জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) তো দেশে অনেক আছে। করবেট থেকে কাজিরঙ্গা, পেঞ্চ থেকে পেরিয়ার। পশুপ্রাণীতে ভর্তি এই পার্কগুলো দেশের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আমাদের দেশের তিনদিক ঘিরে যে সাগর, উপসাগর, মহাসাগরের বিস্তৃতি, তার খবর আমরা খুব কমই রাখি। ঐ বীচে বসে সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় দেখা পর্যন্তই। জলের নীচে যে কত রকম প্রাণীদের বাস--তা নিয়ে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত।
একমাত্র ব্যতিক্রম--গুজরাতের পশ্চিমে কোণে, কচ্ছ বেলাভূমির ধারে একটি ছোট্ট মেরিন ন্যাশনাল পার্ক। নারারা জাতীয় সামুদ্রিক উদ্যান। সারা দেশে মাত্র এই জায়গাটিতে ভাঁটার সময় হাঁটুজলে পায়ে হেঁটে সামুদ্রিক প্রাণীদের দেখা যায়। কোনো স্নরকেল বা স্কুবা ডাইভের যন্ত্রপাতির দরকার নেই। সাঁতার জানা না থাকলেও চলে। শুধু হাঁটতে জানলেই হল। দেখা যায় নানারকম মাছ, অক্টোপাস, কচ্ছপ, নানা রঙের কর্যাল রীফ বা প্রবালপুঞ্জ যা অন্য সময় দশ ফুট জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে থাকে।
পশ্চিম গুজরাটে কচ্ছের রন দিগন্তবিস্তৃত বেলাভূমির জন্য বিখ্যাত। সেইখানেই সমুদ্রের খাঁড়ির আশে পাশে, ছো্ট ছোট দ্বীপ ও বেলাভূমির ধারে ধারে ভাঁটার সময় জল অনেকদূর সরে যায়। মাছের লোভে নানারকম পাখিরাও ভিড় করে। পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণী দেখার ও ছবি তোলার এইটাই প্রশস্ত সময়।
প্রায় পঁচিশ বর্গ কি.মি. নিয়ে এই মেরিন পার্ক। এর মধ্যে অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপও আছে। আছে বেলাভূমি, প্রবালপুঞ্জ ও সুন্দরীগাছের ঘন বন। দ্বীপগুলি খুবই ছোট ও নামহীন। শুধু সব থেকে বড়টির নাম পিরোটান--সেখানে এক পীরের কবরস্থান আছে। অনেক পায়ে হেঁটে ভাঁটার সময় সেখানে পিকনিক করতে যান। জোয়ারের সময় অবশ্য নৌকার দরকার হয়।
কোর্যাল রীফের ওপর হাঁটার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা নারারা। তবে শুধু ভাঁটার সময়েই। প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টায় দুবার জোয়ার আর দুবার ভাঁটা। দুই জোয়ারের মাঝামাঝি ভাঁটার সময়েই হাঁটার সময়। তাই পার্কে যাওয়ার আগে ক্যালেন্ডার দেখে সময় ঠিক করা দরকার।
নারারা বা পিরোটানে যেতে হলে সব থেকে কাছের শহর জামনগর, নারারা থেকে ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। জামনগরে প্রেসিডেন্ট হোটেলেই সমুদ্রের জোয়ার-ভাঁটার নাড়ীনক্ষত্র জানা যায়। হোটেলের মালিক পার্ক সংরক্ষণে প্রবল উৎসাহী। অফিসের দেয়ালে জোয়ার-ভাঁটার সময় লিস্ট সাঁটা। আমরা সেই হোটেলেই উঠেছিলাম। পার্কে যাব শুনে ভদ্রলোক মহা উৎসাহে সমোসা ও লসসী খাওয়ালেন। তারপরে একঘন্টা ধরে কমপিউটারে পার্কে তোলা ছবিগুলো দেখাতে লাগলেন।
আমরা যখন গেছিলাম, ভাঁটার সময় ছিল মাঝ-দুপুরে। শীতের সময় হলেও দুপুরে ছায়াবিহীন খটখটে রোদ। তার উপর জলের মধ্যে-- চোখ একেবারে ঝলসে যায়। খুব করে সানস্ক্রীন মেখে মাথায় টুপি, গায়ে ফুলহাতা জামা, পায়ে মোটা সোলের জুতো ও কাঁধে পানীয়জলের বোতল আর ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হলাম।
নারারায় বীচের ধারেই ন্যাশনাল পার্কের অফিস ও টিকিট কাটার ব্যবস্থা। ওখানেই অল্পদামে সরকারি গাইডও পাওয়া যায়। গাইড নিয়ে যাওয়াটা জরুরী কারণ অনেক প্রাণী ছদ্মরূপে রীফের কোণে কানাচে লুকিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া তাদের দেখা পাওয়া অসম্ভব।
জলের ওপরেও দ্রষ্টব্য--দুধ শাদা বক, ইগ্রেট, হেরন, পেন্টেড স্টর্ক, সীগাল, আইবিস, প্লোভার, স্যান্ড পাইপার--কতরকম পাখির ভিড়। সবাই জোয়ারের আগে যথাসাধ্য পেট ভরাতে ব্যস্ত।
বড় জীবদের মধ্যে আছে অক্টোপাস। এরা সত্যিই বহুরূপী। মুহূর্তের মধ্যে রং বদলায়। কালো কালির পিচিকিরি ছুটিয়ে পলকের মধ্যে অত বড় শরীরটা কী করে যে ছোট্ট খাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, দেখেও বিশ্বাস করা যায় না। আমার মনে হয় সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবথেকে বুদ্ধিমান।