• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • মিখাইলের দুনিয়া : যুদ্ধ, প্রেম, গণহত্যা আর প্রতিবাদের কবিতা : অংকুর সাহা


    || ১ ||

    লোকটা শুয়েছিল
    পাশ ফিরে
    যেভাবে সে সবসময় ঘুমোয়
    কিন্তু এখন যে দেখা যায় তার অস্থিগুলো,
    এমনকি তুমি গুনে ফেলতে পারো তাদের।

    ঘিরে রেখেছিল তাকে সুহৃদেরা
    যেমনটি হয়ে থাকে
    একটাই তফাত: সবাই মৃত তারা।

    পুরোপুরি শান্ত
    নিজের শরীরের ক্ষতগুলো নিয়ে চিন্তাও নেই কোনো।
    ঠিক যেমন ছিল শৈশবে
    তার বয়েস বাড়বে না একচিলতেও।

    জোড়া লাগা দুটো গাছের মতন
    একে অন্যের ঘনিষ্ঠ তারা
    সেই গাছেই হেলান দিয়ে বসতো দুজনে
    এখন তাদের নীরবতা অন্তহীন।

    গণকবরের মাথার ওপর দিয়ে
    সূর্য চলে যান মেঘের আড়ালে
    অন্যদিনের মতোই
    কেবল আজ তিনি উজ্জ্বলতা দেন মরণকে।

    (ম্যাক্স ওয়েইস-এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।)

    ওপরের উদ্ধৃতিটি একটি গদ্যগ্রন্থ থেকে (“The Beekeeper of Sinjar”)—ইরাকের গণহত্যার, গণকবরের, নারীনির্যাতনের সমসাময়িক দলিল—“দায়েশ”(Daesh) অথবা আইসিস (ISIS) কুক্ষিগত উত্তর ইরাকে যে হত্যা, ধর্ষণ আর অত্যাচারের প্রলয় চলেছে সেই ২০১৪ সাল থেকে, তার অন্তরালে কিছু শুভমনোভাবাপন্ন, অসমসাহসী মানুষের আশা আর স্বপ্নের কাহিনী। আবদুল্লাহ নামে এক মৌমাছিপালক তাঁর নিজের পেশা ছেড়ে নতুন কাজ নিয়েছেন; দায়েশের কবলে বন্দিনী ক্রীতদাসী নারীদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া তাঁর নতুন পেশা। সেই কাজের ফাঁকে তিনি আবিষ্কার করেন একটি গণকবর আর সেখানে খুঁজে পান তাঁর আপন ভাইয়ের পচা-গলা মৃতদেহ। গদ্য যেখানে মানব-অনুভূতির সম্যক বর্ণনা দিতে অপারগ, সেখানে কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর মুখের ভাষা। তার লেখিকা হলেন ইরাকের আর আরবি ভাষার প্রথম সারির কবি, নাম দুনিয়া মিখাইল।

    প্রাগৈতিহাসিক যুগে ইরাকের নাম ছিল মেসোপটেমিয়া, সেখানে বাস করতো আসিরিয় মানুষেরা, তারা কথা বলতো আরামাইক ভাষায়, যা ছিল যীশুরও মাতৃভাষা; যীশু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্যেরা এই অঞ্চলের মানুষদের দীক্ষা দেন খ্রিস্টধর্মে—এঁরা পৃথিবীর প্রাচীনতম খ্রিস্টধর্মী। সপ্তম শতাব্দীতে দেশটি দখল করে নেয় যারা তারা ধর্মে মুসলমান, জাতিতে আরব, তাদের মাতৃভাষা আরবি। বর্তমান ইরাকে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—ভূমিজ আসিরিয় মানুষেরা এখন জনসংখ্যার ০.৫ শতাংশ মাত্র। দুনিয়া এই সম্প্রদায়ের মানুষ—তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালে। ইরাকে খ্রিস্টধর্মীরা সংখ্যালঘু, আবার খ্রিস্টধর্মীদের মধ্যে আসিরিয়রা সংখ্যালঘু ।

    || ২ ||

    দুনিয়া মিখাইলের জন্ম ইরাকের বাগদাদ শহরে ১৯৬৫ সালে এক আসিরিয় খ্রিস্টান পরিবারে। শৈশব থেকেই তিনি তিন তিনটি ভাষায় পটু—যীশুর ভাষা আরামাইক (মাতৃভাষা), আরবি (রাষ্ট্রভাষা) আর ইংরেজি (তৃতীয় ভাষা, আমাদের যেমন হিন্দি)। ইংরেজি নিয়ে চর্চা হাই স্কুল এবং কলেজে। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি বাগদাদ অবজার্ভার সংবাদপত্রের দপ্তরে যোগ দেন—সেখানে সাংবাদিক, অনুবাদক আর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব নেন বিভিন্ন সময়ে।

    সাম্প্রতিক প্রচলিত ইতিহাস বলে যে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছে দুবার—১৯৯০-৯১ সালে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম এবং ২০০৩ সালে শুরু-হওয়া ইরাক যুদ্ধ, যার জের চলেছে এখনো। কিন্তু আসলে তার সূচনা প্রথম ইরাক যুদ্ধের প্রায় তিন দশক আগে। যদিও সেনাবাহিনী, কামান-বন্দুক আর জঙ্গিবিমান-ট্যাংক দিয়ে নয়। আমেরিকা ইরাক-এর দখল নেয় ১৯৬৩ সালে—ওই বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি দেশটির শাসনে আসে ফ্যাসিবাদী “বাথ” দলের সদস্য সামরিক অফিসাররা। রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন কর্নেল আব্দুল সালাম আরিফ (১৯২১-১৯৬৬), তাঁর অন্যতম সহকারী এক তরুণ সামরিক অফিসার, নাম সাদ্দাম হোসেন (১৯৩৭-২০০৬), যিনি দেশটির দখল নেবেন ১৯৭৯ সালে। বাথ পার্টির প্রবল সমর্থক মার্কিন সরকার এবং সিআইএ—কুয়েত-এর সামরিক ঘাঁটি থেকে তারা সরবরাহ করে অস্ত্রশস্ত্র এবং সাহায্য করে গুপ্তচর সংগৃহীত গোপন তথ্য দিয়ে। বাধা দেন সাধারণ ইরাকি মানুষ—প্রথম দু দিনেই কচুকাটা হন তিরিশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ উন্নত মার্কিন অস্ত্রে, জেলখানা উপচে পড়ে রাজনৈতিক বন্দিতে—দেশের স্কুল, নার্সারি আর স্টেডিয়ামগুলো হয়ে ওঠে জেলখানা, আর আধুনিক মার্কিন প্রযুক্তিতে চলতে থাকে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ আর নির্যাতন। ১৯৮৮ সালে ১৬ই মার্চ সাদ্দামের সেনাবাহিনী যখন বিষাক্ত গ্যাসের প্রয়োগে ৫০০০-এর বেশি কুর্দ নাগরিককে হত্যা করে, তারা বিষাক্ত গ্যাসের উপাদানগুলো সংগ্রহ করেছিল আমেরিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন সংস্থা থেকে।

    ১৯৯৩ সালে কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম “অনুপস্থিতির স্তোত্রগুলি”, ইরাক-ইরান যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সমসময়ে লেখা কবিতার সংকলন। যুদ্ধের শীতল ছায়ায় চলতে থাকে মানুষের দৈনন্দিন জীবন। একটি কবিতার নাম—“সর্বনাম”:

