• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কোট ডা-জুর, মন আমুর : রাহুল রায়


    ব কিছুরই বোধ হয় একটা অজুহাত লাগে। তাই বিশেষজ্ঞ হওয়ার মত জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে নীস-এ মেয়েদের স্তনের ক্যান্সারের ওপরে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণে ইতিবাচক উত্তর দেওয়া ছাড়া কোন উপায়ই রইল না। তার কারণ কোট ডা-জুর (ভূমধ্যসাগর বা আজুর-এর সমুদ্রবেলা) বা ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা-র অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। ভূমধ্যসাগরের কোলে মালার মতো সাজানো ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা-র অন্তর্ভুক্ত নানা শহর, তার মধ্যে আছে নীস, আন্তিবেস (ফরাসী উচ্চারণে ‘অনসিব’), ক্যানস (ফরাসী উচ্চারণে ‘কান’) ইত্যাদি। সমুদ্রের ধারে ধারে লোকালয়, আর তার পিছন দিক দিয়ে উঠে গেছে ফ্রেঞ্চ আল্‌পস পাহাড়ের শ্রেণী, কোথাও তা লোকালয় থেকে একটু দূরে, আর কোথাও পাহাড়ের সাথে সখ্যতা খুবই ঘনিষ্ঠ, যেন আর তর সয় না আলিঙ্গনে বাঁধতে।

    মে মাসের একেবারে শেষে আমার স্ত্রী স্বপ্না আর আমি বস্টন থেকে লন্ডন-হিথরো ঘুরে এক ঝকঝকে দুপুরে নীস-এ গিয়ে পৌঁছলাম। এয়ারপোর্ট-এর ঠিক উল্টোদিকে আমাদের কনফারেন্সের হোটেল। এয়ারপোর্ট-এর বাইরে বেরোতেই আমার চোখ আটকে গেল। একটা মস্ত জায়গায় রাখা আছে বেশ কয়েকটা বিশাল চৌকাকৃতি পোস্টার/হোর্ডিং। তাদের গায়ে বিংশ শতাব্দীর নানান সিনেমা পার্সোনালিটির ছবি। বুঝলাম এগুলি জগৎ-বিখ্যাত কান ফিল্ম ফেস্টিভালের সাজগোজের সামগ্রী। সঙ্গের ছবিতে দেখা যাচ্ছে কোন এক ফিল্মের সেটে প্রবাদপ্রতিম মারচেল্ল মাস্ত্রয়ানী আর ইয়ুল ব্রেনার আলাপ করছেন।

    আমাদের নীসের মেয়াদ মাত্র তিন রাত, তার মধ্যে আবার আমার লেকচার আছে। সুতরাং হোটেলে জিনিসপত্র নামিয়ে প্রায় পড়িমরি করে ছুট। ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে আমাদের হোটেল শহরের একেবারে এক প্রান্তে, সেখান থেকে বাস নিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থল বা সেন্টার অফ টাউন যাওয়া যায়। কিওস্ক থেকে ক্রেডিট কার্ড বা ইউরো দিয়ে টিকিট কাটা একেবারে জলভাতের ব্যাপার। অনেকে ভয় দেখিয়েছিল যে ফ্রেঞ্চ না জানলে কোন কিছু করা অসম্ভব। আদতে দেখলাম সবাই বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ, আমাদের ইংরেজিতে বলা প্রশ্নের হাত-পা নেড়ে বা ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজিতে উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে কেউই পিছপা নয়, আর আমাদের তাতে পোয়া-বারো।

    ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা ও নীস একসময় ছিল সারা ইউরোপের রাজা-রাজড়া থেকে শুরু করে বিখ্যাত লেখক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রকর ও অন্যান্য শিল্পীদের স্থায়ী বা অস্থায়ী আবাস। নীস শহরের দক্ষিণে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা ঘন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে ভূমধ্যসাগর, তার রঙের কত বাহার, কত ধরনের নীল। আর সমুদ্রতটের গা দিয়ে চওড়া পায়ে-চলার রাস্তা, অ্যাভেনিউ ড’অঙলে, আর তার গা দিয়ে বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে প্রশস্ত সড়ক, তাতে বাস-গাড়ি ইত্যাদির কোন অভাব নেই। নীসের সেন্টার অফ টাউন বা মেসিনা-য় ইউরোপের অন্যান্য বড় শহরের মতো লাল-পাথরের গাঁথনি দেওয়া রাস্তায় মস্ত প্লাজা, তার মধ্যিখানে এক বিরাট মধ্যযুগীয় ফোয়ারা। সেখানে উন্মুক্ত-বক্ষ গ্রীক কামনার দেবী নীম্ফ, নগ্ন গ্ল্যাডিয়েটর, ড্রাগন, ফুঁসে-ওঠা ঘোড়া কোন কিছুই বাদ নেই। তার কাছেই রাজারাজড়ার উপযুক্ত এক মস্ত বাগান। ফোয়ারার উলটো দিক দিয়ে নেমে গেছে একটা চওড়া রাস্তা। সেই রাস্তার দুপাশে বিশাল লম্বা পোস্টের মাথায় পা-মুড়ে বসে থাকা পুরুষদের অস্বচ্ছ কাঁচ বা এই জাতীয় জিনিষ দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য। ইতিমধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে, আর নানা রঙের আলোয় সেই ভাস্কর্যগুলি এক অদ্ভুত আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে।

    স্বপ্না আর আমার দুজনেরই ফরাসী চিত্রকরদের সম্বন্ধে বিরাট উত্সাহ। সেদিন রাতে বাস ধরে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই ঠিক করে ফেলেছি যে পরদিন ভোরবেলা নীস-ভীল থেকে ট্রেন নিয়ে আমরা অনসিব যাবো, পিকাসো মিউসিয়াম দেখতে। উত্তেজনায় আমাদের প্রায় ঘুম ছুটে যাওয়ার অবস্থা। সকালে উঠেই বাস ধরে ট্রেন-স্টেশনে হাজির। প্রায় ঘন্টা-খানেকের রাস্তা। ট্রেন থামছে স্টেশনে, লোকজন উঠছে-নামছে, সব ঘড়ির কাঁটা ধরে। আমাদের পাশে সীটে বসেছিল একটি মেয়ে, ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজি নিয়ে ভারী মিশুকে। সে জানালো যে সে নীস থেকে অনসিব যাচ্ছে ওর দিদিমাকে দেখতে। মেয়েটির নাম মাউন, দেখতে স্প্যানিশদের মতো, কিন্তু ও জানাল যে ওর দিদিমা ভিয়েতনাম আর দাদু সেনেগালের লোক। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল যে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা, ও পরে প্যারিসে গিয়ে দেখেছি সর্বত্র কৃষ্ণাঙ্গ, হরিতাঙ্গ, ও বাদামী-অঙ্গের মেয়ে-পুরুষের একেবারে ছড়াছড়ি, যা অতীত দিনের মহা-শক্তিশালী ফ্রেঞ্চ এম্পায়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়, যার উপনিবেশ ছড়ানো ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সর্বত্র। অন্যদিকে এই ট্রেন-যাত্রার সময়ই আমাদের কামরায় দেখতে পেলাম কয়েকটি সুন্দরী ফরাসী তরুণীকে। এদের চেহারা বর্তমান ফরাসী মডেল সম্বন্ধে আমাদের যা ধারণা তার একেবারে বিপরীত। এই দুধ-সাদা গায়ের-রঙের মেয়েগুলি বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবতী ও গুরুস্তনী। এতক্ষণে রেনেসাঁস থেকে ইম্প্রেসানিস্ট ফরাসী চিত্রকরদের আঁকা ছবির মডেলদের যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম।

    অনসিব স্টেশনে নেমে মাউন বিদায় নিল, আর আমাদের দেখিয়ে দিল সামনের এক রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হাঁটলে একেবারে সমুদ্রের ধারে পিকাসো মিউসিয়াম। এঁকে-বেঁকে রাস্তা চলেছে। দূরে ঘননীল সমুদ্র, তার তটে সাদা-সাদা ‘পোলকা ডট’-এর মত ছোট বড় নানান মাপের ‘ইয়ট’ ও অন্যান্য জলযান ছড়িয়ে রয়েছে, আর তাদের মাঝেই মাথা তুলে রয়েছে বিশাল আকারের এক হাঁটু-মুড়ে বসা পুরুষ-মূর্তি, যার অনেক ছোট সংস্করণ দেখেছি নীসের মেসিনায়, পোস্টের মাথায়। আমরা সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু নিচে নামার বদলে পাথর বা কবল্‌-স্টোন দিয়ে বাঁধানো সরু রাস্তা ক্রমাগত উঁচুতে উঠছে। আর ঠিক যেখানে আকাশ আর সমুদ্রের নীল একাকার হয়ে গেছে সেখানে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যযুগীয় দুর্গ। সেখানেই মিউসিয়াম, যার দেওয়ালে প্যাঁচা-হাতে পিকাসোর ছবি। এই দুর্গের এক পাশ দিয়ে খাড়া পাঁচিল নেমে গেছে সমুদ্রের শরীরে, আর অন্য পাশে ধাপে-ধাপে সিঁড়ির শেষে দুর্গে ঢোকার মুখ, সেখানে অন্য সব জায়গার মত সঙ্গের ব্যাকপ্যাক জমা দিয়ে, টিকিট কেটে মিউসিয়ামে ঢোকা।

    এই দুর্গটা আদতে ছিল গ্রীক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১৬০০ শতাব্দী থেকে এটা ইতালীর গ্রিমালডি রাজপরিবারের হাতে চলে যায়, ও ১৯০০ শতকে এটা হয়ে যায় গ্রিমালডি রাজপরিবারের সংগ্রহশালা বা মিউসিয়াম। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাবলো পিকাসো, তাঁর প্রেমিকা ফ্রান্সয়া জিলোকে নিয়ে যখন এখানে থাকতে আসেন তখন এই জায়গাটা ছিল প্রায় জনশূন্য। তাঁরা এখানে মাত্র দুই মাস থেকে প্যারিসে ফিরে যান। আর এই অল্প সময়ে পিকাসো ছবি এঁকেছেন ২৩টা আর রেখাচিত্র বা ড্রয়িং করেছেন ৪৪টা! এই মিউসিয়ামে রাখা ছবিদের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দ হল ‘গোট’ বা এক ছাগল-এর এক অনবদ্য রেখাচিত্র। তা ছাড়া ছিল বিখ্যাত ছবি, ‘ল্য জয় ড’ ভিভ’ বা ‘আনন্দময় জীবন’ আর কিছু ভাস্কর্য। দিনের শেষে পিকাসো মিউসিয়াম থেকে পরিপূর্ণ মন নিয়ে নীসে ফিরেছি। ইতিমধ্যে স্থির করে ফেলেছি পরের দিন যাব মার্ক শাগাল আর আঁরি মাতিসের আঁকা দেখতে।

    পরের দিন সকালে উঠেই বাসে চড়ে নীসের কেন্দ্রে মেসিনা, আর সেখান থেকে অন্য এক বাস ধরে চললাম শহরের উত্তরপূর্বে, সমুদ্র ছেড়ে পাহাড়ের দিকে। সঙ্গে ম্যাপ থাকলেও তার কোন প্রয়োজন হয়নি, কারণ প্রত্যেক বাসস্টপেই কোন বাস কোথায় যাবে, কখন, দ্রষ্টব্য কি আছে সবই লেখা আছে, ফরাসীতে, কিন্তু বুঝতে কোন অসুবিধে হয়নি আমাদের। আগে পড়ল শাগাল সংগ্রহশালা। নির্দিষ্ট স্টপে নেমে ঠিক তার উলটো দিকেই ‘মুসে ড’ মার্ক শাগাল’।

    মার্ক শাগালের সঙ্গে আমার ছোটবেলা থেকেই পরিচয়। আমাদের বাড়িতে মা ও আমি ছিলাম ছবি আঁকিয়ে, আর ফরাসী ইম্প্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট ইত্যাদি ছবির ওপর ছিল আমাদের দারুণ আকর্ষণ। আমাদের গ্রোভ লেনের বাড়ির দেওয়ালে নানা ছবির প্রিন্ট টাঙ্গানো ছিল। তার মধ্যে ছিল মার্ক শাগালের ‘আই অ্যান্ড দ্য ভিলেজ’ ছবির এক মস্ত বড় প্রিন্ট। সেখানে দেখা যেত ডানদিকে একটা টুপি-পরা লোক, দূরে কিছু এক-চালা বাড়ি, একটা চার্চ বা সীনাগগ, এক লাঙ্গল-কাঁধে চাষি। লোকটার উল্টোদিকে এক ছাগলের মস্ত মুখ, তার মধ্যে একজন গরুর দুধ দুইছে ইত্যাদি। শাগালের মিউসিয়ামে গিয়ে সেই স্মৃতি যেন ফিরে এল।

    মার্ক শাগালের জন্ম জারের রাশিয়া ও বর্তমান বাইলো-রাশিয়ার ভিটেস্ক গ্রামে এক অত্যন্ত গোঁড়া এক হাসিডিক ইহুদি পরিবারে। পরে উনি ফ্রান্সে চলে আসেন, কিন্তু নিজের পারিবারিক মুল, ভিটেস্ক-এ নিজের গ্রামের কথা কোনদিন ভোলেননি। আর ভোলেননি সারা পৃথিবীতে ইহুদিদের ওপরে অত্যাচারের কথা। আর এই মিউসিয়ামে তাঁর সেই ‘থীম’ বারবার ফিরে এসেছে।

    প্রদর্শনীতে ঢুকতেই মস্ত-মস্ত ক্যানভাসে নানা রঙের, বিশেষ করে উজ্জ্বল নীল, সবুজ আর হলুদ রঙের ছটায় চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে গেল। এখানে প্রত্যেকটি ছবিতে রয়েছে বাইবেলে বর্ণিত নানা কাহিনি ও ‘সিম্বলিসম’। যেমন গার্ডেন অফ ইডেনে সাপ-রূপী শয়তানের প্ররোচনায় আদম ও ইভের আপেল খাওয়া ও মানুষ-কৃত প্রথম পাপ, অথবা মোসেসের নেতৃত্বে ইহুদিদের পরিত্রাণ ইত্যাদি। নোয়া'স্‌ আর্কের ওপরে আঁকা ছবিটি ভারি মজার ও ব্যতিক্রমী। এখানে দাড়ি-ওলা নোয়া পথ দেখাচ্ছে, আর জীবজন্তুরা নৌকার বাইরে থেকে ভিতরে কি হচ্ছে তা দেখছে চুপ করে। আরো একটা মজার কথা হল প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতেই শাগালের নিজের ছোটবেলার গ্রাম, সেখানকার লোকজনের ছবি, সেখানে ইহুদিদের ওপরে অত্যাচার ইত্যাদি রয়েছে। অবশ্যই বাইবেলের যুগে এ সবের কোন অস্তিত্বই ছিল না। এ ছাড়া এই মিউসিয়ামে আছে শাগালের সৃষ্ট অপূর্ব কয়েকটি নীল-লাল-সবুজে বিমূর্ত নক্সা-সহ ‘স্টেইন্ড গ্লাস উইন্ডো’।

    শাগাল মিউসিয়াম থেকে বেরিয়ে অল্পক্ষণ বাস চড়ে যেতেই এসে গেল ‘মুসে মাতিস।’ আঁরি মাতিস প্রথম দিকে ইম্প্রেসানিস্ট শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও শীগগিরই ছবিতে উজ্জ্বল ও চড়া রঙের ব্যবহার, ত্রি-মাত্রিকের বদলে দ্বি-মাত্রিক বা ‘ফ্ল্যাট’ ছবি, রেখার মিশ্রণের বদলে বলিষ্ঠ রেখায় আঁকতে শুরু করলেন, ও বন্ধু আন্দ্রে ডিরাঁ-র সাথে শুরু করলেন ‘পোস্ট-কিউবিস্ট’ ‘ফভ (বুনো জন্তু)-ইসম’ আন্দোলন, যা শিল্পীমহলে একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছিল। আরো উল্লেখযোগ্য যে মাতিস ছবি আঁকা ছাড়াও ভাস্কর্য, কাগজ-কেটে শিল্প-সৃষ্টি, জামা-কাপড়ের নক্সা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ করেছেন।

    মুসে মাতিস-এ ঢোকার মুখে একজনকে ডেকে আমাদের একটা ছবি তোলা হল - ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম মনে রেখো’।

    মিউসিয়ামে ঢুকেই মাতিসের নানা ধরনের শিল্পকর্মের উদাহরণ পাওয়া গেল। সামনেই দুই নগ্ন নারীর ভাস্কর্য, তবে পিছন থেকে। আবার তার কাছেই এক দেওয়াল জুড়ে এক মস্ত কাগজ-কাটা উত্তাল সমুদ্রের ছবি। দোতলায় উঠতেই মাতিসের অস্তিত্ব সর্বত্র, দেওয়ালে রঙের খেলা, সাদাকালো ড্রয়িং, শো-কেসে কালো নগ্নিকার ভাস্কর্য, তা ছাড়া আছে মাতিসের সংগ্রহ করা নানান জাপানী ছবি ও অন্যান্য জিনিষ। জানলাম যে মৃত্যুর আগে উনি ছবি আঁকতে বা ভাস্কর্য করতে পারতেন না। তখন তিনি কাগজে এঁকে সঙ্গীদের নির্দেশ দিতেন সেই কাগজ কেটে নক্সা করতে। ঘর-জোড়া সেই কাগজ-কাটা কোলাজ রাখা আছে এই সংগ্রহশালায়, যার এক উদাহরণ দেওয়া হল।

    মুসেমাতিস থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেলে ফিরে আসার কথা, কিন্তু মাতিসের সম্বন্ধে একটা কথা শুনে আমাদের মত পালটাতে হল। শুনলাম, তিনি মৃত্যুর আগে নীসের উত্তরে ফ্রেঞ্চ আল্পসের গায়ে ভেন্স (ফরাসী উচ্চারণে ভন্স) নামের এক গ্রামে একটা চ্যাপেল সাজানোর ভার নিয়েছিলেন। এর সাথে এক হৃদয়গ্রাহী গল্প লুকিয়ে আছে তা আমরা পরে জানতে পেরেছি। মাথায় নীসের সমুদ্র- তটে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া মাথায় বিশেষ কোন পরিকল্পনা ছিল না। সুতরাং চলো ভন্স।

    জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে প্রথমে মেসিনায় ফিরে যেতে হবে, ওখান থেকে বাস আছে প্রতি ঘণ্টায়, ঘণ্টা-খানেকের রাস্তা। ব্যাস, আমরা চললাম বাসে চড়ে ভন্স-এর দিকে। ঘোরানো পাহাড়ি রাস্তা, উঠছে তো উঠছেই। উঁচু থেকে দেখতে পাচ্ছি অনেক দক্ষিণে একফালি সমুদ্র, আর পাহাড়ের গায়ে-গায়ে বাড়ি-ঘর ইত্যাদি। আর একটা ব্যাপার ভারী আশ্চর্য লাগল। অন্তত দু-জায়গায় রাস্তার মোড়ে বড় আকৃতির ভাস্কর্য। বুঝলাম যে শহরের ‘ম্যাডিং ক্রাউড’ এখানে না থাকলেও শিল্প আমাদের ছাড়েনি। সাধে কী বলে শিল্পীর দেশ! একেবারেই, পরে জানতে পারি যে কাছাকাছি দুই গ্রামে মাতিস ও শাগাল চিরঘুমে শুয়ে রয়েছেন ।

    বাস থামল ভন্স-এ। সেখানে মাতিস-চ্যাপেল জিজ্ঞাসা করায় তারা দেখাল সরু পথ বেয়ে সোজা উঠে যাও। রাস্তায় জনমানব বিশেষ নেই যে জিজ্ঞাসা করি, আন্দাজে চলেছি। পথে পড়ল একটা ছোট সেতু, তার রেলিঙের জায়গায় জায়গায় গুচ্ছ গুচ্ছ তালা ঝোলানো। পরে প্যারিসে গিয়ে নোতরদাম ক্যাথিড্রালের গায়ে সেইন নদীর ধারেও একই ব্যাপার দেখেছি। এগুলো আমাদের দেশে ঠাকুরের ‘থানে’ দড়ি বাঁধার মতো, নানান শুভ-কামনায়। মানুষের রূপ পৃথিবীর সর্বত্রই এক। অনেক খুঁজে খুঁজে যখন আমরা চ্যাপেলে পৌঁছেছি, তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা, আধ ঘণ্টার মধ্যে চ্যাপেল বন্ধ হয়ে যাবে।

    ওই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা যা দেখার দেখলাম। মাতিসের নক্সা করা উজ্জ্বল লাল, হলুদ, নীল রঙের পাদ্রীদের পোশাক, কিছু ড্রয়িং, আর চ্যাপেলের মধ্যিখানে যেখানে উপাসনা হয়, সেখানে কয়েকটি অপূর্ব স্টেইন্ড গ্লাস উইন্ডো। আমরা ফিরবো, দেখি দেওয়ালে ঝোলানো একটি অল্পবয়স্ক মেয়ের হাস্যময় মুখের ছবি, আর তার তলায় লেখা আছে একটা হৃদয়গ্রাহী ইতিহাস।



    ১৯৪১ সালে মাতিসের অন্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সার্জারি করা হয়, কিন্তু মাতিস অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন, বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় তিন মাস। এইসময়ই তিনি কাগজ-কাটা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। যাইহোক, এইসময় তিনি একজন নার্সের জন্য বিজ্ঞাপন দেন, ও তাতে সাড়া দেয় মোনিক্‌ বুর্জোয়া নামে এক তরুণী। মোনিক্‌ নিজে ছিল চিত্রশিল্পী, আর দুজনের মধ্যে খুব দ্রুত এক প্লেটোনিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি মাতিসের বেশ কিছু ছবিতে মডেলের কাজও করে। কিন্তু, এই সম্পর্ক মোনিকের পরিবার ভাল চোখে দেখেনি, আর সেই চাপে পড়ে মোনিক্‌ ভন্স-এ ডমিনিকান সিস্টার্স নামে ক্যাথলিকদের এক গোষ্ঠীতে ‘নান’ হয়ে যোগ দেয়, তার নাম হয় জাক্‌-মারী। মোনিক্‌ ও মাতিসের প্লেটোনিক সম্পর্ক এখানেই শেষ। মাতিস ছিলেন নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু জাক্‌-মারী-কে দেখতে পাবেন এই টানে তিনি ‘চ্যাপেল দ্যু রোসারী ড’ভন্স চার্চ’ নিজের মনের মাধুরী দিয়ে সাজাতে রাজি হন। জাক্‌-মারী-র সাথে মাতিসের যোগাযোগ ছিল মাতিসের জীবনের শেষ পর্যন্ত। এই আখ্যান পড়তে পড়তে বার বার তারশঙ্করের সেই বিখ্যাত চরিত্র কৃষ্ণেন্দু আর রীনা ব্রাউনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, বিপরীত লিঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও।

    ভন্স থেকে বাসে চড়ে পাহাড় থেকে সমতলে নামছি, হঠাৎ এক জায়গায় বাস থামতে দেখি সেখানে রয়েছে ‘এস-এন-সি-এফ’ বা ফরাসী ট্রেনের ষ্টেশন। তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে ছ’টা বাজে। মাথায় এসে গেল এক্ষুনি নীসে না ফিরে গিয়ে যদি আমরা বিপরীত দিকে, অর্থাৎ পশ্চিমে ইতালীয় বর্ডারের দিকে যাই, পথে পড়বে কান। যা ভাবা তাই কাজ, বাস ছেড়ে ট্রেন। তিনটে ষ্টেশন পরেই কান। প্রায় সাতটা বাজে, কিন্তু দিনের আলো ঝকঝক করছে। আবার সেই লোককে জিজ্ঞাসা করতে করতে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জায়গায় পৌঁছনো। জানতে পারলাম আগের সপ্তাহে ফেস্টিভাল শেষ হয়েছে, কিন্তু তার নানান সাজসরঞ্জাম এখনো রয়েছে, যেমন ওপরে তাকিয়ে দেখি কান-এর আকাশে ফেস্টুন উড়ছে, তাতে নানান ফিল্ম পারসোনালিটির ছবি, তার মধ্যে আছে বিখ্যাত ফরাসী ‘সেক্স-বম্ব’ ব্রিজিত বারডো।


    কাছেই চোখে পড়ল মস্ত এক প্লাজার মধ্যিখানে লম্বা, উঁচুতে উঠে যাওয়া সিঁড়ির পর কান ফিল্ম ফেস্টিভালের বিশাল অডিটোরিয়াম। এখন বন্ধ। হতাশ যে হয়েছি সে ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। তবু আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি যদি বিশেষ কিছু দেখা যায়। হঠাৎ প্লাজার মাটিতে চোখ আটকে গেল। অডিটোরিয়ামের বাঁ-দিকে স্লেট পাথরের গাঁথনির ওপরে হাতের ছাপ। আর কাছে গিয়ে দেখি প্রত্যেকটি হাতের ছাপের সঙ্গে নানা ফিল্মের লোকজনের হাতের সই, যেমন ভেনেসা রেডগ্রেভ, পিটার সেলারস বা পিঙ্ক প্যান্থার। আরও আছে--সেই বিখ্যাত জাপানী, আকিরা কুরোসাওয়া। সেই সাড়ে ছয়-ফুট ব্যতিক্রমী জাপানীর পাশে প্রায় একই উচ্চতার এক ব্যতিক্রমী ভারতীয়র কথা মনে পড়লো। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও সত্যজিত রায় বা মৃণাল সেনের হাতের ছাপ বা সই খুঁজে পেলাম না। হায়রে দুর্ভাগা ভারতবাসী, ভাবতে ভাবতে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নীস ফিরে যাওয়ার ট্রেন ধরলাম। পরের দিন ভোরবেলা প্যারিস।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments