এখনো পর্যন্ত যে-শেষ কবিতার বইটি বেরিয়েছে দেবারতি মিত্রের, সেই ‘করুণ ধুনোর গন্ধ’-র (২০২১) উৎসর্গ-পাতায় লেখা আছে: “তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম / তুমি হৃদি তুমি মর্ম / ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে”। শুধু স্বামী নয়, যাপনসঙ্গী নয়, প্রেমিক নয়; চিরসখা মণীন্দ্র গুপ্ত ছিলেন তাঁর কাছে সেই আধার, যা তাঁর ব্যক্তিসত্তা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছিল স্বয়ং বিদ্যা, স্বয়ং ধর্ম, স্বয়ং হৃদি এবং স্বয়ং মর্ম। এবং এর পর দেবারতি বলছেন—তুমিই প্রাণ এ-শরীরে। তৈত্তিরীয় উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত রয়েছে এমন কথা, “ইন্দ্রিয়সকল প্রাণকে অনুসরণ করে। এর ফলেই সেগুলি নিজের নিজের কর্তব্যও সম্পাদনে সক্ষম হয়। কি মানুষের ক্ষেত্রে, কি পশুর ক্ষেত্রে, একই কথা প্রযোজ্য। প্রাণ সমস্ত প্রাণীকে জীবন দান করে।” এই ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়েছে, “প্রাণময় কোষের গভীরে রয়েছে মনোময় কোষ। মনোময় কোষ সমগ্র প্রাণময় কোষকে পূর্ণ করে আছে।” এই ব্যাখ্যা পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। বুঝতে পারি, শুধু জীবনসঙ্গী নয়, মণীন্দ্র গুপ্ত দেবারতি মিত্রের প্রাণসঙ্গী-স্বরূপ। অন্তত দেবারতির দিক থেকে তাঁরা দুজনেই অভিন্ন। দুই ভিন্ন যোনি থেকে উত্পন্ন দুজন মানুষ জীবনের একটা পর্ব থেকে একসঙ্গে থাকতে শুরু করল, এবং তাদের মধ্যে নারী সঙ্গীটি সেই দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের জীবন পেরিয়ে এই অনুভবে পৌঁছলেন, তিনি তাঁর সেই সঙ্গীর সঙ্গে শরীর ও মনে অভিন্ন। এই কথা কখন বলছেন দেবারতি? মণীন্দ্র গুপ্ত মারা যাবার তিন বছর পর। মণীন্দ্র গুপ্ত মারা যান ২০১৮-র ৩১-শে জানুয়ারি। এরপর ১৪২৫-এ শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দেবারতির লেখা ‘ন্যাংটোপুটো ছেলেটাকে’ কবিতাটি। সে-লেখার পুরোটা জুড়েই অত্যন্ত অনিবার্যভাবেই মণীন্দ্র গুপ্ত। শুধু তাই নয়, এই কবিতার মধ্যে দিয়ে দেবারতির নতুন কবিজীবন শুরু হল যেন। কবিতাটি সম্পূর্ণ রাখা থাক:
আমার ন্যাংটোপুটো ছেলেটাকে
কে ভুলিয়ে নিয়ে চলে গেল!
কথা বলতে পারে না,
মা কোথায় জিগেস করলে
চোখ দিয়ে মা দেখায়।
কে তাকে নাইয়ে দেবে, খাইয়ে দেবে
চুল আঁচড়ে দেবে।
তার ওপর অভিমান করব, তার দোষ ধরব আমি?
সে যে ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা বোকামি।
মাথা ব্যথা করলে ঊঁ ঊঁ করে,
পেট কামড়ালে কড়ে আঙুল নাড়ে,
এসব শুধু তুমি-আমি বুঝব।
কোন ছেলেধরা আমাকে সর্বস্বান্ত করলে!
সেই অভিন্ন সত্তা নিয়েই শুরু হল এক নতুন অভিজ্ঞান। সর্বস্বকে হারিয়ে ফেলার অকূল-পাথারই সমগ্র সত্তার উপস্থিতিতে পূর্ণ হতে চাইল। সে-কারণেই মণীন্দ্র গুপ্ত চলে যাবার পর থেকেই দেবারতি যা-লিখছেন, তার প্রায় সমস্ত লেখার উদ্দিষ্ট হয়ে উঠছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। কেন এই প্রতিবাত্সল্যভাব নিজের স্বামীর প্রতি? আমাদের ফিরে যেতে হবে দেবারতির নিজস্ব বয়ানের কাছে। মণীন্দ্র গুপ্তকে বিয়ে করে সংসার সামলানোর মুহূর্তে কী ভাবছেন তিনি? ‘জীবনের অন্যান্য ও কবিতা’ গ্রন্থ-র ‘বিবাহ’ পরিচ্ছেদে লিখছেন:
“আমার স্বামীকে আমি পেয়েছিলাম ভাঙাচোরা অবস্থায়। তখন তার রসকস আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। দৈনন্দিন খাওয়াপরা, জীবনযাপনে ক্রমাগত অব্যবস্থা ও অশান্তি সহ্য করার ফলে তিনি কেমন কলের পুতুলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। আদর আপ্যায়ন করে ডাকা তো দূরের কথা তিনি আমাকে নাম ধরে ডাকেননি পর্যন্ত।”বিপর্যস্ত মণীন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৯২৬-এর ২৪ সেপ্টেম্বর। দেবারতি জন্মেছেন এর থেকে প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৯৪৬-এর ১৯ এপ্রিল। অন্যদিকে দেবারতির বিবাহ নিয়ে পরিবারকে কম সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়নি। এবং সে-সমস্যার অন্যতম কারণ যে দেবারতির সেইসময়ের পৃথুল চেহারা, সে-কথা জানতে পারি ওই ‘বিবাহ’ নামের পরিচ্ছেদেই। দেবারতির ভাষায় “আঠারো উনিশ বছর বয়স থেকে আমার বিয়ের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু প্রধানত মোটা চেহারার জন্য সম্বন্ধ ভেঙে যেত।” খুবই লক্ষ করবার ‘চেষ্টা’ শব্দটি। যদি একটি মেয়ে এমন কথা লিখত—সম্বন্ধ আসছিল, তাহলে বোঝা যেত মেয়েটি ডাকসাইটে সুন্দরী বলেই তার জন্যে আপনাআপনি সম্বন্ধ আসছে! কিন্তু না, মাত্র আঠারো-উনিশ থেকেই ‘চেষ্টা’ করা শুরু হয় এবং তা দেবারতির পরিবারের পক্ষ থেকেই। এই ‘চেষ্টা’ শব্দের মধ্যে দিয়ে যে অভিমান নীরবে ব্যক্ত করে দেন দেবারতি, তা আমাদের বুঝে নিতে যেমন অসুবিধে হয় না, তেমনি এ-কথা বুঝতেও অসুবিধে হয় না—পারিবারিক বৃত্তে অনেকের সঙ্গে যৌথ পরিবারে থেকেও তিনি সম্পূর্ণত একা। যে একাকিত্বের নিরসন ঘটেছিল মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে যৌথ জীবন-যাপন সম্পন্ন হওয়ার মধ্যে দিয়ে। ‘প্রধানত মোটা চেহারার জন্য’ শৈশবের স্কুল থেকে কলেজ পেরিয়ে বিবাহের উদ্যোগ পর্যন্ত কম হেনস্থা হতে হয়নি দেবারতিকে। সত্যি বলতে সমাজ ও পরিবার নির্ধারিত কোনো বাঁধাধরা (stereotype) বিয়ের সম্পর্ক দেবারতিও কি মন থেকে মেনে নিতে পারতেন? ফলে দাম্পত্য-পীড়িত মণীন্দ্র গুপ্তকে ‘ভাঙাচোরা’ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে আসা দেবারতি নিজেও কম ভাঙাচোরা ছিলেন না। দু-জনের জীবন পর্যালোচনা করে এ-কথা বলা যেতেই পারে, এই মিলন দুজনের জন্যেই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ও অনিবার্য ছিল। বিবাহ-পরবর্তী নতুন অধ্যায়ের রঙরূপ তাহলে কীভাবে গড়ে উঠল? দেবারতি লিখেছেন: “বরং এভাবেই বলা ভাল—একটি আড়াই-তিন বছরের শিশুর মা-বাবা দুই-ই হয়ে তার দেখাশোনা করা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে দাঁড়াল আমার কাজ। আজও আমার স্বামীকে একটি ছোট বাচ্চা ছাড়া কিছু মনে করি না।” নিজের গর্ভধারণের অভাবকে তিনি পূর্ণ করেছেন মণীন্দ্র গুপ্তের প্রতি তার জেগে ওঠা চিরকালীন প্রতিবাত্সল্য দিয়ে। সেই কারণেই মণীন্দ্র গুপ্তের চলে যাওয়া এক-অর্থে দেবারতির কাছে সন্তানশোক। তার ভেঙে-পড়া-মন এ-কথা বিশ্বাস করতে চায় যে, তার শিশুসন্তানটি নিশ্চয়ই কোথাও আছে! যে নিজে খেতে পারে না, স্নান করতে পারে না, সে কীভাবে মা-কে ছেড়ে থাকবে? কাজেই সে নিজে-নিজে যায়নি। নিশ্চয়ই কোনো ছেলেধরা (এখানে মৃত্যুর রূপান্তরিত প্রতীক) তাকে ধরে নিয়ে গেছে! এই হাহাকার-ভরা মাতৃহৃদয় কিন্তু মৃত্যুর প্রতীকে আশা জিইয়ে রাখল। অর্থাৎ ছেলেধরা তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, কিন্তু তার ছেলে আছে। ইহলোকেই আছে। এইভাবে অসহনীয় শোককে সামান্য এই আশাবাদের ইঙ্গিতে বাঁচিয়ে রাখছেন দেবারতি। যদি মণীন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘ও ও ও ও’ বইয়ের বারোটা কবিতা দেখি, সেই শোককবিতাগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ করব এই দৃষ্টিভঙ্গি, যিনি লিখছেন, এটা বিশ্বাস করেই লিখছেন তার উদ্দিষ্ট মৃত মানুষটি কোথাও আছেন, শুধু তার সঙ্গেই যা দেখা হচ্ছে না!
আমার দু-হাতের কুড়িটা আঙুলেএখানেও সেই স্থির বিশ্বাসই তাকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রিয় সন্তান কোথাও আছে, তাই তাকে খুঁজতে ‘চাঁদমালার মতো সূর্য’ হাতে নিয়ে যাচ্ছেন দেবারতি। একটা-দুটো নয়, একেবারে তেইশ-চব্বিশটা সূর্য। যে-মানুষটি হারিয়ে গেছে অন্ধকারে তাকে খুঁজে আনতে সামান্য আলো হলে চলবে না। বিজ্ঞানের যুক্তিবোধকে বিপর্যস্ত করতে চাইছে দেবারতির মন। গণিত, পদার্থবিদ্যার ধ্রুব সিদ্ধান্তকেও ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে তার আবেগ। বাস্তবে যদি সে নাই থাকে, তবে অঙ্ক কষে নয়, কল্পনা কষে কষে তাকে খুঁজে বের করবেন কবি। আস্তিক্যবোধে বিশ্বাসী বলেই দেবারতি এই আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। তাই এই কবিতাগুলি প্রথানুগ শোক-জনিত কবিতার স্তর থেকে অন্য কোনো নবীনতায় উড্ডীন হয়েছে। তুমি নেই, আমি একা কী করব বা আমার কীভাবে দিন কাটছে, এই কবিতাগুলি সেই নৈরাশ্যের বার্তা দেয় না। আবার পরলোকে বিশ্বাসী হলেও দেবারতির মন কিন্তু মণীন্দ্র গুপ্তকে ফিরে পাবার ইহজাগতিক প্রত্যাশা ছেড়ে দেয় না। এখানে একজন জীবনসঙ্গী খুঁজতে চায় তার জীবনসঙ্গীকে। দেবারতির এই কবিতাযাপন-পর্বে এই খোঁজ এত মরিয়া হয়ে ওঠে এইজন্যেই — তিনি এই সন্ধান করেছেন একজন মা-হিসেবেই, যিনি প্রত্যক্ষভাবে গর্ভ ধারণ না-করেও এই অপূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন এমন এক মানুষকে দিয়ে, যিনি তাঁর প্রাণকোষ-স্বরূপ। এবং এই পুরো যাত্রাপথের পরিণতি এসে উত্তীর্ণ হয়েছে দেবারতির মাতৃ-আকাঙ্ক্ষার কাছেই। মণীন্দ্র গুপ্ত এভাবেই হয়ে যান অবোধ ‘মনা’ এবং দেবারতি তাকে খুঁজতে থাকেন সর্বত্র। এই খোঁজার মধ্যে বালক গোপালের প্রচ্ছন্ন বদমায়েশি রয়েছে, যার ছল-চাতুরীকে অতিক্রম করে কিছুতেই মা-যশোদা তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এরপর আমরা যদি চলে আসি ২০২০-র বইমেলায় প্রকাশিত কাব্যপুস্তিকা “পাখি ও পরি তখন”-এ, দেখব এই বইয়ের কবিতায় আগের বইয়ের কবিতাজগতেরই সম্প্রসারণ। একটিই কবিতা লিখে যাচ্ছেন দেবারতি। এই পুস্তিকার একটি কবিতার নাম: ‘মনাটা কোথায়’।
চারদিক হাঁটকাচ্ছি—
সারা আকাশে চাঁদমালার মতো
তেইশটা চব্বিশটা সূর্য।
আমি আলো ফেলে খুঁজছি আমার বাচ্চাকে,
একমাত্র সন্তানকে।
এতে উপমা, রূপক, বা অলৌকিক কিছু নেই।
সংখ্যাদের সাদা গোলাপের মতো ভালোবাসি,
গণিতে, রসায়নে, পদার্থবিদ্যায়
যা খুশি তাই হতে পারি।
কল্পনা কষে কষে তন্নতন্ন করে খুঁজছি
মনা কোথায়,
এত সহজে আমি হাল ছেড়ে দেব না।
ওর মুখে মুখ দিয়ে ও ও ও ও করলেমানি বেড়ালের কথা দেবারতির বিভিন্ন কবিতায় আছে। তাকে নিয়ে আলাদা গদ্যও লিখেছেন তিনি। দেবারতির নির্জ্ঞানে মানি বেড়ালের ভূমিকা এইজন্যেই গুরুত্বপূর্ণ, তাকে তিনি একমাত্র সঙ্গী করেছেন তার হারিয়ে যাওয়া মনা-কে খুঁজে পেতে। একমাত্র সেই বুঝলে-বুঝবে মনা-কে ফিরে পাওয়াটা তার কাছে কতটা জরুরি। কোনো জাগতিক প্রাণের পক্ষে এই কষ্ট বোঝা সম্ভব নয়। মানি বুঝবে, কারণ মানি ইহজগতে নেই। এবং গল্পের ‘সুভা’-র মতোই এই সমাজে কোণঠাসা, অপমানিত, একাকী দেবারতি তাই কোনো মানুষ নয়, বেছে নেন তার একান্ত প্রিয় মানিকে। দেবারতির নির্জ্ঞান জানে মনা-কে পাওয়া কতটা অসম্ভব। কিন্তু তার স্বজ্ঞান এই কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সেই কারণেই নির্জ্ঞান ও স্বজ্ঞানের যোগসূত্র মানি-ই বারবার চলে আসে কবিতায়। ‘উলুখড়’ পত্রিকার চতুর্দশ সংকলনে (১৪২২) ‘মান-মানির দুনিয়া’ নামের ব্যক্তিগত গদ্যে দেবারতি এক কল্প-আখ্যান রচনা করেছেন তার প্রিয় দুই সন্তানবৎ পোষ্যকে নিয়ে। সেখানে প্রায় স্বপ্নদৃশ্যের মধ্যেই দেবারতির ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রাত আড়াইটের সময়ে। ‘সাদা ন্যাকড়া জড়ানো সরষের পুটলি’-র মতোই তার গায়ে এসে পড়ে মানি। কথা শুরু হয় তাদের। দেবারতি সাবধান করে দেন তাকে: “আর রাতদুপুরে অত ম্যাও ম্যাও কোরো না, মনার ঘুম ভেঙে যাবে। কাল আবার ওর ইস্কুল আছে...”। কথা বলতে বলতে জানা যায় মানিই পাঠিয়েছে মান-কে। মানি তার দুই সন্তানের নাম রেখেছে (টুকু আর রুকু) খুকুদিদি (দেবারতি)-র সঙ্গে মিল রেখে। মানির কাছে যেতে চান দেবারতি, মান-কে অনুরোধ করেন নিয়ে যেতে। মান জানায়, মানি চায় ‘মনা তোমার সঙ্গে যাবে’। দেবারতি সঙ্গে-সঙ্গে বলেন: “আরে মনা তো পুতুল, শুধু চেয়ে থাকে, কী যে দেখছে জানে না, শুধু কথা শোনে, কথা বলে না।” অর্থাৎ মনার নিজের কিছুরই করবার বা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই। সে সর্বতোভাবেই নির্ভরশীল দেবারতির ওপর। এই পুতুল-মোটিফ অবশ্য দেবারতির অনুধ্যানে এসেছে অনেক আগে। তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘আমার পুতুল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। “জীবনের অন্যান্য ও কবিতা” গ্রন্থর ‘দেবাঞ্জলি’ অধ্যায় শুরু হচ্ছে এইভাবে: “শীতে কাঁটা দেওয়া উজ্জ্বল অঘ্রান মাসে দেবাঞ্জলি যেদিন জন্মাল, সেদিন সন্ধেবেলা বাবা আমাদের দু’ ভাই-বোনকে (দেবাশীষ ও দেবারতি) কত আহ্লাদ করে মামারবাড়িতে সোনার পুতুল বোন (দেবাঞ্জলি) দেখাতে নিয়ে গেলেন। আগেই দেখানো হয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তকে তিনি পেয়েছিলেন ‘কলের পুতুলের মতো’-ই। ফলে এই পুতুল-মোটিফের অনিবার্যতা দেবারতির কাব্যজগতে এসেছে নির্বিকল্প মাতৃসত্তার অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকেই চরিতার্থ করতে। পুতুল বাধ্য, সে নিজে দাত্রীর স্নেহের প্রকাশে কোনো বিরুদ্ধতা করে না। এমনকি স্নেহের আতিশয্য হলেও তার কিছু এসে যায় না। মাতৃ-আকাঙ্ক্ষাকে লালন করে চলা দেবারতি সেই শূন্যতা পূরণ করেন নিজের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড় মণীন্দ্র গুপ্তকে আগলে রাখবার মধ্যে দিয়ে। মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা ও জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, কারোর প্রতি জোর ফলানো, কারোর কাছ থেকে কিছু চাইবার ইচ্ছে, নিজের অসুবিধে, কষ্ট অন্যকে জানানো—এসব মণীন্দ্র গুপ্তের স্বভাবে নেই। এই কারণেই দেবারতির স্বীকারোক্তি: “তাঁর কাছাকাছি থাকি বলে বাধ্য হয়ে আমাকেই তাঁর প্রতি শিশুর মতো আচরণ করতে হয় এবং অনেক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়। লোকচক্ষে খানিকটা অস্বাভাবিক দেখলেও এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।” তিনি বুঝতে পারছেন, কিন্তু ‘লোকচক্ষু’-র সামাজিক চাপকে উপেক্ষা করেই তাকে এই আচরণ করতে হয়েছে। এর ফলে দেবারতির লেখা এই কবিতায় এত উদ্বিগ্নতা, এত অস্থিরতা। সে কি জঙ্গলে পড়ে আছে? ভয় পাচ্ছে বাঘ বা শেয়ালের ডাকে? তাহলে আকাশের নক্ষত্রেরা তাকে রক্ষা করছে না কেন, চাঁদের টিপ পরিয়ে তারা দেখাশোনা করছে না কেন দেবারতির প্রাণাধিক-প্রিয় মনা-র। দেবারতি তাই মানি বেড়ালকে নিয়ে তার সন্ধানে বেরোতে চান, অথচ সে-ও কথা না-শুনে মাটিতেই ঠায় পড়ে আছে। একজন জীবিত মানুষ, একজন মানবেতর মৃত জীবকে আশ্রয় করে লোকান্তরে পৌঁছতে চাইছেন একজন জাগতিকভাবে মৃত মানুষের কাছে; কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না। মানি বেড়ালের অনুষঙ্গে অন্য কবিতাও আছে। ‘ও ও ও ও’ বইয়ের ‘মানির আহ্বান’ কবিতাটি উঠে এসেছে স্বপ্নসম্ভব হয়ে, স্বপ্নদৃশ্য নিয়েই। হারিয়ে যাওয়া মনাকে খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্রতীরে চলে এসেছেন দেবারতি। এসে কী দেখছেন মানির আহ্বানে?
অসুখ সেরে যায়।
এখন বাচ্চাটা কোথায় কোন জঙ্গলে
জ্বরে কো কো করে কাঁপছে।
বাঘের ডাক শুনে বড্ড ভয় পায়,
শেয়ালের ডাকেও পায়।
রাতের বাতাসে গাছপালার আফসানি শুনে
ভাবে ডাইনি ওকে ধরতে আসছে।
আকাশের তারাগুলো ওকে
মাসিপিসির মতো দেখাশোনা করলে তো পারে,
চাঁদমামা কপালে টি দিতে পারে না?
মানি বেড়ালকে বলেছি
মনা কোথায়, চল নিয়ে আসি।
সে মার্বেলের গুলির মতো মেঝেতে
একঠায় পড়ে আছে তো পড়েই আছে।
পৃথিবীর সঙ্গে কি সম্পর্ক?জাগতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এই জগতেরই কোনো প্রান্তসীমার সমুদ্রতীরে চলে গিয়েছে মনা। সেখানে সে দুঃখে নেই, বরং সঙ্গীসাথী জুটিয়ে বেশ আনন্দেই আছে। বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা করা মনার শরীর কাঁচা হলুদের মতো, তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ, অথচ মনার (মণীন্দ্র গুপ্তের) শরীরের রঙ কাঁচা হলুদের মতো হওয়ার কথা নয়। তাহলে দেবারতির স্বপ্নদৃশ্যে মনার গাত্রবর্ণ পোড়া তামার মতো না-হয়ে কাঁচা সোনার মতো হল কেন? তাহলে কি এই স্বপ্নজগতে দেবারতির নির্জ্ঞানের সন্তান মেজবোন দেবাঞ্জলির সঙ্গে স্বজ্ঞানের সন্তানকল্প স্বামী মণীন্দ্র গুপ্তকে মিলিয়ে ফেলেছেন? তারা সকলেই অসীম সমুদ্রের মুখোমুখি। দূরের মেঘ হয়ে উঠতে গাছ, গাছ হয়ে উঠছে মেঘ। ওরা সবাই আত্মমগ্ন, তবু মনা মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছে তারই জন্যে। এই কান্নাটুকুই পরজগতের সঙ্গে ইহজগতের সংযোগ। পরজগত থেকে ভেসে আসা এই কান্না ইহজগতের দেবারতি শুনতে পাচ্ছেন না। পরজগতের মানি তাকে সেই কান্নার খবর এনে দিচ্ছে। তাকে অধিগম্য করে তুলছে পরজগতের প্রতি। ‘দুধের সরের গান গাওয়া’ মনাকে তো চাইলেই দেবারতি ভোলাতে পারেন, ছেলে-মরা মায়ের মতো তার মুখ করে থাকবার তো প্রয়োজন নেই! মানি নিজেই তাকে নিয়ে যাবে মনা-র কাছে। এই কবিতার সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য, শোককবিতা হয়েও এই কবিতায় কোনো দুঃখবোধ নেই। বরং নিরুদ্দিষ্ট কাঙ্ক্ষিতকে যে অনন্তে সন্ধান করতে গিয়েছেন দেবারতি, সেখানে শিশুদের মেলা বসেছে, দেবারতির আস্তিক্যবোধ সেই নগ্ন শিশুদের পবিত্রতা দেখে নিচ্ছে দু-চোখ ভ’রে। অনন্তের পরে কী আছে আমরা কেই বা তা জানি। তার আগেই বা কী পরেই বা কী, সেসব আমাদের চিন্তাপরিধির মধ্যে আসতে পারে কি? ‘অমানিশা’ নামের কবিতায় সেই অন্ধকারকেই অনন্তের আত্মীয় বলে উল্লেখ করছেন দেবারতি। অশেষ-অনন্ত সেই রাত্রি, যার ‘কোলে কাঁখে’ মনা কোথায় চলে গেছে। অমানিশাও যেন মাতৃস্নেহে লোকান্তরিত মনাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবেসে ফেলেছে। ‘দীর্ঘতম মৃত্যু’ এসেছে দীর্ঘ জীবনের রোগভোগ, যন্ত্রণা অতিক্রম করেই। যেন অমানিশা তার ব্যাকুল মাতৃহৃদয় নিয়ে এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। তাই তাকে পেয়ে সহজে ছাড়তে চাইছে না। এখানে জাগতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাওয়া মনার প্রতি দুই মায়ের লড়াই ঘনীভূত হয়েছে। জাগতিক স্নেহকে সম্বল করেই দেবারতি চাইছেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে: “যাক, অমানিশার সখ আর ক-দিন?/ বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফিরে আসবি তো মনা,/ মা-ক্যাঙারুর থলিতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে না পারলে/ তুই কি বাঁচবি?” ক্যাঙারুর থলি তার শরীরে অচ্ছেদ্য অবস্থায় থাকে, তার মধ্যেই শাবক নিশ্চিন্ত বোধ করেন। তেমনি মনার কাছেও তার মা-দেবারতি সেই অচ্ছেদ্য সম্পর্কস্বরূপ। তাকে থলিতে অর্থাৎ মাতৃকোটরে ফিরে আসতে হবেই।
সমুদ্রের তীরে মনা বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে
খেলা করছে।
বুড়ো আঙুলের মতো ছোট্ট, কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং,
মুখের ভেতরটা গোলাপি—
ওইরকম দেখতে অসংখ্য সঙ্গীসাথী জুটেছে।
কী নীল, কী নীল সমুদ্র!
দূরে দূরে গাছেরা মেঘ আর মেঘেরা গাছ।
মনাটার গায়ে একতিল সুতোও নেই,
ওদের কারুরই নেই।
ওরা খিলখিল করে হাসছে
যেন দুধের সরের গান গাইছে।
মানি বেড়াল বললে—
যাও, যাও, তাড়াতাড়ি ছুটে যাও,
মনা মাঝে মাঝে খুঁতখুঁত করে
ছেলে-মরা মায়ের মতো মুখ করে আছ কেন?
চলো, আমার সঙ্গে চলো।
‘অক্ষয় মালবেরি’ বইতে মণীন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি থেকে জানিয়েছিলেন তার মায়ের কথা। তিনি লিখছেন: “আমাদের চেনাশোনা, ভালোবাসা হবার আগেই মা যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর, আর আমার দশ মাস। মায়ের এই অসমাপ্ত জীবন বা আমার জীবন থেকে তার চির-অপসরণ একটা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র।” যে-শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, ভূমিষ্ঠ হবার আগে থেকেই গর্ভাবস্থায় তার সঙ্গে যে-শরীরে সে বেড়ে উঠছে, একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। পৃথিবীতে এসে প্রথম তাকেই খুঁজে বেড়ায় সে। মণীন্দ্র গুপ্ত সময় পেয়েছেন মাত্র দশ মাস। ‘চেনাশোনা’ বা ‘ভালোবাসা’ যাই হোক না কেন, তার জন্যে এ-সময় কিছুতেই যথেষ্ট নয়। সে-কারণেই ১৯৮১-র অক্টোবরে, নিজের পঞ্চান্ন বছর বয়সে মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁকে লিখতে হচ্ছে ‘তাঁর এই চিরঅপসরণ একটি প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র।’ এবং কোনো বিস্ময়বোধ ছাড়াই তথ্যের আকারে এই কথা জানাতে পারেন তিনি। এই সেই মা, যাঁর মৃত্যুর পর তাকে শুনতে হয়েছে, জন্মেই তিনি মা-কে ‘খেয়েছেন’। নিশ্চয়ই এ-কথা তাকে কেবলমাত্র দশ মাস বয়সে শুনতে হয়নি। এই কথা তাকে বরাবর শুনতে হয়েছে পরবর্তী জীবনেও। এ-কারণে তার ‘একধরনের নির্বোধ অস্বস্তি’ হত। এর ফলে “যে নেই তার না থাকার জন্য একটা আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত। মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা।” স্বভাবতই এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা তাকে দিয়েছে প্রাকৃতিক আস্তিক্য, দিয়েছে প্রচলিত জীবনপদ্ধতির বিরুদ্ধে টান। সেই সমস্ত মানুষের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে তাঁর, যারা প্রথানুগ সংসারী নয়। ‘অক্ষয় মালবেরি’র পাতায়-পাতায় সেই ধরনের চরিত্রে পরিপূর্ণ, যারা প্রধানত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। মায়ের অকালমৃত্যু তার মনে তৈরি করেছিল অসীম অভিমান। পারিপার্শ্বিক মানুষের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে সেই অভিমানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল নিস্পৃহতা। দশ মাস বয়সে মায়ের স্পর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে, তারপর পঞ্চান্ন বছর বয়সে লেখা মা-কে নিয়ে এক পাতার স্মৃতিকথার শেষ হচ্ছে এইভাবে:
“পরে, একটু বড় হয়ে, যেদিন মা’র ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, তাঁকে একমুহূর্তেই প্রত্যাখ্যান করলাম। সোজা দাঁড়ানো একটি ছিপছিপে কিশোরী, নাকে পাথর বাঁধানো নোলক। মাতৃত্ব দূরের কথা, তার ঠোঁটে চোখে চিবুকে তখনো নারীত্বই আসে নি। এই আমার মা! তবু হয়ত তাকে আমার দরকার ছিল। কিন্তু এখন, এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে, যদি সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়, হয়ত তাকে বলব—বোসো, একটু কিছু খাও—বিস্কুট, সন্দেশ? পারো তো আমার কাঁচাপাকা চুলে একটু বিলি কেটে দাও। যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে।”এর পরের অধ্যায়ের নাম দিচ্ছেন মণীন্দ্র গুপ্ত, ‘প্রথম স্মৃতি’। অর্থাৎ মা প্রথম স্মৃতিরও বাইরে। বরং বলা ভালো, তাকে নিয়ে কোনরকম মাতৃত্বজনিত স্মৃতি লেখকের নেই। এখন, মনে হতেই পারে, দেবারতি মিত্রের কবিতা নিয়ে দু-চার কথা বলতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্তের ছেলেবেলা নিয়ে এত অনুসন্ধান বা আলোচনা কেন। এ-কথা বোঝবার জন্যেই, দেবারতি যে-মাতৃহৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্তকে, মণীন্দ্র গুপ্তের দিক থেকেও তা কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল জীবনে। মাত্র দশ মাস বয়সে মা-কে হারানোর ফলে যে-নিঃসঙ্গতা তৈরি হচ্ছে, তার পরিপূরণ হচ্ছে ১৯৭৫ সালে--ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে--নিজের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট দেবারতি মিত্রকে বিয়ে করবার পর। কিন্তু এতেই শেষ নয়, এর মাঝখানে ১৯৫১ সালে ভালবেসেই প্রথম বিবাহ করছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। কিন্তু সেই বিয়ে নিয়ে নিজে কিছু না-বললেও, দেবারতির লেখা থেকে এ-কথা স্পষ্টতই জানা যায় সে বিয়ে পরবর্তী সময়ে আর সুখের ছিল না। ফলে, শৈশবে মা-কে হারানোর মধ্যে দিয়ে যে অভাববোধ তৈরি হয়েছিল, তা আরোই বিস্তৃত হয়ে যায় প্রথম বিবাহের অসুখী দাম্পত্যে। ঊনপঞ্চাশ বছরে তাকে কাছে পাচ্ছেন দেবারতি এবং বিগত-যৌবন সেই মানুষটিকে গ্রহণ করছেন ‘আড়াই-তিন বছরের শিশু’ হিসেবেই। তাকে ‘রক্ষণাবেক্ষণ’ করাই যে তার প্রধান কাজ, এই মর্মে ব্রতী হচ্ছেন দেবারতি। এরপর তেতাল্লিশ বছর পর সেই মানুষ তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে চিরকালের মতো। এই বিয়োগ তো আত্মবিয়োগ, এই বিয়োগ তো সন্তানবিয়োগই। মা হতে-চেয়েও, মা হয়েও, সেই স্নেহের পাত্রকে হারিয়ে ফেলবার যন্ত্রণা:
আচমকা জলে ঠেলে ফেলে দিলেমণীন্দ্র গুপ্তের প্রয়াণ দেবারতির কাছে অগাধ জলেই পড়ে যাবার সমান। এখন, সেই ঘটনা অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে গেছে। নবতিপর মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে ঊনপঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্যের অবসান হয়েছে। দেবারতি অনুযোগ জানাচ্ছেন খেদোক্তির মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ করেই জলে ফেলে দিলে কেউ সাঁতার শেখে না, তাকে সময় দিতে হয়, প্রস্তুত করতে হয়। কিন্তু এমন তো নয়, বিরানব্বইয়ের মণীন্দ্র গুপ্ত শরীরের দিক থেকে বিপর্যস্ত হননি একেবারে। আসলে এই মৃত্যু যখনই আসত এইভাবেই প্রতিক্রিয়া হত দেবারতির। তার অভিন্ন-প্রাণের বিচ্ছেদের জন্যে তিনি কখনোই নিজেকে প্রস্তুত করতে পারতেন না। তলিয়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, এই দিশেহারা অবস্থারই অভিব্যক্তি। কোথায় তলিয়ে যাচ্ছেন? শীতে, অন্ধকারে। এই কবিতার পরে লেখা ‘অগাধ বিরহ’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতায় দেবারতি লিখছেন: ‘তেমনই আমার এই মৃত্যুকে জীবন সঁপে দেওয়া’। তার পরম-পুরুষ যেখানে গেছেন, সেই মৃত্যুর অধিষ্ঠানেই নিজের জীবনকে অর্ঘ্য দিতে চান কবি। এই কষ্ট কেমন? প্রথম ঋতুযন্ত্রণা থেকে উৎপন্ন ব্যথার মতো দিশেহারা। কেউ গর্ভধারণে মা হন, দেবারতি হয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্তকে জীবনে ধারণ করে। ‘মা’ হবার সর্বংসহ সুখ-দুঃখ তো এই। তাকেই ধ্রুব করে থাকতে চান তিনি।
কেউ সাঁতার শেখে না
আমি তো তলিয়ে যাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি
শীতে, অন্ধকারে।
যেন
প্রথম ঋতুর কষ্ট, দিশাহারা ব্যথা,
বিফল স্বপ্নের রব।
মা হবার সুখ-দুঃখ নিয়ে থাকি শুধু।
‘পান’ নামের একটি কবিতায় আবার মনা-কে পাওয়া যায়। কবিতার কথক পান খাচ্ছেন, তার কোলে বসে মনা তারই মুখের চিবানো পান স্বেচ্ছায় চিবিয়ে খাচ্ছে। এই মুখ থেকে চিবানো পান খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল একসময়। যখন বাড়িতে হামানদিস্তে, ডাবর থাকত। বাড়ির মাতৃস্থানীয়েরা পান তৈরি করে খেতেন। তাদের কাছে বায়না করলে কখনো ছোটদের জুটে যেত ওই থেঁতো কিংবা মুখের এঁটো পান। তেমনি এই কবিতার কথক, যিনি অনিবার্যভাবে দেবারতি স্বয়ং, পান সেজেছেন, আর সেই ‘চিবানো’ পান খেতে চাইছে তার ‘গলা জড়িয়ে’ বসে থাকা মনা। দেবারতি সতর্ক করছেন এই পানে জাদু আছে, এই পান ‘ডাইনি পান’ এবং এই পান খেলে ‘সংসার ছারখারে যাবে, জীবন ছারখারে যাবে,/ তবু পান শেষ হবে না’। সব জেনেশুনেও মনা সব কথাই বিশ্বাস করে। কিন্তু পান চিবানো থামে না তার, একটুও ছিবড়ে ফেলে না সে। আটপৌরে ভাষায় লেখা এই কবিতায় কিন্তু ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুর প্রসঙ্গ এল এই কারণেই, প্রয়োজনে মনা-কে বশীকরণের মাধ্যমেও কাছে রাখতে চান দেবারতি। তাই তিনি পানের ছদ্মবেশে স্বপ্ন খেতে দেন তাকে। আর কবিতাটির বয়ান লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বশ্যতায়, যিনি বশ হচ্ছেন, তাঁরও সম্মতি আছে। কবিতাটা পড়ে নেব এইবার:
আমি দুপুর বেলা বাটা খুলেকামজ প্রতীক হিসেবে পানের ব্যবহার সুপ্রাচীন। মানব-হৃদয়ের সঙ্গে যার আকৃতিগত মিল এবং যা চর্বণ করলে ঠোঁট, জিভ লাল হয়ে পাত্র-পাত্রীর কামনা-বাসনা জাগিয়ে তোলে, সেই পান তো চর্যাপদের সময় থেকেই রতিক্রিয়ার অন্যতম সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত। কিন্তু সেই পান এখানে সন্তানকল্প স্বামীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এসেনশিয়াল টুল হিসেবে ব্যবহৃত হল। যার প্রতি ব্যবহার করা হল, সেও স্বেচ্ছায়, কোনো প্রতিবাদ না-করে, এমনকি ছিবড়েসমেত পুরোটাই খেয়ে ফেলল। কী খেল? সংরক্ত দেহবাদী প্রেম? শরীর? মাংস? না, তা নয়, খেল স্বপ্ন। স্বপ্নেরও কি ছিবড়ে হয়? স্বপ্ন কি স্পর্শযোগ্য, চর্বণযোগ্য কোনো খাদ্য? মানসিক খাদ্য অবশ্য হতে পারে। উনিশেই যে-দেবারতির বিয়ে হবার কথা ছিল, সেই বিয়ে হচ্ছে দশ বছর পেরিয়ে, প্রায় বিগত যৌবন ঊনপঞ্চাশ বছরের মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে। ফলে একদিকে সন্তানধারণের ব্যাকুল অনুপস্থিতি, অন্যদিকে সারাজীবন মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত একাকী একজন মানুষ, তার কাছে দেবারতি হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতিই। যে-রতি বিবাহোত্তর জীবনকে রঙিন ক’রে তোলে, তাকেই প্রতিবাৎসল্যের প্রাধান্যে ধরে রেখেছেন দু-জনেই। মুখের চিবানো পান খাইয়ে বশীকরণের মাধ্যমে সুপ্ত রতি-আকাঙ্ক্ষা ও সন্তান-আকাঙ্ক্ষা একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই পারস্পরিক অনুভূতি যেহেতু অসীম, পাত্র-পাত্রী না-থাকলেও সেই অনন্ত, নাছোড় মনোস্কামনা রয়ে যাবে জল-মাটি-বাতাসের নশ্বর পৃথিবীতে, অবিনশ্বর হয়ে। তাই এই পান কোনদিন শেষ হবে না। প্রতীক কী—গিরীন্দ্রশেখর বসু তার ‘স্বপ্ন’ গ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ অংশে লিখছেন:
মৌরি, মিছরি, চুয়া দিয়ে পান সাজি।
মনা কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে
আমার মুখ থেকে চিবানো পান খায়।
আমি বলি—
এ-হল জাদু পান, ডাইনি পান,
সংসার ছারেখারে যাবে, জীবন ছারখারে যাবে,
তবু পান শেষ হবে না।
মনা চোখ বড় বড় করে শোনে,
সব কথা বিশ্বাস করে।
টুনটুন করে সে পান চিবোয়,
আমার স্বপ্ন খায়, টপ্ন খায়,
একফোঁটা ছিবড়েও ফেলে না।
“যে মানসিক ভাবসমষ্টি বা যে মানসিক শক্তি অসামাজিক কামজ ইচ্ছাকে অবদমিত করে এবং নির্জ্ঞানে আবদ্ধ করিয়া রাখে, তাহাকে মনের প্রহরী বলা যাইতে পারে। এই প্রহরীর ইংরেজী পারিভাষিক নাম censor. আমাদের মনের প্রহরী সবসময় সমান সজাগ থাকে না। নিদ্রাবস্থায়, মানসিক অবসাদ বা উত্তেজনার সময় এবং কোনো কোনো মানসিক রোগে প্রহরী অসতর্ক হইতে পারে; এই সুযোগে অবদমিত রুদ্ধ ইচ্ছা স্বপ্নে অথবা নানাপ্রকার ভুলভ্রান্তির সহায়ে ও আবেগজ ক্রিয়ায় পরিতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। এইভাবে অবদমিত ইচ্ছার প্রকাশ সুস্থ স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় সম্ভব নহে। চোর যেমন ছদ্মবেশে ভদ্রলোক সাজিয়া পুলিশের দৃষ্টি এড়াইয়া নিজ কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করে, সেই প্রকারে অনেকসময় অবদমিত ইচ্ছাও ছদ্মবেশে বা পরিবর্তিত আকারে মনের প্রহরীকে এড়াইয়া আত্মপ্রকাশ করে। এরূপ অবস্থায় অবদমিত ইচ্ছা যে রূপ ধারণ করিয়া সংজ্ঞানে দেখা দেয়, তাহাকে প্রতীক বা symbol বলা হয়।”দেবারতি-মণীন্দ্রের সমাজ-স্বীকৃত বিবাহে অবদমনের তো কিছুই ছিল না। থাকবার কথাও নয়। কিন্তু সারাজীবন স্বামীকে একটি ছোট বাচ্চা ছেলে হিসেবে দেখলেও দেবারতির অবদমিত সন্তানধারণের ইচ্ছে, এই কবিতায় উঠে এসেছে নির্জ্ঞান থেকে, কামজ প্রতীক হিসেবেই অশেষ পানের সমাহারে—চিবিয়ে খাওয়ানোর মধ্যে দিয়ে। পানাতুর এই কবিতা যেমন একদিকে সন্তানকে চিরকাল ধরে রাখবার, একইসঙ্গে মর্মসঙ্গী স্বামীকে চিরজীবনের মতো কাছে রেখে দেবার অসম্ভব জেদকেই প্রচ্ছন্ন ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করে।
‘ও ও ও ও’ (২০১৯) এবং তার পরের বছর প্রকাশিত ‘পাখি ও পরি তখন’-এর (২০২০) সন্তানকল্প উদ্দিষ্ট মনাকে নিয়ে লেখার প্রবণতা পরিবর্তিত হচ্ছে প্রায় কাছাকাছি সময়ে, কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রকাশিত ‘অগাধ বিরহ’-তে (২০২০) এসে। স্বামীর প্রতি বাত্সল্যজনিত যে-দৃষ্টি তাই এই গ্রন্থে এসে খানিকটা বদলে যাচ্ছে। এখানে যেন কোনো লোকান্তরবাসী অধরা পুরুষ, যিনি টান-ভালোবাসার ফলে তার প্রিয় মানুষটিকে দেখতে আসছেন। তার নীরবতা, মৌনতা ও গাম্ভীর্যই বলে দেয়—মানুষটি মণীন্দ্র গুপ্ত ছাড়া কেউ নয়। লোকান্তর থেকে আসা মানুষটিকে কীভাবে আপ্যায়ন করছেন দেবারতি?
শোকের আগুনেচিরসখা চলে গেছে। যাকে ছেড়ে গেছে, তার জীবন এখন কেমন? পরপর লাইনগুলো লক্ষ করবার। কীভাবে এই বিরহকাতর মানুষটি রয়েছেন? শোকের আগুনে—সেদ্ধ হতে হতে। এক লাইনেই বলা যেত, বলা হল দু-লাইনে। এই দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছেদ কীভাবে দেবারতিকে যন্ত্রণাকাতর করেছে—প্রতিদিন ও প্রতি-মুহূর্তে—কুরে কুরে—সেই অব্যক্ত বেদনা যেন ভাষা পেল শোকরূপ আগুনে সেদ্ধ হতে হতে। যিনি আসবেন, যার জন্যে এই নৈবেদ্য, যা আখেরে নিজেরই জীবন—সামান্য একমুঠো চালের মতো। ওই একমুঠো চাল ছাড়া আর কিছুই দেবার নেই। এই চাল ফুটে যে-ভাত হবে, তাই এ-জীবনের সারাৎসার। এই কবিতা লেখার অনেক আগেই, দেবারতির আরেক গদ্যবই ‘ভ্রমরাধিক ভ্রমর’-এর একটি লেখায় পাচ্ছি এই কথা: “দুপুরবেলা ভাত চড়িয়েছি, ভাত ফুটতে ফুটতে হাঁড়ির বাইরে গড়িয়ে পড়ছে—সেও তো ভাতই, অন্নের সুস্বাদু ঘ্রাণ, অন্নের নির্যাস অন্নকে ছাপিয়েও যেন উথলোচ্ছে। ঈশ্বর নিজে তাঁর সৃষ্টবস্তু হয়ে তো রয়েছেনই, তাদের উপচেও তিনি বিদ্যমান।” ঈশ্বর এইভাবে অতিরিক্ত কিছু, নিজেই এই লেখায় ‘কঠোপনিষদ’-এর প্রসঙ্গ এনেছেন দেবারতি, কোন প্রসঙ্গ? যেখানে বলা হচ্ছে—এই পৃথিবীতে যত বস্তু আছে, তারা সকলেই পরমব্রহ্ম থেকে নিঃসৃত। উপনিষদে যা-ব্রহ্ম, দেবারতির উপচে পড়া নির্যাসের আধিক্যে ভাত-ই ঈশ্বর। এখন একজন জীবাত্মা, তার জীবনকে একমুঠো চালের মতো, ফুটিয়ে ভাত করছেন। সেই পরম-অন্ন কে খেতে পারবে? যিনি পরম-পুরুষ ও পরমাত্মা। উপনিষদ অনুসারে জীবাত্মা ও পরমাত্মার কোনো ভেদ নেই। বরং রূপান্তর মাত্র। যেমন এখানে বক্তা ও উদ্দিষ্টে কোনই ভেদ নেই। স্নেহমাখা এই ভাত বক্তার আয়ু ফুটে ফুটে, সারা জীবনের দহনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পরমায়ু হয়ে উঠছে। কাকে দেওয়া হবে?— ‘তোমাকেই’। তাকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে ‘এসো, বোসো’। দুটি শব্দই পৃথক একটি লাইন, অথচ এই লাইনকে আলাদাভাবে খুব কাব্যগুণসম্পন্ন লাইন বলা যাবে না। আসলে দেবারতি সময় দিতে চাইছেন নবতিপর মণীন্দ্র গুপ্তকে, যিনি একই দেহে বৃদ্ধ আবার একই দেহে দেবারতির পুতুল-স্বরূপ, শিশুপ্রাণ—মনা। ঈশ্বর নিজেই সৃষ্টবস্তু, এবং তিনিই প্রয়োজনে নিজেকে প্রসারিত করেন, অতিরিক্ত করেন। ঠিক যেমন এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড নিজেকে প্রসারিত করেই চলেছে। দেবারতির মন জুড়ে যে পরম পুরুষের অস্তিত্ব সৃষ্ট হয়েছে তার জীবৎকাল থেকেই তাই মৃত্যুর পর সামান্য অতিরিক্ত হয়েছে আ-বিভক্তি সহযোগে। মনা— ওই উপচে পড়া ঈশ্বরেরই সমনাম, যাকে দেবারতি সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন মৃত্যুর পরেও। তিনি (দেবারতি) ভালভাবেই জানেন, যে-এসেছে, বেশিক্ষণ থাকবে না, তাই সমস্ত পরমায়ু তিনি বেড়ে দেন তার ঈশ্বরের কাছেই ‘আস্তেব্যস্তে’। সেই পরমায়ুকে সম্ভোগ করে যেন পরমাত্মা তৃপ্ত হন। অর্থাৎ যিনি ইহশরীর ত্যাগ করে চলে গেছেন খিদে-তেষ্টার ঊর্ধ্বে উঠে, তার জন্যে ভাত রান্না করতে করতে দেবারতির মনে হচ্ছে, তিনি কতকাল খাননি। লক্ষ্য করবার বিষয়টি এইখানে, জীবাত্মা-পরমাত্মার দর্শন জানা আস্তিক দেবারতির মনও কিন্তু একমুহূর্তের জন্যে তার ওই বিশ্বাস থেকে সরে সংশয়ে আবিষ্ট হচ্ছেন এই ভেবে—তার সন্তান, তার স্বামী, তার চিরসখা ঠিক করে খাচ্ছে তো? তাকে তিনি কী খাওয়াবেন? সবটুকু। তার সমস্ত জীবন, তার সমগ্র পরমায়ু।
অশ্রুজলে সেদ্ধ হতে হতে
একমুঠো চাল আমার জীবন
আজ হাঁড়িভর্তি ভাত
উথলে পড়ছে, উপচে উঠছে।
এই অন্ন কেউ খাবে?
এই অন্ন কাকে দেব?
এসো, বোসো,
তোমাকেই আস্তেব্যস্তে বেড়ে দিই—
তুমি খাও, খেয়ে তৃপ্ত হও।
‘ভ্রমরাধিক ভ্রমর’ বইয়ের ভূমিকায় দেবারতি লিখেছেন:
“ছেলেবেলা থেকে আরও অনেকের মতো অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আমি ধর্মগ্রন্থও পড়ি। এবং প্রকৃতির নিয়মে স্বভাবতই জীবনের জটিলতা ও দুঃখকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হয়। ধর্মগ্রন্থ পড়ে জোর পাই, শান্তি পাই, আত্মহননের পথ থেকে সরে আসি।”তার মানে, লোকান্তরে যাবার গূঢ় ইচ্ছা দেবারতির মধ্যে ছিল। যৌবনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে, অপ্রাপনীয় পুরুষ-সত্তাকে কামনার মধ্যে দিয়ে, তার জীবনকে ভালোবাসার যে-গ্রন্থিগুলো ফুটে ওঠে, সেখানে কোথাও নিঃসঙ্গতা ছিল, মর্ম দিয়ে যাকে কেউ স্পর্শ করেনি। কীভাবে সমূহ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ঈশ্বরকে খুঁজে পান দেবারতি? মাথার ওপর উপুড় করা আকাশে, মানুষের বুকে পুঞ্জ পুঞ্জ ব্যথায়, নিঃসঙ্গ মাঘের রাতে শীতে কাতর কুকুরের করুণ নালিশে, শালিক-চড়ুইয়ের তর্কাতর্কিতে। প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিকতার এই সম্মেলনের মধ্যে দিয়েই দেবারতির অস্তিত্ব ঈশ্বরের খোঁজ করেছিল। দেবারতির ঈশ্বর সেই দৈনন্দিনের সত্য-মিথ্যার মধ্যেই নিহিত। তুচ্ছ সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে তিনি কীভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, যাঁর জৈবিক আধার স্বয়ং মণীন্দ্র গুপ্ত? সারাদিন সংসার সামলে যখন বিকেলের দিকে দেবারতি একটু বিশ্রামের অবসর পান, তখন ঈশ্বরকে ডাকা তো দূরের কথা, পড়াশুনো করবার শক্তি পর্যন্ত থাকে না। তিনি লিখেছেন ‘ঢুলতে ঢুলতে ঘুমের দেশে গিয়ে পরিত্রাণ পাই।’ যে-ঈশ্বরকে তিনি ডাকতে চান, সেই ঈশ্বরের কি তার প্রতি একটুও মন নেই? তারপর দেবারতি লিখছেন: “আমার অস্বচ্ছ বুদ্ধি, নড়বড়ে শরীর। মাথার ভেতরটা দুধে পুড়ে যাওয়া সসপ্যানের মতো হতশ্রী, মলিন, বিস্বাদ। লক্ষ করছি বাবা, মা, প্রণয়ী, ছেলেমেয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে সবসময় আমার থাকে না।” আমাদের সহজেই মনে পড়বে, মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে দেবারতির সম্পর্কও সাধারণ অর্থে পরিচিত ধরন থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। এই দুটি ভিন্নমাত্রার সম্পর্ক অন্তঃস্রোতে বয়ে এসে দুটি পৃথক ধারা থেকে এক হয়ে গেছে মণীন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর। এবার দুটো কবিতা পাশাপাশি বসিয়ে পড়ব, দুটি কবিতাই সন্ধেবেলা, চা-খাবার সময়ে লেখা। প্রথমটি নেওয়া ‘অগাধ বিরহ’ থেকে, দ্বিতীয়টি ‘করুণ ধানের গন্ধ’ থেকে।
|| ১ ||দুটি কবিতাই চা-পরবের। অলৌকিক চা-পরবের। দুটি কবিতারই সময়কাল অনিবার্যভাবে সন্ধ্যা। না-দিন, না-রাত। দুটি কবিতাই লেখা হয়েছে বিদেহী মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে। প্রথম কবিতায় ‘কতদিন পরে আজ কতদিন পরে’ তিনি এসেছেন, কাছে এসেছেন তবু মনে হচ্ছে তার গলার স্বর কতদূর থেকে ডাকছে, যেন অনন্তের পার থেকে ভেসে আসছে সেই গলার স্বর। তীক্ষ্ণ নীল সূর্যরশ্মি যেমন এ-নয়, নয় শ্রাবণসন্ধ্যার একটানা ঝিল্লিরব। তীক্ষ্ণ নীল সূর্যরশ্মি কখন আসে? ভোরবেলায়। একটানা ঝিল্লিরবই বা হয় কখন? শ্রাবণসন্ধ্যার কথা বলা হলেও এই রব সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এনে দেয়। তাহলে এই স্বর রাতেরও নয়, দিনেরও নয়। যখন দিনের শেষ, রাতের শুরু, তার মধ্যবর্তী কোনও সময়ের সন্ধিক্ষণে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁকে ডেকেছেন। চায়ে ক্লান্তি দূর হয়, কিসের ক্লান্তি? সারাজীবন যার সঙ্গে অভিন্ন দশায় কেটেছে, তার কাছে না-থাকতে পারার ক্লান্তি। চা, মণীন্দ্র গুপ্ত খেতে চাইলেও এই ক্লান্তি আসলে দেবারতির। কিন্তু সেই ক্লান্তি আরোপিত হচ্ছে মণীন্দ্র গুপ্তের বিদেহী সত্তায়। সেই চা-পান কেমন? বেলফুলের গাছের গোড়ায় জল ঢালবার মতো। এই পান যেন হয়ে উঠছে বিদেহী স্বামীর আমন্ত্রণ। বেলফুল সন্ধেবেলায় ফোটে এবং পরের দিন দুপুরে ঝরে যায়। ফাল্গুন থেকে শুরু করে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত বেলফুল ফোটে। বর্ষায়ও এই ফুলের অস্তিত্ব দেখা যায়। বসন্তের সংরাগদীপ্ত বেলফুল, গ্রীষ্মের সাধনরত বেলফুল, বর্ষার বিরহী বেলফুলের গোড়ায় জল ঢালবার মতো চা-পান যেন আমন্ত্রণ, অনেকদিনের অপেক্ষার পর সন্ধেবেলা লোকান্তরে যাবার ডাক। দ্বিতীয় কবিতা পরের বইয়ের। তিনটি গোলাপের অনুপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে এখানে, লাল, নীল ও সাদা গোলাপ। কবিতার শুরুতেই যে তিনটি গোলাপের প্রহেলিকা এসেছে, তা বস্তুত দেবারতি মিত্রের সামগ্রিক প্রেম-চেতনার স্বারবস্তু। হয়ত এত পরিকল্পনা করে কবিতা লেখা হয় না। হওয়া কাঙ্ক্ষিতও নয়। কিন্তু অকপটে বলা কথা মনের কোন গহন সত্যকে তুলে আনে, তার নিয়ন্ত্রণ স্বয়ং লেখকের হাতেও থাকে না সবসময়। এখানে তিনটি গোলাপ—লাল, নীল ও সাদা দেবারতি-মণীন্দ্রর সম্পর্কের সামগ্রিক রসায়নটাই ইঙ্গিতে উস্কে দিচ্ছে, যার অগ্রভাগে সংরাগদীপ্ত ভালোবাসার প্রত্যাশিত ছবি। কিন্তু চিরসখা চলে যাবার পর যেন সেই সংরাগ একপক্ষের। অন্যজন তাকে গ্রহণ করুক বা না-করুক, এই ভালোবাসা জানানো ছাড়া কোনো উপায় নেই দেবারতির কাছে। যতই যন্ত্রণা দেবারতিকে ছিঁড়ে খাক, এই প্রেম তার কাছে unattainable, unreachable, unrequited, যার কোনো প্রত্যুত্তর নেই। মণীন্দ্র গুপ্তের তিরোধানের পর যে মনা-র পৃথিবী সৃষ্ট হয়েছে, তা এই নীল গোলাপ খচিত। শাস্ত্র ভাঙা, পরিচিতি-ভাঙা, গতানুগতিকতার বাইরের সম্পর্কের স্নেহ-কামনার আধার এই প্রেম। তাহলে এই প্রেমের পরিণতি কী? ২ জুন ২০১৯, ‘সংবাদ প্রতিদিনে’ দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে দেবারতি বলেছিলেন: “এদিকে আমি চিরকালই মরে যেতে চাইতাম। উনি বলতেন, ‘কেন মরতে চাও! এত সুন্দর পৃথিবী তোমার কী করে ভাল না লেগে থাকতে পারে! মাঝে মাঝে বলতেন যে, ‘তুমি আগে মারা যাও, তারপরে আমি মরব। কারণ আমার মৃত্যুশোক তুমি সহ্য করতে পারবে না’। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন।” সেই সত্য যিনি বেঁচে রইলেন, তিনি বুঝলেন। সাদা গোলাপ যেমন সমস্ত ধরনের পার্থিব যৌনতা থেকে মুক্ত হয়ে, পার্থিব লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আরও নিষ্পাপ আর বিশুদ্ধ হয়; দেবারতির জীবনের সেই পর্যায় তাকে জীবদ্দশায় নিয়ে গেছে লোকান্তরে। ‘বরফনীল প্যান্ট’ ও ‘ছাইরঙা’ জামা পরা মণীন্দ্র গুপ্ত তার নিরাবেগ ব্যক্তিত্বের মোড়ক খুলে বলতে শুরু করেন: তুমি আমার কবি, শুধু আমারই কবি। আর কাউকে কখনো লিখবে না। কথা দাও, ধ্যানে, স্বপ্নে আমারই কবি থাকবে সারাজীবন। আদপে দেবারতি এখানে মণীন্দ্র গুপ্তের মুখ দিয়ে নিজেরই সতীত্বের বিশুদ্ধতার প্রমাণ রেখেছেন। কথাগুলি দেবারতির, মণীন্দ্র গুপ্তের নয়। ওই সাক্ষাৎকারেই জানিয়েছিলেন দেবারতি পরলোক তার আগ্রহের বিষয়। তাই, যদি অবোধ মনার মুখ দিয়ে তারই অবচেতন নিঃসৃত হয়, সেটা দেবারতির পক্ষে স্বাভাবিক। লক্ষ্য করবার মতো বিষয়, এই কবিতায় সতীত্বের প্রসঙ্গটি নিশ্চয়ই শারীরিক যৌনতার দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি হয়নি। ছাইরঙা-শার্ট-পরা লোকটা কিন্তু তাকে কবি হিসেবেই দেখেছেন। সমাজ-অনুমোদিত, বিবাহজনিত সঙ্গী হিসেবে নয়। আর সে-সম্পর্কই বা তাদের কবে ছিল! এই সতীত্ব তাই কবিত্বের। মণীন্দ্র গুপ্তের মুখ দিয়ে দেবারতি বলিয়ে নিচ্ছেন এই প্রণয়নিষ্ঠার কথা—যতদিন এই কবিজন্ম থাকবে, তিনি শুধুই সেই কবিত্বশক্তির পূর্ণতা দিয়ে তার চিরসখাকেই রচনা করে যাবেন। তিনি আকাশ, বাতাস, গাছপালা, পশুপক্ষী, আর কারোর না। তিনি শুধু একমন, একপ্রাণে একজনের প্রতিই আশিরনখ নিবেদিত।‘এক কাপ চা দাও’ তুমি বললে
কতদিন পরে আজ কতদিন পরে।
অনন্তের পার থেকে তোমার গলার স্বর
তীক্ষ্ণ নীল সূর্যরশ্মি নয়, নয় এ তো
শ্রাবণসন্ধ্যার একটানা ঝিল্লিরব।
বেলফুল গাছের গোড়ায়
একটু একটু করে জল ঢালবার মতো
তোমার গলার স্বর
আমার আত্মাকে শান্তি দিল,
লোকান্তরে নিয়ে গেল আজ।
|| ২ ||লাল গোলাপ, নীল গোলাপ, সাদা গোলাপ
কোত্থাও নেই।
ভ্যানগঘের ছবির মতো চিহ্নিত চেয়ার
গদিতোশকহীন কৃশ খাটের ধার চিত্রবিচিত্রিত।
বরফনীল প্যান্ট, ছাইরঙা শার্ট পরা পুরুষটি
অফিস থেকে ফিরে একটু শ্রান্ত।
এক কাপ চা খেতে খেতে বলল আমাকে—
তুমি আমার কবি, শুধু আমারই কবি,
আর কাউকে কখনো লিখবে না।
কথা দাও, তুমি ধ্যানে স্বপ্নে আমারই কবি থাকবে
সারাজীবন।
তারপর আকাশ বাতাস গাছপালা
পশুপক্ষীর সঙ্গেও আর ভাব হয়নি কখনো।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে রয়েছে, এই জগৎ পুরুষকার আত্মারূপে অবস্থিত থাকলেও তার একাকিত্বের জন্যেই তিনি আনন্দ পাচ্ছিলেন না। কেননা একাকী থাকলে কেউই আনন্দিত হয় না। তাই তিনি এক থেকে দুই হলেন। পূর্ণ করলেন নিজের অভিলাষ। তার স্বকৃত দেহভাগ থেকেই পতি-পত্নীর সৃষ্টি হল। এই কারণেই পুরুষকারের অসম্পূর্ণ দেহরূপ সম্পূর্ণ হয় পত্নীর সংগতেই। তিনি (পুরুষকার) সেখানে উপগত হলেন। এক থেকে দুই হল, একের কারণেই। দেবারতি-মণীন্দ্রের দাম্পত্যজীবনের ক্ষেত্রে এই কথা যে কতবড় সত্যি, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। অনিবার্য কারণেই যখন অভিন্ন কোনো যৌথজীবন একাকী হয়ে পড়ে, তখন তাকে মেনে নেওয়া যায় না। প্রয়োজনে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে, যুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে, আবেগের বিশুদ্ধতা তাকে প্রতিবাদী ও সংশয়ী হতে শেখায়। শোক এমনই মহার্ঘ্য অনুভূতি, শোকাধিকারীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক সত্তাকে সমস্ত ক্ষুদ্রতার গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরে নিয়ে আসে। বৈষ্ণব পদকর্তারা তো কবেই শ্রীরাধার বিরহজনিত রক্তপাতের পদগুলিকে ব্যক্তিক বেদনা থেকে নৈর্ব্যক্তিক দুঃখে পরিণত করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলী যদি বাংলাদেশের প্রেমশাস্ত্র হয়, তবে সেই প্রেমানুভূতির সর্বোচ্চ শিখরে রয়েছে বিরহের পদগুলি। দেবারতিও যোগিনী রাধার মতোই আত্মহারা হয়ে লিখে চলেছেন তাঁর কবিতাগুলি, যার অঙ্গে অঙ্গে সেই বিরহের ঘনীভূত জ্বালা। এই কবিতাগুলি লিপিকুশলতার মাপকাঠির অনেক ঊর্ধ্বে নিজস্ব পৃথিবীতে, রক্তমাখা নাছোড় ভগবানের মতো বসে আছে। আর মনে মনে বলে যাচ্ছে এমন কথা: “কেউ আর ডাকে না আমায়/ কেউ বলে না গল্প করো।/ বন্ধ দরজা, জানলাটি, বারান্দাও নেই—/ তুমি হয়ত কষ্ট পাচ্ছ আমারই মতন।/ এখানে বিকেল থেমে থাকে/ এখানে সন্ধ্যা থেমে থাকে/ আমার রাত্রি শুধু আমারই এখন।” এই কথাগুলি এক নির্জন, ছিন্নবুক মানুষের কষ্টের কথা বলে। চা করে রাখা আছে হয়তো, কিন্তু সেই ছাইরঙা-শার্ট-পরা লোকটা এল না! তখন চা-ঢালা অবস্থায় সেই কাপ বসানো থাকে। পাশে সেই লেখার তক্তপোষ, কাঠের চেয়ার। মানুষ আসে না, একটু হাওয়া আসে। তরঙ্গ খেলে যায় চায়ের শরীরে। নিষ্ফলা সেই বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্রি। যার আসবার কথা ছিল, আসেনি সে। কিন্তু তাই বলে সত্যিই কি তিনি নেই? এই যে দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের যৌথজীবন, বাচ্চা ছেলের মতো মণীন্দ্র গুপ্তকে আগলাচ্ছেন দেবারতি, আবার দেবারতির লেখা প্রতিটি অক্ষর অত্যন্ত নির্মম ভালোবাসায় দেখে দিচ্ছেন মণীন্দ্র গুপ্ত; নিজেকে বিলীন করে অন্যকে ভালবেসে তাঁরা আসলে বাংলা কবিতাকেই মহানুভবতায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ‘স্বকাল’ পত্রিকার মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যায় দেবারতি মিত্রের একটি নাতিদীর্ঘ লেখা আছে। সেখানে একজায়গায় তিনি লিখছেন: “কোনো পত্রিকায় লেখা জমা দেবার তাড়া থাকলে আমি ক্রমাগত ধাক্কা মারতে থাকি—‘কই লিখলে না, লিখছ না, আর সময় কোথায়?’ উনি বলেন—‘আমি ভাবছি’। ভাবতে ভাবতে বেশির ভাগ সময়ে ঘুমিয়েও পড়েন, আমার বড় ভাইজি মানুর ১২ বছরের ছেলে পৃথ্বীরাজও ওইরকম করে তার মায়ের শাসন থেকে নিজেকে বাঁচায়, বিপদ এড়ায়।” বিরানব্বই বছরের অলৌকিক শিশু নিশ্চয়ই কোথাও তেমনই ঘুমিয়ে পড়েছে ভাবতে ভাবতে। তাকে পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা জলপ্রপাতে, নামতা পড়ার সুরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়বার আওয়াজে, জুঁই ফুটে ওঠবার আগের ফোঁপানো কান্নায়, নিজের অন্তর্গত রক্তস্রোতে খুঁজে চলেছেন দেবারতি। শিশুটি দেখা দিচ্ছে না—এই যা।
সহায়ক বইপত্র:
১. ও ও ও ও, দেবারতি মিত্র, দেবভাষা, ২০১৯
২. পাখি ও পরি তখন, দেবারতি মিত্র, শুধু বিঘে দুই, ২০২০
৩. অগাধ বিরহ, দেবারতি মিত্র, চিত্রক পাবলিকেশন, ২০২০
৪. করুণ ধুনোর গন্ধ, দেবারতি মিত্র, কাগজের নৌকা, ২০২১
৫. গদ্যসংগ্রহ ১, ২, দেবারতি মিত্র, অবভাস, জানুয়ারি ২০১৮, নভেম্বর ২০১৮
৬. অক্ষয় মালবেরি (প্রথম পর্ব) মণীন্দ্র গুপ্ত, চিত্রক পাবলিকেশন, জানুয়ারি, ২০০৪
৭. উপনিষদ গ্রন্থাবলী, সম্পাদনা : স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯-তম পুনর্মুদ্রণ, আষাঢ়, ১৪২০
৮. স্বপ্ন, গিরিন্দ্রশেখর বসু, প্রথম পত্রলেখা প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০২০
৯. ‘মণীন্দ্র গুপ্ত অল্পস্বল্প’, দেবারতি মিত্র, ‘স্বকাল’ মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা, ২০১৮
১০. ‘একটা সময় আমার স্বামীকে আমি দেখতাম বাচ্চা চেকের মতো করে,’ সাক্ষাৎকার : দেবারতি মিত্র, সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ভাস্কর লেট, সম্বিত বসু, ২ জুন, ২০১৯
(ঋণ: 'পান' কবিতাটি নিয়ে মাননীয় অধ্যাপক শ্রীতপোব্রত ঘোষের সঙ্গে আলোচনা হয়। তাঁর মতামত ও বিশ্লেষণ আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। স্যারকে আমার প্রণাম জানাই। ‘স্বকাল’ পত্রিকার মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যার লেখাটি, ‘মণীন্দ্র গুপ্ত অল্পস্বল্প’ আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছেন রামানুজ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ‘সংবাদ প্রতিদিনে’ প্রকাশিত সাক্ষাত্কারটি খুঁজে দিয়ে অশেষ উপকার করেছেন সম্বিত বসু। লেখাটি পড়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়। লেখাটি সম্পাদনা করতে প্রতিমুহূর্তে পাশে পেয়েছি আত্মজন গৌরবকেতন লাহিড়ীকে।
সবশেষে যার কথা না-বললেই নয়, তিনি অরণি বসু। এই লেখাটি তাঁকে ছাড়া কখনোই সম্ভব হত না। অরণিদা-কে ভালোবাসা।)