    বালক ট্রেন নিয়ে খেলে।
    বালিকা হুইসেল বাজায়।
    রওনা হয় দুজনে।

    বালক দড়ি নিয়ে খেলে।
    বালিকা হয় বৃক্ষ।
    দোলনায় দোলে দুজনে।

    স্বপ্ন দ্যাখে বালক।
    পালক নিয়ে খেলে বালিকা।
    উড়ে যায় দুজনে।

    বালক জঙ্গি জেনারেলের পোশাক পরে।
    বালিকা সাধারণ মানুষের।
    যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা।

    (এলিজাবেথ উইনসলো-র ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।)

    শিশুসুলভ উপমার আড়ালে বিরাজ করে ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। কিন্তু সরকারী সেন্সরশিপের জন্যে কথা বলতে হয় অপ্রত্যক্ষভাবে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ছদ্মবেশে।

    ইরাকের প্রশাসনে সাদ্দামের সাঁড়াশি চাপ যত বাড়ে, তার সঙ্গে বেড়ে চলে শিল্প সাহিত্যের ওপরে সেন্সরশিপ এবং শিল্পী সাহিত্যিকদের ওপরে নিপীড়ন। দুনিয়াকে বার বার ধরে নিয়ে যায় পুলিশ, জিজ্ঞাসাবাদ করে আর ভয় দেখায়—লেখা বন্ধ না করলে বা সরকারের সমালোচনা বন্ধ না করলে গুরুতর শাস্তির সম্ভাবনা। তিনি চোখের সামনে দেখতে পান সতীর্থ লেখক-সাংবাদিকদের অবস্থা—বন্দীত্ব, অত্যাচার, হয়রানি, কারাগারে প্রহার, ধর্ষণ, এমন কি হত্যা। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে কবি দেশ ছাড়েন: প্রথমে ইরাক থেকে জর্ডন, সেখান থেকে আমেরিকার মিশিগান রাজ্যে। লেখাপড়া করেন ওয়েন রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকট-প্রাচ্য-বিদ্যা বিভাগে—সেখান থেকে এম এ ডিগ্রি করার পর মিশিগান রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষার অধ্যাপকের কাজ নেন।

    ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় “প্রায় সঙ্গীত”(“Almost Music”) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ, তাতে দেশ ছাড়ার বিষাদ আর দেশের জন্যে আকুতি। ইরাকে তখন প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের গণহত্যার পর চলেছে নির্মম অর্থনৈতিক অবরোধ। খাবার নেই দোকানে, পেট্রল নেই গাড়িতে, ওষুধ নেই হাসপাতালে। সাদ্দামের পুলিশ আর গুপ্তচরদের দৈনন্দিন নির্যাতনের চাপে ওষ্ঠাগত মানুষের জীবন। এই গ্রন্থের একটি কবিতার নাম “কমলালেবু” :

    অন্য এক নক্ষত্র থেকে
    গড়াতে গড়াতে আমি
    প্রত্যাবর্তনহীন নদীর জলে
    ডুবি।
    চারদিকে যত সংখ্যারা ভাসে
    অদৃশ্য জালে ছেঁকে তুলি তাদের
    আর ছড়িয়ে দিই, যতক্ষণ না তারা
    পরিণত হয় শূন্যে।
    একরাশ ধোঁয়ার মতন
    মৃত্যুর চূড়ায় বসে
    কাঁদি আমি কারণ
    আমাদের হাসিগুলোকে
    কমলালেবুর খোসা ভেবে ছাড়ালে
    যে গোলক বেরুবে
    তা আমাদের এই পৃথিবী নয়।

    (এলিজাবেথ উইনসলো-র ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।)

    || ৩ ||

    ২০০৫ সালে নিউ ডাইরেকশনস প্রকাশনসংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ইংরেজি কবিতার বই “যুদ্ধ ভীষণ পরিশ্রমী” (“The War Works Hard”), আরবি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেন এলিজাবেথ উইনসলো; সঙ্গে যুক্ত হয় আগের দুটি কবিতার বই থেকে কয়েকটি নির্বাচিত কবিতা।

    ইরাকে থাকাকালীন ১৯৯১ সালে দুনিয়া একটি দীর্ঘ কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন, “সাগর ছেড়ে আসা এক তরঙ্গের দিনলিপি”—তিন বছর লাগে শেষ করতে। ১৯৯৫ সালে সেটি প্রকাশিত হয় বাগদাদ শহরে, ১৯৯৯ সালে কায়রোতে—ইরাকের অন্তহীন যুদ্ধের এক মর্মান্তিক, মহাকাব্যিক বিবরণ। দুই দেশেই ঢেউ তোলে দীর্ঘ কবিতাটি। মনে পড়িয়ে দেয় প্রাচীন মহাকাব্য ইতিহাস আর পুরাণের কথা। কবিতাটির সমাপ্তি একটি স্বপ্নের উপাখ্যান দিয়ে। আমেরিকায় এসে তিনি সূচনা করেন এই কবিতার দ্বিতীয় অংশ: সেখানে একটি ভারী স্যুটকেসে ঠাসবুনোট তাঁর প্রথম ৩০ বছরের জীবনস্মৃতি। সেটি লিখে শেষ করতে এক দশক লেগে যায়। তাঁর শৈশব, তাঁর পিতার অকালমৃত্যু, তাঁর সতীর্থ ও কবি-বন্ধুরা, তাঁর সংবাদপত্রের কর্মজীবন, তাঁর কন্যা লারসা-র প্রসব-অভিজ্ঞতা, তেলকাইফ (তাঁর পূর্বপুরুষের গ্রাম), বাগদাদ, ত্রেবিল, আম্মান, মিশিগান—সব মিলিয়ে এক সংগীতময় পারিবারিক গাথা। ২০০৯ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত হয় দু খণ্ডে বিভক্ত কবিতাটির সংস্করণ—সামনের মলাট থেকে পড়তে শুরু করলে ইংরেজি, পেছনের মলাট থেকে শুরু করলে আরবি—মাঝে কয়েকটা পাতা ছবির অ্যালবাম আর চিঠিপত্র। প্রকাশক : নিউ ডাইরেকশনস। ইংরেজি অনুবাদ করেন এলিজাবেথ উইনসলো এবং কবি নিজে। ইংরেজিতে বইটির নাম “Diary of a Wave Outside the Sea”।

    দুনিয়ার অবচেতন স্মৃতি এক টাইম মেশিন:

    টাইম মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ১৯৯১ সালে নিয়ে আসি,
    প্রচণ্ড বেগে কাঁপতে থাকে যন্ত্রটা,
    আগুন ধরে যাবে মনে হয়।
    হায় ঈশ্বর! ধ্বংসস্তূপের চাপে
    উল্টে যায় সেই যন্তর।
    ভেঙে পড়ার আগে
    ছবি তুলে রাখে
    ঘটনার ও কালবিভাগের,
    আমার হাতের মুঠোয় চাঁদটার মতন।
    ………………….
    ইচ্ছে হয় যদি টাইম মেশিনটাকে
    নিয়ে যেতে পারি শূন্য সালে,
    কিন্তু সর্বনাশ ঘটেছে এই বিপর্যয়ের ফলে।
    টাইম মেশিন আর না পারে এগোতে না পেছোতে।
    ভেঙেছে যন্তরটা।
    ইতিহাসের এক সঙ্কটজনক মুহূর্তে তা থামে,
    যখন স্থানচ্যুতির পরিমাণ শূন্য। (পৃষ্ঠা ৪০-৪১)

    ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ “ইরাকের নিশীথগুলি” (“The Iraqi Nights”), কবিতার আরবি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেন করিম জেমস আবু-জাইদ—সেখানে প্রাচীন সুমেরিয় সভ্যতা এবং আধুনিক মার্কিন প্রযুক্তির নিয়মিত ঘোরাফেরা। স্থানাভাবে বইটির বিশদ আলোচনা সম্ভব হলো না।

    ২০১৮ সালে একটি গদ্য গ্রন্থ: “মৌমাছিপালক—ইরাকের অপহৃত নারীদের উদ্ধারের কাহিনি” (“The Beekeeper of Sinjar—Rescuing the Stolen Women of Iraq”)—যে বইয়ের একটি গা-ছমছমে, কাব্যময় উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধের সূচনা করেছি।

    কবির অনুমতি ও সমর্থন সাপেক্ষে আমি তাঁর কয়েকটি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছি—কবিতাগুলি শিকাগোর “পোয়েট্রি” কাগজের জুলাই-আগস্ট ২০১৮ সংখ্যা থেকে নেওয়া।



    চতুর্থ শিলালিপি

    || ১ ||
    লিখতে চেয়েছিলাম এক মহাকাব্য
    মানুষের মর্মপীড়া নিয়ে,
    কিন্তু যখন সেই রমণীর
    মেটে একচালার ধ্বংসস্তূপে
    খুঁজে পেলাম তার দীর্ঘ কেশের একগাছি;
    সেই হলো আমার মহাকাব্যের সূচনা।

    || ২ ||
    এক ফোঁটা ঘুম নেই কাল রাতে।
    রাতটা যেন লুকিয়ে ছিল
    সকালের কফির কাপে।

    || ৩ ||
    এই নারীর জীবন এক সাপলুডোর ছক
    অন্তহীন ফিরে আসা সূচনায়;
    কিন্তু কার জীবন এমন নয়?
    বুকভরে অক্সিজেন টেনে
    নতুন করে দান ফ্যালে সে।

    || ৪ ||
    বিমানের জানালায়
    ঝকমক করে শহরটা;
    কেবল সূর্যের আলোয় ছড়ানো
    হাড়গোড় আর খুলির জন্যে নয়,
    জানালায় নি:শ্বাস বাষ্পের কুয়াশায়।

    || ৫ ||
    মেয়েটির মৃত্যু হলে
    প্রহর থেমে যায় তার প্রিয়জনদের,
    থামে না তার হাতঘড়ির টিক টিক।

    || ৬ ||
    ঈশ্বর তাঁর বোঝা বয়ে বেড়ান নীরবে;
    বোঝা বাড়তে বাড়তে একটা মুহূর্ত আসে,
    যখন তিনি প্রণোদিত হন
    তা মানুষের কাঁধে তুলে দিতে —
    মানুষ হয় নব দুর্দশার ঈশ্বর।

    || ৭ ||
    মানচিত্রে ইরাক একটা দস্তানা,
    মিশিগানের মাপটাও ঠিক তাই —
    হঠাৎ-ই লক্ষ্য করি এই সাদৃশ্য।

    || ৮ ||
    যদি মানুষজনকে রক্ষা করতে নাও পারো,
    অন্তত: ঘৃণা কোরো না তাদের।

    || ৯ ||
    তার কানকো থেকে নি:সৃত বুদ্বুদগুলো বিরক্ত করে আমায় —
    না পারি বুঝতে তার একটা কথাও।
    যদি তাকে একোয়ারিয়ামের বাইরে ফেলে দিই?
    কী হবে যদি এই কদর্য, অভিবাসী মাছ
    উপচে পড়ে বাইরের পৃথিবীতে?

    || ১০ ||
    এই শহরের অসংখ্য বাতি জ্বলে আর নেভে,
    মনে করিয়ে দেয় :
    আমরা যেমন জন্মাই আগমনের জন্যে,
    তেমনি জন্মাই নির্গমনের জন্যে।


    || ১১ ||
    রুমালগুলো ওদের নিজেদের,
    অশ্রুগুলো ভাগ করে নিই সবাই।


    || ১২ ||
    খালি পায়ে মেয়েগুলো দৌড়োয় প্রাণভয়ে।
    তাদের পেছন পেছন
    আকাশ থেকে তারা খশে।

    || ১৩ ||
    কী আশ্চর্য!
    আমাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখি আমি,
    তার মধ্যে তুমি-ও একটা স্বপ্ন।

    || ১৪ ||
    “আমার চোখের পাতায় থাকবে তুমি,”
    বলেছিলো সে।
    এখন যে ঘুমোয় যখন,
    তার চোখের পাতা হয় আমার আচ্ছাদন।

    || ১৫ ||
    গিলগামেশ আর অমরতার
    আকাঙ্ক্ষা করেন না;
    কারণ তিনি নিশ্চিত যে একমাত্র মৃত্যুর পরই
    সুহৃদ এংকিডুর সঙ্গে তাঁর দেখা হবে আবার।

    টীকা : আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ সালে রচিত প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার গিলগামেশ মহাকাব্যের দুটি প্রধান চরিত্র: গিলগামেশ আর এংকিডু।

    || ১৬ ||
    কেউ কেউ বলেন, প্রেম মানে
    তোমার সবগুলো ডিম
    একই ঝুড়িতে রাখা।
    কিন্তু ডিমগুলো যদি সব ভেঙে যায়
    অক্ষত কি থাকতে পারে ঝুড়িটা?

    || ১৭ ||
    গৃহহীন মানুষদের আর
    সব হারানোর ভয় নেই।
    তাদের চোখের সামনে যা ভাসে:
    মেঘেরা উড়ে যায় দ্রুতগামী যানবাহনের ওপর দিয়ে,
    যেভাবে পায়রার দল পথে পড়ে থাকা কিছু কিছু বীজ
    না খেয়ে-ই ফেলে রেখে উড়ে যায়।
    কিন্তু কেবল তারা-ই জানে,
    দিনের শেষে ফিরে আসা যায়,
    এমন একটা ঘর থাকার তাৎপর্য কী।

    || ১৮ ||
    ঝড় আর বৃষ্টি
    কোনো ভেদাভেদ না মেনে-ই
    ভাসায় আমাদের।
    ঝড়ের চোখে
    সবাই সমান আমরা।

    || ১৯ ||
    যখন আমি টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙি,
    তুমি একটা ধাঁধার সমাধানের মতো
    একের পর এক টুকরো হাতে নিয়ে
    পরম মমতায়
    জোড়া লাগাও আমায়।
    আমি আর
    যে কোনো মুহূর্তে
    ভয় পাই না ভাঙতে।

    || ২০ ||
    খাবার অথবা কম্বল ছাড়াই
    পাহাড়ের মাথায় ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে,
    তারা কেবল শোনে:
    কোনো খবর নেই মানে ভালো খবর।

    || ২১ ||
    তাদের করুণ কাহিনিগুলো মারে নি আমায় —
    কিন্তু সেই কাহিনিগুলো শোনাতে না পারলে
    মৃত্যু হবে আমার।

    || ২২ ||
    মেরে ফেলার আগে
    বাজেয়াপ্ত করে তাদের ব্যক্তিগত তল্পিতল্পা ।
    প্যাকিং বাক্সের ভেতর একটানা
    বেজে চলে তাদের সেলফোনগুলো।

    || ২৩ ||
    বাগানের ঘাস মরে গেলে
    ব্যাকুল হই না আমরা। জানি
    আবার গজাবে সামনের বা
    তার পরের বর্ষায়।
    ফিরে আসে না মৃতেরা, কিন্তু
    তাদের অস্তিত্ব টের পাই
    ঘাসের ঘন সবুজে।


    || ২৪ ||
    ব্যাকুল কামনা যদি জড়ায় আমাদের
    অর্থ কী তার?
    এ কি এমন এক বৃত্ত
    যার না আছে শুরু, না আছে শেষ?

    মূল কবিতার নাম : “Tablets IV”


    অপরিচিতা : তার নারীত্বের চিহ্ন

    সব শব্দের-ই লিঙ্গ আছে
    আরবি ভাষায়।
    ইতিহাস পুংলিঙ্গ।
    কাহিনি স্ত্রীলিঙ্গ।
    স্বপ্ন পুংলিঙ্গ।
    ইচ্ছে স্ত্রীলিঙ্গ।

    মেয়েলি শব্দগুলোর শেষে
    থাকে একটা বৃত্ত, তার মাথায় দুটো বিন্দু।
    তার নাম: বৃত্তের বন্ধন
    শুভ ইচ্ছা দিয়ে বাঁধা;
    ইচ্ছেগুলো সত্যি হয় যখন মানুষ ভুলে যায়
    অথবা তাকে সরিয়ে দেয়
    অন্যের ইচ্ছে।

    ইচ্ছের বন্ধনে বাঁধা শহরে,
    গভীর প্রত্যাশা মানুষের মনে —
    আসবে এক ভিনদেশি
    তার নারীত্বের চিহ্ন নিয়ে।
    এক পথিক দেখেছেন তাকে —
    জ্বলজ্বল করে দুটো বিন্দু,
    প্রতিবাদী আরেক জনের দর্শনে —
    অন্ধকারে শিকারি বেড়ালের
    তীক্ষ্ণ চোখদুটোর মতন।
    কী ভয়ঙ্কর, বলেন তিনি, লাল বৃত্তের ভেতর
    লুকিয়ে থাকে চাঁদ।

    শহরে আজ ব্যস্ত সকলে —
    মনের বাসনা গুলো কাগজে লিখে
    বাতাসে উড়িয়ে দেবার কাজে।
    ভিনদেশি তার যাওয়ার পথে,
    যখন কুড়িয়ে পাবে সেগুলো,
    মালা গেঁথে জুড়ে দেবে তার
    বৃত্তের সঙ্গে; কিছু পুরানো বাসনা
    ফেলে দেবে পথে,
    নতুন বাসনার স্থান দেওয়ার জন্যে।
    লোকে বলে,
    ফেলে দেওয়া বাসনাগুলো পূর্ণ হবে-ই।

    ভিনদেশির বিলম্ব দেখে
    চিন্তিত অপেক্ষারত মানুষেরা।
    কেউ কেউ বলে, সে খুঁজছে
    একটা যুৎসই শব্দ,
    একটা বিশেষ বাক্য সম্পূর্ণ করার জন্যে —
    তার উপহার এই শহরের মানুষের জন্যে।

    অবাক হয়ে ভাবে আর একজন —
    কী চাই তার? ক্রিয়াপদ অথবা বিশেষ্য?
    আমি খুঁজে দেব তার হয়ে?
    তৃতীয় একজন ভয় দেখায় —
    ভিনদেশিকে ছুঁলেই সে
    রূপান্তরিত হবে বুনোফুলে —
    মুহূর্তের জন্যে ফুটে উঠে
    শুকিয়ে ঝরবে মাটিতে।
    আর মুখরিত হবে তার বৃত্ত
    আনন্দ আর বিষাদের সংগীতে
    এবং এমন এক অজ্ঞাত বাসনা জাগিয়ে
    তুলবে তারা, যার কোনো নাম নেই।
    সে কি বাক্যটি সমাপ্ত করবে
    ক্রিয়াপদ অথবা বিশেষ্য দিয়ে?
    অথবা বাক্যের বদলে সে শোনাবে
    কেবল নির্জন শব্দ একটি?
    অবাক হয়ে ভাবে তারা।

    শেষে যখন তারা পদশব্দ শোনে,
    বুঝতে পারে ভিনদেশি এসে গেছে নিকটেই।
    দেখো, সিংহদুয়ার খোলা থাকে যেন,
    একে অন্যকে মনে করিয়ে দেয়।
    ঝুনঝুন আওয়াজ শোনে তারা —
    চুড়ি? না কী শৃঙ্খল?

    মূল কবিতার নাম: “The Stranger in Her Feminine Sign”



    অলংকরণ (Artwork) : উইকিমেডিয়া থেকে
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments