• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • একটি ছোট্ট শহরের ছোট্ট গল্প : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    মনওই শহর

    যাচ্ছিলাম পাখির খোঁজে। এখানে একটানা লম্বা শীতের পর একটু বাইরে বেড়াবার জন্য প্রাণ আনচান করে। এপ্রিল মাসটায় ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী হাঁস, বক, সারস, পেলিকান, পানকৌড়ি ইত্যাদি জলপ্রেমী পাখিদের আনাগোনা। সবাই দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলেছে। ওমাহা থেকে প্রায় তিনশো মাইল উত্তর পশ্চিমে একটা ভারি সুন্দর নদী নিওব্রারা, তারই আশেপাশে জলাজঙ্গল ভর্তি পাখির দল।

    এক ছুটির দিনে ফ্লাস্ক ভরতি চা, ক্যামেরা ও দূরবীন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ সুন্দর দিন, নরম রোদ্দুর, হাওয়ায় হাল্কা শীতের আমেজ, বেশ মনের আনন্দে ঘুরছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড-- Monowi--জনসংখ্যা-১! একটা শহরে মাত্র একজন বাসিন্দা? এ আবার কিরকম শহর? তাহলে তো পৃথিবীর সবথেকে ছোট্ট শহরই হবে, একজনের থেকে তো কম লোক হতেই পারেনা। এমন জায়গা কি না দেখে ফিরে যাওয়া যায়?

    ব্যাস, পাখি দেখা মাথায় রইল। আমরা সব কিছু ফেলে Monowi-র খোঁজে চললাম। জায়গাটা খুবই ছোট্ট--এক বর্গমাইল-এরও কম, একটা হাইওয়ে চলে গেছে মধ্যিখানে, তারই একপাশে ইতস্তত ছড়ানো ভাঙা, পরিত্যক্ত ছোট ছোট কয়েকটা বাড়ি, জানলার কাঁচ ভাঙা, ছাদে ফুটো, চারদিকে লম্বা আগাছার জঙ্গল। একজন বাসিন্দার শহরে এর থেকে বেশি কিই বা আশা করা যায়।


    এলসির বার
    আমরা গাড়িটা এককোণে আগাছার মধ্যে পার্ক করে ঐ একজন বাসিন্দার খোঁজে এদিকওদিক দেখছি হঠাৎ চোখে পড়ল শহরের একমাত্র আস্ত, চলনসই বিল্ডিং--Monowi Inn! তাও দেখি ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস’ তকমা আঁটা! দরজা ঠেলে দেখলাম খোলাই আছে, ভেতরে গোলাপি জামা পরা একজন টুকটুকে শাদা চুল অশীতিপর বৃদ্ধা--এলসি আইলার-- শহরের একমাত্র বাসিন্দা।


    এলসি আইলার
    Inn মানে ওই একটি বড়ো ঘর, একদিকে দেয়াল জুড়ে লম্বা বার, অন্য দিকে এলসির কাউনটার, কিছু সুভেনিরও আছে, আর আছে এলসির ছোট্ট রেস্তরা--সেখানে হ্যামবার্গার থেকে আলুভাজা, হটডগ ইত্যাদি যাবতীয় দরকারি খাবার পাওয়া যায়। ঘরের পাশে লাগা একটা ছোট কিচেন ও স্টোর। মাঝখানে ছড়ানো কয়েকটা টেবিল, চেয়ার আর চারদিকে দেয়াল ভরতি নানা রকম ছবি, পোস্টার ও সাইন সাঁটা।


    সুভেনির টি-শার্ট
    দুটো হ্যামবার্গার ও আলুভাজা সহ কফি খেতে খেতে এলসির সঙ্গে গল্প হল। ভদ্রমহিলা চুরাশি বছরের হলেও খুব টরটরে, অজানা অচেনা অতিথিদের প্রশ্নে বেশ অভ্যস্ত। দেয়ালে লাগানো পৃথিবীর নানা জায়গার লোকেদের ছবি। সত্যিই এলসির Inn-টি বিশ্ববিখ্যাত, দেশের তাবড় টিভি-- NBC (Today show), CBS (Sunday morning), Histoty Channel এমনকি BBC-ও এটা নিয়ে ছবি তুলেছে--পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম শহর হওয়া কি চাট্টিখানি কথা?


    এলসি-র সেন্স অফ হিউমার
    আকারে ছোট হলেও মনওই রীতিমত শহর। নেটিভ আমেরিকান ভাষায় মনওই মানে একধরনের ছোট্ট জংলি ফুল। ১৯০২ সালে এই শহরের পত্তন। ১৯৩০ সালে জনসংখ্যা সবথেকে বেশি, ১৫০ জন ছিল। তারপর কমতে কমতে এখন ১-এ ঠেকেছে। অনেক ছোটো শহরের মতোই নতুন প্রজন্মরা ভালো চাকরির আশায় বড় শহরে চলে যায়। ২০০০ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই--এলসি ও স্বামী রুডি। ২০০৪ সালে রুডি মারা যান। সেই থেকে এলসি একা। এজায়গায় অন্য সবার মত রুডির-ও ব্যবসা ছিল চাষের যন্ত্রপাতির। রুডিই এই বার-টা চালু করেন। এখানে স্কুলের তো দরকার-ই নেই, একটা পোস্ট অফিস ছিল, সেটাও ১৯৬৭-তে বন্ধ হয়ে যায়, থানা আর হাসপাতাল আছে কিন্তু দশ বারো মাইল দূরে পাশের শহরে। মনওইর মত আর দুয়েকটা ছোট্ট শহর আমেরিকায় আছে তবে এরকম স্থায়ী বাসিন্দা সহ শহর আর কোথাও নেই।


    রুডি-র লাইব্রেরি
    এলসির বার ও তাঁর নিজস্ব বাড়ি ছাড়া আর একটি মাত্র আস্ত বাড়ি হল রুডির লাইব্রেরি। একটা বড়ো ঘরের ভেতর মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত তাক ভর্তি প্রায় ৫০০০ পুরনো বই আর ম্যাগাজিন। এরও দেখাশোনা এলসিই করেন।

    অন্যান্য বড়ো শহরের মত মনওইতেও আছে মেয়র--এলসি নিজেই। আছে ট্যাক্স-দেনেওয়ালা--এলসি নিজেই নিজেকে ট্যাক্স দেন। বার চালাবার জন্য লিকর লাইসেন্সও তিনি নিজেই নিজেকে দিয়েছেন। বিনা লাইসেন্সে তো বার চালানো বেআইনি। হাইওয়ে ও তিন চারটি ট্রাফিক লাইট-এর দেখাশোনার জন্য সরকার থেকে টাকাও পান।

    কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? এলসির বয়েস চুরাশি। তাঁর এক ছেলে কিছুদূরে বড়ো শহরে থাকে, মনওই-এর ভার নেবার ইচ্ছে নেই। তাছাড়া নতুন করে সরকারী কাগজপত্র করাবার খরচও আছে। (আপনারা পাঠকেরা একটি ছোট্ট নিজস্ব শহরের অধিকারী হতে চান কি? তাহলে এই আপনার সুবর্ণ সুযোগ।)

    একজন বুড়োমানুষকে এরকম একা একা থাকতে দেখে আমার নিজেরই চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু দেখলাম এলসি-র প্রতিবেশীরা রোজ দোকানে এসে আড্ডা মারেন, কফি খান আর এলসিকে সঙ্গ ও উপদেশ দেন। দরকার পড়লে সব রকম সাহায্যও করেন। দোকানে আশেপাশের গাঁয়ের লোকেদের আনাগোনা লেগেই আছে। এবং সবাই সবাইকে চেনে। দেখে আশ্বস্ত হলুম যে এখনো এসব জায়গায় প্রতিবেশীদের দেখাশোনা করার চলটা বজায় আছে। এলসিকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে চললাম। আবার আদৌ দেখা হবে কিনা কে জানে।


    লাইব্রেরির ভেতরে





    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)