে না মনে হয়। সেদিন বিকেলের সফর দিয়ে শুরু হল আমাদের গৈরালা-ঢিকালার মধ্যবর্তী অঞ্চলে জঙ্গল-পরিক্রমা। গৈরালা কুটির থেকে ঢিকালার দিকে বেরোবার পথটি খুবই খারাপ। রামগঙ্গার তীর ধরে চলা পথের শুরুটুকু এবড়োখেবড়ো পাথরের। তার মধ্যেই বড় বড় গাছের শক্ত শিকড়শিরা রাস্তার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বিছানো। তার উপর দিয়ে আমাদের জিপসি নাচতে নাচতে চলেছে। আমাদের সাত দশকের প্রাচীন হাড় কঁকিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ডানদিকে চোখ ফেরালেই স্রোতস্বিনী রামগঙ্গা। বহমান জলধারা দেখলেই অশোক এবং আমার অবগাহনের ইচ্ছে অদম্য হয়ে ওঠে। কোন জায়গা দিয়ে নদীর বুকে নামা যায়, সেই নিয়েই আমাদের জল্পনা চলছিল। একটু পরেই ডানদিকে একটা প্রশস্ত চত্বরে গাড়ি থামিয়ে ওসমান আমাদেরকে নদীর দিকে তাকাতে বলল। আর তাকাতেই আমাদের জল্পনা চৌপাট! সেখানে দুটি কুমির বালির চরে মাথা আর বাকি শরীর জলে ডুবিয়ে মড়ার মতো পড়ে আছে। ওসমান জানাল, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বাইরে থেকে এনে বেশ কয়েকটি কুমির এনে এখানে তাদের পুনর্বাসিত করেছে। কী খায়? মাছ, ছোট আকারের জলচর প্রাণী তো খায়ই। কখনো কখনো নদীতে নামা হরিণও ধরে ফেলে। অনেক সময় বালিতে মড়ার মতো পড়ে থাকে। হরিণ কাঠজাতীয় বস্তু মনে করে তার কাছাকাছি এসে গেলেই আচমকা মাথা তুলে চোয়াল বসিয়ে দেয় হরিণের পায়ে। তারপর টানতে টানতে জলে নেমে যায়। বনদপ্তরও নজর রাখে। তেমন বুঝলে পাঁঠার খণ্ডিত দেহ ফেলে দেয় নদীতে।
পরদিন সকালের অভিযানটা আমি ফাঁকি দিলাম। জলখাবার সেরে রামগঙ্গার তীরে চওড়া প্যারাপেটের উপর বসেছিল কুটিরের কেয়ারটেকার। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। নদীর দৃশ্য উপভোগও হবে আবার লোকটির সঙ্গে গল্পও করা যাবে। কালো রঙের ছোটোখাটো প্রৌঢ় মানুষটি। বোর্ডারদের যখন যা দরকার হয় – তোয়ালে, সাবান, অতিরিক্ত চাদর, এমনকি অতিরিক্ত খাটও তিনি সরবরাহ করেন। এই যেমন আজ জনতা ঘরে তিনজন নতুন বোর্ডার আসছে বলে শুভব্রত মেয়েদের ঘরে দুটো অতিরিক্ত খাট চেয়ে নিয়ে ঢুকিয়েছে। ওই ঘরেই চারজন থাকবে। বেশ শক্তপোক্ত ফিতেয় ছাওয়া ক্যাম্প খাট।
তার পাশে বসে আগে পরিচয়-পর্বটা সেরে নিলাম। কুমায়ুন ডিভিশনের এক গ্রামে বাড়ি। এখানে আছেন সেই ২০০১ সাল থেকে। এখন পরিবার নিয়েই এখানকার কর্মী-আবাসে থাকেন। আমরা যে-কুটিরে আছি তারই পিছন দিকে খাটো পাঁচিলের ওপাশেই কর্মী-আবাস। আমরা বসেছিলাম সেইখানটায় ঠিক যেখান থেকে নেমে গিয়েছে বাঁধানো সিঁড়ি নদীর বুকে। জিজ্ঞেস করলাম, সিঁড়িটা তৈরি হয়েছিল যখন – তখন নিশ্চয় এই সিঁড়ি দিয়ে নদীতে নামাওঠা করত সবাই। তারের বেড়া দিয়ে সেটা বন্ধ করা হল কবে থেকে?
দেখভালের দায়িত্বে থাকা মানুষটি জানালেন, ২০১৪ সাল থেকে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সিঁড়ি দিয়ে প্রায় রাতেই চত্বরে উঠে আসত বুনো পশুরা। নিরাপত্তার খাতিরেই বৈদ্যুতিক বেড়া বাড়িয়ে সিঁড়িসহ নদীতীরের দিকটিও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাছেই জানা গেল, রামগঙ্গার বুকে বসানো আছে জল তোলার পাম্পমেশিন। সেটা চালিয়ে পাইপলাইন দিয়ে নদীর জল সরাসরি উঠে আসে কুটিরের মাথায় বসানো জলের ট্যাংকে। পাম্প চালানোর সময়, বা খারাপ হলে মেরামতের জন্য কর্মী বা মিস্ত্রীরা এই বেড়া দিয়ে গলে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামে। দিনের বেলায় এমনিতেই তারে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রোদের তেজ বাড়তে ঘরে এসে ঢুকলাম। একটু পরেই আমার ঘরে এলেন কিচেনের দায়িত্বে থাকা কর্মীটি। এসে জিজ্ঞেস করল, - আপনি যাননি দেখে এলাম স্যার। চা-কফি কিছু দেব?
বললাম, - চিনি ছাড়া লিকার হলে মন্দ হয় না। --দু-মিনিটে আসছি স্যার – বলে উঠে গিয়ে সত্যি সত্যিই তিনি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এক কাপ লিকার নিয়ে ফিরে এলেন। আমার মনে হল মানুষটি গল্প করার মুডে আছেন। বারান্দায় অনেকগুলি আরামদায়ক চেয়ার পাতা ছিল। তারই একটাতে চায়ের কাপ হাতে বসে আমি তাকে পাশের চেয়ারে বসতে বললাম। তিনি বসলে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বনদপ্তরের কর্মী কি-না। একেবারেই নয়। জানলাম তিনি রাজ্যসরকারের নিয়মিত কর্মচারী। কুমায়ুন বিকাশ মণ্ডল নিগম রাজ্য সরকার অধিগৃহীত একটি স্বশাসিত সংস্থা। তারা কুমায়ুন ডিভিশনের মধ্যে বনদপ্তরের সব কয়টি কুটিরের কিচেন দীর্ঘমেয়াদি লিজে বন্দোবস্ত নিয়েছে। একজন ম্যানেজার আর দুজন কুক – কিচেনের এই হল সবসুদ্ধু স্টাফ। সবাই নিগমের স্থায়ী কর্মী। ইনিই হলেন ম্যানেজার। নাম মহেন্দ্র আর্য। বেশ লম্বাচওড়া সুপুরুষ চেহারা। বয়স চল্লিশের কোঠায়। বদলির চাকরি তাঁর। এই কুটিরে আছেন বছর তিনেক হল। তাঁর স্ত্রী রামনগর কলেজে অধ্যাপনা করেন। সেখানেই বাসা ভাড়া নিয়েছেন। মেয়ে এইচ এস পাশ করেছে সবে। তাকে নৈনিতালে রেখে পড়াবেন। নৈনিতালে তাদের নিজস্ব বাড়ি আছে। আপাতত ভাড়া দেওয়া আছে। ছেলে পড়ছে দশম শ্রেণিতে। রামনগরেই। ছুটি পেলে দু-একদিনের জন্য রামনগরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আসেন।
অনতিদূর অতীতের সরকারি সংস্থাগুলির বেহাল অবস্থা মাথায় ছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, - নিগমের আর্থিক অবস্থা কেমন – লাভ হয়?
