কিছুদিন আগে একটি ছোট কবিতা লিখেছিলাম, যাতে দ্বারকেশ্বর নদের উৎস এবং নামকরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছিল। সেই কবিতাটিতে এক আদিবাসী বৃদ্ধার কথা আছে। যে পৌরাণিক গল্পের তিনি নায়িকা, হঠাৎ আজ মনে হলো সেই গল্পটি আপনাদের কাছে উপস্থাপিত করলে কারো কারো ভালো লাগতে পারে। বলা বাহুল্য, নাম টাম গুলো কিছুই মনে নেই আর, ও সব আমার কল্পনা। গল্পটি অবশ্য ঠিক যেমন শুনেছি। সত্তর আশি বছর আগে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষের লেখা একটি বইতেও শুনেছি এ গল্পটি পাওয়া যায়। বইটির নাম, বুঝতেই পারছেন, ভুলে গেছি!
সুখাডিহি একটা ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম। মানভূম অঞ্চলের সাওঁতালদের। তিনদিকে টাঁড়, একদিকে নিশ্ছিদ্র শাল আর অর্জুন জঙ্গল। টাঁড় মানে একদম শুকনো পাথুরে সমতল জায়গা—খুব শক্ত মরুভূমি গোছের আর কি; গাছপালা কিছু নেই, ঘাসও গজায় না বললেই চলে। হাতি, বাঘ, মোষ জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে উপদ্রব করেই থাকে। বৃষ্টির জল মাস দুয়েক যা পাওয়া যায়, তাই পাথুরে মাটির ডোবায় ধরে রেখে কাজ চলে, নদী নালা নেই ধারে কাছে। দূরে মেঘের মতো পাহাড় দেখা যায়, অনেক সময় সেখানকার শীর্ণ ঝর্ণায় গ্রামবাসীরা স্নান টান করে আসে। ভাদ্র মাসে করম, পৌষে সারাই এই সব উৎসবের সময়েই আরো বেশি করে।
মাঝে মাঝে সিংভূমের আর দলমার দিকে জল খুঁজতে ভয়ঙ্কর বুনো মোষের দল টাঁড় পেরিয়ে যায়, তাদের যূথপতি দেবতা টাঁড়বারো। ঠাকুরজিউ, মারান বুরু ও অন্যান্য বোঙ্গারাও তাকে এড়িয়ে চলেন, যদিও ঠাকুরজিউর নিজের হাতি ঐরাবত তাকে ডরায় না! আবার ঐরাবত যাদের বোঙ্গা (দেবতা) সেই হাতিরাও কোথাও জলে মোষ দেখলে তাদের তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে।
ঐরাবতের দাঁত দিয়ে টাঁড় খুঁড়ে জল খোঁজা দেখে সম্রাটের কবি তো সম্রাটের জন্য লিখেই ফেললেন সে কথা।
এক গ্রীষ্মে হাহাকার চারদিকে—পাহাড়ি ঝর্ণাতেও এক ফোঁটা জল নেই। খেপে গিয়ে হাতিরা এক রাত্তিরে সব কিছু ভেঙে চুরে সুখাডিহির ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, গ্রামবাসীরা সবাই পালিয়েছে। ওদিকে হাতিদের দলপতি কেউ থাকে না, কোনো এক দিদিমা হাতি দলনেত্রী হয়। হাতিদের কান আবার খুব প্রখর—সব শুনতে পায় ওরা। হঠাৎ দিদিমা ফাঁকা গাঁয়ে শুনলো একটা মানুষ বাচ্চার কান্না। এদিক ওদিক উল্টে পাল্টে দেখে একটা ছোট্ট মেয়ে কাঁদছে। ঐরাবত ছিল সবচেয়ে বড়ো হাতি, বিরাট তার দাঁত। দিদিমা হাতি তাকে ডেকে বললো—যা, এই পুঁচকিটাকে ওর দলের কাছে পৌঁছে দিয়ে আয়। ওরা সব আমাদের ভয়ে পালিয়েছে।
সেই ছোট্ট মেয়ে, পিলচি তার নাম, তাকে ঐরাবত তার বাবা মার কাছে পৌঁছে দিলো অনেক খুঁজে। কিন্তু ঐরাবতের সঙ্গে তার চিরকালের মতো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
পিলচি বড়ো হলো, মা হলো, তার পর একদিন দিদিমা হলো। বহুদিন পর আবার একবার ফিরে এলো সেই দারুণ খরা, চতুর্দিক মরুভূমি। পিলচি-দিদিমা জঙ্গলের ধারে গিয়ে ঐরাবতকে ডাকতে লাগলো।
মাথার ওপর দিয়ে কালো কালো হাতির মতো দেখতে মেঘেরা উড়ে চলে যাচ্ছে, এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে না। কিন্তু মেঘেদের কানে পৌঁছলো পিলচির ঐরাবতকে ডাকা—তারা সে ডাক তাকে বহুদূরে পৌঁছে দিলো।
ঐরাবত এলে পিলচি-দিদিমা বললে—আমাকে ওই পাহাড়টার কাছে নিয়ে চলো তো দাদা—ওখানে জল পাবো।
পাহাড়ের গায়ে ঐরাবত তার বিরাট দাঁত দিয়ে খুঁড়তে লাগলো, আর পিলচি-দিদিমা ঠাকুরজিউকে ডাকতে লাগলো। একটা ছোট ছেলে কোত্থেকে এসে ঐরাবতকে দেখালো—এইখানে খোঁড়ো, জল পাবে।
ফোয়ারার মতো জল বেরিয়ে পাহাড় ছাড়িয়ে টাঁড় ভাসিয়ে ঢল মাতিয়ে ছুটলো নদ—দিদিমা তার নাম দিলো ঢলকিশোর।
শস্যের জোয়ার এসে গেলো সুখাডিহিতে, ফুলে ফলে চারদিক ছেয়ে গেলো। মাছে ভরে গেলো নদ।
সুখাডিহি গ্রামে আর কখনো কিছুর অভাব হয় নি। শ্রাবণের আকাশে কালো মেঘেদের ওপর কখনো কখনো দেখা যায় একটুখানি শাদা—ঐরাবতের পিঠে বসে বুড়ি দিদিমা, শাদা শণের মতো উড়ছে তার পাকা চুল। সাঁওতালরা আজও দুহাত তুলে নমস্কার করে তাদের।
কিছু দূর নেমে আসার পর নাম পাল্টে ঢলকিশোর হয় দ্বারকেশ্বর, আরো পরে হয়ে যায় রূপনারায়ণ। তাকে তো আমরা সবাই চিনি, তাই না?