আপনি যদি বার দুয়েক মাসাইমারা, সেরেঙ্গেটি ঘুরে আসেন তখন আর পাঁচটা লোকের মতো লুঙ্গি ফতুয়া পরে বেরিয়ে পড়া আপনাকে আর মানায় না। তাই রকে আড্ডা মারতে গেছিলাম মাসাইদের মতো একটা লাল চৌখুপি ছাপা চাদর কাঁধের ওপর থেকে ত্যারছা করে পরে। হিংসুটেগুলোর সহ্য হবে কেন। বলে, ‘আফ্রিকা-র জঙ্গল-টঙ্গলে কি এখনও একটু কম জামাকাপড় পরার চল রয়েছে? মানিয়ে যায় কিন্তু, যেমন শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। কেমন ঠেস দিয়ে কথা, দেখলেন?
ধাঁ করে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। লকার থেকে মা-র বালাজোড়া বের করে সোজা চলে গেলাম রামকৃষ্ণ স্যাকরার কাছে। বাড়ি ফিরেই ফোন করলাম জোশে-কে। জোশে আমাদের গতবারের সারথি। বলেছিল ওকে ফোন করে নিলে এজেন্সি ফেরতা হয়ে যেতে হবে না। খরচ অনেক কম হবে। আর এখন তো নাইরোবি আমি প্রায় বিজয়গড়ের মতোই ভালো করে চিনি। হুঁ হুঁ বাবা, এই নিয়ে দুই দুই বার। কাজেই জোশের সঙ্গে কথা শেষ করে সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বিমান যাত্রা প্রায় ঘটনাহীন, খালি দীপঙ্কর লু থেকে ফেরার সময় প্লেন একটা বাজে বাঁক নেয়। ফলে আইল-এ বসা এক পৃথুলা কেনিয়ান মহিলার কোলে দীপঙ্কর ল্যান্ড করে। চোখে ছানি পড়ার পর থেকে একটু আবছা দেখি শুধু তা নয়, যাকে বলে রিফ্লেক্স, তা-ও একটু ঢিলে হয়ে গেছে। ফলে যতক্ষণে আমি ‘টিচ ইওরসেলফ সোয়াহিলি’ হাতড়ে উপযুক্ত শব্দগুলো খুজে পাচ্ছি দীপঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে জবরদস্ত ইংরেজিতে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলল। মহিলা একটু হাত তুলে সহাস্যে ক্ষমা করে দিলেন। আফ্রিকার সহনশীলতা তো ঐতিহাসিক সত্য।
ভাইরাস নামক কিছু উড়ো খবর এদেশে এসে পৌঁছলেও স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোকে আমরা তেমন পাত্তা দিইনি। এরোব্রিজের মুখে সুদীর্ঘ একজন হলিউড সিনেমার আততায়ীর স্টাইলে একটা হাত পিছনে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইরে পা দেয়া মাত্র আচমকা একটা পিস্তলের মত জিনিস কানপট্টিতে তাক করলেন। পিলে চমকে গেল। পরে বুঝলাম গায়ের তাপমাত্রা দেখে নেওয়ার অতি নিরীহ এক ব্যবস্থামাত্র। অতঃপর খুব মসৃণভাবে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই বুক জুড়িয়ে গেল— জোশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। সাধারণত জনে জনে কেনিয়ান সিমকার্ড নেবার দেরিটা সহ্য হতে চায় না। এবার ইউরোপিয়ানদের একটা বড়ো দল ফেরার জন্যে এসেছে। তাদের এজেন্সি বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্যে নিয়ে এসেছে কেনিয়ান এক তাসা পার্টি। নেচে গেয়ে ড্রাম বাজিয়ে তারা ফাটিয়ে দিচ্ছে। কোথা দিয়ে সময় চলে গেল টেরই পেলাম না। নিশুত রাতে যখন হোটেলে ঢুকলাম তাদের রেস্তোঁরা বন্ধ হয়ে গেছে।
রাত্তিরে হাবিজাবি শুকনো খাবার খেয়ে শুয়েছিল সবাই। সামনে কয়েক ঘন্টার মোটর যাত্রা। হামলে পড়ে খেলাম সবাই। তারপর জোশে আর তার বন্ধুর গাড়ি করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। যে তিন হতভাগ্য এই প্রথম এসেছে তাদের প্রত্যেকটা মাইলস্টোনের ধারাবিবরণী দিতে দিতে, পথে একবার থেমে পৌঁছে গেলাম মান্যাটা ক্যাম্পের কাছে। এবারে ঝকঝকে আলো আছে। সুজন প্রস্তাব দিল আলো থাকতে থাকতে মাসাই গ্রাম ঘুরে নেওয়া যাক। তিন চারটে বা আরও বেশি মাসাই গ্রাম আছে ওই চত্বরে।
অর্থমূল্য ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমরা সাদর আমন্ত্রণ পেলাম গ্রামের ভেতরে ঢোকার এবং যথেচ্ছ ছবি তোলার। ওঁরা গাইলেন, নাচলেন, কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালানো দেখালেন, আমরা ছবি তুললাম। তারপর মোড়লরা ঠিক করে দিল একেকজন ভ্রমণার্থী কোন কোন বাড়িতে যাবে। সেখানে বাড়ির মালিক আমাদের মাসাই জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেবে এবং তারপর হাজির করা হবে মাসাই চাদর, পুঁতির গয়না, কাঠ কুঁদে তৈরি মুখোশ অথবা মূর্তি। আশা করা হয় কিছু একটা অন্তত কেনা হবে। এটা সম্পূর্ণ ওই পরিবারের রোজগার। যাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব পরিবার-ই এই সুযোগ পায় সেজন্য মোড়লেরা পালা করে একেক বাড়িতে পর্যটকদের পাঠায়। প্রায় ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকে দেখা উজ্জ্বল, বলিষ্ঠ, সুঠাম মাসাইদের আমরা ছবি নিলাম বটে কিন্তু ওঁদের জীবনে ঠিক কতখানি ম্লানতা আছে ওই অল্প পরিচয়ে তা আমাদের অজানা থেকে গেল।
মান্যাটা ক্যাম্পটা মাসাইমারা রিজার্ভ-এর বাইরে। আমাদের এবার পরিকল্পনা বাকি দু-রাত বনের ভিতরের এক ক্যাম্পে থাকার। সকালে এক দফা ঘোরাঘুরি করে দুপুরে সেখানে যাব আমরা। আরম্ভ হল দুর্দান্ত। সুন্দর আলোয় শুয়ে আছে তিনটে চিতা। ল্যাজ আছড়াচ্ছে, হাই তুলছে, একটু হাঁটাহাঁটি করছে আর মাঝে মাঝে খুবই অবজ্ঞার সঙ্গে তাকাচ্ছে যে গাড়িগুলো তাদের ঘিরে ধরেছে তাদের দিকে। চতুর্দিকে চাপা হর্ষধ্বনি আর ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ। তারপর আমাদের গাড়ি দুটো রওয়ানা হল কিকরোক লজ-এর উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে পুরোনো লজ মাসাই-এর। বিশাল এলাকা নিয়ে লজ। প্রচুর বিরাট বিরাট গাছে লাফালাফি করছে নানা বী ইটার আর ফ্লাইক্যাচারেরা। সামনের আর পিছনের দুটো বিরাট মাঠের একেক পাশে সারি সারি চমৎকার সব কটেজ। লজের পিছনের মাঠ পেরিয়ে নিজস্ব হিপো পুল। অভ্যাগতদের জন্যে গোলাকার মাথা ছাওয়া বসার জায়গা করা আছে তার পাড়ে। এক ছোট্ট হাওয়াই আড্ডা আছে খানিকটা দূরে, মাসাই-এর প্রায় কেন্দ্রস্থলে। সিংহ-রা সেখানে মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে আসে। আর বনের মাঝখানের লজগুলোতেও অনেকে নাইরোবি থেকে সিধা উড়ে চলে আসেন। এইসব লজগুলো তৈরি হয়েছিল যখন পৃথিবীতে মানুষ ছিল কম আর জায়গা ছিল বেশি। বলাই বাহুল্য এখানে খাওয়ার আয়োজন সুপার মডেলদেরও ডায়েটের কথা ভুলিয়ে দেবে।
আর মাসাই ছেড়ে বেরোবার মুহূর্তে গাছের ডালে দিবানিদ্রা দেওয়া এক লেপার্ডের দেখা মেলার পর আমাদের আর চাওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু মাসাই এবার আমাদের আহ্লাদ দেবে বলে ঠিক করেছে। তাই এবার দেখলাম আরও দুটি চিতার লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণ। তাঁরাও একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। এমন সময় কানে এল বেবুনের ডাক। ওঁরা উঠলেন, বারে বারে পিছন পানে দেখলেন এবং দ্রুত পলায়ন করলেন। হাসতে হাসতেই আমরা চলে এলাম নাইবাসা। এবারে লেক প্রায় ফাঁকা। রয়েছে কেবল মেছো ঈগলের দল, পায়েড কিংফিশার আর দু-চারটে পেলিক্যান। নৌকাবিহারে গিয়ে সাক্ষাৎ পাওয়া গেল এক জায়ান্ট কিংফিশারের। পরের দিন সকালবেলা আমরা গেলাম এলিমেনটাইটা লেকের ধারে। সেখানে রয়েছে ঝাঁক ঝাঁক ফ্লেমিংগো। বিকেলে আবার নৌকা করে ঈগলদের মাছ ধরার ছবি তোলা হল। আজ সন্ধেবেলা পানভোজন একটু গুরুভার হল। দলের অর্ধেক কাল বাড়ির দিকে রওনা হবে আর দীপঙ্কর, অভিজিৎ, সুচিত্রাদি আর আমি যাব আম্বোসেলি।
বেশ অনেকটা রাস্তা। বিকেল হয়ে গেল আমাদের আস্তানায় পৌঁছতে। এই ইমপালা সাফারি লজও সুবিশাল। এখানেও ভিতরে প্রচুর গাছ আর তাতে গিজগিজ করছে বায়া উইভার জাতীয় পাখির ঝাঁক। সন্ধের মুখে সুইমিং পুলের খোঁজে হাঁটতে বেরিয়ে ঘোরা হল অনেকখানি। অবশেষে সেটাও পাওয়া গেল আর পড়ে আসা আলোয় প্রথমবারের মত দেখলাম কিলিমাঞ্জারো। ওই পুলের জলে পা ডুবিয়ে বসে হাতের পানীয়তে আলতো করে চুমুক দিতে দিতে মেঘে ঘেরা কিলিমাঞ্জারোর চূড়ার দিকে তাকিয়ে দেখবেন একবার মনে হবে টমটমে করে স্বর্গে যাচ্ছেন। দীপঙ্কর তো তাই বলল।
পরদিন দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে ঢুকলাম আম্বোসেলি। এবং কিমাশ্চর্য যা দেখার জন্যে শুনেছি লোকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকে সহজেই দেখতে পেলাম সেই বিখ্যাত দৃশ্য— পশ্চাৎপটে কিলিমাঞ্জারো রেখে মিছিল করে আসছে হাতির দল।
আমাদের শেষ গন্তব্য ৎসাবো ইস্ট। কত গল্প শুনেছি মোম্বাসা থেকে নাইরোবি রেললাইন পাতার সময় ৎসাবো-র বিভিষীকা সেই দুই সিংহ-এর গল্প। ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’ সিনেমাটা বোধহয় বার চারেক দেখেছি। কালো কেশরের সিংহ তো আমরা দেখবই। দেখব দু-রকমের ধনেশ আর মাটি মেখে লাল হয়ে যাওয়া হাতির দল, গোশক আর ডিকডিক, ওয়াটার বাক আর জিরাফ কিন্তু সব থেকে ভালো লাগল আমাদের এখানের নির্জনতা, নদীর ধারে পিকনিক আর এই বনের একটা বুনো বুনো ভাব যেটা ট্যুরিস্ট আধিক্যের ফলে মাসাই থেকে খানিক লোপ পেয়েছে।
এখন মনে হচ্ছে মোম্বাসা আর ৎসাবো (ইস্ট এবং ওয়েস্ট) দেখার জন্যে আসতে হবে আবার। আওয়াজ দিয়েছিল যে হারামজাদা, সঙ্গে করে সেটাকেও নিয়ে আসব তখন।