--হয় মানে! রীতিমতো লাভজনক সংস্থা কুমায়ুন বিকাশ নিগম। শুধু তো বনদপ্তরের কিচেন চালানো নয়, এটা না হয় এখন একচেটিয়া ব্যাবসা, কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কিন্তু এর বাইরেও বহু ধরনের ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও লাভ করে চলেছে নিগম। পেট্রোল পাম্প, গ্যাস স্টেশন, হোটেল – সব ব্যাবসাই রমরম করে চলছে।
বলা বাহুল্য আমাদের কথোপকথন চলছিল হিন্দিতেই। এই ভাষায় আমার অপটুতা সত্ত্বেও মহেন্দ্রর কোনো অসুবিধে দেখলাম না। তিনি যেতেই আমি চত্বরের সেই ছোট গেটের কাছে গিয়ে দেখি ঘাসের উপর পড়ে আছে অজস্র ছোট আকারের পাকা পাকা আমলকি। কয়েকটি কুড়িয়ে নিয়ে মহেন্দ্রকে দেখাতে তিনি বললেন, আমরা এগুলোকে আঁওলা বলি। আপনাদের যাওয়ার সময় একটা ব্যাগ ভর্তি করে দিয়ে দেব। সফরের গাড়ি ফিরে আসতে আমলকিগুলো নিয়ে তাদের দেখালাম। দেখামাত্র টুম্পা একটা নিয়ে গালের মধ্যে চালান করেই তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগল।
একটা ব্যাপার প্রথম দিনে থেকেই খেয়াল করেছি। নিরামিষ পদের মধ্যেই অতিথিদের পাতে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করার আন্তরিক আগ্রহ আছে মহেন্দ্র আর্য-র। সেদিন রাতেই ‘কালি’ ডাল একখানা মিশকালো রঙের কলাইয়ের ডাল পরিবেশন করল ডিনারে। এই কলাই নাকি স্থানীয়ভাবে এখানেই উৎপন্ন হয় স্বল্প পরিমাণে। বাজার পর্যন্ত পৌঁছয় না। খুবই নাকি উপকারী। খেয়ে আমার তো বেশ ভালই লাগল। আমাদের অন্য ক’জন অবশ্য নাসিকা কুঞ্চন করল।
ওসমান আমাদের জিপসি চালু করল। ভরত থেকে গেল। শুভব্রত এখন কাছাকাছি জায়গা খালি পেয়ে নতুন করে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছে। ওসমান গাড়ি চালাতে চালাতে এই বাঘিনির পরিচয় দিল। এনার নাম পেড়ওয়ালি। ইনি প্রায়ই গাছে চড়ে বসেন। আমরা অবশ্য তাকে নদীর জলেও সমান স্বচ্ছন্দ দেখলাম। ইতিমধ্যেই তিনি দুটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন। দুটিই বড় হয়ে গেছে, মানে দুই অতিক্রম করে গেছে। তারা এখন খুব কমই থাকে মায়ের সঙ্গে। মা শিকার করলে ছোটটি এখনও মায়ের শিকারে ভাগ বসায়। তিন পেরোলে মা তাকে স্রেফ তাড়িয়ে দেবে নিজের এলাকা থেকে। আজ বাঘিনিটি এপারের জঙ্গলে একটা সম্বর শিকার করেছে। পেট পুরে খেয়ে নদীর জলে নেমেছে। মাংসঘুম ভালোই জমবে আজ। পাশের এলাকায় যিনি রাজত্বি করেন তিনি এনারই সমবয়সি বোন। তিনি প্রায়ই নদীর পাড়ে ঘোরাঘুরি করেন বলে তাঁর নামকরণ হয়েছে পাড়ওয়ালি। তারও দুটি বাচ্চা, ছোটটির বয়স দুই।
ওসমান পরে জানাল, বাঘটা মোটেই পূর্ণবয়স্ক নয়। দু-বছরের হবে, সম্ভবত পাড়ওয়ালির কনিষ্ঠ পুত্র। এটা তারই এলাকা। আমাদের দুঃখ হল শুভব্রতর কথা ভেবে, বেচারা আলসে বাঘিনির পেছনে বেকার এতটা সময় না দিলে, আরও কত ভালো ছবি পেত বাঘের। আমরা অবশ্য অনেক ছবি তুলেছি, পূজার তোলা ছবি বেশ সুন্দরও হয়েছে, তবে সে কি আর দক্ষ আলোকচিত্রীর ক্যামেরার ছবির সঙ্গে তুলনীয়!
ছটা বাজতে চলেছে। সাড়ে ছটার মধ্যে কুটিরে ফিরতে হবে। ওসমান গতি বাড়িয়েছে। ঠিক তখনই দেখা গেল রাস্তার সামনে এক দল হাতি। রাস্তার ধারের এক সিঁদুর গাছের ডালপালা ভেঙে ভোজ চলছে। থেমে যেতে বাধ্য হল ওসমান। হাতির দলের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ভয়ংকর ঝুঁকির। জঙ্গলের বাঘও তুলনায় নিরাপদ। হাতির মতিগতি আন্দাজ করা অতি দুরূহ। ওসমান মন দিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখে যাচ্ছে। পিছনে, ডাইনে, বামে আরও কিছু জিপসি থেমে আছে। মিনিট দশেক পরে সিঁদুর গাছটি ন্যাড়া হয়ে যেতে হাতির পাল রাস্তারই ধারে কিন্তু একটু ভেতরের দিকে অন্য একটি গাছে মন দিল। সন্ধের আগে তারা ডিনার সেরে নিচ্ছে, অন্ধকার নামলেই বিশ্রামের জায়গা খুঁজে নেবে। ওসমান খুব ধীরে এগোতে লাগল, একটা চোখ নিশ্চয় আছে তাদের গতিবিধির দিকে। আমরাও যে ভয় পাচ্ছি না, তা বলা যাবে না। সাবধানে হাতির দলকে পেরিয়ে গিয়েই পাঁইপাঁই করে দৌড় লাগাল আমাদের জিপসি। পিছনে তাকিয়ে দেখছি অন্য গাড়িগুলিও ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছে।
আমরা কুটিরে পৌঁছে যাওয়ার প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ভরতের গাড়ি ঢুকল সেখানে। তখন প্রায় সাতটা বাজে। তাকিয়ে দেখি টুম্পার কপালে একটা সাদা ফেট্টি বাঁধা। সেটা রক্তে ভিজে গেছে। রক্ত গড়িয়ে নেমেছে ভুরু পর্যন্ত। মহা উত্তেজিত শুভব্রত ভরতের উদ্দেশ্যে বাঘা বাঘা বাক্যবাণ হানতে হানতে টুম্পাকে ধরে নামাল। নিয়ে এসে বারান্দার চেয়ারে বসাল। তারপর নিজের ব্যাগ হাতড়ে তূলা ডেটল মলম ইত্যাদি যা পেল, তাই দিয়ে শুশ্রূষা করতে বসল। মুখে অবিরাম ভর্ৎসনা ভরতের উদ্দেশ্যে। সে বেচারা কাঁচুমাচু মুখে হাত কচলাচ্ছে আর বলছে, কী কী ওষুধপত্র লাগবে লিখে দিন স্যার, আমি যেমন করে হোক ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এনে হাজির করব। ঠিক কেমন করে এই দুর্ঘটনা ঘটল সেটা জিজ্ঞেস করারও সুযোগ দিচ্ছে না শুভব্রত। টুম্পা কিন্তু শান্ত, অবিচল – যেন কিছুই হয়নি তার। শুভব্রত একটা কাগজে ওষুধের এবং ব্যান্ডেজের সরঞ্জামের নাম লিখে দিতেই ভরত সেটা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ছিনিয়ে দৌড় লাগাল তার গাড়ির দিকে। ‘টাকা নিয়ে যাও টাকা নিয়ে যাও’ বলে শুভব্রতর হাঁকডাকে কর্ণপাতও করল না।
ভরত চলে যাওয়ার পর ঘটনার বিবরণ জানা গেল। ফেরার সময় একটা গড়ানের মুখে ভরত আচমকাই দেখে, সামনেই রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা হাতি এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই ভরত সজোরে ব্রেক দাবিয়েছে। পিছনের আসনে বসেছিল টুম্পা আর শুভব্রত। টুম্পার সামনেই ছিল ক্যামেরার স্ট্যান্ডটা, ক্যামেরাটা ততোক্ষণে খুলে নেওয়া হয়েছে। আচমকা ব্রেকের ফলে দুজনেই সামনের দিকে ছিটকে এসেছে। শুভ সামনের হ্যান্ডেলটা ধরে বেগ সামলে নিলেও টুম্পার কপাল সজোরে ধাক্কা খেয়েছে স্ট্যান্ডের সামনে বেরিয়ে থাকা স্ক্রু-তে। কপাল ভালো বলতে হবে যে চোখটা বেঁচে গেছে। বিবরণ শেষ করে শুভ ফের ভরতকে নিয়ে পড়ে, --মাথামোটা ইডিয়েট একটা। নিশ্চয় হাতি নিয়ে একটা ফোবিয়ায় ভোগে। হাতির থেকে অনেকটাই দূরে ছিলাম, ধীরেসুস্থে ব্রেক কষলেই যথেষ্ট ছিল।
ভরত সম্পর্কে শুভর প্রাথমিক উচ্চ ধারণা একেবারেই পালটি খেয়ে গেছে। বিজরানিতে থাকতেই দু-একজন বন-কর্মীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করে ঢিকালা কুটিরে অশোক ও তার জন্য একটা দুই-শয্যার ঘর আগামী মাসের শেষের দিকে এক সপ্তাহের জন্য বুক করে নিয়েছিল সে। এবারে চেষ্টা করেও সেখানে জায়গা পায়নি বলে সেই আক্ষেপ মিটিয়েই নেবে। তাই ঠিক করেছিল রুহিকে বলে ভরতকেই সেই সফরে পাইলট-গাইড-এর দায়িত্ব দেবে। এখন সিদ্ধান্ত বদল করে ওসমানকে নেবে বলে স্থির করল। ওসমানের মাথা অনেক ঠান্ডা, ধীর-স্থির প্রকৃতির ছেলে সে। দুদিন আগেই জঙ্গল সফরে ভরত যে অত্যন্ত জ্ঞানী গাইড এবং ছবি তোলার ব্যাপারেও তার প্রভূত ‘সেন্স’ আছে – এই নিয়ে আমাদের কাছে পঞ্চমুখ ছিল, সে কথা ভেবে আমি হাসি চাপলাম।
যেমন বলেছিল, ঠিক সেই সময়েই ভরত ফিরে এল শুভর লেখা ওষুধ, সরঞ্জাম সমেত। বেশ ভালো করে টুম্পার কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধল শুভ। সে ততোক্ষণে অনেক শান্ত। এরপর চলল ওষুধপত্রের দাম নেওয়া নিয়ে ঝুলোঝুলি। ভরত কিছুতেই টাকা নেবে না, তার নিজের দোষেই দুর্ঘটনা – তার দায় সম্পূর্ণই তার। যদি ওষুধের দামটাও সে দিতে না পারে তাহলে চিরকালের মতো সে অপরাধী হয়ে থাকবে নিজের কাছেই। কিন্তু শুভব্রতর সঙ্গে সে কি পারে! নিতেই হল তাকে। পরের দিন অপরাধীর মন নিয়েই সে ওসমানের সঙ্গে আমাদের পৌঁছে দিল রুহি ম্যাডামের অফিসে। সেখানে একপ্রস্থ বিদায়ের উষ্ণ সম্ভাষণ গ্রহণ করে আমরা দিল্লি রওনা হলাম গাড়িতে।
ভ্রমণকাহিনি এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ফেরার বিমানেও দু-দফা এমন নাটকের শিকার হলাম আমরা যে বিরক্তি লাগলেও সংক্ষেপে সেটি না লিখলে পাঠকরা বিমানযাত্রার টুকিটাকি জ্ঞানলাভ থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রথম নাটক আমদের সঙ্গের জিনিসপত্র চেকিং করতে গিয়ে। শুভর সঙ্গে ছিল ক্যামেরার উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ব্যাটারি-চার্জার। সেটি তুলে নিয়ে চেকিং অফিসার শুভকে একটিও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিমানবন্দরের চিফ সিকিউরিটি অফিসারের কাছে জমা দিয়ে দিলেন। আসার সময় কলকাতা বিমানবন্দরে কিন্তু এটা নিয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করেনি। শুভ ছুটল নিরাপত্তা-প্রধানের কাছে, জিনিসটি খুব দামি, ক্যামেরার জন্য অপরিহার্যও বটে। আমরাও তার সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, শুভ এক কথায় আমাদের প্রস্তাব খারিজ করে দিল। দল পাকিয়ে গেলে উলটো বিপত্তি হবে। শুভ আক্ষরিক অর্থেই হাত জোড় করে তাঁর অনুগ্রহ ভিক্ষা করল। তিনি স্বভাবতই নরম হলেন। ক্যামেরাটা দেখতে চাইলেন, সত্যিই মিনি জেনারেটার-সম সেই চার্জার সেই ক্যামেরার জন্য অপরিহার্য কি-না। বেশ কিছুক্ষণ দেখেশুনে শুভকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে ফিরিয়ে দিলেন সেটি।
দ্বিতীয় নাটক আমাদের বিমানে ওঠার মুহূর্তে। বোর্ডিং পাশ পরীক্ষা করছিলেন যে-মহিলা, তিনি বললেন, আপনারা একপাশে অপেক্ষা করুন, এস চ্যাটার্জি চলে যান এত নম্বর কাউন্টারে, আপনার লাগেজে আপত্তিকর বস্তু পাওয়া গেছে। শুভ ছুটল সেখানে। আমি ভেবে দেখলাম, আমার ব্যাগে দুটো লাইটার আছে, সেগুলোই কি অপরাধী! ঠিক তাই, শুভ ফিরে এসেই বলল, - মামা, আপনি জানেন না – লাগেজে লাইটার রাখা নিষেধ! আমি মিনমিন করে বললাম, আসার সময় লাগেজেই ছিল যে, ধরা পড়েনি তো!
বুড়ো হয়ে মামাকে ভীমরতিতে ধরেছে – মনে মনে ভেবে নিয়ে শুভ ক্ষমাঘেন্না করে আর বাক্যব্যয় করল না বোধহয়। আমরা বিমানে উঠে বসলাম কিন্তু এই নাটকের জের কলকাতায় নেমেও আমাদের ছাড়ল না। সেখানে নেমেছি যখন, তখন মধ্যরাত্রির দিকে ঘড়ির কাঁটা হেলে পড়েছে। কনভেয়ার বেল্টের দিকে তাকিয়ে আছি তো আছিই। সকলের ব্যাগপত্তর চলে এল, আমার সবেধন নীলমণি ছোট স্যুটকেসটি আর শুভর ক্যামেরা স্ট্যান্ড বেপাত্তা। নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে জানাতে তাঁরা একটা ফর্ম ভরতে বললেন। ভরে সইটই করে দেওয়ায় আশ্বাস দিলেন আমার ঠিকানায় তাঁরা দিন দুইয়ের মধ্যে লাগেজ পাঠিয়ে দিবেন। হতাশ আমি সব গেল ধরে নিয়ে স্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ আমার গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
চন্দননগরের পথে আমি যখন মাঝরাস্তায়, অশোকের ফোন – মামা, নাটকের ক্লাইম্যাক্স এইমাত্র সম্পন্ন হলো। আমি আর শুভব্রতই কেবল তার সাক্ষী থাকলাম। সব গুটিয়ে নিয়ে আমরা এই সবে রওনা দিচ্ছি এয়ারপোর্ট থেকে। সব মানে স-ব – তোর হারানো ব্যাগসমেত। মেয়েদের আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শুভব্রতর গাড়িতে। তার একটু পরেই ক্যামেরার স্ট্যান্ড পাওয়া গেল। সেটা নিয়ে আমরা বেরোতে যাব, অফিস থেকে ফোন এল, ব্যাগ পাওয়া গেছে, অফিসে এসে নিয়ে যান। আমরা নিরুদ্দিষ্টের কাউন্টারের কাছেই স্ট্যান্ডটা রেখে ব্যাগ নিতে গেলাম। ফিরে এসে দেখি স্ট্যান্ড উধাও। এদিক ওদিক খোঁজ করছি, কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা লোক সেটা হাতে নিয়ে যাচ্ছে। ধরলাম তাকে। এয়ারপোর্ট-এরই লোক, বলল, এটাকে পড়ে থাকতে দেখে অফিসে জমা দিতে যাচ্ছে। এক দফা হেসে নিয়ে ফের বলল, এবার বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রা দে। আমি শুভব্রতকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাব। তোর ব্যাগ পৌঁছে যাবে সময়মতো।
যাক, গাড়িতেই চোখ বুজলাম একটু। অমনি চোখে ভেসে এল বাঘের হরিদ্রাভ চোখ। অত সামনে থেকে দেখেও তখন একবার আড়চোখে দেখে নেওয়া ছাড়া সেই চোখে চোখ রাখার সাহস হয়নি। শুনেছিলাম, বন্য প্রাণীর চোখে চোখ রাখা খুবই বিপজ্জনক, নিমেষেই সে আক্রমণ করে বসতে পারে। এখন আর সেই ভয় নেই, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বাঘের চোখে চোখ রেখে যাচাই করে নিতে পারি সে-চোখের প্রকৃত রঙ।