আর, পাঠক, ইতিহাসে দিলচসপি না থাকলে মিশর ভ্রমণ আপনারও একঘেয়ে লাগতে পারে। প্রাতঃস্মরণীয় মুজতবা আলি কাইরো থাকার প্রথম ছ মাসের মধ্যে পিরামিড দেখে উঠতে পারেননি। কাইরোর কাফেতে আড্ডা মেরেই সময় কেটে গেছে। আর ঐ টন টন পাথর দেখতে যাবার আছেই বা কি। আরেকবার মুর্শিদ-এর স্মরণে কান স্পর্শ করে বলি মুজতবা আলির পঞ্চতন্ত্রের ঐ সাকুল্যে আড়াইখানা লেখা থেকে যে মিশর দেখেছি আমাদের ন-দিন এর সফরে কেন আমার দুই জন্ম কেটে গেলেও সে দেখাই আমার হবে না, সে কিসসা বর্ণন তো দূরস্থান। আমাদের যাদবপুরের হোস্টেলে নানা শিক্ষালাভ করেছি। তার মধ্যে একটা হল ফুটো মশারিতে কি করে মশার প্রবেশ আটকানো যায়। যেখানে ফুটো তার উলটো দিকে ঠিক সেই রকম একটা ফুটো করে একটা খবরের কাগজ গোল টিউবের মত করে পাকিয়ে এক ফুটো থেকে অন্য ফুটো অবধি বরাবর চালিয়ে দিলেই কম্ম ফতে। বাবাজি এ-দিক ও-দিক দিয়ে যতই উড়ে বেড়াক না কেন মশারির মধ্যে কিছুতেই ঢুকতে পারবে না। ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো আপনাকে সেই কায়দায় মিশর-এর এ-মাথা থেকে ও-মাথা নীলনদ বরাবর ঘুরিয়ে আনবে। আপনি পিরামিড, আলেক্সান্দ্রিয়া, আসোয়ান, লাক্সর সব ঘুরে ফেলবেন কিন্তু মিশরের পঁচানব্বই শতাংশ আপনার ধরাছোঁওয়ার বাইরে থেকে যাবে। আমারও গেছে। সেই পাঁচ শতাংশই সামান্য সোয়াদ বদলে পেশ করছি। গোস্তাকি মাফ করবেন।
মুম্বাই থেকে ইজিপ্ট এয়র-এর যে বিমানে চাপলাম তাতে একপাল জোব্বা-টুপি পরা তীর্থযাত্রী দেখলাম অন্য কিসিমের বাঙাল। তাঁদের দলটি সংখ্যাগুরু। তাঁরা মনোমত এ ওর পাশের বোর্ডিং পাস পাননি। কিন্তু বাঙাল মাত্রেই জানে নিয়মের পরোয়া করলে সংসারে টিঁকে থাকা অসম্ভব। তাই তাঁরা যথেচ্ছ পোঁটলা-পুঁটলি ঠুসে দিয়ে নিশ্চিন্তে যে যার মনোমত আসন গ্রহণ করলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমরা তার আগেই জায়গায় বসে পড়েছিলাম। গুটিকয় সাহেব-মেমের বিভ্রান্ত অবস্থা দেখে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ অনুভব করলাম। অতঃপর একজন বিমানসেবিকা ও দুই অতি বলিষ্ঠ চেহারার বিমানসেবক ভাষাপারাবার সাঁতরে সেই কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খলা দশ মিনিটের মধ্যে একেবারে দুরুস্ত করে ফেললেন। পরে সেই ভদ্রসন্তানটিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। রাজি হলেন না।
আধো ঘুমের মধ্যে দেখলাম চমৎকার এক সমুদ্রঘেঁষা বন্দরে নামছি। প্রায় লাফিয়ে উঠে মাথার উপর থেকে ব্যাগ নামাতে গিয়ে থমকে গেলাম। সহযাত্রীদের তো কোন চিত্তচাঞ্চল্য দেখছি না! সামনের স্ক্রীন থেকে মালুম হল এটা ফুএলিং স্টপ। মোকাম আরো প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরি। অবশেষে কাইরোতে নামার পর থেকেই শুরু হল আপ্যায়ন। আমরা রাজার জামাই।
ইমিগ্রেশন পৌঁছোবার আগেই এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ সসম্ভ্রমে আমাদের স্বাগত জানিয়ে আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে আমাদের আরবীতে লেখা একটি করে ফর্ম ধরিয়ে দিয়ে তলায় দস্তখত করার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। আর আমরা সই করে দেওয়া মাত্র ঝড়ের গতিতে বাকিটা ভর্তি করে ইমিগ্রেশন কাউন্টার-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। এত দ্রুত হল যে অন্য পিঠে ইংরেজিতে লেখা কিনা দেখতেও পারলাম না। তাঁর সঙ্গে ওপারের ব্যক্তির এক লহমার হাসি বিনিময় হতেই আমাদের সামনের দুয়ার খুলে গেল, আমরা মিশরের মাটিতে পা দিলাম। এজেন্সির অতিথি হয়ে এলে সব মসৃণ। বাইরে আরো দুই সহাস্য যুবক দাঁড়িয়ে। আগামী তিনদিন আমাদের দেখ-ভালের দায়িত্ব তাদের।
মূল প্রার্থনাকক্ষ বিশাল এবং তার ঝাড়বাতি শ্রীভূমির পুজো প্যান্ডেলের ঝাড়বাতির থেকেও বোধহয় বড়। গম্বুজ খিলানের চমৎকারিত্ব থেকে চোখ নামিয়ে সবে ইতিউতি দর্শণার্থীদের দিকে নজর করেছি--ইহাব (আমাদের প্রথম গাইড) কোরাণে বর্ণিত প্রার্থনার নিয়মাবলী কেমন নিশ্ছিদ্র তাই ব্যাখ্যানায় লেগে গেল। আমি পাপিষ্ঠ নিশ্ছিদ্র ধর্মের আবহে হাঁসফাঁস করি। ছবি তোলার অছিলায় বেরিয়ে এলাম।
শহরের একটা বড় টুকরো দেখা যাচ্ছে। দেখে পিপাসা পেয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় ধূসর। খুব ইচ্ছে করছিল অলিগলি ঘুরে ঘুরে দেখতে একটু পাড়াগুলো কেমন। কোথাও কি রঙ নেই? কাফেগুলোয় সেই আড্ডা কি এখনও বসে? তার বদলে আমরা এবার গেলাম হ্যাঙ্গিং চার্চ আর সিনাগগ দেখতে। বেশ ভিড়। তারপর ইহুদি সিনাগগ। স্বয়ং মেরি মাতা নাকি শিশু যিশুকে নিয়ে এইখানে কিছুকাল কাটিয়ে গেছেন। মিশর দেশের মুশকিল এই যে দ্রষ্টব্য সব কিছুই প্রায় কম সে কম চার হাজার বছরের পুরোন। ফলে মাত্র হাজার দুই বছর আগের ঘটনার তো বোধহয় প্রত্যক্ষদর্শীও পাওয়া সম্ভব। এজেন্সির কতগুলো বাঁধা জিনিষ আছে। আপনার ইচ্ছে হলেই আপনি ফট করে একটা দোকানে ঢুকে পড়বেন তার জো নেই। গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে হয়তো কোন পারফিউমের কারখানায় বা কোন কিউরিও-র দোকানে। আপনার বাঙাল রক্তে বিদ্রোহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে উঠবে। সিনাগগ থেকে বেরোনোর পর যখন দু চারটে দোকানে আমরা হাঁফিয়ে উঠেছি ইহাব আমাদের বসাল সেই রাস্তার মোড়ের এক কফিখানায়। চওড়া ফুটপাথে দিব্যি টেবিল চেয়ার পাতা। ঘন টার্কিশ কফি খেয়ে মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল।
আমি যখন সবচেয়ে মুখরা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম শেষ কোন সিনেমাটা তাদের ভালো লেগেছে বোঝা গেল তার ইংরেজি আমার থেকেও টুটাফাটা। বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে সে দলের যে মেয়েটি ইংরেজি জানে তার কাছ থেকে শিখে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি আরবী জানি কিনা। আমি না বলাতে সে বিজয়িনীর হাসি দিয়ে আমার সঙ্গে একটা হাই ফাইভ করল। গোটা দলটা তারপর হৈ হৈ করতে করতে নিচে নেমে গেল। মন্তাজার প্রাসাদের বিশাল বাগান চত্বরেও দেখলাম একঝাঁক তরুণ-তরুণী হা হা করে হাসছে, গান চালিয়ে নাচছে, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, অর্থাৎ অবিকল তরুণদের যা যা করার তাই করছে। কাইরোয় এই উচ্ছলতা দেখিনি। ইহাব বলল মিশরের দক্ষিণ বেশি গোঁড়া।
এবার কাইরো। সরকারি প্যাপিরাস বিক্রয়কেন্দ্রে নামলাম আমরা। ইহাব পইপই করে বলে দিয়েছিল অন্য কোথাও থেকে আমরা যেন প্যাপিরাস না কিনি। বেশির ভাগই নাকি লোকঠকানো। আমরা ঢুকতেই আপ্যায়ন করে জিজ্ঞেস করা হল আমরা কি ইচ্ছে করি চা, কফি, ঠান্ডা কিছু? বুঝলাম সব সরকারি হস্তশিল্প কেন্দ্রের মতই এখানেও দাম একটু চড়া হবে। কিন্তু এখানকার কর্মীরা বড্ড হাসিখুশি, সুভদ্র, অনলস। তাই সবাই সাধ্যমত প্যাপিরাস কিনে, তাতে নিজেদের ইচ্ছে মত হিয়েরোগ্লিফিক অক্ষরে এটা ওটা লিখিয়ে হোটেলে ফিরে চললাম। কাল আমরা যাব পিরামিড দেখতে।
আজ থেকে আমাদের ভার ইহাব-এর বড়কর্তা ফ্রাঁসোয়া-র হাতে। সে মিশর-এর কুড়ি শতাংশ কপটিক খ্রিস্টানদের একজন। সে আরো ঝানু গাইড। দুর্দান্ত গল্প বলতে পারে। এরপর থেকে আমরা যে গণ্ডা গণ্ডা মন্দির দেখব তার গায়ের সচিত্র পুরাণ সে ব্যাখ্যা করে না দিলে অত পাথর সত্যি হয়ত আমাদের একঘেয়ে লাগত।
পিরামিড চত্বরেও রাশি রাশি ছোটখাটো ফেরিওয়ালা আর উটচালক। ফ্রাঁসোয়া আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল তাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে। দেখলাম সেই ছেলেবেলার ইতিহাস বই-এ যেমনটি দেখেছি, হুবহু তাই। বাড়তির মধ্যে পিরামিডের গা বেয়ে খানিকটা ওঠার সুযোগ পাওয়া গেল। চমৎকার ঠান্ডা ঠান্ডা পাথর।
কাইরোর যাদুঘরটি ভারী জ্যান্ত। মমি ভর্তি ঠান্ডা ঘরটি পর্যন্ত। সারা পৃথিবী ভেঙে পড়েছে। ফলে গমগম করছে যাদুঘর। এক ধবধবে শাদা দাড়িওয়ালা কপটিক যাজক এসেছেন শাদা সুতোর কাজ করা কালো আলখাল্লা পরে। চোখে সরু সোনালি রিমের চশমা। ইচ্ছে হচ্ছিল একটা জানালার পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে গোটাকতক ছবি তুলি ওনার। ব্রীড়াবশত পারলাম না।
যে ট্রেন আমাদের আসওয়ান নিয়ে যাবে তার দেরি আছে। তাই ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গে বিনা বাক্যব্যয়ে যাওয়া গেল এক সুগন্ধির দোকানে। সেখানেও প্রথমে আপ্যায়ন, তারপরে পণ্যের ব্যখ্যানা এবং গুণকীর্তন, অতঃপর কেনাকাটা।
আমাদের খাওয়ার কথা আজ এক খুব নামী ইজিপসিয়ান রেস্তোঁরায়। কিন্তু ও হরি, সেখানে পাওয়া যায় শুধু কুশারি — ভাত, ম্যাকারনি, ছোলা ইত্যাদির একটা খিচুড়ির উপরে ভিনিগারে ভেজানো টোম্যাটো ছড়ানো। নানা টক ঝাল সস আপনি যোগ করে নিতে পারেন। তিনতলা একটা রেস্তোঁরা শুধু এই বিক্রি করে চলেছে, তিলধারণের ঠাঁই নেই।
বিকেলে আমরা গেলাম ফিলা মন্দির দেখতে। সুবিপুল নাসের বাঁধ যে সুবিশাল নাসের হ্রদ তৈরি করেছে তাতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমন বাষট্টিটি মন্দির নাকি খুলে খুলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফিলা তার মধ্যে একটি। নীলনদের মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপে রয়েছে ফিলা। ভারি মিষ্টি দেখতে তাকে।
এই কদিন এই বিলাসতরণীই আমাদের বাসস্থান। প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা আসওয়ান-এ নোঙর করে থাকার পর জাহাজ রওয়ানা দিল লাক্সর-এর উদ্দেশে। পথে অবশ্য আমরা থামব। পরদিন বেশ ভোরে উঠে আমরা টাঙায় চড়ে গেলাম এডফু মন্দির দেখতে। সে মন্দির আপনি ইউ টিউব-এ দেখে নিতে পারবেন। কিন্তু সেই আধো আলোর সকালে যখন বাতিস্তম্ভগুলো জেগে আছে আর শহরটা আস্তে আস্তে জেগে উঠছে, রুটির দোকানে ইতিমধ্যেই ভিড় হয়ে গেছে, লোকেরা খবরের কাগজ হাতে চা-কফির দোকানে জড় হচ্ছে তখন আপনি এই মিশরের সঙ্গে একটা আরামদায়ক আত্মীয়তা অনুভব করবেন ফারাওদের মিশরের সঙ্গে যেমনটি হবার কোন উপায়ই নেই।
জাহাজ আবার ছাড়ল। জাহাজের ছাদে একটি পুঁচকে সুইমিং পুল আর সারি সারি ডেক চেয়ার পাতা আছে। দুপুরের রোদ্দুর। কিন্তু ছুরির মত হাওয়া। যে দু চারটি সিংহ-হৃদয় ছাদে রয়েছেন তাঁরা হয় শীতের পোষাকে সুসজ্জিত, নয় বাথ টাওয়েলে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে মমি সেজেছেন। অল্প থেকেই নিজেদের ঘরের প্রশস্ত কাঁচের জানালা দিয়েই জলযাত্রা নিরীক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
অবশেষে লাক্সর। এখানকার মন্দির দর্শনের পর লাক্সর বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে পাওয়া গেল দু ঘন্টা সময়। বিকেল হয়ে গেল প্রায় দুপুরের খাওয়া খেতে। ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গে আমাদের এবার ছাড়াছাড়ি হবে। গাড়ি নিয়ে আমরা রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছলাম হুরগুডা। সেখানের যে পাঁচতারা হোটেলে আমাদের রাখা হল আমাদের তো চোখ ট্যারা হয়ে গেল। লোহিতসাগরের এক কোনা ঘিরে নিয়ে তারা নিজস্ব বেলাভূমি বানিয়ে নিয়েছে। তবে সে সমুদ্র এমন শান্ত যে হোটেলের তিনটে সুইমিং পুলের যে কোন একটাতে চান করলেও একই ফল।