• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | রম্যরচনা
    Share
  • আবার আনু : নিবেদিতা দত্ত
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩


    স্নেহের আনাই,
    তোর 'ভাল্লাগে না'গুলো এবার আমাকেও পেয়ে বসেছে। কখনো মনে মনে কোলকাতাকে বরফে মুড়ছি, কখনোও সেই কবেকার 'হুঁকোদা'কে ফিরে ডাকছি একটু গপ্পো করার লোভে। আর তার মধ্যেই দেখ তোর মেল--- তাতে আবার সেই 'ভাল্লাগে না'র জের। এমনিতেই তো এই ২০২০র করোনা আশংকায় ঘরবন্দি আমরা তো ভাল না লাগার খপ্পরে পড়েই আছি। কিন্তু তুই তো জানিসই তোর দিম্মাটার কোথাও হারিয়ে যেতে নেই মানা, তবে এবারের বেরিয়ে পড়াটা বেশিরভাগটাই কাছেপিঠে, নিজের মন থেকে অন্য কিছু মনের আনাচেকানাচে খুশি ভাগ করে নিতে।

    তোর সাথে অনেকদিন আমার কথা হয়নি, ওই বিজয়ায় তুই প্রণাম জানাস, আর আমি তোকে নববর্ষের আশিস পাঠাই। এরই মাঝে তোর মাম অবশ্য নানান ব্যস্ততার ফাঁকে আমায় জানিয়েছে তোর এই হঠাৎ ভালো না লাগার কথা। কী জানিস কোলকাতাকে ভাল লাগাতে বেশ কসরত করতে লাগে। তার এই রূপে অপরূপাকে খোঁজা--কষ্ট লাগে বইকি। কিন্তু দেখ, দেখতে শুনতে ভাল না হলেও, মুখের উপর কি তা বলা যায়? তাই এ শহরের ভালমন্দের বিচার ছেড়ে চল আবার মেলে মেলে ঘুরে বেড়াই। যখন তোকে প্রথম মেল করা শুরু করি তখন তুই কত বড় ছিলি বলতো?—আচ্ছা আমিও বেশ, অত অঙ্কের কি সত্যিই কোনো দরকার আছে? আর আমি আবার ওতে ভারী কাঁচা! আসল কথা এতদিন তো তোকে কিছু লিখে পাঠাইনি, কিছু গপ্পো তো জমেই আছে। আর গপ্পের মজাই হল একবার ঝুলি নাড়লে ঝুউ-ঝুর ঝুউঝুর করে কত কথকতা পড়তে থাকবে।

    আজকে আগেই লিখি এক পাঁচ-বছুরের কথা। নাম? ধরে নিই তোজো, কেমন? কোনো কোনো দিন মালি না এলে আমি গাছে জল দিই আর তোজো যায় স্কুলে। বাস না আসা অব্দি আমরা একটু গল্প সেরে নিই। একদিন সন্ধেবেলা হঠাৎ তোজো ওর প্রথম কিছু লেখা দিয়ে গেল। ও নাকি ঘরের মাঝেই সাইকেল চালায় আর লিখে লিখে সাইকেল বাস্কেটে রাখে আমাকে দেবে বলে। ওর মা বলছিল ও সাইকেল চালিয়েই আসতে চাইছিল। কিন্তু আমরা থাকি মাঝারি এক রাস্তার এপার-ওপার, তাই ওর মা রাজি হয়নি। সে যা হোক, তোজো লেখা দিয়ে খুশি, আমি পেয়ে। কারো মনে জায়গা করে নিতে পারলে আমার খুব আনন্দ লাগে রে আনাই, একটু অহংকার অহংকারও লাগে—যদিও সবাই বলে অহংকার ভাল না; কিন্তু হলে আর কী করি বল। কোনো কিছুর আশা না করে যদি একটু ভালবাসা পাওয়া যায় সেতো অনেক পাওয়া--তাই না?

                                                                —দিম্মা

    স্নেহের

           আনাই,

    আজ লিখছি ঝাড়ু পাখিদের কথা। ভাবছিস সে আবার কী! 'বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস'এ কিন্তু ও পাখি নেই। যদি বলি ওরা পাখি না, মানুষ; কী বলবি আমায়? জানি বলবি দিম্মাটা যে মাঝে মাঝে কী হেঁয়ালি করে! আসলে কোলকাতা নানান মানুষের জায়গা—নানান রাজ্য থেকে আসা লোক এখানকার পাকা বাসিন্দা হয়ে গেছে। বিহার থেকে প্রায় কুড়ি তিরিশ বছরের ওপর আসা কিছু মানুষ এই সল্টলেকেই তাদের রুজি খুঁজে পেয়েছে ইস্ত্রিওয়ালা আর ঝাড়ুদার হিসেবে। এই ঝাড়ুদাররা যখন দুটো ঝাড়ু বগলে হেঁটে বা সাইকেল চেপে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজে যায় হঠাৎ দেখলে ওদের অদ্ভূত এক ধরনের ঝাড়ু পাখিই মনে হয় আমার। দেখি ওদের আঁকতে পারি কিনা--এতদিন পর আঁকা কি আসবে হাতে? না সে অভিমান করে ছেড়ে গেছে আমায় জানি না।

    আমার আদর জেনো-–

                                                                —দিম্মা

    আনুরাম

    ইউরেকা!

    'ভাল্লাগে না' তাড়াবার একটা দারুন ওষুধ পেয়েছি। মনে পড়ে গেল মুম্বাইতে থাকা তোর মতো এক ছোট্ট মানুষের কথা। সে নিয়ম করে প্রতি বুধবার হ্যারির পিছনে ছোটে—ছোটার ফল? ঝোপেঝাড়ে পড়ে হাত পা ছড়ে যাওয়া আর রাশি রাশি দু-হাত উপচে পড়া খুশির রাজা হওয়া। হ্যারিটা কে--তাই তো? সে ছোটদের আদর খাওয়া নেহাতই এক দেশি কুকুর। তাহলে তো তার থাকার জায়গাটার কথাও বলতে হয়। মুম্বাইতে টি, আই, এফ, আর, নামে এক গবেষণাগার ও কলেজ আছে, সেখানকার ক্যাম্পাসও সমুদ্রের ধারে--ফ্ল্যাটের নীচেই ভারী সুন্দর এক এনক্লেভে ছোটরা খেলে বেড়ায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষার তোয়াক্কা না করে । সেখানেই হ্যারির বাস। ওর কাজের মধ্যে একটাই। সকালে যখন ছোটরা বাসে করে স্কুলে যায় ও নিয়ম করে ক্যাম্পাস গেটের কাছে এসে লেজ নাড়ায় আর তারপর সারাদিন এনক্লেভে আসাযাওয়া করা ছোটদের আদর খায়। কেউ দেয় বিস্কুট, কেউ ব্রেড, তাতেই ওর পেট ভরে যায়। আদর খেলে ওর চোখ নাকি কালো কুচকুচে মার্বেলের মত দেখায়, আমি দেখিনি--ছোটদেরই একজন এটার খোঁজ পেয়েছে। তা যে ছোটটির কথা লিখছি (ছোটই বলছি, পড়ে তো সবে ক্লাস ফোরে) তার মা একদিন জানালে সে নাকি পড়ে গিয়ে তার হাত পা খুব ছড়ে গেছে। ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে জিগেস করেছিলাম কারণটা। সেটা হ'ল প্রথম বুধবারের 'হ্যারি ফলোইং' খেলার ফলাফল। ফলো করতে করতে সটান কাঁটা ঝোপে গিয়ে সেঁধোনো। আহা আনু এর থেকে মন ভালো করার দাওয়াই আর কী হতে পারে বল? হাসছিস আর ভাবছিস দিম্মাটা যেন কী হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। নারে সত্যি আমরা কেন পারি না অমন ছুটতে। আচ্ছা বেশ, লোক হাসার ভয়ে নাহয় মনে মনেই ছুটব। ভেবেই তো আমার মন ঝলমলিয়ে গেল। ভাবলাম এক্ষুনি তোকে মেল করি। কেমন লাগল জানাবি কিন্তু!

                                                                —দিম্মা

    আদরের পোস্ত বড়া,

    মনে পড়ে গেল এ নামে ডাকলে তুই কত খুশি হ'তিস--আমরা দুজনেই যে পোস্ত বড়ার ফ্যান!

    লিখেছিস 'হ্যারি ফলোইং'এর কথা ভেবে তুইও খুব মজা পেয়েছিস, অবাকও হয়েছিস ভেবে এমনটা করা যায় নাকি? যায়-ই তো-- কেউ তো ভেবেছিল অমন করে, আর যেমন ভাবা তেমন কাজও করে দেখে নিয়েছিল।

    আচ্ছা, কখনো বর্ষার জলে সোজা চিৎপটাং হয়ে শুয়ে দেখেছিস? তাতে অবশ্য কানে জল ঢুকে কান পাকতেই পারে, যেমনটা সেই মুম্বাইএর ক্ষুদের হয়েছিল কিন্তু আনন্দটাও তো কম হয়নি। জানি না বর্ষার দিনগুলো তোর কেমন কাটে—মাম নিশ্চয় হাজারটা না-এর জালে বেঁধে ফেলে, তাই তো? 'বরষার জলে পা দিও না, বাইরের খাবার খেও না, ফুচকা তো নয়ই। হাত ধোবেই ধোবে খাবার আগে' এমনি আরো কত কী। আর আমার তো জানলা-দরজা বন্ধ করা, ভিজে কাপড়ের ডাঁই শুকোতেই দিন যায় আর তার সাথে মন ভার মাথা ভারের দাপটে কাহিল হওয়া; বরষার জলে চিৎপটাং হয়ে শোয়া আর হয় কোথায় বল? কান নাহয় পাকে না, কিন্তু কতটা আনন্দ বাদ যায় বল্‌ তো?

    আচ্ছা এ নাহয় করা গেল না। কিন্তু যদি রেনি ডে হয়ে স্কুল বন্ধ হয়ে যায় যেমন সেবার মুম্বাই-এ হয়েছিল আর আমাদের ছোট্ট কল্পনাবাগীশটি মহানন্দে রঙিন ছাতাকে তাঁবু ভেবে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে তার তলায় সেঁধিয়েছিল, তেমনটা যদি আমরা করি তাহলে কেমন হয়? এমন খুশি কি তুই আমি হতে পারি না? রঙিন ফুলছাপ ছাতা তো থাকেই বাড়িতে, কিন্ত তার তলায় চাদর মুড়ি দিয়ে শোওয়া কোথায় হয় রে। ভাবছি করে দেখব, ইচ্ছে হলে তুইও করে দেখতে পারিস। সব ভাল্লাগে না গুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যাবেই যাবে।

                                                                —ইতি তোর ক্ষেপি দিম্মা।

    আনু,

    লিখেছিস বর্ষার জলে চিৎপটাং হয়ে শোওয়া হয়নি তবে স্কুল বাস থেকে নেমে জুতো মোজা হাতে জমা জলে একটু পা ছপছপিয়ে নেওয়া গেছে। তা বেশ করেছিস, ওইটুকুই ঢের—বড় শহরে বৃষ্টির জল তো আর খুব পরিষ্কার হবে না—বাড়ি এসে হাত ধুতে ধুতে সেই 'ডেটল হি ডেটল হো' গানটা গেয়ে নিয়েছিস নিশ্চয়।

    জানিস আনু, আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। তেতলার ছাদে বেশ থোকো থোকো সবুজ মখমলের মত শ্যাওলা জমেছে, প্রায় ভরে গেছে ছাদ। হঠাৎ দেখলে মনে হচ্ছে সেই টিভিতে ওয়েদার রির্পোটে দেখানো রঙিন গ্লোবের গা, তাতে অবশ্য দেশ চিহ্ন করার জন্য অন্য রং ও থাকে।

    আনাই, আজ কিন্তু তোকে 'কিং অফ মুনা'র গল্পটা বলবই বলব। কে এই কিং? সেই আমাদের আগের জানা ছোটটি। একদিন দেখি হঠাৎ চানঘর থেকে নাংগা বেশে (তোয়ালে নিতে ভুলে যাওয়ার ফল আরকি) লাফ দিয়েই খাটে উঠে চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে শুধু পা বার করে খানিক তিড়িং বিড়িং নাচ আর তার সাথেই ফরমান জারি 'আই এম দ্য কিং অফ মুনা'। মুনার রাজ্য খাড়া হল। তাতে লোক লস্কর, পাইকপেয়াদা তো চাই। কদিন ধরে বিচার বিবেচনা করে এল 'কুইন অফ মুনা'--তার মাসি, মাদার অফ দ্য কিং—আমি, আরো অনেকে। যোগ্যতা প্রমাণের কোনো ব্যাপার ছিল না, রাজা শুধু আমাদের হাতে একটি করে রুপোলি তারা স্টিকার আটকে দিলে—সেই আমাদের নতূন রাজ্যের সদস্য পরিচয়পত্র। তুই যদি সেনাপতি-টতি হতে চাস বলে দেখব'খন। রাজ্য সামলাতে সেনাপতি তো নেহাতই জরুরি তাই না। একটা ছবি তাড়াতাড়ি এঁকেছিলাম 'কিং অফ মুনা'র। দেখি খুঁজে পাই কিনা। আমার অনেক আদর জেনো--

                        —দিম্মা

    পুনঃ- চিঠি তোমার কেমন লাগল জানিও—ভাল লাগলে ঝুলি হাতড়াতে বসে যাব তোমার জন্য।–-দিম্মু।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments