ছত্তিশগড়ের চালচিত্র---রঞ্জন রায়; সুন্দরবন প্রকাশন; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০২০; ISBN 978-81-938324-1-7
ঢ্যাম কুড় কুড় বাদ্যি বাজে…….
সাড়ে তিন দশক আগে গ্রামীণ পুরুলিয়ায় এক ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারের হাঁ করে ‘বিয়ের গান’ শোনবার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল এ’বইয়ের একটা অধ্যায় পড়তে পড়তে—"ধলেশ্বরী নদীতীরে পিসিদের গ্রাম”!
আর, আরেকটা অধ্যায় পড়তে গিয়ে, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে”! সে-অধ্যায়টি ‘জাত যায় কোথা দিয়ে’-শীর্ষক।
*
বই পড়ছি, না ছবি দেখছি--এই দোলাচল সারা বইখানি পাঠকালে জাগরূক ছিল। তার একটা কারণ যদি প্রবীণ লেখকের কলমের জাদু হয় তো অপরটি এই কলমচির সমগ্র কর্মজীবনব্যাপী অভিজ্ঞতাটিও বটে। কারণ এ’ অভাজনও লেজার আর ব্যালান্স আর লোন আর রিকভারি আর টার্গেট নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে, শুরু যার প্রি-কম্প্যু’কালে পুরুলিয়ার ঐ গ্রামে। তাই রঞ্জন-বর্ণিত তুরতুরিয়া মঠের মোহন্ত হোন্ বা পিওন জগদীশ হোক্ বা চমনলাল রোহিদাস--এ’সবই চেনা চরিত্র; এক নামে বা আর।
*
‘চালচিত্র’ মানে কী?
অভিধান দেখতে হয় না, সকলেই জানি, প্রতিমার পিছনের ঐ যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবির মালা, মূলপ্রতিমাটি যার প্রেক্ষাপটে ভাস্বর হয়ে ওঠে---তা-ই হলো ‘চালচিত্র’। অর্থাৎ, ‘প্রধান’ হয়তো নয়, কিন্তু যে প্রেক্ষাটি না থাকলে ‘মূল’-টিই হয়তো ফ্যাকাশে হয়ে যেত। আর, রঞ্জনবাবুর এ’ ‘চালচিত্র’-র লবকুশ হলেন ঐ ঐ সকল চরিত্রাবলী। এবং এর পট-টি? পট-টি হলো এক ‘গ্রামীণ ব্যাঙ্ক’ (RRB—Regional Rural Bank)---প্রতিষ্ঠামতই যাদের লক্ষ্য গ্রাম্য ভারতবর্ষের কোণায় কোণায় ঢুকে ঢুকে তার অর্থব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলা। আর সেটা করতে গিয়েই এই ‘মানুষ দেখা’, ‘জীবন দেখা’ আর, ‘দেশ দেখা’! আরে বাপু, মানুষের জীবনকে যদি তার দেশ-সমাজের চালচিত্রে না দেখবে তো তার আর্থিক বুনিয়াদ মজবুত করে তুলবে কী করে?
নবীন নায়ক ম্যান্জার গঙ্গারাম দেবাঙ্গন এমনভাবেই হয়ে গেছেন ভারতীয় অর্থনীতির এক ইস্কুরুপ!
*
দেখে তো অনেকেই, কিন্তু এমন লিখতে পারে কয়জনা?
উচ্চশিক্ষিত এক বঙ্গসন্তান সেই ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় এক লোভনীয় ব্যাঙ্কের চাকুরি যখন পেয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল তার পথ চলার, মানুষ দেখার, জীবন দেখার। ‘পরবাস’ পত্রিকায় দীর্ঘ তিন বচ্ছরব্যাপী ধারাবাহিক প্রকাশিত হবার কালে যে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল এই ‘ছত্তিশগড়ের চালচিত্র’, সম্পাদক-সমীপেষু-তে আসা তোড়া তোড়া পাঠকপত্রেই তার প্রমাণ। এমন কোনো এক অর্বাচীন পত্রলেখক এই রচনাটিকে ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’-এর সঙ্গে তুলনা করায় উৎসাহী হয়ে পড়া শুরু করি, এবং কমপ্লিটলি বোল্ড হয়ে এখন যে এই থামলাম তার পিছনে নবীন প্রকাশনা-হাউজ ‘সুন্দরবন প্রকাশনা’-রও কম অবদান নেই। কারণ যে যত্ন নিয়ে ছাপাই-বাঁধাই-কাগজ-প্রুফদেখন ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে ডালিটি সাজিয়েছেন এঁরা, দশে সাড়ে নয় পেয়ে যান তাতে; কেবল যদি না পশ্চাদপৃষ্ঠের ব্লার্বটি অত দীর্ঘ হতো। তাছাড়া, উত্তমপুরুষে ব্লার্ব পড়তে ভালো লাগে না। বরিষ্ঠ বিকাশ গণ চৌধুরী মশায় নামী শিল্পী; সযত্ন করা প্রচ্ছদটি গ্রন্থের মূলসুরের সঙ্গে এক্কেবার লাগসই হয়েছে। বড় ভালো লেগে গেল।
*
রাজ্য হিসেব ছত্তিশগড় বয়সে নবীন। বিশ বছরের বেশি উমর হবে না এর। তবু আদত বয়সের হিসেবে এ’অঞ্চল ভারতের অন্যতম প্রাচীন, অতিপ্রাচীন। রামায়ণে উল্লেখ আছে এখানকার। তবে, কালস্রোতে ভারতের এক অতি পশ্চাদপদ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল এ’, পূর্ণরাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর থেকে ক্রমোন্নতি শুরু, যার পিছনে গ্রামীণ-ব্যাঙ্কেরও মস্ত অবদান আছে, বলা বাহুল্য। গ্রন্থশেষের চারিটি ‘পরিশিষ্টে’ লেখক অতি যত্নসহকারে এখানকার ইতিহাস-ভূগোল-লোক/সামাজিক জীবনের এক পারিসাংখ্যানিক পরিচিত এঁকে দিয়েছেন, যেটি অত্যন্ত কাজের কাজ হয়েছে। এবং পরিশ্রমের। ফিকশন লিখিয়েরা এতোটা খাটেন না, সাধারণত।
*
গ্রন্থপাঠ শেষে ফের নাড়াচাড়া করি কেতাবখানি।
ঠুকরে-ঠাকরে যাই একেকটি অধ্যায়শীর্ষনামঃ ‘রিমঝিম বরষে পানি’, ‘চাম্মু চামারের জাদু’ বা… ‘ডারউইন সাহেব ও চুমু-উৎসব’।
বড় জাদু খেলে দিয়েছ গো ব্যাঙ্কার-সাহেব! ফের ফিরে আসতে হবে তোমার ক্যাশবাক্সের, থুড়ি রসভাণ্ডের গন্ধে গন্ধে! ব্যাঙ্কের গপ্প পড়তে গিয়ে জীবন পড়িয়ে নিলে---ছল ভরে!
তাই শুধি, কেন বাজাও? কেন বাজাও?
চিরায়ত শরদিন্দু— সম্পাদনাঃ ভাস্কর বসু; দ্য কাফে টেবল; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২০; ISBN 978-93-87753-81-5
আলফ্রেড হিচককের এক্কেবারে সমবয়সী, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের-ও। এবং, কাজী নজরুল ইসলামের।
সন ১৮৯৯ খ্রি.। বেহার-যুক্তপ্রদেশে বাঙ্গালীর বড্ড মান ছিল সেকালে। বড় ডাক্তার-উকিল-মাস্টার প্রায় হতোই না বাঙালি ছাড়া। তাই মাতুলালয় জৌনপুরে ছেলেটি যখন জন্মেছিল সে-বছর, উকিল বাপ তাকে লিখিপড়ি করিয়ে নিজের মান্য পেশায় আনতে চাইবেন--এ'তো স্বাভাবিক। সেটা হয়ে গেলে কি আর আজকের এই লেখা হয়, না আলোচ্য বইটি অতি-আদরে লেখেন পৌনে-বিশেক নামী লেখক? বিতর্ক ওঠে, হেমিংওয়ে-নজরুলের সম-দর্জা দেই না কেন শরদিন্দুকে? ধ্রুপদী আর জনপ্রিয় লেখকের মধ্যে বিরোধ আছে নাকি? কেন?
*
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কত বড় লেখক ছিলেন (বা, ছিলেন না), তাঁর ব্যোমকেশ চরিত্র বাঙালির হোমস কিনা, বরদা-সদাশিব চরিত্রদ্বয় তার গায়েগায়ে সমান টক্কর দিয়ে চলে কিনা---এ'সব 'পরবাস'-পাঠকের অজ্ঞাত নহে, তাই তাঁদের সামনে অযথা চর্বিতচর্বণ করে লাভ নাই; কিন্তু শরদিন্দুর উপরে সযত্ন-লিখিত এই এন্থোলজিটির পরতে পরতে কেমন করে জনপ্রিয়-শরদিন্দু, 'বাবা'-শরদিন্দু, 'ব্রাত্য'-শরদিন্দু খুলে গেছেন, ফুটে উঠেছেন, সে-বিষয়ে দু'কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না।
*
(ক) সামগ্রিক..., (খ) শীর্ষ জনপ্রিয়তা, (গ) রম্য ইতিহাস, (ঘ) স্মৃতিকথায়, (ঙ) বরেণ্য ছোটগল্পকার, (চ) প্রবাসেই নিজের মাটি এবং (ছ) কিশোর সাহিত্যে, নারীচরিত্র বিন্যাসে---এমন সাতখানি প্রধান অধ্যায়ে গ্রন্থটিকে ছেয়েছেন সম্পাদক-মশায়, যার প্রতিটিতে গড়ে দুটি-তিনটি করে সুলিখিত নিবন্ধ রয়েছে! ষষ্ঠটিকে একটি আলাদা অধ্যায় হিসেবে রাখায় একটু 'কিন্তু' রেখে লেখকপুত্রের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি মহা-আগ্রহে পড়ি (৪র্থ অধ্যায়ে)। এটি গ্রন্থটির তাজ! নবতিপর শান্তনুবাবু যেভাবে কোনো রাখঢাক না রেখে সত্যজিতের 'চিড়িয়াখানা'-কে গামছা পরিয়ে ছেড়েছেন, বা শরদিন্দু-শচীনদেবের সখ্যতার গল্প শুনিয়েছেন, বা বাং-ঐতিহাসিক গল্পে কেন শরদিন্দুকে মানদণ্ড ধরা হয় তার বয়ান দিয়েছেন---এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় সাক্ষাতকারটিকে। পল্লব সমানে খুঁচিয়েও গেছেন ভালোই (এটা কিন্তু বধাঈ---compliment)!! কিন্তু বরিষ্ঠ সাহিত্যিক শেখর মুখোপাধ্যায় তাঁর বিশ পৃষ্ঠার নিবন্ধে সঞ্জয় সুব্রমণ্যহম - জিওফ্রে পার্কারের মত তেষট্টিখানি বইয়ের সন্দর্ভ টেনে টেনে এনে কী যে বলতে চেয়েছেন---কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। উপরন্তু, শরদিন্দু ও সন্দীপনের লিখনের মিল যে চক আর চীজের মতো---এটা বুঝি।
বরঞ্চ শমীতা দাশগুপ্তের 'শরদিন্দুর কলমে নারী' প্রবন্ধটি অতি উপাদেয় লেগেছে; বিষয় হিসেবেও এটি অতি আকর্ষণীয়। 'অর্থমনর্থম্' পড়ে সত্যবতীর প্রেমে পড়ে যায়নি এমন বাঙালি ছোকরা আছে?
প্রথম নিবন্ধটিকেই শ্রেষ্ঠের শিরোপা দিতে ইচ্ছে করি। শীর্ষনামে 'অথচ' শব্দখানি এখানে বড়ই বাঙ্ময় ('ব্রাত্য অথচ আলোকময়')। জনপ্রিয় হলে কি ক্লাসিক হয় না? 'পদ্মানদীর মাঝি' কেন এক ক্লাসিকের দর্জা পায়, 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' পায় না?! কোথাও একটা বড় ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, যেটাকে 'ভাবের ঘরে চুরি'-ও বলা চলে।
এ' বইয়ের ষোলখানি নিবন্ধের প্রতিটি ধরে ধরে আলোচনার অবকাশ হেথায় নাই, প্রয়োজনও নেই। তবে বিষয়-বিন্যাসে ও লেখক-চয়নে সম্পাদক মশাই ভালো চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন (কেবল....শেষে বলছি #)---এটি বেশ। তবে অতি-দীর্ঘ ব্লার্বটি নয়। পশ্চাদপৃষ্ঠের ওটি 'সূচিপত্র' হয়ে গেছে, ব্লার্ব নয়। গোড়াতে দেওয়া কয়েকটি ফোটোর মান অতি দীন। এখন তো ডিজিটালি মেক-আপ করা যায়। প্রকাশনার মান ঢিলেঢালা, বহু মুদ্রণপ্রমাদ। তবে হ্যাঁ, একটি প্রসঙ্গ ভালো উঠেছেঃ তিন বাঁড়ুজ্যে বিভূতি-তারা-মানিক নিয়ে যত মাতামাতি, তার সিকিও শরদিন্দুকে নিয়ে হয়নি, হয় না। সেদিক দিয়ে এ বই এক মহৎ উদ্যোগ বটে। শরদিন্দুর জীবৎকালে কিরীটির বিক্রি অনেক বেশি ছিল, পরে ফেলুদারও। কিন্তু ধ্রুপদী গোয়েন্দাগল্পে ব্যোমকেশের স্থান বাঙালির হৃদয়ে যে কতটা গাঢ়---কাল প্রমাণ করেছে সেটা, আরও করছে, করবে।
এখানেই শরদিন্দুর জয়!
পুনঃ # মাফি মেঙে বলি, 'প্রিয়' শরদিন্দুর নানান দিক নিয়ে তো ষোলখানি নিবন্ধ হলো, 'অপ্রিয়' শরদিন্দু নিয়ে একটাও হতে পারতো না, সম্পাদক-মশায়?
এ'রম গোটা দশেক গল্প তো এক্ষুনি মনে পড়ছে! [গুস্তাকি মাফ!]
মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাংঃ শরীর এবং অন্যান্য আলাপ—তৃপ্তি সান্ত্রা; কারিগর, কলকাতা-৪; ISBN: 978-81-940295-1-9
এই কেতাবের গ্র.স. লেখার আদৌ কোনো এক্তিয়ার এ’কলমচির আছে কিনা---ভাবি। যে মহলের অন্দরে ঢোকার পাশপোর্ট নাই তার সম্বন্ধে বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া চলতে পারে মাত্র, কিন্তু বিশেষজ্ঞের মতামত? নৈব নৈব চ!
কিন্তু গ্র.স. মানেই কর্তাত্বি করা---কে বললে সেটা? বইয়ের ক্রেতা ও পাঠকের এক স্বোপার্জিত অধিকার তো আছেই,তার বলে ‘পাঠ-প্রতিক্রিয়া’ তো লেখাই যায়। তো, লিখিঃ
সওয়া-শ’ পৃষ্ঠার এক নাতিতন্বী কেতাব, আর ঐ তার শিরোনাম!! ঐ তো, দেখুন না। অভ্র বসুর ভাগীরথী-গ্রন্থটির কথা মনে পড়ে গেল। অতএব, এখানে প্রথমে এই প্রশ্নটাই মনে আসে না কি যে আমাদের লক্ষ্মীশ্রী বঙ্গমাতার শব্দভাণ্ডারে কেবল মহিলাদিগেরে বলা এত্তো এত্তো স্ল্যাং-শব্দ আছে নাকি, হতে পারে নাকি, যাতে প্রায় দু’শো+ পৃষ্ঠা ভরে যায়? বইটি কিনে সে ভ্রম টুটলো। শীর্ষনামের একখানিমাত্র আট-পৃষ্ঠার নিবন্ধ---প্রথম নিবন্ধটি---তার নামেই গ্রন্থনাম, বাকি বিশটিই স্ল্যাং-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্করহিত। এতে প্রকাশকের বিপণনী গিমিক প্রকাশ পেলেও পাঠক তো ঠকলেন---যা পড়বে বলে কেনা, পুর-টা তাহা নহে।
*
কিন্তু না, ঠকেননি। আর তার জন্যেই এ’কলম ধরা। কারণ স্থানপাওয়া প্রবন্ধগুলির যা ধার-ভার-মান---তা ভাবায়-জ্বালায়-রাগায়। বাঙলাভাষায় নারীবাদী কলমের তো অভাব নেই, সে জঁরের তাজ হয়ে থাকা বই এ’খানি!
বলি দু’কথা:
*
‘দ্য ভ্যাজাইনা মনোলোগ’: ১৯৯৬-তে লেখা এই নাটকটি এতাবৎ ৪৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, প্রায় দেড়শো দেশে অভিনীত হয়েছে, যাতে জেন ফন্ডা থেকে ওপ্রা উইনফ্রি-র মানের শিল্পীরা অভিনয় করেছেন নানা সময়ে। ‘দ্য ন্যু ইয়র্ক টাইমস’ একে ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রাজনৈতিক নাটক’-অভিধায় ভূষিত করেছে। সত্যি বলছি, লেখিকা ইভ এন্সলার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, এখন তৃপ্তি-দি’র এই কেতাব থেকে এর সম্বন্ধে জেনে, দেখে (ইউ-টিউবে), পড়ে [#] এতোই অভিভূত যে তার দাম সাড়ে চারশ’-র [পুস্তক-মূল্য] অনেক বেশি।[#] ‘মন,মন,তোমার শরীর নাই কুসুম?’---চতুর্থ নিবন্ধ।
প্রথম নিবন্ধটির কথা তো বলাই হলো না।
ঠিকাচে, ঠিকাচে,---বলে-টলে দিয়ে একশা করবো না, তবে ২০০৪-এ’ মফস্বলবাসী এক ইং-অধ্যাপিকার পক্ষে এই বিষয়ে ও এই সাহসে এমন এক প্রবন্ধ লিখে পত্রিকায় ছাপাতে গাট্স লাগে। হ্যাঁ। রীতিমত। কারণ সেখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও এসে গেছে যে। তবে, না, ‘নাংমারানি’ শব্দের যে অর্থ লেখিকা এখানে [পৃ ১৭] দিয়েছেন সেটা সঠিক বলে মনে হয় না (কোনো সূত্রও নেই), অভ্র বসুর অভিধানেও ঐ অর্থ লেখা নেই [পৃ ৩৫৯] ।
আর শেষে ঐ যে ‘বড়ো রানির বৃদ্ধকাল…’ ছড়াটি?
ত্রিশ বছর আগে মালদহের গ্রামে এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম ইটি, এখন ফের শুনে/পড়ে বয়সটা-ই কমে গেল মোর! স্যালুট জানাই সাহসী লেখিকাকে এমন দেশীয় ছড়াটিকে গ্রন্থিত করে রাখবার জন্যে। ভবিষ্যতের কোনো গবেষকের কাজে লাগবে।
*
কামোদ্দীপনাময়ী নারীচিত্রকে ধ্রুপদী স্তরে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে রবি ঠাকুরের সমবয়সী অস্ট্রীয় শিল্পী গুস্তফ ক্লিমট (১৮৬২-১৯১৮ খ্রি.)আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর নারী-স্বমেহন সিরিজের চিত্রগুলি আমাদের স্তম্ভিত/শিহরিত করে তোলে। তৃপ্তি সান্ত্রা ‘স্বমেহন’ নিয়ে নবনীতা দেবসেন/জয়া মিত্র/রুশতী সেন-দের দীর্ঘ দীর্ঘ ইন্টারভ্যু নিয়েছেন বটে, তবে গুস্তফ ক্লিমট দেখেছেন বলে মনে হয় না, কারণ পৃষ্ঠা বাইশে এর বিপরীত কথাই লিখেছেন। আর, নারী-স্বমেহনের যে ক্লাসিক চিত্র দেখে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়, বেলজিয়ান শিল্পী ফেলিসিয়েন রপসের ‘সেইন্ট তেরেসা’, তারও কোনো রেফারেন্স পেলাম না। যেমন, ভগাঙ্কুর ও নারীর যৌন-সন্তুষ্টির আলোচনায় ‘নারী-সুন্নৎ’ (female circumcision) এবং তার ধর্মীয় স্বীকৃতির প্রসঙ্গ অবশ্যম্ভাবীভাবে আসা উচিত ছিল। নেই।
*
শেষ অধ্যায়ে (‘আলাপ’) লেখিকা দশটি বাঁধা প্রশ্ন নিয়ে বেশ কিছু নামী নারীবাদীর সামনে হাজির হয়েছিলেন, তাতে ‘উভকামিতা’, ‘স্বমেহন’ বা ‘সেক্স এডু.’র মতো স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। এটি গ্রন্থটিকে অযথা ভারাক্রান্ত করেছে, পাঠগতি রুদ্ধ করেছে। শেষে ‘সহায়ক গ্রন্থ’-পরিশিষ্টে কাজের বইয়ের উল্লেখ বেশ কিছু রয়েছে, কিন্তু তথায় সত্রাজিৎ গোস্বামী ও এরিক প্যাট্রিজের উল্লেখ না দেখে অবাক হয়েছি। বিশেষত, প্যাট্রিজ সাহেবকে না ছুঁয়ে স্ল্যাং-এর আলোচনা হতে পারে নাকি?
নতুন প্রকাশনীর ছাপাই-বাঁধাই ভালো। প্রচ্ছদ মামুলি ও কল্পনাবিহীন।
*
শেষে লিখি: এ’বই একবারে পড়ে শেষ করে ফেলে তাকে তুলে রাখবার নয়, না এ’ যৌন সুড়সুড়ির কেতাব। এর ‘সংকেত ভাষা’, ‘অনার্যজনোচিত’, ‘মা হবার সাধ’ বা ‘হেটোকথা’-র মতো নিবন্ধগুলি বারেবারে পড়বার আর ভাববার বিষয়বস্তু, যা যুগে যুগের এক পাথরচাপা বিষয়কে সম্মুখে আয়নার মতো করে সামনে তুলে ধরে।
আবার নতুন করে মুখ দেখি।
নিজের।
গল্প সংগ্রহ---দিবাকর ভট্টাচার্য; পরম্পরা প্রকাশন; কলিকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ: জানু্য়ারি ২০২০; ISBN: 978-93-88341-38-7
ফ্রানৎস্ কাফকা, জন কীটস, অস্কার ওয়াইল্ড থেকে ভিনসেন্ট ভ্যান গোহ্--এমনকী বিজ্ঞানীপ্রবর গ্রেগর মেণ্ডেল ও সঙ্গীতের মহামানব যোহান সিবেস্টিয়ান বাখ্--ভিন্ন ভিন্ন দেশে কালে এঁদের আবির্ভাব হলেও একটা বিষয়ে এঁদের বড্ড মিল।
‘পরবাস’-এর গুণী পাঠক নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ধরে ফেলেছেন মিলটা।
হ্যাঁ, জীবদ্দশাতে এই এই মহানহস্তীগণ বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি পেয়ে যাননি, বরঞ্চ আলফ্রেড ওয়েগনারের (‘Continental Drift’-তত্ত্বের জনক) মত বিজ্ঞানীকে তো রীতিমত ঠাট্টা-গঞ্জনা সইতে হয়েছিল।
*
আজ থেকে আট বছর আগে, জুন ২০১২-তে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক প্রয়াত লেখকের সদ্য-প্রকাশিত গল্প-সংকলন নিয়ে বলতে গিয়ে নালেঝোলে হন; বিশেষত এই কারণে, যে সেটি (‘চরাচর সারে’ ) ছিল তার এক দশক আগে প্রয়াত দিবাকর ভট্টাচার্যের (১৯২৮-২০০২) প্রথম প্রকাশিত সংকলন! জানি না, কোন্ অভিমানে মৃত্যুর পরে নিজের সমস্ত লেখাগুলিকে অগ্নি-আহুতি দেবার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন দিবাকর; ভাগ্যিস তাঁর চিকিৎসক-পুত্র রঞ্জন বাপের সে-আদেশ পালন করেননি, তাই না আজ এই নিবন্ধটির ঐ শীর্ষনাম দিতে পারছি। বড্ড মিল পাই অমিয়ভূষণ মজুমদারের সঙ্গে, যিনিও আজীবন লিটল-ম্যাগে লিখেও আজ কিংবদন্তীর দর্জা পেয়ে থাকেন।
*
সম্প্রতি একবার মোটে এই গল্প-সংগ্রহটি পড়ে ফেলে দিবাকর ভট্টাচার্যের মতো নিমগ্ন সাহিত্য-তাপসের মূল্যায়ন করে ফেলি--এমন এলেম নাই। এঁর সমগ্র জীবন ও সাহিত্যকৃতি নিয়ে সিরিয়াস কাজ হওয়া উচিত---যেটি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের কোনো গবেষক করবেন, করা উচিত---এ’বিষয়ে সন্দেহ নেই কোন। যে যে দশক-ব্যেপে তাঁর জীবন ও সাহিত্যকীর্তি---সেই সদ্য-বিভক্ত সদ্য-স্বাধীন ভারতবর্ষ/বাংলা…থেকে নকশাল আন্দোলন…কম্যুনিজমের নিকেশ…থেকে ১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ----এ’সবই অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো এসে গেছে তাঁর কলমের ডগায়। দিবাকর নিমগ্ন থেকে গেছেন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথে…..প্রতিফলিত তাঁর ‘বুফো’, ‘একাকার’, ‘অসার’ প্রভৃতি বহু বহু গল্পে---নিষিক্তভাবে।
আর ফর্ম নিয়ে অনায়াস নাড়াচাড়া—আনাগোনা---মনের গহনে, লেখার অবয়বে---এ’তো দিবাকরের আভরণ! যেমন, প্রথম গল্পটিই ধরুন না (‘নিঃশব্দে’) যেখানে নিজের সঙ্গে কথাবার্তা (soliloquy) এবং দীর্ঘ প্যারাগ্রাফে ‘ইটালিক্স’-এর ব্যবহার এক অদ্ভুত দ্যোতনা এনে দিয়েছে। ‘অথচ’ গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হবেন না এমন পাঠক হতে পারেন না: যে-রূপে প্রিন্স দ্বারকানাথ এসে পড়েছেন, ছেয়ে আছেন এ গল্পের সর্বাঙ্গ জুড়ে---তাতে কখন ‘স্নেহাংশুদা’ আর কখন…..নাঃ বাবা, স্পয়লার করবো না। পড়ুন পাঠক, পড়ুন ও এই শীর্ষনামের সার উপভোগ করুন---এই প্রার্থনা।
*
দিবাকর প্রসঙ্গে ‘পরবাস’ পত্রিকার একটি বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য। দক্ষিণ ২৪-পরগনার বহড়ু অঞ্চলে, যেখানে পরবাসের একটি শিকড় (বললে ভুল হবে না), দিবাকর ভট্টাচার্যও সেখানকারই আদিনিবাসী। জুন ২০১২-তে (সংখ্যা ৫১) দিবাকরকে প্রথম আবিষ্কারের সময় থেকে লাগাতার প্রায় প্রতি সংখ্যায় তাঁকে পড়তে পেয়েছি, যেগুলি নিয়ে আগামীতে নিশ্চয়ই আরেকটি সংকলন বেরোবে, কারণ ওঁর সেই সেই ‘অমলিন কথামালা হইয়া’, বা, ‘অধম’, বা ‘অকল্পিত’-এর মতো অনবদ্য গল্পগুলি কিন্তু এই সংকলনটিতে নেই। (বর্তমান সংকলনটির কপিরাইট কার---সেটা লেখা নেই কোত্থাও---দেখে বড় আশ্চর্য লেগেছে।) রাজা ভট্টাচার্য-কৃত ‘ভূমিকা’-টি অতি কাজের, ---বইটির আয়না!
*
কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি সাহিত্যধারার নানান ফর্মের মধ্যে ‘ছোটগল্প’-কে বঙ্গসাহিত্যের এক অতি সফল ও পুষ্ট ধারা বলে মনে করি। বিভূতি, মানিক, বনফুল, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মতি নন্দী, আবুল বাসার থেকে…কতো নাম করবো? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী মহাশয় যেমন এ’গোত্রের অনবদ্য এক শিল্পী হয়েও বোধহয় ততটা প্রচার পাননি, যেমন ওপার বাংলার জুবেইদা গুলশন আরা, বা মামুন হুসেইনের এক একটি ছোট গল্পের ঝলকে আজও বিস্মিত হই। দিবাকর ভট্টাচার্যও এমনি ঝলক দিয়ে মূর্ত হলেন---এবং সে ঝলকানি দীর্ঘদিন পাঠকের মনোলোককে আলোকিত করে রাখবে---কোনো সন্দেহ রাখি না তাতে।