• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • চতুর্থ বাংলা ছন্দ? : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    মস্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ — যে কোনো গবেষণায় এই কাজটি করা সব থেকে কঠিন। মোটামুটি সবার জানা, দলবাজির বিচারে বাংলা ছন্দ প্রধানত তিনটি বৃত্তরীতি মেনে চলে — অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত। ছন্দগুলির নামকরণ আদিতে প্রবোধচন্দ্র সেনের করা হলেও পরে তিনি নিজেই তাদের নাম বদলে যথাক্রমে মিশ্রকলাবৃত্ত, কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত রাখেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “কবিতার ক্লাস” পড়লেই এই তিন বৃত্ত ছন্দের আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। দুই ধরনের দলের (syllable) সঙ্গে আমরা সবিশেষ পরিচিত — রুদ্ধদল ও মুক্তদল। দলের আদল চেনা জলের মতো সহজ। উচ্চারণের সময় গড়িয়ে গেলে মুক্ত, আটকে গেলে রুদ্ধ। তিনটি বৃত্তছন্দের মধ্যে স্বরবৃত্তের চালচলন খানিকটা রহস্যময়। ব্যাপারটা জানা থাকলেও আমি সক্রিয় ভাবে স্বরবৃত্তের বেনিয়ম নিয়ে কিছু চিন্তা করিনি। মেনে নিয়েছিলাম স্বরবৃত্ত চারটি দল দিয়ে গড়া পর্বর পাশাপাশি পাঁচটি বা তিনটিদল দিয়ে গড়া পর্বও হেসে খেলে বসিয়ে নেয়। কারণ তার পরিচয় ছেলে-ভুলানো ঘুম-পাড়ানি (lullaby) ছড়ার ছন্দ হিসেবে। ছড়ার ছন্দে আর মাত্রার চুলচেরা হিসেব কে রাখে? এক সময় মনে করা হত স্বরবৃত্তে আর যাই হোক গুরুগম্ভীর কবিতা লেখা সম্ভব নয়। আধুনিক অনেক কবিই অবশ্য সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। যাই হোক, দু-এক দিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নিজেকে আবার প্রশ্ন করলাম — কেন এমন? আগেও তাবড় ছন্দজ্ঞানীরাও নিশ্চয় বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন। তবে যতটুকু পড়েছি এবং শুনেছি তাতে মনে হয় সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করার সময় পার হয়ে যায়নি (it is still an open problem)।

    মাত্রা আর দল দুটি ভিন্ন বস্তু। বৃত্তছন্দ অনুযায়ী তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বদলে যায়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে একটি রুদ্ধদল দুই মাত্রার মর্যাদা পায় এবং একটি মুক্তদল এক মাত্রার। অক্ষরবৃত্তে শব্দের আদিতে বা মধ্যে থাকলে রুদ্ধ মুক্ত দুই দলই এক মাত্রার মর্যাদা পায়। কিন্তু শেষে থাকলে রুদ্ধদল দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। স্বরবৃত্তে স্থান-নির্বিশেষে রুদ্ধ মুক্ত দুই দলই এক মাত্রার মর্যাদা পায়। তিনটি দল দিয়ে গড়া “ছান্দসিক=ছান্‌-দ-সিক্‌’ শব্দটি মাত্রাবৃত্তে পাঁচ মাত্রার, অক্ষর বৃত্তে চার মাত্রার এবং স্বরবৃত্তে তিন মাত্রার। আশা করি দল ও মাত্রার মধ্যের সম্পর্কটা পরিষ্কার করতে পারলাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভালোবাসার পাশেই’ নিখুঁত চার মাত্রার পর্ব বিভাজনে স্বরবৃত্তে লেখা কবিতার অনুপম উদাহরণ। স্বরবৃত্তের চলন জানতে হলে ওই ছন্দে লেখা বিখ্যাত কবিদের কবিতা খুঁজে পড়াই ভালো।

    মাত্রা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? আমার ধারণা ছন্দ আসার আগে এসেছে সুর, তাল এবং গান। এমনকি মানুষ লিখতে শেখার আগে গান গাইতে শিখেছিল। সংস্কৃত শ্লোক সুর করে পড়া হত, যাতে মনে গেঁথে যায়। গান একটানা গাওয়া যায় না। শ্বাস নিতে ছাড়তে হয়। তাই মানুষ শ্লোকের কথাকে ভাগ করে নিল ছোট ছোট অংশে বা পর্বে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্বের সময়-দৈর্ঘ সমান হওয়া উচিত। সমান সময়-দৈর্ঘের পর্বগুলিকে আরও ছোট ছোট সময়ের অংশে (time unit) ভাঙা যায়। মাত্রার ধারণা এসেছে সময়ের পরিমাপ থেকে। পর্ব ভাঙার সর্বনিম্ন সময়ের পরিমাপ হল মাত্রা। প্রবোধচন্দ্র সেন বলছেন — কালের দিক দিয়ে উচ্চার্য শব্দের ওজন বা পরিমাণের একক বা unitকে বলা যায় মাত্রা (ছন্দ-জিজ্ঞাসা, প্রবোধচন্দ্র সেন, জিজ্ঞাসা, ১৩৬৭)। দল ও মাত্রার সময় পরিমাপ স্পষ্টতই সমান নয়। রুদ্ধদল উচ্চারণ করতে গেলে যে পরিমাণ সময় লাগে তা মুক্তদল উচ্চারণের পরিমাণের থেকে বেশি। এখন প্রশ্ন হল রুদ্ধদল উচ্চারণের সময়ের পরিমাপ কি মুক্তদলের দ্বিগুণ? মাত্রাবৃত্তে আমরা সে ভাবেই মাত্রা গুনি। মাত্রাবৃত্তে লেখা, সাত মাত্রার পর্ব দিয়ে গড়া শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’, সাত-পাঁচের যুগলবন্দীতে লেখা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর ‘একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকী’তে’ বা পাঁচ মাত্রার পর্ব দিয়ে গড়া শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’, জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ জনপ্রিয় কিছু কবিতার উদাহরণ, যেগুলি আবৃত্তিকারদেরও অত্যন্ত প্রিয়। মাত্রাবৃত্তের চারিত্রিক (characteristic) বিজোড়-মাত্রিক গতি-প্রকৃতি জানতে হলে ওই কবিতাগুলির কাছে গিয়ে বসতে পারেন কিছুক্ষণ।

    অনেকে বলেন স্বরবৃত্ত মাত্রাবৃত্তের একটি special case. স্বরের (দলের) সংকোচন প্রসারণ করে স্বরবৃত্তকে মাত্রাবৃত্তের ধাঁচে ফেলে দেওয়া যায়। পড়ার সময় টেনে অথবা তাড়াতাড়ি পড়ে মাত্রা সংখ্যা সমান করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ স্বরবৃত্তে মাত্রার সংকোচন ও প্রসারণ বৈধ। আমার মতে এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ স্বরবৃত্তকে মাত্রাবৃত্তের ছাঁচে জোর করে ফেলতে গেলে তার চলার গতি বদলে যায় যা কখনোই কাম্য নয়। তবে কি স্বরবৃত্ত গানের ছন্দ? গানের ছন্দেও মাত্রার সংকোচন ও প্রসারণ সম্ভব। কিন্তু তালের অনুশাসন খুব কড়া। তার্কিক বলবেন স্বরবৃত্তর চলন হল ‘মনোহরণ চপলচরণ’ হরিণগতির। গান চলে সুরের হাত ধরে ‘সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব’। তা হলে স্বরবৃত্ত গানের ছন্দ হয় কী করে? উত্তর হল গানের চলন নির্ধারণে তালের সঙ্গ দেয় লয়। সুতরাং স্বরবৃত্ত জন্ম নিয়েছে গানের হাত ধরেই, এই প্রস্তাবে কোনও মৌলিক ভ্রান্তি নেই।

    কবিতার ক্লাসে স্বরবৃত্তের নিয়মের ব্যতিক্রম নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন — স্বরবৃত্ত সম্ভবত গানের ছন্দ। শঙ্খ ঘোষের “যমুনাবতী” কবিতাটিকে বাংলা কবিতার মাইলফলক কবিতা হিসেবে দেখা হয়। কবিতাটিতে কবি স্বচ্ছন্দে দুটি বৃত্ত ছন্দ — মাত্রা ও স্বরবৃত্তের ব্যবহার করেছেন যা সচরাচর দুর্লভ। সে অন্য আলোচনা। দেখার ব্যাপার হল, কবি স্বরবৃত্ত অংশে চারটি দল দিয়ে গড়া ‘স্বরস্বতী’র অব্যবহিত আগে পাঁচটি মুক্ত দল দিয়ে গড়া ‘যমুনাবতী’র ব্যবহার করেছেন — “যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে...”। স্বরবৃত্তকে যাঁরা ছড়ার ছন্দ বলে হেয় করার চেষ্টা করেন তাঁরা বলবেন ‘যমুনাবতী’কে ‘যোম্‌নাবতী’ পড়ো। কিন্তু নীরেন্দ্রনাথ বলছেন যে তাকে ‘যমুনাবতী’ পড়লেও স্বরবৃত্তের চাল নষ্ট হয় না। ওই কবিতাটিতে অন্যত্র তিনটি রুদ্ধ দল দিয়ে গড়া একটি পদেরও (‘রুই কাৎলার’) সন্ধান পেয়ে যাই। সেখানেও কান বলে তিন মাত্রার পর্বও অবলীলায় চার মাত্রার পর্বগুলির সঙ্গে উচ্চারণ করা যাচ্ছে। একটুও ছন্দ বিচ্যুতি ঘটছে না।

    গানের কথা যখন এসে পড়ল তখন বলে রাখা ভালো গানের তাল কিন্তু তিনটি বৃত্ত ছন্দকেই অমান্য করে। সেখানে পর্ব বিভাজন নির্দিষ্ট সময়ের পরিমাপ মেনে করা হয় অর্থাৎ প্রতিটি পর্বের সময়ের পরিমাপ সমান। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি গানের ছন্দকে চতুর্থ বৃত্তছন্দের মর্যাদা দিতাম। নাম দিতাম তালবৃত্ত, একটি তাল = এক মাত্রা। যতদিন না সুধীজনে এই নামটি মেনে নিচ্ছেন ততদিন একে স্বরবৃত্তের একটি বিশেষ রূপ হিসেবে দেখা যায়। এই প্রস্তাবনায় আমি অবশ্য “তালবৃত্ত” শব্দটিই ব্যবহার করব ও প্রমাণ করার চেষ্টা করব তালবৃত্তের চলন অন্য তিনটি বৃত্তছন্দের থেকে আলাদা। উদাহরণ দিয়ে দেখাব বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু কবিতা লেখা হয়েছে যা অনান্য বৃত্তের তুলনায় তালবৃত্তের পরিকাঠামোয় বেশি ভালো বসে।

    সংস্কৃত ছন্দকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় রূপান্তর করেছিলেন মাত্রাবৃত্তের পরিকাঠামোয়, অন্তত আমি তেমনই বুঝেছি। বাংলা উচ্চারণ হ্রস্ব-দীর্ঘর ভেদাভেদ করে না বলে হ্রস্ব স্বরকে করেছিলেন মুক্তদল এবং দীর্ঘ স্বরকে করেছিলেন রুদ্ধদল। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রবর্তক। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ওপর পরোক্ষ রবীন্দ্র-প্রভাব রূপান্তরের এই ধারারজন্য বহুলাংশে দায়ী বলে মনে হয়। অথচ গীতগোবিন্দ গাওয়া হত মৃদঙ্গর তালে। “ধীরে সমীরে যমুনা তীরে...” চেষ্টা করেও মাত্রাবৃত্তে পড়া যায় না। তাছাড়া মাত্রাবৃত্তের পরিকাঠামোয় বিচার করলে অনেক সংস্কৃত ছন্দেরই পর্ব বিভাজনে মাত্রার সংখ্যা অসমান হয়। যেমন মন্দাক্রান্তায় প্রতি পংক্তিতে ৮-৭-৭-৫ (৪)। এই অসঙ্গতির কারণ কী? আমার মনে হয় সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় রূপান্তর করতে গেলে গানের ছন্দের অর্থাৎ তালবৃত্তের পরিকাঠামোতেই করা উচিত।

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “চাবি” কবিতাটির ছন্দ আমার বড়ই intriguing (বাংলা প্রতিশব্দ জানি না) লাগে। কেন জানি না, অনেক বলেন কবিতাটি পাঁচের চালের মাত্রাবৃত্তে লেখা। কিন্তু ‘তোরঙ্গ আজ’ ‘স্মৃতির ভিতর’, ‘তিল তো তোমার’, ‘হঠাত লিখতে’, ‘পরম যত্নে’ সব পর্বগুলিই মাত্রাবৃত্তের মাত্রা গণনা অনুযায়ী ৬ মাত্রার। আমার জ্ঞান মতে মাত্রাবৃত্ত মাত্রা নিয়ে অসৈরণ বরদাস্ত করে না। সুতরাং কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে লেখা নয়। তবে কি চার মাত্রার পর্বের স্বরবৃত্তে? “অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে/ তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো/ লিখিও উহা ফিরত চাহ কিনা।” ‘অবান্তর’ ও ‘তোমার মুখ’ — শক্তি অবলীলায় একটি মুক্ত ও দুটি রুদ্ধ — তিনটি দল দিয়ে পর্ব গড়ার কাজ সেরেছেন। আবার প্রথম লাইনের ‘এখনও পড়ে’ পাঁচটি অযৌগিক মুক্ত দল দিয়ে গড়া, অথচ পড়তে তো বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। ব্যাপারটা অন্য ভাবেও চিন্তা করা যায়। সেই অন্য চিন্তাটাই এই প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য। কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে সব পর্বগুলি পড়তেই সময় লাগছে মোটামুটি সম পরিমাণের। আমার ধারণা তালবৃত্তের পরিকাঠামোর মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।

    আসল ব্যাপারটা হল এই যে রুদ্ধ মুক্তর ক্রমের ওপর পর্বের মাত্রা সংখ্যা নির্ভর করে। তার মানে সেই মূলে ফিরে যাওয়া — সংস্কৃত ছন্দ... যেখানে হ্রস্ব দীর্ঘরক্রমানুসারে ছন্দ নির্ধারিত হত। সংস্কৃত ছন্দ মাত্রাবৃত্ত না স্বরবৃত্ত সেই তর্ক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে যদি আমরা একটা সাধারণ সূত্র ধরে এগোই — একটি পংক্তির প্রতিটি পর্বের উচ্চারণের সময় পরিমাপ সমান হওয়া উচিত। আর একটু বিশদে বলি, কী বলতে চাইছি বোঝানোর জন্য সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কৃত রূপান্তরিত মন্দাক্রান্তার উদাহরণ নিই।

    পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল কই গো কই মেঘ উদয় হও...

    “পিং-গল বিও-হল/ ব্য-থি-ত ন-ভ—তল/ কই-গো কই-মেঘ / উ-দয়-হও...”

    রুদ্ধ-রুদ্ধ-রুদ্ধ-রুদ্ধ/মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত-রুদ্ধ/ রুদ্ধ-মুক্ত-রুদ্ধ-রুদ্ধ / মুক্ত-রুদ্ধ-রুদ্ধ...

    অক্ষর বৃত্তের পরিকাঠামোয় মাত্রা গণনাঃ ৬-৭-৭-৫। মাত্রা বৃত্তের পরিকাঠামোয় মাত্রা গণনাঃ ৮-৭-৭-৫। স্বরবৃত্তের পরিকাঠামোয় মাত্রা গণনাঃ ৪-৬-৪-৩। আচ্ছা, মন্দাক্রান্তাকে তালবৃত্তর পরিকাঠামোয় মাপলে, সময় পরিমাপের নিরিখে ওই লাইনটিতে কতগুলি মাত্রা পাচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত তোলা থাকুক। মন্দাক্রান্তার এক লাইনে চারটি পর্ব, শেষের পর্বে সব বৃত্তেই ব্ল্যাঙ্কিং থাকে, তাই কম মাত্রা সিদ্ধ। প্রথম তিনটি পর্বের শেষ মাত্রাগুলি রুদ্ধ, তাই ধরে নিতে পারি সেগুলির উচ্চারণে সম পরিমাণ সময় লাগবে। ওই রুদ্ধ দলটিকে ছেড়ে দিলে, প্রথম পর্বের তিনটি রুদ্ধদল (রুদ্ধ-রুদ্ধ-রুদ্ধ) উচ্চারণ করতে এবং দ্বিতীয় পর্বের পাঁচটি মুক্ত দল (মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত-মুক্ত) উচ্চারণ করতে একই সময় লাগা উচিত। আগেই দেখেছি স্বরবৃত্তে চারটি মিশ্র দল দিয়ে পড়া পর্বের পাশে পাঁচটি মুক্ত ও তিনটি রুদ্ধ দল দিয়ে গড়া পর্ব অনায়াসে জায়গা করে নেয়। তাই পাঁচটি মুক্ত বা তিনটি রুদ্ধ দল দিয়ে গড়া পর্বকে ৪ মাত্রার সমতুল্য ঘোষণা করা যায়। লক্ষ করে দেখুন, এই হিসাবে মুক্ত দলের মাত্রা মর্যাদা রুদ্ধদলের থেকে কম। কিন্তু “মুক্ত-মুক্ত”-র মর্যাদা “রুদ্ধ”-র সমান নয়, তাই এই ছন্দকে মাত্রাবৃত্ত বলা ঠিক হবে না। এমনকি তৃতীয় পর্বের রুদ্ধ-মুক্ত-রুদ্ধকেও এই বিচারে ৪ মাত্রার মর্যাদা দেওয়া উচিত। খুঁজলে বাংলা কবিতায় এই ধরনের পর্ব গঠনের প্রয়োগের উদাহরণও পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

    এবার ‘চাবি’ কবিতাটির ছন্দ পড়তে চেষ্টা করা যাক। আমি ব্র্যাকেটের মধ্যে প্রথমে দল ও পরে তালবৃত্ত অনুসারে মাত্রা সংখ্যা লিখে দিলাম।

    “আমার কাছে (৪, ৪) এখনো পড়ে (৫, ৪) আছে
    তোমার প্রিয় (৪, ৪) হারিয়ে যাওয়া (৪, ৪) চাবি
    কেমন করে (৪, ৪) তোরঙ্গ আজ (৫, ৪) খোলো!

    থুৎনি ’পরে (৪, ৪) তিল তো তোমার (৪, ৪) আছে
    এখন?ও মন, (৪, ৪) নতুন দেশে (৪, ৪) যাবি?
    চিঠি তোমায় (৪, ৪) হঠাৎ লিখতে (৪, ৪) হলো।

    চাবি তোমার (৪, ৪) পরম যত্নে (৪, ৪) কাছে
    রেখেছিলাম, (৪, ৪) আজই (আজি) সময় (৪, ৪) হলো-
    লিখিও, উহা (৪, ৪) ফিরৎ চাহো (৪, ৪) কিনা?

    অবান্তর (৩, ৪) স্মৃতির ভিতর (৪, ৪) আছে
    তোমার মুখ (৩, ৪) অশ্রু—ঝলো (৪, ৪) মলো
    লিখিও, উহা (৫, ৪) ফিরৎ চাহো (৪, ৪) কিনা?”
    ‘হারিয়ে যাওয়া’ এবং ‘লিখিও উহা’ চারটি দলের সমাহার ধরেছি, কারণ ইয়ে, ওয়া এবং ইয়ো দ্বিস্বর যৌগিক। তাদের এক মাত্রার মর্যাদা দেওয়াই শ্রেয়। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, শক্তি ‘লিখো উহা’ না লিখে ‘লিখিও উহা’ লিখলেন কেন? চারটি মুক্তদল দিয়ে গড়া পর্ব স্বরবৃত্তে সিদ্ধ হলেও আমার কানে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। আমরা আগেই দেখেছি রুদ্ধ-মুক্ত-রুদ্ধকেও ৪ মাত্রার মর্যাদা দেওয়া যায়। ‘চাবি’ কবিতায় দুটি জায়গায় শক্তি মুক্ত-রুদ্ধ-রুদ্ধকে ৪ মাত্রার সমতুল্য ধরেছেন। তার মানে এই নয় যে মুক্ত-রুদ্ধ-রুদ্ধ-মুক্ত — ৪ মাত্রার সমতুল্য হবে না। তবে মুক্ত-রুদ্ধ-রুদ্ধ-রুদ্ধ ৪ মাত্রা নৈব নৈব চ। দ্রষ্টব্য, স্বরবৃত্তের পরিকাঠামোয় কোনও কোনও পর্ব তিন বা পাঁচ মাত্রার হলেও তালবৃত্তের পরিকাঠামোয় সব পর্বগুলিই চতুর্মাত্রিক। Hence proved, “চাবি” কবিতাটি তালবৃত্ত ছন্দে গঠিত।

    ছান্দসিকরা না মানলেও কবিরা কিন্তু এই ছন্দটি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। এবার একজন সমসাময়িক কবির জনপ্রিয় একটি কবিতার উদাহরণ দিয়ে প্রস্তাবনাটির দাঁড়ি টানব। এই উদাহরণটি দেবার উদ্দেশ্য হল — আধুনিক সময়েও কবিরা এই ছন্দের রহস্য ভাঙতে উৎসাহী হয়েছেন। শ্রীজাতর “উড়ন্ত সব জোকার” কবিতার ছন্দও আমার মতে স্বরবৃত্তের এই বিশেষ রূপ বা তালবৃত্তের আওতায় পড়ে। “আকাশ বড় কৃপাসিন্ধু। ঝাকাস যত উড়ন্ত সব জোকার/ বেকার ছিলাম অ্যাদ্দিন, আজ কাজ পেয়েছি গায়ের গন্ধ শোঁকার।” ‘অ্যাদ্দিন, আজ’ পর্বটির দল সংখ্যা তিন, তিনটিই রুদ্ধ। কবি অনায়াসে ‘এতদিন আজ’ লিখতে পারতেন, এতটুকু ছন্দ বিচ্যুতি হত না। কিন্তু তিনি তার চলতি রূপ ‘অ্যাদ্দিন, আজ’ লিখতেই পছন্দ করেছেন। একই দল-ক্রম ছড়িয়ে আছে আরও দু-এক জায়গায় (‘হ্যামবার্গার’ ইত্যাদি)। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচটি মুক্ত দল দিয়ে গড়া পর্ব ‘পিছু নিয়েছে’রও দেখা পেয়ে যাই।

    আশা রাখি এই প্রস্তাবনা স্বরবৃত্তের রহস্যময় চেহারায় খানিকটা আলোকপাত করতে পারবে। এই লেখাটির মাধ্যমে গুণীজনদের কাছে বাংলা বৃত্তছন্দের তালিকায় ‘তালবৃত্ত’ নামের চতুর্থ ছন্দটির অন্তর্ভুক্তির জন্যও আবেদন রইল। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও অন্তত এটুকু যদি মান্য করা হয় যে স্বরবৃত্তর পর্ব গঠনে চার মাত্রার পাশাপাশি পাঁচ ও তিন মাত্রার পর্বও স্বমহিমায় বৈধতা পায়, তাদের উচ্চারণ বিকৃত করার প্রয়োজন হয় না, তাও যথেষ্ট। অনেক কিছুই আলোচনার বাইরে রয়ে গেল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে যৌগিক স্বরের বিষয়ে। আমি যৌগিক স্বরের উল্লেখ করলেও বিস্তারিত আলোচনায় যাইনি। এ ছাড়া তাল, মাত্রা ও যতির সম্পর্ক নিয়ে নিয়ে আলোচনাও মুলতুবি রেখেছি। আমি নিজে তালকানা। একটি পরিশীলিত অভিমত পেয়েছি মন্দাক্রান্তাকে তিনতালে বেশ পড়া যায়। তবে তার জন্য যতির গণনা করা অপরিহার্য। যতিকে মাত্রার মর্যাদা দেওয়া উচিত কি উচিত নয় সেই বিতর্কও আপাতত তোলা রইল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: সঞ্চারী মুখার্জী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments