‘Indian origin man claims son was killed by VIPS, Scotland Yard covered up murder.’
ডেইলি টেলিগ্রাফের হেডলাইনটায় আঙুল দেখিয়ে লিলি মানে আমাদের সুপরিচিত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির সুন্দরী এবং মুখরা
ধর্মপত্নী মিসেস লিলিয়ান ব্রিয়ারলি রোষ কষায়িত নেত্রে তার বাইরে বাঘ, ঘরে ভিজে বেড়াল স্বামীটিকে খালি বললেন, “ছিঃ ছিঃ, এতদূর অধঃপতন হয়েছে!”
মাইক, আমতা আমতা করে একটা কিছু উত্তর দিতে গেছিলেন, কিন্তু নিজের কানেই সেই ফিসফিস ধ্বনি ঠিক পৌঁছোল না। রবিবার সকালে জমিয়ে কফি সহযোগে খবরের কাগজে খেলার পাতাটা নিয়ে বসেছিলেন, আজ মাইকের একটু বেলায় বেরনোর কথা, লিলির মেজাজ দেখে বুঝলেন, গেল সব মাটি হয়ে। খেলার পাতা ছেড়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শ্রাদ্ধ করে দেওয়া ভারতীয় ব্যবসায়ী বিশাল মালহোত্রর, ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেওয়া ইন্টারভিউতে মন দিলেন। ইন্টারভিউটা পড়তে পড়তেই রবার্টসনের ফোনটা এল, মাইক বললেন আমি এখনই পৌঁছচ্ছি।
আমি বললাম, “অধীরদা এ তো মারাত্মক ব্যাপার, বিশাল মালহোত্র গুরুতর অভিযোগ এনেছেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা টনি অ্যাডামস সম্বন্ধে যেটুকু পড়েছি, তাতে তো তিনি অতি দক্ষ প্রশাসক এবং কড়া ধাতের মানুষ বলেই পরিচিত, আর তার হাতে আছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইতিহাসের চতুরতম গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি, তার তরুণ উদ্যোমি সহযোগী রবার্টসন এবং অন্যান্য দক্ষ অফিসাররা। শেষে ব্রিয়ারলিও কি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন! মুখ দেখে কাউকে বোঝার উপায় নেই তা হলে? অবশ্য মাইক ব্রিয়ারলির মুখই বা পাঠক কবে দেখেছেন? তার মাঝারি উচ্চতা, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, পোশাক পরিচ্ছদ বা হাঁটা চলা তেমন নায়কোচিত নয়, কবিতা পাগল (প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘লিলির সঙ্গে অলিগলি’-নিজে একশো কপি কেনা ছাড়া, একটাও বিক্রি না হবার পর, একটু দমে গেছেন, বিনা পয়সায় সেই একশো কপি অবশ্য বিলি করতে পেরেছেন, তাই বা কম কী!), বউকে ভয় পায়। বিশেষত্বর মধ্যে চওড়া চোয়াল আর অতি উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, এর বাইরে লোকটার সম্বন্ধে, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’ কোনওদিন কিছু লেখেনি।” উত্তেজিত ভাবে একটানা কথাগুলো বলে দম নিতে থামলাম, দেখলাম অধীরদা ওঁর ট্রেডমার্ক মিটিমিটি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। গতকাল রাতেই অধীরদা ফোনে বলে দিয়েছিলেন, ডাবলিন থেকে দ্য ইনভেস্টিগেটরের লেটেস্ট কপিটা এসে গেছে আর তাই রোববার সকালে মাইক ব্রিয়ারলির গোয়েন্দাগিরির টানে বাজারটা বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই এসে জুটেছি অধীরদার বৈঠকখানায়। কাহিনির শুরুতেই এ হেন গোয়েন্দাই যদি অভিযুক্তের কাঠগড়ায় থাকেন তবে মাথার ঠিক থাকে?
অধীরদা বললেন, “অতনুদা গল্পের গোয়েন্দার চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থাকে, তার ম্যানারিজম পাঠকের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে গোয়েন্দার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, গোয়েন্দার বৈঠকখানা ঘরটিও একটা চরিত্র হয়ে ওঠে বটে, মক্কেলরা সব সেখানেই এসে তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে গোয়েন্দাটির হাতে তদন্তভার তুলে দেন, আর তার সহকারী সেইসব কেস লিপিবদ্ধ করে পাঠকের দরবারে পেশ করেন, এই সহকারীরা সকলেই এক একজন সাহিত্যিক আর কী! মাইক ব্রিয়ারলি তো গল্পের গোয়েন্দা নন, তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা। তা আপনি কোথাও দেখেছেন নাকি যে কোনও পুলিশ কেসে পুলিশ অফিসারের চেহারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে? তিনি পাইপ খান, না মাথার বাঁ দিকে সিঁথি করেন তাতে কী আসে যায়? মাইক ব্রিয়ারলিকে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ তার বৈঠকখানায় এসে কোনও রহস্য উদঘাটনের তদন্তভার তুলে দেয় না, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড যে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব তাকে দেয়, তিনি সেটাই পালন করেন মাত্র।
মাইক ব্রিয়ারলির সহকারী রবার্টসন সাহিত্যিক নয়, সে কোনওদিন ব্রিয়ারলির রহস্য উদঘাটন প্রণালী নিয়ে বই লিখবে না, মাইকের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী মন, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে সে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু সে মোটেই গল্পের গোয়েন্দার সহকারীর মতো মাইক ব্রিয়ারলির ভক্ত নয়, বরং মাইক তার উপরওয়ালা বলে এবং দক্ষতায় অনেক এগিয়ে বলে একটু পেশাদারি অসূয়াও আছে, কর্মক্ষেত্রে যা হয়। ডাবলিনের পত্রিকা, ‘দ্য ইনভেস্টিগর’-এর রিপোর্টারদের কাছে মাইকের উদ্ভট কবিতা এবং পত্নীভীতির কথা রবার্টসনই রটিয়েছে বলে সন্দেহ হয় এবং তাতে বেশ কিছু রং মেশানো থাকতে পারে। আপনিও মাইক পত্নী লিলির মতো পুরো ঘটনাটা না জেনেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেলেছেন, কারণ আপনারা দু’জনেই মাইক ব্রিয়ারলিকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, তার সামান্য বিচ্যুতি আপনারা সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, মাইক ব্রিয়ারলি প্রখর বুদ্ধিমান হলেও রক্ত মাংসের একজন মানুষ, অতি নাটুকেপনা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা,
আর প্রশংসা পেতে চাওয়ার রোগ মুক্ত নন। তবে আপনার আশঙ্কার কারণ নেই, আমি কাল রাতেই কৌতূহল দমন করতে না পেরে কেসটা কিছুটা পড়েছি, বিশাল মালহোত্র যে অভিযোগ করেছেন তা অনেক পুরনো ঘটনা, তার সঙ্গে মাইক ব্রিয়ারলি বা টনি অ্যাডামসের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার হিসেবে দায় তাদেরও আছে, মাইক ব্রিয়ারলি সেই দায়ভার থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে মুক্ত করতে পারেন কি না সেটাই দেখার। চলুন দেখা যাক রবার্টসন কেন মাইককে ফোন করল। টনি অ্যাডামসের নির্দেশেই যে ফোন তা বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘটনা যে দিকে মোড় নিয়েছে তাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা তদন্তভার তার সেরা অস্ত্রের হাতেই তুলে দেবেন বুঝতে কোনও অনুমানের দরকার নেই।” আমি মনে মনে স্বীকার করলাম, কেন অধীরদা রহস্য কাহিনির এনসাইক্লোপিডিয়া, যে দক্ষতায় তিনি পুরো ব্যাপারটা বর্ণনা করলেন, তাতে তিনিও যে দক্ষ গোয়েন্দা হতে পারতেন তাতে সন্দেহ নেই। ঘটনাটা কী সেটাই জানবার জন্য এখন উশখুশ করছি।
উশখুশটা একটু দীর্ঘায়িত হলেও তেমন আফসোস হল না। নন্দিতা বৌদি মানে অধীরদার স্ত্রী গরম গরম ফুলকো ফুলকো দুধ সাদা লুচির সঙ্গে আলুর ছেঁচকি যা পরিবেশন করেছিলেন, তাতে নিরুপায় আমি গোটা দশেক লুচি সাবড়ে তবে থামলাম, এখন বসেছি গরম কফির পেয়ালা হাতে ঘটনার ঘনঘটা কোন দিকে অগ্রসর হয় তা জানার জন্য।
অধীরদা পড়া শুরু করলেন, “বিশাল মালহোত্রর আটবছর বয়সী ছেলে ২৮শে জুলাই, শনিবার, ২০০১-সকাল দশটা নাগাদ, উইন্ডসর ক্যাসেলে কোনও একটা অনুষ্ঠান দেখতে বার্কশায়ারে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে উধাও হয়ে যায়। উইন্ডসর ক্যাসেল বার্কশায়ারেই অবস্থিত, সুশীল মালহোত্র মানে বিশালের ছেলে, অনেকবার আগেও একা উইন্ডসর ক্যাসেলে গেছে। পুলিশ সুশীলকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়। সপ্তাহ দুয়েক বাদে বিশাল এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের ফোন পান, যুবকটি তার পরিচয় গোপন রাখে, শুধু বলে সে একজন পুরুষ যৌন কর্মী এবং সুশীলকে বাচ্চাদের যৌন নির্যাতনকারী (Paedophiles)
একটা গ্যাং অপহরণ করেছে, এদের ক্লায়েন্টরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং অভিজাত ব্রিটিশরা এতে জড়িত। বিশাল ওই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের সাথে তার কথোপকথন টেপ করে রেখেছিলেন এবং প্রায় কুড়ি মিনিটের টেপটি তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেন। যুবকটির গলা শুনে বিশালের মনে হয় তার বয়স বছর ২০-২৫ হবে। যুবকটি কিন্তু কোনও প্রভাবশালীর নাম বলতে অস্বীকার করে, নিজের প্রাণ বাঁচাতেই সে ঝুঁকি নিতে চায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এই কেসের কোনও কিনারা করতে পারেনি, সুশীল উধাও হবার তিন সপ্তাহ বাদে, ১৮ই অগস্ট সমারসেটের একটা জলার ধার থেকে সুশীলের দেহ পাওয়া যায়।
পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়, ‘সুশীলের উপর যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।’ ইস্ট সমারসেট করোনার, ‘পিয়ার্স মুর’ সুশীলের মৃতদেহ inquest করার পর এটি একটি খুনের ঘটনা বলে রায় দেন।” অধীরদা একটা সিগারেট ধরাতে থামলেন। আমি বললাম, এ তো মারাত্মক ব্যাপার, তিন সপ্তাহ ধরে একটা আট বছরের বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে গেল, একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সে সম্বন্ধে ফোন করে কিছু সূত্র দিল, তারপরেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কিছু করতে পারল না এবং বাচ্চাটিকে শেষ পর্যন্ত খুন হতে হল। বিশাল মালহোত্রর অভিযোগের যথেষ্ট সারবত্তা আছে, আচ্ছা এত বছর বাদে এই ঘটনা আবার সংবাদের শিরোনামে উঠে এল কেন? রবার্টসন কেন মাইক ব্রিয়ারলিকে ফোন করল সেটা এখনও খোলসা করলেন না।
অধীরদা বললেন, “এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে, অর্থাৎ যে সময় সুশীল অপহৃত হয়, Paedophiles দের উপস্থিতি এবং কার্যকলাপ নিয়ে লন্ডন তোলপাড় হয়, ব্রডস্ট্রীট অঞ্চলের দু’টি হোটেলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, পুলিশ একাধিকবার এইসব হোটেলে হানা দিয়ে কিছুই পায়নি, বিবিসি আলাদা করে অনুসন্ধান চালিয়ে বলে এটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়। কোনও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া বাচ্চার খোঁজ পুলিশ পায়নি, শিশু অপহরণের সামান্য কিছু ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, সেগুলো সবই মুক্তিপণের সঙ্গে যুক্ত, পুলিশের মতে আসলে এ গুলো অপরাধ জগতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিশেষ করে ড্রাগসের কারবারীদের অন্তর্কলহের ফল, একে অপরকে জব্দ করে কাজ হাসিল করতে বাচ্চা অপহরণ একটা প্রধান অস্ত্র। খুব সামান্যই এ সব পুলিশে রিপোর্ট হয়। আর একটা কথা উল্লেখ করব, সেই সময় পুলিশ বা বিশাল মালহোত্র কোনও পক্ষই সেই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের কথা প্রকাশ্যে আনেননি, যুবকটির নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত এবং এখনও বিশাল মালহোত্র সেই অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ যৌনকর্মীর কথা সাংবাদিকদের সামনে বলেননি, সেই সংযম এবং কৃতজ্ঞতা তিনি বজায় রেখেছেন। এটা একেবারেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
১১ই জুন, ২০২১ তারিখে, এক ভদ্রলোক পুলিশে অভিযোগ জানান তার
বছর দশেকের ছেলেকে দক্ষিণ লন্ডনে একা উদভ্রান্তর মতো ঘুরতে দেখে এক সহৃদয় ব্যক্তি ছেলেটিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান। ছেলেটির বাড়ি কেন্টের চিলহ্যামে, তাকে সেখান থেকে সেইদিন সকালেই অপহরণ করা হয় এবং তাকে একটি বাড়িতে তোলা হয়, সেখানে একজন মাঝবয়সী লোক তার বয়সী একটি বাচ্চা ছেলের উপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছিল, সেটা জানলার ফাঁক দিয়ে সে দেখে ফেলে।
এরপর সে নিজেই ফাঁকতালে ওখান থেকে পালিয়ে যায়। বাচ্চাটি কোন বাড়িতে তাকে অপহরণ করে রাখা হয়েছিল তার কিছুই বলতে পারেনি, এমনিতেও সে লন্ডনের রাস্তাঘাট বিশেষ চেনে না।
যে অজ্ঞাতপরিচয় সহৃদয় ব্যক্তি বাচ্চাটিকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যান, তিনিই নাকি বাচ্চাটিকে বলেন সে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেটি দক্ষিণ লন্ডনে অবস্থিত। এই ঘটনা সামনে আসতেই বিশাল মালহোত্র স্বভাবতই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে তুলোধনা করে বলেছে বাচ্চাদের যৌন নির্যাতনের চক্র প্রবল ভাবে সক্রিয় সেটা প্রমাণ হয়ে গেল এবং তার ছেলেকে এরাই হত্যা করেছিল, সব জেনেশুনে প্রভাবশালীদের আড়াল করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। পুলিশের বক্তব্য, বাচ্চাটির বাবার বয়ানে যথেষ্ট অসঙ্গতি আছে এবং বাচ্চাটি খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না। বাচ্চাটি অপহরণের ঘটনা কিন্তু তার বাড়ির লোক পুলিশে জানায়নি, জানিয়েছে সে ফিরে আসার পরে।
অতনুদা চলুন এবার দেখা যাক রবার্টসনের ফোন পেয়ে ব্রিয়ারলি কোথায় গেলেন, আমরা ঘটনাস্থলে ঢুকে পড়ি।”
সাসেক্স থেকে পশ্চিমে হ্যাম্পশায়ার যাওয়ার রাস্তায় একটা মাঠের ভিতরে মাইক যখন রবার্টসনের কথা মতো পৌঁছলেন, তখন দেখলেন বড়কর্তা টনি অ্যাডামস স্বয়ং উপস্থিত, একজন পুলিসকর্মী ঢাকা দেওয়া কাপড়টা সরিয়ে লাশটা মাইককে দেখাল, একটা বাচ্চার হাত, পা, মাথা কিছুই নেই, শুধু ধড়টুকু আছে, পুলিশের ডাক্তারের মতে, বাচ্চাটির বয়স ৯-১০ হবে।ব্রিয়ারলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই লাশ পরীক্ষা করে রবার্টসনকে বললেন দ্রুত পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করতে। টনি অ্যাডামসকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল, তিনি মাইক এবং রবার্টসনকে তার গাড়িতে উঠতে বললেন। ফেরার রাস্তায় তিনি মাইককে বললেন, “বুঝতে পারছ ব্রিয়ারলি, কাল সকালে পুরো ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। লাশটা দেখে তো কিছুই বোঝার উপায় নেই, পরশুদিন যে ছেলেটা অপহৃত হয়েছিল, সে আরও একটা বাচ্চার কথা বলেছিল, মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা পালানোতে অপহরণকারীরা কোনও ঝুঁকি না নিয়ে অন্য বাচ্চাটাকে খুন করেছে, তার পরিচয় গোপন করতে হাত, পা, মাথা কেটে নিয়েছে। তোমার কী মনে হয়? তুমি কোথা থেকে তদন্ত শুরু করতে চাইছ?” মাইক বললেন, “স্যার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না সেটা বলতে পারি না, মৃতদেহ সবসময়ই কথা বলে, এখানেও বলছে। আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভ থেকে কাজ শুরু করতে চাই, বিশাল মালহোত্র যে টেপের কথা বলেছেন সেটা শুনতে হবে, ফরেন্সিক রিপোর্ট চলে আসার আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লাইব্রেরিতেও একটু সময় কাটাতে হবে। একবার চিলহ্যামে যেতে হবে উদ্ধার হওয়া বাচ্চাটার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা দরকার। তার আগে পুলিশ যে তার বয়ান নথিবদ্ধ করেছে, সেটাও দেখতে হবে।” রবার্টসন বিড়বিড় করে ওঠে, “শুরু হল বুড়ো ছুঁচোর নাটক, লাশ পাওয়া গেল এখন, কুড়ি বছর আগের টেপ শুনতে আর্কাইভে যাবে, সবসময় নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার ধান্দা, বসকে দেখাচ্ছে কত বুদ্ধিমান।” টনি অ্যাডামস বললেন, “যা ভাল বোঝো ব্রিয়ারলি।” মুখে বললেন, “জানি তুমি সবসময়ই বিচিত্র পথে তদন্ত করো, তবে আর্কাইভে গিয়ে একটা পুরনো টেপ শুনে কী করবে আর লাইব্রেরিতে বসে খুনের তদন্ত কী করবে বুঝতে পারছি না।” মুখে যেটা বললেন না, সেটা হল মাইক ব্রিয়ারলির মতো বিচিত্র জীব তিনি জীবনে দেখেননি।
তিনদিন বাদে যখন রবার্টসন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লাইব্রেরিতে ঢুকল তখন মাইক মন দিয়ে একটা ছড়ার বই পড়ছিলেন। দেখে পিত্তি জলে গেল রবার্টসনের, শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল আর বিড়বিড়িয়ে গালাগাল দিয়ে উঠল, “শালা বুড়ো ছুঁচো, এখানে বসে কাব্যচর্চা করছে আর আমাকে দৌড় করাচ্ছে কোথায় কোথায় ৮-১০ বছর বয়সী এশীয় বাচ্চার এক সপ্তাহের মধ্যে মিসিং ডায়রি হয়েছে তার খোঁজ করতে, সেইসব কেসের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট তৈরি করতে।”
মাইক, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন, “সেরকমই তো হবার কথা। রবার্টসন তুমি ফরেন্সিক টক্সিকোলোজির ব্যবস্থা করো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই রিপোর্ট আমার চাই। এখন বলো ওই এশীয় বাচ্চাদের মিসিং ডায়রি কতগুলো হয়েছে?” রবার্টসন বলল, “গত এক সপ্তাহে তিনজন ৮-১০ বছর বয়সী এশীয় বাচ্চা নিখোঁজের ডায়রি জমা পড়েছে। এর মধ্যে আমি চিলহ্যামের বাচ্চাটিকে ধরছি না। আর মিসিং ডায়রি যা হয়েছে তা হয় ওই বয়সী বাচ্চাদের নয়, নয়তো তারা এশীয় বংশোদ্ভূত নয়। এই ফাইলে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তা বস, ছড়ার বইতে কী রহস্যর খোঁজ করছিলেন সেটা জানতে পারি? আমি তো পুরো অন্ধকারে।”
রবার্টসন খোঁচা মারার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
“তা বলতে পারো রবার্টসন, অন্ধকারের কথাটা নেহাত মন্দ বলোনি, একে অন্ধকারের ছড়া বা প্রবাদ বলতেই পারো। তবে এখন চিলহ্যাম যেতে হবে, আশাকরি, চিলহ্যামের ঘটনা পুরো খতিয়ে তোমার দেখা হয়ে গেছে।
লাঞ্চটা আগে সেরে নিই চলো। ছড়া পরে হবে।”
অধীরদা বললেন, “বলেছিলাম না অতনুদা, ব্রিয়ারলি অতি নাটুকেপনার মোহ ছাড়তে পারেন না, নিজের ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন দু’পক্ষকেই অন্ধকারে রেখে শেষে গিয়ে ওঁর আস্তিনের তাসগুলো দেখানোর একটা নেশা ব্রিয়ারলির আছে।”
আমি বললাম, “সে আপনি যাই বলুন অধীরদা। মাইকের প্রত্যেক কথার কিন্তু একটা গভীর অর্থ আছে, সেটা মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। গোয়েন্দাপ্রবর প্রখর মস্তিষ্কের অধিকারী, ভগ্নাংশের কম সময়ে কর্তব্য ঠিক করে নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিলম্ব করেন না।”
অধীরদা শুধোলেন, “যেমন?”
আমি বললাম, “উদ্ধার হওয়া বাচ্চার মৃতদেহটি দেখে মাইক এমন কিছু টের পেয়েছে, যাতে করে তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভ এবং লাইব্রেরিতে থেকে তদন্তের কাজ শুরু করেছেন, মোটেই তিনি এমনি এমনি ছড়ার বই পড়ছিলেন না, ওটা বিশেষ কোনও বই হতে বাধ্য, যার সঙ্গে এই কেসের সংযোগ রয়েছে, রবার্টসনের সে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নেই বলে ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। বিশাল মালহোত্রর জমা দেওয়া কুড়ি বছরের পুরনো টেপ শোনাও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। আট-দশ বছরের এশীয় বাচ্চাদের নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে জানতে চাওয়ারও কারণ আছে, রবার্টসন বলেছে ওই তালিকায় চিলহ্যামের বাচ্চাটিকে রাখেনি। তার মানে পরিষ্কার সেও এশীয় বংশোদ্ভূত, সম্ভবত সে যে আর একটি বাচ্চার উপর যৌন নির্যাতন হতে দেখেছে, সেও এশীয়, বিশাল মালহোত্রর ছেলেও তাই ছিল। অর্থাৎ একটা প্যাটার্ন মাইক খুঁজে পেয়েছেন।”
অধীরদা বললেন, “ব্র্যাভো অতনুদা, সঙ্গে আমি কিছু যোগ করি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেই মাইক রবার্টসনকে বলেছেন, ফরেন্সিক টক্সিকোলজির ব্যবস্থা করতে, এটা করতে হয় শরীরে নির্দিষ্ট বিষ বা ড্রাগসের উপস্থিতি জানার জন্য, সেরকম কিছুর ইঙ্গিত পোস্টমর্টেমে আছে নিশ্চয়ই, তাই মাইক সঠিক বিষের কথা জানতে চাইছেন, আমার ধারণা তিনি সেটা বুঝতেও পেরেছেন। আগে ফরেন্সিক টক্সিকোলজিতে অনেক সময় লাগত, এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো সংস্থা আধুনিকতম ল্যাবে সেরা বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে এই রিপোর্ট দ্রুত বার করে ফেলবে। চলুন, মাইকরা চিলহ্যামে সেই বাচ্চাটির বাড়িতে পৌঁছে গেছে, দেখি সেখানে কী কথোপকথন হয়।”
মি: নরেশ সিং, কেন্টের একটি শপিং মলের স্টোরে কাজ করেন। বিকেল চারটে নাগাদ যখন মাইক আর রবার্টসন তার বাড়িতে পৌঁছোল, তখন তিনি রবার্টসনের নির্দেশ মতো বাড়ি চলে এসেছেন, খুবই বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “আপনাদের জন্য কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল, আজ আমার ছুটি নেই, সবে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসছে, এই সময় ম্যানেজার তো ছুটি দিতেই চাইছিল না।”
মাইক বললেন, “যাতে আপনার কাজের কম ক্ষতি হয়, সেটা দেখা আপনারই দায়িত্ব। আপনি পুলিশে একটা অভিযোগ জানিয়েছেন কিন্তু প্রচুর মিথ্যা বলেছেন বলে পুলিশের অনুমান। আপনি নিশ্চয়ই চান বাচ্চারা যাদের লালসার শিকার, তাদের শাস্তি হোক। আপনার ছেলে যতই বুদ্ধিমান হোক, সে নিজে অপহরণকারীদের ডেরা থেকে পালিয়ে এসেছে সেটা গল্প হিসেবে অত্যন্ত কাঁচা।
আপনার বাচ্চাকে যিনি বাঁচিয়েছেন তাকে আড়াল করতেই আপনি মিথ্যা বলেছেন, কিন্তু ভেবে দেখুন, তিনি সব বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবেন না আর তিনিও চান অপরাধী ধরা পড়ুক। যত কম বার আপনি জেরার সম্মুখীন হবেন, তত আপনার কাজের ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে। আমার নাম, ‘মাইক ব্রিয়ারলি’ এবং আমার সঙ্গী, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিখ্যাত গোয়েন্দা, ‘অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন।’ আপনি হয়তো আমাদের নাম শুনে থাকবেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার ছেলেকে যিনি বাঁচিয়েছেন আমরা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব, এখন তাকে খুঁজে বার করতে আপনার সাহায্য দরকার। নয়তো অপরাধীদের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়।” একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নরেশ বললেন, “কিন্তু আমি তো তাকে চিনি না।” মাইক বললেন, “আমরা চিনতে সাহায্য করছি। আপনি, আপনার ছেলে অপহরণের কথা পুলিশকে জানাননি, অভিযোগ জানিয়েছেন সে ফিরে আসার পরে। কারণটা হল ১১ই জুন, স্কুল যাওয়ার পথে আপনার ছেলে অপহৃত হয়।
তার স্কুল লকডাউনের পরে, জুনের ১ তারিখেই খুলে গেছিল। আমরা খোঁজ নিয়েছি ১০ বছরের একটি ছেলের হাঁটা পথে ওই স্কুলে পৌঁছতে মিনিট ১২ লাগার কথা। সেদিন পথেই তাকে অপহরণ করা হয়, সেটা আপনার ছেলে আগেই বলেছে। এখান থেকে লন্ডন গাড়িতে যেতে লাগে এক ঘন্টার কিছু বেশি সময়, তাকে লন্ডনে নিয়ে পৌঁছনোর মোটামুটি ঘন্টা খানেকের মধ্যে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ফোন পেয়ে বেলা ১১ টা নাগাদ লন্ডনের উদ্দেশে আপনারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রওয়ানা দেন। আপনার কর্মক্ষেত্র থেকে সে খবর আমরা জেনেছি। যে অ্যাপ ক্যাব আপনারা বুক করেছিলেন তার নম্বর এবং সেটি কোথায় আপনাদের ড্রপ করে, তার কিছুই আমাদের অজানা নয়।
বাকিটা আপনি বললে আমাদের সুবিধা হয়।” নরেশ বললেন, “আমি যা জানি, তা সত্যি বলব।
আমার ছেলের স্কুল শুরু হয় সকাল ৯টায়, সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আনুমানিক তার মিনিট কুড়ি আগে। সে একাই স্কুলে যায়, স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে ফুটপাথও বদল করতে হয় না।
আমরা স্বামী-স্ত্রী বাড়ি থেকে বেরোই সকাল ৯.৩০ নাগাদ, দু’জনেই এক শপিং মলের ভিন্ন ভিন্ন স্টোরে কাজ করি। আমার ছেলে বাড়ি ফেরে ৪.৩০ নাগাদ এবং বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে আমাদের ফোন করে সেটা জানিয়ে দেয়, ওর কাছে মোবাইল নেই। তার আগে স্বভাবতই আমাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় না। আমাদের সংসার মোটামুটি চলে যায় তবে এমন অবস্থা নয়, যে ছেলের জন্য গভর্নেস রাখতে পারি, তার প্রয়োজনই বা কী? দশ বছরের একটি ছেলে নিজের দেখাশোনা করতে পারে, আমার ছেলে সুরেশ খুবই স্মার্ট, সে নিজেকে সামলাতে জানে। অপহরণের ঘটনার পরেও আমি তাই বলব, সে ছেলে মোটেই ঘাবড়ায়নি।
যাইহোক সেইদিন প্রায় ওই ১১টা নাগাদই এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি আমাকে ফোনে করে বলে, আপনার ছেলের থেকে আপনার মোবাইল নম্বর পেয়ে আপনাকে ফোন করছি, সে Paedophiles দের খপ্পরে পড়েছে, তাকে অপহরণ করে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে দুপুরে একটা পার্টি আছে, সেখানে ওকে ব্যবহার করা হবে, আপনি ১টার আগে আসতে পারলে ওর কোনও ক্ষতি হওয়ার আগে ওকে ঠিক এখান থেকে বার করে দেব। নয়তো আপনার ছেলে হয়তো যথাসময়ে বাড়ি ফিরবে, কিন্তু ওর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি এবং আমার স্ত্রী একটা ক্যাব বুক করে ওই ভদ্রলোকের বলে
দেওয়া জায়গায় সাউথ লন্ডনের নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি, আমাদের পক্ষে সেই ব্যক্তিকে ফোন করা সম্ভব হয়নি, যেহেতু সে পাবলিক ফোন থেকে কল করেছিল। কিছুক্ষণ বাদে আমরা আবার তার ফোন পাই, হতে পারে সে আমাদের আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল বা সময় আন্দাজ করে ফোন করেছিল।
লোকটি খুব দ্রুত কথা বলছিল এবং বলেছিল আপনার ছেলের কোনও ক্ষতি হয়নি, এখনই আপনার ছেলেকে পেয়ে যাবেন আর ওকে নিয়ে লন্ডন থেকে বেরিয়ে যাবেন, এরা খুব প্রভাবশালী লোক, নয়তো সমস্যা হবে। মিনিট পনেরো বাদে দেখি ফুটপাথ ধরে আমার ছেলে দৌড়ে আসছে। তারপর আমরা ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে পুলিশকে ফোন করি। এই হল আমাদের আসল কাহিনি।” মাইক বললেন, “মোটামুটি ঠিক আছে, তবে কিছু জিনিস লুকিয়ে গেছেন, পুলিশের কাছে যে গল্পটি সেদিন ফেঁদেছিলেন, সেটি আপনার অজ্ঞাতপরিচয় বন্ধুর বলে দেওয়ার সম্ভাবনা, আপনি কিছু হয়তো যোগ করেছিলেন। তবে আপনি অ্যাপ ক্যাব থেকে ঘটনাস্থলের আগেই নেমে গিয়ে যে কিছুটা পথ হেঁটে গেছিলেন, সেটি পুরোপুরি আপনার বন্ধুর অবদান, সে আশঙ্কা করেছিল, পুলিশ অ্যাপ ক্যাব ট্র্যাক করে ফেলবে। তারপর অকুস্থল বার করা খালি সময়ের অপেক্ষা এবং আপনার বন্ধুটির পরিচয় তাতে আর গোপন থাকত না এবং তার প্রাণ সংশয় হওয়া মোটেই বিচিত্র ছিল না।
ট্রেনে এলে ব্যাপারটা এড়ানো যেত, কিন্তু তখন অত হ্যাপা পোহানোর মানসিকতা আপনাদের ছিল না। কৃতজ্ঞতা থেকে আপনি এ টুকু করতেই পারেন। আপনার ছেলের সঙ্গে আমি আলাদা করে কথা বলব, ওকে ডাকুন।”
রবার্টসনের মনে হল, আজ একটু বসের পায়ের ধুলো নেওয়া উচিত। শুধু অপরাধী নয়, অপরাধের শিকার হওয়া মানুষের মনস্তত্ত্বও মাইক ব্রিয়ারলি এত ভাল বোঝেন যে লক্ষ্যে পৌঁছতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয় না। গাড়িতে উঠে রবার্টসন বলল, “বস, আপনি বোধহয় জুরাসিক এজের অপরাধেরও কিনারা করে ফেলবেন, এ তো বছর কুড়ির আগের ঘটনা, আগেও এ রকম অনেক করেছেন। তবে আর একটু খুলে বললে আমার কাজ করতে সুবিধা হয়। সবাই তো আপনার মতো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মালিক নয়।” মাইক কিন্তু এত প্রশংসায় স্বভাবসিদ্ধ বিগলিত হলেন না, বললেন, “রবার্টসন, নরেশ সিং কেন্ট পুলিশকে যে বয়ান দিয়েছিল, তার অসঙ্গতি ধরতে বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই। সে ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছি। সুশীল মালহোত্রকে অপহরণ করেছিল Paedophiles গ্যাং, সুরেশ সিংকেও তাই। এদের দু’জনের বাবাকেই একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোন করে খবর দেয়। আমার খটকা লাগে এরা আসলে একই ব্যক্তি হতে পারে। বিশাল যে টেপ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে জমা দিয়েছিল, সেটা শুনতে গিয়ে আমি লক্ষ করি কুড়ি মিনিট কথোপকথনে অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তি মোট একানব্বই বার, ‘okay’ শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এটি তার মুদ্রাদোষ। প্রথম চিন্তা ছিল, ব্যক্তিটি অভিন্ন হলেও সেই মুদ্রাদোষ কী কুড়ি বছর বাদেও বজায় আছে? যদি ধরে নিই, সে যখন বিশাল মালহোত্রকে ফোন করেছিল, তখন তার বয়স ছিল কুড়ি, তা হলে এখন তার বয়স চল্লিশ, গলার স্বর খুব একটা বদলাবে না, কারণ কুড়ি বছর বয়সে একজন যুবকের গলা তৈরি হয়ে যায়, বার্ধক্য আসার আগে সেই স্বর পরিবর্তন হয় না। বড়জোর চেহারা ভারী হয়ে গেলে স্বর কিছুটা ভারী হতে পারে, একজন যৌনকর্মীর চেহারার দিকে নজর রাখতে হয়, সুতরাং সে সম্ভাবনা কম। কিন্তু টেপ শুনে নরেশ বা সুরেশ অল্প সময় কথা বলা একজনের গলা সঠিক ভাবে চিনতে পারবেই সেটা গ্যারান্টি দেওয়া যায় না, মনে রাখতে হবে সেই সময় তারা প্রবল উৎকন্ঠার মধ্যে ছিল। ভরসা করেছিলাম ওই প্রবল মুদ্রাদোষ কাটানো মুশকিল এবং সেটাই ঠিক প্রমাণিত হল, টেপ করা কথোপকথন শুনে নরেশ সেটা চিনতে পারল। আমার আর একটা ভয় ছিল, কুড়ি বছর আগে সুশীল মালহোত্রর অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে যা তোলপাড় হয়েছিল, তাতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিটি বিশাল মালহোত্রর সংযম সত্ত্বেও পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিল কি না, বিশালের অভিযোগ অনুযায়ী যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্তকারী অফিসাররা অপরাধীদের আড়াল করতে চাইত, তবে সেখান থেকেও ওই ব্যক্তির পরিচয় বেরিয়ে যেতে পারত। যার একটাই পরিণাম, মৃত্যু।
এখন নিশ্চিত করে বলা যায় সেই তদন্তকারী অফিসাররা কর্তব্যে চূড়ান্ত গাফিলতি করলেও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল না। তা রবার্টসন, তোমার তো কর্তব্যে গাফিলতির কোনও নিদর্শন নেই, লন্ডন শহরে একজন বছর চল্লিশের পুরুষ যৌনকর্মী, যার ক্লায়েন্টরা সব তথাকথিত নীল রক্তের অভিজাত শ্রেণির, যার নাকি কথায় কথায়, ‘okay’ বলার মুদ্রাদোষ আছে, সে তোমার কাছে কত ঘণ্টা পরিচয় গোপন করে থাকতে পারবে? কালকের মধ্যে তাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আমার অফিসে হাজির করবে, তারপর দেখি কার রক্ত কত নীল। ফরেন্সিক টক্সিকোলজির রিপোর্টও তো দু’-তিন দিনের মধ্যে হাতে পাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে এই রহস্যের যবনিকা পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
অধীরদা আর আমি একটা কফিব্রেক নিলাম, সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অধীরদা বললেন, “রবার্টসন যতটা কৃতিত্বের ভাগীদার, তার কিয়দংশ, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর কলমচি কিন্তু তাকে দেন না। মাইক ব্রিয়ারলির লার্জার দ্যান লাইফের ছবি যত তুলে ধরা যায়, ততই ওদের কাগজের বিক্রি বাড়ে। মি: ব্রিয়ারলির দক্ষতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে, তবু দৌড়-ঝাঁপের কাজই শুধু নয়, মাইক ব্রিয়ারলির নির্দেশ কাজে পরিণত করতে রবার্টসনকে যথেষ্ট বুদ্ধিও খরচ করতে হয়, রবার্টসনের ইনফর্মার বেস দুর্দান্ত, সেটা কাজে লাগিয়েই সে অজ্ঞাতপরিচয় সাহায্যকারীকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে হাজির করবে। ইদানীং কালের নিঁখোজ এশীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চাদের সম্বন্ধেও তার নিখুঁত রিপোর্ট তৈরি। হাতে চলে এসেছে ফরেন্সিক টক্সিকোলজির রিপোর্ট।
চলুন দেখা যাক ব্রিয়ারলি আর রবার্টসন কেন ল্যাঙ্কাশায়ারে শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ী মি: ডিসিলভার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ডিসিলভার ছেলে এখনও নিখোঁজ।
মিসেস ডিসিলভা বললেন, তার স্বামী, মি: দাসুন ডিসিলভা ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গেছেন। ভদ্রমহিলাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল, স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, একটা দশ বছরের ছেলের যদি ছ’দিন ধরে কোনও খোঁজ না পাওয়া যায় তবে মায়ের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এই সময় ব্রিয়ারলির সঙ্গে মিসেস ডিসিলভার কথোপকথনটা বরং আমরা এড়িয়ে যাই, সোজা ঢুকে পড়ি তার তিন দিন বাদে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কনফারেন্স রুমে, যেখানে বড়কর্তা টনি অ্যাডামস ছাড়া উপস্থিত আছেন মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসন, বিশাল মালহোত্র, নরেশ সিং, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অপর একটি ঘর থেকে অডিয়ো কনফারেন্সে পুরুষ যৌনকর্মী মি: ট্রেন্ট লিওন(সে এই কেসের চূড়ান্ত মীমাংসা হওয়ার আগে বিশাল মালহোত্র এবং নরেশ সিংয়ের মুখামুখি হতে রাজি নয়।), এবং পুরো ঘটনা ভিডিয়োগ্রাফির জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন অফিসার।
টনি অ্যাডামস নির্দেশ দিলেন, “শুরু করো ব্রিয়ারলি, মিডিয়া হাউসগুলো হাত-পা ধুয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পিছনে পড়ে আছে, তার যোগ্য জবাব দেওয়া চাই। যদিও এটা মেনে নেওয়া ভাল যে মি: মালহোত্রকে সুবিচার দিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ব্যর্থ হয়েছে। হতে পারে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমরা কেউ দায়িত্বে ছিলাম না। কুড়ি বছর পরেও তো একটা বাচ্চা খুন হয়ে গেল, দু’বারই মি: লিওন সতর্ক করেছিলেন, তবু বাচ্চা দু’টোকে বাঁচানো যায়নি। এবার তো মি: নরেশ সিং যেদিন সন্ধ্যায় পুলিশের কাছে গেলেন, তার একদিন বাদেই বাচ্চাটার মৃতদেহ পাওয়া গেল। তবে যত প্রভাবশালী চক্রই এর পিছনে থাকুক, তাদের আজীবন জেলের ঘানি টানিয়ে তবে ছাড়ব।”
ব্রিয়ারলি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বোমাটা ফাটালেন, “মি: নরেশ সিংয়ের ছেলে সুরেশ আর একটি বাচ্চার উপর যে যৌন নির্যাতন চলতে দেখেছিল, সেই বাচ্চাটি খুন হয়নি।” টনি অ্যাডামস যেন আঁতকে উঠলেন, “কী বলছ ব্রিয়ারলি, তবে কে খুন হল?”
“স্যার, আসলে ওখানে আর কোনও বাচ্চা ছিলই না। সুরেশ কিছুই বলেনি, তার মুখে কথা বসিয়ে বলেছিলেন মি: লিওন আর মি: নরেশ সিং, কথাটা মিথ্যা হলেও উদ্দেশ্যটা ভাল ছিল। তারা চেয়েছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে তোলপাড় হোক, ভুয়ো বাচ্চাটাকে খুঁজতে গিয়ে আসল Paedophiles গ্যাংকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খুঁজে বার করুক। কে খুন হল, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
গত শতাব্দীর শেষভাগে এবং এই শতাব্দীর প্রথমভাগে এই Paedophiles গ্যাং লন্ডন এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রবল সক্রিয় ছিল, এদের লক্ষ্য থাকত আর্থিক এবং সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের বাচ্চারা, এই বাচ্চারা অনেকেই এশীয়, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বংশোদ্ভূত বাচ্চা ছেলে। হ্যাঁ, মেয়েরা কখনও এদের লক্ষ্য হয়নি। এই গ্যাংটি কাজ করত একজন নরপিশাচের হয়ে, যে ব্রিটিশ সমাজে লর্ড উপাধি প্রাপ্ত, তবে তিনি একা নন, তার সঙ্গে ছিল দু’জন ব্রিটিশ বিজনেস টাইকুন, যারা নিজেরাও অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। এই পিশাচ ত্রয়ীর লোলুপতার শিকার হয়েছে বহু বাচ্চা। এদের কোনও কোনও বিশেষ অতিথিও এদের প্রসাদ পেত।
মি: লিওনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি সেই লর্ডের এশীয় বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল, বাকি দু’জন সেই স্রোতে গা ভাসিয়েছিল। তবে এরা শুধু বাচ্চাদের ভোগ করেই সন্তুষ্ট ছিল না, মি: লিওনের মতো পুরুষ যৌনকর্মীদের তাদের ডেরায় ডাক পড়ত, তবে মি: লিওন আসলে সেই লর্ডের স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী, সেই হিসেবে ওর একটা আলাদা খাতির এবং লর্ডের অন্দরমহলে অবারিত দ্বার ছিল।
এরা প্রথম ভুল করে বসে বিশাল মালহোত্রর মতো বিত্তশালী এবং লন্ডনে ভারতীয় কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় মানুষের সন