আথাবাস্কা নদীর ধারে একা দাঁড়িয়ে আছি। দুধ-সাদা জলে তীব্র জলোচ্ছ্বাস। রাতের কাঁটা প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই। আকাশে তখনও কনে-দেখা আলো। স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে কে বলবে যে একটু আগে এখানে জবরদস্ত ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাইন বাংলোর সারি সারি কেবিনে আলো নেই, ভিতরে ছায়া ছায়া অন্ধকার থিতিয়ে আছে। নদীর এপারে পাওয়ার-কাট হয়েছে। ওপারে ঘন-ছায়া পাইন বন, পাহাড়ের মধ্যে দু’একটা বিন্দুর মতন আলো দেখতে পাচ্ছি। তাহলে পুরো জ্যাসপারের আলো চলে যায় নি? আশাকরি এদিকে শিগগিরি এসে যাবে।
নদীর পাশ দিয়ে পাইন বনের মধ্যে কাঁচা পথ ধরে হাঁটছি। নদী থেকে তীব্র হিমেল ঝোড়ো হাওয়া উঠে আসছে। দুরন্ত হাওয়ায় চুল উড়ছে, মুখে চোখে জলকণা ছিটোচ্ছে। নদী-পাইনবন-ছায়াঘন কেবিন সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃতিক পরিবেশ। যা আমার আলোকের গতির চেয়েও দ্রুত, বিক্ষিপ্ত মনকে ধীরে ধীরে শান্ত করে আনল। এটাই প্রকৃতির আশ্চর্য ম্যাজিক। নদীর ধার দিয়ে দূষণমূক্ত বাতাস নিতে নিতে অনেক দূর এসেছি। এবার বাইরেও আঁধার নামছে। এই যা! সেল ফোন আনতে ভুলে গেছি। আমাদের কেবিনটা কি করে চিনব? পথে দেখেছিলাম, এক ভদ্রলোক বারবিকিউ পিটে কাঠের আগুন জ্বালিয়েছেন। সেই পর্যন্ত চিনে যেতে পারলেই, তার বাঁদিকের গলিতেই আমাদেরটি। ফিরবার পথে আবার সেই মানুষটি, সামনে আগুন নিয়ে নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে মগ্ন হয়ে আছেন। একাকি যেন এক আদি মানবের মতন। তাঁর চারপাশে অজস্র আগুনের ফুলকি। এঁর কেউ সাথী নেই? আসা যাওয়ার পথে একবারও “hello” বলেন নি। মানুষ এবং আগুন যেন এই নিস্তব্ধ প্রেক্ষাপটেরই অংশ।
আমরা ক্যালগেরি থেকে সাত ঘন্টা ড্রাইভ করে (ছশো কিলোমিটার) জ্যাসপার ন্যাশানাল পার্কে এসেছি। এই নিয়ে তৃতীয়বার আসা। এবার একটু ঘুরপথে, এডমন্টন থেকে আমাদের পুত্রকে তুলে নিয়ে এসেছি। তারই খুব শখ। ঋজুর কাছ থেকেই জানলাম যে জ্যাসপার জ্যোতির্বিদ্যার পিঠস্থান “World’s largest dark sky preserve.” এখানে মহাবিশ্বের অনেক বিরল ঘটনা দেখা যায়। আগামী কাল মধ্যরাতে উল্কাপাত হবার কথা। ঋজুর উৎসাহে উল্কাপাত দেখতেই আসা। তাছাড়া জ্যাসপারের অসাধারণ প্রকৃতির নেশা তো আছেই।
কেবিনে ফিরে দেখি বাবা-ছেলে দুজনে অন্ধকারে বসে। আমি না ফিরলে ঘুমাতে যেতে পারছিল না। তারা আমার এই অবিবেচনায় – অর্থাৎ “অন্ধকারে অচেনা জায়গায়”, “একা” এবং “সেল ফোন ফেলে” চলে যাওয়ায় বেশ চটেছে। কিন্তু এতই হা-ক্লান্ত যে, বিশেষ কিছু বলল না। আমি কি জানতাম যে হাঁটতে গিয়ে প্রকৃতিদেবী দূরে নিয়ে যাবেন? পুরোপুরি সেল ফোন-নির্ভর জীবনে, হাতে ঘড়িটিও নেই। এত বছর কানাডায় আছি, কখনও পাওয়ার-কাট হতে দেখিনি। তাই টর্চ, মোমবাতি সাথে নেই। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। তীব্র আলোয় পাইন-কাঠের বাদামি-হলুদ কেবিন ঝলমল করছে। কী ব্যাপার? পাওয়ার এসে গেছে। কিন্তু ঘুমের যে দফারফা।
কাল সারা রাস্তা মেঘ আর বৃষ্টি আমাদের সাথে এসেছে। দীর্ঘ পথের শেষ একশো কিলোমিটারে - হিন্টন থেকে জ্যাসপার, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে অজস্র লেক, জলা জমি পেরিয়ে এলাম। অপূর্ব মায়াবি মেঘে-মাখা পথ। আদিগন্তব্যাপী বিস্তৃত পৃথিবীটা যে কত অপূর্ব সুন্দর, তা বাইরে না এলে বোঝা যায় না। নিজেদের ছোট্ট গণ্ডিতে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি।
কানাডার পশ্চিমে রকি মাউন্টেনের মধ্য দিয়ে ক্যালগেরি থেকে উত্তরে চারটি ন্যাশানাল পার্ক – ব্যানফ, জ্যাসপার, কোটনি এবং ইয়োহো। ১৯০৭-এ কেনেডিয়ান সরকার জ্যাসপার ন্যাশানাল পার্কটি অধিগ্রহণ করেন। প্রায় ১১,০০০ স্কোয়ার কিলোমিটারের জ্যাসপার, রকির বৃহত্তম, UNESCO's Canadian Rocky Mountain Parks World Heritage Site. ভারতের করবেট ১,৩০০ আর জলদাপাড়া ২১৬ স্কোয়ার কিলোমিটার। তাহলে জ্যাসপার প্রায় দশগুণ বড়? প্রত্যেক বছর এখানে দুই মিলিয়ান টুরিস্ট আসেন, যাঁরা অনায়াসে বিন্দুর মতন হারিয়ে যেতে পারেন। এখানে অজস্র গ্লেসিয়ার, লেক, ঝরনা, নদী, জঙ্গল, সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ আর নানা বন্য জন্তু। এবারে ঝটিকা সফর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সদ্যজাত শিশুর একমুখ নির্মল হাসির মতন বিশ্ব জুড়ে আলো ফুটেছে। বৃষ্টিধৌত পাহাড়ে আলো ফোটার চেয়ে পবিত্র কিছু হয় না। আমরা ৪৮ কিলোমিটার দূরে মালাইন লেকে (Maligne Lake) চলেছি। পাহাড়ি পথে গাড়ি ঘুরে ঘুরে উঠছে, “পাহাড়ের আর দিগন্তের নীলে; শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্রবাঁধা ছন্দে আর মিলে।” এসে গেল মালাইন লেক। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা দিগন্ত, মাঝে ঘন সবুজাভ-নীল মালাইন লেক। শেষ দেখতে পাচ্ছি না। দীর্ঘ geological বর্ষ ধরে, পাহাড়ে গ্লেসিয়ারের ক্ষয় হতে হতে, সমুদ্রের মতন গভীর এই লেকের সৃষ্টি। আমরা এক ঘন্টার বোট ট্রিপ নিয়েছি। বোটের মধ্যে নানা দেশের টুরিস্ট। বোট চালক আর টুর গাইড দুজনেই University of Ottawa-র ছাত্রী। এখানে সামার জব করতে এসেছে। ওদের কাছে এই লেক আবিষ্কারের কাহিনী শুনলাম।
এখানকার First Nation মানুষরা পাহাড়ের মাঝে এই সুন্দর লেকের কথা জানলেও, বাইরের কেউ জানত না। মেরি স্কেফার (Mary Scaffer) আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার লোক। ভৌগোলিক আবিষ্কারের নেশায় তিনি এবং তাঁর স্বামী চার্লস স্কেফার দুজনে আমেরিকা থেকে রকিস-এ আসতেন। কানাডায় পাহাড়ে গ্রীষ্মকালটা কাটিয়ে, শীতে ফিরে যেতেন। ১৯০৭-এ ওঁরাই লেকটা খুঁজে পান। ১৯১২ সালে, স্বামীর মৃত্যুর পরে, মেরি কানাডার প্রকৃতিকে ভালোবেসে রকিস-এ থেকে যান। দীর্ঘ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছিলেন। ওঁর লেখা থেকে এখানকার শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের কাহিনী আমেরিকায় ছড়িয়ে যায়। টুরিস্টরা আসতে শুরু করে। ১৯০৯-এ একটা পাহাড়ের নামকরণ হয় “Mount Scaffer.” এইভাবে তাঁর নাম অনেক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সাথে এই অঞ্চলে জুড়ে গেছে।
বোট থেকে মাথা বার করতেই, একঝাঁক পাখির মতন দুরন্ত লেকের হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঃ কী যে শান্তি! ভিতরে নানা দেশের টুরিস্ট। অন্য একটা বোট আমাদেরটা দুলিয়ে, চারিদিকে সাদা ফেনা ছিটিয়ে চলে গেল। দুটো বাচ্চা খুব মজা পেয়ে জোরে হাততালি দিচ্ছে। মালাইন লেকের দু’পাশে জঙ্গলের পিছনে নীল পাহাড়ের মাথায় জুঁই-সাদা-পবিত্র গ্লেসিয়ার। লেকের তীর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে স্পিরিট আইল্যান্ডে এসে গেলাম। এই দ্বীপটি কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফোটোগ্রাফিক স্পট। ২০১৪ iPad মডেলের আইকন ছিল। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা এক বিশাল সবুজাভ-নীল লেকের মধ্যিখানে ছোট্ট স্পিরিট আইল্যান্ড প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। হলুদ দ্বীপের কপালে মস্ত বড় সবুজ টিপের মতন এক গুচ্ছ পাইন গাছ। এ’দিকের ভূখণ্ড থেকে তিরতির করে জলস্রোত গিয়ে দ্বীপটিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আইল্যান্ডে যাওয়া যায় না। দূর থেকে কী সুন্দর লাগছে!
জ্যাসপারের প্রকৃতি রহস্যময়, বৈচিত্রে ভরা। এখানে এলেই আমরা স্পিরিট আইল্যান্ডে যাই। কী যেন একটা চুম্বকের আকর্ষণ আছে। প্রকৃতির নেশা একটা তীব্র আসক্তি! বোটে ঘুরে, তীরে ফিরেছি। লাঞ্চ সেরে ফিরবার পথে আবার একটা সমুদ্রসম বিশাল লেক (Medicine Lake)। ভরা গ্রীষ্মের গ্লেসিয়ার গলা জলে মেডিসিন লেক এখন কানায় কানায় পূর্ণ। পথের পাশে যেন ২০ কিমি দীর্ঘ এক আহ্লাদী গর্ভবতী নারী শুয়ে আছে । এখানে প্রাকৃতিক নামকরণের পিছনে নানা গল্প আছে। প্রত্যেক বছর শীতকালে মেডিসিন লেকের সব জল মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়। আবার মার্চে ফিরে আসে। আগে আদিবাসিরা ভাবত এই লেকে ভৌতিক রহস্য আছে, তাই নাম দেয় মেডিসিন লেক। অনেক চেষ্টায়, লেকের অতল গভীরে কোন ফাটল খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাহলে এই বিশাল লেকের জল কীভাবে অদৃশ্য হয়? ১৭ কিলোমিটার নীচে, আথাবাস্কা উপত্যকায় অনেকগুলো ঝরনা আছে। সম্ভবত সেখানে এই বৃহৎ প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ জল নিষ্কাষণী ব্যবস্থার নির্গমণ পথ। সেখানে ঢুকে ফাটল বন্ধ করা অসম্ভব। মেডিসিন লেক, আজও শীতকালে জলবিহীন, রহস্যময়।
এবারে আমাদের ঝটিকা সফর। ক’দিন আগে খেলতে গিয়ে ঋজুর শোল্ডার ডিসলোকেশান হয়েছে। কাঁধ থেকে স্লিং ঝুলছে। তিনি কিছুতেই উল্কাপাত দর্শন মিস করবেন না। “স্লিং আছে। খুব সাবধানে থাকব। প্লিস, প্লিস!” এই দর্শন নাকি আবার চার বছর পরে হলেও হতে পারে। অগত্যা…? পাইন বাংলোয় ফিরে তিনজনেই লম্বা দিয়েছি। উল্কাপাত দেখতে রাত জাগতে হবে। কাল সকালে আবার লম্বা ড্রাইভ, ফিরবার পালা।
এবার আসি “Dark Sky Preserve”-এর কথায়। বস্তুটি কী? জ্যাসপারে ৯৭% জায়গায় জনবসতি নেই। পার্কের ভিতরে তো কৃত্রিম আলোও নেই। তাই “preserve” তৈরি করাটা অন্য জায়গার থেকে সহজ। ঋজু আগে বলেছিল। এবার পরিষ্কার হোল। ২০১১ সালে the Royal Astronomical Society, Canada জ্যাসপারকে Dark Sky Preserve বলে ঘোষণা করেছে। তার মানে, এখানে আকাশ পুরোপুরি আলোক-দূষণ মুক্ত। পার্কস কানাডা, জ্যাসপারের মিউনিসিপালিটি, টুরিসম, চেম্বার অফ কমার্স, নানা প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগ শুরু করেছিল। সরকারি বিনিয়োগে বেশ কিছু বছর কাজ চলে। হাইওয়ের সব স্ট্রিট লাইট মাটির দিকে মুখ করা হয়েছে, যাতে আকাশে আলো ছড়াতে না পারে। কাছাকাছি জনবসতিগুলোকেও আলো-দূষণমুক্ত করা হয়েছে। জ্যাসপারের “Dark Sky Festival” এখন পৃথিবীবিখ্যাত। অক্টোবর মাসে সারা পৃথিবীর মানুষ এই উৎসবে আসে। রোজকার চেনা আকাশে যে মহাবিশ্বের কত অচেনা রহস্য লুকিয়ে আছে, এই উৎসবে তার আস্বাদ পাওয়া যায়।
জ্যাসপারে রাত্রিগুলো দিনের মতনই সুন্দর। আমি চুপচাপ মাথার উপরে এক স্বপ্নময় আকাশ জেগে উঠতে দেখছি। অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীর গল্পের মতন রাতের রানি হাজার তারার চুনি পান্না দিয়ে বহুমূল্য রেশমি শাড়ি বুনছে। বাড়ি থেকে এমন অপূর্ব তারা-ভরা আকাশ কখনই দেখিনি। বড় শহরে আলো এবং অন্যান্য দূষণ আকাশকে ঢেকে রাখে। তাই আপনার, আমার মতন প্রায় ৮০% মানুষকে তারা দেখতে দূরে যেতে হয়। যেখানে কৃত্রিম আলো নেই। অনেকদিন আগে টিকিট কাটা ছিল। জ্যাসপার পার্ক লজে এসেছি। খোলা মাঠে বিশাল তাঁবুর ভিতরে প্ল্যানেটোরিয়াম তৈরি হয়েছে। পাহাড়ে রাতে ঠান্ডা পড়ে গেছে। তাঁবুর ভিতরে heater চালিয়ে, ৫০ জনের অভিনব বসার ব্যবস্থা! রাত দশটায়, প্ল্যানেটোরিয়াম-তাঁবুতে বসে মহাবিশ্বের তারামণ্ডলের গল্প শুনলাম।
রাত বারোটায় পার্ক লজের কর্মীরা বাসে চড়িয়ে আমাদের মাটির থেকে নীচে মালাইন গিরিখাতের কাছে এনেছে। গোটা ১৫ টুরিস্ট আর Astronomical Society-র দুজন সদস্য। এঁরা আমাদের গাইড। নিকষ কালো অন্ধকারে, গিরিখাতের মধ্যে রাত্তিরের তীব্র ঠান্ডা মেখে বসে আছি। ধীরে ধীরে অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে যাই। সদ্য চাল ধোয়া আবছা জলের মতন, আশপাশের মানুষগুলোকে একটু একটু দেখতে পাচ্ছি। গুটিসুটি কম্বলে গা ঢেকেছে। গাইডরা খুব উন্নতমানের দূরবীন আর টেলিস্কোপ দিয়ে আমাদের জুপিটার, স্যাটার্নের রিং চিনতে শেখান। ওঁরা গ্রিক উপকথার সেই বিখ্যাত ভাল্লুকটিকে দেখান, যে মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। মহাবিশ্বে ১৪টা তারা মিলে ভাল্লুক তৈরি করেছে। লেজে Little Dipper, দেহে Big Dipper আর মাথার উপরে North Star. গাইডরা বলছেন যে সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চাষিরা তারা জুড়ে আকাশে ভাল্লুক, কুকুর, যোদ্ধা এইসব কল্পনা করেছে। একটা তারামণ্ডল বছরের বিশেষ ঋতুতে, আকাশে বিশেষ জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। তখন কোন ক্যালেন্ডার ছিল না। চাষিরা তারামণ্ডল দেখে কখন বীজ বুনবে বা ফসল কাটবে বুঝতে পারত।
গিরিখাতের মধ্যে জলপ্রপাতের শব্দ গভীরতর হচ্ছে। আজ আকাশ মেঘে ঢাকা। উল্কাপাত দেখতে পাওয়া যাবে না। ঋজুর মুখের ভাব দেখতে চেষ্টা করি। আহা, ও যে খুব আশা করেছিল। অন্ধকারে শুধু ওর কাঁধে সাদা স্লিং-এর আভাস দেখতে পাচ্ছি। এক আচেনা গিরিখাতে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বসে, মনের মধ্যে এক গভীর নিরাপত্তাবোধের জন্ম হয়। এই মুহূর্তে, জীবনের সব ভার আমি যেন কার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি। “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই— কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।”
ঘুমে দুচোখ জুড়িয়ে আসছে। চারপাশে কী হচ্ছে? চেতন-অচেতনের মাঝে বুঁদ হওয়াটা খুব উপভোগ করি। হঠাৎ আকাশে মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠল। গিরিখাতটা মধ্যরাতে পূর্ণ চন্দ্রের আলোতে ঝলসে ওঠে। এত তীব্র চাঁদের আলো আগে কখনো দেখি নি। “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত” আলোতে পুরোপুরি জেগে গিয়েছি। এই অপ্রাকৃতিক চাঁদের কাছে মনটা নতজানু হয়, “হে পূর্ণচন্দ্র, এ জীবনে যা পেয়েছি তা অসামান্য, তাই আমি জীবনের কাছে গভীর কৃতজ্ঞ।” এইবার হোটেলে ফিরবার পালা। কালকে যখন রোজকার জীবনে ফিরে যাব, তখন যেন এই কৃতজ্ঞতাটুকু মনের মধ্যে থেকে যায়।