• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • সে وہ : বলরাজ মেন্‌রা
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়

    [বলরাজ মেন্‌রা (১৯৩৫ – ২০১৭) উর্দু ভাষার নব্যপন্থী কথাকার। বহু প্রতীকী ছোটগল্প লিখেছেন। খ্যাতনামা ‘শউর’ (شعور) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

    অনূদিত গল্পটি এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি থেকে ২০০৪-এ প্রকাশিত সামওয়ারুল হুদা সম্পাদিত ‘সুরখ ও সিয়াহ্‌’ কেতাব থেকে সংগৃহীত।]

    চোখ খুলে সময়টা টের পায়নি সে।

    ডান হাতটা বাড়িয়ে বেড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা উঠিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে ধরল।

    প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে আবার হাত বাড়িয়ে দেশলাইয়ের প্যাকেটটা খুঁজল।

    দেশলাইয়ের বাক্সে কাঠি ছিল না।

    দেশলাইয়ের খালি বাক্সটাকে কামরার মধ্যে লপ্পা করে ছুঁড়ে দিল। বাক্সটা সিলিংয়ে লেগে মেঝেয় এসে পড়ল।

    এবারে সে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাল।

    বেড টেবিলের ওপর চার-পাঁচটা দেশলাই বাক্স ছড়িয়ে। একটার পর একটা বাক্সগুলো সব তুলে তুলে দেখল, সব কটাই খালি। লেপটা সরিয়ে ঘরের আলো জ্বালল।

    দুটো বাজতে যায়। মেঝেটা বরফের মত ঠাণ্ডা।

    ওহ্‌, দুটো বাজে! আমার সময়ের কোন খেয়াল ছিল না। মনে হচ্ছিল সকাল হয়ে আসছে।

    আজ এই অসময়ে ঘুমটা কেন যে ভেঙ্গে গেল?

    ঘুম একবার ছুটে গেলে চোখদুটো তো আর জোড়া লাগে না। সে সারা ঘরে তল্লাশি চালাল। বইয়ের আলমারি, বাতিল কাগজের ঝুড়ি, প্যান্টের পকেট, জ্যাকেটের পকেট... কোথাও দেশলাই মিলল না।

    একেকটা করে বই সরিয়ে দেখল, তাও মিলল না।

    ঘরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

    বইগুলো সব এধার ওধার হয়ে পড়ে রয়েছে, জামাকাপড়ও ছড়িয়ে আছে, ট্রাঙ্কটাও খোলা। কেউ যদি এসে পড়ে এখন?

    রাত দুটোর সময় ঘরের এই অবস্থা!

    ঠোঁটে ধরা সিগারেটটা কাঁপছে।

    জ্বলন্ত সিগারেটের সঙ্গে দপদপ করতে থাকা হৃদয়ের কতই না মিল!

    দেশলাই কোথায় পাই? না পেলে কী করব...

    হয়ত...

    আমার ধকধক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে যাবে না তো?

    আজ এমন অসময়ে ঘুমটাই বা ভেঙে গেল কেন?

    সময়টাও আমি বুঝতে পারিনি। আর ...চোখজোড়া একবার খুললে আর তো জোড়া লাগে না। দেশলাই বাক্স পাওয়া যাবে কোথায়?

    সে চাদরটাকে কাঁধের ওপর ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডিসেম্বরের শীতের রাত, অন্ধকারের রাজত্বে নিস্তব্ধতাই যেন প্রহরী।

    কোনও এক দিকে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার আগে সে কয়েক মুহূর্ত সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হাঁটতে শুরু করলেও কোন রাস্তায় যে চলেছে তাও যেন ঠাহর হয় না। নিকষ কালো নিঝুম রাত; দূরে যতদূর দেখা যায় কোথাও কেউ নেই।

    ল্যাম্পপোস্টের মাঝারি আলো রাতের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতাকে যেন আরও গাঢ় করে তুলেছে। আর ... চৌরাস্তার মোড়ে এসে পাদুটো যেন আর নড়ে না।

    এখানে জ্বলজ্বল করছে আলো, দুধসাদা টিউবলাইটগুলো ঝকমক করছে। তবে চারিদিক একেবারে নিঝুম, শান্ত – দোকানপাটও সব বন্ধ।

    সে হালুইকরের দোকানের দিকে পা বাড়াল।

    হালুইকরের উনুনে হয়ত আধ-নেবা কয়লা পাওয়া যেতে পারে -- জ্বলন্ত কয়লার একটা টুকরো বা প্রায় নিভন্ত অঙ্গার।

    দোকানের সামনের চত্বরে লেপমোড়া কেউ একজন কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।

    সে উনুনের কাছে গিয়ে ঝুঁকতেই লেপের কুণ্ডলীটা খুলে গেল।

    ‘এই...কে? কী করছেন?’

    ‘দেখছিলাম উনুনের মধ্যে একটা আধ-নেবা কয়লার টুকরোও পাই কি না!’

    ‘পাগল নাকি? চুলা তো কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে?’

    ‘তাহলে?’

    ‘তা হলে আবার কী? বাড়ি যান!’

    ‘দেশলাই আছে নাকি আপনার কাছে?’

    ‘দেশলাই?’

    ‘হ্যাঁ, সিগারেটটা ধরাতাম।’

    ‘আচ্ছা পাগল লোক তো! যান, যান...ঘুমের সময় জ্বালাবেন না।’

    ‘দেশলাই তা হলে নেই আপনার কাছে?’

    ‘দেশলাই শেঠের কাছে আছে। সে এলে চুলা ধরানো হবে।’

    সে আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ঠোঁটে ধরা সিগারেটটা কাঁপছে। আবারও পা ফেলল সামনের দিকে। চার মাথার মোড় পেছনে পড়ে রইল, আলোর চমকানিও পড়ে রইল। আরও কত কিছুই তো সে পেছনে ছেড়ে এল।

    এবার কদম দ্রুত পড়ছিল। ল্যাম্পপোস্টের পর ল্যাম্পপোস্ট -- আবার ল্যাম্পপোস্ট। অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট পেছনে থেকে গেল। ঢিমে আলোর ল্যাম্পপোস্ট -- যারা রাতের আঁধার আর নিস্তব্ধতাকে আরও গাঢ় করে তোলে।

    হঠাৎই পা দুটো থেমে গেল। উল্টোদিক থেকে কেউ যেন এগিয়ে আসছে। লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    ‘দেশলাই আছে নাকি আপনার কাছে?’

    ‘দেশলাই?’

    ‘সিগারেটটা ধরাতাম ...’

    ‘না, দেশলাই নেই। আসলে আমার ওই নেশাটাও নেই।’

    ‘আমি ভাবছিলাম...’

    ‘কী ভাবছিলেন?’

    ‘হয়ত আপনার কাছে দেশলাই পাব।‘

    ‘না, দেশলাই নেই। বললাম যে, আমি ওই নেশা থেকে বেঁচেছি। এখন বাড়ি ফিরছি। আপনারও তো ঘরে ফেরা উচিত।’

    লোকটা পা ফেলে এগিয়ে গেল।

    ঠোঁটের সিগারেটটা তখনও একইভাবে কাঁপছে। ক্লান্ত পা-দুটো ঢিমে গতিতে চলছে। কটা বাজে তাও জানা নেই, চলার গতিও শ্লথ।

    ল্যাম্পপোস্ট আসে, টিমটিমে আলো ফেলে, তারপরে আবার অন্ধকার।

    আবার একটা ল্যাম্পপোস্ট, মাঝারি আলো, আবার নিকষ কালো।

    ঠোঁটে সিগারেটটা চেপে ধরে সে ধীর পায়ে এগোয়।

    ফুসফুস পর্যন্ত ধোঁয়া টেনে নেওয়ার ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। রাতের পোশাকের ওপর বিছানার চাদরটা খালি জড়ানো থাকায় ঠান্ডাও লাগছে।

    কম্পিত পায়ে কোনওক্রমে এগিয়ে চলল সে -- সময় আর সরে যেতে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোর হিসেব না রেখেই।

    আরও একবার পা দুটো থেমে গেল। সামনে একটা বিপদের চিহ্ন -- সতর্কবার্তা দেওয়া আছে। পুলের মেরামতের কাজ চলছে, দুর্ঘটনা এড়াতে লাল কাপড় জড়ানো একটা লণ্ঠন সড়কের ঠিক মাঝখানে তক্তার সঙ্গে বাঁধা। সে লণ্ঠনের আগুন থেকে সিগারেটটা ধরাবে ভেবে সবে পা ফেলতে যাবে, এমন সময় কানে এল...

    ‘কে?’

    সে উত্তর দিল না। অন্ধকারের কোনও অজানা পর্দা সরিয়ে এক সেপাই তার দিকে এগিয়ে এল। ‘কী করছিলেন?’

    ‘কিছু না তো!’

    ‘আমি জিজ্ঞেস করেছি কী করছিলেন?’

    ‘আপনার কাছে দেশলাই হবে?’

    ‘আমি জিজ্ঞেস করছি কী করছিলেন আর তোমার উত্তর হল দেশলাই আছে কিনা? কে তুমি?’ ‘সিগারেটটা ধরাতে হবে... যদি আপনার কাছে দেশলাই হত তো ...’

    ‘তুমি এখানে কিছু করছিলে কি?’

    ‘আমি লণ্ঠনের আগুন থেকে সিগারেটটা ধরাতে চাইছিলাম। যদি আপনার কাছে দেশলাই হত তো ...’

    ‘কে তুমি, থাকোই বা কোথায়?’

    ‘আমি ...’

    ‘থাকো কোথায়?’

    ‘মডেল টাউন।’

    ‘আর তোমার দেশলাই দরকার... মডেল টাউনে থাকো... কোথায় মডেল টাউন?’

    সে ঘুরে গিয়ে দেখাল।

    অনেক দূর পর্যন্ত ঘুটঘুট্টে অন্ধকার।

    ‘চলো আমার সঙ্গে থানা পর্যন্ত ...মডেল টাউন... মডেল টাউন তো এখান থেকে দশ মাইল দূরে... তোমার দেশলাই দরকার বললে না? থানায় দেশলাই পেয়ে যাবে।’

    সেপাই বাহুটা পাকড়ে ধরায় সে সেপাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। থানা তো সেই অন্তহীন সড়কের ওপরই -- এ রাস্তার শেষ কোথায়?

    সেপাইয়ের সঙ্গে গিয়ে থানার একটা ঘরে ঢুকল সে।

    বেশ কজন একটা বড় টেবিল ঘিরে বসে। সবার মুখেই সিগারেট। টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইও পড়ে ছিল।

    ‘সাব, ইনি পুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বলছিলেন মডেল টাউনে থাকেন ...আর দেশলাইয়ের খোঁজ করছিলেন।‘

    ‘কী ব্যাপার?’

    ‘যদি আপনারা অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের দেশলাইটা ব্যবহার করতে পারি? সিগারেটটা ধরাতে চাইছিলাম।’

    ‘কোথায় থাকেন?’

    ‘মডেল টাউন। আপনাদের দেশলাইটা নিতে পারি কি?’

    ‘করেন কী আপনি?’

    ‘আমি অচেনা লোক...আমি কি দেশলাইটা ...’

    ‘মডেল টাউনে কতদিন আছেন?’

    ‘তিন মাস! দেশলাইটা...’

    ‘দেশলাই...মাচিস্... মাচিস্ কা বাচ্চা... যাও আপনে ঘর... না হলে আটকে রেখে দেব!’

    সে একদম কাহিল অবস্থায় থানার বাইরে এল।

    সেই অনন্ত পথে আবার ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে চলল। তার নাক দিয়ে জল পড়ছে... শরীরটা আর বইছে না যেন।

    সিগারেট খাওয়াটাই একটা রোগ! এ রোগটাকে কেন যে লালন পালন করছি! দেশলাই কোথায় যে মিলবে...যদি না পাই তো?

    সময়, ল্যাম্পপোস্ট, সড়ক, নিজের শরীরটাও যেন তার অপরিচিত। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলেছিল সে। কাঁপতে থাকা পাদুটো যেন কোনও নেশাখোরের।

    সকালের আলো ফুটতে সে একটু দাঁড়াল। বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। একটু সামলে নিয়ে এগোনোর জন্য পা ফেলতে যাবে এমন সময় সামনের দিক থেকে কাউকে আসতে দেখে তার পাদুটো আবার কাঁপতে শুরু করল। লোকটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগন্তুকের মুখে ধরা সিগারেটটা কাঁপছে।

    ‘আপনার কাছে একটা দেশলাই হবে নাকি?’

    ‘দেশলাই?’

    ‘আপনার কাছে দেশলাই নেই?’

    ‘দেশলাইয়ের জন্য আমিও তো...’

    লোকটা তার কথা না শুনেই এগিয়ে গেল।

    সেই দিকে যেদিক থেকে সে নিজেই এতটা পথ চলে এসেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments