(এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক রচনা। কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে আহত করা আমার উদ্দেশ্য নয়, কোন চরিত্রের সঙ্গে মিল দেখতে পেলে জানবেন যে সেটা নেহাৎ কাকতালীয় ব্যাপার।)
|| ১ ||
ধিন তা ধিনা, পাকা নোনা
মহাশিবরাত্রির সকাল। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর শহর। ফুলচৌক থেকে আর গাড়ি এগুতে পারছে না। বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম। পাঁচটাকা ভাড়ার সওয়ারি অটোতে মাঝবয়েসি ভদ্রলোক খিঁচিয়ে ওঠেন।
—কি মুশকিল! আমাকে রোগীর খাবার নিয়ে সরকারী হাসপাতাল যেতে হবে। পেশেন্ট সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে, আজ জেনারেল ওয়ার্ডে দেবে। তার আগে আমাকে বিল ক্লিয়ার করতে হবে। আর আমি গেলে তবে তো রাত্তিরের ডিউটি করা বন্ধুটি রিলিফ পেয়ে বাড়ি যাবে। এইটুকু রাস্তা যেতে আর কতক্ষণ লাগাবে?
এবার টিউটোরিয়ালের জন্যে বেরুনো দেখনসুন্দরী মেয়েটি বলে—আমিও আধা ঘন্টা লেট্। কি যে করি?
রোগাটে টাকমাথা আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোক বকের মত গলা লম্বা করে অটো ড্রাইভারকে বলেন—কি হল? কিছু বুঝতে পারলে?
—মহাশিবরাত্রি কা জুলুস হ্যায় কাকা, শংকরসেনা কা। টাইম তো থোড়া লগেগা জী।
রোগীর বাড়ির ভদ্রলোক এবার খিঁচিয়ে ওঠেন—আগে জানলে কে তোমার অটোতে চড়ত? অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না!
ড্রাইভার নির্লিপ্ত ভাব দেখায়।
—কেইসে বাত করত ভাউ? শংকরসেনার যে মহাশিবরাত্রির দিন বিশাল ভব্য জুলুস বেরুবে সেটা তো গোটা শহর জানে। এতো প্রতিবছরের ব্যাপার। কৌন সী নয়ী বাত! কিন্তু এবার তো আগে থেকেই বড় বড় হোর্ডিং লাগিয়ে শহরবাসীকে জানানো হয়েছে।
ফুলচৌক, জয়স্তম্ভ চৌক, শাস্ত্রী চৌক-- কোথায় নয়? তাতে সর্বাধিনায়ক বিক্রম সোলাংকী ছাড়াও নগর অধিনায়ক রাকেশ ডোডেজা, জেলা অধিনায়ক রমেশ বহল সবার ফোটো লাগানো হয়েছে।
আর শহরের সব গলির থেকেই মিছিল আসছে, মিলবে রজবান্ধা ময়দানে। সেখানে বিক্রমজী অ্যাড্রেস করবেন। ওঁর জীবনের একটাই মিশন।
টাকমাথা ভদ্রলোক হেসে ফেলেন। —ওরে বাবা! যা লম্বা একখান লেকচার দিলি ভাই! তুইও কি শঙ্করসেনার সদস্য?
—আমরা সমস্ত অটো ড্রাইভাররাই সদস্য। বিক্রমজী আমাদের ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট যে!
শঙ্করসেনার নাম শুনে রোগীর খাবার পোঁছুতে যাওয়া ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ খাদে নেমে যায়। তবু বিড়বিড়ানি থামে না।
সেটা টের পেয়ে অটো ড্রাইভারের গলাতেও জাগে অনুরোধের সুর।
—আজ একটু কষ্ট করুন, স্যারজী! বছরে একটা তো দিন। কোন ক্ষতি হবে না আপনার। শঙ্করজী আছেন। বাবা ভোলেনাথের ওপর ভরসা রাখুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্যস্, আর দশ মিনিট।
এবার মারাঠি ভদ্রলোকের মুখে একটু মুচকি হাসি ফোটে।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবেন না? আমি যে সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি। কত বছর যেন!
—মানে? কাকাজী, এসব কি বলছেন? কয়েকবছর অপেক্ষা?
—যেতে দাও। ও কিছু না। বুড়ো মানুষের সব কথা ধরতে নেই। ওরা অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে!
এবার পাশের একটা মোটরসাইকেল জিলিপির কায়দায় ভীড়ের ভেতরে ঢুকে ট্যারা হয়ে দাঁড়াল। অটো ড্রাইভার খিস্তি করতে গিয়ে থেমে গেল। চালক ছেলেটির হাতে শঙ্করসেনার আর্মব্যান্ড বাঁধা।
—আরে ভাইয়া! কহাঁসে! সব ঠিক হ্যায় না?
—হাঁ, হাঁ, সব ঠিক হ্যায়। পাঠানলোগ মুহর্রমকে জুলুস মেঁ আখাড়া সে আদমী লাকর খুব তলোয়ারবাজী আর লাঠি কা প্যাঁয়তরা দিখায়া থা না? অব উন সবকী পুঁ সরক গয়ী। আরে উন্কী বাত ছোড়ো। ত্রিশুল পার্টি কে লোগ ভী নহী শোচে থে ইয়ে প্রোগ্রাম অ্যায়সা সাকসেস হোগী। ইসবার আগলা চুনাও মেঁ হমলোগোকো জ্যাদা সীট দেনা পড়েগা।
ডানদিকের বড়ইপাড়া গলি থেকে আরেকটা মিছিল এসে রাস্তাকে আরো ভারাক্রান্ত করে। মারাঠি ভদ্রলোক অটো থেকে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে ওই মিছিলটি দেখতে থাকেন।
কী আশ্চর্য! সামনে সব চোদ্দো-পনেরো বা আরো ছোট ছোট ছেলের দল। তারা নাচছে ত্রিশূল নিয়ে।
কিন্তু এ যে ওয়েল্ডিং করা ভারি রড দিয়ে তৈরি বিশাল ত্রিশূল, প্রায় দশ ফুট লম্বা। এই ত্রিশূল সোজা করে তুলে ধরে কার বাবার সাধ্যি! তাই তারা অন্তত: ছ'জন মিলে আড়াআড়িতে ধরেছে। আর নাচছে বিলম্বিত লয়ে। ছন্দটা হল:
"ধিনতা ধিনা, পাকা নোনা''।
ধিনতা-ধিনা,—ওরা লাফিয়ে দুই স্টেপ এগিয়ে যাচ্ছে।
পাকা-নোনা,—আবার দুই স্টেপ পিছিয়ে আসছে। ফলে মিছিল আর এগুচ্ছে না।
উনি মুগ্ধ হয়ে নাচ দেখতে থাকেন। ঠোঁটের মধ্যে এক চিলতে হাসি।
মাস দুই পরের এক সকাল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। আজ সমস্ত অফিস, স্কুল-কলেজ ছুটি। আজ যে রামনবমী। "মর্যাদা পুরুষোত্তম'' রামচন্দ্রের জন্মদিন। সারা শহর জুড়ে রঙিন কাগজের মালা। বড় বড় পোস্টার। আজ শঙ্করসেনা ও ত্রিশূল পার্টি সবারই বিশাল মিছিল বেরিয়েছে। মোড়ে মোড়ে পটকা ফাটছে। কোন কোন জায়গায় স্টল থেকে মিছিলযাত্রীদের লেবুর শরবত বা শিকঞ্জী পানি খাওয়ানো হচ্ছে। একটি মোড়ে কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের তরফ থেকেও স্টল লাগানো হয়েছে। তার সামনে একটি ব্যানারে লেখা আছে--"রাম হলেন সারা ভারতের অস্মিতার প্রতীক''।
মিছিলে কিছু লোক খোলা ত্রিশূল ও তলোয়ার নিয়ে নাচতে নাচতে চলেছে। চলছে নকল যুদ্ধ ও তলোয়ারবাজির মহড়া। সামনে ব্যানার—হনুমান আখাড়া।
শ্লোগান উঠছে—মন্দির বানানা হমারা কাম—জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম।
যো হিন্দুহিত কা বাত করেগা, ওহি দেশ মেঁ রাজ করেগা।
তুম মানো ইয়া না মানো, হম মন্দির ওহীঁ বানায়েঙ্গে।
সৌগন্ধ রাম কী খাতে হ্যায়, মন্দির ওহিঁ বানায়েঙ্গে।
একটা-দুটো চ্যাংড়া ছোঁড়া সব মিছিলেই থাকে। এখানেও ওমনি দুজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল।—মুসলমানোঁ কা দো হী স্থান, পাকিস্তান ইয়া কব্রিস্তান।
কয়েকজন হেসে ফেললো। কিন্তু তিনজন সিনিয়র ভলান্টিয়ার এসে ওদের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে চুপ করতে বল্লো।
—এখন ওসব স্লোগান চলবে না। সামনে ইলেকশান।
তাঁতিয়াপাড়াটা হল খানদানি মারাঠি পাড়া। এখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরে মহারাষ্ট্র মণ্ডল। আর মোড়ের থেকে দু'কদম পায়ে হাঁটলেই স্বয়ংসেবক দলের জেলা অফিস, একটি নতুন রং করা পুরনো বাড়িতে। তার তিনটি বাড়ি পরে একটি ঘিঞ্জি দোতলাবাড়ির চিলেকোঠা মত ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন আমাদের পূর্ব পরিচিত সেই আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোকটি। আজকে পোস্ট আফিস থেকে কিছু পয়সা তোলার ছিল। তবে আজ তো সব ছুটি। তাই ভদ্রলোকটি বেরোন নি।
খবরের কাগজ পড়া হলে উনি ভাল করে দাড়ি কামালেন। মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইছিলেন—সরফরোসী কী তমন্না অব হমারে দিলমেঁ হ্যায়। দেখনা হ্যাঁয় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মেঁ হ্যাঁয়!
বিক্রম শোলাংকি আজ খুশ মেজাজে। রামনবমীর র্যালি সুপার-ডুপার সাকসেস। সন্ধের দিকে ফোন এসেছিল সত্তাধারী ত্রিশূল পার্টির এক ম্যানেজারের। সে বাস্তুঘুঘুটি আবার মুখ্যমন্ত্রীর খাসম্খাস। কিছু ফিলার দিল। আগামী নির্বাচনে শংকরসেনা আর ওই পার্টির কোন প্রত্যক্ষ নির্বাচনী সমঝোতা হবে না। কিন্তু রায়পুর (উত্তর) সীটটিতে সোলাংকি দাঁড়ালে ওরা ডামি ক্যান্ডিডেট দেবে। ততদিন গোটাচারেক আই পি সির কেসগুলো ঠান্ডা বস্তায় রাখা হবে।
মার দিয়া কেল্লা! এম এল এ হয়ে গেলে তখন বাকি কেসগুলোকেও দেখে নেয়া যাবে। তবে ওরা রবীন্দ্র পাণ্ডে মার্ডার কেসে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ রবীন্দ্র পাণ্ডের শ্বশুর আবার ত্রিশূল পার্টির ফান্ড ম্যানেজার।
শালা! না করুক গে'! উসকি মা কী--!
বিক্রম বিক্রমাদিত্য হোটেলে রাতের ডিনার সারতে সারতে চেলা-চামুণ্ডাদের অভয়দান করে বাড়ি যেতে বল্লেন। রয়ে গেল শুধু ঘনিষ্ঠতম দু'জন। রাকেশ ডোডেজা আর রমেশ বহল। নগর অধ্যক্ষ আর জেলা অধ্যক্ষ।
রাত্তির প্রায় বারোটা বাজে। টেবিলের ওপর খালি বোতল জমছে একের পর এক।
হঠাৎ ডোডেজার গলায় হুংকার শোনা গেল--আর বিরিয়ানি নেই কেন? বেয়ারাগুলো কি ভ্যারেণ্ডা ভাজছে?
রমেশ বহলের আওয়াজ উদারার উপরে যায় না।
বলল—মালিক কো বুলাও।
মালিক কাঁপতে কাঁপতে এসে হাত জোড় করে বললো—আজ আমার মিস্ত্রি একটু আগে বাড়ি চলে গেছে। কাল ভাল বিরিয়ানি খাইয়ে দেব। ভোলেবাবা কী কসম।
—কেন? তোর মিস্ত্রিকে ছুটি দিলি কেন? আমাদের যখন খাওয়া হয় নি তুই ওকে বাড়ি যেতে দিলি কেন? কাল সকালে তোর দোকান তুলে কুমারী নদীতে ফেলে দিলে খুশি হবি? কাল থেকে যেন তোর ওই মিস্ত্রি বিক্রমাদিত্য হোটেলে না আসে।
—সরকার! আপকী ইচ্ছা মেরে সর-আঁখো পর। লেকিন উসকে বেটা বিমার হ্যায়।
হঠাৎ বিক্রম হেসে ফেলেন। চ্যালাদের বলেন--হয়েছে, হয়েছে। এবারের মত ছেড়ে দে। ঠিকই তো বলছে, ছেলের অসুখ হলে কি আর করা যাবে। চল, সবাই উঠি। কাল হাইকোর্টের জজের বাড়িতে লোক পাঠাতে হবে। শুয়ার কে অউলাদ বড্ডো বেশি চাইছে। তবে চিড়িয়া একবার দানা খেয়েছে। কাজ করবে।
হোটেলের শাটার বন্ধ হওয়া শুরু হয়। এবার চাকরবাকররা খেতে বসবে।
টেবিলগুলো প্রায় খালি, শুধু একটি টেবিলে একজন আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোক ধীরে ধীরে খেয়ে চলেছেন। মালিক জানে ওই ভদ্রলোক কাছেই থাকেন। গত দু'বছর ধরে নিয়মিত এখানেই একটু রাতের দিকে আসেন।
বেয়ারা গিয়ে বলে--কাকা, একটু তাড়াতাড়ি করুন।
বিক্রম আজ দিলদরিয়া। বলেন—অ্যাই, বুড়ো মানুষকে তাড়া দিস না তো, গলায় লাগবে। কাকা, আপনি কোথায় থাকেন?
আরে, ও তো আমার বাড়ির কাছে চলুন, আপনাকে আমি পৌঁছে দেব।
সাদা হাঁসের মত ইনোভা গাড়িটাতে উঠতে ভদ্রলোকটি খুব ইতস্তত: করছিলেন। সেই দেখে ডোডেজা আর রমেশ বহল হেসে গড়িয়ে পড়ে।
--"আরে আংকল! ইস গাড়ি মেঁ হমারে বসকে সাথ সফর করনে কে লিয়ে রায়পুর কে লোগ ক্যা নহীঁ করনে কো তৈয়ার হ্যায়! অউর এক আপ হ্যায় যো--''
ওদের ঠেলাঠেলির চোটে বিব্রত মারাঠি "আপলা মানুস'' হাতের কালো হ্যান্ডব্যাগটি নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসতে গেলেন তো বিক্রম মানবেনই না!
—আপ হমারে আংকল হ্যাঁয়। আপ কহাঁ ওহাঁ ছোটেলোগো কে সাথ----। আপ তো ইহাঁ মেরে বাজু মেঁ--।
কথাগুলো একটু জড়িয়ে আসছে। ড্রিংকের মাত্রাটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে।
—বস্, আমাদের গাড়িতে আজ আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি? রমেশ অনুরোধ করে।
—আরে না না, তোরা বাড়ি যা! চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক ঠাক চল রহা হ্যায়। ড্রাইভার আছে। আরে,সবচেয়ে বড় কথা আজ সঙ্গে আংকল আছে।
বিক্রম হাসিতে ফেটে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে দুই শাগরেদ মাতাল অশ্লীল হাসি হেসে ওঠে।
—ক্যা বাত বস্, আজ তো আংকল সাথ হ্যায়! হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা!
গাড়ি তাঁতিয়াপাড়ার মোড় ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলে উনি বলেন—আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। একটু গলির মধ্যে, গাড়ি ঢুকবে না। আমি ওটুকু হেঁটে যাবো। রাত্তিরের হাওয়াটা ভাল লাগছে, ধন্যবাদ! জয় শ্রীরাম!
—আরে আংকল, আমারও কেমন গুমোট লাগছে। এখান থেকে আমারও বাড়ি খুব কাছে। আমি বরং আপনার সঙ্গে একটু হাঁটি। অ্যাই, গাড়ি নিয়ে যা! মাজীকে বলবি দশ মিনিটের মধ্যে পায়দল চলে পৌঁছচ্চি। যেন কোন চিন্তা না করে।
--লেকিন বস্,--
—চোপ বে! কোঈ লেকিন-উকিন নেহি। জ্যায়সা বোল রহা হুঁ, অ্যায়সা হী কর্ ভূতনীকে!
এবার দুজনে হাঁটতে থাকেন। একজন বছর চল্লিশের অমিতাচারী ক্ষমতাশালী মাতাল, আর অন্যজন সারাজীবন সম্ভবত: কলম পিষে ক্ষয়ে যাওয়া প্রৌঢ় এক মারাঠী।
কিছু কথা বলতে হবে তাই উনি বলেন—আপনি আজকে খুব খুশি, না!
মাতাল চমকে ওঠেন!—আপনি কি করে জানলেন?
—আপনার চোখ মুখ বলছে। তাছাড়া আপনাদের কথাবার্তা খানিক কানে আসছিল। আপনি এবার ভোটে দাঁড়াবেন।
—আংকল! আপনার ভোট পাবো তো!
—নিশ্চিন্ত থাকুন!
—ব্যস্,আপনি আমার সঙ্গে আছেন, আমি নিশ্চয়ই জিতবো।
—সে আর বলতে!
—কিন্তু, কি জানেন, কেউ কেউ অন্যের ভালো দেখতে পারে না। আমাকে হিংসে করে।
—কে? আপনার আবার দুশমন কে?
—এই দেখুন না, অ্যাডভোকেট তিওয়ারির শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
—কিন্তু তিওয়ারি তো পাঁচ বছর আগে খুন হয়ে যায়।
—হ্যাঁ, আংকল! তবু গত নির্বাচনে ত্রিশূল পার্টি জেতার পর ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মুখ্যমন্ত্রীকে ধরাকরা করে। আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়। আমি নাকি ওকে খুন করিয়েছি। আর ওদের পেয়ারের এক ব্রাহ্মণ এস পি। সে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে খোলা গাড়িতে চড়িয়ে জয়স্তম্ভ চৌক অব্দি লাথ-মুক্কা-বেল্ট দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যায়। সাত মাস জামানত হয় নি। শেষে হাইকোর্টে বেইল পাই। সত্যি কথা বলবো? হারামজাদা জজ, রণ্ডীর বাচ্চা, আমার থেকে দশ পেটি নিয়েছে।
—আপনি তো ওকে মার্ডার করেন নি। তবে?
—আরে, সেই সময় আমি ৫৫ কিলোমিটার দূরে মহাসমুন্দে মুম্বাই থেকে আসা এক বি গ্রেড নায়িকাকে দিয়ে আমার নতুন বার-কাম-হোটেলের উদ্ঘাটন করাচ্ছিলাম। তাতে শহরের প্রেস হাজির ছিল। তাই তো বেইল পেলাম।
—তাহলে আপনাকে জড়ালো কি করে?
—আর বলবেন না! ঐ তিওয়ারি উকিল, আমার ছোটবেলার বন্ধু, একদম লংগোটিয়া। কিন্তু সেদিন নগর অধ্যক্ষ ডোডেজার ফোন এল। বস্, চারদিন আগে দুটো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে আমাদের ঘুংঘরু বারে ড্রিংক করে পয়সা না দিয়ে যাচ্ছিল। ম্যানেজার রাস্তা আটকালে ওকে গাল দেয়। তখন আমাদের স্টাফ ওদের রাম ধুনাই দেয়। তারপর ওরা হোস্টেল থেকে কিছু ছেলে নিয়ে আসে। হকিস্টিক দিয়ে আমাদের ম্যানেজারকে বেদম মারে। ও এখন হাসপাতালে । ওরা প্রচুর ভাঙচুর করে।
আজ ওদের একটাকে আমাদের ছেলেরা সুভাষ কলোনীতে দেখতে পেয়ে তাড়া করে। কিন্তু ও দৌড়ে আপনার বন্ধু তিওয়ারি উকিলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওনাকে বোঝাই যে ছেলেটাকে আমাদের হাতে তুলে দিন। বসের নির্দেশ। তা উনি বল্লেন—ও আমার আশ্রিত। আজকে আমার জন্মদিন। আমি আজ আশ্রিতকে তার দুশমনের হাতে তুলে দেব না। ও পরে নিজে থেকে বেরিয়ে গেলে তখন তোমরা ওকে কি করবে সে আমি দেখতে যাবো না। কিন্তু আমার বাড়ির ভেতর কেউ ঢুকবে না।
কি করা যায় বস্?
—আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলিয়ে দে।
—তাই তো বল্লাম, তা ওর সেই এককথা। কারো সঙ্গে কথাটথা বলবে না। কিন্তু ওকে ছেড়ে দেবে না।
—এক কাজ কর। তোরা জনা চল্লিশ যা'। দু'ঘন্টা টাইম। সদর থানা থেকে কেউ আসবে না। সেটা আমি দেখছি। দরজা ভেঙে ওর বাড়িতে ঢোক। তলোয়ার দিয়ে দুটোকেই কেটে ফ্যাল্।
—বস্! তিওয়ারি উকিল যে আপনার বন্ধু।
—কোন শালা বলে? যে আমার ইজ্জত নিয়ে খেলে, আমার কথার কোন ভাও দেয় না--সে কিসের বন্ধু? কেটে ফেল্।
—যাকগে, আংকল! আপনি আমার কাকা। এসব কথা আবার কাউকে বলতে যাবেন না। ওই কেসটা খতম না হওয়া অব্দি, মানে হাইকোর্ট আমাকে নির্দোষ ঘোষণা না করা অব্দি আমার ইলেকশনে দাঁড়ানো বেশ চাপ। সেসব হয়ে যাবে। শংকর ভগবান তাঁর সেবককে রক্ষা করবেন।
এবার ফাঁকা মাঠ। কোণায় একটা ডাস্টবিন। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। ঘরদোরগুলো একটু এগিয়ে গিয়ে।
—আচ্ছা! এবার আমি চলি। আপনারো তো আর একটু।
—কিন্তু আপনার বাড়ি কই? এখানে তো ফাঁকা মাঠ।
—কথা বলতে বলতে পেছনে ছেড়ে এসেছি। ফিরতে হবে।
এবার ভদ্রলোক একটু পেছন ফিরে হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলতে থাকেন।
—কি হল আংকল?
—মোবাইলটা বের করছি। মনে হয় গিন্নি চিন্তা করছেন।
—যান্, যান্ আংকল। হা:-হা:-হা:! আপনি আমার সঙ্গে রয়েছেন, বিক্রম শোলাংকির সঙ্গে। কোঈ ভি আপকা বাল বাঁকা নহী কর সকতা।
কিন্তু মোবাইলের শেপটা এমন কেন? আংকল, এটা কোন কোম্পানীর?
প্রশ্নটা শোলাংকির গলাতেই রয়ে গেল। সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন থেকে প্রায় বুকে ঠেকিয়ে দুই বার ট্রিগার টেপা হয়ে গেছে।
বিক্রম কিছু বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। শরীরকে আড়াল করেছে একটি গুলমোহরের গাছ। রাস্তায় কেউ নেই। খানিকক্ষণ পরে বিক্রমের সাফারি স্যুটের পকেট থেকে মোবাইলের রিং বেজে উঠল। তারপর বাজতেই থাকল। একটু পরে থামতে না থামতেই আরো একটি ফোন। দূর থেকে আসা একটি প্রাইভেট গাড়ি দ্রুতবেগে খালি জায়গাটা পেরিয়ে গেল।
মাত্র চারশ' মিটার দূরে বিক্রমের প্রাসাদোপম বাড়িতে পোষা জার্মান শেফার্ডটি কেন যেন আকাশের দিকে মুখ তুলে বিচ্ছিরি গুঙিয়ে উঠল। গাড়ির ড্রাইভার তাকে ধমকে উঠলো।
—আবে! চুপ হো যা! সাহাব আভী আনে ওয়ালে।
সাতসকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আপৎকালীন বৈঠক। কনফারেন্স টেবিলকে ঘিরে অতিরিক্ত ডিজি, আই জি, ডিআইজি, জেলা এস পি, সিটি এস পি, ডি আইজি ইন্টেলিজেন্স, ডি এস পি (ক্রাইম) সবাই বসে উশখুশ করছেন। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশে বারান্দায় চেয়ার লাগিয়ে কয়েকজন ডি এস পি; কোতায়ালি থানার টি আই, দক্ষিণ রায়পুর জোনের অতিরিক্ত এস পি সবাই আদেশের প্রতীক্ষায়।
কনফারেন্স রুমে টেবিলের মাথায় ডিজিপি'র চেয়ারটাই শুধু খালি। উনি আসলেই মীটিং শুরু হবে। উনি এখন মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে। সবাই জানে মুখ্যমন্ত্রী এখন ওনার ক্লাস নিচ্ছেন।
সবাই রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন আর নীচু গলায় ফিস্ফিস্ করছেন।
সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল—কার কার ওপরে যে --।
কিস্ কিস্ পর বাজ গিরেগা? সারে পুলিশ ব্যবস্থা কী নাকামিয়াবি কা ঠিকরা কিসকে সর পর ফোড়া যায়েগা!
পুলিশি ব্যবস্থার ব্যর্থতা বটেই!
মাঝরাতে শংকরসেনার আইকন সোলাংকি মার্ডার হলেন। তারপর ঘন্টাদুইয়ের মধ্যে মোদহাপাড়ার মুসলিম মহল্লায় হামলা হয়। ছটা বাড়িতে আগুন লাগে, তিনজন মারা যায়। এদের মধ্যে সাট্টাবাজ ইয়াসিন পুরনো হিস্ট্রিশীটার। শংকরসেনারও একজন মারা গেছে। আম্বেদকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অন্তত: চল্লিশজন আহত, যাদের মধ্যে বারোজনের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের মধ্যে একজন আবার সোলাংকিজী'র ড্রাইভার। ওকে হাসপাতালে কড়া পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে।
শংকরসেনা গোটা রাজ্যব্যাপী বন্ধ ডেকেছে, আবার পুলিশ প্রশাসন রায়পুর শহরে চব্বিশঘন্টার কার্ফিউ ঘোষণা করেছে। সকাল থেকে বিভিন্ন মোহল্লায় পুলিশভ্যান মাইক থেকে কার্ফিউয়ের ঘোষণা করে চলেছে।
সেই যে সেবার ইন্দিরাজী দেহরক্ষীদের হাতে মারা গেলেন তখন রায়পুর শহর প্রথমবার কারফিউয়ের নাম শুনেছিল। ফলটা হয়েছিল মারাত্মক।
ছেলেমেয়ে-বুড়োবুড়ি সবাই দলে দলে ঘর ছেড়ে রাস্তায় ভিড় জমিয়েছিল-—কারফিউ কি জিনিস, সেটা কেমন তা’ দেখতে।
পুলিশ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হার মেনে কারফিউ তুলে একশ' চুয়াল্লিশ ধারা জারি করল, তখন কিছু কাজ হল।
দুই দশকে অনেক কিছু পালটে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম জানে কারফিউ কী, একশ' চুয়াল্লিশ কী।
কিন্তু সাতসকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই একী! খবরের কাগজগুলো আধসেদ্ধ খবর দিয়েছে।
এতগুলো খুন? কে কাকে, কেন! বন্ধ না কারফিউ, কোনটা মানবো?
এই অবস্থায় যা হয়, গুজবের বাজার গরম। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে মুসলিম আতংকবাদীদের হাতে শঙ্করসেনা প্রমুখ বিক্রম সোলাংকী মারা গেছেন। মুম্বাইতে ঠাকরে-আড়বানী এরা অনেকদিন ধরেই টারগেট। কিন্তু ওঁরা তো জেড সিকিউরিটি পেয়েছেন। কিন্তু ছত্তিশগড়ী নেতাটির কোন সরকারী সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। তাই তিনি সফট টারগেট ছিলেন।
—আসলে বেইমানী করেছে ওনার ড্রাইভার। এতদিনের সব সতর্কতা ভুলে ওই রাত্তিরে বাড়ির একটু আগে একা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। ওর দেয়া খবরেই তো আততায়ীরা এসে রাস্তায় অ্যামবুশ করেছে।
বিশাল ওভ্যাল টেবিলের মাথার দিকের খালি চেয়ারের হেলান দেয়ার জায়গাটায় একটি শ্বেতশুভ্র তোয়ালে রাখা, নার্সিংহোমে সদ্যোজাত শিশুদের নার্সরা যে-ধরনের তোয়ালেতে মুড়ে আত্মীয়স্বজনদের দেখাতে আনে।
সবাই উস্খুস্ করছিল আর ঘড়ি দেখছিল। এমন সময় একজন ইন্সপেক্টর দ্রুতপায়ে এসে কয়েকটি ফোল্ডার ঐ চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর রেখে হুড়মুড়িয়ে কেটে গেল। তক্ষুণি একজন সাদা পোষাকের পিয়ন এসে ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে রেখে এল। সবাই নড়েচড়ে বসল,—আয়েগা, আনেওয়ালা! আয়েগা।
এবার একজন কাঁচাপাকা চুলের চেক বুশশার্ট পরা ব্যক্তি মাপা পায়ে এসে সংযুক্ত পরিবারের কর্তার আসনে বসলেন। তাঁর পেছন পেছন আসা টাকমাথা বেঁটে ভদ্রপুরুষের জন্যে তাঁর পাশেই একটি চেয়ার রাখা হল।
কোন ভণিতা না করে ছত্তিশগড় রাজ্যের ডিজিপি শ্রী ভুবনমোহন সাক্সেনা বলা শুরু করলেন।
—সি এম স্যার রাজ্য পুলিশের পার্ফর্ম্যান্স, ডেডিকেশন, সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি সব নিয়ে অত্যন্ত নারাজ। উনি বল্লেন—আপনার পুলিশ বিভাগ নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বলার মত কোন তথ্য আমার হাতে নেই। কাজেই আমি প্রটেস্ট করতে পারিনি।
কাল শংকরসেনার মুখিয়া বিক্রম সোলাংকি মার্ডার হয়েছে, মাঝরাতে। তার একঘন্টার মধ্যেই রায়পুরের মুসলিম বসতি মোদহাপাড়ায় হামলা হয়। তিনজন মারা যায়। তাদের মধ্যে একজন ইলিয়াস হিস্ট্রি শীটর। শংকরসেনার এক কর্মী রায়কোয়াড়ও মারা গেছে।
আহত জনাচল্লিশ, তদের মধ্যে একজন সোলাংকির ড্রাইভার।
সকাল থেকে কোন নতুন ঘটনা ঘটেনি। কারণ, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আজ সন্ধে অব্দি কারফিউ জারি করে রেখেছে।
বাকিটা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-চীফ পার্থসারথি, ইন ডিটেইলস্, বলবেন।
সবার চোখ এখন মধ্যপ্রদেশ ক্যাডার থেকে সদ্য ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বে আসা টাকমাথা ঈষৎ পৃথুল ভদ্রলোকটির দিকে।
মিনারেল ওয়াটারের বোতলে একটু চুমুক দিয়ে গলা খাঁকরে উনি বলতে লাগলেন।
—কালকে রামনবমীর সফল শক্তি প্রদর্শনের পর বিক্রম সোলাংকি একটু ওভার কনফিডেন্ট ছিলেন। ফলে দুই সাগরেদের সঙ্গে বিক্রমাদিত্য হোটেলে নিত্যনৈমিত্তিক ডিনার পর্ব সারার পর উনি সঙ্গীদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ড্রাইভারের সঙ্গে বাড়ির জন্যে রওয়ানা দেন। আবার বাড়ি থেকে কয়েকশ' মিটার আগে উনি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাবেন বলে জিদ করেন। ড্রাইভারকে হাঁকিয়ে দেন। আধঘন্টা কেটে যাওয়ার পরও উনি বাড়ি না ফিরলে শ্রীমতী সোলাংকি চিন্তিত হয়ে রাকেশ ডোডেজাকে ফোন করেন।
এবার আই জি (রায়পুর) বলেন—সরি টু ইন্টার্ভেন। গাড়িতে ড্রাইভার ছিল না, আর উনি একা নেমে ছিলেন--এটা কি কারেক্ট রিপোর্ট?
—বলছি, সবই গুছিয়ে বলছি।
ইতিমধ্যে ডোডেজা এবং বহল, শংকরসেনার নগর ও জেলা অধ্যক্ষ, সোলাংকিজির মোবাইলে ফোন করেছিল। কিন্তু রিং বেজে গেছে। কেউ ফোন তোলে নি।
তাই তারা শ্রীমতী সোলাংকিকে শুধু এইটুকু বলে —ভাবীজি, হম লোগ দশ মিনট মেঁ পহুঁচ রহে হ্যাঁয়।
পৌঁছে গিয়ে ওরা সোজা ড্রাইভারকে ধরে।
—বস্ কে খালিরাস্তায় একা নামিয়ে এলি কেন? মাঝরাত্তিরে?
—উনি খুব জিদ্ করছিলেন, আর একা নয় ওই আংকলও ছিলেন।
—কোন আংকল? ওই হাড়হাভাতে বুড়ো? আরে ও তো দুধভাত। হোটেলে নিয়মিত খেতে আসে, ব্যস্। তুই ওকে কতটুকু জানিস্? ওর ভরসায় বস্কে ছেড়ে বাড়ি এলি?
ড্রাইভারকে চাকরিতে লাগিয়েছিল রমেশ বহল নিজে, ওদেরই পাড়ার ছেলে।
ও হিমশীতল গলায় বলে—গাড়িতে ওঠ, স্টার্ট কর। ব্যাক করে যেখানে বসকে নামিয়েছিলি সেইদিকে চল্। আর রাস্তার দু'দিকে নজর রাখ। আজ বস্ একটু বেশিমাত্রায় লগী মেঁ থেঁ।
ওরা তিনজন রওয়ানা দিল ফিরতি পথে। না, কোথাও বসের চিহ্ন নেই। ওদের মনটা কুডাক ডাকতে লাগলো। এভাবে প্রায় বিক্রমাদিত্য হোটেলের কাছে পৌঁছে গিয়ে রমেশ বহল বিরক্তিতে মাথা নাড়লো।
বল্লো—উঁহু, এভাবে হবে না, গাড়ি আবার ব্যাক কর। ঠিক কোনখানটায় বসকে নামিয়েছিলি সেখানে আমাদের নামিয়ে দে'। খোঁজাটা আবার ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে।
রাত দেড়টার পর রাস্তা ফাঁকা। শুনশান রোড। জনমানবের দেখা নেই। কিন্তু বাঁকের মুখে ঝাঁকড়াচুলো গাছটার নীচে কেউ শুয়ে আছে না?
রমেশ দৌড়তে থাকে। শুয়ে থাকা শরীরটার কাছে গিয়ে ডাকে?
—বস্, উঠো ব্যস্, হমলোগ আ গয়ে। আরে এ ক্যা হাল বনাকে রাকখে আপনে?
না:, বসের মদ্যপানের মাত্রা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে।
তারপরই ও নিজের হাতের দিকে আর বসের শরীরে দিকে তাকায়। আর আতংকে ভরা ফাঁকা আওয়াজে চেঁচায়।
—আরে ডোডেজাজী! জলদি আও। ছাতি মেঁ গোলী লগি হ্যাঁয়।
এবার ডোডেজাও দেখতে পায়। ধুলোর মধ্যে পড়ে থাকা বসের বুকের ওপর দুটো ছ্যাঁদা। রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করেছে। কিন্তু তার আগে অনেকখানি রক্ত চুঁইয়ে পড়ে চারপাশের ধুলো ভিজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রক্তের গন্ধে ছুটে আসছে গাছ ও আশপাশের উইঢিবি থেকে বেরিয়ে আসা লাল ও ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল।
ওরা তৎক্ষণাৎ বডি গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ‘মেকাহারা' হাসপাতাল রিপোর্টে লেখে ‘brought dead’.
অতিরিক্ত ডি আই জি মুখ খুল্লেন—পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কি বলছে? আর ব্যালিস্টিক রিপোর্ট?
—দেখুন, ফাইনাল পি এম রিপোর্ট বেলা এগারোটা নাগাদ পাওয়া যাবে। তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের। ক্ষতের চারপাশে পোড়া দাগ। একটি গুলি বাঁদিকের ফুসফুসকে ফুটো করে পেছনের গাছে বসেছে। আর একটি একটু ওপরে তেরচা হয়ে কলার বোনের কাছে আটকে আছে।
ব্যালিস্টিক রিপোর্ট? আগ্নেয়াস্ত্রটি এখনো পাওয়া যায় নি। তবে মনে হয় স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন। এগুলো কয়দশক আগে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার হত। আজকাল হয় না।
গোটা হল হঠাৎ নিস্তব্ধ। এই হত্যায় পুলিশি রিভলবার? তবে কি পুলিশবাহিনীর লোক ইনভলড্?
এবার ডি জি পি বল্লেন—মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে পারিনি যে আজকাল আমাদের ফোর্স ওইসব সেকেলে হাতিয়ার ব্যবহার করে না। ওগুলো অস্ত্রের চোরাবাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
আই জি বল্লেন—ওর ড্রাইভার কেন হাসপাতালে?
ডিজিপি বিরক্ত মুখে তাকালেন।
—আপনি কাল রাত্তিরে কোথায় ছিলেন?
—সারাদিন রায়পুর শহরেই ছিলাম। শংকরসেনার শৌর্য প্রদর্শন, থুড়ি মিছিল, ভাল ভাবে মিটে গেলে রাত্তিরে ভিলাইয়ে বোনের বাড়ি গেছলাম, নেহরুনগরে। আপনার জন্যে হেড কোয়ার্টার ছাড়ার পোস্ট ফ্যাক্টো অনুমতি চেয়ে ফ্যাক্স করেছিলাম।
—তা' এতবড় ঘটনার পর মিটিংয়ে আসার আগে নিজের এস পি'র থেকে ব্রিফিং না নিয়েই এসেছেন?
আই জি'র অপ্রস্তুত ভাব দেখে এস পি হড়বড়িয়ে বল্লেন—স্যার, উনি এসে আমাকে কল করেছিলেন, কিন্তু আমার ফোন এনগেজড্ ছিল। আমি বলছি—হাসপাতাল থেকে বডি সেনা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নগর অধ্যক্ষ ডোডেজা সৈনিকদের নির্দেশ দিয়ে মুসলমান পাড়ায় হামলা করায়। আর জেলা অধ্যক্ষ রমেশ বহল ড্রাইভারকে একটি ছোট কামরায় দরজা বন্ধ করে বেধড়ক ঠ্যাঙায়। ওর সন্দেহ এটা সুপারি নেয়া কিলারদের কাজ। আর তাদের সঙ্গে যোগসাজশেই ড্রাইভার ওই নির্জন জায়গাটিতে গাড়ি থামিয়ে সোলাংকিকে একলা নামিয়ে দেয়।
ও এখন হাসপাতালে। কলার বোন ভেঙেছে, আঙুলগুলো থ্যাঁতলানো। পেটে ও মুখে ভাল চোট পেয়েছে। প্রথমে বেল্ট, তারপর হকিস্টিক দিয়ে মারা হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি, তবে ডাক্তারের ওপিনিয়ন হল—বেঁচে যাবে।
অ্যাডিশনাল এস পি বলেন—পুলিশ পাহারা লাগানো হয়েছে। ও আমাদের ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু!
—ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু! আপ কল রাতকো কহাঁ থেঁ, জনাব?
ডিজিপি'র গলায় তিক্ত ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে।
—আমি স্যার রাত্তিরে ভাটাপাড়া গিয়েছিলাম। মানে সব কিছু তো ঠিকঠাকই ছিল। কে জানতো যে এমনি একটা---
—হ্যাঁ, ভাটাপাড়া যেতেই পারেন। নিশ্চয়ই ভাইঝি বা বোনপো'র অন্নপ্রাশন, নয় পৈতে, নয় বিয়ের এনগেজমেন্ট! কি, ঠিক বলছি না?
না:, সি এম কিছু ভুল বলেন নি। আপনাদের গোটা ডিপার্টমেন্ট নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে!
সবাই চুপ। কিন্তু সবার মনে একই চিন্তা। ডিজিপি সায়েবের ‘আপনাদের' ডিপার্টমেন্ট না বলে "আমাদের'' ডিপার্টমেন্ট বলা উচিত ছিল।
উনি নিজেই কাল শহরে ছিলেন না। রায়গড়ে কবি সম্মেলন শুনতে গিয়েছিলেন। সেই নিয়ে যে সি এম খুব খুশি ন'ন, এটা আমলারা সবাই জেনে গেছে।
—সেই মারাঠি ভদ্রলোককে ইন্টারোগেট করা হয়েছে কি?
প্রশ্ন করেছেন মাওবাদী বিরোধী অভিযানের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিজি রাজশেখর।
টাকমাথা ভদ্রলোক উত্তর দিলেন—হ্যাঁ, করা হয়েছে বৈকি! টি আই, (সিভিল লাইনস্) এবং এস পি (রায়পুর) শুরুতে, তারপরে আমি।
—আমি জানতে চাইছি উনি ওনার বাড়ির কাছে তাঁতিয়াপাড়ার মোড়ে না নেমে আরো এগিয়ে ওই শুনসান মাঠের পাশে নামলেন কেন?
—এই একই প্রশ্ন আমিও করেছি। উনি বললেন যে সোলাংকিজী অনেক কথা বলছিলেন। যেমন উনি আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়াতে চান। ওনার জেতার সম্ভাবনা কি রকম, কি ধরনের ভোট পাবেন, এইসব। এর মাঝে বাধা দেয়া অভদ্রতা হত, তাই একটু এগিয়ে নামতে হল, এই মাত্র।
—ওনার ঘর সার্চ করা হয়েছিল?
আই জি'র প্রশ্ন শুনে ডিজিপি ভুবনমোহন মুখ বাঁকালেন। কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই তড়িঘড়ি জবাব এলো এস পি রায়পুরের কাছ থেকে।
—আমি নিজে গিয়েছিলাম স্যার। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায় নি।
একটি পুরনো বাড়ির দোতলায় টালির ছাওয়া ঘর। দুটো জানলা, একটা দরজা। সামনে একফালি ব্যালকনি। ঘরের মধ্যে নেয়ারের খাট। জানলার পাশের দেয়ালে পেরেক থেকে ঝুলছে একটি আয়না। একটি পুরনো আলমারি। তাতে জামা কাপড়, কিছু কাগজপত্র, ব্যাংক আর পোস্টাপিসের দুটো পাসবই। উল্টো দেয়ালে একটি টেবিলে কিছু বইপত্তর, লেখার সরঞ্জাম। পাশে শস্তা কাঠের র্যাকে কিছু বই। পাটিগণিত, অ্যালজেব্রা, নেসফিল্ডের গ্রামার। আবার শেকসপীয়র, প্যালগ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারি। পু ল দেশপাণ্ডের নাটক। কিছু মারাঠি, ইংরেজি পত্রিকা। সার্চ করা হল বিছানার তলা, বাথরুম, তোষকের ভাঁজ। টেবিলের সংলগ্ন ড্রয়ারে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, কিছু পেনের রিফিল, একটা এক্সার্সাইজ খাতা, দুটো বড় সাইজের ম্যাগনেট ও একটা বড় আতসকাঁচ। পাওয়ার বেড়েছে, ছোট অক্ষর পড়তে লাগে।
না:, সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায় নি।
কাজের মধ্যে পাড়ার বাচ্চাদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে ইংরেজি ও অংক পড়ান। রাত্তিরে একটু দূরে বিক্রমাদিত্য হোটেলে খেতে যান। তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেন।
একমাত্র ছেলেটি একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। স্ত্রী তারপর থেকেই ডিপ্রেসনের শিকার। পান্ধারপুরে বাপের বাড়িতে থাকার সময় ক্যান্সার হয়। দু’বছর আগে দেহ রেখেছেন।
না:, সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না।
মিটিং শেষ হল তিনজনের একটি কমিটি বানিয়ে যার চেয়ারম্যান অবশ্যই রাজ্যের ডি জি শ্রী ভুবনমোহন। সাতদিনের মধ্যে কমিটি গোপন রিপোর্ট পেশ করবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সামনে নির্বাচন। এর বেশি সময় কমিটিকে দেয়া যাবেনা—ওনার স্পষ্ট আদেশ।
সাতদিন পরে রিপোর্ট হাতে নিয়ে বৈঠকের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
—এটা কি? তদন্ত রিপোর্ট না প্রোব্যাবিলিটির অংক? আমি জানতে চাইছিলাম খুনটি কে করেছে? আপনাদের লিস্টি হিসেবে অন্তত: চারজন সম্ভাব্য খুনী! ইয়ার্কি পেয়েছেন! না পারলে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিন।
(এটা ডিজিকে)।
—আর মি: পার্থসারথি, আপনাকে এম পি'র পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে লিয়েন-এ এনে কি লাভ হল?
খানিকক্ষণ পরে গুস্সা কমলে সি এম ব্লাডপ্রেসারের বড়ি ও দুগ্লাস জল খেয়ে গুম হয়ে দু' মিনিট বসে থাকলেন। জোরে জোরে নি:শ্বাস নিলেন। তারপর বল্লেন—ও কে, এই অর্থহীন রিপোর্টের থেকে কোন গূঢ় অর্থ বেরোয় কি না দেখি! ভুবনমোহনজী, আমাকে সাহায্য করুন।
—দেখুন, স্যার! রিপোর্ট বলছে প্রায় বুকে ঠেকিয়ে করা পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের দুটো গুলিতে ভিকটিমের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। হাতিয়ার পাওয়া যায় নি।
আমাদের দেখতে হবে কারা ওই সময় সোলাংকিকে গুলি করার অবস্থায় ছিল। আর তাদের মোটিভ কি হতে পারে? এবার লিস্টটা দেখুন।
——বিকাশ রঞ্জনেকর; ৭০ বছরের মারাঠি ভদ্রলোক। সম্ভবত: উনিই সোলাংকিকে শেষবার জীবিত অবস্থায় দেখেন। উনি সোলাংকিকে গুলি করবার জন্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন।
কিন্তু কেন? কোন স্পষ্ট মোটিভ নেই। কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। আর মাত্র সেই রাতেই উনি সোলাংকির কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। তাও ঘটনাচক্রে।
——সোলাংকির ড্রাইভার। ওর কথায় মাতাল সোলাংকিকে ও রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সোজা বাড়ি গেল কেন? কেন ডোডেজা বা বহলকে মোবাইলে জানালো না? কে বলতে পারে ও একটু পরেই ফিরে এসে নিজে সোলাংকিকে মেরেছে কি না! অথবা কোন উগ্র মুসলিম গ্রুপের সুপারি দেয়া লোক ওর যোগসাজসে কাম ফতে করেছে! আমাদের মতে ও হল একনম্বর সন্দেহভাজন লোক।
——রমেশ বহল। শংকরসেনার জেলা অধ্যক্ষ। অত্যন্ত উচাকাঙ্ক্ষী। নুমেরো উনো হতে চায়। যদি সোলাংকি আগামী নির্বাচনে টেকনিক্যাল কারণে দাঁড়াতে না পারে তাহলে শংকরসেনার রায়পুর কেন্দ্রে ওর প্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত।
আমাদের কাছে খবর আছে যে গতসপ্তাহে হাইকোর্টের জজকে রবীন্দ্রপাণ্ডে মার্ডার কেসে সোলাংকিকে পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিলে জজের কাম তামাম হবে বলে যেসব উড়ো ধমকি এসেছে তার পেছনে সম্ভবত: এই রমেশ বহল। আর সোলংকির ড্রাইভার হল রমেশের পাড়ার ছেলে।
——ডোডেজা। শংকরসেনার প্রভাবশালী রায়পুর ইউনিটের অধ্যক্ষ। পুরো নেটওয়ার্ক ওর নিয়ন্ত্রণে। তড়িঘড়ি দাংগা লাগানোর প্ল্যানটা ওর। হয়তো বহলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাণ্ডটি করিয়েছে। মোটিভ? সেই ক্ষমতার লোভ।
——শেষ সম্ভাবনা--কোন অজ্ঞাত উগ্রবাদী নেটওয়ার্ক, ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চাইছে।
বিকাশ রঞ্জনেকরের দোতলার চিলেকোঠায় আবার টিউশন শুরু হয়েছে। শুরুতে পাড়ার লোকে খুব অবাক হয়েছিল। এই নিরীহ লোকটিকে এরা পাঁচ বছর ধরে চেনে। শুরুতে পাড়ার মমতা ভোজনালয়ে খেতে যেত। গত দু'বছর ধরে একটু দূরের বিক্রমাদিত্য হোটেলে খেতে যায়, তাও রাত্তিরে। দুপুরে ঘরেই কিছু ভাতে ভাত ফুটিয়ে আচার দিয়ে খেয়ে নেয়, বোধহয়। পোস্টাপিসে মাঝে মধ্যে যায়। কখনও সখনও মহারাষ্ট্র ব্যাংকে।
কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই, এমন লোককে পুলিশ কেন নিয়ে গেল?
পরে বুঝলো সামান্য জিগ্যেসবাদ-খানাতল্লাসী। ওনার সঙ্গেই সোলাংকিজী রাত্তিরে পায়চারি করছিলেন যে! যাহোক, কলিযুগে কখনও সখনও সত্যের জয় হয়। এবার হয়েছে, ওনাকে ছেড়ে দিয়েছে।
আজ রাত্তিরে বিকাশের ঘুম আসছে না। বিক্রমাদিত্য হোটেলে আজ আবার খাবার সময় পাশের টেবিলে প্রয়াত সোলাংকিজীর দুই সাগরেদ। সেই ডোডেজা আর বহল। সঙ্গে কিছু নতুন চেলা-চামুণ্ডা। টুকরো-টাকরা কথাবার্তা যা কানে আসছে তাথেকে বুঝলেন যে সন্তানহীন সোলাংকিজীর সাম্রাজ্যের ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু হয়ে গেছে।
মহাসমুন্দ শহরের নাইটিংগেল বার ও রায়পুর শহরের দুটো ইউনিয়ন, পনেরোটা দোকান একটি গাড়ি পেয়েছে ডোডেজা আর ভিলাই রোডের ওপর থ্রি-স্টার হোটেল, চারটে লজ, বিক্রমাদিত্য হোটেল ও সোলাংকিজীর বাড়ির দোতলার ভাগ পেয়েছে রমেশ বহল।
বিধবা পত্নীর কপালে জুটেছে বসত বাড়ির নীচের অংশ, ওই অলুক্ষুণে গাড়ি আর ২৫ লাখ টাকা। ওনার ভাই এসে দিদির প্রাপ্য অংশ বুঝে নিয়ে ব্যাংকে টাকা ফিকস্ড করে দিয়েছে। তবে নি:সন্তান দিদির সমস্ত ফিকস্ড ডিপোজিটে নিজের ছেলেকে নমিনি করতে ভোলেনি।
যাকগে, মাসে যা সুদ পাওয়া যাবে তা মন্দ নয়। নিজের বাড়ি গাড়ি থাকা একজন বিধবার খাইখরচের জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু বিকাশের কানে আসছিল এই ভাগাভাগিতে তিনপক্ষের কেউই খুব সন্তুষ্ট নয়।
বেরুনোর সময় কাউন্টারে পেমেন্ট করে মৌরি নিয়ে মুখে ঢালার সময় মুখোমুখি হয়ে গেলেন শংকরসেনার টপ অর্ডারের। উনি নমস্কার করে বল্লেন—সব কুশল-মঙ্গল তো?
আশ্চর্য! এরা কেউই ঠিক করে জবাব দিল না। একটু যেন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।
ট্রানজিস্টরে বাজছে পাকিস্তান রেডিওতে মেহদী হাসান।
—"কিঁউ মুঝসে খফা হো গয়ে অয় জানে তমন্না। ভিগি হুয়ি মৌসম কী মজা কিঁউ নহীঁ লেতে?''
ঘুম আসছে না। উঠে গিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিলেন। তারপর লো ভল্যুমে ট্রানজিস্টরে অন্য একটি স্টেশন খুললেন।
রেডিও পুণের ঘোষক জানাচ্ছেন এখন আপনারা শুনবেন মারাঠী নাট্যসংগীতের প্রোগ্রাম। খানিকক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট ঘরটিতে খেলা করতে লাগলো সরস্বতী রাণের রেওয়াজি গলায় একটি বহু পুরনো নাট্যসংগীত। বিকাশ চমকে উঠলেন। এই গানটি শুভদার বড় প্রিয় ছিল। নিজেও ভাল গাইতো। পুণের সারদা সংগীতকলা বিদ্যাপীঠের ভাল ছাত্রী ছিল। সেই কলেজের বার্ষিক উৎসবের সময় গান শুনতে গিয়েই তো পরিচয়। বিকাশ তখন পুণের ফার্গুসন কলেজে বিএসসি পদার্থবিদ্যার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সে'সময় সারদা সংগীতকলা বিদ্যাপীঠের অ্যানুয়াল ফাংশন শোনা পুণের কলেজের ছাত্রদের মধ্যে একটা ক্রেজ ছিল। তারপর অনেক কিছু।
বাপ-মার অমতে বিয়ে। জীবনসংগ্রাম। চাকরি পাওয়া এবং খোয়া।
সেই সব দিনে বিকাশ শুভদাকে শোনাতেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা।
"আমরা দু'জনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে''।
শুভদার বড় ভাল লেগেছিলো কথাগুলি।
ও শোনাতো একটি গজল।
"ম্যাঁয় দেখুঁ তো দুনিয়া তুমে ক্যায়সে সতাতী হ্যায়! তুম আপনী রঞ্জ-ও-গম, আপনী পরেশানী মুঝে দে দো''।
(দেখবো তো এই জগৎ তোমায় কি করে গো ব্যথা দেয়! তোমার যত জ্বালা-যন্ত্রণা সব আমাকে দাও।)
কোলকাতায় ট্রান্সফার নিলেন। শুভদা শিখলো কিছু বাংলা গান। গাইতো--
"পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি শূন্য পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।''
কিন্তু কোথায় যেন আস্তে আস্তে ফাটল ধরছিল। ক্রমশ: সেই ফাটল বাড়তে লাগল। দুজনার জগৎ ধীরে ধীরে আলাদা হতে লাগল।
কোলকাতায় এসে কখন যেন বিকাশ বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন।
শুভদার ছোট ভাই পুণেতে শংকরসেনার ছাত্রনেতা। শুভদা নিজে ভগিনী মণ্ডলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
প্রথম দিকে এগুলো নিয়ে হাসাহাসি হত। কিন্তু একদিন বিকাশ বল্লেন—শিবাজীকে নিয়ে তোমরা বড় বাড়াবাড়ি কর। উনি একটি কৌমের প্রতিনিধি ছিলেন। আদৌ স্বতন্ত্র ভারতের জন্যে লড়াই করেন নি, করেছিলেন নিজের জাগীর-এর জন্যে।
জবাবে শুভদা রবীন্দ্রনাথের "শিবাজী উৎসব'' থেকে কোট করলেন—"এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ডচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি।''
বিকাশ তখনকার মত চুপ করলেও খোঁচা দিতে ছাড়েন নি। শেষে শুভদাকে খুশি করতে কোলকাতা ছেড়ে মুম্বাই ট্রান্সফার নিলেন।
ততদিনে ছেলে হয়েছে মিলিন্দ।
মুম্বাইতে এসে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে লাগলো। শুভদার ওপর তার ছোট ভাইয়ের প্রভাব ম্যাজিকের মত কাজ করতো। ও তখন কামগার সেনার বড় নেতা। দিদিকেও নিয়ে গেল শংকরসেনার মহিলা শাখায়।
বিকাশ বিচলিত।
—তোমার কি মাথা খারাপ হল? তুমি একজন লেখাপড়া শেখা সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন সংবেদনশীল মহিলা। কি করে ও'রকম কম্যুনাল অর্গানাইজেশনে যোগ দিলে?
—কম্যুনাল কাকে বলছ? তোমার পার্টি কেরালায় মুসলিম লীগের সংগে হাত মেলায় নি? আসলে তোমরা বামপন্থীরা হচ্ছ স্যুডো! মাইনরিটিকে তেল লাগানো তোমাদের নীতি।
শেষে ছোট মিলিন্দ এসে বলতো—তোমরা চুপ করবে? আচ্ছা, তোমরা এত কী নিয়ে ঝগড়া কর? আয়ে দিন? আমি তো কিস্যু বুঝতে পারি না।
—সব আমার কপালের দোষ। আর দোষ হল তোর বাবার কোলকাতার আপব্রিংগিং এর। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। ভাই ঠিকই বলতো—তেলে জলে মিশ খায় না।
এবার বিকাশ রেডিওর নব ঘুরিয়ে কোলকাতা ধরলেন।
চেনা গান—"কার মিলন চাও বিরহী!''
উঠে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে বের করলেন একটি পাতা আলগা হয়ে যাওয়া পুরনো অ্যালবাম। হলদে হয়ে যাওয়া কিছু সাদাকালো ফোটোগ্রাফ, গোটা কয়েক রঙিন ফোটো।
একটি হলদেটে ছবিতে শুভদা কলেজের দিনে, দুই বেণী করা, মারাঠি কায়দায় কোঁচা দিয়ে শাড়ি পরে হাসছে। বিয়ের দুটো ছবি, এখনো মনে হয় সেদিনের কথা। আর মিলিন্দ, শুভদার কোলে, হাসপাতাল থেকে এসে। ওর মুখেভাত, মামা খাইয়ে দিচ্ছে। স্কুলের পোষাকে, মায়ের হাত ধরে। তার পরের পাতাগুলো খালি।
আজ থেকে দশবছর আগে, ঠিক এই দিনে, মিলিন্দকে হারিয়েছেন, মুম্বাই শহরে একটি দুর্ঘটনায়।
তার দু'বছর পরে শুভদা সরে গেলেন—বরাবরের মত।
রাজ্য ইন্টেলিজেন্সের সরকারি অফিসটি সিভিল লাইন্স পাড়ায়। কিন্তু ওখানে খালি স্ট্রিকটলি অফিসিয়াল মিটিংগুলো হয়। আসল অফিসটি বৃটিশ ঐতিহ্য মেনে নতুন গড়ে ওঠা মহাবীর রিজেন্সির ভিতরে একটি সাদামাটা দোতলা বাড়িতে। একতলায় একটি ছোট সাইন বোর্ড, তাতে লেখা সমাচার এজেন্সি। গেটে কোন চৌকিদার নেই।
কিন্তু অতিসাধারণ দেখতে জনা ছয়েক কর্মচারী আছে যাদের দেখলে প্রথম নজরে ঠাকুর, চাকর বা মালি বলে ভুল হতে পারে।
পার্থসারথির বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটে।
গত সাত মাসেও বিক্রম সোলাংকি খুনের কোন কিনারা হয় নি। চিফ মিনিস্টার একটাই কথা বলেন। —আমার রেজাল্ট চাই, রেজাল্ট! খালি শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না।
দোতলার একটি কামরায় এসি চলছে, কিন্তু পার্থসারথি স্বস্তি বোধ করছেন না। না:, VLCC-র কোর্স করে দুমাসে ওজন কমেছে মাত্তর তিন কেজি, কোমরের বেড় দু'ইঞ্চি। ওরা যে বলেছিল—ছ'কেজি কমবে আর ন্যাদাপেটও চার ইঞ্চি কমবে! টাকা তো নিয়েছে একগাদা। ডেপুটি মি: পটেরিয়া ঠাট্টা করে বলেছেন—স্যার, আপনার ছ'কেজি মাংস কমাতে ওরা যা টাকা নিচ্ছে সে হিসেবে আপনার মাংস পাঁঠা, খাসি বা মুরগীর চেয়ে কত বেশি দামি তা হিসেব করেছেন?
কথাটা মন্দ বলেনি। তবে ওরা বলেছিল—দেখিয়ে, মোটাপা কম কর্না লাইফ স্টাইল কা সওয়াল হ্যায়। সির্ফ ব্যায়াম হী নহী, ভোজন হী নহী, টেন্শন ভী কম হোনা হ্যায়।
এই পেশায় শালার টেনশন কোত্থেকে কম হবে?
এখন উনি আর পটেরিয়া টেবিলের ওপর বিছিয়ে রেখেছেন একগাদা ফাইল আর কিছু কাগজ। আলোচনার মাঝে কখনো কাগজে আঁকিবুকি কাটছেন। কখনো বিরক্তিতে হাত ঝেড়ে উঠে পায়চারি করছেন বা ইনস্ট্যান্ট কফি খাচ্ছেন।
—হ্যাঁ, যদি ড্রাইভার কাজটি করে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে ও রিভলবারটি পেল কোথায়? আর যদি ধরে নেই বাইরে থেকে কেউ দিয়েছে, তাহলে ভাবতে হচ্ছে ব্যাটা লুকিয়ে রেখেছিল কোথায়? ধরে নিলাম হোটেলে যখন খাওয়া দাওয়া চলছিল?
—হ্যাঁ,ও তো রাস্তায় গাড়িতে বসেছিল। তখন কেউ ইজিলি সাপ্লাই দিতে পারে। পুরনো বাঁধা ড্রাইভার । গাড়ির মধ্যের কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে রাখলেও কেউ সন্দেহ করবে না।
—সে বেশ! কাজ হয়ে গেলে হাতিয়ার কোথায় সরালো? বাইরে কোথাও ফেললো? ধর খারুন নদীতে?
—না, স্যার! ঘটনার আন্দাজ কুড়ি মিনিটের মধ্যে যখন ডোডেজাদের ফোন এল তখন ও বাংলোতেই ছিল। খারুন নদী গিয়ে এত কম সময়ে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
—ওর কামরাও তো ভালো করে সার্চ করা হয়েছে।
—স্যার, ও কিন্তু আর্থিক কষ্টে আছে।
সোলাংকির চ্যালা চামুণ্ডারা ওকে পেঁদিয়ে লাট করার পর ওকে কেউ চাকরি দিচ্ছে না। ফলে ও তখতপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ক্ষেতে কাজ করছে। আর লোক্যাল থানায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে।
—তাহলে পেশাদার কোন এক বা একাধিক লোকের কাজ? সুপারি কিলার্স্? তুমি কি বল? কিন্তু সোলাংকি যে ওই নির্জন মাঠের কাছে নেমে পায়ে হাঁটবে সেটা তো মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে ও নিজেও জানতো না। ভাড়াটে লোক কি করে জানবে?
—হয়তো সেদিন ওকে গাড়ি নিয়ে ফলো করে ছিল। সুযোগ পেয়ে গেল।
—অথবা, ড্রাইভার মিথ্যে কথা বলছে। হত্যাকারীরা রোজকার বাড়ি ফেরার রাস্তায় ওৎ পেতে ছিল।
—তাহলে ড্রাইভার আজ এত মাস পরেও আর্থিক কষ্টে কেন? তখতপুরে ছোটখাট দোকান খুলে বসতো না? যারা এই কাজ করিয়েছে তারা কোন অ্যাডভান্স দেয় নি?
না:, নতুন করে ভাব। ওই মারাঠি? আপলা মানুস? ও শস্ত্রটি কোথায় রাখবে?
—স্যার, ওর তো কোন মোটিভ দেখা যাচ্ছে না।
—ধ্যাত্তেরি! মোটিভ পরে দেখা যাবে। তুমি আমি ওকে কতটুকু চিনি? আগে মোডাস অপারেন্ডি কি হতে পারে ভাব!
—না, স্যার! বাত কুছ জম্ নহী রহা। ও লোকটিই বা কি করে জানবে যে সেদিন সোলাংকি ওকে হঠাৎ গায়ে পড়ে লিফট্ দিতে চাইবে?
রোজই তো বিক্রমাদিত্য হোটেলে খায়, আর ওখানেই সোলাংকিদের রাতের আড্ডা। কই, বাকি দিন তো ওকে কেউ লিফট দেয় নি!
হঠাৎ পার্থসারথি লাফিয়ে উঠলেন।
—আরে হ্যাঁ, ওই বিক্রমাদিত্য হোটেলে সিসিটিভি আছে না? আমি এস পি-কে বলেছিলাম ওই হোটেলের ঘটনার দিন থেকে আগের একমাসের সন্ধে ছ'টার থেকে হোটেল বন্ধ হওয়া অব্দি তোলা ফিল্মের কপি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে। গতকাল সেগুলো এসে গেছে। চল, পাশের প্রোজেকশন রুমে গিয়ে সেগুলো ভাল করে দেখি।
দুজনে উঠে প্রোজেকশন রুমে গিয়ে ভাল করে ১৫ দিনের ফিল্ম দেখলেন। কখনো ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করে, কখনো স্লো মোশনে। কখন যে ছ'ঘন্টা গড়িয়ে গেছে খেয়াল নেই। ইতিমধ্যে দুবার সম্ভর বড়া একবার ইডলি আর অন্তত: চারবার কফি এসেছে।
শেষে ক্লান্ত হয়ে বল্লেন—সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়! দ্যুৎ, নিকুচি করেছে। বাকিটা কাল দেখব।
—হ্যাঁ, স্যার! সেই ওদের তিনজনে বা কখনও চারজনের বিশেষ টেবিলে বসা, মদ খাওয়া, বড় বড় বাকতাল্লা মারা। সেই মারাঠি বিকাশ বাবুর এককোণায় বসে ধীরে ধীরে রুটি চিবুনো বা কখনো পত্রিকা পড়া। আর কখনো ওদের চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে বড় বড় চোখে দেখা।
হ্যাঁ, পনের দিনের মধ্যে দু'বার অন্য কাস্টমারের সঙ্গে হাতাহাতির ছবিও আছে। ওই যে স্যার ধমতরী থেকে দরকারী কাজে রায়পুরে আসা বাপ-ছেলেকে ওরা ওদের রোজকার টেবিল খালি করেনি বলে বেদম পিটেছিল, মনে আছে? ওই যে যেটায় ওরা প্রথমে পুলিশে শিকায়ত করেও পরে ভয় পেয়ে উইথড্র করেছিল? আরে যা ফুটেজ্ আমাদের হাতে এসেছে তাতে শঙ্করসেনার হোমরাচোমরাদের কনভিক্শন হয়ে যাবে।
কিন্তু পার্থসারথি কিছু অন্যমনস্ক। পটেরিয়ার সাজেশন হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মত করে উড়িয়ে দিলেন।
—শোন, আমরা এখানে শংকরসেনাদের বুক করতে আসিনি। আমাদের দায়িত্ব হল সোলাংকির আততায়ীদের খুঁজে বের করা।
—হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি এই ফুটেজ দেখা একেবারে ফালতু যায় নি।
—আপনার মাথায় কিছু এসেছে। নেকস্ট স্টেপ কি হবে?
—কুমীর গভীর জলে আছে, ঘাপটি মেরে। খেলিয়ে তুলতে হবে।
—মানে?
—আরে, তোমার বিলাসপুরে তখতপুরের কাছে এক গাঁয়ে খুব চালাক মানুষখেকো এক কুমীরের কথা মনে পড়ছে? যাকে বনবিভাগের গানম্যান গিয়েও মারতে পারছিল না? যে দিনের বেলায় কখনও ভেসে উঠতো না? কিন্তু মাঝরাত্তিরে উঠে হাওয়ায় ফুসফুস ভরে নিয়ে আবার জলের তলায় লুকিয়ে পড়তো?
টোপ দিতে হবে। দেখা যাক, যদি গেলে!
চল, কালকে রমেশ বহলের বাড়ি গিয়ে চা খাব। ওকে খবর দাও যাতে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়িতেই থাকে।
রমেশ বহল ভাগের টুকরোয় প্রাপ্ত বিক্রম সোলাংকির প্যালেসিয়াল বাড়ির দোতলায় শিফ্ট করে গেছেন। বাড়ির সাইড গেট দিয়ে এনট্রান্স্।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই সোনালী রঙের গোল্ডেন রিট্রিভার "ঘাঁউ'' করে সম্বর্ধনা দিল।
কোসার পাঞ্জাবী-কুর্তায় রমেশকে মানিয়েছিল বেশ। সামনের বিশাল ব্যালকনিতে বেতের সোফাসেট। তবে কফি টেবিলটি কাঁচের।
চা এল খাস পাঞ্জাবী দা, অনেকটা মালাইওলা দুধ দিয়ে তাতে আবার দারচিনি-লবঙ্গ দেয়া।
প্রশ্ন করছিলেন মি: পটেরিয়া।
—আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি এখনো বসের ওই রকম ডেথকে মেনে নিতে পারেন নি।
রমেশজী মাথা নাড়েন।
—আচ্ছা, ওই ড্রাইভারটি তো আপনারই পাড়ার।
—উ:, ওই এককথা আমাকে কতবার জিগ্যেস করা হবে?
—আপনি নিশ্চয়ই চান যে আপনার বসের মার্ডারার ধরা পড়ুক।
—তাতে আপনার কোন সন্দেহ আছে?
—তাহলে আশা করব যে আপনি আমাদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করবেন।
—করছি না কি? কিন্তু ড্রাইভার যে আমার পাড়ার ছেলে, ওকে যে কিছু মাস আগে আমিই চাকরিতে ঢুকিয়ে ছিলাম এটা আপানাদের আগে ওই ঘটনার দিন থেকে অন্তত: একশ'জন জিগ্যেস করেছে। প্রেস, চ্যানেল, এস পি, স্টেশন অফিসার কে নয়? আখবারেও প্রকাশিত হয়েছে, আপনারা সব জেনে বুঝে ঐ একটা বেতুকী কোশ্চেন দিয়ে শুরু করবেন তারপর আবার আরোপ লাগাবেন যে আমি সহযোগিতা করছি না। আরে বাবা! হম ভি তো ইনসান হ্যায়, হ্যায় কি নহী—আপহীলোগ বাতাইয়ে।
হাত তুললেন মি: পার্থসারথি।
—ও কে; আমি অন্য প্রশ্ন করবো। আপনি কেন চাইছিলেন?
—চাইছিলাম? কী চাইছিলাম? —মানে?
—মানে খুব স্পষ্ট! উনি মারা গেলে আপনার ষোল আনা লাভ। বেঁচে থাকলে বেশ কিছু লোকসান।
—আপনার জায়গায় দুসরা কেউ এই কথা বল্লে আমি তার—। আপনি কি জানেন উনি না থাকলে আমি আজ কি করতাম? ইউনিভার্সিটির সামনে পানঠেলা চালাতাম। খুব বেশি হলে ক্যান্টিনের ঠিকে নিতাম। আজ আমি যদ্দূর যা হয়েছি, জেনে রাখবেন বসেরই দয়ায়।
—আমিও তো তাই বলছি। আচ্ছা! আপনি কি মনে করেন ওই কাণ্ডে ড্রাইভারটির কোন হাত থাকতে পারে?
—না:, ও বেওকুফ, কিন্তু ইমানদার; বেইমান নয়।
—আপনি নিশ্চিত যে টাকা দিয়ে ওকে কেনা যাবে না?
—শত প্রতিশত। এতটুকু খোঁট থাকলে ওকে আমি বসের গাড়ি চালাতে দিতাম না।
—তা অমন ইমানদার লোকটিকে আপনি মেরে তাড়ালেন কেন? এমনিতেই তো আজকাল ইমানদারির বাজারভাও কম।
—তাড়ালাম এই জন্যে যে ওর বেওকুফিতেই বসের জান গেছে।
বস আমার নিডর, সাচ্চা হিম্মতওয়ালা, একদম বাহাদুর। কিন্তু সেদিন ড্রিংক একটু বেশি হয়ে গেছিল। ড্রাইভারের উচিত ছিল একটু দূর থেকে বসকে কভার করা, আর নয়তো আমাদের রিং করে জানানো যে বস জিদ করে পায়দল চলছেন।
—আজকাল ও কি করছে, কেমন আছে তার খোঁজ নিয়েছেন? নাকি ইমানদার ছেলেটিকে শংকরজী বা রামজীর ভরসায় ছেড়ে দিয়েছেন? চাকরি কেড়ে নিলেন তারপর আর কোন দায়িত্ব নিলেন না? এর চেয়ে ওকে চাকরিতে না লাগালেই পারতেন?
—না, না, আমি উতনা স্বার্থী, খুদগর্জ বুরা আদমী নঈ। আমি ওর একটা নিয়মিত মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। কিন্তু এসব কথা আর কাউকে জানাবেন না। সেনার মধ্যেও অনেকে আমাকে ভুল বুঝতে পারে।
এবার গরজে উঠেছেন মি: পটেরিয়া।
—আপ উস্সে ভি বুরা হ্যায়। চালাকি করে নিজের হাতে মেরেধরে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে পুলিশ ও মিডিয়ার নজর ওর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তারপর ও যা অমূল্য সার্ভিসটি দিয়েছে তার জন্যে তাকে আর্থিক পুরস্কারও দিচ্ছেন। ও ইমানদার তো বটেই তবে কার জন্যে সেইটাই ভাবার বিষয়।
রাগে ও ভয়ে বহলের মুখে খানিকক্ষণ কথা ফুটল না।
একটু পরে নীচু স্বরে বললো—আপলোগ ক্যা মুঝকো আভি গিরফতার করেঙ্গে?
পার্থসারথি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
এখন ওসব কিছুই করছি না। আমরা শুধু চাই যে আপনি আমাদের সঙ্গে আরও একটু সক্রিয় সহযোগিতা করুন।