• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | প্রবন্ধ
    Share
  • হেমেন্দ্রকুমার রায়ঃ এক পথিকৃতের কীর্তিকাহিনী : প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

    বাংলা শিশু সাহিত্যে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীকে অপাঙ্‌ক্তেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় আরেকটি অস্ত্র হলো গল্পের মূল চরিত্রগুলিকে heteronormative দৃষ্টিকোণ থেকে সংসার-বিমুখ, অতএব 'স্বাভাবিক' সমাজ জীবনের মুখ্য দায়িত্বের প্রতি উদাসীন দেখিয়ে তাদের নৈতিকভাবে হেয় করা। আমরা এই পর্বে দেখাব যে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গী আর ঔরসজাত সন্তান ছাড়াও পরিবার হয়! এবং এইসব পরিবারে তথাকথিত 'স্বাভাবিক' সংসারের মতোই মায়া, মমতা, এবং একে-অপরের প্রতি গভীর প্রেমের উপস্থিতি আছে।



    দ্বিতীয় পর্ব

    অভিযানকারীদের ‘পরিবার’:

    বেশির ভাগ বাংলা উপন্যাসে অ্যাডভেনচার-প্রবণ যুবকদের পারিবারিক পাশ বা সাংসারিক দায় বলে কিছু নেই; যেমন বিমল-কুমারের আর্থিক সঙ্গতি যথেষ্ট এবং কোন পিছুটান নেই; আর হয়তো নেই বলেই তারা ঝাঁপ দিতে পারে অকূল পাথারে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্তের কীর্তি উপন্যাসে জয়ন্ত-মানিক সম্পর্কে খবরঃ ‘তারা দুজনেই মাতৃপিতৃহীন, কাজেই স্বাধীন। দুজনেরই কিছু কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে, কাজেই তাদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ও নেই’। কোথাও-কখনো বাবা-মা বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের উল্লেখ থাকলেও তার গুরুতা আদপে নেই। যেন, পারিবারিক প্রসঙ্গটি শুধু উহ্য নয়, একেবারে বাদ না দিলে, অ্যাডভেনচার-প্রিয় বাঙালি চরিত্রদের বাস্তবগ্রাহ্য বা বিশ্বাসযোগ্য করাই যায় না।[১]

    আপাতদৃষ্টিতে এই মন্তব্য যথার্থ মনে হতে পারে। কিন্তু এর পেছনে আছে এক প্রাচীন এবং গভীর ও সঙ্কীর্ণ মানসিকতা-প্রসূত মৌলবাদঃ বিপরীত লিঙ্গের দু’টি মানুষ একত্র হবে, এক বা একাধিক সন্তানের জন্ম দেবে; এই মর্মস্থল বাদে পরিবার হতেই পারে না! বৃহত্তর বাস্তব জগতে এই ধারণায় যে কতখানি প্রমাদ আছে, তার প্রমাণ অন্তর্জাল ঘাঁটলেই মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যাবে। একাধিক সভ্য দেশে সমলিঙ্গের মানুষেরা বিবাহ এবং সন্তান-পালনের অধিকার ভোগ করেন। সনাতন ভারতবর্ষ বিদেশী শাসকের প্রণয়ন করা ৩৭৭ ধারা তার স্বাধীন আইন ব্যবস্থায় সযত্নে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং সেই বিদেশীরা নিজেদের দেশে ১৯৬৭ সালে এই চিন্তাধারা ও তার থেকে তৈরি আইন পরিত্যাগ করলেও ভারতের তা’ করতে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক অবধি লেগে যায়! তাও সমকামী সম্পর্ক আইনী অপরাধ নয়, এইটুকুই। সমকামীদের বিবাহ বা সন্তান-গ্রহণের ন্যায্য অধিকার এদেশে এখনও সুদূর পরাহত।

    বিশ্বসাহিত্যে অবশ্য অনেক আগে থেকেই সমলিঙ্গের চরিত্রদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এই রচনায় আমরা যাদের নিয়ে আলোচনা করছি, তাদের পূর্বপুরুষ শার্লক হোমস ও ডাঃ ওয়াটসন আমার প্রথম উদাহরণ। এর উত্তরে যাঁরা হাত-পা ছুঁড়ে এই জুটির দ্বিতীয় অভিযানেই (The Sign of Four, ১৮৯০) ওয়াটসনের কুমারী মেরি মর্স্টনের সঙ্গে বিয়ের কথা তুলবেন, তাঁদের উদ্দেশে গবেষক গ্রেহাম রবের উক্তি উদ্ধৃত করছিঃ

    Early in the investigation, Dr Watson inconsiderately falls in love with the distressed client:

    ‘What a very attractive woman!’ I exclaimed, turning to my companion.

    He had lit his pipe again and was leaning back with drooping eyelids. ‘Is she?’ he said languidly; ‘I did not observe.’

    ‘You are really an automaton – a calculating machine’, I cried. ‘There is something positively inhuman in you at times.’

    He smiled gently.

    The human calculating machine tries to woo Watson away from his beloved Mary. Summoning up a meal of grouse and oysters, he chides his friend, ‘You have never yet recognized my merits as a housekeeper.’ He even tries to impress him with his bedside manner … His wifely virtues spurned, Holmes loses his friend to marriage with ‘a most dismal groan.’

    Happily, Mrs Watson never materializes and has the grace to be dead by 1904. ‘Old times’ return, with many moments of fervent intimacy: Watson’s hands are clutched, his knees patted, and his ears brushed by Holmes’s whispering lips … In the following scene [from the short story ‘The Three Garridebs’], Watson has been shot and feels a searing pain in his thigh. The 19th-century man of forensic investigation meets the 19th-century man of medicine in a loving embrace:

    My friend’s wiry arms were round me, and he was leading me to a chair.

    ‘You’re not hurt, Watson? For God’s sake, say that you are not hurt!’

    It was worth a wound – it was worth many wounds – to know the depth of loyalty and love which lay behind that cold mask. The clear, hard eyes were dimmed for a moment, and the firm lips were shaking … All my years of humble but single-minded service culminated in that moment of revelation.[২]

    এঁদের পরেই আছে পি জি উডহাউসের-সৃষ্ট, আপাতদৃষ্টিতে প্রভু-ভৃত্য জুটি বার্টি উস্টার-জীভস (প্রথম গল্প ‘Leave it to Jeeves’ ১৯১৬ সালে প্রকাশিত)[৩]। আদপে জীভস বার্টির অভিভাবক এবং বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে তথাকথিত ‘প্রেম’-এর ক্ষেত্রে কঠোর শাসনকর্তা। একাধিক ছোট গল্প ও উপন্যাসে বারবার প্রমাণিত যে বার্টির জীবনে কোন প্রেমিকা বা স্ত্রীর প্রবেশের প্রশ্ন ওঠে না, সেরকম সব সম্ভাবনা জীভস অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে রদ করে, সেই জীভস যে আবার বার্টির একাধিক বন্ধুকে তাদের বিষমকামী প্রেমের বিয়েতে পরিণিত লাভ করায় সাহায্য করে। বিশেষ করে ‘Bertie Changes his Mind’ নামক ছোট গল্প এবং The Inimitable JeevesThank You, Jeeves উপন্যাস দুটির উপসংহারের দিকে সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

    তারপর দুই পুরুষ, একজন ভৃত্য যে মাঝে-মাঝে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, আর এক সারমেয়! বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘার কথা মনে পড়ছে তো? ঠিক এই রকম ‘পরিবার’ বাঙালি পাঠক দেখেছেন প্রথমে ফরাসী ভাষায় ১৯২৯ সাল থেকে রচিত, এবং তারপর বিশ্বের একাধিক ভাষায়, এমনকি বাংলাতেও অনূদিত, ধারাবাহিক অ্যাডভেঞ্চারের সচিত্র কাহিনীতেঃ টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, তাদের খানসামা নেস্টর, এবং কুকুর, যার ফরাসী নাম ‘মিলু’, ইংরেজি নাম ‘স্নোই’, আর বাংলা নাম ‘কুট্টুস’। ব্রিটেন আর বেলজিয়ামের পর আসুন আমেরিকায়। ইংরেজিতে লিখিত ও চিত্রিত ব্যাটম্যানের (রেখায়-লেখায় জন্ম ১৯৩৯) কাহিনীতেও দেখি, তার ‘পরিবার’ বলতে ছোটবেলা থেকে তার বাটলার অ্যালফ্রেড, আর কিছু পরে কিশোর/যুবক রবিন।[৪]

    বাংলায় এমন ‘পরিবার’ আমরা দেখতে পাব অজিত ও ব্যোমকেশকে নিয়ে। একটু ভেবে বলুন তো, সত্যবতীকে বিয়ে, তারপর খোকার জন্ম, এসবের মাঝখানেও ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের শেষে যে সহবাস শুরু হয়েছিল, তা’ লেখক অক্ষত রেখে দেন কেন? আর ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের বাসিন্দাদের সম্বন্ধে পূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন মরশুম মুখোপাধ্যায়।[৫]

    এবার আসি বিমল-কুমারের প্রসঙ্গে। যকের ধন-এ কুমারের ঠাকুরদা মারা গেছেন, কিন্তু মা আছেন, আছে তার পোষা দেশী কুকুর বাঘা, কুমারের বয়স সতেরো বছর, সে ‘সেকেন্ড ইয়ারে’ পড়ছে। কুমারের চেয়ে বিমল বছর-তিনেকের বড়, সেই বছরেই সে বি-এ দেবে। বিমলের বাড়িতে কে আছে তা কিন্তু কুমার আমাদের জানাচ্ছে না! সপ্তম পরিচ্ছেদে বিমলের মুখ থেকে আমরা জানছি তার পুরোনো, বিশ্বস্ত, এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী ভৃত্য রামহরির কথা। এই পরিচ্ছেদেই কুমার বিমলকে জানাচ্ছে যে তার মা গেছেন শান্তিপুরে, কুমারের মামার বাড়িতে। তাঁকে না জানিয়ে কীভাবে সে বিমলের সঙ্গে খাসিয়া পাহাড়ে অভিযানে যাবে? বিমল উত্তরে বলছে কুমার যেন তার মাকে চিঠি লিখে জানায় যে সে বিমলের সঙ্গে আসাম বেড়াতে যাচ্ছে। অষ্টম পরিচ্ছেদে বন্ধুর প্রতি সহানুভুতিশীল বিমল মার জন্য মন-কেমন-করা কুমারকে জানায় যে কুমার সেইদিনই তার মার দেখা পাবে। আসাম মেলে ওঠা করালী ও তার দলবলকে বোকা বানিয়ে তারা রাণাঘাটে নেমে চলে যায় কুমারের মামার বাড়ি শান্তিপুরে। এবার নবম পরিচ্ছেদে আমরা বিমল-কুমারের সুদীর্ঘ saga-য় শেষবারের মতো কুমারের মার দেখা পাব। এই দৃশ্যে কিছু কথা মনোযোগ-সহকারে পড়া প্রয়োজনঃ

    তিনদিন মামার বাড়িতে খুব আদরে কাটিয়ে মায়ের কাছ থেকে আমি বিদায় নিলুম। মা কি সহজে আমাকে ছেড়ে দিতে চান? তবু তাঁকে আমরা যকের ধন আর বিপদ-আপদের কথা কিছুই বলি নি, তিনি শুধু জানতেন আমরা আসাম বেড়াতে যাচ্ছি।

    যাবার সময়ে বিমলকে ডেকে মা বললেন, “দেখ বাবা, আমার শিবরাত্রির সলতেটুকু তোমার হাতে সঁপে দিলুম, ওকে সাবধানে রেখো।”

    বিমল বললে, “ভয় কি মা, কুমার তো আর কচি খোকাটি নেই, ওর জন্যে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”

    মা বললেন, “না বাছা, কুমারকে তুমি কোথাও একলা ছেড়ে দিও না, ও বড় গোঁয়ারগোবিন্দ … ও যদি তোমার মতো শান্তশিষ্টটি হতো তাহলে তো আমাকে ভেবে মরতে হতো না!”

    বিমল একটু মুচকে হেসে বললে, “আচ্ছা মা, আমি তো সঙ্গে রইলুম, যাতে গোঁয়ার্তুমি করতে না পারে, সেদিকে আমি চোখ রাখব।”

    আমি মনে মনে হাসতে লাগলুম। মা ভাবছেন আমি গোঁয়ার-গোবিন্দ আর বিমল শান্তশিষ্ট! কিন্তু বিমল যে আমার চেয়ে কত বড় গোঁয়ার আর ডানপিটে, মা যদি তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন!

    মায়ের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে আমি, বিমল আর রামহরি “দুর্গা” বলে বেরিয়ে পড়লুম – বাঘা আমাদের পিছনে-পিছনে আসতে লাগলো।[৬]

    প্রথম বাক্যে কুমার একবচন ব্যবহার করে মার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বিমল আর রামহরিও তো কুমারের মামার বাড়িতে অতিথি ছিল – তাদের বিদায় নেবার কথা সেভাবে বলা হলো না কেন? কারণ, কুমারের মা যে বিমলের হাতে কুমারকে “সঁপে” দিলেন, সেটা রূপক নয়, আক্ষরিক-ভাবে সত্য। মায়ের কোলে বসে আদর-খাওয়া, করালীর বাড়িতে ঢুকে মড়ার মাথা উদ্ধারের প্রস্তাবে শঙ্কাকুল এবং অস্বীকারী কুমার এবার, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বাঙালি’ থেকে ‘মানুষ’ হয়ে উঠবে বিমলের অভিভাবকত্বে। কুমারের ভেতো বাঙালি চরিত্রের জন্য দায়ী তার অতি স্নেহশীলা এবং অত্যধিক প্রতিরক্ষামূলক মানসিকতার মা, যাঁর অন্ধ স্নেহের বিচারে তাঁর গোবেচারা পুত্রই গোঁয়ার, আর পরের সন্তান বিমল শান্তশিষ্ট! তাঁর এই তুলনামূলক মূল্যায়ন আর বিমলের হাতে কুমারকে সঁপে দেওয়ার প্রত্যক্ষ ফল উদ্ধৃতির শেষ বাক্যে প্রকট। কুমার প্রবেশ করছে এক নূতন পরিবারের পরিসরে। এই পরিবারের মাথা, পিতৃহীন কুমারের জন্য বিশেষ করে, বিমল, পুত্র/ছোট ভাই/ শিষ্যের স্থানে কুমার, বিমলের ভৃত্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকের মতো কথা বলা রামহরি।

    রামহরি সাহসী এবং শক্তিমান হলেও এই দুই যুবকের প্রতি অপত্য স্নেহ পোষণ করে (বিমলকে সে ডাকে “খোকাবাবু” বলে) আর ভবিষ্যতে তাদের দুঃসাহসিকতায় শঙ্কিত হবার জোরে কুমারের মার শূন্যস্থান সে খানিকটা পূরণ করে। উদাহরণ যক্ষপতির রত্নপুরী উপন্যাসের[৭] শুরুতেই বিমল-কুমার চীনে পাড়ায় খেতে গিয়ে দুরাত্মা ছুন-ছিউ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সঙ্গে মারামারি করে বাড়ি ফেরার পর, কাহিনীর কথক বিমলের এই বর্ণনাঃ

    হতভাগা রামহরি বুড়ো হয়েছে, তবু তার চোখের জেল্লা কি কম? আমাদের দেখেই বললে, ‘কার সঙ্গে মারামারি করে আসা হলো শুনি?’

    - ‘কে বললে, আমরা মারামারি করেছি?’

    - ‘থামো খোকাবাবু, মিছে কথা বলে আর পাপ বাড়িও না। নিজেদের জামা-কাপড়ের দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি। ও আবার কি? কুমারের জামায় যে রক্তের দাগ!’

    কুমার হেসে বললে, ‘ধন্যি তুমি, রামহরি! পাহারাওয়ালার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এলুম, কিন্তু –’

    - ‘কি সর্বনাশ! এর মধ্যে আবার পাহারাওয়ালাও আছে? এই বুঝি তোমাদের খেতে যাওয়া? এমন সব খুনে ডাকাত নিয়ে আর যে পারা যায় না। হাড় যে ভাজা-ভাজা হয়ে গেলো। জামা-টামা খুলে ফ্যালো, দেখি কোথায় লাগলো?’

    এই পরিবারের চতুর্থ মূল সদস্য কুমারের দেশী কুকুর বাঘা, যে সকলের সন্তানপ্রতীম। তাদের অ্যাডভেঞ্চার জীবনের ইতি ঘটে যখন এই চারজনের একজন – তাদের সকলের সন্তান বাঘা – কুমারকে রক্ষা করতে গিয়ে আত্মবলিদান দেয় মান্ধাতার মুল্লুকে উপন্যাসে।[৮] বিপরীতকামী ‘স্বাভাবিকতা’ না থাকলে একটি পরিবারকে স্বীকৃতি না দেওয়া সমকামভীত সঙ্কীর্ণতা ও গোঁড়ামির পরিচায়ক।

    যকের ধনে আমরা দেখেছি যে কুমার আর বিমলের বাসস্থান ভিন্ন। কিন্তু আবার যকের ধন থেকেই দেখা যায় যে বিমল, কুমার, রামহরি ও বাঘা একই বাড়িতে বাস করছে, যেখানে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন মানিকবাবু। এরপর, জেরিনার কণ্ঠহার উপন্যাস[৯] শুরুই হচ্ছে কুমার শান্তিপুরে মামার বাড়ি যাওয়ার ফলে বিমলের একাকীত্ববোধ উল্লেখ করে। এর পরেই যকের ধন-উত্তর বিমল-কুমারের বাসস্থান সম্পর্কে আরও বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়ঃ

    এ রাস্তায় বিমলদের দু-খানা বাড়ী ছিল। একখানা খুব বড়ো এবং একখানা খুব ছোটো। বড়ো বাড়িখানায় বাস করতেন বিমলের বহু আত্মীয়স্বজন – যাঁদের সঙ্গে আমাদের গল্পের কোনও যোগ নেই।

    ছোটো বাড়িখানায় বাস করত বিমল নিজে। সে বহু লোকের গোলমাল সহ্য করতে পারত না, তাই ফাই-ফরমাস খাটবার পক্ষে রামহরিই ছিল যথেষ্ট। বড়ো বাড়ীতে যেত কেবল দু-বেলা দুটি আহার করার জন্যে। বাকি সময়টা তার কেটে যেত ছোট বাড়ীর ছোট্ট বৈঠকখানায় বা লাইব্রেরীতে বসে কখনও পড়াশুনো করে এবং কখনও কুমারের সঙ্গে বিচিত্র ও অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখে। শান্তিপূর্ণ নির্জনতায় বাড়ীখানিকে মনে হত যেন আশ্রমের মতো।


    কুবেরপুরীর রহস্য[১০]

    এই উপন্যাসটি হলো বিমল-কুমারের মানস সরোবরের কাছে রাবণ-হ্রদ বা রাক্ষসতালে অভিযানের আখ্যান। এই কাহিনীর আরম্ভে হেমেন্দ্রকুমার বিমল-কুমারের পারিবারিক জীবনে যে কার স্থান হতে পারে না, তা স্পষ্ট করার জন্যে মূল আখ্যানের থেকে পরিহার্য, কিন্তু এই দুই বন্ধুর মানসিকতা বোঝার পক্ষে অত্যাবশ্যক, একটি অণু-কাহিনী রেখেছেন, যার প্রথম বাক্যই হচ্ছে, ‘বিমল ও কুমার স্থির করেছে, এ জীবনে তারা বিবাহ করবে না।’ এই সিদ্ধান্তের পিছনে আছে তাদের ‘পদ্মপাতায় জলবিন্দুর মতো’ ‘মহা-ডানপিটের জীবন’। এই আখ্যান শুরু হওয়ার মুহূর্তে তাদের অতীত অভিযানের তালিকায় আছেঃ আসামের (বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশের) খাসিয়া পাহাড়, মঙ্গল গ্রহ, সেখান থেকে নির্গত হয়েই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী-অধ্যুষিত এক দ্বীপ, পূর্ব আফ্রিকার হিংস্র পশু ও আদিবাসী মানুষদের জঙ্গল, আর হিমালয়ের শিখরে নরখাদক নরদানবদের দেশ। এরপর, লেখক বলছেনঃ

    এমন অসাধারণ জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো বিবাহ করা চলে না … হয়তো কবে তারা উত্তর-মেরুর তুষার-মরুর মধ্যে পথ হারিয়ে শ্বেত-ভল্লুকদের দেশে মাসের পর মাস প্রবাস-যাপন করতে বাধ্য হবে, আর এদিকে তাদের বউরা ঘরের কোনে বসে চোখের জলে বুক ভাসাতে থাকবে! হয়তো কবে তাদের খেয়াল হবে চন্দ্রলোকে যাবার জন্যে, আর খেয়ালমতো কাজ করে এ জন্মে আর এ দেশে ফিরে আসা হবে না! তখন স্বামী থাকতেও তাদের বউদের হতে হবে অনাথা বিধবার মতো!

    কিন্তু বিমল-কুমারের মতো ‘ধনী এবং বিখ্যাত’ ‘সৎপাত্রে’র ওপর ঘটককুলের আক্রমণ বন্ধ হতে পারে না। এক নাছোড়বান্দা ঘটকের কাছে অবশেষে বিমল তার “মনের মতো” পাত্রীর প্রয়োজনীয় ক্ষমতাগুলির তালিকা পেশ করেঃ এরোপ্লেন চালানো, বন্দুক ছোঁড়া, ঘোড়ায় চড়তে পারা, কুস্তি ও বক্সিং লড়তে জানা। হতভম্ব ঘটক উত্তর দেন যে “বাঙালির মেয়ে”-র পক্ষে এরোপ্লেন চালান সম্ভব নয়, আর “ঘরের বউ” আবার কুস্তি লড়বে কি, তবে বিমল শেখালে পাত্রী বন্দুক ছোঁড়া শিখতে পারে! বিমল বলে, “যে মেয়ে ও-সব বিদ্যে জানে না, তার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া অসম্ভব!” ঘটক এবার কুমারের মতামত জানতে চাইলে যা উত্তর পায়, সেটি খুবই অর্থবহঃ “আমরা দুজনে একসঙ্গে খাই, একসঙ্গে বেড়াই, একসঙ্গে ঘুমোই – মরবারও সাধ আছে একসঙ্গে। কাজেই আমাদের মতামতও একরকম।” এরপর বাঘার ধারালো দাঁত দেখিয়ে বিমল ঘটক-বিদায় সারে!

    ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন উপন্যাস[১১] থেকে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আমরা জানতে পারি। নীরদ বসুর হত্যার পর তাঁর বাড়িতে সুন্দরবাবু যখন তদন্ত করছেন, তখন সেখানে হাজির হয়, সুন্দরবাবুর ভাষায়, “দুটি ছোকরা”, যারা তাঁকে জয়ন্ত-মানিকের কথাই মনে করায় – “তোমাদেরই মতো তাদের কথার কিছু মানে হয় না, আর তোমাদেরই মতো তারা বদ্ধ পাগল!” – এবং সুন্দরবাবুর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়ার দরুন তিনি যখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের বেরিয়ে যেতে বলেন, তারা এতটুকু ভয় না পেয়ে, “হেসে গড়িয়ে প’ড়ে, ঘর থেকে হাত ধরাধরি ক’রে হেলে দুলে বেরিয়ে” যায়! বিমল-কুমারের শরীরী ভাষা লক্ষ্যণীয়।

    সম্ভাব্য পাত্রীর ক্ষেত্রে যে ক্ষমতাগুলি বিমল উল্লেখ করেছে, সেগুলির, সব না হলেও, অনেকগুলিই-জানা, মেয়ের দেখা কিন্তু বিমল-কুমার হিমালয়ের ভয়ঙ্কর উপন্যাসে[১২] ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে! এবার তাকে নিয়েই আলোচনা হোক।

    মৃণু

    ভদ্রলোক সম্প্রদায়ভুক্ত কিশোরদের জন্যে লেখা অ্যাডভেনচার গল্পগুলো যেন রূপকথারই রকমফেরঃ নীলকমল-লালকমলদের জায়গায় সেখানে হয়তো আছে বিমল-কুমারেরা আর রাক্ষস-খোক্কসদের বদলে ‘দানবাকার’ আফ্রিকাবাসী বা অন্য কোনো ‘জংলি ভূত’। তফাত এটুকুইঃ হাজার ঢুঁড়লেও অ্যাডভেনচার কাহিনিতে রূপকথার রাজকন্যাদের দর্শনলাভ হবে না। (বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৫-৮৬)

    বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘার মূল পরিবার সম্প্রসারিত হয়েছে একাধিক অভিযানে, এবং বাড়তি সদস্যরা সংখ্যায় সাধারণত দুইঃ বিনয়বাবু ও কমল। ব্যতিক্রম হলো দুটি অভিযান, যেখানে কমলের জায়গায় এসেছে বিনয়বাবুর কন্যা মৃণু। মৃণুর কথা আমরা প্রথম শুনছি হিমালয়ের ভয়ঙ্কর উপন্যাসে, যেখানে সে অপহৃত হচ্ছে হিমালয়ের অভ্যন্তরে বসবাসকারী মানবাকৃতি বানর-জাতীয় দানবদের দ্বারা। অর্থাৎ, অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনী নিয়ে আলোচনার পরিভাষায় মৃণু হলো ‘দুর্দশাগ্রস্ত কুমারী’, damsel in distress, যার অসহায় অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করবে আমাদের দুই পুরুষ নায়ক! অথচ, উপন্যাসের ঘটনাচক্রে আমরা কী দেখি? বিনয়বাবুর আর্ত অবস্থায় তাঁর হারানো সন্তানকে উদ্ধার করতে গিয়ে বিমল-কুমার-রামহরি বন্দী হয় অপহরণকারী দানবদের হাতে, তাদের সঙ্গে বিনয়বাবুও! তাদের উদ্ধার করে অপহৃতা মৃণু, যাকে এই নরমাংসভোজী দানবেরা ধরে এনেছে তাদের কুকুর-দেবতার পূজারিণী করবে বলে!

    এর পর আমরা মৃণুর দেখা পাব সূর্যনগরীর গুপ্তধনে[১৩], যেখানে সে আবার অপহৃতা হবে, লাল মানুষদের দ্বারা। তার আগে এই অভিযানে তার যাওয়া নিয়ে বিমলের আপত্তি – “তুমি তো আমাদের মতো পুরুষ মানুষ নও” (পৃঃ ১৩৬) – উড়িয়ে দিয়ে মৃণু মহাভারত থেকে বনবাসে পাণ্ডবদের সহগামিনী দ্রৌপদী, ভারতের ইতিহাস থেকে চাঁদবিবি আর লক্ষ্মীবাঈ, আর তার নিজের সময়ে রাশিয়া আর চীনের মহিলা যোদ্ধাদের উপমা টেনেছে, এবং জানিয়েছে যে সে বন্দুক, লাঠি, ছোরা, সবই ধরতে পারে! অভিযানে সামিল হবার অনুমতি সে তার স্নেহময় পিতা বিনয়বাবুর কাছ থেকে আদায় করেছিল মেয়েদের ধর্ম পালন করেই, অনুমতি না দিলে কেঁদে ভাসাবার শাসানি দিয়ে। কিন্তু অনুমতি পাবার পর তার আনন্দ দেখে রামহরি তাকে প্রশ্ন করে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে কিনা। প্রত্যুত্তরে মৃণু বলে, যে অত তাড়াতড়ি বিয়ে ক’রে “পরাধীন” হবার মেয়ে সে নয় (পৃঃ ১৩৯)। আর কুমার যখন তাকে প্রশ্ন করে যে সে শাড়ি পরে লাল মানুষদের সঙ্গে হাতাহাতি করবে কিনা, মৃণু বলে সে সেই দিনেই দরজির কাছে খাকি কোট-প্যান্টের অর্ডার দেবে। বিমূঢ় রামহরি বলে, “ভগবান নিশ্চয়ই পুরুষ গড়তে বসে ভুল ক’রে তোমাকে গড়ে ফেলেছিলেন!” মৃণুর জবাব অত্যন্ত অর্থবহঃ “সেইজন্যেই তো আমি পুরুষের ব্রত নিয়ে ভগবানের ভুল শোধরাবার চেষ্টা করছি!” (পৃঃ ১৪১-১৪২) অনেক পুরুষ যেমন বিপরীতকামী সংসারধর্ম পালন করবার তাগিদ অনুভব করে না, অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রেও এই সহজ সত্য খাটে।

    মৃণু অপহৃতা হবার পর অবশেষে ইকটিনাইকের সাহায্যে বিমল-কুমারের দলটি সূর্যমন্দিরে আশ্রয় নিলে সেখানে প্রথমে শোনা যায়, কুমারের ভাষায়, ‘অভাবিত কণ্ঠের এক সঙ্গীতধ্বনি,’ যার কথায় প্রকাশ পেয়েছে বিমল-কুমারেরই জীবন-ধর্ম, যা উচ্চারিত হয়েছিল এই অভিযানের শুরুতেই – জড়ত্বের প্রত্যাখ্যানঃ

    জয়যাত্রার রথ ছুটেছে

    দূর অজানার মন্তরে!

    রথ ছুটেছে উল্কাবেগে,

    স্থবির জীবন উঠছে জেগে,

    কালবোশেখীর তুফানে মোর

    চিত্ত যে তাই সন্তরে!

    রথ ছুটেছে – রথ ছুটেছে! শব্দে কাঁপে শৈলচূড়ো!

    রথ ছুটেছে – চাকার তলায় ভীরুতা-ভয় ধুলোয় গুঁড়ো!

    সারথি হয় বিপদ-রথের

    কে সে ভাগ্যবন্ত রে – (পৃঃ ২০৭)

    এর কিছু পরেই উদিত হয় গায়িকা মৃণু, ‘মুখে তার মধুর হাসি; পরণে তার রেড-ইন্ডিয়ান নারীদের মতো বর্ণোজ্জ্বল পোশাক; গলায়, হাতে জ্বলছে বহুমূল্য রত্নালঙ্কার!’ যে হিমালয়ে নরখাদক দানবদের পুরোহিত হবার পর তার তথাকথিত-উদ্ধারকারীদেরই নিজে উদ্ধার করেছিল, তার কাছে লাল-মানুষদের কাছে সমাদরে জীবন কাটানো তো বড়ই উপভোগ্য এক অ্যাডভেঞ্চার! যখন সে তার বাবার মুখে শোনে যে লাল-মানুষদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে তাদের ইনকার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, তার প্রতিক্রিয়া হয়, “আমি হতুম ইনকার ইনকী? আমাকে ছেড়ে দাও বাবা, আমি … হাসতে হাসতে মাটির ওপরে গড়িয়ে পড়ি!” (পৃঃ ২০৯) এবং ইকটিনাইকের প্রদর্শিত গুপ্তপথ দিয়ে সূর্যনগর থেকে নির্গত হতে-হতে মৃণু এবার ধরে এক স্বরচিত হাসির গান, যার সঙ্গে এবার গলা মেলায় বাঘা, যার মনে গান বাজনা শুনলেই করুণ-রসের সঞ্চার হয়ঃ

    ইনকা যদি করতো আমায় ইনকী রে!

    চক্ষে তবে জ্বলত আমার

    অগ্নিরাগের ফিনকি রে!

    এক চড়ে তার ঘুরতো মাথা,

    কুঁচকে যেত বুকের ছাতা,

    ভাবতো বোকা – “এমনি ভাবেই

    কাটবে আমার দিন কি রে, -

    এ যে বিষম ইনকী রে!” ((পৃঃ ২১২)

    বিমল-কুমার অনেক আগেই বিপরীতকামী তথাকথিত ‘স্বাভাবিকতা’কে বর্জন করেছে। এবার, উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাষ্যকারের শব্দচয়ন ব্যবহার করলে, তাদের রূপকথাসম অভিযান-সমূহের ইতিহাসে, একমাত্র যাকে ‘রাজকন্যা’ বলা যেতে পারে, সেই মৃণুও এই ‘স্বাভাবিকতা’কে প্রত্যাখ্যান করল। কুমার, যে একাই মৃণুর এই অভিযানে সামিল হবার ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিল (বিমল শেষ মুহূর্ত অবধি বলে গেছে যে মৃণু না গেলেই ভালো হয় – কুমারের পক্ষে এ তার জীবনসঙ্গীর সঙ্গে প্রায় অভূতপূর্ব মতানৈক্য), অনেক আগেই পাঠকদের মনে করিয়েছে, ‘কলেজে-পড়া বাঙালির মেয়ে বললে মনের মধ্যে যে দুর্বলতার প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে, মৃণু তেমন মেয়ে নয়। তার দীর্ঘ ঋজু দেহখানি শক্তি ও স্বাস্থ্যে সুন্দর।’ (পৃঃ ১৪২) এর পরে সোনার পাহাড়ের যাত্রী-তে[১৪] ক্ষুব্ধ বিনয়বাবু বিমল-কুমারকে বলছেন, “তোমাদের কাছে আশকারা পেয়ে পেয়ে মৃণু দস্তুরমত ‘টম-বয়’ অর্থাৎ গেছো মেয়ে হয়ে উঠেছে। দু-দুবার মারাত্মক বিপদে পড়েও ওর আক্কেল হল না।” এ-হেন ‘নায়িকা’র সঙ্গে আমাদের নায়ক-যুগলের সম্পর্ক যে কী তা মৃণু এর আগের অভিযান, সূর্যনগরীর গুপ্তধন-এ স্বয়ং পরিষ্কার করে দিয়েছে! লাল মানুষদের ওপর ইকটিনাইকের ভাষায় “প্রেত-মানুষ”-দের প্রথম আক্রমণের পরদিন সকালে বিমল-কুমার-ফিলিপ যখন তদন্তে বেরোন, তখন তাদের অজান্তে তাদের পিছু নেয় মৃণু। বিমলের উক্তি – যে সেই আক্রমণের যে রক্তাক্ত ফলাফল এখন দৃশ্যমান, তা মৃণু সহ্য করতে পারত না – শুনে রেগে গিয়ে সে ঝোপের আড়াল থেকে বন্দুক ছুঁড়ে তাদের চমকে দেয়। তিনজন পুরুষই ঝোপের দিকে তাদের বন্দুক তাক করাতে মৃণু চিৎকার করে ওঠে, “বিমলদা! কুমারদা! বা রে, তোমরা ভগ্নীহত্যা করতে চাও নাকি?” (১১শ খণ্ড, পৃঃ ১৬০) এই উক্তির সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে, সোনার পাহাড়ের যাত্রী-তে বিমল মৃণুকে সম্বোধন করছে, “লক্ষ্মী বোনটি আমার,” বলে! (৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩)

    আর এই প্রবন্ধের পাঠকদের আবার মনে করিয়ে দিই যে heteronormative-মানসিকতার লোকের চোখে এমন আদর্শ ‘পাত্রী’ থাকা সত্ত্বেও কুবেরপুরীর রহস্যে ঘটকের কাছে পেশ করা পাত্রীর কাঙ্খিত গুণাবলীর তালিকা নিছকই বিমলের অছিলা। তাদের মূল পরিবার নারী-বর্জিতই থাকবে।

    হেমন্ত-রবীন

    বিমল-কুমার এ ব্যাপারে কোন ব্যতিক্রম নয়। দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের জন্য রচিত চারখানি উপন্যাসের কেন্দ্রে জুটি হলো গোয়েন্দা হেমন্ত চৌধুরী এবং তার লেখক-বন্ধু ও সাহিত্যিক রবীন। প্রথম উপন্যাস অন্ধকারের বন্ধু[১৫] আরম্ভ হচ্ছে এই যুগলের পূর্ব-ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েঃ

    পাঠশালা থেকে ইস্কুলে, ইস্কুল থেকে কলেজে আমরা দুজনে বরাবরই একসঙ্গে শিখেছি লেখাপড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত ওঠবার পরেও জীবনের যাত্রাপথে আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয় নি – সাধারণত যা হয়ে থাকে। তার কারণ, আমরা দুজনেই ছিলুম স্বাধীন।

    … আমরা দুজনেই ধনীর সন্তান এবং দুজনেই শৈশবে বাপ-মাকে হারিয়েছি … আমরা দুজনেই বিবাহ করি নি এবং ঘটকেরা বাড়ির চৌকাঠ মাড়ালেই ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে যাই।

    বিমল-কুমারের থেকে হেমন্ত-রবীনের জীবনযাত্রার একটি বড় পার্থক্য হলো যে তারা আলাদা বাড়িতে বাস করে। কিন্তু, দ্বিতীয় উপন্যাস রাত্রির যাত্রী-তে[১৬] নাটক দেখে গভীর রাতে বর্ষণ-প্লাবিত কলকাতায় হেমন্তের বাড়ির খানিক আগেই মোটর অচল হয়ে যায়।

    … হাঁটুর উপরে কাপড় তুলে হেমন্তের বাড়ীর সামনে এসে বললুম, “তুমি তো নিজের আস্তানায় এলে। এখন আমার উপায়?”

    - “কেন, তুমিও আমার শয্যার অংশগ্রহণ করবে চল না!”

    অগত্যা তার প্রস্তাবেই সায় দিলুম।


    জয়ন্ত-মানিক

    বিমল-কুমারের পরেই অবশ্য হেমেন্দ্র-ভক্তদের যাদের নাম পড়ে তারা হলো জয়ন্ত-মানিক। তাদের প্রথম আবির্ভাব জয়ন্তের কীর্তি উপন্যাসে[১৭]যকের ধনে বিমল-কুমারের মতো এই প্রথম অভিযানের সময় জয়ন্ত আর মানিক(লাল) আলাদা বাসস্থানে থাকে। ড্রাগনের দুঃস্বপ্নে[১৮] রাত বারোটায় জয়ন্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানিক নিজের বাড়িতে ফেরে আর নীরদ বসুর বাড়ির ছাত থেকে এক ছায়ামূর্তিকে আকাশে উড়ে যেতে দেখে। পরদিন, জয়ন্তের ভাষায়, “সূর্যোদয়ের আগে” মানিকের উদয় ঘটে জয়ন্তর বাড়িতে এই বিচিত্র সংবাদ নিয়ে। এছাড়া আর কোন গল্পে দুজন যে আলাদা থাকে এমন ইঙ্গিত প্রবন্ধকারের মনে পড়ছে না। এরপর বজ্রভৈরবের মন্ত্র গল্পে[১৯] শ্যামদেশের দস্যু চুয়াং-এর হাত থেকে প্রত্নতাত্বিক মনোমোহনবাবুকে রক্ষা করতে জয়ন্ত তাঁকে বলছে তিনি যেন তাঁর নিজের বাড়ি ছেড়ে জয়ন্তর বাড়িতে গিয়ে থাকেন। মনোমোহনবাবুকে অভয় দিয়ে জয়ন্ত বলে, “আপনিও বিবাহ করেন নি, আমারও বাড়িতে বাসন-মাজা দাসী ছাড়া আর কোনও নারী নেই। সুতরাং আপনার কোনই অসুবিধা হবে না …”!

    এই নারীবর্জিত পরিবারে কিন্তু স্নেহ, এবং স্নেহ থেকে জাগ্রত উৎকণ্ঠা ও আবেগের উপস্থিতি লক্ষণীয়। মানুষ-পিশাচ উপন্যাসে[২০], জয়ন্ত-মানিক কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের আলিনগরে নবাব ও তার আজ্ঞাবহ জীবন্ত মৃতদেহগুলির সন্ধানে। এ কথা জানতে পেরে সুন্দরবাবুর প্রতিক্রিয়াঃ

    ‘অ্যাঁ, বলো কি? সেই যমালয়, যেখানে যমদূতেরা হানা দিয়ে ফিরছে, সেইখানে তারা দুটো প্রাণী গিয়ে কি করতে পারবে? … তাদের ফেরবার আশা ছেড়ে দাও, আর তারা ফিরছে না!’ এই বলে তিনি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন, কারুর সঙ্গে আর একটি কথাও কইলেন না।

    সন্ধ্যা এলো। রাত হলো। সকলেরই মন খারাপ। মহম্মদ, অমিয়, নিশীথ ও পরেশ টেবিলের ধারে বসে চুপিচুপি পরামর্শ করছেন। সুন্দরবাবু মুড়ি দিয়ে সেই ভাবেই পড়ে আছেন।

    রাত্রের খাবার সাজিয়ে দেওয়া হলো। অমিয় ডেকে বললে, ‘উঠুন সুন্দরবাবু, খাবেন আসুন।’

    সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! আমি খাবো না। জয়ন্ত আর মানিক বেঁচে নেই। আমার মন কেমন করছে। আমার গলা দিয়ে খাবার গলবে না।’ তাঁর গলা ধরা, বোধহয় মুড়ি দিয়ে তিনি কাঁদছেন।

    গতানুগতিক বিচারে, এ হেন আচরণ কিন্তু মোটেই পুরুষসুলভ নয়। আমরা শুনছি এক অতি-স্নেহপ্রবণ অভিভাবিকার কণ্ঠ! থানার কর্মকর্তা মহম্মদ সাহেবের মন্তব্য এই গতানুগতিক চিন্তা থেকেই উদ্ভূতঃ

    মহম্মদ বললেন, ‘আপনি না পুলিশে কাজ করেন! এত সহজে কাবু হয়ে পড়লেন?’

