এবার একটা মিটিং-এর জন্য গুজরাট যেতে হয়েছিল। আমি তো যেখানেই কাজে যাই দু’একটা নির্ভেজাল বেড়ানোর প্ল্যান জুড়ে দিই। এবার গির ন্যাশানাল পার্কে যাব ঠিক করলাম। সারা এশিয়া মহাদেশে একমাত্র গির পার্কেই বনের রাজা সিংহর দেখা পাওয়া যায়।
পার্কটি অন্যান্য বড় শহর থেকে বেশ দূরে। সব থেকে কাছের শহর সুন্দর দিউ। সেখান থেকে গাড়িতে ঘন্টা দুয়েকের পাড়ি। আমরা গেছিলাম জামনগর থেকে — প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা, তবে মন্দ নয়। বেশি ভিড় নেই। আরামসে দু’ধারে কাঁটাবন, ছোট ছোট গাঁ, রাস্তার ধারে গুজরাটি ধাবা — যেখানে গাছের ডাল থেকে খাটিয়া ঝুলিয়ে পথ ক্লান্ত যাত্রীদের দিবানিদ্রার ব্যবস্থা। এই সব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সাশানগিরি জেলায় বনের রাজার রাজত্বে।
ইদানীং গিরের আশে পাশে অনেক নতুন ট্যুরিস্ট হোটেল ও রিসর্ট তৈরি হয়েছে। অবস্থাপন্ন চাষীরা নিজেদের জমিতে অনেক জায়গা নিয়ে বাগানবাড়ির মত বিরাট হোটেল তৈরি করেছেন। রাজের ফার্ম, শ্যামের ফার্ম, অম্বরের ফার্ম ইত্যাদি সব নাম। রাস্তার ধারে ধারে তাদের সরব বিজ্ঞাপন।

হোটেলের মধ্যে তাঁবু
আমাদের হোটেলটার নাম শুধু ‘দি লজ’। তাড়াহুড়োয় শেষ মুহূর্তে এক ট্রাভেল এজেন্ট ঐখানেই রিজার্ভেশন করেছিল। আমরা কোত্থাও কোনো বিজ্ঞাপন বা রাস্তার নিশানা পেলাম না। স্থানীয় লোকেরাও ঐ হোটেলের নাম জানে না। কেউ বলল নামটা নিশ্চয়ই ‘গির লজ’, কেউ বলল লজ নয়। নিশ্চয়ই ‘লর্ডস্’। কিন্তু কোনোটাই মিলল না। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকারে বনে জঙ্গলে ঘোরা আরও মুশকিল। শেষকালে ঘন্টা দুয়েক ঘোরাঘুরির পর এক বুড়ো বলল, “ও তো জিমির ফার্ম। সম্প্রতি নাম বদলেছে।” অবশেষে পৌঁছলাম ঠিক জায়গায়। সত্যিই কোথাও হোটেলের নাম লেখা নেই, কোনো সাইন বোর্ড, বিজ্ঞাপন বা দিকচিহ্ন নেই। হোটেলের ভেতরেও কাগজপত্রে, বাসনকোসনে, এমনকী বেয়ারাদের উর্দিতেও কোনো নাম লেখা নেই। জিগ্যেস করলে ওরা মুচকি হাসে, মনিবের ইচ্ছা।

তাঁবুর ভিতর
নামের গোলমাল ছাড়া হোটেলের আর সবকিছুই নিখুঁত সুন্দর। কিছু ঘর পাকা, কিছু তাঁবু খাটানো। কিন্তু তাঁবু বলে আরামের কোনো কমতি নেই। পুরো এয়ার কন্ডিশন, লাগোয়া বাথরুম, গরম জল সব সময়। সামনে জালি দেওয়া বারান্দা। হোটেলের চারদিকে বাগান, চাষখামার, ফলের অর্চার্ড ও জঙ্গলে বুনো ফুলে ও পাখিতে ভর্তি। আমি তো পাখি দেখেই আত্মহারা। কে সিংহের খোঁজে যায়!
খাওয়া দাওয়ারও এলাহি ব্যবস্থা। ভারতীয় থেকে বিলিতী খানা--অর্ডার দিলেই গরম গরম রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসবে। আমরা ইচ্ছা ছিল স্থানীয় কাথিয়াওয়াড়ি-গুজরাটি খাবার টেস্ট করার। তাই আমরা ব্রেকফাস্টে পেলাম গরম হাতে-গড়া মেথি ঠেপলা--পরোটার মত, সঙ্গে সুখা আলু, পুরী ও নানা রকম আচার, চাটনির সম্ভার। দুপুরের খাওয়ায় দিল ভর্তু (বেগুনের ভর্তা), খিচড়ী, ও সঙ্গে দইয়ের কারি। পাতের পাশে এক বাটি গাওয়া ঘি--খিচুড়িতে ঢালবার জন্য। প্রচুর ঘি। দেখলাম সব কিছুতেই ঘি দেবার প্রচলন। আর খাবার তো সবই নিরামিষ।

জীপ সাফারি
পার্কের মধ্যে সাফারী শুধু জীপে চড়েই সম্ভব। পায়ে হাঁটা, হাইকিং, ট্রেকিং ইত্যাদি সব সখ্ৎ মানা। সাফারীর সময় সকাল ছটা থেকে ন’টা ও নটা থেকে বারোটা। তারপর দুপুরে খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রাম সেরে তৃতীয় ট্রিপ--তিনটা থেকে ছটা। প্রত্যেক ট্রিপের আলাদা টিকিট ও আগে থেকে রিজার্ভ করা দরকার। ভোর বেলাটা পাখি দেখার সব থেকে ভালো সময়। তাই অন্ধকার থাকতে থাকতেই ভোর ছ’টার ট্রিপে বেরিয়ে পড়লাম।
পুরনো ব্রিটিশ জমানায় গিরের জঙ্গল ছিল জুনাগড়ের নবাবদের শিকারভূমি। চুটিয়ে ব্রিটিশ ও নবাবী শিকারের ফলে সিংহের সংখ্যা মাত্র কুড়িতে পৌঁছেছিল। ব্রিটিশরাই সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। ১৯৬৫-তে ভারত সরকার জাতীয় পার্কের উদ্বোধন করেন। তখন সিংহ সংখ্যা মাত্র ১২৫। সম্প্রতিকালে ২০১০ ও ২০১৫ পরিসংখ্যায় দেখা যায় সিংহের সংখ্যা ২৭% বেড়ে গেছে। ভারতের অন্যান্য পার্কের তুলনায় এ এক অতুলনীয় সাফল্য। বর্তমানে এই ৫০০ বর্গমাইল পার্কে প্রায় ৫২৭ সিংহের বাস।


লেপার্ড, ও শিয়াল
পার্কে সাতটা শাখা-নদী থাকা সত্ত্বেও জমিজঙ্গল বেশ শুকনো। বেশিরভাগই বিশাল পাতাওয়ালা সেগুন (teak) গাছ। এছাড়াও আছে কাঁটাভরা acacia, flame of the forest এবং আরও অনেক নাম না-জানা গাছপালা। শীতের শুরুতে ঝরা শুকনো ও মাটির হলদেটে পাটকিলে রং এক্কেবারে হুবহু সিংহের গায়ের রঙের মত। প্রকৃতির এরকম ছদ্মবেশি কারসাজি দেখে অবাক হই। ঐ জঙ্গলে সিংহ যদি চুপটি করে বসে থাকে, কারুর সাধ্য নেই তাকে খুঁজে বার করে।
গিরের এক কোণে একটুখানি জমি আলাদা করে রাখা আছে। নাম দেবালিয়া। সেখানে বাসে করে আধঘণ্টার মধ্যে জঙ্গলে ঘুরে আসা যায়। টিকিট খুব সস্তা। যাঁরা জীপসাফারি করতে পারেন না তাঁদের জন্যই এই ব্যবস্থা। এটা একরকম দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মতই কিন্তু কপাল ভাল থাকলে সিংহমামার দেখাও পাওয়া যেতে পারে।


সম্বর, ও হরিণ (spotted deer)
সিংহ ছাড়াও পার্কে আছে সিংহের খাবার--নানারকম হরিণ, সম্বর, চিংকারা, নিলগাই, বুনো শুয়োর, বাঁদর ইত্যাদি। আছে সাপ, শেয়াল, বনবিড়াল, বেজী, নদীতে কুমীর। এছাড়াও আছে আরেক প্রধান খাদক--লেপার্ড। এরা নিশাচর। দিনে ঘুমোয়, তাই দেখা পাওয়া কঠিন। সিংহের চেয়েও এরা চতুর ও মানুষের ওপর আক্রমণ করতে দ্বিধা করে না। গাঁয়ের লোকেরা এদের সিংহের চেয়েও বেশি ভয় করে।


সানবার্ড (sunbird), ওয়াগ-টেল (wagtail)


পেঁচা, সানবার্ড (sunbird)

ল্যাপ-উইং (lapwing)
এসব ছাড়াও আমার প্রিয় পাখিদের সম্বন্ধে কিছু না লিখলে গিরের গল্প অসমাপ্ত হয়ে যাবে। পার্কে প্রায় তিনশ জাতির পাখি দেখা গেছে। শীতের মরসুমে পরিযায়ী পাখির ভিড় বেশ হয়। নানা জাতির ঈগল, পেঁচা, ময়ূর, কাঠঠোকরা, বাজ, শিকরা, ধনেশ, পিটা ও প্রচুর জলচর পাখিতে পার্কটা সদাই মুখর।
একবার আমরা সবাই জীপে ঠেলাঠেলি করে ঝোপের মধ্যে একটা সিংহীর ছবি তোলার চেষ্টা করছি, হঠাৎ নজরে পড়ল জীপের ঠিক সামনেই একটা ল্যাপউইং এক পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে স্থির চোখে চেয়ে রয়েছে। ভাবটা যেন-- একবার আমার দিকেও তাকাও একটু!

প্রাতঃভ্রমণরত সিংহী
আফ্রিকার সিংহদের তুলনায় গিরের সিংহের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে এরা মানুষখেকো নয়। সিংহদের সংখ্যা বেশ বাড়ছে। কোর এলাকা ছাড়িয়ে প্রায়ই এরা আশেপাশের গ্রাম, লোকালয়ে ঢুকে পড়ে ও দু-একটা গরু বা ছাগলও মেরে খায়। গাঁয়ের লোকেরা কিন্তু আশ্চর্যরকম ক্ষমাশীল। এরকম ক্ষতি তারা দেবীর বাহনের জন্য উৎসর্গ করা মনে করে। হয়ত এইজন্যই সিংহরাও গাঁয়ের লোকেদের প্রতি বেশ উদাস। এরকম পাশাপাশি সিংহ ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। (তা বলে জীপ থেকে নামবেন না কিন্তু।) দেশের অন্যান্য পার্কে বাঘ, হাতি, গণ্ডার ইত্যাদি সংরক্ষণের খবর খুব আশাপূর্ণ নয়। তাদের তুলনায় গিরের সিংহরা বেশ শান্তিতে আছে। হয়ত এইরকম সহাবস্থানই এদের ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায়।

জঙ্গলের রানি
(ভ্রমণকাল---নভেম্বর ২০১৭)