নগেনের ভিটে ছাড়িয়ে একটু এগোলে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। বনবিবির থান। দক্ষিণরায়ের মুখ থেকে দুখেকে উদ্ধার করে কোলে নিয়ে বসা বনবিবি, তার একটু দূরে পেছনের দু’পা আর লম্বা লেজে ভর করে আটফুট খাড়াই দাঁড়ানো রায়বাঘা, হাঁড়ির মত মুখে ভাঁটার মত দু চোখ, তাতে মুখের খাবার ফস্কে যাওয়ার রাগ। এটাই লোকের পুজো দেবার জায়গা ছিল — গাঁয়ের আর কোথাও তো ছিল না একসঙ্গে দুই দেবতা। তবে ওই বনবিবি পর্যন্তই — তার থেকে বড় মাপের দেবী এ গাঁয়ে কোন কালেই নেই। কালিঠাকুরের মন্দির আছে শহরে — নদীর ওপারে। বড় কিছু চাইবার হলে লোকে ভুটভুটিতে নদী পার হয়ে পুজো দিয়ে আসে। বনবিবির থান পুজোর জায়গা ছিল, সেটা এখন অতীত। দেবতারা এখানে ছিলেন — ঐ ঝড় আর বান হওয়া পর্যন্ত। এখন তেনারা আর নেই। পড়ে আছে এখানে ওখানে রঙ লেগে থাকা কয়েকটা মাটির ঢিপি বা মণ্ড — বাকি সব বানের লোনা জল গলিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই ঝড় জল বানে অনেক মানুষ গরু ছাগল ভেড়া মারা গেছে — এই দুই দেবতাও পার পান নি। কিম্বা হয়তো দেবতারা ঝড় হবার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলেন, রেখে গিয়েছিলেন তাদের খোলসগুলো।
গোবিন্দর ভিটেতে পৌঁছবার আগে গেঁয়ো রাস্তার ডান হাতে একটা বড় ডোবা। সেটার চার পাশে বুনো ঝোপের ঘন জঙ্গল ছিল। গত ঝড়টা সে সব ঝোপ বিলকুল সাফ করে দিয়ে ডোবাটাকে একেবারে ন্যাংটো করে দিয়েছে। ডোবাটার পাশে জন দশ বারো মেয়েছেলে একটা গোল চক্র করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের একটুখানি জায়গা খালি — সেখানে কি আছে বা হচ্ছে ঐ মেয়েছেলের চক্রের বেড়ার জন্যে কিছু চোখে পড়ে না। কিন্তু গোবিন্দ জানে সেখানে কি হচ্ছে। গাঁয়ের কোন অল্পবয়েসী মেয়ে সেখানে বেগমোচন করছে। এখন তো ঝোপঝাড় সব সাফ হয়ে গেছে — সে সবের আড়ালে বসার তো কোন উপায় নেই। তাই এখন কোন মেয়ের সে সব দরকার পড়লেই কাছাকাছি সব ঘরের মেয়েছেলেরা তাকে এভাবে আড়াল করে দাঁড়ায় — মেয়েটা তার কাজ সেরে নেয়। গোবিন্দ তাড়াতাড়ি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। যদি বেড়া হয়ে দাঁড়ানো মেয়েছেলেদের কারোর চোখে পড়ে যায় যে গোবিন্দ ওদিকে তাকিয়ে দেখছে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। সবাই মিলে গালাগাল দিয়ে ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে। সন্ধেবেলা ওর নিজের বৌটা ঘরে ফিরবে, তখন ওর কানেও কথাটা উঠবে। গোবিন্দর আর এক চোট জোর ভোগান্তি হবে।
কাপড়ের বেড়া উঁচু করে তুলে মাথা নিচু করে গোবিন্দ নিজের ঘরে ঢুকল। বাইরে সকালের রোদ, ঝকঝকে আলো — ঘরের ভেতর সে তুলনায় অন্ধকার। সেই অল্প আলোতেই চোখে পড়ল ওর ন বছরের ছেলেটা ঘরের ভেতর বসে ওর ছোট্ট কাঠের রেলগাড়িটা নিয়ে খেলছে। গত মাসের মাইনে পেয়ে প্রতিমা ওটা শহর থেকে ওর জন্যে কিনে এনেছে। এই বাজে খরচায় গোবিন্দ একটু রাগ করেছিল। প্রতিমা ওকে এক খিঁচুনি দিয়ে বলেছে, আমার রোজগারের টাকায় আমি আমার ছেলেকে খেলনা কিনে দিয়েছি, তোর তাতে কিরে মিন্সে? গোবিন্দ চুপ করে গিয়েছিল, এ নিয়ে আর কোন কথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ বলে ওর মনে হয় নি।
ছেলের নাম বুদ্ধিশ্বর। কিন্তু নামটাই সার, মাথায় এক ফোঁটাও বুদ্ধি নেই। পাশের গাঁয়ে প্রাথমিক ইশকুল আছে — সেখানে সব থেকে নিচের কেলাসেই পর পর দুবার ফেল মেরেছে। ইশকুলে লিখতে শিখিয়েছিল রবি ঠাকুরের নাম। তা ঐ ছেলে লিখতে শিখল, রবি ঠা-, আর ঐ ঠা তে এসেই একেবারে ঠেকে গেল, আর এগোল না। এখন তো সব ইশকুলে নিয়ম হয়েছে, পড়ুয়াদের মারধোর করা চলবে না। আরে বাবা, পিঠে বেশ কয়েক ঘা না পড়লে কি আর এসব ছেলের মাথায় কিছু ঢোকে? এখন তো আর ইশকুলেই যায় না, ঝড়ে ইশকুল বাড়িটার টিনের চাল ভেঙে টেঙে একাকার কাণ্ড হয়েছে। ওর নাম রেখেছিল ওর দাদু, প্রতিমার বাবা — বুড়োর বুড়ী মরে যাবার পর সে মেয়ের কাছেই থাকত। ঐ নাম রাখার পরে পরেই বুড়ো মরেছিল। প্রতিমার সে কি কান্না — বাবাগো তুমি কোথায় গেলে? আমাকে ফেলে রেখে কোথায় চলে গেলে তুমি? দুহাতে বুড়োর মড়াটা জাপ্টে ধরে রেখেছিল, পোড়াতে নিয়ে যেতে দেবে না। শেষ পর্যন্ত জোর করে ওর হাত ছাড়াতে হয়েছিল। যত সব আদিখ্যেতা। বয়েস হয়েছে, বুড়ো হয়েছে, মরবে না? আবহমানকাল ধরে মেয়ে-জামাই-এর অন্ন সাঁটবে নাকি? গোবিন্দর ভাইটা, যাকে বুকে নিয়ে ওর মা নোটনের কাছে গিয়েছিল, সে তো মারা গিয়েছিল অল্প বয়েসেই। তখন কিন্তু প্রতিমা একটুকুও কাঁদে নি।
গোবিন্দর ভাই যে অল্প বয়েসে মারা যাবে সে কথা নোটন বলে নি। কিন্তু যা বলেছিল ওর জ্যাঠা অর্থাৎ হীরুর ছেলেদের সম্পর্কে তা হয় নি। এখন দুজনেই শহরে থাকে। বড়টা পিওনের কাজ করে বি এল আর আপিসে। রোজ সেখানে শয়ে শয়ে লোক আসে নিজেদের জমি জায়গার কাজের জন্যে। সে সব লোকের কাগজ বার করবে সরকারি আপিসের পিওন, তাক থেকে নামিয়ে ওসব কাগজে হাত দেয়ার হক্ আর কারোর নেই। এক একটা লোকের কাগজ বেরোয় আর ওর হাতে আসে নগদ টাকা, চাকরির ওপরে উপরি। উপরিটাই আসল রোজগার, চাকরির মাইনে আর কটা টাকা? সে টাকায় হীরুর বড় ছেলে জমি টমি কিনে ফেলেছে, আর শহরের বাজারে একটা বারোয়ারি মেয়েকে রাখেল রেখেছে। একবার ওকে দেখেছিল গোবিন্দ — হীরুর ছেলেই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছিল। মেয়েটার ছুকরি বয়েস, রোগা, কিন্তু দেখতে মন্দ নয়। ওর দাদার হাতির মত মোটা বিয়ে করা বৌটার সারা গায়ে সোনা — সোয়ামির মেয়েমানুষ রাখার কথা সব জানে, কিন্তু চুপ করে থাকে। মেয়েছেলেকে সোনার গয়না দিলে সে যেরকম বশ হয় সে রকম তো আর কিছুতেই হয় না। কাজেই হীরুর বড় ছেলে দিব্যি আছে। ছোট ছেলে কাজ করে পরগণার সদর আদালতে। সেখানেও প্রত্যেক মামলার কাগজ বার করবার জন্যে টাকা — টাকায় টাকা। অর্থাৎ হীরুর দুই ছেলেই সুন্দর দুধেভাতে আছে।
বুদ্ধিশ্বর পরে আছে একটা নোংরা, জায়গায় জায়গায় তাপ্পিমারা শার্ট, কোমরের নিচে আর কিছু নেই। ছেলের পৌরুষের জয়ধ্বজা সগৌরবে দৃশ্যমান। ওর দিকে তাকিয়ে গোবিন্দ হঠাৎই রেগে গেল, তার কারণ ছেলেকে দেখেই ওর মনে হয়েছে বোধহয় মা আর ছেলে মিলে সব খাবার খেয়ে ফেলেছে — ওর জন্যে রেখে দিয়েছে শুধু ভাত আর নুন। ছেলের দিকে রাগের চোখে তাকিয়ে গোবিন্দ এক গর্জন ছাড়ল, এই শুয়ারের বাচ্চা, পেন্টুল পরিস নি কেন?
ছেলে বাপের গর্জনকে পাত্তাই দিল না। ও জানে, মা ঘরে থাকলে বাপ ওকে বুদ্ধি বলে ডাকে, আর মা না থাকলেই বলে শুয়ারের বাচ্চা। মাঝে মাঝে অবশ্য হারামজাদাও বলে। ও আরও জানে, যতই গর্জাক, ওকে ধরে মার লাগাবার সাহস ওর বাপের নেই। তাহলে ওর মা ওর বাপকে খেয়ে ফেলবে। বাপের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, মা পেন্টুল ধুয়ে দিয়েছে।
গোবিন্দ ঘরের কোণে টাঙানো দড়ির দিকে তাকায়। সেখানে ছেলের আধভেজা পেন্টুল ঝুলছে। গোবিন্দ চুপ করে গেল। ছেলের একটাই পেন্টুল। খুব নোংরা হলে সেটা খুলে নিয়ে ওর মা ধুয়ে দেয়। খানিকটা অন্তত: না শুকোলে তা তো আর পরা যায় না। কাজেই এখন এ নিয়ে ছেলের ওপর আর চেঁচানো যাবে না। দড়িটা নিচু। বুদ্ধি নিজেই তার পেন্টুলে হাত পেয়ে যায়। বেরোতে ইচ্ছে করলে ও সেই আধভেজা পেন্টুলই নামিয়ে পরে ফেলে। তারপর বেরিয়ে গিয়ে গাঁয়ের অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। আজ বোধহয় ওটা এখনও বেশী ভিজে রয়েছে। তাই ও এখনও ঘরে আছে।
গোবিন্দ ঘর থেকে বেরোল। জোর খিদে পেয়েছে। চান সেরে আসবে, তারপর ঘরে ফিরে দেখবে প্রতিমা কি খাবার রেখে গিয়েছে। ডোবাটার দিকে গেল না। ওটায় চান করতে গা ঘিন ঘিন করে। তার উল্টো দিকে দু পা গেলেই একটা বড় পুকুর। গোবিন্দ সেদিকে পা চালাল। পুকুরটার জল লোনা হয়ে গেছে। বানের জলে যখন পুকুর ঢেকেছিল তখন এটার জলে প্রচুর লোনাজল মিশেছে। ডুব দিলেই মুখে জল ঢোকে, তখন টের পাওয়া যায়। এক ডুব দিয়েই চান সারল গোবিন্দ, মুখে যা জল গিয়েছিল তা থু থু করে পুকুরেই ফেলে দিল। তারপর ঘরে ফিরল। ছেলেটা ঘরে নেই, দড়ির ওপর ওর পেন্টুলটাও নেই। যাক্ শালা যেখানে খুশি। ওর লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ, এসব নিয়ে গোবিন্দর কোন মাথাব্যথা নেই। ওর কপালে যা আছে তাই তো হবে। ইশকুলে কয়েক কেলাস পাশ দিতে পারলে জ্যাঠাদের মত সরকারি আপিস আদালতে চাকরি জুটে যেত, ডান হাতে মাইনে আর বাঁ হাতে উপরি আসত। অবশ্য লেখাপড়া না করলেও অনেকের অনেক কিছু হয়। অনেকেই তো লেখাপড়া না করে পার্টিতে ঢুকে পড়েছে, তল্লাটের ছোটখাট নেতা হয়ে গেছে। হাতে ঘড়ি পরে ভটভটিয়া দাবড়ে বেড়ায়, বাড়ি বানানোর ইট, বালি জোগান দেয়। সরকারি বাবুরা, সাহেবরা ওরা ঘরে ঢুকলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে হাতে হাত মেলায়। দেখা যাক ছেলেটার কিরকম কপাল।
খাবারটা দেখে খুশি হয়ে উঠল গোবিন্দ। আজ ভাতের সঙ্গে ডাল আছে, সস্তা সরষের তেলের গন্ধ মাখানো দু টুকরো বেগুনভাজাও আছে। বৌটার দিলে একেবারে দয়ামায়া নেই তা বোধহয় নয়। খালি যদি রাতে গোবিন্দর শরীরের তাগিদটাকে একটু সামাল দিত। বৌটার নিজের ইচ্ছে টিচ্ছে সব মরে গেছে কিনা কে জানে। অবশ্য এমনও হতে পারে যে ওর একটা ভালবাসার মরদ জুটে গেছে। কাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেখানে ঘুরে আসে কিনা তা কি বলা যায়? গোবিন্দ বেগুনভাজা চিবোয় আর নিজের মনে অল্প অল্প মাথা নাড়ে। তা হতে পারে, খুবই হতে পারে।
খাওয়া শেষ করে গোবিন্দ বেরিয়ে পড়ল। ঘর বন্ধ করার কোন ব্যাপার নেই, ঘরের তো কোন দেয়ালই নেই। তবে চুরিরও কোন ভয় নেই। ঘরে কিছুই নেই, চোর আসবে কেন? এলে তার মজুরি পোষাবে না।
মাটি কাটার কাজ হচ্ছে নদীর ওপারে। ধনা বোরেগী ঠিকাদার। ওর পায়ে ধরে কেঁদে পড়বে। কাজ দেওয়া না দেওয়াটা পুরোটাই ওর হাতে। মাতব্বর লোক, পার্টি আপিস, বিডিও আপিস, সব জায়গায় ওর হাত আছে। বানের জল নদীর বাঁধ ধুয়েমুছে দিয়েছে। নতুন করে বাঁধ তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। প্রচুর টাকার কাজ। বেশীর ভাগ কাজের ঠিকাদারিটাই ধনা পেয়েছে। জোর কামাচ্ছে লোকটা। টাকা মাটি, মাটি টাকা। ধনার জন্যে মাটিতেই টাকা।
ভুটভুটিতে করে নদী পার হতে হবে। ফেরি ঘাটটা ওর ঘর থেকে বেশ একটু দূর। রাস্তার বাঁ দিকে বিরাট চাষের খেত। ছ মাস আগেও গোবিন্দ এই খেতে জনমজুরের কাজ করেছে। বীজতলা থেকে ধানের চারা এনে রুয়েছে, আগাছা পরিষ্কার করেছে। বলদের পেছনে লাঙ্গল ধরেছে, ধান পাকলে ধান কেটেছে। হ্যাঁ, মউলের ছেলে চাষের খেতে জনমজুর হয়েছে, মউলে হয় নি। বারণ ছিল নোটনের — সুদামেরও। বাপ গেল মধু ভাঙ্গতে, তাকে নিল দক্ষিণরায়। দোষ লেগেছে, নিশ্চয়ই কোন দোষ লেগেছে। তুই ছোঁড়া আর ওপথ মাড়াস নি বাপু, তোর ছাওয়ালপানদেরও ও রাস্তায় যেতে দিস নি। ও পথে যেও না বাপা, রায়বাঘার ভয়।
অতএব গোবিন্দর এখন রোজগার মাটি থেকে, চাষের খেত থেকেও। ও পেল্লাদ মণ্ডলের জমিতে মজুর খাটে — জমিটার অন্ধিসন্ধি ও চোখ বুজে বলে দিতে পারে। জমিটায় সেচের জল একটু বেশী লাগে, কিন্তু তাতে ধান হয় ভাল। এখন এই জমি, এই খেত পড়ে আছে — খাঁ খাঁ খালি। বানের নোনা জল এই জমিতে দাঁড়িয়েছিল বেশ কয়েকদিন। মাটি প্রচুর নুন গিলে নিয়েছে।
আলপথ দিয়ে হাঁটছিল গোবিন্দ, টপ করে খেতে নেমে পড়ল। নিচু হয়ে হাতের আঙুল দিয়ে একটু মাটি তুলে জিভে দিল। ভালরকম নোনা। কম করে দুটো বর্ষা লাগবে এই নোনা কাটতে। তদ্দিন এখানে চাষটাষ বন্ধ। অর্থাৎ দু দুটো বচ্ছর গোবিন্দর এখানে কাজ জুটবে না। বিপদের কথা — অন্য কাজ না পেলে বড়ই বিপদে পড়বে গোবিন্দ।
ফেরিঘাটে আসতে আসতেই প্রায় ওর চোখের সামনে ভুটভুটিটা ঘাট ছেড়ে গেল। একটাই ভুটভুটি, এপার পার করে। হতাশ চোখে গোবিন্দ দেখল নদীর ছোট ছোট ঢেউ কেটে তেরচা ভাবে ভুটভুটিটা ও পাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আস্তেই যাচ্ছে, কারণ এখন ভাটার টানের উল্টোমুখে যাচ্ছে ওটা। ভুটভুটি ভর্তি ঠাস বোঝাই লোক, কয়েকটা গরু ছাগল নিয়েও উঠেছে তাদের মালিকেরা। গরু ছাগলের ভাড়া মানুষের ভাড়ার চাইতে বেশী। ভাড়ার হিসেবে দুই মানুষে এক ছাগল, আর তিন মানুষে এক গরু। ভুটভুটিটা এখন ওপারে গিয়ে জিরোবে, তারপর লোক বোঝাই হলে তবে আবার এদিকে রওনা দেবে। কম করে এক ঘন্টার ধাক্কা। আর তার ভেতর যদি জোয়ার এসে যায় তবে আরও এক ঘণ্টা।
ফেরিঘাটের পাশে একটা খাবারের দোকান। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ঐ দোকানটা করেছে ওর মালিক। লোকটা হিন্দুস্থানি — সরকারি জমির ওপর দোকান দিয়েছে, দিব্যি চালাচ্ছে। পার্টিকে টাকা খাইয়ে রেখেছে, কাজেই পুলিস এসে দোকান ভেঙে দেবে এ চিন্তা নেই। ভালরকম টাকা রোজগার করছে লোকটা — ফেরিঘাটে সারাদিনই লোকের আনাগোনা থাকে তো। দোকান বানাতে বেশী খরচা করে নি — বাঁশের খোঁটার ওপর ত্রিপলের চালা, পেছন দিকটা অর্থাৎ নদীর দিকটা আর দু পাশ ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকটা এমনিতে খোলা, খালি ঝড় বাদল হলে সেই সময়টায় একটা ত্রিপল টাঙিয়ে ও দিকটাও ঢাকা দেয়। দোকানে কতগুলো মাটির বড় বড় উনুন পাকাপাকিভাবে তৈরী হয়েছে, সেই উনুনগুলোর ওপর বড় বড় কড়ায় সমানে তেল ফুটছে। তৈরী হচ্ছে তেলেভাজা, কচুরি, ঘুগনি, আলুর দম — সেই সঙ্গে জিলিপি। ভুরভুর করে গরম খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে সেদিক থেকে। যদিও গোবিন্দ একটু আগেই নিজের ঘরে বেগুনভাজা দিয়ে ডালভাত খেয়ে এসেছে তবুও ওর জিভে জল এসে গেল। চাষের খেতে মজুরখাটা মানুষ, একপেট খেয়েই আবার একপেট খেতে পারে। কিন্তু দোকানে ঢুকে যে খাবে তার পয়সা কোথায়? গতকাল প্রতিমা খালি নদী এপার ওপার করার ভুটভুটির ভাড়াটা দিয়েছিল। এ ছাড়া একভাঁড় চা যে কিনে খাবে তারও তো পয়সা নেই।
তবুও গোবিন্দ দোকানের ভেতর একবার উঁকি দিয়ে দেখল। সেখানে পর পর সব লম্বা বেঞ্চি পাতা। সেই বেঞ্চিতে বসে লম্বা সরু টেবিলের ওপর শালপাতার থালায় অনেকেই খাচ্ছে। প্রায় সবাই অচেনা লোক — তাদের ওপর চোখ বোলাতে গিয়েই পাঁচুর সঙ্গে গোবিন্দর চোখাচোখি হয়ে গেল। পাঁচুর গায়ে পরিষ্কার একটা সার্ট — ভদ্দরলোকের পরার মত, ওর ফুলপ্যান্টটাও তাই। দুটো শালপাতায় খাবার নিয়ে খাচ্ছে পাঁচু। ঘুগনি দিয়ে মেখে মুড়ি, একগোছা কচুরি আর বড় হাতার হাতা দুই আলুর ছক্কা, তার সঙ্গে গোটা কয়েক লম্বাটে চেহারার বেগুনি। মস্ত একটা হাঁ করে বেগুনিতে একটা বড়গোছের কামড় বসাচ্ছিল পাঁচু, সেই অবস্থাতেই হাতছানি দিয়ে ডাকল গোবিন্দকে। তবুও দোকানে ঢুকতে একটু থমকাচ্ছিল গোবিন্দ। পকেটে পয়সা না নিয়ে ঢোকা কি উচিত হবে? ভুটভুটির ভাড়ার টাকায় কচুরি খেয়ে ফেললে ওপারে গিয়ে কাজের খোঁজ করা যাবে না। আর তাহলে ঘরে মেয়েমানুষটা ভয়ানক হাঙ্গামা করবে। ওদিকে আবার ভাল ভাল সব খাবারের গন্ধ আসছে নাকে, পাঁচুও সমানে হাতছানি দিচ্ছে। গোবিন্দ দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে পাঁচুর পাশের বেঞ্চিতে বসল।
পঞ্চানন সরদার, সংক্ষেপে পাঁচু। গোবিন্দর একেবারে ছোট বয়েসের লঙোটিয়া দোস্ত। গোবিন্দর মতই চাষের ক্ষেতের জনমজুর। একটা মেয়ে রেখে বৌ মারা গিয়েছিল কাঁচা বয়সেই। পাঁচুর আর একটা বিয়ে বসার ইচ্ছে ছিল খুব, কিন্তু বিয়েটা করব করব করেও করে উঠতে পারে নি। দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা — তার ওপর দোজ বর, ঘরে একটা মেয়েও আছে। বিয়ের খোঁজ যে একেবারে পায় নি তা নয়, কিন্তু সে সব মেয়েদের অনেকেরই শরীরের খুঁত ছিল, নয়তো সে মেয়ে দেখতে একেবারে রক্ষেকালি, তাদের সঙ্গে বিয়ে হলে চোখ বুজে পীরিত করতে হত। পাঁচু সব জায়গাতেই এক পা এগিয়ে দু পা পিছিয়েছে — এভাবে খালি পিছিয়েই এসেছে।
পনের ষোল বছর বয়েস হতেই পাঁচু নিজের মেয়ে ভেলির বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। একা মানুষ, দিন চলে যাবে, নিজের আর একটা সাঙা করার কথাও ভাবতে শুরু করেছিল, পাঁচু তো আর একেবারে বুড়ো ধুড়ো হয়ে যায় নি। কিন্তু বাদ সাধল ভেলি। পরপর দু বছর দুটো মরা বাচ্চা বিয়োল, দুটোই আবার ছেলে। শউরবাড়িতে নাম রটল অলক্ষী বলে। তারপর একদিন মারধর করে সোয়ামি আর শাউড়ি মিলে দিল খেদিয়ে। ওরা আবার ছেলের বিয়ে দেবে — অলক্ষীকে তাড়িয়েছে, এবার লক্ষী ঘরে আনবে। ভেলি এসে উঠল বাপের কাছে। পাঁচু খুবই চটেছিল মেয়ের ওপর, অলক্ষী বলে গালাগাল তো দিয়েইছিল, গোটা কয়েক চড় থাপ্পড়ও মেরেছিল। তবে নিজের জন্ম দেওয়া মেয়ে, তাকে তো আর তাড়ানো যায় না। আর পাঁচু রাগ করলেই বা কি হবে, ভেলির যাবার আর জায়গা কোথায়? কাজেই ভেলি থেকে গেল পাঁচুর কাছে।
ঐ ঝড় আর বানে সব লোকের কপাল ভেঙেছে, কিন্তু পাঁচুর কপাল খুলে গিয়েছে। ঝড়ের পর সব লোকের ভয়ানক অবস্থা। থাকার জায়গা নেই, পেটে কোন খাবার নেই। বিডিও আপিসের সামনে সরকারি সাহায্যের জন্যে লম্বা লাইন। সে লাইন মাঝে মাঝে ভেঙে যায়, লোকেরা সব নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। তখন পুলিস এসে লাঠি চালায়, যাকে হাতের সামনে পায় তাকেই লাঠিপেটা করে, সে লাইন ভেঙ্গে মারপিট করেছে না করেনি সে সব দেখে না। তখন ওরা গাঁয়ে এসেছিল। খুব সাজগোজ করা মাঝবয়েসী তিনটে মেয়েছেলে। ওদের সঙ্গে এসেছিল পাশের গাঁয়ের উদ্ধব। নামকাটা সেপাই — ভীড় বাসে ট্রেনে লোকের পকেট মারে — একবার ছ মাস জেলও খেটেছে। উদ্ধবই ওদের নিয়ে গিয়েছিল কয়েকটা পরিবারের কাছে, যাদের ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে। গুজগুজ ফুসফুস করে কথা। কলকাতায়, আরও কোথায় কোথায় কাজ পাওয়া যাচ্ছে — ভাল মাইনে। মেয়েদেরই কাজ — আর হ্যাঁ গায়ে গতরে খেটে পরিশ্রমের কাজ, বয়স্ক মেয়েমানুষ হলে চলবে না। অল্পবয়েসী মেয়ে চাই — যে কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাবে না।
কেউই বিশেষ ওদের এসব কথা শোনে নি — শোনার মত কথা তো নয় — মুখের ওপর না বলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ভেলি কিন্তু ওদের কথা শুনল। বাপকে বলল, আমি ওদের সঙ্গে যাব। আমার সোয়ামি আমাকে খেতে দেয় নি, মেরে ধরে খেদিয়ে দিয়েছে। আমি এবার গতর খাটিয়ে রোজগার করব, নিজের ভাত নিজেই জোগাড় করব।
পাঁচু তা না না না করছিল, কিন্তু ভেলি জেদ ধরে বসল। কার জন্যে ও পড়ে থাকবে এখানে? সোয়ামি তো থেকেও নেই, পাঁচুও তো একদিন মরবে, তখন ভেলির গতি কি হবে? না, ভেলি কলকাতা যাবেই, এখানে থেকে ও শুকিয়ে মরবে না।
সেই পাঁচুর বরাত ফিরে গেল। ভেলি এখন বাপকে টাকা পাঠায়, সে টাকায় পাঁচু নবাবি করে। গাঁয়ের লোক ওর দিকে আড়চোখে চায়, নিচু গলায় কানাঘুষো করে। নানা কথা বলে, সে বড় কুৎসার কথা। পাঁচুর মেয়ে কলকাতায় গিয়ে লাইনে নেমেছে, নটি হয়েছে। পাঁচুর অপমান না লাগুক, গাঁয়ের তো অপমান। লোকে এখন বিশেষ মেলামেশা করে না ওর সঙ্গে, কিন্তু ও তাতে থোড়াই পরোয়া করে। ওর কাছে এখন ভালরকম টাকা। ইচ্ছে করলেই ও ওর ত্রিপলের চাল আর কাপড়ের বেড়া দেওয়া ঘর ভেঙে ফেলে নতুন ঘর তুলতে পারে। কিন্তু ও তা করবে না। নিজে ঘর তুলে ফেললে সরকার আর ঘর তোলার জন্যে টাকা দেবে না। মোটা, বাঁধাই করা সরকারি খাতায় ওর নামের পাশে ঢ্যারা পড়ে যাবে।
পাঁচু এখন ভাল খায়দায়, নদীর ওপারে শহরের বারোয়ারি মেয়েদের কাছে যায়। ওর বিয়ের আর দরকার নেই। আর আজকাল ওসব মেয়েদের কাছে গেলে অসুখ হবারও ভয় নেই। ঐ এনজিও না কি বলে, তার লোকজন আজকাল ওসব মেয়েদের কাছে আসে। ওদের সঙ্গে ডাক্তার দিদিমণিরাও থাকে। তারা মেয়েদের সব শেখায় পড়ায় — কি করে ওসব অসুখ আটকাতে হয়। পাঁচু ঐ মেয়েদের কাছেই এসব শুনেছে। পুরুষের ব্যবহারের রবাট মেয়েরা নিজেদের কাছে রাখে, অবশ্য তার দামটা খদ্দেরের থেকে নিজের দরের থাকে আলাদা করেই নিয়ে নেয়।
ভুটভুটি এপারে আসতে, এপার থেকে ছাড়তে এখনও অনেক দেরী। পাঁচু গোবিন্দকে কচুরি আর আলুর দম খাওয়াল, সেই সঙ্গে বেগুনি। ছোটবেলার বন্ধুর ওপর কৃতজ্ঞতায় গোবিন্দর মন ভরে যায় — মনে মনে পাঁচুর দরাজ দিলের প্রশংসা করে। পরের পয়সায় খাওয়া, তবুও একগোছা কচুরি আর বেশ কিছু বেগুনি খেয়ে ফেলল গোবিন্দ, তারপর বড় একটা মাটির খুরিতে করে ডবল কাপ চা। পাঁচুর পয়সায় এত খাওয়া দাওয়া- তার পরে ওর মেয়ের একটু খোঁজখবর না নিলে ভাল দেখায় না। পাঁচু মেয়ের কথা বলতে পারার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি। মেয়ে ভাল আছে, এবার নাচ শিখবে ভাবছে। কলকাতায় অনেক বড় বড় খাবারের দোকানে পয়সাওলা সব লোক খাবারের সঙ্গে বিলিতি মদ খায়, সেখানে বাজনার সঙ্গে মেয়েরা নাচে — প্রচুর টাকা পায় সেসব মেয়েরা। মেয়ের সাফল্যের কথা বলবার সময় পাঁচুর দু চোখ চকচক করছিল, ওর মুখে একটা খুশির হাসি ভেসে বেড়াচ্ছিল। ওই যে কি মোবাইল নাকি বলে সেই একটা ফোন কিনেছে পাঁচু, তাতে মানুষজনের ছবি তোলা যায়, ছবি পাঠান যায়, ছবি দেখা যায়। ভেলি বাপকে নিজের ছবি পাঠিয়েছে, গোবিন্দকে সেই ছবি দেখাল পাঁচু। ভেলি যখন গাঁ ছেড়েছিল তখন মুখ ছিল হাড় বার করা। এখন তাতে সুন্দর মাস লেগেছে, চামড়া চকচকে হয়েছে, চোখের চাউনি হয়েছে সিনেমার হেরোইনের মত। ভেলির ছবি দেখে গোবিন্দর নিজের মেয়েটা, মেনকার কথা মনে পড়ছিল। মেয়েটার বয়েস ছিল ভেলির মতই, এক আধ বছর এদিক ওদিক হতে পারে। খুব ভাবও ছিল ভেলির সঙ্গে।
গোবিন্দর ভুটভুটির ভাড়াটাও পাঁচুই দিয়ে দিল। ভুটভুটিতে যথারীতি ঠাসাঠাসি ভীড়। গোবিন্দর ঠিক সামনে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা কচি পাঁঠা। ওর মালিক ওটাকে ওপারের বাজারে বিক্রী করবে। তারপর ওটা জবাই হয়ে যাবে, এই পাঁচুই হয়তো ওটার মাংসের তৈরী চপ খাবে। পাঁঠাটা মাঝে মাঝেই মিহি গলায় ডাকছিল, আর ওর খুদে খুদে শিং দিয়ে গোবিন্দর পেটে ঢুঁ দিচ্ছিল। গোবিন্দর সরবার উপায় নেই, যা গাদাগাদি ভীড়, সরতে গেলে কেউ হয়তো ঠেলা খেয়ে জলেই পড়ে যাবে। তবে পাঁঠাটা খুবই কচি আর ওর শিং দুটোও ছোট ছোট- গোবিন্দর পেট ফুটো হওয়ার ভয় ছিল না।
ওপারের ফেরিঘাট থেকে শহরে যাবার রাস্তাটা পাকা, পিচ বাঁধানো। আর একটা রাস্তা কাঁচা, ওটাও ফেরিঘাট থেকেই বেরিয়েছে, নদীর ধার বরাবর চলে গিয়েছে অনেক দূর। ফেরিঘাটের বাইরে তিন চারটে টোটো দাঁড়িয়ে আছে — বাবু মানুষেরা ভুটভুটি থেকে নেমে এই সব টোটো ভাড়া করে শহরে যায়। ভুটভুটি থেকে নেমে দুজনে ওই টোটোগুলোর কাছে এসে দাঁড়াল। পাঁচু পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করল, তার থেকে একটা সিগারেট কায়দা করে বার করে নিল। দামী সিগারেট — ঠোঁটে ধরে টানার দিকটাতে বাদামী রঙের ফিলটার লাগানো। গোবিন্দ খুব আশা করেছিল পাঁচু ওকেও একটা দেবে। দিল না। প্যাকেটের ওপর বার কয়েক সিগারেটের ডগাটা দিয়ে টুক টুক করে ঠুকল, তারপর ওটা ঠোঁটে চেপে ধরে দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে ফেলল। পাঁচুর ওপর একটু গোসা করল গোবিন্দ। শালা এত টাকার কচুরি বেগুনি খাওয়াল, আর এখন একটা সিগারেট দিল না। কিন্তু ও মনে মনে পাঁচুর তারিফ না করেও পারল না। এখন পাঁচু আর চাষের ক্ষেতে কাজ করা মাথায় গামছা বাঁধা, খালি গা, হাঁটুর ওপর তুলে কাপড় পরা দিনমজুর নয় — ওকে এখন দিব্যি একজন ভদ্দরলোক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। নদীর ধার, জোরালো হাওয়া দিচ্ছে বলে কি সুন্দর কায়দা করে হাতের আড়াল দিয়ে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাল — আবার ধোঁয়া ছাড়ছে একেবারে শহুরে লোকের মত। গোবিন্দর সামনে যে লোক দাঁড়ানো সে আর ওর ছোটবেলার দোস্ত পাঁচু সরদার নয় — ও এখন পরিষ্কার একজন বাবু — বাবুসাহেব পঞ্চানন সরদার।
ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটটা ডান হাতের দু আঙুলে ধরে ঠোঁট থেকে সরাল বাবুসাহেব পঞ্চনন। গোবিন্দকে বলল, আমি এবার যাই, বুঝলি — আমার একটু দরকারি কাজ আছে।
সামনের টোটোটাতে উঠে বসল পাঁচু। টোটোটা নড়ে উঠতেই ওটার তলা থেকে একটা বেড়াল ছিটকে বেরিয়ে এল — প্রায় গোবিন্দর পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। টোটোটা পিচের রাস্তায় চলতে শুরু করল — কোন ধোঁয়া নেই, আওয়াজ নেই — ইলেকটিরিতে চলে তো। গোবিন্দ টোটোর পেছনটা দেখতে পেল — লাল রঙ দিয়ে বড় বড় করে লেখা — প্রো: গণেশ মণ্ডল।
মোড় ফিরে বাজারের রাস্তাটায় ঢুকে গোবিন্দর চোখের আড়ালে চলে গেল গণেশ মণ্ডলের টোটো — পঞ্চাননবাবু যাতে চড়ে বসে সিগারেট ফুঁকছে। শালা দিন দুপুরেই বাজারের ঐ মেয়েদের কাছে গেল নাকি? কি জানি, যেতেও পারে। ওর পকেট এখন সব সময় গরম, ওর বিলকুল হক্ আছে ওদের কাছে যখন তখন যাওয়ার।
বড় একটা শ্বাস ফেলল গোবিন্দ। তারপর পাঁচুর ওপর একবুক হিংসে নিয়ে কাঁচা রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগল। যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে এ রাস্তাটা দিয়েই সেখানে যেতে হবে — প্রায় কোশ খানেক হাঁটতে হবে।
সন্ধের মখে মুখে ঘরে ফিরল গোবিন্দ। কাজ হয়নি। কাঁচুমাচু মুখ করে বৌ এর কাছে কৈফিয়ৎ দিল। অবশ্য একপিঠের ভুটভুটির ভাড়া যে বেঁচে গিয়েছে তা বেমালুম চেপে গেল। ওকথা বলে দিলে বৌটা এক্ষুনি জবরদস্তি ও টাকা ফেরৎ নিয়ে নেবে। ধনা ওকে ঘন্টা দুই বসিয়ে রেখেছে। তারপর বলেছে এখন কাজ কম আর লোক অনেক বেশী, সেজন্যে এখন গোবিন্দকে কাজ দেওয়া যাবে না। এ কথা বলে দিয়ে গোবিন্দর দিকে আর তাকায়নি। মুটকি একটা মাঝবয়েসি মাটিকাটা কামিন মেয়েছেলের সঙ্গে হাসি মস্করা শুরু করেছিল। গোবিন্দ ওর পা ছুঁতে গিয়েছিল, জুতোর ডগার ঠোক্কর দিয়ে গোবিন্দর হাত সরিয়ে দিয়েছে ধনা। আর সেই সঙ্গে দাঁতখিঁচুনি, শালা হাড়হাভাতে — যা ভাগ্ এখান থেকে। তারপরই অবশ্যি একটু নরম হয়ে আবার বলেছে, মাসখানেক পরে আসিস, তখন দেখব।
সব শুনে প্রতিমা ঠোঁট ওল্টাল। ওর সোয়ামিটা একেবারেই একটা অপদার্থ। চেহারাতেই পুরুষমানুষ, এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নেই। তারপর গোবিন্দকে খাবার বেড়ে দিল প্রতিমা। আজ কাজের বাড়ি থেকে বৌটা খিচূড়ি আর আলুভাজা নিয়ে এসেছে। খাওয়াটা জমবে ভাল।
সকালের কাজ সেরে নদীর পাড় থেকে ফিরছিল গোবিন্দ। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। শীত পড়তে এখনও দেরী আছে, কিন্তু হাওয়াটা জোলো, ঠাণ্ডা আর জোরালো, মাঝে মাঝেই গায়ে ছুঁচের মত বিঁধছে। একটা ঝড়জল হবে। অসময়ের জল, চাষবাসের ক্ষতি না করে দেয়। তবে জলটা বেশ ভালই হবে। গোবিন্দ সেটা জানে। নদী ডাকছে। ভাটার টানের কলকল ছলছলের ভেতর খুব মিহি একটা আওয়াজ। গোবিন্দ ঠিক শুনতে পেয়েছে। নদীর ধারের মাটিতে ছোট থেকে বড় হয়েছে, ঐ আওয়াজ শুনতে ওর ভুল হয় না।
গোবিন্দ একটু জোরে পা চালাল। ওর গায়ের পাতলা জামাটায় এই হাওয়া মানছে না। জোরে হাঁটলে শরীরটা একটু গরম হয়, শীত শীত ভাবটা একটু কমে। বনবিবিতলার পাশ দিয়ে যাবার সময় গোবিন্দ জোড়হাত কপালে ঠুকে একটা পেন্নাম করল। বনবিবিই হোক, আর যে কোন দেবদেবীই হোক, কোন একজনের দয়া ওর এখন বড় দরকার। পেল্লাদ মণ্ডল এবার শীতে বোরো চাষ করবে না — ঢ্যাঁড়শ আর টমেটো লাগাবে। লঙ্কাও লাগাতে পারে। তা লাগাক, গোবিন্দর তাতে কোন মাথাব্যথা নেই। ওর চিন্তা পেল্লাদ ওকে কাজ দেবে কিনা। কানাঘুষোয় শুনেছে পেল্লাদ এবার মেয়ে মজুর দিয়ে কাজ করাবে। মেয়েছেলেরা ব্যাটাছেলেদের চাইতে কম মজুরিতে কাজ করে কিনা। এ কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তো চিত্তির। গোবিন্দ তো বাড়ি বসে যাবে। বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে গোবিন্দ তাহলে খাবে কি?
ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে গোবিন্দ মেয়েদের গলার বিকট ক্যাঁচমেচি শুনতে পেল। ওর ঘরে মা মেয়েতে ঝগড়া লেগেছে। মেনকাটা হয়েছে শয়তান, কোন কাজকম্ম করার দিকে মন নেই — দিনরাত পাঁচুর মেয়ে ভেলির সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস আর হিহি হাহা হাসি। ভেলি বিয়ে হওয়া মেয়ে — পুরুষমানুষের সঙ্গে শুয়ে এসেছে, কি মন্তর এখন মেনকার কানে দিচ্ছে কে জানে। অবশ্যি এর জন্যে গোবিন্দ নিজেকেও দোষ দেয়। মেয়ে সোমত্ত যুবতী হয়েছে, গোবিন্দ এখনও ওর বিয়েশাদি দিয়ে উঠতে পারল না। কিন্তু যে ছেলের অবস্থা একটু ভাল, একটু জমি জায়গা আছে, তার বাপ মা-ই একগাদা টাকা চায়। এমন তো নয় যে মেনকা দেখতে শুনতে ভাল, ওকে দেখে ছেলের পক্ষ টাকা না নিয়েই ঘরে নিয়ে যাবে। গোবিন্দ একবার পরাণ হালদারের সঙ্গে এই ছেলের পক্ষের টাকা চাওয়া নিয়ে কথা বলেছিল। পরাণ তো রেগেই কাঁই। বল্লে, বিয়ে করবার জন্যে টাকা চাওয়া তো বেআইনি। গোবিন্দ, তুই নালিশ কর। তাহলে ঐ সব ব্যাটারা হাজতে যাবে।
গোবিন্দ আর কোনোদিন পরাণের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে না পারার দু:খের কথা বলতে যায় নি। হুঁ: — নালিশ না হাতি। ওসব আইনকানুন ভদ্দরলোকদের জন্যে। গোবিন্দ ওসব ঝামেলার ভেতর ঢুকে ফেঁসে যাক আর কি। নিজের পেটের ভাত জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে, ও যাবে কিনা উকিল, থানা পুলিসের পেছনে ছোটাছুটি করতে। তাছাড়া ছেলের বিয়ে দিয়ে টাকা নেয়ার এই ব্যবস্থাটাকে পুরোপুরি খারাপ বলে মেনে নিতে পারে না গোবিন্দ। ওর নিজের ছেলেটা, বুদ্ধিশ্বর, ওটা লায়েক হলে পর ভগমান যদি দয়া করে, তাহলে ওর বিয়ে দিয়ে নিজেই কি বেশ কিছু টাকা ঘরে আনবে না গোবিন্দ?
গোবিন্দ ঘরে ঢুকল। ভেতরে ধুন্ধুমার চলছে। প্রতিমা ধরেছে মেনকার চুল আর মেনকা দু হাত দিয়ে মাকে ঠেলছে। মা বলছে, সোমত্ত মাগি, ওই ভেলিটার সঙ্গে দিনরাত কি এত কথা তোর! দুটো ঘরের কাজ করে সংসারে একটু সাহায্য করতে পারিস না? মেয়ে কিছু কম যায় না, সে-ও চেঁচিয়ে বলছে, আমি কেন কাজ করব, কাজ করবি তুই। তুই কাজ করে, রান্না করে আমাকে খাওয়াবি। তা না পারলে সোয়ামির সঙ্গে আনন্দ করে আমাকে জন্ম দিয়েছিলি কেন — সে সময় মনে ছিল না? বুদ্ধিশ্বরের দিকে তাকাল গোবিন্দ। খুব মজা পেয়েছে ছেলে, হাসি মুখে দাঁত বার করে মা আর দিদির ঝগড়া দেখছে।
গোবিন্দ বৌ আর মেয়েকে দুই থাবড়া দিয়ে আলাদা করে দিল। বৌকে বলল, চটপট যাহোক দুটো ফুটিয়ে নে। তাড়াতাড়ি খাওয়া সারতে হবে। জোর ঝড় জল হবে। নদী ডাকছে রে।
প্রতিমা জানলা দিয়ে উঁকি দিল। হাওয়ার জোর বেশ বেড়েছে, মাথার ওপর জবরদস্ত কালো কালো মেঘ জমছে। দু চার ফোঁটা বৃষ্টিও উড়ে আসছে সেই সঙ্গে। জানালা দিয়ে চোখে পড়ে দক্ষিণ-পূবের অশথ গাছটা — তার পুরো মাথাটা হাওয়ায় এদিক ওদিক নড়ছে আর তার ডালে পাতায় পাখীগুলো চেঁচিয়ে ডাকছে, আর পাখা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে।
প্রতিমা দৌড়ল ঘরের বাইরে রান্নার চালাটার দিকে। সেই সঙ্গে বিড় বিড় করে মেনকাকে গাল দিতে লাগল — মেয়েটা হয়েছে একটা অলক্ষী, রান্নাটা করতেও মাকে একটু সাহায্য করবে না।
ঘরের ভেতর একটা বাঁশের মাচা। সেটাতে গোবিন্দ শোয়। মাটিতে মাদুর পেতে তার ওপর ছেঁড়া একটা পাতলা তোষক — সেখানে শোয় প্রতিমা আর ছেলে মেয়ে। রাত একটু বাড়লে যখন ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তখন গোবিন্দ মাচার থেকে ঝুঁকে পড়ে খোঁচা দিয়ে জাগায় তার বৌকে। বাঁশের মাচায় বড় শব্দ হয়, সেজন্য প্রতিমা ওপরে ওঠে না, গোবিন্দই নিচে নেমে আসে। চটপট নিজের দরকার মিটিয়ে আবার মাচায় উঠে যায়। খাওয়াটা সেরে নিয়েই গোবিন্দ এই মাচাটা বেঁধে ফেলল ঘরের খড়ের চালটার সঙ্গে — ঘরে নৌকো বাঁধবার মোটা দড়ি মজুত ছিল। এই কাছি-দড়ি গোবিন্দ এনেছিল অনন্ত সাঁপুই-এর কাছ থেকে — গত কালবোশেখীর ঝড়বিষ্টির সময়। অনন্তর দুটো বিরাট বিরাট নৌকো আছে — সে দুটো ডিজেল তেলের মেশিনে চলে। যে সব মাছমারা সাগরে যায় তারা নৌকো ভাড়া নেয় অনন্তর থেকে, ঘরে বসেই লোকটা ভাল রোজগার করে। তা গোবিন্দ ওই দড়ি ফেরৎ দেয়ার আর ফুরসৎ পায় নি, অনন্তও দড়ি ফেরৎ চেয়ে পাঠায়নি। এখন আবার এই অসময়ের ঝড়ে তা কাজে লাগছে। ঘরের যত তৈজসপত্র, সে সবও গোবিন্দ তুলে ফেলল মাচার ওপর। যতটা পারা যায় মাচার ওপর ভার চাপানোর দরকার। ঘরের চালে যে দড়ি বেঁধেছে তার একটা দিক ঝুলে রইল মাচার ঠিক ওপরে। বৌ ছেলে মেয়েকে ডেকে তুলে নিল মাচার ওপর। বুদ্ধিশ্বর ওর খেলনা রেলগাড়িটাও মাচার ওপর তুলেছিল — ওর কান জোরে মুলে দিয়ে গোবিন্দ সেটা লাথি মেরে মাচার ওপর থেকে নিচে ফেলে দিল। এ্যাঁ এ্যাঁ করে কান্না জুড়ল ছেলে। মেনকা খাওয়া শেষ করতে দেরী করছিল বলে প্রতিমা ওকে এক চড় মেরেছিল। মাচার ওপর বসেও মেনকা ফোঁপাচ্ছিল। গোবিন্দ ছেলেমেয়ের কান্নাকে পাত্তাই দিল না। ঝড় আসছে — তাগড়া ঝড়। ঘরের চাল উড়ে না যায়। নদী ডেকেছে, সাবধান, সবাই সাবধান।
হাওয়া এখন আরও পাগলা, আরও দামাল — অল্প অল্প আওয়াজও করতে শুরু করেছে। সূর্য মাথার ওপরে, কিন্তু ভরদুপুরের চোখ ধাঁধানো ঠা ঠা রোদের আলোর বদলে নিভে যাওয়া গোধূলির একটা মরা, ফ্যাকাশে আলো, কারন আসমান জুড়ে এখন একটা ঘন ঠাসা গাঢ় কালো মেঘের দেয়াল — তার কোথাও কোন ফাঁকফোকর নেই, কোন ফাটল দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আলো যে ঢুকে আসবে তার উপায় নেই। বিষ্টি শুরু হয়ে গেছে, বড় বড় ফোঁটার ঘন বিষ্টি — হাওয়ার তোড়ে তা আরও জোরালো হয়ে গাঁ গঞ্জের সব ঘরের দেয়ালে ঘুষো মারার মত করে ধাক্কা মারছে।
কিন্তু গোবিন্দ জানে এখন যা হচ্ছে তা নেহাতই খেলা — খেলাঝড়, খেলা বিষ্টি। আসল ঝড়বিষ্টি এখনও আসে নি, তারা এখন পাঠিয়েছে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোদের। নিজেরা আসছে — আর বেশী দেরী নেই, তারা এসে পড়ল বলে।
তারা এল, তারা একেবারে গোবিন্দর ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল। গোবিন্দর বাস দক্ষিণ দেশে, সমুদ্দুরের কাছাকাছি দক্ষিণরায়ের বসতির একেবারে পাশে, বয়েস প্রায় দু কুড়ি হল, ঝড়জল ও কম দেখে নি। কিন্তু এই ঝড়টার বাড়াবাড়ি যেন অনেক বেশী। হাওয়া দমকায় দমকায় ছুটে আসছে লাখো হাতির জোর নিয়ে, গজরাচ্ছে যেন সাতদিনের ভুখা রায়বাঘার রোষের ডাক। আর সেই সঙ্গে তুড়ে বিষ্টি। সাদা জলের একটা দেয়াল বেরিয়ে আসছে আসমান থেকে — সে এক যাদুর দেয়াল — কখনো শেষ হয় না — বেরিয়ে আসছে তো আসছেই — সাগরের ক্ষ্যাপা ঢেউএর মত ভূঁইয়ে আছড়ে পড়ছে, আর আছড়াচ্ছে গোবিন্দর ঘরের চাল আর মাটির দেয়ালগুলোকে। ঝড়ের ঝটকাগুলো আসছে যেন গোবিন্দর ঘরটা ভেঙে দেবার জন্যেই, সেটাকে ভূঁইয়ে ফেলে দিয়ে জলকাদার সঙ্গে মিশিয়ে দেবার জন্যে। কেন বাপু, এই গোবিন্দ ভূঁইমালি, গেরস্থ বাড়ির গরুছাগলের চাইতেও তুচ্ছ একটা প্রাণী, তার বাপ মধু ভাঙতে গিয়ে রায়বাঘার খোরাক হয়েছিল বলে যে আর মউলে হয় নি, পেল্লাদ মণ্ডলের জমিতে ধানচাষের দিনমজুরি করে যে কোনরকমে নিজের আর বৌ বাচ্চার পেটে দুটো অন্ন দেয়, তার ঘরটা ভেঙে তাকে রাস্তায় বার করে দিয়ে তোমাদের লাভ কি বাপসকল? কিন্তু গোবিন্দর প্রার্থনায় কোন কাজ হয় না, তারা আসে, আসতেই থাকে, উন্মাদ দানবের মত, দমকার পর দমকা, ঝটকার পর ঝটকা — মড়মড় করে আওয়াজ হয় — চালাটা গোবিন্দর ঘরের খুঁটি ছেড়ে দিয়ে আকাশে উঠে যেতে চায়, হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড় মারতে চায়। গোবিন্দ চাল থেকে ঝুলে থাকা দড়ি ধরে ঝুলে পড়ে, ওকে জাপ্টে ধরে ঝোলে ওর বৌ আর ছেলে মেয়ে। ঘরের দেয়ালগুলো হাওয়ার আর বিষ্টির ঝাপটা খায়, মনে হয়, ঘরের ভিতের ভেতর থেকে নড়েচড়ে উঠছে। দমকাটা কেটে যায়, গোবিন্দ দড়ি ছেড়ে মাচার ওপর দাঁড়িয়ে দম নেয়। ঐ ঐ, আবার বিষ্টির শব্দ ছাপিয়ে হাওয়ার গজরানি বেড়ে ওঠে, আবার আসছে, আবার গোবিন্দ আর তার ছেলেমেয়ে বৌ দড়ির ওপর নিজেদের ভার দিয়ে ঝুলে পড়ে — অল্প করে কিছু একটা ছেঁড়ার আওয়াজ হয় — গোবিন্দ বোঝে, চালার ফাঁসের কাছে দড়িটা একটু একটু করে ছিঁড়ছে। আবার হাওয়ার একটা জোর ঝটকা — জানালার ঝাঁপটা খুলে গিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল — বিষ্টির প্রচণ্ড ছাঁট ঘরের মধ্যে ঢোকে — ওদের সবাইকে চুপচুপে ভিজিয়ে দেয় — ঘরের মেঝেটা মুহুর্ত্তের মধ্যে জলে থইথই করতে থাকে। জলে আর হাওয়ায় কাঁপতে থাকে মাচার ওপরের মানুষগুলো। কিন্তু গোবিন্দ হাল ছাড়ে না — যতক্ষণ পারে লড়াই করবে — এই ঘর, এই ঘরের চালা ওর বাপ মাধবের থেকে পাওয়া ওর সম্পত্তি — সহজে এগুলোকে এই ঝড় জলের হাতে ছেড়ে দেবে না।
মড় মড় করে একটা বিকট আওয়াজ। ঘরের একটা দেয়ালে ফাটল ধরেছে, ফাটলের ওপরের অংশটা একটু ঝুঁকে গিয়েছে ঘরের ভেতরের দিকে। ঝড়ের আর একটা বড় ঝটকা, আর ব্যস — খালাস। দেয়ালটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। হ্যাঁ, আর একটা ঝটকা আসছে, এসে গেছে, এসে পড়েছে একেবারে ঘাড়ের ওপর। এবার চালের বাতায় একটা জোর মড়মড় আওয়াজ, তারপরই দড়িটা ছিঁড়ে গোবিন্দর হাতে থেকে গেল — ঘরের চালা উঠে গেছে ওপরে — হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে খেতে উড়ে চলেছে ঐ বুনো, হিংস্র বাতাসের সাথে সাথে।
মাচার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে চারটে মানুষ। মাচা ছোট, চারজনের জায়গা কি হয়? গোবিন্দ জাপ্টে ধরল মাচার বাঁশ, ওর ওপর জড়াজড়ি করে বাকি ক’জন। মাথার ওপরে চাল নেই, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে হাওয়ার ঝাপ্টা ভূঁইএ ফেলে দেবে, তেমন জোরালো হলে তুলে নিয়ে মাটিতে আছড়েও ফেলতে পারে। তবে এসব করেও আর বাঁচা যাবে মনে হচ্ছে না — এই ঝড় এবার ওদের জান খাবেই খাবে।
দুম করে একটা প্রচণ্ড আওয়াজ। ঘরের ওই দেয়ালটা ভেঙে পড়ল। গোবিন্দ প্রায় দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে রইল, হাওয়ার পরের জোরালো ঝটকাটা কখন আসে। পিঠের ওপর আছড়ে পড়ছে তুমুল বিষ্টি — গোবিন্দ জানে এবার ও মারা যাবে। ও এখন বৌ ছেলেমেয়ের কি হবে তা ভাবছে না — নিজে কখন মরবে, মরার সময় ওর কি কষ্ট হবে তাই ভাবছে। বাপ মাধব মরেছিল দক্ষিণরায়ের কামড়ে, বিলাসীকে নিয়েছিল উদরাময়, প্রতিমার বাপটা একদিনের জ্বরে চোখ উল্টে মরেছিল। মরার সময় ওদের কিরকম কষ্ট হয়েছিল আন্দাজ করবার চেষ্টা করল গোবিন্দ। ওর নিজের মরার কষ্টটা কি ওদের কষ্টের চাইতে বেশী হবে?
ঝটকাটা আর এল না। হাওয়ার বেগটা কি একটু কমে আসছে? বিষ্টিটাও কম মনে হচ্ছে, মেঘ হালকা হয়ে একটু আলোও হয়েছে। তবে কি এ যাত্রায় ও বেঁচে গেল? জয় ভগমান, জয় মা বনবিবি, জয় বাবা দক্ষিণরায়। সবই তোমাদের লীলা। এই ঝড়বিষ্টিও তোমরা দিয়েছ, আবার তোমরাই আজ এই গোবিন্দকে বাঁচালে।
কিন্তু এবার গোবিন্দর কানে এল অন্য একটা আওয়াজ। ও এই আওয়াজ চেনে। জল আসছে, নদীর জল। বিষ্টিতে নদী ফুলে উঠেছে, দুপাড় উপচে জল আসছে। এরপর আসবে জোয়ার, তখন আর দেখতে হবে না, ক্ষ্যাপা হাতির মত ছুটে আসবে জল, কম করে এক মানুষ- দেড় মানুষ জল দাঁড়িয়ে যাবে এই পুরো এলাকাটায়।
লাফ মেরে মাচার থেকে নেমে পড়ল গোবিন্দ। এর ভেতরেই অনেকটা জল দাঁড়িয়ে গেছে, পায়ের পাতা পুরো ডুবে যাচ্ছে। প্রতিমাকে ডাকল, বৌ, ওঠ, শীগ্গীর ছাওয়ালপানদের নিয়ে বেরোতে হবে। শীগ্গীর চল্। বান আসছে। দেরী করলে সবাই মিলে ডুবে মরব।
বৌ, ছেলে, মেয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল গোবিন্দ। দরজার ঝাঁপটা নেই, কখন ভেঙে গিয়ে ভেসে বেরিয়ে গিয়েছে কে জানে। পথে এখন গোবিন্দর হাঁটু জল, মিনিটে মিনিটে জল বাড়ছে। এর মধ্যেই জলে বেশ স্রোত, জল ঠেলে এগোতে কষ্ট হচ্ছে। গোবিন্দ ছেলেটার কোমর জাপ্টে ধরে জল ঠেলে হাঁটছে — বাচ্চামানুষ একা এই জল ঠেলে এগোতে পারবে কেন? প্রতিমা আর মেনকার প্রায় কোমরজল — দুজন দুজনের কোমর জড়িয়ে ধরে জল ঠেলে এগোচ্ছে। জোয়ার আসার আগে একটা উঁচু জমির ওপর শক্তপোক্ত দেখে গাছে উঠে পড়তে হবে। জোয়ার এসে পড়লে স্রোত হবে ভয়ংকর, জল ফুলে উঠে যা সামনে পাবে তা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গোবিন্দর ঘর থেকে একটু এগিয়েই একটা প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ — গোবিন্দর ঠাকুর্দার বাপের আমলের। এই ঝড়টাতে চারপাশের ঝোপঝাড় সাফ হয়ে গেছে। ছোটখাট গাছটাছ পড়ে জলে ভেসে গিয়েছে — তেঁতুলগাছটা সোজা খাড়া আছে। আশা করা যায় বানের স্রোত বাড়লেও এটা পড়ে গিয়ে ভেসে যাবে না। গাছটার শেকড় মাটির ভেতর অনেকদূর ঢুকেছে — বানের জল গাছের গোড়ার খানিকটা মাটি খাবে ঠিকই, কিন্তু আদ্যিকালের পুরনো গাছটার তেমন কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। গাছের গোড়ার জমিতে এসে খানিকটা দম নিল গোবিন্দ, তারপর গাছের ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কোথায় একটু নিরাপদে বসা যায়। গাছের বেশী ওপরদিকে নয়, বেশ কয়েকটা শক্ত আর মোটা ফেকড়ি বেরিয়েছে, ওখানে উঠে একটাতে বসে আর একটাতে হেলান দেওয়া যায়। গাছের অন্য সব ডালপালার পাতা এমনভাবে ঝুঁকে পড়েছে যে সেসবে ঠেসান দিয়ে বসলে বেশ গদীর কাজ করবে।
ওরা সবাই গাছে চড়তে পারে। প্রথমে গোবিন্দ উঠল। কিন্তু খুব অভ্যস্ত কাজটাও এখন খুব একটা সোজা হল না। সারা গায়ে মাথায় জল, এখনও ভালই বৃষ্টি পড়ছে বলে চোখেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, ভিজে কাদা মানুষটার হাত পিছলে পিছলে যায়। শেষ পর্যন্ত উঠে পড়ল গোবিন্দ। বুদ্ধি আর মেনকার উঠতে তত কিছু অসুবিধে হল না — অল্প বয়স, বিষ্টিটার জন্যে তরতরিয়ে না পারলেও একটু চেষ্টা করে উঠে পড়ল। কষ্ট হল প্রতিমাকে তুলতে। দুই ছেলেমেয়ের মা হওয়া শরীর — এখন কি আর সহজে গাছে উঠতে পারে? গোবিন্দ আর মেনকাও প্রতিমার দু কাঁধের নিচে বাহুতে হাত লাগিয়ে ওকে টানল।
প্রতিমা শেষ অবধি উঠল কিন্তু তখন গাছের ঘষা লেগে ওর দু হাতের, কোমরের জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে গেছে — গায়ের কাপড়টাও সপসপে ভিজে ছিল বলে অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছে — সেই ছেঁড়ার ফাঁক দিয়ে ওর বুকের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। কাপড়ের আঁচলটা দুফেরতা দিয়ে উদলা বুক ঢাকল প্রতিমা। মেয়েমানুষ — যতই বিপদে পড়ুক, লজ্জা তো ঢাকতেই হবে।
তারপরই প্রতিমার কান্না — সেই সঙ্গে শাপশাপান্ত। ঝড়কে, বৃষ্টিকে, নদীকে, বেচারা ভগবান তো আছেই। দু:খ অনেক। ঘর ভেঙে গেছে, সেই দু:খ, পেতলের বাসনগুলো ভেসে গেল তার দু:খ, কাপড়চোপড় নেই, উদলা গায়ে থাকতে হবে, সেই দু:খ। গোবিন্দ রেগে গিয়ে এক ধমক দিল, থাম মাগি, চুপ কর। এখন পরানে বাঁচার চিন্তা আর মাগি কান্না জুড়েছে ওর বাসন ভেসে গেল বলে। তখন একচোট গালাগাল হল গোবিন্দর ওপর। গোবিন্দ একবার ভাবল বৌকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে চিন্তা মন থেকে বাদ দিল। কোনরকমে গাছের ডালে বসে আছে, জুৎ করে মার লাগাতে গেলে নিচে জলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মাগি চেঁচাচ্ছে, চেঁচাক। খানিক পরে নিজেই থেমে যাবে।
সারা শরীর চপচুপে ভিজে, গায়ের জামা আর হাপ পেন্টুলটা জলে ভিজে গায়ের চামড়ায় এঁটে বসা, ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া, মাঝে মাঝেই গোবিন্দরও দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু জোর করে ও জাগিয়ে রাখল নিজেকে। বুদ্ধিটাকে ও একহাত দিয়ে জাপ্টে ধরে রেখেছে, নইলে ছেলেটা নিচে পড়ে যেতে পারে। ছেলেটার তো আর শাড়ির আঁচল নেই যে গাছের ডালে বাঁধবে। আর একবার নিচে পড়ে গেলে — ব্যস, ছেলেটা একেবারে খরচার খাতায় চলে যাবে। জল এখন দেড় মানুষ খানেক উঁচু, আর তার স্রোত কি — বাপরে বাপ, আওয়াজ করে নিচু জমির ঢালের দিকে ছুটছে। সেই আবার ভাটার টান এলে হয়তো জল একটু নামবে, জলের টানও খানিক কমবে। কিন্তু সে অনেক সময়ের ধাক্কা। ততক্ষণ কারোর মুখে একফোঁটা খাবার জলও জুটবে না, খাওয়া তো দূরের কথা। আর ভাটা পড়লেই যে জল নেমে যাবে তারই বা ঠিক কি? এরকম বান হলে নাকি নৌকো করে সরকারি লোক আসে। তারা এরকম জলবন্দী মানুষগুলোকে পেলাস্টিকের প্যাকেটে ভরা জল দেয়, খাবার দাবারও দেয় — তাদের নৌকোয় তুলে নিয়ে উঁচু শুকনো জায়গায় কোন পাকা বাড়িটাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু সেরকম নৌকো কি আসবে এখানে? তারা কি করে জানবে যে গোবিন্দ তার বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে গাঁয়ের বুড়ো তেঁতুলগাছটার ফেকড়িতে উঠে বসে আছে? গোবিন্দ নিজেই নিজেকে জিগ্যেস করে — কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। ভাগ্যিস ঝড় আসার আগে সবাই দুটো করে নুনভাত খেয়ে নিয়েছিল, নইলে এখানে পেট শুকিয়ে বসে থাকতে হত।
সন্ধে হয়ে গিয়ে চাঁদ উঠে গেল। জোছনা পড়ে জল এখন গলানো রূপো — কত কি তাতে ভেসে যাচ্ছে — একটা ঘরের ভাঙা চালা, এক চাবড়া ঘাস, খানিকটা বুনো ঝোপ, গেরস্তর হাঁড়ি কলসী — ঐ ঐ একটা গরু যাচ্ছে, একবার ডুবছে, একবার ভাসছে — এখনও বেঁচে আছে, যখন ভাসছে তখন মুখটা জল থেকে উঁচু করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করেছে — একটা মরা মেয়েমানুষ গেল — একেবারে উদোম, জলের তোড়ে গায়ের কাপড় সব খুলে বেরিয়ে গেছে, জলের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ভেসে চলে গেল।
গাছের ওপর চারটে মানুষের চারপাশে ভনভন করেছে ঝাঁকবন্দী মশা, জোঁকও গায়ে উঠে আসছে মাঝেমাঝেই। মশা কামড়ালে বা জোঁকে ধরলে এক হিসেবে ভাল, ঘুমের ঢুলুনিটা কেটে যায়। গালে মশার হুলের প্রচণ্ড জ্বালা, গোবিন্দর ঘুম কেটে গিয়ে চোখ খুলে গেল। মেনকার দিকে নজর পড়ল, ও চমকে উঠল, ওর চোখ বড় হয়ে গেল।
মেনকা ঝিমুচ্ছে, ও দেখতে পায় নি। ওর ঠিক সামনের একটা ডালে লেজের দিকের লিকলিকে শরীরটা পাকিয়ে নিয়ে বাকি শরীরটা খাড়া করে মেনকার একেবারে মুখোমুখি — ঘোর কালো শরীর — ফণা ধরে উঠেছেন তিনি, মাথার ওপরে একজোড়া খড়মের ছাপ, একেবারে সাক্ষাৎ যম। মেনকাকে সাবধান করে দেবার সময়টুকুও পেল না গোবিন্দ — ঐ ফণা বিদ্যুতের মত নামল মেনকার গলায়। জেগে উঠে চীৎকার করে উঠল মেয়েটা — দেবতা তার কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করে গাছের ঘন পাতার আড়ালে সড়সড় করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বিষের জ্বালায় মেয়েটা ধড়ফড় করছিল আর গোঙাচ্ছিল। ওর মা আর বাপ অসহায় চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল। প্রতিমা আমার মেয়েটার কি হল গো বলে কান্না জুড়েছিল। কিন্তু ওরা বুঝেছিল, এখন, এই অবস্থায় ওদের পক্ষে মেয়ের জন্যে কোন কিছুই করা সম্ভব নয় — যা অনিবার্য, তাই হবে। ধড়ফড়ানিতে গাছের ডালে বাঁধা মেনকার চুপসে ভেজা শাড়ির আঁচল পড়পড় করে ছিঁড়ে গেল — মেয়ে গাছ থেকে প্রায় পড়ে যায় যায়। ওকে ধরে ফেলল প্রতিমা — কিন্তু ধরতে গিয়ে ও নিজেই প্রায় পড়ে যায় আর কি — নিজেকে সামলাতে গিয়ে মা ছেড়ে দিল মেয়ের হাত। ঝপাস করে একটা আওয়াজ — মেয়ে গাছ থেকে খসে পড়ল নিচে, জলের ওপর। বাপ আর মা গাছে বসে দেখল কিভাবে তাদের মেয়ে ছটফট করে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে, গোঙাতে গোঙাতে, তীব্র স্রোতে ভেসে দূরে, আরও দূরে চলে গেল — তারপর তাকে আর দেখা গেল না।
ওদের ছেলেটা এসব কিছু দেখে নি। গোবিন্দ ওকে ধরে রেখেছিল বলে ও নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমোচ্ছিল — এই চেঁচামেচিতেও ওর ঘুম ভাঙেনি।
প্রতিমা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিল। বৌ এর কান্না শুনতে শুনতে গোবিন্দর মাথায় হঠাৎ একটা আলটপকা চিন্তা এল — খাওয়াবার মুখ একটা কমে গেল।