নানান ঝুট-ঝামেলার মাঝ দিয়ে বসন্ত কাল কিন্তু এসেই গেল—২০২২র বসন্ত। তবে কোলকাতা শহরের বসন্ত তো! ভোরের দিকে অল্প একটু কোকিল ডাকায়, কৃষ্ণচূড়ার কচি পাতায় জানি সে এল বলে (গাছগাছালি ভরা সল্টলেকে থাকার দৌলতেই এ সম্ভব তাও ঠিক)। আর অবজ্ঞাভরে ছুঁড়ে ফেলা গরম জামা—এ ঘরে ও ঘরে খাটের একপাশে বোঁচকা বাঁধা, কবে কাচা হবে না জানা সোয়েটার মাফলারের স্তূপও জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। তবে বাসা বাঁধার তাগিদে পাতিকাকের ধারালো ঠোঁটে শুকনো ডাল ভাঙাতে বেশি পাই বাসন্তিকার আগমনের খবর। আরও কয়েক জনা আছেন, তাঁদের ভুললে চলবে কেন? ওঁরা হলেন প্রথম পাতের নিম-বেগুন আর বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হোমিওপ্যাথির ম্যালান্ড্রিনাম। হাসছিস! তা হাস কিন্তু এদের সবাইকে নিয়েই তো এ দেশের বসন্ত কাল।
প্রকৃতির এই নতুন হওয়ার মাঝেও আমি কিন্তু সেই পুরনো বছরের জের টেনে এখনও গৃহবন্দীই বলতে পারিস। ওই হাট-বাজারের ছুতোটা আছে বলেই বাঁচোয়া। যেখানেই যাব ভাবছি সে আন্দামানই হোক বা পুরী বেনারস, কোথাও হোটেল ফাঁকা নেই—মানুষ যেন এই দু বছরের বন্দীদশার পুরো শোধ তুলছে। বই মেলাতেও নাকি প্রতিদিন এক লাখের মত মানুষের ভিড় হয়েছিল—নিউজ চ্যানেলরা অন্তত তাই বলছে।
তাহলে উপায়? সে তো একটাই—আমার আনাইয়ের কাছে হাট করে মনের দরজা খুলে দেওয়া। জানিসই তো আমি ফেসবুক হ্যোয়াটসঅ্যাপ কোনোটাতেই নেই, তুই-ই আমার ওই সবগুলো এক সাথে করা একটা বান্ডিল। আর মজাটাও ওই একটাই, কেউ তো নেই দোষ-ভুল ধরার, আমি বলি আর তুই শুনিস এই তো!
তোর পর আমার আর বন্ধু বলতে কাছেপিঠের যেখানকার যত মালী। তোর মাসিমণি অবশ্য একথা জানলে মুখভার করবে, কিন্তু ওর সাথে আমার অন্য রকমের ভাব, ওর সাথে গান গাই বিড়াল দেখি। এই দেখ এক কথা বলতে অন্য কোথায় ভেসে যাচ্ছি। হচ্ছিল মালী বন্ধুদের কথা। হাসি চাপতে পারছিস না তাইতো, কেউই পারে না। কি করি বল, পারি না যে—যেখানে যাই আগেই গাছপালা চোখে পড়ে, তাদের নিয়ে নানান প্রশ্ন করি, কখনো ওঁরা কিছু গাছপালা দেন, আদাজল খেয়ে ওদের বাঁচাবার চেষ্টা করি আর আমার মোবাইল এই মালী বন্ধুদের ফোন নম্বরে ভরা থাকে। কোন গাছ সংখ্যায় বাড়াতে কাটিং-ই যথেষ্ট নাকি বীজ ছাড়া গতি নেই—এমন সব কত শত গুগলকে করা প্রশ্ন আমার ‘আস্ক এনিথিং’-এ। তবে কি জানিস এত সবে বেশ ভরা ভরা লাগে; গাছ বাঁচানোর উৎকণ্ঠা, বীজ পুঁতে চারা বেরনো অবধি উদ্গ্রীব অপেক্ষা—এ যেন বলে বোঝানোর নয়। আর গার্ডেনিয়ায় একসাথে প্রথম চারটে ফুল দেখার আনন্দ--সে যে অনবদ্য। জানিস এখানে সবাই বলছে গার্ডেনিয়া শৌখিন নাম হলেও ও নাকি বাংলার গন্ধরাজ। আমি ঠিক জানি না, তবে আমার কিন্তু মহারাষ্ট্রের নামটাই বেশি ভাল লেগেছে, ওখানে সবাই বলে ‘অনন্তা’।
এর মাঝে হতাশাও আছে রে আনু। আমাদের বাড়ির সামনে ফুটপাথটি একেবারে দাঁতভাঙা, আর ভাঙা অযত্নের জায়গাতেই যত জঞ্জাল জমা হয়, এখানেও তাই হচ্ছিল। আমি তা এড়াতে ভাঙা জায়গাগুলিতে গাছ দিয়েছিলাম, সকলের চোখও টেনেছিল গাছগুলো এই সাত সাতটা বছর। হঠাৎই গরুর উৎপাত, একেবারে চিবিয়ে সব মুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তি দিয়ে বুঝছি ওরা খাবার পায় না তাই অমন করে। কিন্তু মনে ভারি কষ্ট পাচ্ছি, আর গরু কোন গাছ খায় না গুগলকে করা সেইসব প্রশ্নে আমার মোবাইল আবারও ভরে উঠছে।
আসল কথা কি জানিস চারদিকের বাইরের দরজা যত বন্ধ হচ্ছে মনের দুয়ার পরতে পরতে ততই খুলে যাচ্ছে। দেখ আজকাল কোথাও গিয়ে নিরিবিলিতে সাত-আট দিন হাত-পা ছড়িয়ে কাটানো গেল তা হবার নয়, তাই ভাষাছাড়া এই গাছপালারা এত টানে। এর ফাঁকে ফাঁকেই মনে আসে হারানো কিছু দিনের কথা। সেকালে বাগানবাড়ি না থাক, নিদেনপক্ষে এক-আধটা গ্রামের বাড়ি প্রায় সবারই থাকত। হঠাৎই মনে করলে বলা যেত ‘চল বেরিয়ে পড়ি, যাই গ্রামের দাদু দিদিদের (দূর সম্পর্কে্রই সই) দেখে আসি।’ বিজলি বাতি, পাখার অভাব মিটিয়ে দিত নদীর ধার বা পুকুর পাড়ে তালের সারির ছায়া ।
দেখ আনাই পাঁচতারা হোটেল, প্লেনে যাতায়াত, ব্যুফে ব্রেকফাস্ট, দামি গাড়িতে ট্যুর--এসব হয়তো কারো কল্পনাতেই আসত না, কিন্তু কথায় কথায় আধার কার্ড বা আরটিপিসিআরের ভূতও ধাওয়া করত না। পদে পদে সাবধানতা, অন্যমনস্ক হওয়া চলবে না, নইলে খেসারত দিতে হবে পার্স বা মোবাইল সেট। অথচ বেড়ানোর প্রথম কথাই বোধহয় খেয়ালে ভেসে অন্যমনস্ক হওয়া।
হ্যাপা যদি এখানেই শেষ হত তাহলে বা হত। কিন্তু আজকের দিনে বেড়াবার প্রস্তুতি-লিস্ট এত ছোট নয়--এর সাথে আছে বাড়ি পাহারার সিকিউরিটির ব্যবস্থা, দেড়-দু মাস আগে প্লেনের টিকিট ও হোটেল বুকিং, ফ্যাশানেবল জামাকাপড়ের চিন্তা—আরো কত কি! এতসবের পর দুই বা তিন দিন হোটেল বাস, যাতায়াত নিয়ে পাঁচ দিন, তাতেই মনে হবে খুব বেড়ানো হল নাকি শুধু বলা যাবে ‘বেড়িয়ে এলাম’। অন্যদিকে ট্যুর ট্র্যাভেলসের সাথে গেলে নিজের অতি দামি নির্জনতা খোয়াতে হবে অপরিচিতের ভিড়ে। কিছুটা ঝাঁকিদর্শন অবশ্য হবে।
হারানো সেসব দিনে কিছু মানুষের নিজের গাড়ি হয়ত ছিল। না থাকলেও কুছ পরোয়া নেহি—খট-খটাং কু ঝিক-ঝিক তো ছিলই। খোলা জানলা দিয়ে দুধারে সবুজ দেখতে দেখতে ধুলো-বালি মেখে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতেই এসে যেত গন্তব্যস্থল। টিনের চাল দেওয়া স্টেশনের একধারে লাইন দেওয়া সাইকেল কার্ট, চড়ে বসলেই হল। ঠিকানা? বললেই হবে, ধরে নেওয়া যাক, ভটচায বাড়ি। ভ্যানওআলা এক গাল হেসে বলবে ‘হুই চণ্ডীতলা ছাড়ায় সেই ভটচায কর্তা তো, চিন্তা করবেন নি মা, ঠিক নে যাবানি।’
ফোটানো জল বা মিনারেল ওয়াটারের বালাই ছিল না তখন। মাটির হাঁড়িতে ফটকিরি দেওয়া জলে তেমন কিছু অসুখবিসুখ হত কি? হয়ত একটু-আধটু পেট ব্যথা--তাও গ্যাঁদাল পাতা আর থানকুনির ঝোল খেলেই সব ঠিক! সাথে সাদামাটা দু সেট কাপড়জামা, শীতকাল হলে গায়ের র্যাপার গামছা সাবান কিছু দরকারি ওষুধপাতি, আর হ্যাঁ, একটা মশারি থাকলেই দিব্যি চলত, বুঝলি। তাও দিদার মাখা সর ময়দা হলুদবাটার কাছে হার মেনে শহুরে সাবান বেশিরভাগ সময়ই মোড়কে মুখ লুকাত।
কয়লা ইঞ্জিন টানা ছোট ছোট ইস্টিশনে থামা ট্রেনে যদি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত দিদা সন্ধ্যে সন্ধ্যে রাতের পাট মিটিয়ে দিতেন। আনাই, এখানেই বলে রাখি দেরি করে পৌঁছলে বিরক্তির কিছু ছিল না, অজানা অচেনা ছোট গ্রামগুলোও তো বেড়ানোর মধ্যেই পড়ত, তাই না? রাতে, কাঠের আঁচে সদ্য সেঁকা হাতে ফুঁ দিয়ে ভাপ নামানো ফুলকো রুটি আর তার সাথে, সব স্বাস্থ্যের কথা উড়িয়ে দিয়ে বেশ তেলতেলে তরকারি, শেষ পাতে ঘরে ভাজা জিবগজা আর ঠান্ডা জল—সে যেন পরম পাওয়া। খাওয়ার পর হাতপাখা নিয়ে উঠানে খানিক গল্পগাছা—ওঁরা নেবেন শহরের খবর, আমরা পাড়ার সবার হাল হকিকত শুধাবো। একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া, আর পাশেই গোয়াল ঘর থেকে আসা গরুর ঘণ্টির আওয়াজে সারা দিনের ক্লান্তি ডুবিয়ে একদৃষ্টে মশারির ভিতর থেকে চৌকো এক তারা ভরা আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া, আর যদি পূর্ণিমা হয় তো বেশ লাগে সেই ছোট্ট চৌকনো ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়া মেঝেতে বাইরের ডালপালার কালো ঘন ছায়া-আলপনা।
ভোরের তারা মিলোতে না মিলোতে উঠে উঠানের নিমের হাওয়ায় চোখ মেলা, কুয়োতলায় মুখে জলের ঝাপ্টা মেরে ধানখেতের আল ধরে উঁচু করে ছাপা শাড়ি পরে হন হন হাঁটা দেওয়া। ঠান্ডা কাল হলে টাটকা খেজুর রসের লোভে এদিক-ওদিক তাকানো। তার আগে অবশ্য দিদার কাঠের বাসনের বাক্স থেকে আমাদের জন্যই বার করা কলাইয়ের সবুজ বা বেগুনি মগে ঘন গরুর দুধের চা। কেবল আমার সয় না, তাই শহর থেকে আনা গুঁড়ো দুধের চা আর পাড়ার মনিহারি থেকে মারি বিস্কুট। পাড়া বেড়িয়ে ফিরে মুড়ি আলুর চপ বা ঘুগনি মুড়ি, আবার কখনো জম্পেশ করে মাখা ছাতু মুড়ি আর শেষে কড়াইতে দুধ জাল দেওয়া ঘন দুধের চাঁছি। হাতে সময় থাকলে দিদা যা বোন্ডা বানাতেন খেতের টাটকা বিন্স গাজর ফুলকপি দিয়ে তা কোলকাতার সাউথ ইন্ডিয়ান কাফেকেও হার মানাত। ‘কার কাছে শিখলে দিদা এমন বড়া?’ জিগেস করলে মুচকি হেসে বলতেন ‘বলব কেন?’
বেলায় অল্প একটু রান্নাবান্নায় হাত বাটানো। ব্যাস! তারপর মাটির মেঝেয় মাদুরে দে লম্বা। বই পড়ো বা না পড়ো কি আসে যায়। রান্নাশাল থেকে দিদা বার কয়েক হাঁক পাড়ায় আড়মোড়া ভেঙে দিদারই একটা আটপৌরে শাড়ি পরে পুকুরঘাটে গুটি গুটি এগোনো, কেউ দেখে ফেললে যে বলবে ‘কেন ঘেরা কলতলা তো আছে বাড়িতে’। পুকুরের শানে পা ঘসে সর ময়দা মেখে স্নানের যে আলাদা স্বাদ কি করে বোঝাই। কখনো পা ঘসতে ঘসতে আনমনে মুখ তুলে দেখা শিঙ্গি মাছের মত কালো রোগা ন্যাংটা খোকার ঝপাং করে জলে ঝাঁপ দেওয়া। তারপর ডুবসাঁতার দিয়ে ও পাড়ে উঠে আমায় দেখে পাড়ে রাখা ছোট গামছার নেংটিখানি পরে মার দৌড় খেতের ভিতর দিয়ে ঘর পানে।
দুপুরে কাঁসার থালায় আপত্তি করায় (অত মাজামাজির দরকার কি?) খেতের কলাপাতা এনে কুয়োশালে ধুয়ে মুছে নিত চা-পিসি। তারপর আর কি! তাল পাতার পাটিতে সার দিয়ে বসে পড়ো—সে যে কি ভাল লাগা তোকে কি বোঝাই আনু, একঘেয়ে ডাইনিং টেবল, কত কায়দার চেয়ার, টেবল ম্যাট, সব কদিনের জন্যে ভুলে মেরে দেওয়া--। কখনোসখনো আবার দিদা-দাদু পাড়ার কাউকে কাউকে খেতেও বলতেন আমাদের খাতিরে। পাতে থাকত উচ্ছে দিয়ে লাল শাক ভাজা, কাঁচা মুগের ডালের সাথে কুরকুরে পুঁটিমাছ, আলু ফুলকপির মাখো মাখো তরকারি, চাল কুমড়োর বড়ি দিয়ে পুকুরের রুই মাছের ঝাল। শেষ পাতে চালতার মিষ্টি অম্বল বা দিদার স্পেশাল কুলের আচার। পাড়ার ময়রার ছানার মুড়কি আর ঘরে পাতা দই দিয়ে ভোজ সমাপন।
তুই হয়তো বলবি ‘এত তো বকে গেলে, কই কে তোমার ভটচায দিদা, গ্রামের নামই বা কি বললে না তো?’ ওরে একটা নাম হলে তো বলি। ওই যে বললাম মনটা পালাবার জন্য আঁকুইপাঁকুই করছে, বাইরের দরজা তো প্রায় সবই বন্ধ, সামান্য লড়ঝড়ে মিনিবাসেই ওঠা মানা, তাই ইচ্ছে সড়ক ধরে অচিনপুরে গিয়ে পড়েছি। যাদের দেখেছি, যে আদর পেয়েছি তাদের থেকে, তাই নিয়েই সাজিয়েছি আমার অচিনপুর—-ভাবছিস বাবাঃ এ তো এপ্রিল ফুউলের বাড়া হ’ল; --তা নাহয় একটু ওইরকমই হ’ল, কি এসে যায়—এ মেলে তো ভাইটু কেবল তুই আর আমি। আমার হাত-পা ছড়িয়ে সাতদিন থাকা তো হ’ল।
একটু মজা করলাম, রাগ কোরো না কিন্তু। সামনেই নতুন বছর, অনেক আশীষ দিয়ে আজকের মত এই অব্দি।
–দিম্মা