    সুন্দরবাবু বললেন, ‘পুলিশে কাজ করি বলে কি আমি মানুষ নই? আমার প্রাণ পাথর? আমি খাবো না।’

    রাত দুপুরে হঠাৎ শোনা যায়, প্রথমে মোটর গাড়ি এসে থানার সামনে দাঁড়ানোর আওয়াজ, তারপরে সিঁড়িতে দু’জনের পায়ের শব্দঃ

    সুন্দরবাবু তাঁর বিপুল ভুঁড়ির ভার ভুলে গিয়ে শূন্যে এক লাফ মারলেন। মহা উল্লাসে বলে উঠলেন, ‘ও পায়ের শব্দ আমি চিনি। জয়ন্ত আর মানিক আসছে।’

    সুন্দরবাবু একসঙ্গে তাদের দু’জনকে চেপে ধরে বললেন, ‘আঃ, বাঁচলুম! কী ভাবনাটাই না হয়েছিলো, হুম!’

    বিমল-কুমারের পরিবারে অভিভাবক যদি হয় রামহরি, জয়ন্ত-মানিকের ক্ষেত্রে সে ভূমিকা এই উপন্যাসে পালন করেছেন সুন্দরবাবু।

    বরুণ-অরুণ

    হেমেন্দ্রকুমারের রচনায় বিপরিতকামী ‘স্বাভাবিকতা’-বর্জিত পরিবারের সবচেয়ে দুঃসাহসিক উদাহরণ তাঁর ‘আলেয়া সিরিজে’র বরুণ আর অরুণ। প্রথম উপন্যাস মায়ামৃগের মৃগয়া-তে[২১] আমরা দেখি ‘বিখ্যাত লেখক অরুণকুমার চৌধুরী’কে। অরুণ আর তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু বরুণ এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করে এম-এ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছেঃ

    বরুণ ধনীর সন্তান হলেও … মেলামেশা করত গরিবদেরই সঙ্গেই এবং বরাবরই তার মূলমন্ত্র ছিল – ‘দরিদ্র-নারায়ণের সেবা’। যেখানে অভাবের হাহাকার … যেখানে বন্যা বা ঝড় বা ভূমিকম্পের দৈব দুর্বিপাক হয়েছে, … বরুণ সেখানে ছুটে যাবেই। কত যে তার গোপন দান ছিল, অরুণ পর্যন্ত জানে না।

    এই বরুণ হঠাৎ একদিন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল … সকলে স্থির করলে, বরুণ সন্ন্যাসী হয়েছে। কিন্তু অরুণ … জানত, বরুণ হচ্ছে জনতার সাধক – লোকালয়ের বাইরে গিয়ে সাধনা করা তার পক্ষে অসম্ভব। এবং যাবার সময়ে বরুণও তাকে চিঠিতে জানিয়ে গিয়েছিল – ‘আমি অদৃশ্য হচ্ছি আরও ভালো করে দৃশ্যমান হবার জন্যে।’ …

    সুদীর্ঘ আট বৎসর অজ্ঞাতবাস করবার পর বরুণ আবার যখন দৃশ্যমান হল, লোকের কাছে সে তখন ‘দস্যু দীনবন্ধু’ নামে বিখ্যাত!

    মনে আছে [অরুণ], বরুণের মুখে প্রথম যেদিন এই সত্য জানতে পারলে, সেদিন সে কতখানি আহত হয়েছিল! বরুণ আজ ডাকাত দীনবন্ধু!

    তারপর বরুণ যখন তার দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিলে, তখনও সে মতপরিবর্তন করলে না বটে, কিন্তু মানতে বাধ্য হল যে, ডাকাত বলতে সব সময়েই অসাধু বোঝায় না!

    খাঁটি বন্ধুত্ব ভোলা অসম্ভব। দস্যু হলেও বরুণকে সে ত্যাগ করতে পারবে না!

    এর কিছু আগেই দেখা গেছে কীভাবে গোয়েন্দা পুলিশের প্রসিদ্ধ কর্মচারী প্রশান্ত – এই উপন্যাসে ‘মজুমদার’, এর পরের সব উপন্যাসেই ‘চৌধুরী’ –কে মিথ্যা বলে অরুণ তার বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বরুণকে রক্ষা করেছে। তারপরেই লেখক উল্লেখ করেছেন অরুণের মনের কথাঃ ‘আইনের নাগপাশ! হ্যাঁ, বরুণকে বাঁচাবার জন্যে তার ভিতরেও সে ধরা দিতে রাজি আছে’। একাধারে আমার ছাত্র এবং বন্ধু শ্রীঅভিরূপ মাশ্চরক আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজদ্রোহী উপন্যাসে আমাদের বরুণের মতোই ‘রবিন হুডে’ পরিণত প্রতাপকে কেমন এই মানসিকতা নিয়েই তার প্রেমিকা রক্ষা করেছিল।

    তাহলে, এখানে আমরা দুই পুরুষ বন্ধু পাচ্ছি বটে, কিন্তু একজন কর্তৃত্বপূর্ণ আর অপর জন প্রথমের ঔজ্জ্বল্যে খানিকটা নিস্প্রভ – যেমন হেমন্ত-রবীন, জয়ন্ত-মানিক – এমন এক যুগল নয়! খানিকটা কষ্টকল্পিত তুলনা চলতে পারে বিমল-কুমারের সঙ্গে, কারণ সেই যকের ধন থেকেই কুমার বিমলকে মাঝে-মাঝে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। অমাবস্যার রাতে কুমার বিমলের আপাত-অনুপস্থিতিতে একাই বেরিয়ে পড়েছে অভিযানে। কিন্তু বর্তমান জুটির ক্ষেত্রে আসলে কোন তুলনাই খাটে না! একজন সমাজের মধ্যে বাস ক’রে সাহিত্যচর্চাকে জীবিকা করেছে; অপরজন সমাজ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে লোভী ধনীর ঐশ্বর্য লুণ্ঠন করে বিলিয়ে দেয় দরিদ্রদের সেবায়! আইনের চোখে সে অপরাধী, দস্যু। কিন্তু বিপদে পড়লে সে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নেয় তার ‘সামাজিক’ বন্ধুর কাছে। এই বিচিত্র ‘সংসারে’ তৃতীয় সভ্য হল শ্রীধর, যে ‘আগে ছিল ডাকাত এবং বার-দুয়েক জেলও খেটেছিল। কিন্তু তারপর প্রথমে বরুণের অধীনে চাকরি নেয়। এবং বরুণ অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করবার পর অরুণ তাকে দেয় নিজের ভৃত্যের পদ।’ (পৃঃ ১০) ‘সামাজিক’ জীব অরুণ তার নিজের সংসারেই সংখ্যালঘু! সাধারণ এবং সমাজবিরোধী ডাকাতি ছেড়ে শ্রীধর প্রথমে বশ্যতা স্বীকার করে দরিদ্র-নারায়ণের সেবক বরুণের। আর বরুণ, আইনের বাইরে থেকে, ধনী দুষ্টের দমনকারী ও শিষ্টের পালক রূপে নিজেকে প্রস্তুত করতে নিরুদ্দেশ হলে, শ্রীধরকে আশ্রয় দেয় অরুণ! শ্রীধরের কাছে বরুণ ‘বড়দা’ আর অরুণ ‘ছোটদা’।

    দ্বিতীয় উপন্যাস বজ্র আর ভূমিকম্প[২২] শুরু হয় একের পর এক ডাকাতি দিয়ে, যেখানে হত্যা – এমনকী স্ত্রীহত্যাও – ঘটে। আর প্রতিটি ডাকাতির অকূস্থলে পাওয়া যায় নীল কাগজের ওপর লেখা ‘দীনু’! অরুণের সন্দেহ হয়েছিল যে বরুণ শ্রীধরকে পাপ-পথ থেকে ফিরিয়ে আনলেও নিজে শ্রীধরের মতো সাধারণ ডাকাত হয়ে গেছে। কিন্তু খবরের কাগজে এইসব পড়ে শ্রীধর চীৎকার করে ওঠে, “বড়দা করবেন খুন? অসম্ভব!” তার “দৃঢ়বিশ্বাসের প্রবল বাতাসে” অরুণের মনে সন্দেহের কুয়াশা দূর হয়। প্রশান্ত হাজির হয় অরুণের বাড়িতে, কারণ, এবং প্রশান্তের উপমা খুবই অর্থবহ ও সুপ্রযুক্ত, “মৌচাকে মৌমাছি আসবে না, এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে নাকি?” পাঠকের দৃষ্টিতে বাঙালি রবিন হুড বরুণ এবং তার জগতই হল মধুপূর্ণ মৌচাক। কিন্তু প্রশান্তর দৃষ্টিতে বরুণের কাছে তার সামাজিক বন্ধু অরুণের বাড়ি হল মৌচাক! আর মৌমাছির মৌচাকে আসার উপমা সাধারণত কোন প্রেক্ষিতে ব্যবহার হয়? বরুণ-অরুণের একজন যদি বিপরীত লিঙ্গের হত, তাহলে, প্রথম উপন্যাসে একজনের অপরের জন্য মিথ্যা বলা, আইনের নাগপাশে ধরা দিতে সম্মতি, এবং এর পর বরুণকে মৌমাছি আর অরুণের গৃহকে মৌচাক বলার পর এদের সম্পর্ককে আপামর পাঠক কী মনে করতেন?[২৩]

    আলেয়া সিরিজের পঞ্চম ও শেষ উপন্যাসে কলকাতা ও তার উপকণ্ঠ ছেড়ে লেখক আমাদের এবার নিয়ে গেছেন বোর্নিও দ্বীপে, যার ‘আর একটি নাম হচ্ছে সূর্যকরের দ্বীপ। কারণ এই স্বাস্থ্যকর দ্বীপটি যেন চিরনিদাঘের দেশ … তার উপরে ঝলমল করে অম্লান সূর্যের পরিপূর্ণ কিরণ।’ এই জলবেষ্টিত ভূখণ্ডের নামেই শেষ আখ্যানটির নাম সূর্যকরের দ্বীপে[২৪]

    প্রথম চারটি উপন্যাসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল অল্প। যেমন, প্রথম কাহিনী মায়ামৃগের মৃগয়া-র ছ’মাস পরে শুরু হচ্ছে বজ্র আর ভূমিকম্প। এর পর খুব শীঘ্রই আসছে নীলপত্রের রক্তলেখা-র ঘটনাসমূহ। তার শেষে শঙ্করলালের গুলিতে আহত হয়ে বরুণ/দীনবন্ধু/দীনু ধরা পড়ছে প্রশান্তর হাতে। ব্যাধের ফাঁদ শুরু হচ্ছে সাতমাস কারাবাসের পর কীভাবে বরুণ আগের উপন্যাসের শেষে জেল থেকে পালাবার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে তা দেখিয়ে। এই আখ্যানের শেষে শঙ্করলালকে পুলিশের হাতে দেওয়ার পর বরুণ প্রশান্তকে জানাচ্ছে যে সে, বরুণ, এবার সম্ভবত দেশত্যাগী হবে, উত্তেজনার খোঁজে।

    সূর্যকরের দ্বীপে-তে আমরা প্রশান্তর মুখে শুনছি যে শঙ্করলাল দ্বীপান্তরের সাজা পেলেও পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়ঃ

    “সে হচ্ছে চার বছর আগেকার কথা। গেল তিন বছর আমরা তার কোনও খোঁজই পাইনি। তারপর কিছুদিন আগে খবর পেয়েছি, শঙ্করলাল এই বোর্নিও দ্বীপে এসে নতুন নাম নিয়ে চারিদিকে ডাকাতি, রাহাজানি করে বেড়াচ্ছে। তাকে আবার বন্দী করবার জন্যেই এই দ্বীপে আমি এসেছিলুম। কিন্তু … জাপানিদের হাতে বন্দী হবার ভয়ে আমাকেই এখন বনবাস করতে হচ্ছে। তার উপরে আমি বেশ বুঝতে পারছি … শঙ্করলালও আমাকে বন্দী করবার চেষ্টায় আছে।” (পৃঃ ১৬৮)

    চীন-ভারত-মালয়দেশের মানুষ সম্বলিত যে দলটির নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রশান্ত দু-দুবার শঙ্করলালের দল-কর্তৃক অপহৃত হয়, সে দুবারই তাকে রক্ষা করে এক রহস্যময় ব্যক্তি যে প্রথম সাক্ষাতেই প্রশান্তকে জানায়, “আমি এই বনে বনে ঘুরে বেড়াই বিপন্নদের সাহায্য করবার জন্যে … জাপানি দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আজ শহর ছেড়ে যারা বনবাসী হচ্ছে, আমি তাদের আশ্রয় দেবার চেষ্টা করি।” (পৃঃ ১৫৩) এই ব্যক্তির প্রতিনিধি প্রশান্তকে জানায় যে উক্ত ব্যক্তির নাম ‘তুয়ান[২৫] গজ’ কারণ তিনি কেবল বর্শা-হাতে একটি বৃহৎ হস্তী বধ করেছিলেন (পৃঃ ১৫৫)। অবশেষে প্রশান্ত তুয়ান গজকে দর্শন করেঃ

    এক কবাটবক্ষ, সিংহকটি, সুদীর্ঘ মূর্তি! তার মাথায় বাহারি পালকবসানো টুপি, কণ্ঠে মালার মতন একটি গহনায় দুলছে দুটি গোলাকার ধুকধুকি, তার কটিদেশে বর্ণ-বিচিত্র কৌপীনের চেয়ে কিছু-বড়ো বস্ত্র। তার দেহের অন্যান্য সব অংশ অনাবৃত। সে এক হাতে ধরে আছে একটি বন্দুক এবং আর এক হাতে একটি বড় টর্চ। তার কোমরবন্ধে সংলগ্ন রয়েছে ছোরা, তরবারি ও রিভলভার। (পৃঃ ১৫৯)

    সে মাথায় বোর্নিওর মানুষদের চেয়ে বেশি উঁচু, এবং তাদের মতো গজের মুখে কিন্তু মঙ্গোলীয় ধাঁচ নেই। দ্বিতীয়বার মাঝির ছদ্মবেশে গজ তাকে রক্ষা করার পর বিমূঢ় প্রশান্ত তাকে বলেঃ

    “আপনাকে এর আগে আমি দেখেছি বলে মনে হয় না, তবে মাঝে মাঝে আপনার চোখের ভিতরে যে ভাব ফুটে ওঠে … কবে, কোথায়, কার চোখে ঠিক যেন ওইরকম ভাব ফুটে ঊঠত … তার নাম আমি মনে আনতে পারছি না।” (পৃঃ ১৬৭)

    গজ বাস করে তথাকথিত ‘অসভ্য’ ‘কেয়ান’ জাতির যোদ্ধাদের এক গ্রামে। কেয়ানেরা শত্রুহত্যা করার পর তাদের মাথার চুল ছিঁড়ে নিয়ে নিজেদের ঢাল সাজায় বটে, কিন্তু গজের ভাষায় তারা “শহুরে সভ্যদের চেয়ে ভালোমানুষ। আমি তাদের ভালোবাসি, তাদের নানা দিক দিয়ে সাহায্য করি, তাই তারাও মনে করে আমাকে আত্মীয়ের মতন।” (পৃঃ ১৫৩) কেয়ানদের গ্রামে গজ ছাড়াও প্রশান্তর পরিচয় ঘটে গজের বন্ধু তুয়ান উলুর সঙ্গে, যার সম্বন্ধে গজ বলে, “আমাদের দুজনের দেহ ভিন্ন বটে, কিন্তু দুজনে হচ্ছি একেবারে একপ্রাণ, একমন।” (পৃঃ ১৬১) উলুকে দেখেও প্রশান্ত বলে, “ওঁকে যেন এর আগে আর কোথায় দেখেছি। ঠিক সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ – অথচ কোথায় কি যেন মিলছে না।” (পৃঃ ১৬১) দ্বিতীয়বার গজ প্রশান্তকে উদ্ধার করার পর উলুর মণিবন্ধে একটি জড়ুলের দাগ দেখে অবশেষে প্রশান্ত দুয়ে-দুয়ে চার করতে সমর্থ হয়ঃ “আপনি হচ্ছেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অরুণবাবু। আর আপনার বন্ধু হচ্ছে … দীনুডাকাত, আর সেই দীনুডাকাতই আজ এখানে ছদ্মবেশে তুয়ান গজ নাম ধারণ করেছে!” (পৃঃ ১৬৯) মৃদু প্রতিবাদ করে দীনবন্ধু বলে, “আপনি তো জানেন, আমি হচ্ছি অরুণের বন্ধু বরুণ। দীনুডাকাতের মৃত্যু হয়েছে।” (পৃঃ ১৭০) এই একই কথা সে বলেছিল ব্যাধের ফাঁদে-র শেষেঃ “এখন আমি দীনুডাকাত নই, আমার নাম শ্রীবরুণকুমার।”[২৬]

    তাহলে বরুণ-অরুণের ‘পারিবারিক’ জীবনের পূর্ণ বর্ণনা কী দাঁড়ালো? যুগলের একজন আইনের চোখে সমাজবিরোধী, কিন্তু নৈতিকতার মানদণ্ডে দুষ্টের দমনকারী–শিষ্টের পালক, তার নিজের ভাষায় “ঈশ্বরের লাঠি! যারা দরিদ্রের রক্তশোষণ করে, তাদের পিঠ ভাঙব বলে আমি হয়েছি তৈরি!” কিন্তু রাজার আইন নিজহাতে তুলে নেওয়ায় তাকে হতে হয় রাজরোষের স্বীকার, আর সেই রোষের উৎপীড়ন এড়াতে সে মাঝে-মধ্যেই আশ্রয় নেয় তার নিতান্তই সামাজিক কবি-ঔপন্যাসিক বন্ধুর গৃহে, যে বন্ধু, তার নিজের দ্বিধা সত্ত্বেও প্রথমজনের পাশে দাঁড়াতে ইতস্তত করে না। আবার কারণে-অকারণে বরুণ অরুণকে না দেখে থাকতে পারে না ব’লে, প্রয়োজন না থাকলেও, প্রশান্তর ভাষায়, মৌমাছির মতো অরুণের মৌচাকে উড়ে আসে, ছদ্মবেশ ধারণ করে। কলকাতায় তাদের পরিবারে আছে প্রাক্তন সাধারণ ডাকাত শ্রীধর, যে এখন বাস করে অরুণের কাছে, তবে তার প্রথম প্রভু বরুণের সঙ্গে অভিযানে বেরোতে তার উৎসাহের অভাব নেই। বরুণের কাছে থাকে তার পুত্রসম ছোট্টুলাল। ব্যাধের ফাঁদে-র শেষে বরুণ প্রশান্তকে বলে যে বর্তমান জীবন বরুণের কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠায় সে যাত্রা করবে অজানার সন্ধানে। সে চলে যাবার পর, পাঠকদের মনে থাকবে, অরুণ হেসে উঠেছিল সকৌতুকে।

    তার কারণ সূর্যকরের দ্বীপে এসে আমরা বুঝতে পারি। বরুণ প্রশান্তের সঙ্গে ‘ইতি গজ’ করেছিল। তার “প্রাণের চেয়ে প্রিয়” (ব্যাধের ফাঁদ, রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ১৪৬) অরুণকে ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারে? দুই বন্ধু স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছে, কারণ বরুণের পক্ষে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় অরুণের সঙ্গ ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। আর বরুণ সাতমাস ধরে ছিল “ফিরিঙ্গী রাজার অতিথি”, তাই সে আর অরুণ সংসার পেতেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে এমন এক অরণ্যে যা ছিল ওলন্দাজদের রাজ্যের অন্তর্গত, কিন্তু উপন্যাসের কাহিনীকালে হয়েছে জাপানিদের হস্তগত। তবে ওই অরণ্যে কোন সম্রাটেরই হুকুম চলে না। জাপানিদের অত্যাচার এড়াতে দলে-দলে মানুষ – আগেই বলা হয়েছে তাদের মধ্যে আছে চীন, ভারত, ও মালয়ের বাসিন্দারা – পালিয়ে আসে এই বনের ভিতর, কিন্তু সেখানে এই অসহায়দের লক্ষ্য করে আর-এক ব্রিটিশ শাসকের চোখে সমাজবিরোধী শঙ্করলালের দলবল, তাদের খুন-জখম করে তাদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেবার অভিপ্রায়ে। এই অসহায়দের রক্ষাকর্তা সেই ব্রিটিশদেরই এককালীন বন্দী বরুণ-দীনবন্ধু! সে শঙ্করলাল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের “অমানুষ” অভিধা দিয়ে প্রশান্তকে বলে “যার মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই সেইই হচ্ছে অমানুষ। মানুষের মতন হাত-পা-মুখ থাকলেই কারুকে আমি মানুষ বলি না।” (পৃঃ ১৫৮) এই অমানুষ যখন বরুণকে অপহরণ করে, অরুণ প্রতিজ্ঞা করে যে সে বরুণের মৃত বা জীবন্ত দেহ উদ্ধার করবে, এবং এই কাজে যে-কোন শত্রু বাধা দিলে তাকে অরুণ বধ করবে, প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দেবে। ‘কারণ, বরুণ নেই যে-পৃথিবীতে সে-পৃথিবী হচ্ছে অরুণের পক্ষে মরুভূমির মতো।’ (পৃঃ ১৮৭)

    আবার বলি, এখানে যদি বরুণ হতো ‘বরুণা’, তাহলে এই শেষ বাক্যটির ব্যাখ্যা আপামর পাঠককুল কীভাবে করতেন? বিশেষ, যেখানে তুয়ান গজ-রূপী বরুণ আগেই প্রশান্তকে উলু-রূপী অরুণ সম্বন্ধে বলেছে, “আমাদের দুজনের দেহ ভিন্ন বটে, কিন্তু দুজনে হচ্ছি একেবারে একপ্রাণ, একমন”? আর কাহিনীর শীর্ষবিন্দুতে চরিত্রগুলির গতানুগতিক ভূমিকা উল্টে যায়! অপহৃত বরুণ হয়ে যায় দুর্দশাগ্রস্ত পুরুষ বা man in distress। এবং এই পাঁচটি উপন্যাসে মোট তিনবার (বজ্র আর ভুমিকম্পে প্রথমবার, আর বর্তমান উপন্যাসে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার) বরুণ-দ্বারা তার প্রাণরক্ষার ঋণ শোধ করে প্রশান্ত, শঙ্করলালের মানুষ-ঘাতকের হাত থেকে বরুণকে রক্ষা করে। এরপর, রূপকথার রাজপুত্রের মতো তার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুকে শঙ্করলালের ‘অমানুষ-ঘাতক’ পোষা ওরাংওটাঙের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে অরুণ, জীবটির ওপর গুলিবর্ষণ ক’রে সেটিকে কাবু ক’রে, যদিও বরুণই সেটিকে তারপর প্রশান্তর বন্দুক নিয়ে গুলি করে একেবারে মেরে ফেলে।

    ওপরের আলোচনার অনুস্মরণ হিসেবে আমার ছাত্র শ্রী অভিরূপ মাশ্চরকের এই অপ্রকাশিত লেখাটি দিলামঃ

    আছে তাঁর দীনবন্ধু-সিরিজের বরুণ এবং অরুণ। ছোটোবেলা থেকে ঘনিষ্ঠ তারা, একই স্কুল ও কলেজে পড়েছে। কলেজ থেকে পাশ করে বেরবার পরে অরুণ হয়ে ওঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক, এবং বরুণ হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। যখন তার পুনরাবির্ভাব ঘটে, তখন সে রবিনহুড-সদৃশ দস্যু দীনবন্ধু, যে অত্যাচারী বড়লোকের অর্থ লুঠ করে তা বিলিয়ে দেয় গরিবদের মধ্যে। প্রাণাধিক প্রিয় বরুণকে দস্যুরূপে দেখে দুঃখিত হয়েছিলো অরুণ, বরুণ যে আর পাঁচজন অপরাধীর সমগোত্রীয় নয়, একথা বোঝার পরেও সে-দুঃখ পুরোপুরি যায়নি তার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এতটুকু শিথিল হয়নি তাদের পারস্পরিক টান। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে অরুণের বাড়িতেই এসে আত্মগোপন করে বরুণ, অরুণও তাকে রক্ষা করবার জন্যে পুলিশের বিরাগভাজন হতে প্রস্তুত। তারা একে অন্যকে না দেখে বেশীদিন থাকতে পারে না, এটা বুঝতে পেরে অরুণের বাসস্থানের ওপর দিবারাত্রি পাহারার ব্যবস্থা করে পুলিশের বড়কর্তা প্রশান্ত মজুমদার (পরে ‘চৌধুরী’)। এই বিপদ মাথায় নিয়েও কখনো বরুণ ছদ্মবেশে এসে উপস্থিত হয় অরুণের কাছে, কখনো বা অরুণ লুকিয়ে বরুণের গুপ্ত ঘাঁটিতে গিয়ে হাজির হয়। শত্রুর নজরদারি উপেক্ষা করে তাদের এই অদম্য মিলনেচ্ছা ও গোপন সাক্ষাৎকে অভিসার বললে তা খুব একটা বেমানান হয় না মোটেই। শেষ পর্যন্ত অরুণের অনুরোধেই দস্যুজীবন থেকে বিরত হয় বরুণ, কিন্তু পূর্বোক্ত ডাকাতিগুলোর জন্য সে এখনো আইনের চোখে অপরাধী। তাই, পলাতক প্রেমিকযুগলের মতোই তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়, এবং ঘর বাঁধে সুদূর বোর্নিওর জঙ্গলে। সেখানেও যখন বিপদ তাদের পশ্চাদধাবন করে এবং বরুণের প্রাণসংশয় ঘটায়, তখন সেই বিপদ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত অরুণ দুশ্চিন্তায় হয়ে ওঠে উন্মত্তপ্রায়, কেননা “বরুণ নেই যে-পৃথিবীতে সে-পৃথিবী হচ্ছে অরুণের পক্ষে মরুভূমির মতো।”

    বরুণ তো বটেই, তার সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে অরুণও হলো একজন বিদ্রোহী-অপরাধী, সমাজে বাস করলেও যারা সমাজের জন্যে “ক্ষতিকারক” বলে বিবেচিত হয়। উপরিউক্ত তথ্যগুলির পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলা হয় যে বরুণ ও অরুণের এই বিদ্রোহী-অপরাধী অবস্থান তাদের সমকামিতার রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে সেটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত, বিশেষতঃ যেখানে দেখি যে তাদের কথোপকথনে প্রায়ই মিশে থাকে এক অদ্ভুত অন্তঃরঙ্গতার সুর, যা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে “তোমাকে আমি কত ভালোবাসি, তা তুমি জানো”-র মতো উক্তিতে (সূর্যকরের দ্বীপে, রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ১৮০)। এমনকি প্রশান্তের সম্মুখেও অরুণ অকপটে স্বীকার করে, “পৃথিবীতে বরুণের চেয়ে আর কারুকে আমি বেশী ভালোবাসি না।” (ব্যাধের ফাঁদ, রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ১১০) সাধুবাদ দিতে হয় হেমেন্দ্রকুমারকে, যে এই ধরণের কাহিনীর যা প্রধান আকর্ষণ, সেই থ্রিলারসুলভ উত্তেজনা পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিবেশন করেও পুরুষের প্রতি পুরুষের ভালোবাসার এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য চিত্র তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন।


    এর‍্যাস্টেস-এরোমেনোস

    প্রাচীন গ্রীক সমাজে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক এক পুরুষের (এর‍্যাস্টেস) সঙ্গে তুলনায় অপরিণত মানসিকতার কোন কিশোর বা যুবকের (এরোমেনোস) মানসিক এবং/অথবা শারীরিক সম্পর্ককে বলা হতো ‘পেডের‍্যাস্টি’। সেই ১৯২৫-ই মেঘদূতের মর্তে আগমন থেকে আমরা বিনয়বাবু আর কমলের মাধ্যমে এইরকম একটি জুটি পেয়েছি।[২৭]

    বিনয়বাবুর সঙ্গে কমলের আলাপ হয় মধুপুর বেড়াতে গিয়ে। কমলের বয়স উনিশ বৎসর, সে কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। বিনয়বাবুর বয়স পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু বয়সে এতখানি তফাৎ হলেও, দুজনের মধ্যে আলাপ খুব জমে উঠেছিল। বিনয়বাবুর স্বভাবটা ছিল এমন সরল যে, বয়সের তফাতের জন্যে কারুর সঙ্গে তাঁর ব্যবহারের কিছুমাত্র তফাত হতো না।

    … গ্রহ-নক্ষত্রের খবর রাখা … [বিনয়বাবুর] একটা মস্ত বাতিক। এ সম্বন্ধে তিনি এমন সব আশ্চর্য গল্প বলতেন … [যে] অনেকে তাঁকে পাগল বলতেও ছাড়তেন না।

    কমল কিন্তু তাঁর কথা মন দিয়ে শুনত। কমলের মত শ্রোতাকে পেয়ে বিনয়বাবুও ভারি খুশি হয়েছিলেন এবং এইজন্যেই কমলকে তাঁর ভারি ভালো লাগত। নিজের নতুন নতুন জ্ঞানের কথা কমলের কাছে তিনি খুলে বলতেন, কমলও তা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে কিছুমাত্র ইতস্তত করত না।

    বিলাসপুরে আপাত-অলৌকিক ঘটনাসমূহের খবর সংবাদপত্রে পড়ে – গঙ্গাবক্ষ থেকে একদল খালাসি-সমেত একটি স্টীমার, গ্রামের একটি প্রাচীন বটগাছ ও তাতে বসবাসকারী বানর, এবং স্টেশনের লাইন থেকে একটি রেলগাড়ির ইঞ্জিনের - বেমালুম অদৃশ্য হওয়া, আর রাতে মাঝেমাঝে এক অদ্ভুত শব্দ এবং তার সঙ্গে বরফের মতো ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস বওয়া – বিনয়বাবু এক বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, এবং অকূস্থলে কমলকে নিয়ে যেতে চান। কমল এককথায় রাজী হয়। বিলাসপুরে পৌঁছে, সেখানে নিজের আত্মীয়ের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও বিমলবাবু কমলকে নিয়ে ডাকবাংলোয় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কমলও বলে, '‘অচেনা লোকের বাড়ির চেয়ে ডাকবাংলোই ভালো।’ ডাকবাংলোয় থাকা ও রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করে ‘বিনয়বাবু কমলের হাত ধরে বাংলোর হাতা থেকে আবার বেরিয়ে পড়লেন।’ (২৯১)

    এর পরেই কিন্তু আবির্ভাব ঘটে বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘার, আর বিনয়বাবু তাঁর বয়স ও প্রভূত জ্ঞানের জন্য এই এবং এর পরবর্তী সমস্ত অভিযানে তাঁর প্রাধান্য বজায় রাখলেও, কমলের চরিত্রায়ন একেবারেই নিস্প্রভ ও ম্লান হয়ে পড়ে। শুধু মাঝে-মধ্যে তার বয়সসুলভ উচ্ছ্বাসের জন্য সে বিনয়বাবুর তিরস্কারের মুখে পড়ে – যা আবার বিমল-কুমারের ভাগ্যেও জোটে, যার ফলে কমল বেশি করে স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। হিমালয়ের ভয়ঙ্কর উপন্যাস থেকে মৃণুর আবির্ভাবের পর কমলকে আরও নির্জীব লেগেছে।

    বিশালগড়ের দুঃশাসন উপন্যাসের[২৮] দ্বিতীয়ার্ধে আমরা পাচ্ছি আরেকটি ‘এর‍্যাস্টেস-এরোমেনোস’ জুটিঃ বয়স্ক অবিনাশবাবু এবং যুবক বিনয়। এই উপন্যাসটি আইরিশ লেখক ব্র্যাম স্টোকারের উপন্যাস ড্র্যাকুলা-র (১৮৯৭) বাংলা রূপান্তর, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। রূপান্তরটির একটি অমূল্য মুখবন্ধে – যেটি এখনকার কোন পুনর্মুদ্রণেই রাখা হয় নি – হেমেন্দ্রকুমার বলছেনঃ

    মূল ‘ড্রাকুলা’ হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের পাঠ্য। কিন্তু আমাকে রচনা করতে হয়েছে ছোটদের মুখ তাকিয়ে। মূল গ্রন্থের কয়েকটি চরিত্র ও ঘটনা একেবারেই বর্জন করেছি।[২৯]

    শিশু সাহিত্যের অলিখিত বিধানঃ বিষমকামী-আদিরসাত্মক কিছু খোলাখুলি রাখা চলবে না (সমকামিতা তো আরও নিষিদ্ধ বিষয়!) । অতএব, রূপান্তরের পূর্বার্ধে, যেখানে হেমেন্দ্রকুমার মোটামুটিভাবে উৎস-আখ্যানকে অনুসরণই করেছেন, তিনি একেবারেই বাদ দিয়েছেন বিনয়ের (যে মূল উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ও কথক জোনাথন হার্কারের বাঙালি রূপ) বাগদত্তা নারীর উল্লেখ (স্টোকারে কুমারী মিনা মারে), যে চরিত্র কাহিনীর শেষার্ধে হবে রুদ্রপ্রতাপ-ড্র্যাকুলার অন্যতম শিকার। উত্তরার্ধে একই ভাবে বর্জিতা হয়েছেন লন্ডন-কলকাতায় রুদ্রপ্রতাপ-ড্র্যাকুলার প্রথম শিকার, মিনার তুলনায় খানিকটা লাস্যময়ী স্বভাবের, কুমারী লুসি ওয়েস্টেনরা। এর ফলে, হেমেন্দ্রকুমারের ভাষায়, ‘অনেক জায়গাতেই মূল গ্রন্থের সঙ্গে আমার রচনার কোনই সম্পর্ক [থাকে নি] – সে-সব স্থলে আমি হয়েছি মৌলিক কাহিনীর লেখক।’[৩০] এই মৌলিকত্ব সবচেয়ে প্রকট যে জুটির নাম করেছি, তাদের চিত্রায়নে।

    বিশালগড়-ট্রান্সিলভেনিয়া থেকে বিনয়-জোনাথন কোনমতে প্রাণ হাতে করে কলকাতা-লন্ডনে ফেরার পর সে শরণাপন্ন হয় পঞ্চাশোর্ধ সখের প্রেততত্ব-বিশারদ অবিনাশবাবুর, যিনি হলেন স্টোকারের ‘পলিম্যাথ’ ডাঃ ভ্যান-হেলসিং-এর রূপান্তর। ভ্যান হেলসিং একাধারে চিকিৎসক, দার্শনিক, এবং অধিবিদ্যাবিদ। তাঁর পুত্রের মৃত্যুর শোকে তাঁর স্ত্রী অপ্রকৃতস্থ। তা সত্বেও, মানবিক কারণে এবং তাঁর রোমান-ক্যাথলিক মূল্যবোধের জন্য ভ্যান হেলসিং স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটান নি। বিপরীতে, অবিনাশবাবু পৈতৃক উত্তরাধিকারসূত্রে অবস্থাপন্ন, এবং তার ওপরঃ

    সংসার ভাবনাকেও [তিনি] জলাঞ্জলি দিতে পেরেছেন, কারণ আজ পর্যন্ত তিনি সুদূরে পরিহার করে এসেছেন বিবাহ নামক সুপ্রসিদ্ধ উপদ্রবটা। বিয়ের পর রাঙাবউ আসা ব্যাপারটা নিতান্ত মন্দ নয়, তবে ওই পর্যন্ত। তারপর আসতে শুরু করে যখন ‘পুত্রকন্যার প্রবল বন্যা’, ব্যাপারটা তখন গুরুতর হয়ে ওঠবার উপক্রম করে। তারপর সেই সূত্রে যে আসে কতরকম বিপদ, বিভ্রাট ও বিভীষিকা এখানে তার তালিকা দাখিল করার দরকার নেই। (৩৯)

    আগেই বলেছি যে মূল উপন্যাসের প্রধান দু’টি মানবী, মিনা ও লুসি, বিশালগড়ের দুঃশাসনে নেই (রুদ্রপ্রতাপ-ড্র্যাকুলার তিন পিশাচিনী সহচরীরা অবশ্য পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত!)। এর ফলে, ড্র্যাকুলা-বিরোধী যে Crew of Light বা আলোক-দলের সভ্যের সংখ্যা স্টোকারে ছিল ছয় – ডাঃ ভ্যান হেলসিং, জোনাথান হার্কার ও, প্রথমে তার বাগদত্তা ও পরে তার স্ত্রী, মিনা, লুসির হবু-স্বামী আর্থার হোমউড, এবং লুসির দুই ব্যর্থ প্রেমিক, ভ্যান হেলসিং-এর পরিচিত ডাঃ সিওয়ার্ড, আর আমেরিকী মরিস কুইন্সি – হেমেন্দ্রকুমারে দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’জনেঃ অবিনাশবাবু আর বিনয়ভূষণ ভৌমিক – প্রথমজন প্রৌঢ়, দ্বিতীয়জন যুবক। বিনয়বাবু আর কমলের কথা মনে পড়ছে কি?

    অবিনাশবাবুর কাছে বিনয় এসেছে কারণ সে মনে করে অবিনাশবাবু ‘বাংলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেততত্ত্ববিদ’ (৪১)। অর্থাৎ, অবিনাশবাবুকে বিনয় বিজ্ঞ পরামর্শদাতা গুরুর আসনে বসিয়েছে। সে এরপর পদে পদে পিশাচের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নিয়মকানুন তার গুরুর কাছে শিখেছেঃ বিশালগড়ের সরাইখানার বৃদ্ধার দেওয়া কবচ সবসময় ধারণ করা, যা দেখিয়ে অবিনাশবাবু বিনয়কে দিয়ে পরপর দু’বার রুদ্রপতাপকে প্রত্যাহত করান; বিশালগড়ে পৌঁছে অবিনাশবাবুই মন্ত্রপূত গণ্ডি টেনে নিজেকে ও বিনয়কে তার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে পিশাচদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন, এবং তিনিই কাহিনীর শীর্ষবিন্দুতে তিন পিশাচিনী ও রুদ্রপ্রতাপের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন।

    এই প্রসঙ্গে ওই তিন পিশাচিনী বিনয়কে প্রলুব্ধ করে অবিনাশবাবু-রচিত গণ্ডির বাইরে টেনে আনার যে প্রচেষ্টা করে, সেই দৃশ্যটির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মূল উপন্যাসে এই প্রলোভনের লক্ষ্য এক নারী, মিনা। ভ্যান হেলসিং মিনার আতঙ্কমিশ্রিত ঘৃণার প্রতিক্রিয়া দেখে আশ্বস্ত হচ্ছেন যে মিনা ড্র্যাকুলা-কর্তৃক রক্তশোষিত হলেও, এবং পিশাচের রক্তপান করতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও‌ নিজে ওই বীভৎস জীবগুলির মতো হয়ে যায় নি। তাছাড়া এই প্রলোভনের মূলে আছে সমকামী রিরংসা, যার মাধ্যমে স্টোকার তাঁর সমকামিতা-ভীত মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, যে মনোভাব তাঁর সারা উপন্যাস-জুড়ে প্রকট। হেমেন্দ্রকুমার এই প্রলোভনকে রূপান্তরিত করেছেন বিষমকামিতায়। বিনয় এই দৃশ্যে তার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছে এই ভাষায়ঃ

    আমার বোধশক্তি যেন ক্রমেই কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগল … আমার মনের মধ্যে যেন নূপুর বাজাচ্ছে কী এক অজানিত আনন্দের ছন্দ। যেন এই আনন্দকে লাভ করতে পারলে আমি অনায়াসেই পরিত্যাগ করতে পাওয়া যে—কোনও সাম্রাজ্যের সিংহাসন!

    ... অবশেষে পাশে পাশে আত্মপ্রকাশ করল তিন-তিনটে মূর্তি! মূর্তিগুলো যেন পরিচিত …

    পাশাপাশি তিনটি তরুণীর সঞ্চারিণী লতার মতন তনু। এমন সব পরমা সুন্দরী আমার চক্ষু জীবনে আর কখনও দেখে নি। রূপকথার রাজকন্যারাও তুচ্ছ তাদের কাছে। বকপক্ষশুভ্র তাদের দেহ …

    আমি দাঁড়িয়ে উঠলুম মাতালের মতন টলতে টলতে … নিজের অজ্ঞাতসারেই আমি গলা থেকে কবচখানা টেনে বার করলুম, তারপর অবিনাশবাবুর রেখা-মণ্ডলের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়ালুম –

    কিন্তু পর-মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক হাতের টানে আছাড় খেয়ে মাটির উপরে পড়লুম পিছন দিকে। (৬০-৬১)

    মত্ততা, বিভ্রান্তি, ও প্রাণঘাতী সম্মোহন – এ সব লেখক যুক্ত করেছেন বিষমকামী প্রলোভনের সঙ্গে। তার কাছে আত্মসমর্পণ করা থেকে বিনয়-এরোমেনোসকে রক্ষা করছেন এর‍্যাস্টেস-অবিনাশবাবু, ঠিক যেভাবে প্রাচীন গ্রীসে লাইসিয়াসের (অন্য মতে মেনিপ্পাসের) গুরু অ্যাপোলনিয়াস মানবীরূপিণী রক্তশোষিকা সর্পিণী লামিয়ার গ্রাস থেকে ছাত্রকে বাঁচিয়েছিলেন। এরপর, অবিনাশবাবুর কাছে তিরস্কৃত হয়ে অনুতপ্ত বিনয় বলছে, “আর কোনও দিন আমি পদচ্যুত হব না।” (৬২) ‘পদচ্যুত হওয়া’, ‘পদস্খলন’ নৈতিক ভ্রষ্টতা, বিশেষ করে যৌনাচারে ভ্রষ্টতা নির্দেশ করতেই ব্যবহার হয়ে থাকে।

    দ্বিতীয় পর্বের উপসংহার

    মানসশ্রবণে শুনতে পাচ্ছি অনেকের ক্রোধ এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যঃ ‘একে তো প্রায় বটতলার লেখক হেমেন রায়, সিংহভাগ লেখাই বিদেশী রচনার টুকলি! আর শিশুদের লেখায় প্রচুর বীভৎস রস ব্যবহার করেছেন (মানুষ-পিশাচ, বিভীষণের জাগরণ), যে জন্য ‘আসল’ শিশু সাহিত্যিকদের (লীলা মজুমদার প্রমুখ) কাছে কোনদিন কল্কে পান নি। তবে হ্যাঁ বাপু, বিকৃত যৌনতা (সমকামিতা তো বিকৃতিই) দেখিয়েছেন এমন বলা যাবে না!’ আবার, যাঁরা গায়ে একটু ‘প্রগতিশীলতা’-র আতর মাখতে ভালোবাসেন, তাঁরা বলবেন (যেহেতু প্রগতিশীলতা আর উত্তর-উপনিবেশবাদ তাঁদের কাছে সমার্থক), ‘যে উপনিবেশবাদ-সুলভ মনোভাব হেমেন রায়ের লেখায় সর্বত্র প্রকট (এই বিশ্লেষণের প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য), তাঁর কাছে তো ইংরেজ শাসকদের ‘হোমোফোবিয়া’ই প্রত্যাশিত। তিনি দেখাবেন বিকল্প যৌনতার ব্যাপারে উদারতা?’

    প্রত্যুত্তরে আবার বন্ধুপ্রতীম ছাত্রের অপ্রকাশিত বক্তব্য রাখলামঃ

    একটি উপন্যাসের কথা বলবো। এই লেখাটা অবশ্য আগেই পড়েছি, কিন্তু এশিয়া পাবলিশার্স হেমেন্দ্রকুমার রচনাবলীর ২৯-তম খণ্ড প্রকাশ করেছেন ও তাতে এই উপন্যাসটি রেখেছেন। প্রিয়া ও প্রিয় নামক এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র হলো পিরু ঠাকুর।[৩১] তার জন্ম তথাকথিত ভদ্রঘরে, কিন্তু সে বাস করে সমাজের ‘অভদ্র’ পল্লীগুলোতেই। ধর্মে হিন্দু, কিন্তু কোনো ধর্মের প্রতিই তার আসক্তি নেই, তাদের রীতিনীতিরও সে ধার ধারে না। ছুটকোছাটকা কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে; এসব কাজের মধ্যে আছে আমরা যাকে গুন্ডামি বলি, সেই ধরনের কাজও। তবে গড়পড়তা গুন্ডার সঙ্গে পিরু ঠাকুরের যে অনেক তফাৎ, আর সাহস, সততা ও বুদ্ধির মতো বহু গুণ যে তার মধ্যে আছে, তা উপন্যাসটা পড়লেই জানা যায়। সে-প্রসঙ্গ এখন থাক। বরং বলা যাক পিরু ঠাকুরের বাড়ির এক সান্ধ্য আসরের কথা।

    সেদিন ভালো খাওয়াদাওয়া হবে, তাই পিরুর এক বন্ধু আবদার করে যে কাছেই অবস্থিত পতিতাপল্লী থেকে ডেকে আনা হোক ক্ষেন্তি নামের এক রূপোপজীবিনীকে, একটু নাচ-গান করে পানভোজন-কালীন ফুর্তি বাড়াবার জন্যে। ক্রুদ্ধভাবে সে-প্রস্তাব নাকচ করে পিরু ঠাকুর বলেন, “কেন, মেয়েমানুষ না হলে কি নাচ হয় না?...তার চেয়ে কেষ্টাব্যাটাকে নাচতে বল না, ও তো অনেকদিন যাত্রায় সখী সেজেছে।” নর্তকীর বদলে নারীবেশী এক পুরুষের নাচ দেখার এই ইচ্ছা যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। কিন্তু এখানেই থেমে যাননি লেখক। কেষ্টর ব্যাপারে তিনি বলেছেন, “যাত্রার দলে থেকে কেষ্ট মেয়ে সাজতে শিখেছিল। তার মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল না এবং মাথায় ছিল লম্বা চুল। কাজেই অল্পক্ষণ পরে সে যখন কাপড়খানি কায়দা করে ঘুরিয়ে পরে মেয়ে সেজে এল, তখন তাকে নিতান্ত পুরুষের মতন দেখাল না। পিরু-ঠাকুরের সুমুখে গিয়ে ঢং করে দাঁড়িয়ে সে একটি নয়নবাণ ত্যাগ করতেও ভুললে না!” লক্ষণীয়, কেষ্ট আগে যাত্রাদলে ছিলো, এখন নেই। কিন্তু এখনো সে মাথায় মেয়েদের মতো বড় চুল রাখে এবং এখনো মেয়েদের পোশাক পরলে তাকে “নিতান্ত পুরুষের মতন” দেখায় না। নয়নবাণ ত্যাগ করার ব্যাপারটা নিয়ে তো মন্তব্যই নিষ্প্রয়োজন। তবে এখানেও দাঁড়ি টানেননি হেমেন্দ্রকুমার। কেষ্টর নয়নবাণে বিদ্ধ পিরু ঠাকুরের মুখে তিনি বসিয়েছেন এই উক্তি, “ওরে কেষ্টা রে! আসল মেয়ে আজ পর্যন্ত আমার কিছুই করতে পারলে না, কিন্তু তোর ওই একটি নয়নবাণেই আমার মাথা আজ ঘুরে গেলো—মাইরি।”

    এরপর আর খুব বেশী কিছু বলার থাকে না, তবে একটা কথা যোগ করা উচিত। পিরু ঠাকুরের আসরে এরপর যে গানটি সহযোগে কেষ্টার নাচ ও হইহুল্লোড় শুরু হয়, সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। এটা পড়ে নাসারন্ধ্র দিয়ে ক্রোধাগ্নি নির্গত হতে পারে রবীন্দ্রভক্তদের, তবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বোধহয় মুচকি হেসেই ক্ষান্ত দিতেন। না, শুধু তিনি হেমেন্দ্রকুমারের সুহৃদ ছিলেন বলে নয়। ‘গোরা’, ‘ব্যবধান’ এবং ‘স্ত্রীর পত্র’-এর লেখক ভিন্ন যৌনতার মানুষেরা তাঁর গানের তালে নাচছে, এমন কথা পড়ে রাগ করতেন বলে মানতে আমার কষ্ট হয়।


    [১] শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাসঃ উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য (১৯৯১, পরিবর্ধিত কারিগর সংস্করণ, কলকাতাঃ ২০১৩), ২৮৩।

    [২] Graham Robb, Strangers: Homosexual Love in the Nineteenth Century (W. W. Norton & Company, New York, Londonঃ 2005) 262-64. ‘The Three Garridebs’ নামের ছোট গল্পটি ১৯২৫ সালের জানুয়ারিতে The Strand পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

    [৩] এই গল্পের এক বছর আগে, ১৯১৫-য় ‘Extricating Young Gussie’-তে জীভসের আবির্ভাব ঘটেছে বটে, তবে সে গল্পে সে নিতান্তই পার্শ্বচরিত্র।

    [৪] সমকামিতা-বিদ্বেষী পাঠককুল অবশ্য এই চরিত্রগুলির স্রষ্টাদের ‘ভ্রম সংশোধন’ করতে সবসময় তৎপর। ১৮৮৯ সালে আমেরিকান নাট্যকার এবং অভিনেতা উইলিয়াম জিলেট তাঁর ৪-অঙ্কের নাটক Sherlock Holmes মঞ্চস্থ করার আগে কোনান ডয়েলকে প্রশ্ন করেন, “May I marry Holmes?" বিরক্ত লেখক উত্তরে বলেন "You may marry him, murder him, or do anything you like to him." উডহাউস ১৯৭৫-এ প্রয়াত হবার পর, ১৯৮১-তে সিরিল নর্থকোট-পার্কিনসন জীভসের একটি কাল্পনিক জীবনীতে বার্টির বিয়ে দেন তার পরিচিতা ববি উইকহ্যামের সঙ্গে! যাঁরা মূল গল্পগুলি পড়েছেন, তাঁরা এই পরিণতি যে কতটা হাস্যকর তা অনুধাবন করবেন। এই অপচেষ্টা এখনো চালু আছে, উদাহরণ সিবাসচিয়ান ফোকস এবং প্রদীপ স্বামীনাথনের লেখা আরও দু’টি বই। ব্যাটম্যান-কে নিয়ে প্রায় প্রতিটি ছায়াছবিতেই একজন করে নায়িকা অবধারিত!

    আমাদের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় কুকর্মের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছেন সত্যবতী ব্যোমকেশের জীবনে আসার পরেও তার অপ্রাসঙ্গিকতা বারবার প্রতিপন্ন ক’রে! দুর্ভাগ্যক্রমে, যকের ধন-এর দু’টি চলচ্চিত্রায়নেই (হেমেন্দ্রকুমারের জীবদ্দশায় ১৯৩৮-এ, যা নিয়ে হেমেন্দ্রকুমারের লিখিত আক্ষেপ পাওয়া যায়, এবং সাম্প্রতিক ২০১৭ সালে) নারী চরিত্র ঢুকেছে। ২০১৯ সালে সাগরদ্বীপে যকের ধন ছবিতে তো ‘বিমল সেন’ (হেমেন্দ্রকুমারে আছে বিমলচন্দ্র রায়, ছবিতে লেখকের কুমারনাথ সেন হয়ে গেছে ‘কুমার রায়’! মনে হয়, ভানু-গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্টেন্ট ছবি থেকে ভানু রায়-জহর ব্যানার্জী অনুপ্রাণিত!) তো ছবির প্রযোজকের স্ত্রী-অভিনীত ডঃ রুবি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেমালিঙ্গনে লিপ্ত হয়! দুটি ছবির কোনটিতেই কিন্তু বাঘার দেখা মেলে নি!

    [৫] মরশুম মুখোপাধ্যায়, ‘ঘনাদার বাতলেমি’, সাহিত্যতক্কোঃ তৃতীয় বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, ‘বাংলা সাহিত্যে দাদাগিরি’ (জলপাইগুড়ি, কোলকাতাঃ নভেম্বর ২০১৪) পৃঃ ৯৫-১১৭।

    [৬] যকের ধন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১ম খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৭৪, ৫ম মুদ্রণ, ১৯৮৪) ৯-১৩১ । উদ্ধৃত অংশটি ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠায় আছে।

    [৭] যক্ষপতির রত্নপুরী, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৫শ খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৯৫) ৫১-১৩১ । উদ্ধৃত অংশটি ৫৬-৫৭ পৃষ্ঠায় আছে।

    [৮] এই চার মূল সদস্য ছাড়া এই পরিবারে অনেকবার সামিল হয়েছেন সকলের গুরুজন-স্থানীয়, বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত, বিনয়বাবু, তাঁর শিষ্য কমল, এবং দুটি অভিযানে কমলের জায়গায় বিনয়বাবুর কন্যা মৃণু। মৃণুকে নিয়ে বিশদে আলোচনা করা হবে, কারণ সে বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘার (সম্প্রসারিত) পরিবারে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র। চার জনের মূল পরিবার অন্য আটটি অভিযানে সম্প্রসারিত করেছে জয়ন্ত-মাণিক-সুন্দরবাবুর ত্রয়ী। মান্ধাতার মুল্লুকে পাওয়া যাবে হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী-র ১৩শ খণ্ডে সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৯২) পৃঃ ১৬১-২৫৯।

    [৯] জেরিনার কণ্ঠহার, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৭৬, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৩) পৃঃ ১৭-১২০। উদ্ধৃত অংশ আছে ২৫ পৃষ্ঠায়। জোর বর্তমান প্রবন্ধকারের।

    [১০] কুবেরপুরীর রহস্য, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৮শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ২০০৫) পৃঃ ১৪৩-২০৮। উদ্ধৃত অংশ আছে ১৪৪ পৃষ্ঠায়। সম্পূর্ণ অণুগল্পটি আছে ১৪৪-১৪৫ পৃষ্ঠায়।

    [১১] ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮০) পৃঃ ৭-৬৯। উদ্ধৃত অংশ আছে ২০ পৃষ্ঠায়।

    [১২] হিমালয়ের ভয়ঙ্কর, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৭) পৃঃ ১৭-১২০।

    [১৩] সূর্যনগরীর গুপ্তধন (১৯৪৪), হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) ১২৩-২১২।

    [১৪] সোনার পাহাড়ের যাত্রী, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ৫ম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোং, কলকাতাঃ ১৯৮৩) ৯-৯৯। উদ্ধৃতি ৪৩ পৃষ্ঠা থেকে।

    [১৫] অন্ধকারের বন্ধু, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) পৃঃ ৫৫-১২২ । উদ্ধৃতি পৃঃ ৫৬ থেকে। (জোর প্রবন্ধকারের)

    [১৬] রাত্রির যাত্রী, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৪শ খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় ৫-৫২, উদ্ধৃতি পৃঃ ৩৭ থেকে।

    [১৭] জয়ন্তের কীর্তি, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৮৭) ৯-১০০।

    [১৮] ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, ১১নং পাদটিকা দেখুন, পৃঃ ১০।

    [১৯] বজ্রভৈরবের মন্ত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৬শ খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৯৭), ১৫৯-১৯৮। উদ্ধৃতি পৃঃ ১৭৩ থেকে।

    [২০] মানুষ পিশাচ, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ২য় খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৭৬, ৫ম মুদ্রণ ১৯৮২) ৮৪-১৯২; উদ্ধৃতি পৃঃ ১৭৬-১৭৮।

    [২১] মায়ামৃগের মৃগয়া হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ২০০০), ৫-৫৪; উদ্ধৃতি পৃঃ ৯-১০ থেকে।

    [২২] বজ্র আর ভূমিকম্প, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৪শ খণ্ড সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়াঃ কলকাতা, ১৯৯৬) ১৬৯-২১৬। উদ্ধৃতি ১৭৫ ও ১৮০ পৃষ্ঠা থেকে।

    [২৩] পাঠকদের প্রতি অনুরোধঃ এই দীর্ঘ পাদটিকাটি এখন নয়, বরুণ-অরুণকে নিয়ে আলোচনা শেষ হ’লে, তারপর ফিরে এসে পড়বেন, নতুবা মুখ্য বক্তব্যের খেই হারিয়ে যেতে পারে!

    বজ্র আর ভূমিকম্পে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বরুণ-প্রশান্তর দ্বন্দ্বকে নতুন মাত্রা দেয়। প্রশান্তকে বস্তায় পুরে গঙ্গায় সলিল-সমাধি দিয়েছিল কাহিনীর খলনায়ক, নকল-দীনু, মহাদেও। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেছিল বরুণ! এবং এর ফলে বরুণ ও শ্রীধরকে হতে হয় মহাদেওয়ের হাতে বন্দী! এবার বরুণের বিশ্বস্ত সহচর ছোট্টুলাল – বরুণের ‘পরিবারের’ আরেক সদস্য – যায় প্রশান্তের কাছে, বরুণকে উদ্ধার করার দাবী নিয়ে। চরম নৈতিক দো-টানায় পড়ে প্রশান্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ছোট্টুলালের সঙ্গে মহাদেওয়ের ডেরায় যাবে, বরুণকে উদ্ধার করবে কিন্তু ছোট্টুলালের শর্ত মেনে বরুণকে গ্রেপ্তার করবে না, কারণ ছোট্টুলালের সাহায্য ছাড়া প্রশান্ত তো সে ডেরার খোঁজই পাবে না! তদোপরি, আগের দিন দীনবন্ধু/বরুণ না থাকলে ছোট্টুলালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত বরুণকে গ্রেপ্তার করার মতো, ছোট্টুর ভাষায়, “এত বড় অধর্মের কথা উচ্চারণ করতে” পারত কি? (রচনাবলী, ১৪শ, পৃঃ ২০২) । তবে এরপর লোকের কাছে নিমকহারাম হবে না প্রশান্ত; সে দেবে চাকরিতে ইস্তফা! প্রশান্তের সৌভাগ্য যে অকুস্থলে গিয়ে সে দেখে যে বরুণ অভূতপূর্ব কায়দায় সেখান থেকে পালিয়েছে। এই ঘটনার প্রভাব আমরা দেখব সিরিজের পরবর্তী উপন্যাসের শেষ থেকে।

    তৃতীয় উপন্যাস নীলপত্রের রক্তলেখা-তে আমরা পাই বরুণের দিক থেকে কিছু মূল্যবান আত্মসমীক্ষা। বরুণ নিজের সম্বন্ধে অরুণকে বলেছে, “আমি তো তোমাদের মতন আইনভীত শান্তিপ্রিয় লোক নেই – রাজদ্বারে আমার স্থান কোথায়? যতই গরিবের উপকার করি, আর পাপীকে শাস্তি দিই, - কিন্তু আমি হচ্ছি সমাজের পরিত্যক্ত জীব, সমাজ মনে মনে আমাকে দয়া করলেও মুখে তা স্বীকার করবে না, সমাজে অতি নিম্নচরিত্র লোকেরও যে অধিকার আছে, আমার তা নেই।” দুঃখিত অরুণ বলে যে বরুণ তো ইচ্ছা করলেই “এই ঘৃণিত অভিশপ্ত জীবন ত্যাগ করতে” পারে। এ হলো দুঃসাহসী, সমাজ থেকে নির্বাসন নেওয়া নায়কের প্রতি তার সামাজিক প্রিয়জনের আকুতি। প্রত্যুত্তরে বরুণ বলে যে “সামাজিক যুগে সাধারণ মানুষের জীবন … একশোবার-পড়া উপন্যাসের মতো একঘেয়ে।” বরুণ চায় “বিপদ, রোমাঞ্চ, দুঃসাহসিকতা, ঘটনার পর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত”, এবং এসব যারা খোঁজে, “সাধারণত তাদের হতে হয় … চোর বা গুণ্ডা বা খুনি। আমি নিজের লাভের লোভে সাধারণ পাপী হতে পারি না … কাজেই আমি হয়ে পড়েছি সাধুর শত্রুদের যম, দীনের বন্ধু দীনুডাকাত! আমি বেআইনি কাজ করি বটে, কিন্তু পাপী নই। পৃথিবীর আইন আমাকে দাবি করতে পারে, কিন্তু আমার ঊপরে নরকের দাবি নেই।” (রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ৯৮) এরপর অদৃষ্টবাদীর ভাষায় হতাশ অরুণ বলে যে বরুণ “মৃত্যুকে … পরিহাস করে তাচ্ছিল্য করতে [চায়]। মৃত্যু পরিহাসের ভক্ত নয়। হয়তো অকালেই নিজের প্রাপ্য আদায় করবার জন্যে সে প্রস্তুত হচ্ছে।” (পৃঃ ৯৯) অরুণ চলে গেলে দ্বিধাগ্রস্ত বরুণ ভাবে, ‘ভালোর পরিণামে ভালো আর মন্দের পরিণামে আসে মন্দ। এই তো স্বাভাবিক নিয়ম। আমি কি এই নিয়মের বাইরে? … ‘তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্!’ ঈশ্বরের তুষ্টিতে নিখিল বিশ্ব তুষ্ট হয় … আমি কি ঈশ্বরের অভিপ্রেত কার্যসাধন করছি না – যার ফলে অসাধু হয় লাঞ্ছিত আর সাধু হয় আনন্দিত? … তবে আমি কেন ঘৃণ্য পাপীর মতন শাস্তির আশা করব?’ (পৃঃ ১০০) ।এর অব্যবহিত পরে বরুণের ওপর নেমে আসে যুগপৎ পুলিশ আর বজ্র আর ভূমিকম্পে-র নকল দীনু মহাদেও মিশিরের ভাই শঙ্করলালের আক্রমণ, এবং শঙ্করলালের গুলিতে আহত হয়ে অধ্যবসায়ী প্রশান্তের হাতে অবশেষে বন্দী হয় দস্যু দীনবন্ধু!

    সেই কবে আবার যকের ধনের মুখবন্ধে হেমেন্দ্রকুমার বাঙালি ছেলেদের ডানপিটে হতে বলেছিলেন, তাদের আপদ-বিপদের কোলে মানুষ হতে বলেছিলেন। অপর দিকে বিমল-কুমারের জগতে এক করালীর বাড়িতে ঢুকে চোরের ওপর বাটপাড়ি করা ছাড়া কোন নৈতিক উভয়সঙ্কট আমরা খুব একটা পাই নি। কিন্তু, লেখকের নিজের ভাষায়, ‘দীনু ডাকাতের কীর্তি’ বর্ণনা করার সময়, কাহিনীর নৈতিক আবহাওয়া হয়ে উঠেছে অনেক বেশি জটিল ও দুরূহ। আহত বরুণ প্রশান্তকে বলে যে তার বিরুদ্ধে যতই ডাকাতির মামলা হোক, সে ডাকাত নয়, সে পাপীকে শাস্তি দেয়, গরিবের উপকার করে। উত্তরে প্রশান্ত বলে, “আপনি শাস্তি দেবার কে? পাপীকে শাস্তি দেবার জন্যে আছেন রাজা। রাজার রাজদণ্ড যে নিজের হাতে নেয়, রাজা তাকে ক্ষমা করেন না। শিশুও এ কথা জানে।” শেষে বরুণ বলে যে কারাগার তাকে ধরে রাখতে পারবে না, এবং এই নিয়ে সে বাজি ধরতেও রাজি। প্রশান্তের উত্তর গুরুত্বপূর্ণ। আগের উদ্ধৃতিতেই দেখেছি যে যে দীনবন্ধু পত্রে এবং কথায় প্রশান্তকে চিরকাল ‘তুমি’ সম্বোধন করে এসেছে, তার প্রতি প্রশান্ত ব্যবহার করছে ‘আপনি’! এবার প্রশান্ত বলেঃ

    “বাজি রাখবার দরকার নেই বরুণবাবু। কর্তব্যের খাতিরে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করব। আমার সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। আপনার ওপরে আমার আর কোনও রাগ বা আক্রোশ নেই। এর পর আপনি মুক্তি পেলেও আমি দুঃখিত হব না।”

    প্রশান্তের একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করে বরুণ হাসতে হাসতে বললে, “ধন্যবাদ।” (পৃঃ ১০৪)

    পাঠকেরা অবশ্য প্রশান্তের মনোভাব বুঝতে পারবেন বজ্র আর ভূমিকম্পের কথা মনে করে।

    চতুর্থ উপন্যাস ব্যাধের ফাঁদে এই ঘটনা ও তজ্জনিত মনোভাবের যৌক্তিক অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়। শুরুতেই কাতর প্রশান্ত অরুণের শরণাপন্ন হয়, প্রশান্তের বিচারে মৃত্যোন্মুখ বরুণের প্রাণ বাঁচাতে! অরুণকে প্রশান্ত জানায় যে অরুণের বন্ধু খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, তার ওজন কমে গেছে পঁচিশ পাউন্ড। সে কারোর সঙ্গে, এমনকি প্রশান্তের সঙ্গেও কথা বলে না। দিনরাত সে বিছানায় শুয়ে থাকে, আদালতের কাঠগড়ায় ঝিমিয়ে থাকে মাতালের মতো! প্রশান্ত ভুলতে পারে না যে “এই দীনুই আমার জীবনরক্ষা করেছে – নিজের জীবনও বিপন্ন করে।” (রচনাবলী, ১৭শ, পৃঃ ১১০) হেমেন্দ্রকুমারের অন্য ‘জুটি’দের নিয়ে কাহিনিতে এমন ভাবগত জটিলতা দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কারণ সে সব জুটির কেউই বরুণের মতো আইনের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধাচরণ করে নি।

    অরুণ প্রশান্তকে কোন সান্ত্বনা দেয় না বা দীনুর সঙ্গে দেখা করে তাকে উৎসাহিত করার প্রস্তাবে সহযোগিতার কথাও বলে নাঃ

    “যে নিজে মরতে চায় তাকে আমি উৎসাহিত করব কেমন করে? আর কিসের জন্যেই বা উৎসাহিত করব? আপনাদের জেলখানায় চিরকাল বাস করবার জন্যে? … সে-অপমান সহ্য করার চেয়ে বরুণের পক্ষে মৃত্যুই শ্রেয়!”

    ভারাক্রান্ত প্রশান্ত বোঝে যে বরুণ-অরুণ একই ধাতুতে গড়া! অরুণ তা স্বীকার করে যোগ করে, “তা নইলে আমাদের বন্ধুত্ব এতটা প্রগাঢ় হতে পারত না।” (রচনাবলী, ১৭শ, পৃঃ ১১০)

    বজ্র আর ভূমিকম্পে-র মতোই অবশ্য এই গুরুগম্ভীর ভাবগত সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে বরুণ আদালত চত্বর থেকেই কৌশলে পালায়। এরপর নানা ঘটনার শেষে মহাদেওর ভাই শঙ্করলালকে বুদ্ধিতে এবং গায়ের জোরে পরাস্ত করে বরুণ তাকে অর্পণ করে পুলিশের হাতে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে হতভম্ব প্রশান্তকে অরুণের বাড়িতেই চা-জলখাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে বরুণ তাকে জানায়, “হাজার বার মাথা খুঁড়লেও কাল থেকে বেশ-কিছুকালের জন্যে আর তুমি আমাদের দেখা পাবে না! সুতরাং আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধু অরুণের জীবনকে আর যেন ভারবহ করে তুলো না! … কলকাতায় থাকব না, বাংলাদেশে থাকব না, হয়তো ভারতবর্ষেও থাকব না!” (পৃঃ ১৪৬) তাহলে কি বরুণ-অরুণের এই বিচিত্র সংসারের এখানেই ইতি? তা যদি হয় তবে বরুণের মোটরগাড়ি সশব্দে ছুটে বেরিয়ে যাবার পর অরুণ সকৌতুকে হেসে উঠল কেন?

    [২৪] সূর্যকরের দ্বীপে, রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড (এশিয়া, কলকাতাঃ ২০০০), ১৪৭-১৯৪।

    [২৫] ‘তুয়ান’ স্থানীয় ভাষায় ‘স্যার’ বা ‘মহাশয়’-এর প্রতিশব্দ।

    [২৬] ব্যাধের ফাঁদ, রচনাবলী, ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ১০৫- ১৪৬। উদ্ধৃতি ১৪৪ পৃষ্ঠা থেকে।

    [২৭] হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১ম খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৭৪, ৫ম মুদ্রণ, ১৯৮৪), ২৮৪-০০০, উদ্ধৃতি পৃঃ ২৮৫ থেকে।

    [২৮] বিশালগড়ের দুঃশাসন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৮শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ২০০৫) ৫-৭০।

    [২৯] হেমেন্দ্রকুমার রায়, বিশালগড়ের দুঃশাসন (অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির, কলকাতাঃ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৬, তৃতীয় মুদ্রণ বৈশাখ ১৩৭১, মে ১৯৬৪), আখ্যাপত্র ও প্রকাশনা-তথ্য সম্বলিত পৃষ্ঠার পরের পাতা।

    [৩০] আগের পাদটিকা দেখুন।

    [৩১] প্রিয়া ও প্রিয়, রচনাবলী, ২৯ম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত (এশিয়াঃ কলকাতাঃ ২০১৭) ৫-১৩২। উক্ত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে ১০৮-১১০ পৃষ্ঠায়। উদ্ধৃতিগুলি এই তিনটি পাতা থেকেই।

     &nbsp


    (এর পরে)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments