শুনুন - যে গল্পটা বলছি সেটা কিন্তু একটা আজগুবি গল্প। তাছাড়া গল্পটা বেশ বিপজ্জনক। আর আমি এটা বলছিও একটা আজগুবি এবং বিপজ্জনক শর্তে। শর্তটা হলো এই যে গল্পটা আপনাকেই শেষ করতে হবে। আর আপনি যদি এই গল্পের শেষটা না করে দিতে পারেন তাহলে হয়তো নিজেই শেষ হয়ে যাবেন এই গল্পের শেষে। কারণ- আমি তো শুরুতেই বললাম এটা একটা আজগুবি এবং বিপজ্জনক গল্প।
বহুকাল আগে তিনটি লোক ছিলো যারা অনেক চেষ্টা করেও জীবনে সফল হতে পারেনি। তারা সবাই ছিলো পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান কিন্তু দুর্ভাগা। এরকম অনেককেই আমাদের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায় যারা তাদের গুণের কদর সারা জীবনেও পায় না। এরাও ছিলো সেই দলেরই লোক। যাদের নিয়ে কোনো গল্প হয় না। তাই এই গল্পটাও এদের নিয়ে নয়। এদের নিয়ে এই গল্পটা শুরু হয়েছে। আর এগিয়ে গেছে খুব আজগুবি ভাবে। তারপর কিন্তু গল্পের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়াবে একটা বিশেষ চরিত্র। আর সেই-ই দাপিয়ে বেড়াবে বাকি গল্পটায়। যদি না শেষটায় আপনি –
শেষের কথা এখন থাক। শুরুর কথাই হোক। শুরুতেই দেখা যাচ্ছে যে এরা তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে। যে দিকে দুচোখ যায় সেদিকে। যদি কোথাও কিছু একটা কাজটাজ জুটে যায়। এইভাবে বহু রাস্তা পার হয়ে ওরা এসে হাজির হলো একটা ঘন জঙ্গলের সামনে। ওই জঙ্গলের ভিতরে ঢুকবে কিনা সেই নিয়ে ওরা যখন ইতস্তত করছে তখনই শুনতে পেল একটা ভরাট গলায় কেউ বলে উঠলো — ‘যা যা - এই জঙ্গলের ভিতরে যা।’ ওরা চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো কোত্থেকে এই কথাগুলো ভেসে আসছে। তখনই ওদের চোখে পড়লো সামনে একটা প্রকাণ্ড গাছের নীচে বসে আছেন এক বিরাট জটাধারী সাধু। ‘এই জঙ্গলের ভিতরে যা - তোরা প্রত্যেকে বিশেষ ক্ষমতা পাবি - তারপর দেখ কী হয়’ - বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। ওরা দেখতে পেল উপর থেকে অজস্ৰ গাছের পাতা ঝরে পড়ছে ওনার উপর। দেখতে দেখতে পাতার স্তূপে সমস্ত জায়গাটা ছেয়ে গেল। আর উনি ওই পাতার স্তূপে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেলেন। ওদের সামনে পড়ে রইলো একটা শুকনো পাতার বিশাল স্তূপ। ওরা শুনতে পেল চারিদিকের ঘন গাছের পাতার ভিতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার শনশনে শব্দ। ওরা ভাবলো এইমাত্র যা ঘটলো তা কি সত্যি না সমস্তটাই সবার মনের ভুল? যাইহোক ওরা আর ভালো মন্দ বিচার না করেই চলতে শুরু করলো ওই ঘন বনের ভিতর দিয়ে।
এইভাবেই এই গল্পটার শুরু। এবার শুনুন গল্পটা কীভাবে ক্রমশ আজগুবি হয়ে উঠছে।
বনের মধ্যে চলতে চলতে ওরা হঠাৎ দেখতে পেল একটা ঘন সবুজ মাঠ। যেখানে একটাও গাছগাছালি নেই। ভোরের নরম আলোয় থিরথির করে কাঁপছে লম্বা সবুজ ঘাসের সারি। এটা দেখামাত্রই ওদের মধ্যে একজনের শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে থরথর করে কেঁপে উঠলো। একটা অদ্ভুত গলায় সে বলে উঠলো – ‘আমি দেখতে পাচ্ছি - স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি - ওই ঘাসের নীচে মাটির তলায় কী আছে।’ অন্য দুজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো - ‘কী আছে? কী আছে?’ ‘কঙ্কাল- একটা আস্ত কঙ্কাল - আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি’ - ধরা ধরা গলায় বলে উঠলো সে। এই লোকটিকে এবার থেকে আমরা ‘অতিদ্রষ্টা’ নামে জানবো।
অন্য দুজন তখন বললো - ‘বেশ - তাহলে ওখানেই মাটি খুঁড়ে দেখা যাক - তোমার কথা সত্যি না মিথ্যে।’ এরপর ওরা দুজনে ওই ঘাসজমি খুঁড়তে শুরু করলো। আর একটু বাদেই ওই মাটির তলা থেকে বের হলো একটা আস্ত মানুষের কঙ্কাল। সঙ্গে সঙ্গে অতিদ্রষ্টা বলে উঠলো - ‘বলেছিলাম কিনা? আমার মধ্যে এই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে যাতে আমি দেখতে পাই এমন কিছু যা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।’
এদিকে ওই কঙ্কালটা দেখেই ওই দুজনের মধ্যে একজনের শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে মুহূর্তের জন্য থরথর করে কেঁপে উঠলো। তারপর একটা অদ্ভুত গলায় বলে উঠলো - ‘আমার ক্ষমতা আরো বেশি।’ অতিদ্রষ্টা বললো - ‘বেশ বেশ। তাহলে সেটা দেখাও দেখি।’ এর উত্তরে ওই লোকটি উপরের আকাশের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে দুহাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো - ‘আমি এই কঙ্কালের উপর এর রক্ত মাংস অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব স্থাপন করছি।’ এই লোকটিকে এবার থেকে আমরা ‘অতিস্রষ্টা’ নামে জানবো।
এদিকে অন্যেরা এইকথা শোনার পরমুহূর্তেই দেখতে পেল ওই কঙ্কাল একটা পূর্ণ দেহের মানুষের আকার পেয়েছে। ওই পূর্ণদেহের মানুষটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় জনের শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে মুহূর্তে জন্য থরথর করে কেঁপে উঠেই যেন পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। আর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো - ‘আমার ক্ষমতা তোমাদের থেকে এতটাই বেশি যা তোমাদের কল্পনার বাইরে।’ অন্যেরা দুজনে বলে উঠলো - ‘প্রমাণ দাও - প্রমাণ দাও।’ তৃতীয় জন চোখ বন্ধ করেই এক আশ্চর্য ফিসফিসে স্বরে বললো - ‘আমি এই মানুষটির শরীরে প্রাণ সঞ্চার করছি।’ এই তৃতীয় জনকে এবার থেকে আমরা ‘অতিজীবক’ বলে জানবো।
ইতিমধ্যে ওই শরীরটি প্রাণ পেয়ে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ হয়ে উঠে বসলো ওদের সামনে। অতিদ্রষ্টা আর অতিস্রষ্টা যেন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সদ্য প্রাণ পাওয়া মানুষটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। খানিকক্ষণ চারিদিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখলো! তারপর পায়ে পায়ে ওই তিনজনের দিকে এগিয়ে এল।
বুঝতে পারছেন তো গল্পটা কীরকম আজগুবি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যাইহোক এই আজগুবি গল্পে যখন ঢুকে পড়েছেন তখন পরের ঘটনাগুলো শুনতে থাকুন।
ওরা তিনজনেই বলে উঠলো - ‘আমরা আপনাকে আমাদের অলৌকিক ক্ষমতায় পুনর্জন্ম দিলাম । কিন্তু আমরা খুবই দুর্ভাগা। আমরা জানি না আপনি কে। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারবেন।’ লোকটি ওদের দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলতে থাকলো - ‘আমি ছিলাম এক বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের অনেক নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলাম। অনেক নতুন যন্ত্র তৈরি হয়েছিলো সেই তত্ত্বের প্রয়োগ করে। মানুষের রোজকার জীবন রাতারাতি বদলে গিয়েছিলো সেই সব যন্ত্রপাতির ব্যবহারে। আমার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু আমার এক আবিষ্কারের কারণেই আমাকে তখনকার রাজা হত্যা করেছিলেন। কারণ এই আবিষ্কারের ফলে তাঁর রাজমহিমা নষ্ট হয়ে যাতে পারতো।’ ওরা তখন বলে উঠলো - ‘আপনাকে আমরা আবার ফিরিয়ে আনলাম। আপনি আবার গবেষণা শুরু করুন। নতুন জিনিস আবিষ্কার করুন। তাহলে নিশ্চয়ই পারবেন আমাদের ভাগ্য বদলে দিতে।’ লোকটি খুব আস্তে করে বললো - ‘আমি তো জ্যোতিষী নই। আমি বিজ্ঞানী। কারো ভাগ্য ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তোমাদের জন্য আমার ক্ষমতায় যেভাবে যতটা করা সম্ভব আমি নিশ্চয়ই করবো। কাল ঠিক এইসময় এখানে এসো। দেখি কী হয়।’ ওরা খুব স্বস্তি পেয়ে চলে গেল। পরদিন ওই সময়ে অর্থাৎ দিনের শুরুতেই ওরা অতি উৎসাহে এসে হাজির হলো ওই ঘাসজমিটার সামনে। ওরা দেখতে পেল লোকটি ওই ঘাসজমিটার উপরে কেমন অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। ওদেরকে দেখে লোকটি চিৎকার করে বলে উঠলো - ‘কেন করলে? কেন করলে তোমরা এমন কাজটা?’ ওরা অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকালো। লক্ষ্য করলো একরাতের মধ্যেই লোকটির চেহারা যেন একেবারে বদলে গেছে। উস্কোখুস্কো চুল। চোখদুটো লাল। যেন বহুকাল খাওয়া হয়নি, ঘুম হয়নি। লোকটি ধরা ধরা গলায় বলে উঠলো - ‘পারবো না। আমি পারবো না আর কিছু করতে। আসলে সময় অনেকটাই পার হয়ে গেছে। নতুন নতুন সব তত্ত্ব এসেছে। আমার সব তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেছে। আমি এই পৃথিবীতে এখন অচল। আমার সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি আজকের দিনে কোথাও কোনো কাজেই লাগবো না আর।’ তারপর খুব কাতর ভাবে সে বললো - ‘কেন এভাবে আমাকে ফিরিয়ে আনলে তোমরা? আমি যেভাবে যেমনটি ছিলাম সেভাবেই থাকতে চাই - বরাবর।’ ওরা অবাক হয়ে দেখলো ওই ব্যক্তিটি আবার একটা কঙ্কালের আকারে বদলে গিয়ে সামনের ঘাসজমির তলায় চলে গেল।
ওরা নিজেদের মধ্যে হা-হুতাশ করতে লাগলো ওদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা প্রয়োগ করে কিছুই লাভ হলো না বলে। তারপর আবার এগিয়ে চলতে লাগলো ওই ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। এর খানিক বাদে ওদের সামনে দেখা গেলো একটা পাথুরে টিলা। যার চারিদিকে নানা ধরনের পাথর ছড়িয়ে ছিলো। মাঝবেলার গনগনে সূর্যের নীচে সেই পাথরগুলো থেকে যেন ধারালো বর্শার মতো আলো ঠিকরাচ্ছিল। অতিদ্রষ্টা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললো - ‘আমি এখানে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখতে পাচ্ছি।’ অন্যেরা বলে উঠলো - ‘কী জিনিস? কোথায় আছে?’ অতিদ্রষ্টা বললো - ‘ওই দূরের পাথরের চাঁইটার নীচে।’ অন্য দুজনে দৌড়ে গিয়ে ওই পাথরের চাঁইটা সরাতেই দেখতে পেল সেখানে পড়ে রয়েছে একটা মানুষের কঙ্কাল। কঙ্কালটা দেখেই অতিস্রষ্টা ঠিক আগের মতোই ওই কঙ্কালটার শরীরে রক্ত মাংস অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থাপন করলো। আর তারপরেই অতিজীবকও আগের বারের মতো ওই দেহটিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলো। এবারে কিন্তু কেউই কারো উপরে আস্ফালন দেখালো না। প্রত্যেকে ঠিক আগের বারের কাজটাই করলো। কিন্তু যা কিছু করলো সবই নিঃশব্দে।
এইবার ওই সদ্য প্রাণ পাওয়া দেহটি আস্তে আস্তে উঠে বসলো। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। এরপর সোজা উঠে দাঁড়িয়ে যেন নিজেকেই বললো - ‘কী আশ্চর্য! এ কী করে সম্ভব?’ ওরা তিনজনে আগের বারের মতোই বলে উঠলো - ‘আমরা আমাদের অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে আপনার আবার নতুন জন্ম দিলাম। আমরা জানি না আপনি কে। কিন্তু আমরা বড়ো দুর্ভাগা। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন।’ লোকটি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো - ‘আমি ছিলাম এক কবি। আমার কবিতা, আমার গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতো। তারা বলতো যে ওই সব কবিতার কথাগুলো, গানের পঙ্ক্তিগুলো তাদের জীবনকে নাকি বদলে দিয়েছে। আর সেই জন্যই আমাকে সেইসময়ের শাসক আমাকে বন্দী করেছিলো। পুড়িয়ে দিয়েছিলো আমার সমস্ত লেখা। আর তারপর এখানেই, ওই টিলার উপর থেকে আমাকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।’ – এই বলে লোকটি চুপ করে গেল। ওরা বলে উঠলো - ‘কিন্তু এখন তো আপনি আবার জীবন ফিরে পেয়েছেন। আবার নতুন করে লিখুন। আমাদের পথ দেখান কী ভাবে আমরা এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে পারবো তার উপায় বলে দিন।’ লোকটি ওদের দিকে তাকিয়ে বললো - ‘আমি তো কারো ভাগ্যবিধাতা নই। আমি শব্দ নিয়ে সুর নিয়ে কাজ করি। সেই কাজ যদি তোমাদের জীবনে কোনো আলো দেখাতে পারে আমি তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু আমাকে একটু সময় দাও। কাল এইসময়ে আমার কাছে এসো।’ এই কথা শুনে ওরা খুব আস্বস্ত হলো। পরদিন দুপুরে ওরা আবার এই টিলাটার কাছে চলে এল। আর দেখতে পেল ওই লোকটি মাথা নীচু করে বসে আছে একটা পাথরের উপরে। যেন একটা পাথরেরই মুর্তি। ওরা পায়ে পায়ে লোকটির খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। লোকটি এবার মাথা তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে খুব কাতর ভাবে বললো - ‘ভালোই করেছো তোমরা। আমাকে এইভাবে ফিরিয়ে এনে। এইভাবে সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে।’ ওরা লোকটির কথার কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। লোকটি আবার বলতে শুরু করলো - ‘সময় অনেক এগিয়ে গেছে। মানুষের ভাবনাচিন্তা অনেক বদলে গেছে। তাদের মুখের ভাষা বদলে গেছে। ভাবের প্রকাশ বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়া ভাষা আর ভাবের জগতে আমার শব্দগুলো কথাগুলো পুরোপুরি অচল। এই সত্যটাকে আমার মেনে নিতেই হবে। এই সময়ে আমার কথায় আমার গানে কারো জীবনে কোনো নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যাবে না আর। তাই আমি ওই পাথরের নীচে যেমন ছিলাম তেমনই থাকতে চাই।’ এই কথা বলার পরমুহূর্তেই ওরা দেখতে পেল লোকটি একটি কঙ্কালে বদলে গিয়ে ওই পাথরের চাঁইয়ের নীচে চলে গেল। ওরা হতবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো। তারপর অতিদ্রষ্টা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো - ‘আমার ক্ষমতা কোনো কাজেই এল না।’ অতিস্রষ্টা বললো - ‘আমারো তাই।’ অতিজীবক বললো - ‘আসলে আমাদের এই অলৌকিক ক্ষমতা আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন করতে পারলো না।’
এরপর ওরা আবার আগের মতোই চলতে শুরু করলো। কারণ ওই জঙ্গলের মধ্যে এ ছাড়া তো ওদের আর কিছুই করার ছিলো না। এইভাবে চলতে চলতে ওদের চোখে পড়লো একটা পোড়ো বাড়ি। বাড়ি না বলে সেটাকে একটা ঘর বলাই ভালো। অতিদ্রষ্টা বললো - ‘আমি আবার একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি। ওই বাড়িটার নীচে।’ অন্য দুজনে ক্লান্তস্বরে বললো - ‘তাহলে কি খুঁড়ে দেখবো একবার?’ অতিদ্রষ্টা নিরুৎসাহে বললো - ‘আমার আর কোনো আগ্রহ নেই।’ অতিস্রষ্টা বললো - ‘আমারও নেই। কিন্তু কিছুই তো করার নেই। তাই -’ অতিজীবক বললো - ‘হ্যাঁ। আমারও তাই মনে হয়। এখানে আর কী বা করবো। চলো যাই। খুঁড়ে ফেলি। কিন্তু কিছু আশা আর করবো না।’ অতিদ্রষ্টা বললো - ‘এরপর কিন্তু আমরা ফিরে যাবো।’ অতিস্রষ্টা বললো - ‘হ্যাঁ। যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই।’ অতিজীবক বললো - ‘ফিরে যাবো ওই গাছটার কাছে। যেখানে ওই সাধুবাবা বসেছিলেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করবো কেন এমন করলেন আমাদের সঙ্গে।’ এরপর ওরা যেন আনমনেই জায়গাটা খুঁড়তে লাগলো। একটু পরেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল একটা মানুষের কঙ্কাল। অতিদ্রষ্টা সেদিকে ফিরেও তাকালো না। অতিস্রষ্টা যেন অভ্যাসবশতই ওই কঙ্কালের দেহে রক্ত মাংস অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থাপন করলো। সেও তাকালো না এরপর ওই দেহটার দিকে। সবশেষে অতিজীবক চোখ বুজে ওই দেহে প্রাণের সঞ্চার করলো। এরপর ওরা ওখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরলো। কেউই তাকিয়ে দেখলো না যে কে আবার জীবিত হলো ওদের এই আশ্চর্য ক্ষমতায়। হঠাৎ ওরা শুনতে পেলো একটা জোরালো গলার আওয়াজ - ‘আরে কোথায় চললে? কোথায় চললে তোমরা?’ ওরা অবাক হয়ে দেখলো ওই সদ্য প্রাণ পাওয়া লোকটিই বলছে এই কথাগুলো। ‘আমি আবার বেঁচে ফিরলাম। আমি জানতাম। আমি জানতাম। আমাকে কেউ কখনো চিরকাল দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ - এই কথাগুলো বলে সে আকাশের দিকে তার হাতদুটো মুঠি করে ঝাঁকিয়ে বললো - ‘আমি সেটা করে দেখিয়ে দিলাম।’ এই কথাগুলো শুনে ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এরপর অতিদ্রষ্টা বললো –‘তুমি তো ওখানে ওই বাড়িটার নীচে মরে কঙ্কাল হয়ে পড়েছিলে। আমরা আমাদের অলৌকিক ক্ষমতায় তোমাকে ফের জীবিত করলাম।’ লোকটি থতমত খেয়ে ওদের দিকে তাকালো। এবার অতিস্রষ্টা বললো - ‘আমার এই বন্ধু তার আশ্চর্য ক্ষমতায় তোমার কঙ্কালটা মাটির নীচে দেখতে পেয়েছে। আমি সেই কঙ্কালের উপর রক্ত মাংস অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থাপন করেছি। আর আমার অন্য বন্ধুটি তোমার ওই মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করেছে।’ লোকটি অতিস্রষ্টার কথায় হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো। এবার অতিজীবক বললো - ‘এতে তোমার কোনো কৃতিত্ব নেই।’ এই বলে ওরা আবার ওদের ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করলো। লোকটি কথাগুলো শুনে কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপর হৈহৈ করে বলে উঠলো - ‘আরে চললে কোথায়? আমার কথাটা তো শোনো।’ ওরা বললো - ‘আমরা ফিরে যাচ্ছি যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই। সেখানে এক সাধুবাবা আমাদের এই অলৌকিক ক্ষমতাগুলি দিয়েছিলেন। যাতে আমাদের ভাগ্য বদলে যায়। কিন্তু কিছুই হলো না। আমরা যেমন দুর্ভাগা ছিলাম তেমনই রয়ে গেলাম। তাই যেখান থেকে রওনা হয়েছিলাম সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।’ এই কথাগুলো শুনে লোকটি বললো - ‘দাঁড়াও। তোমরা এইভাবে আমার সামনে থেকে চলে যেতে পারো না। আমাকে তোমরা পুনর্জন্ম দিয়েছো। আমি তো অকৃতজ্ঞ হতে পারি না। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তোমাদের ভাগ্য আমি বদলে দেবোই।’ বলতে বলতে নিজের বাঁহাতের তালুতে ডানহাত দিয়ে একটা ঘুষি মারলো ওই লোকটা। ওরা অবাক হয়ে ওই লোকটির দিকে তাকালো। অতিদ্রষ্টা বললো - ‘সত্যি বলছো?’ অতিস্রষ্টা বললো - ‘তোমাকে আমরা বিশ্বাস করবো তো?’ অতিজীবক বললো – ‘আসলে আমরা এর আগে এইভাবে দুজনের পুনর্জন্ম দিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা কেউই আমাদের জন্যে কিচ্ছু করতে পারলো না। আমাদের যে দুর্দশা ছিলো তা রয়েই গেলো। আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন হলো না।’ এই কথাগুলো শুনে ওই লোকটি ওদের দিকে তাকিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বললো - ‘আমি জানি না তোমরা কাদের পুনর্জন্ম দিয়েছিলে, কিন্তু আমি ওদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমার পরিচয় জেনে রাখো। আমি ছিলাম এক বিখ্যাত কূটনীতিবিদ। তারপর হয়েছিলাম এই অঞ্চলের শাসক। বহুকাল শাসন করেছি এই অঞ্চলে। ওরা আমার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত না করতে পেরে এক নোংরা ষড়যন্ত্র করে আমায় বন্দী করার চেষ্টা করে। আমি আমার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরদের নিয়ে পালিয়ে আসি আমার রাজধানী রাজত্ব সব ছেড়ে। এই বাড়িতে এই ঘরে আমি লুকিয়ে ছিলাম। সুযোগের অপেক্ষায়। যখন আমি পাল্টা আক্রমণ করতে পারবো। কিন্তু আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষটা আমার সঙ্গে বেইমানি করে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। ওরা এসে এই বাড়িটা ঘিরে ধরে। তারপর আমাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করে।’ অতিদ্রষ্টা জিজ্ঞেস করলো – ‘ওরা মানে কারা?’ লোকটি গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো - ‘ওরা আমার বিরোধী পক্ষ।’ অতিস্রষ্টা জিজ্ঞেস করলো - ‘কিন্তু ওরা তোমাকে এইভাবে মারলো কেন?’ লোকটি আরো গম্ভীর ভাবে বললো - ‘কারণ ওরা জানতে পেরেছিলো যে আমি থাকলে ওদের মহাবিপদ।’ অতিজীবক বললো - ‘সে যাই হোক - তুমি আমাদের পিছু ডাকলে কেন?’ এই কথার উত্তরে লোকটি এবার একে একে ওদের তিনজনের মুখের দিকেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো - ‘ঠিক এই কথাটাই আমি তোমাদের বলতে যাচ্ছিলাম। তোমাদের এত প্রতিভা অথচ কী অবহেলায় জীবন কাটাচ্ছো। এটা তো হতে পারে না। আমার রাজত্বে এসব হতো না। তাহলে আমি তোমাদের এই দুর্দশা দেখেই বুঝতে পারছি তোমাদের মতো মানুষরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছে। তাদের আমাকে প্রয়োজন আছে। তাদের মাথা উঁচু করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্যে। তাদের সামাজিক সুরক্ষার জন্যে। তাদের এই কষ্টকর জীবন বদলে দেওয়ার জন্যে। আর তাই আমি আবার ফিরে এসেছি। আমার নাম মায়ামোহন। অত সহজে আমাকে দাবিয়ে রাখা যায় না।’ ওরা এসব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটি এবার অতিজীবকের কাছে এসে খুব নরম গলায় বললো - ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি তোমাদের জীবন বদলে দেবো।’ ওরা সবাই তখন বলে উঠলো - ‘দেবে? সত্যি সত্যিই আমাদের জীবন বদলে দেবে? তাহলে আমাদের আর ফিরত যাওয়ার দরকার নেই।’ এইকথা শুনে ওই লোকটি যাকে এবার থেকে আমরা মায়ামোহন বলে জানাবো, সে ওদের সবার মুখের দিকে খুব গভীর ভাবে তাকালো। আরো গভীর কন্ঠে বললো - ‘না। যাবে। অবশ্যই ফিরে যাবে। ওই সাধুবাবার কাছে।’ ওরা বললো - ‘কেন? তুমি তো বললে যে তুমি আমাদের জীবন বদলে দেবে। তাহলে আর সাধুবাবার কাছে যাবো কেন?’ মায়ামোহন এবার খুব কোমল গলায় বললো - ‘সাধুবাবার কাছে তো যেতেই হবে।’ এবার অতিদ্রষ্টা বললো - ‘কিন্তু কেন যাবো?’ এবার মায়ামোহন অতিদ্রষ্টার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত দিয়ে বললো - ‘এখন তো আমি নিঃস্ব। কারণ আমার কোনো ক্ষমতা নেই।’ এরপর অতিস্রষ্টার সামনে এসে তার হাতদুটো ধরে বললো - ‘তোমরা আমাকে আমার ক্ষমতাটা ফিরে পাওয়ার বন্দোবস্ত করো। তারপর দেখো কী হয়।’ অতিস্রষ্টা উত্তর দিলো - ‘আমরা তোমার ক্ষমতা কী করে ফেরত পাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারবো? আমাদের নিজেদের কী করে দিন চলে তার ঠিক নেই।’ মায়ামোহন অতিজীবকের একেবারে মুখোমুখি এসে খুব আস্তে করে বললো - ‘না না। তোমরাই পারবে।’ অতিজীবক বললো - ‘আমরা তোমাকে পুনর্জন্ম দিয়েছি। এরপর তো আমাদের আর কিছু করার নেই। তাছাড়া আমরা অনেক দিন ধরে খুব কষ্টে আছি - সাধুবাবার দেওয়া ক্ষমতায় আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাই ফিরে যাচ্ছি ওনার সন্ধানে। এই অবস্থায় আমরা তোমার জন্যে তো কিছুই করতে পারবো না।’ লোকটি এবার খুব গাঢ় কন্ঠে বলে উঠলো - ‘পারবে। পারবে। তোমরা সাধুবাবার কাছে অবশ্যই যাবে। উনি তোমাদের খুব ভালোবাসেন। ওনার কাছ থেকে জেনে আসবে আমি কী করে ক্ষমতা ফিরে পাবো। আর আমি ক্ষমতায় এলেই - তোমাদের তো আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েইছি - যা এর আগে কেউ তোমাদের দেয়নি। জেনে রেখো সাধুবাবা তোমাদের জীবন বদলে দেবেন। কিন্তু তা আমার মাধ্যমে।’ ওরা এই কথাগুলো শুনে চুপ করে রইলো। মায়ামোহন বললো - ‘আর ভাবনাচিন্তা কোরো না। আর দেরি কোরো না। যাও। কী ভাবে আমি ক্ষমতা ফিরে পাবো সেটা জেনে এসো। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। কারণ তোমাদের কাছে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ এই বলে মায়ামোহন ওর ডান হাতটা মুঠো করে ঝাঁকিয়ে নিলো। ওরা এই কথাগুলো শুনে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো যে এই মায়ামোহনের কথায় কিন্তু একটা আলাদা জোর আছে। আগের দুজনের পুনর্জন্ম দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। ওই বিজ্ঞানী আর কবি কেউই আর নতুন জীবনে ফিরে আসতে চাননি। ওনারা নিজেদের বাতিল মনে করে আবার মাটির তলায় চলে গেলেন। কিন্তু এই মায়ামোহন যিনি শাসক ছিলেন তিনি কিন্তু একেবারেই অন্য ধাতের মানুষ। উনিই একমাত্র যিনি সোচ্চারে বললেন - আমি আবার ফিরছি। তাছাড়া উনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আমাদের জীবন বদলে দেবেন। তাহলে এখুনি ওই সাধুবাবার কাছে গিয়ে লোকটার ক্ষমতা কী করে ফেরত পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই করা উচিত।
এরপর ওরা অনেক পরিশ্রম করে ফিরে এলো ঠিক সেই জায়গায় যেখানে তারা ওই সাধুবাবার দর্শন পেয়েছিলো। ওরা দেখতে পেল সেই বিরাট গাছটাকে আর তার তলায় চোখ বুজিয়ে বসে থাকা সাধুবাবাকে। ওরা এইবার সাধুবাবাকে প্রথমে বিজ্ঞানীর ঘটনাটা বললো। তারপর কবির ঘটনাটা বললো। এরপর বললো মায়ামোহনের ঘটনাটা। সবশেষে বললো মায়ামোহনের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার বিষয়টা। সাধুবাবা সব শুনে বললেন - ‘দ্যাখো একজন বিজ্ঞানী নতুন জীবনে ফিরে আসতে চাইলেন না কারণ তিনি মনে করলেন বিজ্ঞান এত এগিয়ে গেছে যে তিনি এখন আর গ্রহণীয় নন। একজন কবি নতুন জীবনে ফিরে আসতে চাইলেন না কারণ তিনি মনে করলেন মানুষের ভাষা- ভাবনা-ভঙ্গিমা এত বদলে গেছে যে তিনি এখন আর পূজনীয় নন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ, শাসক অবশ্যই ফিরে আসতে চাইছেন তাঁর পুরোনো ক্ষমতায়। কারণ তিনি মনে করছেন তিনিই হবেন মানুষের দুঃখ কষ্টের ত্রাতা। তাই না?’ ওরা বললো - ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঠিক তাই।’ এরপর সাধুবাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন - ‘তোমরা একটা শাসকের পুনর্জন্ম দিয়ে তার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য আমায় অনুরোধ করছো কেন?’ ওরা বললো - ‘উনি যে বলেছেন আমাদের জীবন বদলে দেবেন।’ সাধুবাবা বললেন - ‘উনি তোমাদের জীবন বদলে দেবেন?’ ওরা বললো – ‘হ্যাঁ। উনি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন আমরা যদি ওনাকে ওনার হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উপায় বলে দিতে পারি তাহলে আমরা যা চাইবো সব পাবো ওনার থেকে।’ এইকথা শুনে সাধুবাবা মৃদু হেসে বললেন - ‘প্রাপ্তি তো তোমাদের হবেই। একজন শাসকের পুনর্জন্ম দিয়েছো যখন। যাইহোক। তোমরা এখন ফিরে যাও। যেখান থেকে এসেছিলে সেখানেই। সেখানে গিয়ে ভালো করে দ্যাখো - ওই শাসকের ক্ষমতা ওখানেই কীভাবে পড়ে আছে।’ এইকথা বলার সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে অসংখ্য পাতা ঝরে পড়তে লাগলো ওই সাধুবাবার শরীরের উপরে। দেখতে দেখতে ওনার শরীরটা পুরোপুরি ঢেকে গেল শুকনো পাতার স্তূপে। ওরা অবাক হয়ে দেখলো ঠিক প্রথম বারের মতো ওদের সামনে একটা বিরাট শুকনো পাতার স্তূপ। চারিদিকে কেউ কোত্থাও নেই। শুধু শনশন করে হাওয়া বইছে চারিদিকে। ওদের আবার মনে হলো যা ঘটলো তা কি সত্যি না ওদের মনের কল্পনা! কিন্তু ওরা আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সেই পোড়ো বাড়িটার দিকে আবার রওনা দিলো। মায়ামোহন ওদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। ওরা ফিরে আসতেই মায়ামোহন বললো - ‘কী বললেন সাধুবাবা?’ ওরা বললো - ‘উনি বলেছেন ক্ষমতা এখানেই আছে। তাকে খুঁজে নিতে হবে।’ মায়ামোহন লাফিয়ে উঠে বললো - ‘এখানেই? কোথায়? খোঁজো এক্ষুনি।’ ওরা বললো- ‘চেষ্টা করছি।’ এর পরমুহূর্তেই অতিদ্রষ্টার শরীরে যেন কেমন একটা বিদ্যুতের ঝিলিক বয়ে গেলো। সে থরথর করে কেঁপে উঠলো। তারপর কেমন একটা অদ্ভুত স্বরে বলে উঠলো - ‘ওই ঘরের পিছনে উঠোনের নীচে - আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’ অন্যদুজন ওই কথা শুনে দুদ্দাড় করে দৌড়লো ওই জায়গায়। তারপর খুঁড়তে লাগলো ওই উঠোনটা। আর একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো একটা বিশাল কঙ্কাল। অবশ্যই সেটা কোনো মানুষের নয়। কোনো বিরাট চতুষ্পদের। ওই কঙ্কালটাকে দেখামাত্রই অতিস্রষ্টার শরীরে যেন একটা বিদ্যুতের ঝিলিক বয়ে গেলো। ও অদ্ভুত স্বরে বললো - ‘আমি এই কঙ্কালটার শরীরে রক্ত মাংস অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থাপন করছি। এই কথা বলার পরেই দেখা গেলো একটা বিরাট বাঘের দেহ পড়ে আছে ওই উঠোনে। ওই বাঘের দেহটি দেখামাত্রই অতিজীবকের শরীরে যেন একটা বিদ্যুতের ঝিলিক বয়ে গেলো।’ ও অদ্ভুত স্বরে বললো - ‘আমি এর দেহে প্রাণ সঞ্চার করছি।’ মায়ামোহন এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিলো ওদের কাণ্ডকারখানা। এবার সে আঁতকে উঠে বলতে গেলো - ‘এ কী করছো! এ কী ভয়ঙ্কর কাজ করতে চলেছো তোমরা।’ কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। ওই প্রকাণ্ড বাঘটি প্রাণ পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং চারদিক কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর একটা হুংকার দিয়েছে। ওরা তিনজন পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো। ওদের মনে হচ্ছিলো এরপর আরো কী ভয়ানক পরিণতি আছে ওদের কপালে। কিন্তু বাঘটি ওদের দিকে ফিরেও তাকালো না। সে গুটিগুটি এগিয়ে গেলো মায়ামোহনের দিকে। মায়ামোহন ভয়ে কাঁপতে লাগলো। বাঘটি খুব ধীরে ধীরে মায়ামোহনের দিকে এগিয়ে এসে তার পায়ের সামনে এসে বসলো। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো মায়ামোহনের দিকে। যেন সে মায়ামোহনের কতকালের পোষ্য। মায়ামোহন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো বাঘটির দিকে। কয়েক মুহূর্তের পর বাঘটি তার ডান থাবাটি দিয়ে মায়ামোহনের হাঁটুটা আস্তে করে ছুঁলো। যেন পরম যত্নে সে ডাকছে মায়ামোহনকে। মায়ামোহন খুব ভয়ে ভয়ে বাঘটির মাথায় হাত ছোঁয়ালো। বাঘটি চোখ বন্ধ করে ঘড়ঘড় করে শব্দ করতে লাগলো। ঠিক একটা পোষা বেড়ালের মতো। যেন কত আদর পাচ্ছে সে মায়ামোহনের কাছ থেকে। মায়ামোহনও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে লাফিয়ে বাঘটার পিঠে উঠে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটিও যেন পিঠ বেঁকিয়ে তাকে তুলে নিলো। এরপর মায়ামোহন দুহাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে বলে উঠলো – ‘পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি! আমার ক্ষমতা।’ বাঘটিও যেন মায়ামোহনের কথায় সায় দিয়ে একটা বিরাট হুংকার দিয়ে উঠলো। এরপর একটা প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে চলে গেল ঘন বনের মধ্যে। ওরা তিনজন অবাক হয়ে নিজেদের ভিতরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তারপর বললো - ‘তাহলে এই বাঘটিই মায়ামোহনের সেই ক্ষমতা?’
শুনলেন তো? শুনলেন তো মন দিয়ে? এই হলো গল্পের শুরুটা। খুব আজগুবি মনে হচ্ছে তাই না? এইবার গল্পটা কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা শুনুন। আর এটাই বেশ বিপজ্জনক।
ওই বাঘের পিঠে চড়ে মায়ামোহন তো হৈ হৈ করে পার হয়ে যেতে লাগলো একের পর এক গ্রাম গঞ্জ লোকালয়। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে থাকলো তাকে। আর বলতে লাগলো - ‘বাপরে! কী ক্ষমতা!’ আর মায়ামোহন তো এটাই চেয়েছিলো। লোকে যাতে তাকে দূর থেকে দেখেই টের পায় তার ক্ষমতার দৌড়টা। কিন্তু সে এটাও ভাবলো যে এইভাবে মানুষের থেকে দূরে থাকলে তো হবে না। তাকে মানুষের কাছে যেতে হবে। এইজন্য সে এবারে ওই বাঘের পিঠে চড়ে এক লোকালয়ে ঢুকলো। কিন্তু সবাই তাকে ওইভাবে দেখে দুদ্দাড় করে পালাতে লাগলো। মায়ামোহন তাদের উদ্দেশ্য করে বললো - ‘শোনো শোনো আমার মা বোনেরা আমার ভাই দাদারা -আমার কথাটা শোনো - আমাকে দেখে তোমাদের ওইভাবে পালাতে হবে না। তোমরা জেনে রাখো এখন থেকে আমি তোমাদের সব দায়িত্ব নিলাম। তোমরা আমার কথামতো চলো। আমি তোমাদের জীবন বদলে দেবো। তোমাদের সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করার দায়িত্ব আমার। তোমাদের সুরক্ষার দায়িত্ব আমার। তোমরা কেবল আমার কথা শুনে চলো। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যদি কেউ দুষ্টু লোকেদের পাল্লায় পড়ে আমার কথা না শোনে তাদেরকে কিন্তু আমি কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবো না। বুঝেছো?’ - কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে চারিদিক কাঁপিয়ে বাঘটা হুংকার দিয়ে উঠলো। যারা দাঁড়িয়ে শুনছিলো মায়ামোহনের কথাগুলো তারা চমকে উঠলো সেই আওয়াজে। তারা মায়ামোহনের এইসব কথা কী বুঝলো কে জানে। কিন্তু তার কথার উত্তরে কেউ কিছু বলতে সাহস করলো না।
এরপর থেকেই শুরু হলো মায়ামোহনের নতুন শাসনকাল। ব্যাপারটা মায়ামোহন যেমনটি বলেছিলো তেমন হলো না কিন্তু। ওই ভয়ঙ্কর বাঘের পিঠে চড়ে মায়ামোহন চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াতো। তার বেশ কিছু অনুচর জুটে গেল। তারা মায়ামোহনের নামে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াতো। কারো কোনো হিম্মত ছিলো না তাদেরকে বাধা দেওয়ার। কারণ তারা মায়ামোহনের লোক। এইভাবে বেশ কিছুকাল কেটে গেল। মায়ামোহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো আরো আরো নতুন নতুন জায়গায়। এসবের মূলে ছিলো তার ওই প্রকাণ্ড বাঘটা। অর্থাৎ তার ক্ষমতা। যার পিঠে চড়ে সে দিগবিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো। এইভাবে চারিদিকে দাপট দেখাতে দেখাতে মায়ামোহন তো ভুলেই গেছে ওই তিনজনের কথা। যাদের জন্যে সে আবার পুনর্জন্ম পেয়েছিলো। আর পেয়েছিলো এই বাঘটা অর্থাৎ তার হারিয়ে যাওয়া ক্ষমতা। কিন্তু ওই তিনজন তো ভোলেনি মায়ামোহনের কথা। তার প্রতিশ্রুতির কথা। কারণ ওদের জীবনে তো কোনো পরিবর্তন আসেনি। ওদের একই রকম দুর্দশায় দিন কাটছিলো। তাই ওরা ঠিক করলো মায়ামোহনের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে মায়ামোহন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তার কী হলো। এতদিন তো কেটে গেল। এইবার তারা নিজেদের প্রাপ্য চেয়ে নেবে মায়ামোহনের থেকে। এইসব ভেবেচিন্তে ওরা তিনজনে একসঙ্গে মায়ামোহনের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিলো না। কারণ মায়ামোহন বাস করে এক বিরাট প্রাসাদে। লোকালয় থেকে অনেক দূরে। সেখানে যাওয়া অত সোজা নয়। তাছাড়া সেই প্রাসাদের চারিদিকে তার নিজের লোকজন। তাদের রাজি করিয়ে মায়ামোহনের কাছে হাজির হওয়া খুব শক্ত ব্যাপার। যাইহোক ওরা অতি কষ্টে পৌঁছতে পারলো মায়ামোহনের সামনে। দেখলো মায়ামোহন বসে আছে একটা বিরাট সিংহাসনে। আর তার পায়ের কাছে বসে আছে সেই প্রকাণ্ড বাঘটা। ওদের দেখে মায়ামোহন যেন চিনতেই পারলেন না। সেইমুহূর্তে ওদের মনে হলো - এই দুজনেই কঙ্কাল হয়ে মাটির তলায় পড়েছিলো কিছুকাল আগেই - ওরাই এদেরকে পুনর্জন্ম দিয়েছিলো। ঠিক তখনই মায়ামোহন হৈহৈ করে বলে উঠলো - ‘আরে তোমরা যে! আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। আসলে অনেকের কথা সবসময়েই ভাবতে হয় তো কতদিন পরে আবার দেখা হলো তোমাদের সঙ্গে। তা তোমরা ভালো আছো তো?’ মায়ামোহনের কথার উত্তরে ওরা গম্ভীরভাবে বললো - ‘নাহ্। ভালো আর কোথায় আছি।’ তারপর মায়ামোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা কেন কে জানে ওকে ‘আপনি’ করে বলতে থাকলো। এর আগে তো মায়ামোহনকে ‘তুমি’ করে বলতো ওরা। যাইহোক। ওরা বললো - ‘আপনি বলেছিলেন ক্ষমতা পেলে আমরা যা চাইবো তাই দেবেন - আমাদের জীবন বদলে দেবেন। আমরা তো আপনাকে আপনার হারানো ক্ষমতা পাইয়ে দিয়েছি। অনেক দিন হয়ে গেল কিন্তু -’ কথাটা শুনেই মায়ামোহনের চোখদুটো মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠলো। মায়ামোহন হাত তুলে ইশারায় ওদেরকে চুপ করতে বললেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন –‘হ্যাঁ আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ক্ষমতা পেলে তোমাদের জীবন বদলে দেবো।আর এই হলো আমার ক্ষমতা। আমার বড়ো আদরের ক্ষমতা। ওকে আমি ক্ষমতাদেবী বলে ডাকি।’ এই বলে ওই বাঘটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সে। আর বাঘটাও ঘড়ঘড় করে পোষা বেড়ালের মতো আদুরে আওয়াজ করতে লাগলো।মায়ামোহন বলে যেতে লাগলো - ‘এর জন্যই মানুষজন আমাকে এত ভয় পায়। আবার ভক্তিও করে। আসলে ওইসব মানুষরাই তো আমার আপনজন।’ তারপর খুব নরম গলায় বললেন - ‘যাও তো ক্ষমতাদেবী - ওদের জীবনটা বদলে দাও তো।’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা ভয়ঙ্কর হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়লো ওদের উপর। তারপর ওদের তিনজনকেই টুকরো টুকরো করে দিলো। চারিদিক রক্তে ভেসে যেতে লাগলো। সেই রক্তের ধারা ভেসে গেলো বহুদূর। যা শেষ পর্যন্ত এসে থামলো ওই সাধুবাবার পা স্পর্শ করে। সাধুবাবা চমকে উঠলেন সেই রক্তের স্পর্শে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন - ‘জানতাম। তখনই জানতাম। কী পরিণতি হবে ওদের। যখন ওরা একজন শাসকের পুনর্জন্ম দিলো।’ এদিকে মায়ামোহনও ওদের খণ্ড খণ্ড দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে খুব আস্তে করে বললো - ‘এইবার ওদের জীবন বদলে গেল।’ মায়ামোহন তার সিংহাসন থেকে উঠে পড়লো। গড়িয়ে যাওয়া রক্তের ধারার দিকে তাকিয়ে বললো - ‘সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে এই তিনজন কী ভাবে আত্মহত্যা করলো ভয়ানক মানসিক অবসাদে।’
শুনলেন? গল্পটাকে এবার বেশ বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে তো। এইবার শুনুন এরপরে যা যা ঘটলো।
পরদিন মায়ামোহন ঘোষণা করে দিলেন যে তাঁর রাজত্বে কেউ যেন মনের কষ্টে না থাকে। সবাইকে খুশি হয়ে থাকতে হবে। ফুর্তিতে থাকতে হবে। এরজন্য যা খরচপাতি লাগবে তা মায়ামোহন দেবে। কিন্তু মানুষজনের জীবনে অবসাদ নয় আনন্দ চাই। মন খারাপ করে নয় খুশি হয়ে থাকা চাই - সারাবছর ধরে। এদিকে আরো একজন কিন্তু মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেল। সে হলো ওই প্রকাণ্ড বাঘটা। সবার চোখের আড়ালে এমনকি মায়ামোহনও লক্ষ্য করেনি যে বাঘটা ওদের তিনজনকে মারার পর ওদের রক্তটা একটু চেটেছিলো। এর আগে কখনো সে মানুষের রক্তের স্বাদ পায়নি। এইবার প্রথম পেল। স্বাদটা বেশ ভালোই লাগলো তার। বেশ খুশি হলো সে এই রক্তের স্বাদ পেয়ে।
=
লক্ষ্য করুন এইখান থেকেই কীভাবে গল্পটা অন্য ভাবে, অন্যদিকে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
পরদিন সকালে মায়ামোহন সেই বাঘের অর্থাৎ তার আদরের ‘ক্ষমতাদেবীর’ পিঠে চড়ে যাচ্ছিলো নিয়মমাফিক। তার রাজত্বের জায়গাগুলোতে। হঠাৎ কী মনে করে বাঘটা দিলো এক পেল্লায় লাফ। তারপর তীরবেগে দৌঁড়তে লাগলো। দৌঁড়তে দৌঁড়তে পৌঁছে গেল এক গভীর জঙ্গলে। মায়ামোহন খুব অবাক হলো। কারণ তার আদরের ক্ষমতাদেবী তো কখনো করে না এরকম। সে এক পাও নড়ে না মায়ামোহনের ইঙ্গিত ছাড়া। এখন হঠাৎ কী হলো? বাঘটা হাঁফাতে হাঁফাতে একটা বিরাট ঘাসজমির ভিতরে এসে দাঁড়ালো। মায়ামোহন তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে খুব নরম গলায় বললো - ‘কী হলো? কী হলো ক্ষমতাদেবী? এইভাবে ছুটে এই গভীর জঙ্গলে চলে এলে কেন?’ এই বলে আবার তার ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অন্যসময় এমন হলে বাঘটা ঘড়ঘড় করে একটা আদুরে আওয়াজ করে। এবার কিন্তু সে ওই আওয়াজ করলো না। আর তা না করে যেন একটু ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলো তার পিঠের সওয়ারটিকে। তারপর তার পাগুলো টানটান করে পিঠটাকে বেঁকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল।
মায়ামোহন খুব অবাক হলো তার এই আচরণে। মনে হলো কী হচ্ছে ব্যাপারটা! এরপর মায়ামোহন কিছু বোঝার আগেই তার প্রিয় ক্ষমতাদেবী অর্থাৎ সেই বাঘটা তার পিঠে একটা প্রবল ঝটকা দিয়ে বিরাট হাঁ করলো। এই ঝটকাটার জন্যে মায়ামোহন আদৌ প্রস্তুত ছিলো না। তার শরীরটা ওই বাঘের পিঠ থেকে প্রায় দুহাত শূন্যে উঠে ঘুরপাক খেয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে অর্থাৎ শূন্যে উঠে যাওযার মুহূর্তে মায়ামোহন দেখতে পেল তার প্রিয় ক্ষমতার ভয়ঙ্কর দাঁতালো হাঁ-মুখটা। তখনই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওই তিনজন দুর্ভাগার টুকরো হয়ে যাওয়া দেহগুলো।
শুনছেন? শুনছেন কী ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌছে গেছে গল্পটা! তাহলে তো বুঝতে পেরে গেছেন এরপর কী ঘটলো। অর্থাৎ -
অর্থাৎ ইহার পর মায়ামোহন ছিটকাইয়া মাটিতে পড়িল তাহার প্রিয় ক্ষমতাদেবীর পিঠ হইতে। ইহার পর সেই ক্ষমতাদেবী বিকট গর্জন করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িলো মায়ামোহনের বুকে। কারণ সে যে রক্তের স্বাদ পাইয়াছে। তাই সে আবার সেই স্বাদটি পাইতে বড়োই আগ্রহী। তাই তার প্রকাণ্ড হাঁমুখটি নামিয়া আসিলো মায়ামোহনের ঘাড়ের উপরে - আর তাহার পর আরেকটি রক্তের ধারা...
না না। এসব কিছুই ঘটলো না। যা ঘটলো তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না মায়ামোহন। সে শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে কী অদ্ভুত ভাবে আবার এসে বসলো তার ওই ক্ষমতাদেবীর পিঠে। আর সেই ক্ষমতাদেবীও যেন তার পিঠটিকে পেতে রেখে দিয়েছিলো মায়ামোহনের জন্যে। মায়ামোহন যখন এইরকম আশ্চর্য ভাবে ওই বাঘটির পিঠে এসে বসলো তখন তার মনে হচ্ছিলো এ কি সত্যিই সম্ভব? এই ভাবে বাঘের পিঠের ঝাঁকুনি খেয়ে ঠিকরে উঠে শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ফের এসে বসা সম্ভব ওই বাঘটার পিঠেই? না কি সমস্তটাই একটা মৃত্যুর আগের মুহূর্তের একটা প্রহেলিকা?
কিন্তু মায়ামোহন যেই টের পেল একটা অতি পরিচিত ঘড়ঘড়ে আওয়াজ - সে বুঝতে পারলো তার অতি প্রিয় ক্ষমতাদেবী আবার অতি আদরে তাকে পিঠে নিয়েছে। এটা মৃত্যুর আগের মুহূর্তের কোনো ঘোলাটে কল্পনা নয়। বরং পরিষ্কার বাস্তব। তখনই মায়ামোহনের মনে হলো - আসলে এটা ছিলো তার ক্ষমতাদেবীর তার সঙ্গে একটা নতুন আদরের খেলা। এইবার মায়ামোহনকে পিঠে নিয়ে বাঘটি হেলতে দুলতে বেরিয়ে এল সেই জঙ্গলের ভিতর থেকে। মায়ামোহনও আরো জাঁকিয়ে বসলো তার ক্ষমতাদেবীর পিঠে। অর্থাৎ আবার শুরু হলো মায়ামোহনের শাসনের দিন। এবার কিন্তু মায়ামোহন অনেক সতর্ক। বিশেষত তার ক্ষমতাদেবীর আচরণের ব্যাপারে। এইভাবে কেটে গেল আরো কিছুকাল। আবার একদিন হঠাৎ ওই বাঘটি ঠিক আগের ঘটনার মতোই তীরবেগে দৌড়তে দৌড়তে ঢুকে পড়লো এক গভীর জঙ্গলে। মায়ামোহন ভাবলেন - ‘আবার এর মতিগতি এভাবে বদলালো কেন?’ ইতিমধ্যে বাঘটি এসে পড়েছে জঙ্গলের ভিতরে এক বিরাট দীঘির সামনে। দীঘিটার সামনে এসে বাঘটি ঠিক আগের বারের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়ালো। আগের বারের মতোই তার চারটে পা টানটান করে নিয়ে পিঠটাকে বেঁকিয়ে ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ামোহনের বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। সে বেশ বুঝতে পারছিলো এরপর কী ঘটতে চলেছে। বাঘটা কয়েক মুহূর্ত এইভাবে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ একটা হুংকার দিয়ে তার পিঠে একটা ঝটকা দিলো। ঠিক আগের বারের মতো। কিন্তু আগের বারের থেকে এই ঝটকার জোর অনেক কম। তাই মায়ামোহনের শরীরটা বাঘের পিঠ ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠলো বটে কিন্তু তা আগের বারের মতো অতটা উঁচুতে নয়। সেই মুহূর্তে মায়ামোহনের মনে হলো এবারেও যদি আগের বারের মতো কোনোক্রমে - এবং হলোও তাই। মায়ামোহন শূন্যে সামান্য ঘূর্ণিপাক খেয়ে আগের বারের মতো এসে পড়লো ওই বাঘটার পিঠে। আর তখনই বাঘটা যেন একটু ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলো তার সওয়ারকে। মায়ামোহন এইভাবে ফের জীবন ফিরে পেয়ে মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো এই ক্ষমতাদেবী তার বিশেষ অনুগত পোষ্য। অতএব সে কখনোই তাকে এইভাবে পিঠ থেকে ফেলে দিতে পারে না। এটা তার একটা খেলামাত্র। মায়ামোহন তার ক্ষমতাদেবীর ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো - ‘বেশ! বেশ! এটা তোমার একটা খুব পছন্দের একটা খেলা হয়েছে তাই না?’ বাঘটিও আদুরে ঘড়ঘড় আওয়াজ করে যেন মায়ামোহনের কথায় সম্মতি জানালো। তারপর খুব খুশি হয়ে একলাফে দীঘিটা পার হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল জঙ্গলের ভিতর থেকে। লোকালয়ের দিকে। তখন বাঘের পিঠে মায়ামোহন হো হো করে হাসতে লাগলো।
এরপর কেটে গেল আরো কিছুকাল। ক্ষমতার পিঠে মায়ামোহন আরো বেশি করে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো সর্বত্র। আগে মায়ামোহনকে দেখতে মানুষের ঢল নামতো। এখন মানুষজন তার আসার আঁচ পেলেই ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাতে অবস্থা মায়ামোহনের কিছু গেল এল না। বরং সে মনে মনে খুশিই হলো। এতদিনে লোকে বুঝেছে তার দাপট। এইভাবে দিব্যি কেটে যাচ্ছিলো মায়ামোহনের এমন দাপুটে দিনগুলো। হঠাৎ একদিন বিকেলবেলায় যখন দিনের আলো ক্রমশ হলুদ হয়ে আসছে - তখন সেই বাঘটি কী মনে করে তাকালো ওই পড়ন্ত সূর্যের দিকে। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে গেল ওইদিকে তাকিয়ে। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে। মায়ামোহন একটু অবাক হলো তার ক্ষমতাদেবীর এই ব্যবহারে। এবার সেও তাকালো ওই পড়ন্ত সূর্যের দিকে। তারপর তার অতি প্রিয় ক্ষমতাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললো - ‘দ্যাখো দ্যাখো কীভাবে সূর্য ডুবছে - কীভাবে চলে যাচ্ছে অস্তাচলে। একটু বাদেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাবে। কিন্তু ওই অন্ধকারেও আমি আমার ক্ষমতাকে নিয়ে দৌড়ে বেড়াব সর্বত্র। যেখানে আমার খুশি যেমন আমার ইচ্ছে। আমাকে কেউ অস্তাচলে পাঠাতে পারবে না।’ এই বলে মায়ামোহন তার ক্ষমতাদেবীর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলো। সাধারণত এইসময় ওই তার ক্ষমতাদেবী অর্থাৎ ওই বাঘটা খুব খুশি হয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ করে। কিন্তু তখন সেরকম কিছুই হলো না। বাঘটা ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে স্থির হয়ে রইলো। আবার যেন একটা পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে সে। মায়ামোহন বাঘটার এইভাবে হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটার মানে বুঝতে পারলো। আগেও এমন ঘটনা দু দুবার ঘটেছে। মায়ামোহন বিলক্ষণ বুঝতে পারলো কী হতে চলেছে এর পরের মুহূর্তে। সে বুঝতে পারলো এইবার শুরু হবে তার ক্ষমতাদেবীর সেই খেলাটা। হঠাৎ একটা পিঠে ঝটকা মারবে সে। মায়ামোহন সেই ঝটকার ধাক্কায় তার পিঠ থেকে ছিটকে উঠে যাবে উপরের দিকে। শূন্যে ঠিকরে ওঠার সময়ে এক মুহূর্তের জন্য মায়ামোহনের মনে হবে এটাই বোধহয় তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। কিন্তু শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে সে আবার এসে বসবে ওই ক্ষমতাদেবীরই পিঠে। কেমন করে এটা হয় মায়ামোহন তা নিজেও জানে না। কিন্তু এটাই হয়। কারণ এটাই ঘটেছে। এর আগে। দু দুবার। মায়ামোহন এখন নিশ্চিত যে এটা একটা খেলামাত্র। তার ক্ষমতাদেবীর একটা নতুন খেলা। এই ক্ষমতা দেবী তার বড়ো অনুগত। বড়ো আদরের। তাই সে কখনোই মায়ামোহনকে ওই ভাবে পিঠ থেকে ঝাঁকিয়ে ফেলে দেবে না। যতোই তার দিকে বিরাট হাঁমুখ তুলুক কখনোই দাঁত বসাবে না। প্রথম বার সে ভেবেছিলো তার পতন ও মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে ফের বসেছিলো ক্ষমতার পিঠে। তারপর আবার দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছিলো আগের বারের চেয়ে অনেক বেশিমাত্রায়। দ্বিতীয়বার এতটা ভয় না পেয়ে মায়ামোহনের মনে হয়েছিলো কোনোক্রমে যদি এবারেও কপালজোরে বেঁচে যেতে পারি। সেবারেও মায়ামোহন আবার শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে এসে বসেছিলো ক্ষমতার পিঠে। তারপর আরো অনেক বেশি দাপট দেখাচ্ছিল সে। লোকজনকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলো তার কথাই শেষ কথা। তার ইচ্ছেই আইন। নয়তো তার ক্ষমতাদেবীর ভয়ঙ্কর হাঁমুখটা দেখতে হবে লোকজনকে। এইসময় তার মনে হচ্ছিলো এই ভাবে বারবার বেঁচে যাওযার ব্যাপারটা মোটেও কপাল জোরে ঘটেনি। ঘটেছে তার নিজস্ব দক্ষতায়। তার ক্ষমতাদেবী যেমন তাকে নিয়ে খেলছে সেও কিন্তু তাকে নিয়ে খেলছে। আর খেলছে তার দারুণ কৃতিত্বে। এইসব কথাগুলো মনে হচ্ছিলো মায়ামোহনের যখন বাঘটা ওই পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে ছিলো। এইবার মায়ামোহন তার ক্ষমতা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো - ‘নে শুরু আবার শুরু কর তোর ওই খেলাটা। আমি তৈরি আছি। ক্ষমতা তুই আগের মতো পিঠ ঝাঁকিয়ে আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দে। দ্যাখ আমি কীরকম তোর পিঠ থেকে ছিটকে গিয়ে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে তোর পিঠেই জাঁকিয়ে এসে বসি। আর এবারে আমি চাই এটা সবাই দেখুক। দেখুক আমি ক্ষমতাকে নিয়ে কীভাবে খেলা করতে পারি। তারপর শুরু হবে আমার আরেক খেলা। আমার সামনের মানুষজনদের সঙ্গে। অবশ্যই তোকে সঙ্গে নিয়ে। কি রে বুঝছিস তো আমার কথাটা। এবার শুরু কর শুরু কর। দেখতে পাচ্ছিস অনেক লোক জুটে গেছে রে এই খেলাটা দেখতে।’ এই বলে মায়ামোহন আরেকবার তার অতি প্রিয় ক্ষমতাদেবীর গলায় হাত বুলিয়ে দিলো। সেই ক্ষমতাদেবী অর্থাৎ বাঘটি কিন্তু তার অভ্যাস মতো সেই আদুরে ঘড়ঘড়ানিটা আর করলো না। বরং নিঃশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা হেলিয়ে যেন দেখার চেষ্টা করলো তার সওয়ারকে। তারপর একটা প্রকাণ্ড হাঁ করে বিকট হুংকার দিলো। সেই হুংকারের আওয়াজ ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা চারিদিকে অদ্ভুত ভাবে মিশে গেল।
আর এর পরেই সেই বাঘটা একটা বিরাট লাফ দিলো - ওই অন্ধকার ঘনিয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে - আর মায়ামোহন ছিটকে গেল তার ক্ষমতার পিঠ থেকে - শূন্যে - দিন শেষের ঘোলাটে আলোআঁধারিতে । এরপর –
এরপর –
এরপর তো আপনি বলবেন। হ্যাঁ আপনিই। কারণ আমি তো গোড়াতেই বলেছিলাম। গল্পের শুরুটা আমি জানি। সেটা বললাম। কীভাবে গল্পটা এগিয়ে যাচ্ছে তাও জানি। সেটাও বললাম। কিন্তু কীভাবে এর শেষ হবে সেটা আমার জানা নেই। তাহলে গল্পটা কি এভাবেই চলতে চলতে থাকবে? প্রতিবার ক্ষমতার লম্ফ ঝম্ফ । প্রতিবার মায়ামোহনের ক্ষমতার পিঠ থেকে ছিটকে যাওয়া। আর প্রতিবার তার শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আবার জাঁকিয়ে এসে বসা ওই ক্ষমতার পিঠে। আর তারপর মায়ামোহনের আরো দাপুটে শাসন। আর এই গল্প চলতেই থাকলো। জেনে রাখুন আপনিও তো এই গল্পের মধ্যেই আছেন। আপনি কি বলতে পারেন ওই মায়ামোহন এইবার আবার ডিগবাজি খেয়ে তার ক্ষমতার পিঠে ফের জাঁকিয়ে বসে তার ক্ষমতার হাঁ মুখ নিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসবে না? তাহলে তো আবার একটা রক্তপাত হবে। আর গল্পটা শেষ হয়ে যাবে খুব সহজেই। তাহলে এভাবেই শেষ হয়ে যাক গল্পটা। এটা যদিও আপনার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক। এটাও আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম।
না হলে?
না হলে তো আপনাকেই শেষ করে দিতে হবে গল্পটাকে।
অর্থাৎ এই মায়ার খেলাকে।
অন্য এক চমৎকার রক্তপাতে।