• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | উপন্যাস
    Share
  • ফরিয়াদ : সাবর্ণি চক্রবর্তী
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩


    গোবিন্দর যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়েছে। জানালার ঝাঁপটা খুলে গিয়েছে, শেষ শীতের ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে হু হু করে। যদিও একটু রোদও ঘরে এসেছে তাতে কিছুই বিশেষ কাজ হচ্ছে না, জোর শীত করছে গোবিন্দর। ও বৌএর ওপর রেগে গেল। মাগি নিশ্চয়ই ঝাঁপটা ভাল করে বন্ধ করে নি। কাঁথার বিছানায় উঠে বসল গোবিন্দ, আর তক্ষুনি ওর মনে পড়ে গেল। ওর কাছে কোন টাকাপয়সা নেই। প্রায় সারা মাসটাই এখনো পড়ে আছে--মাস না গেলে ও আর কাজও পাবে না, কাজেই কোন টাকাও পাবে না।

    ঘরের দরমার দেয়াল দুটো দিয়েও ঠান্ডা আসছে। সরকারি সাহায্যের টাকায় ঘর তুলেছে গোবিন্দ, কিন্তু পুরোটা বানাতে পারে নি। ঘরের চালটা যাও বা ছেয়েছে, দুটো-দেয়াল দরমা দিয়ে তৈরী করতে হয়েছে। আর তা তো হবেই--ওই সাহায্যের খানিক টাকা তো পেটেও খেতে হয়েছে। সব টাকাই হয়তো খেয়ে ফেলত, ঘরটা কিছুই হত না--যা হয়েছে সব প্রতিমার জন্যে। বৌটাই সব টাকা খর্চা হয়ে যেতে দেয় নি--গোবিন্দর হাত থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে দুটো মাটির দেয়াল তুলিয়েছে, ঘরের চালটাও তৈরী করিয়ে নিয়েছে।

    বৌটা এখন ঘরে নেই। অনেক দূরে একটা ইটভাটা আছে, সেখানে কাজ করতে গেছে। কাজটা হয়তো পেতো না, পেল্লাদ মণ্ডল ভাটার মালিককে বলে-কয়ে কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে। এ কাজ গোবিন্দ পায় নি। মালিক যত পারে মেয়ে মজুরনি রেখেছে--কারণ তাদের মজুরি কম। প্রতিমাও রোজ কাজ পায় না। একে তো ও একেবারে আনাড়ি, তার ওপর ও অল্পবয়েসি মজুরনিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানতালে কাজ করতে পারে না। ওদের হাত অনেক তাড়াতাড়ি চলে। কাজেই মাসের মধ্যে সাত দশ দিনের বেশি কাজ পায় না প্রতিমা। নদীর ওপারে পুলিসবাবুর বাড়ির কাজটা ওর আর নেই। পুলিসবাবুর চাকরিতে উন্নতি হয়েছে--বাবু চলে গিয়েছেন অন্য একটা বড় থানায়। সে জায়গাটা নাকি অনেক দূর--রেলে পুরো এক রাতের পথ। বাবুর গিন্নী প্রতিমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, প্রতিমাই যায় নি। তাহলে গোবিন্দ হয়তো বৌয়ের টাকায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে খাবে, কাজকর্মের চেষ্টাই বন্ধ করে দেবে। এমন কি একটা রাখেল মেয়েমানুষও জুটিয়ে ফেলতে পারে। সোয়ামিটাকে বিশ্বাস আছে কিছু?

    অবশ্য এমন নয় যে গোবিন্দ একেবারেই কোন কাজ করে না। ধনা ওকে যে আশ্বাস দিয়েছিল সেটা রেখেছে। ওকে মাটি কাটার কাজ দেয়। কিন্তু বেশি নয়, মাসে দু-তিন দিন। এ মাসে চার দিন পেয়েছিল, হাতে এসেছিল বেশ কয়েকশো টাকা। গতকাল--এই গতকালই তো ওর হাতে টাকাটা ছিল। কিন্তু মোটে কয়েক ঘন্টা। কয়েক ঘন্টা পরেই টাকাগুলো সব উড়ে গেল ট্যাঁক থেকে। কপাল, সবই কপালের খেলা।

    পরশুদিন কাজ শেষ করে ধনার থেকে একটা কাগজ পেয়েছিল গোবিন্দ। ঐ কাগজের পরচি দেখিয়ে সমবায় সমিতি থেকে টাকা নিতে হবে। সরকারি টাকা ধনার হাতে আসে না--যদি ধনা মজুরদের পাওনা না মিটিয়ে ঐ টাকার বেশির ভাগ নিজে মেরে দেয়? কিন্তু এসব ব্যবস্থা করেও কি ধনার হিস্যাটা আটকানো যায়? টাকা তোলবার পর ওর পাওনা এখানে এসে ওকে হাতে হাতে দিয়ে যেতে হয়। নইলে আবার ফিরে কাজ মিলবে কি করে? সরকার এতশত জানে কিনা গোবিন্দর জানা নেই--জানলেও বোধহয় সরকারের কিছু করার নেই।

    কাল সকাল সকাল এসে সমিতির বন্ধ জানালার সামনে লাইন দিয়েছিল গোবিন্দ। সমিতিটাও শহরে, নদীর ওপারে, এখানে আসার জন্যেও ভুটভুটির যাওয়া আসার ভাড়াটা গুনতে হয়। কাল সকালে ভুটভুটির প্রথম ফেরিটা ধরে নদী পেরিয়েছিল গোবিন্দ--তাড়াহুড়োতে সকালের বেগমোচনটাও ভাল করে করতে পারে নি। এত হুটোপাটি করে এসেও দেখে জানালার সামনে এরই মধ্যে লম্বা লাইন। ওর সামনের লোকগুলোকে মনে মনে গাল দিয়েছিল গোবিন্দ--এই সক্কালবেলাতেই এতগুলো লোক জুটে গেছে এখানে--শালারা এক রক্তবীজের ঝাড়।

    সমিতির সেই বন্ধ জানালা আর খোলেই না। সমিতিতে এখন টাকা নেই--ক্যাশবাবু গেছেন ব্যাঙ্কে, নগদ টাকা তুলে আনতে। বেলা প্রায় বারোটা, তখন এলেন একটা সাইকেল রিক্সায় চেপে, কোলের ওপর টাকার ব্যাগটা আঁকড়ে ধরা, পাশে বসা দোনলা বন্দুক হাতে পাহারাদার। তবে তক্ষুনি তো আর জানালা খুলবে না। ক্যাশবাবু একটু জিরোবেন, গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে একটু ঠান্ডা করে নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিয়ে কাপের চা-টুকু শেষ করবেন, বেশিরভাগ টাকা দেয়ালে গাঁথা শক্ত মোটা জগদ্দল পাথরের মত চেহারার লোহার বাক্সে ভরে সেটাকে দুটো বড়-বড় লম্বা লম্বা চাবি দিয়ে বন্ধ করে একটা চাবি ম্যানেজারবাবুকে দিয়ে দেবেন, তবে না বাকি টাকা নিয়ে জানালার সামনে এসে বসবেন। লাইন লম্বা, ক্যাশবাবুও তিনবার না গুনে কাউকে টাকা দেন না--কাজেই লাইন এগোয় শামুকের মত। গোবিন্দ যখন টাকা পেল তখন বেলা দুটো তিনটে হবে, শীতের রোদে মিইয়ে এসেছে, হাওয়ার ঠান্ডা ভাবটা অনেকটা বেড়ে গেছে।

    গোবিন্দর খিদে পেয়ে গিয়েছিল। টাকা হাতে পেয়েই ওর ইচ্ছে হল ঘরে চলে যায়। রাস্তায় ফেরিঘাটের দোকানটার থেকে কিছু খেয়ে নেবে। কিন্তু তা হবার জো নেই। একে তো ধনাকে টাকা দিতে আসার জন্যে আবার ভুটভুটি ভাড়া খরচা হবে, তাছাড়া ধনার নিয়ম--বেঁচে থাকো বা মরে যাও, যেদিন টাকা তুলবে সেদিনই ধনার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে। ভারী কড়া নিয়ম, কোন এদিক ওদিক করা চলবে না। সমবায় সমিতির ঠিক বাইরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। সমিতির বাবুরা ওখান থেকে চা কিনে খান, সঙ্গে খান দুই নোনতা বিস্কুট। বিস্কুটগুলো সবই নেতিয়ে যাওয়া নরম, অনেক দিন ধরে ওগুলো কাঁচের বৈয়ামে রাখা থাকে তো। গোবিন্দ ঐ দোকানে ছোট্ট এক ভাঁড় চা খেল। বিস্কুট নিল না। এক আধটা বিস্কুট খেয়ে খিদে মিটবে না, বরং বাড়বে।

    চা খেয়ে গোবিন্দ সোজা গেল যেখানে মাটি কাটার কাজ হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ধনাকে দেখতে পেল না। কাজের জায়গা থেকে একটু দূরে ভূঁইয়ে বসে আছে বুড়ো তারিণী মণ্ডল, আরামসে বিড়ি ফুঁকছে আর ধোঁয়া ছাড়ছে। ওর পাশে গাদা করে রাখা অনেকগুলো কোদাল আর মাটি বইবার ঝোড়া। অনেক মজুরেরই নিজস্ব ঝোড়া কোদাল নেই। তারিণী তাদের ঐ দুটো জিনিষ ভাড়া দেয়। তাদের এক এক খেপ কাজ শেষ হলে তারা তাদের মজুরির টাকা থেকে তারিণীর ভাড়াটা মিটিয়ে দেয়।

    গোবিন্দও কাজ চালায় তারিণীর কাছ থেকে ঝোড়া কোদাল ধার নিয়ে। ওরও তারিণীকে ভাড়ার টাকাটা দেয়ার কথা। ও এগিয়ে গেল তারিণীর দিকে। বেশ কয়েকটা দশ টাকার নোট। দিতে কষ্ট হয়--গায়ে লাগে। তবুও দিল। এই লেনদেনের ভেতর বেইমানির কোন জায়গা নেই। তারিণী ওকে খাতির করে পাশে বসাল, বিড়িও দিল একটা।

    বিড়িটা ধরিয়ে বেশ একটা সুখটান দিয়েছে এমন সময় গোবিন্দর চোখে পড়ল। একটা মেয়ে কামিন। বয়েস কম, দিব্যি স্বাস্থ্য। আবার মাজা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটে। মনে হল যেন নদীর পাড়ের দিক থেকেই এল। গোবিন্দ হাঁ করে ওকে দেখছিল। মেয়েটাও একবার ওর দিকে তাকাল, মুখ বাঁকিয়ে ওকে দূরছাই করার মত একটা ভঙ্গি করল, তারপর মজুরদের ভিড়ের ভেতর মিশে গেল।

    গোবিন্দ তাকাল তারিণীর দিকে। মেয়েটা কে হে? আগে তো দেখি নি। আশপাশের কোন গাঁয়ের থেকে এসেছে নাকি?

    তারিণী সব জানে, ও মেয়েটার সব খবর দিল গোবিন্দকে। মেয়েটা আর তার একটা আধবুড়ো বর একটা দূরের গাঁ থেকে এসেছে। গত কদিন ওদের কাজ ছিল না, তাই গোবিন্দ ওদের দেখতে পায় নি। আজ থেকে আবার ওরা কাজে লেগেছে। ধনার নেকনজর আছে ওদের ওপর--মাসের মধ্যে দশ দিন, বারো দিন করে কাজ পায় ওরা। আর তা হবেই বা না কেন? ধনা তো ওই মেয়েটার সঙ্গে শোয়--মেয়েটার বরটাই তো ওকে পাঠিয়ে দেয় ধনার কাছে। দিনের মধ্যে কোন একসময় মেয়েটা আর ধনা আড়ালে চলে যায়--ভালরকম পীরিত করে আসে। তবে ওরা একসঙ্গে যায় না, একসঙ্গে ফেরেও না। মেয়েটা এই এখন এল, ধনা আসবে আধঘণ্টাটাক পরে।

    গোবিন্দ ব্যাপারটা বুঝে নিল। ও জানে যে বেশ কিছু মজুর আর কামিন আছে যারা একটু দূর থেকে এখানে কাজ করতে আসে--ঝড়টার চোট ওদের গাঁয়ের ওপর দিয়েও গেছে তো। সন্ধের মুখে মুখে কাজ শেষ হয়, তখন পিচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে ছোট মাপের লরী, যাকে বলে ছোট হাতি। তার মাল বওয়ার জায়গায় হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে এসব মজুর। যে-সব গায়ে খাটা পুরুষ আর মেয়েছেলে শহর থেকে কাজ শেষ করে ফিরবে তারাও ওঠে। ঠাসগাদাই ভিড় হয় ছোট হাতিতে। দু-আড়াই ঘণ্টায় ঐ মালের গাড়ি তাদের পৌঁছে দেয় এমন সব জায়গায় যেখানে বাস ঢোকে না, ঢুকতে পারে না। পরের দিন সকালে একইভাবে কাজে আসে ওরা। ওই কামিনটা আর তার মরদটাও বোধহয় সেভাবেই এখানে যাতায়াত করে।

    তারিণীর দেয়া আর একটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে গোবিন্দ সব মজুরদের মাটি কাটার কাজ দেখছিল। শীতের বেলা পড়ে আসছে। আর মশার উৎপাতও বাড়ছে। একটা বড় সড় পুরুষ্টু মশা ওর চারপাশে ভনভন করছিল। এক সময় ওটা বসে পড়ল গোবিন্দর হাঁটুর নিচে উদলা পায়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দ একটা প্রচণ্ড চড় বসাল সেখানে। চড়ের চোটে পায়ের ওখানটা জ্বালা করে উঠল, কিন্তু মশাটা মরল - থেঁতলে লেপটে গেল ওর পায়ের ওপর। মশাটা মারতে পেরে ভারি আনন্দ হল গোবিন্দর, কিন্তু সেই সঙ্গে ওর একটু দুঃখও হল -- আহা একটা কৃষ্ণের জীব মারা গেল। তবে একথাও ঠিক যে ওর আয়ু ফুরিয়েছে, আর এই গোবিন্দ ভূঁইমালির হাতেই ওর মরণ লেখা ছিল। ওর আয়ু থাকলে কি গোবিন্দ আর ওটাকে মারতে পারত?

    হঠাৎ গোবিন্দর চোখে পড়ল একটা বুড়ো লোক কাজ করছে। লোকটা বোধহয় কেশোরুগী -- একটু কাজ করেই বসে পড়ে জিরোচ্ছে, খক খক করে কাশছে, থুতু ফেলছে, আবার উঠে কোদাল ধরছে। লোকটাকে যেন চেনা চেনা লাগে। গোবিন্দ ওকে ভাল করে দেখল -- ও হরি, এ বুড়ো তো পাঁচুর শউরো। ওকে দেখেছিল সেই পাঁচুর বিয়ের সময়। বরের সঙ্গে গোবিন্দও মেয়ের বাড়ি গিয়েছিল তো। ভাল খাইয়েছিল লোকটা। সেই খাওয়ার জন্যেই লোকটার মুখ এখনও গোবিন্দর মনে আছে। বৌ মরে যাওয়ার পর পাঁচু আর শউর শাউরির কোন খোঁজখবর রাখেনি। পাঁচুর শউরোটা একেবারে বুড়ো হয়ে গেছে। চেহারা আর নোংরা ছেঁড়া জামাকাপড় দেখে মনে হয় আজকাল ঠিকমত খেতে পায় না। তার ওপর আবার রোগে ধরেছে। একবার ভাবল চেনা দেবে। কিন্তু তারপরই ও চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিল। ও বুড়ো যখন জানবে গোবিন্দ পাঁচুর বন্ধু তখন ঘ্যান ঘ্যান করে নিজের দুঃখের সাতকাহন বলতে থাকবে। ওর দুঃখের কথা শুনতে গোবিন্দর তো কোন দায় পড়ে নি। তবে ও দুঃখী একথা ভেবে গোবিন্দ মনে মনে একটু আরাম বোধ করল। নিজের চাইতে আর একটা লোক বেশী দুঃখী হলে নিজের দুঃখটা একটু কম মনে হয় -- বিশেষ করে লোকটা যদি চেনা হয়।

    তারিণী একেবারে ঠিক বলেছিল। ধনা এল বেশ কিছুক্ষণ পরে। আধঘন্টা মতই হবে। এক বুক দু:খ নিয়ে ধনার পাওনা ওর হাতে দিল গোবিন্দ। চট করে টাকা কটা নিয়ে সেগুলো পকেটে পুরে ফেলল ধনা। তারপর খুব গম্ভীর মুখ করে গোবিন্দকে বলল, সামনের মাসের গোড়ায় আসিস।

    গোবিন্দর এটা জানাই ছিল যে সামনের মাসের আগে আর কাজ পাবে না। কিন্তু সোজা ধনার মুখ থেকে কথাটা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। ওর যদি ওই কামিন মেয়েটার মত একটা বৌ থাকত। মনে মনে প্রতিমাকে মেয়েটার পাশে দাঁড় করায় গোবিন্দ। না:, প্রতিমার বয়েস চলে গেছে--তাছাড়া আধপেটা খেয়ে গাল ভাঙা, দু চোখ গর্তে বসা, দু-বাচ্চার মায়ের ভরা বুকও শুকিয়ে চুপসে গেছে। গোবিন্দ চিন্তাটা মন থেকে তাড়াল। প্রতিমাকে দিয়ে একাজ হবার নয়--অনর্থক এসব কথা ভেবে লাভ নেই।

    ভুটভুটির ফেরিঘাটে যেতে যেতে সন্ধে হয়ে গেল। শীতের বিকেল চট করে ফুরিয়ে যায়। ঝপ করে দিনের আলো যায় নিভে। সেখানে দেখা হয়ে গেল অমূল্যের সাথে। অমূল্য গোবিন্দরই গাঁয়ের লোক, গোবিন্দর সঙ্গে ও-ও মাটি কাটার কাজ করছে, আজ সমিতি থেকে টাকা তুলেছে। ওকে দেখে অমূল্য দাঁত বার করে একগাল হাসল। গোবিন্দ ওর মুখ থেকে ভেসে আসা এক ঝাপটা দিশি মদের গন্ধ পেল, সেই সঙ্গে পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ। শালা টাকা পেয়ে ভালরকম মাল টেনেছে, তার সঙ্গে খেয়েছে মদের চাট।

    দাঁত বার করে রেখেই অমূল্য ওর পকেট থেকে কতগুলো একশ টাকার নোট বার করে দেখাল। বলল এই দ্যাখ, আজ রোজগার করেছি মোটে দুঘণ্টায়। অমূল্য গোবিন্দর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল--গোবিন্দর নাকে আসা মদের গন্ধ তীব্র, জোরালো হয়ে উঠল। গলা নিচু করে অমূল্য আবার বলল, তাস খেলে, স্রেফ তাস খেলে।

    গোবিন্দর হিংসে হচ্ছিল ওর ওপর। একবার ভাবল বলে দেয় -- তোর রোজগারের টাকা আমাকে দেখাচ্ছিস কেন? তুই কি আমাকে টাকা দিবি? কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারল না, খালি রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে রইল অমূল্যের দিকে।

    অমূল্যই ফের কথা বলল। ফেরিঘাটের পেছনদিকে একটা ছোট গলি, সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, যাবি নাকি ওখানে?

    গোবিন্দ চেনে, সেই গলিতে মদনের চায়ের দোকান। দোকানটা বড়--বাইরের দিকে চা, বিস্কুট, পুরনো বাসী কেক বিক্রী হয়। ভেতরটা দিশি মদের ঠেক--আর জুয়োর আড্ডা। গোবিন্দ মাঝেমধ্যে দোকানের বাইরের দিকে পাতা লম্বা বেঞ্চিতে বসে চা বিস্কুট খেয়েছে, আর খুব লোভ লাগলে এক টুকরো কেক। ভেতরে ঢোকার সাহস পায় নি কখনো। কিন্তু এখন ওর সামনে অমূল্য একশ টাকার নোট মেলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আর ওর নিজের পকেটেও খেলার জন্যে কিছু রেস্ত আছে। একটা বিরাট লোভ ওর সামনে অমূল্যর চেহারা নিয়ে দাঁড়ানো। তবুও গোবিন্দ ঠিক সাহস পায় না। অমূল্যর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায়, তারপর বলে, খেলব? যদি হেরে যাই?

    অমূল্য মুখ বাঁকাল। বলল, হারবি কেন? এতটুকু সাহস নেই তোর? মরদ নোস তুই?

    পৌরুষের অপমানটা খুব জোর গোবিন্দর গায়ে লাগল। ভয়টা ভেঙ্গে গেল। লোভটাও আরও অনেক বেড়ে উঠল। ও অমূল্যকে বলল, ঠিক হ্যায়, চল্‌, যাবো ওখানে। তুইও চল্‌, আয়, দ্যাখ আমি কি করি।

    তারপর অমূল্যর আগে ও নিজেই ওই গলির দিকে পা বাড়িয়ে দিল।

    তিন তাসের খেলা। মেঝের ওপর বড় মাদুর পাতা, তার মাঝখানে খবরের কাগজ ভাঁজ খুলে মেলে রাখা আছে। ঐ কাগজের ওপর বাজির টাকা পড়ছে, তার চারপাশে খেলুড়েরা বসা। আরও অনেক লোক তাদের পেছনে বসা, দাঁড়ানো। গোবিন্দ বসে পড়ল--সবাই হৈ হৈ করে ওকে খেলায় ডেকে নিল। অমূল্য বসল গোবিন্দর পেছনে। ও খেলবে না, গোবিন্দর জন্যে বড় নোট ভাঙিয়ে ছোট ছোট নোট দেবার ব্যবস্থা করবে। মদনই ছোট নোটের জোগান দেয়--একশ টাকার নোট দিলে ন খানা দশ টাকার নোট। বাকি একটা নোট ওর পাওনা। ছোট ছোট বেশ কিছু কাছে না থাকলে বাজির দান ফেলতে অসুবিধে হয়--গোবিন্দ তো আর খেলবে বলে সেভাবে তৈরী হয়ে আসে নি।

    গোবিন্দ এ খেলা আগে কয়েকবার খেলেছে--হারজিৎ কিছুই বিশেষ হয় নি। কিন্তু আজ যে ওর তাসের হাত এত ভাল হবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি। তিনটেই এক রঙের তাস--মার দিয়া কেল্লা! একটা টাকার গাদা চলে এল ওর কোলে। তিনটে গোলাম--এবার তিন রঙের। কিন্তু একেবারে মোক্ষম জিতের হাত। দু একবার হারল, কিন্তু গায়ে লাগল না--মোটের ওপর ও জিতেই চলেছে। বাকি খেলুড়েরা একটু বাঁকা, একটু রাগের চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। আর সেরকম তো তাকাবেই--একই লোক বেশি বেশি করে জিতে যাচ্ছে, বাকি যারা তাদের হিংসে তো হবেই। গোবিন্দর পাশে বড় এক ভাঁড় ভর্তি দিশি, তার সঙ্গে শালপাতার থালাভর্তি ডালের আর পেঁয়াজের ঝালবড়া। মদন দিয়ে গেছে। গোবিন্দ এর মধ্যেই দু-ভাঁড় খেয়ে ফেলেছে। এটা তিন নম্বর--মদন তাক বুঝে গোবিন্দর ভাঁড় ভরে ভরে দিচ্ছে। এবার কি তাস--আরে: রাজা, সাহেব, বিবি আর গোলাম। গোবিন্দর একটু আপশোষ হল--অত তাড়াতাড়ি হাতের তাস দেখে নিয়ে দান শেষ না করে দিলেই হত। এক একটা দান শেষ হচ্ছে, গোবিন্দ কাগজের ওপরের টাকাগুলো নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ওকে বাহবা দিয়ে একটা হৈ হৈ হররা উঠছে--

    একটা নয়া আদমী খেলতে বসেছে, আর দারুণ টাকা জিতে নিচ্ছে। অমূল্যও ওর পিঠে ছোট ছোট আদরের চাপড় দেয়--খেলে যা গোবিন্দ, খেলে যা--আজ তুই রাজা--তোকে আজ মারে কে? এখন গোবিন্দর পেটের ভেতরটা গরম গরম লাগছে--মাথাটাও গরম—তিন-ভাঁড় তাড়ি ওর সারা শরীরে ছুটে বেড়াচ্ছে। এবার ও হাতের তাস না দেখে খেলে যাবে--এক বাজিতেই হাজার টাকা জিতবে। আর, আর--ও আজ বাড়ি ফিরবে না—হীরু-জ্যাঠার ছেলে ঐ যেরকম মেয়েমানুষ রেখেছে, সেরকম একটা কচি কিন্তু ডবকা, নরম সরম মেয়ের সঙ্গে রাত কাটাবে। আর করবেই বা না কেন--পকেটে টাকা এলেই তো পুরুষমানুষের এসব করার অধিকার তৈরী হয়ে যায়। ঘরের বৌটা তো সতেরো-আঠেরো বছরের বাসী পান্তাভাত--তাও তো খাওয়া মুস্কিল--যে ঘোড়ার মত চাট ছোঁড়ে। আজ ও সারারাত ধরে পোলোয়া-কালিয়া খাবে। তাসের দেবতা যখন ওর ওপর দয়া করেইছে তখন ও আজ রাতে ফুর্তি করতে ছাড়বে কেন?

    পরের বাজি খেলল গোবিন্দ--হাতের তাস না দেখে--যত জিতেছিল সব লাগাল, নিজের মাটি কাটার টাকাটাও। এখন ওর ভীমের মত বুক, সেই বুকভর্তি দুর্ধর্ষ সাহস--ও জানে ও জিতবেই। কম করে হাজার টাকা তো হবেই--দেড় দু হাজারও হয়ে যেতে পারে। অমূল্যর কথাটাই নিজেকে একবার মনে মনে শুনিয়ে দিল, ঘাবড়াও মৎ গোবিন্দ--খেলে যাও।

    ওদিকের শেষ খেলোয়াড় হাত উল্টে দান শেষ করে দিল--এবার ওকেও দান শেষ করতে হবে--তাস ওল্টাতে হবে।

    কিন্তু, কিন্তু একি? হে বাবা ভগবান, হে মা বনবিবি, হেই বাবা গাঁ থেকে নিউদ্দিশ নোটনক্ষ্যাপা--একি তাস? আলাদা আলাদা রঙের তাস--দুরি, তিরি আর একটা ছক্কা। গোবিন্দর কপালে তো একেবারে ফক্কা। সব জেতা টাকা গেল--সেই সঙ্গে উড়ে গেল মাটি কেটে রোজগারের টাকাটাও। এখন কি হবে? কি করবে এখন গোবিন্দ?

    গোবিন্দর সামনে কাগজের ওপর এলোমেলো ছড়ানো টাকাগুলো ওর উল্টোদিকে বসা কালোমত তাগড়া চেহারার লোকটা দুহাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। ফ্যালফ্যাল করে বোকার মত তাকিয়ে সেটা দেখল গোবিন্দ। একটা বোবা কষ্ট ওর বুকের ভেতরটা মুঠো করে চেপে ধরল--কষ্ট, কষ্ট, আঃ, আহা রে--বড় কষ্ট। চারপাশের লোকজনের গোলমাল করা গলার আওয়াজ ওর কানে আসছিল--হেরে গেছে--জব্বর হেরে গেছে লোকটা। ও বুঝতে পারছিল এবার ওর উঠে পড়া উচিত, কিন্তু ও উঠে দাঁড়াতে পারছিল না--ওর বুকের পাঁজরাগুলো কি সব মটমট করে ভেঙ্গে গেছে? ঠিক সে সময়তেই মদন এসে ওর গলার কাছে জামা মুঠো করে চেপে ধরল--এই শালা, এতটা দিশি খেয়েছিস, ঝালবড়া খেয়েছিস, তার দাম কে দেবে? আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লোকজন আবার হৈ হৈ করে উঠল--জোর প্যাঁদানি খাবে শালা, মদন ওর খাল খিঁচে দেবে।

    কপাল ভাল, অমূল্যটা ছিল--গোবিন্দকে একা এখানে রেখে বাড়ি চলে যায় নি। অমূল্যরে এবারটা আমায় বাঁচা--মালের দাম, ঝালবড়ার দামটা দিয়ে দে। নইলে আজ আমার কপালে লাগদুমাদুম মার রয়েছে। সে মার খেলে আমি কি আর বাঁচব? আমার মরার পাপ তোরও লাগবে--আমাকে দিয়ে জুয়ো খেলিয়ে মার খাইয়ে মেরে ফেলেছিস--সেই পাপ। সে পাপ করিসনে বাপধন, মদনার টাকাটা ওকে ফেলে দে।

    অমূল্য টাকাটা দিয়ে দিল। তবে ধার হিসেবে। একশ বাহাত্তর টাকা। মাসে শতকরা দশ টাকা সুদ। ভুটভুটির ভাড়াটাও সেভাবেই দিল। তবু তো দিল--তা নাহলে ওই শীতের রাতে গোবিন্দর ঘরে ফেরা হত না--ফেরিঘাটে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হত।

    ফেরিঘাট থেকে অমূল্য চলে গেল--ওর ঘরের রাস্তা অন্যদিকে। গোবিন্দ একাই হেঁটে চলল ওর নিজের ঘরের দিকে। চারপাশ ঘোর অন্ধকার, এতটা মাল খেয়ে ফেলেছে বলে গোবিন্দর একটু একটু মাথা ঘুরছে, নিজের ঘরের রাস্তাটাও চিনতে ভুল হয়ে যাচ্ছে। শালার চাঁদটাও ওঠেনি এখনও--বোধহয় এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। সামনে একটা ঘরের উঠোন--একটা মেয়েমানুষকে আবছামত দেখা যাচ্ছে--ওটা প্রতিমা নয়? হ্যাঁ, প্রতিমাই তো মনে হচ্ছে। দু পা সেদিকে এগোল গোবিন্দ। মেয়েছেলেটা ঘরে ঢুকে পড়ল--না না, ওটা প্রতিমা নয়। মেয়েছেলেটা দিব্যি মাজা দুলিয়ে হেঁটে গেল--আর প্রতিমার মাজা তো না খেয়ে খেয়ে শুকনো--হাঁটার সময় তা আর দুলবে কি করে? তার মানে ও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল--আর ঢুকে পড়লেই সর্বনাশ হয়েছিল আর কি। এই রাতে মুখে আর সারা গায়ে দিশি মালের গন্ধ নিয়ে অন্য লোকের ঘরে ঢুকে পড়লে আর দেখতে হত না--জব্বর পিটাই জুটত কপালে। গত ঝড়টায় ছোট বয়েস থেকে চেনা সব ঝোপঝাড়, গাছপালা হাপিশ হয়ে গেছে--চারপাশ এখন খোলামেলা, এখানে ওখানে দাঁড়ানো সব ঘরগুলোও অন্ধকারে একই রকম দেখতে মনে হয়।

    শেষপর্যন্ত নিজের ঘরটা খুঁজে পেল গোবিন্দ। দুটো দেয়াল মাটির আর বাকি দুটো দরমার, এরকম ঘর ধারে কাছে আর নেই। এই তো, সামনেই তো ওর দরজার ঝাঁপটা, সেটাও খুঁজে পেয়েছে গোবিন্দ। ঘরের ভেতর কোন আলো নেই--বৌ আর ছেলে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

    ঝাঁপটা ঠেলল গোবিন্দ। ঝালবড়া অনেক খেয়েছে--ওর এখন খিদে নেই। পা দুটো অল্প অল্প টলছে, দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে, ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে। ঠেলা খেয়ে ঝাঁপ খুলল না। বৌটা ভেতর থেকে আগল লাগিয়ে দিয়েছে। জড়ানো গলায় গোবিন্দ হাঁক পাড়ল, পোতিমা ও পোতিমা--ওরে শালা বুদ্ধি রে--

    ঘরের ভেতর একটা হাল্কা আলো জ্বলে উঠল। বৌটা জেগেছে, ঘরের কুপিটা জ্বেলেছে। পা টা আবার টলে গেল, দরজার খুঁটি ধরে নিজেকে সামলে নিল গোবিন্দ।

    ঝাঁপটা খুলে গেল, সামনে কুপি হাতে দাঁড়ানো প্রতিমা। ওর নাক মুখ কুঁচকে গেল, গোবিন্দর মুখে দিশির গন্ধ--সে তো চাপা পড়ার নয়। গোবিন্দকে ঘরে ঢুকতে দিল প্রতিমা। তারপর দরজার ঝাঁপ বন্ধ করে আগল লাগিয়ে দিয়ে গোবিন্দর দিকে ফিরল। গোবিন্দ ততক্ষণে ওর মাদুর আর কাঁথার বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

    প্রতিমা জানে গোবিন্দ আজ টাকা আনতে গিয়েছিল। বলল, আসবার সময় তো মদ টেনে এসেছিস, বাকি টাকাটা দে। টাকা না হলে কাল থেকে হাঁড়ি চড়বে না।

    গোবিন্দ শুয়ে শুয়েই জড়ানো গলায় উত্তর দিল, টাকা নেই।

    কেন, নেই কেন? প্রতিমা কড়া গলায় জিগ্যেস করল। তোর কাছে মদ খাবার টাকা থাকে, ঘরে দেবার জন্যে টাকা থাকে না কেন?

    গোবিন্দ প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিল, প্রতিমার ক্যাটক্যাটে গলা কানে যেতে ওর ঘুমভাবটা কেটে গেল। ও-ও ঝাঁঝালো গলায় বলল, রাতের বেলা ঝামেলা করিস নে মাগি, ঘুমুতে দে। একবার বলে দিয়েছি তো, টাকা নেই। আবার বিরক্ত করলে মার খাবি।

    প্রতিমা এবার ফেটে পড়ল, হারামজাদা, মদ গিলে ঘরে ফিরতে তোর লজ্জা করে না? যা টাকা আজ পেয়েছিস তা কোথায় গেল? কোন রেন্ডির সঙ্গে শুয়ে এসেছিস আজ? সেখানেই যা, ঘরে এসেচিস কোন মুখে? রাস্তার বেশ্যার পেছনে তুই টাকা ঢালবি আর আমি গতরভাঙা কাজ করে তোকে খাওয়াব? বেরো, বেরো, বেরিয়ে যা ঘর থেকে। শীগগীর বেরো, নইলে খ্যাংরা মেরে তোকে তাড়াব।

    টক করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল গোবিন্দ। ওর এখন রাগ হয়েছে। বেশ্যাবাড়ি ও যায় নি--যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু যেতে পারে নি, সেই দু:খটা ও ভুলতে পারে নি। ওর টাকা নষ্ট হয়েছে অন্য কারণে। অন্যেয্য অভিযোগ করার জন্যে ওর তো বৌয়ের ওপর রাগ হতেই পারে। আর যেহেতু ও পুরুষমানুষ ও কি আর সত্যি ঘটনা বুঝিয়ে বলে বৌয়ের ভুল ভাঙাবার চেষ্টা করবে? তাতে তো পৌরুষের অপমান হবে। তার ওপর বেশ্যাবাড়ি যেতে না পারার দু:খটাকে প্রতিমা আবার আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দিয়েছে। কাজেই এখন ওর পক্ষে উচিৎ কাজ হবে বৌটাকে একটা জব্বর মার দেয়া। নিজের এই যুক্তিকে মেনে নিয়ে গোবিন্দ বৌ এর ওপর চড়, থাপ্পড়, লাথি, কিল চালাতে থাকে। এখন বৌকে মার দেয়ার সুবিধে আছে, প্রতিমার সেই আগের পুলিস মনিব তো আর এ তল্লাটে নেই। কিন্তু ওর নেশার জন্যে মারগুলো খুব একটা জোরালো হচ্ছিল না। আর তাতে গোবিন্দ নিজের ওপরেও রেগে যাচ্ছিল--বৌটাকে ভালরকম পিটাই করা হচ্ছে না। প্রতিমা চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খাবার মেয়েমানুষ নয়--ও-ও পাল্টা হাত চালাচ্ছিল আর খুব শীগগির নিজে বিধবা হওয়ার জন্যে ভগবানের কাছে চিল চীৎকার করে আবেদন জানাচ্ছিল। এই মারপিটের শারীরিক কসরতের ফলে গোবিন্দর শরীরের ভেতরের দিশি মদ এবং ডাল আর পেঁয়াজের ঝালবড়ায় নড়াচড়া পড়ছিল। গোবিন্দ হড়হড় করে বমি করে দিল--তার বেশিরভাগটা পড়ল ঘরের মেঝেতে, আর অল্প কিছু প্রতিমার গায়ে। লাফিয়ে সরে গেল প্রতিমা--ওর বিধবা হওয়ার ইচ্ছেটা আরও জোরালো ভাবে ভগবানকে জানাতে লাগল। গোবিন্দ শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়, আর বৌয়ের চীৎকার শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকাতে লাগাল। ওদের ছেলেটার ঘুম এই চেঁচামেচি গোলমালেও ভাঙে নি--ঘুমিয়ে কাদা হয়েই ছিল, ওর বিছানাটা রোজকার মত ওর হিসিতে ভেজা।

    তারপর আজকের এই সকাল। গোবিন্দ বিছানায় উঠে বসে ঘরের চারপাশে নজর করছিল। ওর কালকের বমি পরিষ্কার করা হয়েছে, যদিও দু এক জায়গায় একটু একটু বমির দাগ লেগে আছে। বৌটাই সব সাফা করেছে--আর কে করবে। ওর খুব ঘেন্না লেগেছে নিশ্চয়ই, তবুও যতটা পারে সাফসুতরো করেছে। কি আর করবে। মেয়েমানুষ তো আর নিজের ঘর নোংরা রাখতে পারে না। গোবিন্দ উঠে দাঁড়াল--পেটের ভেতর খিদের খোঁচা। কাল সন্ধেবেলা যা পেটে পড়েছিল সবই তো রাতে বমি হয়ে বেরিয়ে গেছে। বৌটা খাবার কিছু রেখে গেছে কি? গোবিন্দর তো এখন উপায় নেই--সারা মাস বৌয়ের রোজগারেই খেতে হবে--যদি অবশ্য খাবার জোটে। ভাতের হাঁড়িটা ওর চোখে পড়ল। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল সেটায় ভাত রয়েছে, আর হাঁড়ির পাশে একটা মাটির সরায় একটু নুন আর লঙ্কা। মুহূর্তে বৌয়ের ওপর খুশি হয়ে উঠল গোবিন্দ। হাজার হোক, মন্তর পড়ে মালাবদল করা ইস্তিরি, তাকে পেটাই করো কি গায়ে বমি করো, সে সোয়ামীর জন্যে ভাত রান্না করে দেবেই।

    ছেলেটা ঘরে নেই। নিশ্চয়ই ওর মা কাজে বেরোবার আগে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। আর হারামজাদাটা তার পরেই খেলতে বেরিয়ে গেছে। কাজেই এই ভাত পুরোটাই গোবিন্দর জন্যে। কিন্তু খাবারে তক্ষুনি হাত লাগাল না। মাথাটা একটু ব্যথা করছে, কাল সন্ধেবেলা নেশা করার জের। পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে বেশ আরাম করে খাওয়া যাবে।

    ভাতটা খেতে বিশেষ ভাল নয়। তার কারণটা গোবিন্দ জানে। এই চাল প্রতিমা বিপিন মুদীর পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে-চিনতে এনেছে--পোকায় খাওয়া খুদ-মেশানো একেবারে মোটা চাল। খিদের মুখে ঐ ভাতই গ্রোগ্রাসে খেয়ে নিল গোবিন্দ। এতক্ষণে পেটের শান্তি। এঁটো ভাতের হাঁড়ি ঘরের এককোণে রেখে দিল। প্রতিমা এসে সব ধুয়ে পরিষ্কার করবে--সেটা ও জানে।

    দরজার ঝাঁপ ঠেলে একটা মানুষ ঘরে ঢুকে এল। বাইরে দিনের আলো, কিন্তু জানালাটা দিয়ে বিশেষ আলো আসে না বলে ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার। গোবিন্দ প্রথমে বুঝতে পারে নি কে এই লোকটা। তারপর চিনল। পাঁচু। সেদিনকার মতই গায়ে ভদ্দরলোকের ধোপদুরস্ত জামা কাপড়, পায়ে পালিশ করা ভাল জুতো, চোখে কালো রোদ চশমা। ঝট করে চেনা শক্ত। ছোটবেলার বন্ধু, ঘরে এসেছে অতিথ হয়ে--গোবিন্দ বলল, আয় পাঁচু, আয়। কিন্তু কথাটা বলেই গোবিন্দ ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল--পাঁচুকে কোথায় বসতে দেয়া যায়? ভদ্দরলোক বাবুসাহেব পঞ্চানন--ওকে তো বসবার জন্যে চেয়ার-টেয়ার দেয়া উচিত। গোবিন্দর ঘরে সে-সব দূরস্থান, বসতে দেবার জন্যে একটা আসন পর্যন্ত নেই।

    গোবিন্দ বসে আছে নিজের নোংরা, ছেঁড়া বিছানায়--সেটার আবার একপাশে খানিকটা জায়গায় শুকিয়ে যাওয়া বমির দাগ। পাঁচুকে সেই বিছানায় বসতে বলা--মুশকিলের ব্যাপার, খুবই মুশকিল।

    পাঁচু ঘরে ঢুকে এসে ঐ বিছানাতেই বসল--বমি শুকিয়ে থাকা জায়গাটা বাঁচিয়ে। আর তো বসার জায়গা নেই। নিতম্ব রাখল বিছানায়, আর জুতোসুদ্ধ দু-পা ছড়িয়ে দিল সামনে মাটির মেঝের ওপর। জুৎ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।

    গোবিন্দ জুলজুল করে তাকিয়ে ওর সিগারেট খাওয়া আর ধোঁয়া ছাড়া দেখছিল। আজ ওকে দেখে বোধহয় পাঁচুর মায়া হল, ওর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরল। ও আবার সিগারেট ধরানোর জন্যে একটা ছোট পকেটে রাখার যন্তর কিনেছে, তাই দিয়ে গোবন্দর ঠোঁটে ধরা সিগারেট ধরিয়ে দিল।

    খানিকটা ধোঁয়া গিলে, বার কয়েক কেশে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল গোবিন্দ। বিড়ি টানা অভ্যেস, হঠাৎ সিগারেট খেতে গেলে একটু অসুবিধে তো হবেই। ধোঁয়াটা মুখের ভেতর একটু সামলে নিয়ে পাঁচুকে বলল, তোর ঐ যন্তরটা তো বেড়ে জিনিষ রে।

    বিদেশী মাল, বেশ একটু গর্বের সুরে বলল পাঁচু। কোরিয়াতে তৈরী--চোরা চালান হয়ে আমাদের দেশে আসে। আমি চোরাবাজারে কিনেছি--তাতেও বেশ দাম লেগে গেছে।

    গোবিন্দ চুপ করে রইল। কোরিয়া কি বস্তু -- খায় না মাথায় দেয়, তা ওর জানা নেই।

    জিনিসটা অবশ্য আসলে কোরিয়াতে তৈরি নয়, একেবারেই দু নম্বরী নকলি বাজে মাল। তবে পাঁচু কোনদিনই জানবে না যে ও মোটা দাম দিয়ে যন্ত্রটা কিনে ভীষণ ঠকে গিয়েছে। ও ফোরিন জিনিস ব্যবহার করছে, তাই ও বিশ্বাস করে যাবে। বিশ্বাসে মিলয়ে সিগারেট লাইটার, তর্কে বহুদূর।

    আরও খানিকটা ধোঁয়া ছাড়ল পাঁচু--সেই ধোঁয়া গোবিন্দর বদ্ধ ঘরটার ভেতর তাল পাকিয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। তারপর পাঁচু বলল, কাল রাতে তোর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম--তখন জোর চিল্লামেল্লি শুনতে পেলাম। পোতিমার গলাও শুনলাম। কি ঝামেলা হয়েছে রে?

    গোবিন্দ পুরো কাহিনীটা বলল। সব টাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে তাই প্রতিমা ক্ষেপেছে। এদিকে হাতে একটা পয়সা নেই। প্রতিমা যে-কটা টাকা পাবে তাতে তিন তিনটে পেট চলবে কি করে?

    পাঁচু মুখের ভেতর জিব দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করা সহানুভূতি জানায়। বলে, তাহলে তুই তো খুব জোর মুস্কিলে পড়েছিস রে। তোর তো এক্ষুণি কোন কাজকর্ম পাওয়ার দরকার।

    গোবিন্দ মুখটা করুণ করে নিজের হাত উল্টে দিল। বলল কাজ কোথায়? চাষের কাজ বন্ধ হয়ে থেকেই তো দেশে কাজের আকাল পড়েছে। তোর খোঁজে কিছু আছে নাকি? জুটিয়ে দে না কিছু একটা।

    আবার ধোঁয়া ছাড়ল পাঁচু। এবারে আরও লম্বা ধোঁয়া। ঐ ধোঁয়ার আড়াল থেকে বলল, ব্যাপারটা কি জানিস, আমি আজকাল ওসব কাজকর্মের কোন খোঁজ রাখি না। আমার তো দরকার হয় না।

    তারপর পাঁচু দু-আঙ্গুলে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখে বলে গেল ওর নিজের কথা--ও যে কত ভাল আছে সেই গল্প। গোবিন্দ মুগ্ধ হয়ে শুনল। কি সুন্দর মুরুব্বিয়ানা ভাব নিয়ে কথা বলে পাঁচু--ঠিক যেন সরকারি আপিসের বাবু, টেবিলের ওধারে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভারিক্কি মেজাজে কথা বলছে। একটা বড় ব্যাপার করে ফেলেছে পাঁচু। ও ওর রাখেলটাকে ওর বাঁধা মেয়েমানুষ করে নিয়েছে--মেয়েটাকে রাখবার জন্যে ঐ পট্টিতেই একটা আলাদা ঘর ভাড়া করে নিয়েছে। খরচা কিছু হয়েছে, তবে সেটা ওর গায়ে লাগেনি। গোবিন্দ বুঝতে পারছিল পাঁচুর বড় আনন্দ, বড় সুখ হচ্ছিল এসব কথা বলার সময়। নিজের মুখে অন্য কাউকে বলতে পারলে সেই সুখ বেড়ে যায়। আর এই সুখ, এই আনন্দ যে শুনছে তার যদি নাগালের বাইরে হয় তাহলে সুখটা আরও অনেক বাড়ে। পাঁচু আজ গোবিন্দর ঘরে এসে নিজের সুখকে প্রচুর বাড়িয়ে নিচ্ছিল। পাঁচু কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। গোবিন্দ শুনল, তার কারণ নিজের দুর্দশা ছাড়া ওর বলার আর কিছুই ছিল না। তারপর পাঁচু উঠে পড়ল। ওর মেয়েমানুষের কাছে যাবে, ভাল ভাল খানা আনিয়ে দুজনে খাবে। যাওয়ার সময় একটা একশ টাকার নোট পকেট থেকে বার করে গোবিন্দর দিকে এগিয়ে দিল। বলল, এ টাকাটা রাখ্‌। বুঝেসমঝে খর্চা করিস। তিনটে পেট--একটা মাস--চালিয়ে নিস হিসেব করে।

    একেবারে ভগবানের দান। গোবিন্দ দু হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল।

    দরজার কাছে গিয়ে পাঁচু আবার ঘুরে দাঁড়াল। আদেশের গলায় বলল, টাকাটা আবার মেরে দিস না যেন। কাজ পেয়ে গেলে শোধ দিয়ে দিস।

    নিজের বিছানায় লম্বা হল গোবিন্দ। বৌয়ের রোজগারের ভাত খেয়ে ঘরে শুয়ে ঘুমোন--সে বড় আরাম। যে লোক কখনো তা করে নি তাকে সেই আরামটা কোনমতেই বোঝান যাবে না।

    ছেলেটা, বুদ্ধি ফিরল বিকেলে। এসেই খাই খাই করে, খিদে পেয়েছে বলে চেঁচাল। তারপর বাপের হাতে মার খেয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ধুলোপায়েই শুয়ে পড়ল, শুয়েই ঘুম। ছেলেটা একেবারে কুম্ভকর্ণের মত হয়েছে--খালি ঘুম, আর জেগে থাকলেই খাওয়া। থাক শালা ঘুমিয়ে। ঘরে এখন কোন খাবার নেই, পোতিমার কাছে ভাত বানাবার চাল আছে কিনা সন্দেহ। ঘুমিয়েই রাত পার করে দিক হারামজাদা।

    প্রতিমা ফিরল বিকেল পার করে, একেবারে সন্ধের মুখে মুখে। নিজের কোমরে হাত রেখে কোঁকাতে কোঁকাতে ঘুরে ঢুকল, আর ঢুকেই সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।

    গোবিন্দ বুঝল--ওর কোমরে খুব জোর ব্যথা হয়েছে। আর তা তো হবেই। কদিন ধরে কাজ করেছে--হাজার লক্ষ বার সামনে ঝুঁকতে হয়েছে। এসব কাজ পারে অল্প বয়েসী মেয়েরা। দু বাচ্চার মা একটা মাঝবয়েসী মেয়েমানুষ কি আর এসব পারে?

    একটু জল গরম করে সেঁক দিবি নাকি? গোবিন্দ জিগ্যেস করল। ব্যথাটা তাহলে একটু কমবে।

    গোবিন্দর একথা বলার কারণ আছে। প্রতিমার কাল সকালে আবার কাজে যেতে হবে, কাজ কামাই করলে চলবে না। একদিন না গেলে ইটভাটার ম্যানেজার আবার তার পরদিন কাজ দেবে কিনা সন্দেহ।

    থাক্‌ থাক্‌, তোর আর দরদ দেখাতে হবে না--খেঁকিয়ে উঠল প্রতিমা। আমি মরি আর বাঁচি--তোর তাতে কি? ব্যথা নিয়েও আমাকে কাজে যেতেই হবে। নইলে তোরা বাপ-ছেলেতে গিলবি কি? তুই তো আর টাকা রোজগার করে আনবি না।

    গোবিন্দ পকেট থেকে একশ টাকার নোটটা বার করল--ভাঁজ খুলে প্রতিমার সামনে মেলে ধরল। প্রতিমার চোখ বড় হয়ে গেল, চক চক করে উঠল। কোথায় পেলি? খুশির গলায় ও গোবিন্দকে জিগ্যেস করল। কাজ পেয়েছিস বুঝি?

    মাথা নড়ল গোবিন্দ। না রে, তা নয়। তারপর পাঁচু এসেছিল সেকথা বিশদ করে বলল।

    প্রতিমা স্থির চোখে গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে সব শুনল। তারপর আস্ত আস্তে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমন্ত ছেলের দিকে চোখে ফেরাল। ছেলে নি:সাড়ে ঘুমুচ্ছে। যথারীতি ঘুমের ভেতর নিজের বিছানা হিসি করে ভিজিয়ে ফেলেছে।

    ছেলের দিকে চেয়ে থাকে প্রতিমা। ওর মাথায় অনেক চিন্তা। ঘরে চাল নেই। বিপিন মুদী বলে দিয়েছে ধারে আর চাল দেবে না। প্রতিমার নিজের কাছে টাকা নেই--হপ্তা শেষ না হলে ইটভাটায় মজুরি পাওয়া যাবে না। গোবিন্দর ওই একশ টাকার নোটটা নিয়ে যেতে হবে চাল কিনতে। জ্বালানির কাঠ আর পাতাও ফুরিয়ে এসেছে--ভাত ফুটিয়ে নেয়ার পর কোমরে সেঁকে দেবার জন্যে যে একটু জল গরম করবে তার উপায় নেই।

    প্রতিমা আবার মুখ ঘোরায়--গোবিন্দর চোখে চোখাচোখি হয়। বৌটা এখন কি ভাবছে তা গোবিন্দ বুঝতে পারে--ওর চিন্তার ছবি ও প্রতিমার চোখে দেখতে পায়। ওর নিজের মাথাতেও এখন অনেকগুলো ‘যদি’ আর ‘হয়তো’। যদি মেনকা বেঁচে থাকত। তাহলে হয়তো ভেলির সঙ্গে ও-ও রোজগার করতে চলে যেত--দুজনের খুব ভাব ছিল তো। তাহলে হয়তো মেনকার থেকে গোবিন্দ টাকা পেত--ঐ পাঁচু যেরকম পাচ্ছে। যদি সেরকম হত, তাহলে গোবিন্দকে আর ধনার কাছে মাটি কাটার কাজ করতে হত না, পোতিমার কোমরে আর ব্যথা হত না।

    আর-আর-যদি নাগদেবতা মেনকার বদলে বুদ্ধিকে ছোবল দিত, তাহলেই তো সবকিছু বদলে যেত। গোবিন্দ নিজেকে কল্পনা করে--পরনে পাঁচুর মতো জামা জুতো, হাতের আঙ্গুলে ধরা ধোঁয়ানো সিগারেট, জামার পকেটে সিগারেট ধরাবার যন্তর, দু বেলা ভরপেট খাওয়া--ভাত, ডাল ভাজা--আর সে-সবের সঙ্গে রোজই বড় মাছের খানা। প্রতিমার সুখী সুখী চেহারা চোখের সামনে ভাসে--গায়ে হাত দিলে বৌটা আর আপত্তি করে না, বরং কাছে ঘেঁষে আসে। আর এক আধদিন গোবিন্দ নদীর ওপারে বাজারের ওখানে সন্ধেটা কাটিয়ে রাত করে ঘরে ফিরলেও হাঙ্গামা করে না। সে রাতটা আর কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে না। বোঝে--আজ রাতে গোবিন্দর শরীরে আর তাগত নেই।

    ভগবানের কাছে ফরিয়াদ করে গোবিন্দ--কেন তুমি নাগদেবতাকে আমাদের মেয়েটার কাছে পাঠালে, ওর বদলে এই হারামজাদা বুদ্ধিটার কাছে পাঠালে না কেন? বার বার নালিশ করে। ভগবান লোকটা কালা, কানে সহজে কিছু শুনতে পায় না--তাই নালিশ-ফরিয়াদ বার বার, অনেকবারই করতে হবে।


    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments