।। পর্ব ১।।
ভারতের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে অতন্দ্র প্রহরীর মত যে সহ্যাদ্রি বা পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দাঁড়িয়ে আছে, তার কাঁধের কাছ থেকে বিস্তৃত বাহুর মত চলে গেছে বালাঘাট পর্বতশ্রেণী। প্রায় ২০০ মাইল দীর্ঘ এই বালাঘাট শেষ হয়েছে আজকের মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের সীমানায়, ভীমা নদীর প্রান্তে। এই অঞ্চলের সকল পর্বতের মতই, বালাঘাট ও বহুসংখ্যক সমতল-শীর্ষ পাহাড় ও তাদের মধ্যে মধ্যে গভীর উপত্যকার সমাহার।
সন্ধ্যা আগতপ্রায়। বালাঘাটের এক বিশেষ চূড়ায় এক নারীমূর্তি একাকিনী দাঁড়য়ে ছিলেন। এই পাহাড়টি যমুনাচল নামে পরিচিত। তিনি নিষ্কম্পভাবে চিন্তামগ্ন মুখে সামনের উপত্যকার দিকে চেয়ে ছিলেন। পাহাড়ের ছায়াহেতু সে উপত্যকাটি প্রায়ান্ধকার, শুধু দূরের এক বঙ্কিম প্রান্ত দিনান্তের সূর্যের শেষ বক্র রক্তাভায় রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এটি পর্বতমালার পশ্চিম ভাগ, তাই বৃক্ষলতাগুল্মাদি আচ্ছাদিত, ছায়াচ্ছন্ন। বৃষ্টিবিরলতাহেতু পর্বতগুলির পূর্বভাগ নিষ্পাদপ, কঠিন, কর্কশ।
মহিলার পরনে কারুকার্যরহিত হরিদ্রাভ রেশমবস্ত্র, পর্বতারোহণের উপযুক্ত ধরনে কাছা দিয়ে কটি বেষ্টন করে আঁটোসাঁটোরূপে পরিহিত। পীত অঙ্গবাসে, কেশবিন্যাসে, সামান্য আভরণে কোথাও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু তাঁর মুখ দেখলে অনুভূত হয় এ কোন সামান্য নারী নয়। অকল্পনীয় ধৈর্য ও নির্ভীকতা মূর্তি পরিগ্রহ করলে হয়তো এমন তেজস্বিনী ব্যক্তিত্ব তৈরী হয়। আপাতত সেই অতুলনীয় আয়তচক্ষুর দৃষ্টি অন্যমনস্ক, অতীতচারী।
দূর থেকে প্রায় অশ্রুত ঘন্টাধ্বনি ভেসে এল। সেও সঙ্গে মেষশাবকের ডাকও। মুহূর্তে তাঁর তন্ময়তা ঘুচে গেল। তড়িৎপদে তিনি কিনারা থেকে সরে গিয়ে পশ্চাতের বৃক্ষরাজির মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
তিনি এখনো প্রস্তুত নন। কারো কাছে তাঁর উপস্থিতি ব্যক্ত হওয়া অনভিপ্রেত এখন।
বালাঘাটকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই সীমানায় জড়িয়ে রেখেছে গোদাবরী আর ভীমা নদী। এছাড়া অন্য যে উল্লেখযোগ্য নদীটি নাচতে নাচতে এ পর্বতমালার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তার নাম মঞ্জীরা। মঞ্জীরার গতিপথ বিচিত্র, বীদ অঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে সে প্রথমে বাকি সব নদীর অনুরূপেই দক্ষিণ-পূর্ব বাহিনী ছিল, কিন্তু মাঝারাস্তায় হঠাৎ মোচড় মেরে হয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব বাহিনী। সম্ভবতঃ গোদাবরীর আকর্ষণ ভীমার থেকে প্রিয়তর মনে হয়েছে তার।
ভীমাও বঞ্চিত নয় অবশ্য, তার দু-দুটো শাখানদী এই বালাঘাটের উপর দিয়ে এসেছে - বোর আর শিনা। এই বোর নদীর একটি অতিক্ষুদ্র শাখার তীরে কর্দম ঋষির আশ্রম। তিনি সস্নেহে এই চপলা তটিনীর নামকরণ করেছেন মন্দাকিনী। স্বর্গের নদী। এই কাঁটাগুল্ম-আকীর্ণ, জনবিরল, অনুর্বর স্থানটিই তাঁর কাছে স্বর্গতুল্য প্রিয়।
তাঁর পত্নী অনুভূতি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সহমত কিনা তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। ঋষিদেবের দুটি অকালকুষ্মাণ্ডসম তরুণ শিষ্য আর নিকটস্থ দরিদ্র গ্রাম থেকে নিয়মিত-আগতা এক স্থানীয় সহকারিণীর সহায়তায় তিনি আশ্রমের সব কাজ নিজহস্তেই সমাধা করে থাকেন। 'গোঁয়ার মিনষে'র পাল্লায় পড়ে এই শমন-অরুচি স্থলে থাকতে বাধ্য হওয়ায় তাঁর তিন বৎসর বয়স্ক পুত্রের যে সঙ্গীসাথী কেউ নেই, এটি তাঁর নিত্য অভিযোগের প্রধান অঙ্গ। ঋষি মহাশয় ধ্যানে সবিশেষ পটু, অভিযোগের তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ধ্যানমগ্নতা সমানুপাতে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
কিন্তু অবশেষে তাঁর জেদপ্রসূত হঠকারিতার ফল বড় বিষম হলো। বর্ষা ঋতুতে উপর্যুপরি নদীতে অবগাহন বা পর্বতবাহিত মৃত্তিকামিশ্রিত বারিপানের ফলে তিনি দেহে প্রবল উত্তাপসহ সেই যে শয্যাশায়ী হলেন, আর উঠলেন না। শিষ্যদ্বয় যথাসাধ্য সৎকারাদি সমাপন করল, তার পর নব্য গুরুগৃহের সন্ধানে যাত্রা করল।
অনুভূতি কিছু দিন শোকবিহ্বলা হয়ে রইলেন, সহকারিণীটি শিশুর দেখভাল করল। তার পর অনুভূতি বুঝলেন, জীবন বড় নির্মম, শোকপালনের থেকে, দৈনন্দিন যত প্রতিকূলতা আচম্বিতে তাঁদের সামনে এসে জুটেছে তার উপায় করা আশু কর্তব্য। তিনি কর্মঠা, নেহাত নির্বুদ্ধিও নন। কাজেই গৃহ প্রতিপালনের সংস্থান দ্রুত করে নিলেন, পুরাতন সহকারিণীটিই গ্রামে বলেকয়ে সম্বৎসরের তণ্ডুল আনিয়ে দিল, আর কিছু শাক ও আনাজ তিনি নিজেই কুটীর পার্শ্বে লাগাইয়াছিলেন। মাতাপুত্রের জীবন একরকম ভাবে অতিবাহিত হইতে লাগিল।
এই সামান্য আয়োজনেও, বালক হাস্যমুখে শশীকলার ন্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগল। তকে দেখে মাতার মনে যত হর্ষ, ততই দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। এই বিশাল এ ধরায়, তিনি এক একাকিনী নারী। সেই বাতুলস্বভাব ব্যক্তির সহিত বিবাহের ফলে তাঁর পরিচিত গৃহ পরিজন ছেড়ে কত দূরে এসে পড়েছেন, এখানে তাঁর আপনার বলতে কেউই নাই। এই শিশুকে বড় করতে হবে, গুরুগৃহ সন্ধান করে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, মানুষ করতে হবে। সম্পূর্ণ একাকিনী এ সকল করতে হবে, পারবেন তো?
মাতৃহৃদয় বলে, অবশ্য পারবেন। নারীহৃদয় বড় দুর্বল, আশঙ্কায় শতধা হতে থাকে। পৃথিবী কত বিপদ, কত হিংস্র জীব, কত দুরাত্মায় পরিপূর্ণ - তিনি পারবেন তো এই কুসুমতুল্য কোমল প্রাণটিকে নিরাপদ রাখতে! কোনো ধনী, ক্ষমতাবান ব্যক্তির শরণ নেবার কথা চিন্তা করেন একবার, পরক্ষণেই তা মন থেকে দূরীভূত করে দেন। তিনি নারী। অ-গতযৌবনা। রক্ষক ভক্ষক হতে কতক্ষণ! নারীমাংসের লোভ ধন ও ক্ষমতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত যে!
এরকমই এক বিনিদ্র রাত্রে, তাঁর কর্দম ঋষির কণ্ঠে শ্রুত মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনী স্মরণে আসে। একা নারী হওয়া সত্ত্বেও, ত্রিভুবনের দেবদেবী তাঁরই শরণ নিয়েছিলেন বিপদে ত্রাণ করতে। তিনিই পরম শক্তি, তিনিই চরম আশ্রয়।
মনস্থির করতে এক মুহূর্তও লাগে না অনুভূতির। শরণাগত হতে হলে, এনারই শরণাগত হবেন তিনি। এত বৎসর ঋষির গৃহিণী হবার সুবাদে ধ্যান জপমন্ত্র প্রকরণ সবই তাঁর জ্ঞাত। কাল থেকে, প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঐ মন্দাকিনীতীরে তিনি মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার ধ্যান-বন্দনা করবেন। তাঁর ও তাঁর পুত্রের রক্ষাভার এখন থেকে দুর্গা মাতার।
জীবনযাপন বেশ একটা নিয়মে থিতিয়ে এসেছে অনুভূতির। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তাঁর। পুত্র ও পরিচারিকা তখনো গভীর ঘুমে। তাদের নিদ্রায় ব্যাঘাত না করে, নিজের পূজা-উপচার গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
মন্দাকিনী তীরের নির্জন জোলো বাতাসে, ধ্যানাসনে বসে তাঁর মন অনায়াসে ডুবে যায় দেবীর ধ্যানে। দুর্গা, ভবানী, শৈলজা, অম্বিকা - যেদিন যে নাম মুখে আপনি আসে তাই জপ করেন মনপ্রাণ ভরে। ধ্যানচক্ষে ভেসে ওঠা দৃপ্ত সিংহবাহিনী মূর্তিটির সস্নেহ দৃষ্টি চেতনায় ধরা দেয়, কিন্তু মায়ের মুখটি স্পষ্ট হয় না।
রোদের তেজ তীব্র হচ্ছে, আসন তুলে উঠতে উঠতে নিজের অধৈর্যে নিজেই হেসে ফেলেন অনুভূতি। সবে তো মাসাধিক কাল হল, এরই মধ্যে সিদ্ধিলাভ করবেন! তাও এরকম অল্প সময়ের অর্চনায়? কিন্তু উপায় কই তাঁর আর বসার, এখনই ফিরে গিয়ে পাকশালার কর্ম, তারপর তাঁর বহু পরিশ্রমে এই অনুর্বর পর্বতঢালে সৃষ্টি করা সামান্য শস্য ক্ষেত্র, অলাবু-বার্তাকু-শাকাদির ক্ষেত্র, পুত্রকে বিদ্যাভ্যাসের গোড়াপত্তন করানো, গৃহকর্ম...পরিচারিকাটি তিনি ফিরলেই তার গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে, আবার সূর্যাস্তের আগে ফিরে এসে বর্তন মার্জনাদি করে রাত্রে তাঁকে সঙ্গ দেবে। ঋষির দেহান্তর পর থেকে এইই তাঁর দিনের বৃত্তান্ত। এর চেয়ে বেশী সময় যে ধ্যান করা সম্ভব না, সে কি আর মা ভবানী বুঝবেন না?
ফেরার পথে পা রেখেই এতক্ষণের শুদ্ধ সুন্দর মনের ভাবটা নষ্ট হয়ে গেল অনুভূতির। আজও লোকটা দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে। অচেনা বিরাট বলশালী চেহারা, রুক্ষ চুল, পাকানো গোঁফ ও পোশাক দেখলে যোদ্ধা মনে হয়। হবে হয়তো রাজার কোন সৈনিক বা কর্মচারী — রাজকর আদায়ের জন্য কখনো কখনো তারা এই পর্বতমালার গ্রামে গ্রামে আসে বটে। কিন্তু গত তিনদিন ধরে লোকটা এমন সময়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে, এটা খুবই অস্বস্তিকর।
প্রথম দুদিন লোকটি তাঁকে উঠতে দেখেই সরে দাঁড়িয়েছিল অন্য দিক ফিরে। অনুভূতি ভেবেছিলেন হয়তো প্রাতর্ভ্রমণ করতে এসে তাঁর পূজা না হওয়া অবধি দাঁড়িয়ে আছে। কাল সরেও দাঁড়ায়নি, মুখও ফেরায়নি, বরং বেশ স্পষ্টভাবে তাঁকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করেছে লোকটা। সে চোখের চাহনি বড় কলুষিত, অনুভূতির সর্বাঙ্গে যেন পিচ্ছিল স্পর্শ বুলিয়ে গেছিল তা।
কাজেকর্মে সেকথা ভুলেই গেছিলেন তারপর। আজ আবার লোকটাকে পথের ঠিক মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশংকায় মন শিউরে উঠল তাঁর। এ আজ পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে না বুঝে, যথাসম্ভব নিজেকে সংকুচিত করে, পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেন অনুভূতি।
আচম্বিতে বুকে যে কনুইয়ের ইচ্ছেকৃত ধাক্কাটা লাগল, তাতে যত না ব্যথা লাগল তার চেয়ে বেশি হল আতঙ্ক, হাত থেকে কোষা-কুষিটা পড়ে গেল মাটিতে। সেটা না তুলেই, ছিটকে সরে গেলেন তিনি, যথাসাধ্য তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, "সাবধান! ফের যদি এখানে দেখি তো অভিশাপ দিয়ে নির্বংশ করে দেব!"
লোকটা জবাবে জোরে হেসে উঠল একবার। কিন্তু আর এগিয়ে এল না। শুধু তাঁর হাত থেকে পড়ে যাওয়া কোষা-কুষিটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে অন্যদিকে চলে গেল।
একছুটে বাড়ি না ঢোকা অবধি আর পিছনে তাকাতে সাহস পেলেন না অনুভূতি। যদিও তাচ্ছিল্য আর কৌতুক মেশানো কুশ্রাব্য হাসির আওয়াজ আর কটু, ঝাঁঝালো দেশজ মদের গন্ধটা তাঁকে বহুদূর ধাওয়া করেছিল।
এমনই কপাল, সেদিনই পরিচারিকাটি বিকেলে এল না। ফলে সারারাত ছেলেকে জড়িয়ে প্রায় জেগে কাটালেন অনুভূতি। বড় ভয়ে, বড় আতঙ্কে। খালি মনে হতে লাগল সেই ভয়াল চেহারার দুর্জন লোকটা হয়তো সকালে তাঁর পিছু পিছু এসে বাড়ি চিনে গেছে; হয়তো সে এবার আসছে রাতের অন্ধকারে। সামান্য গাছের ডালের শব্দে মনে হচ্ছে কেউ হাঁটছে বাইরের উঠোনে, হাওয়ার শব্দে মনে হচ্ছে এই বুঝি দরজায় ধাক্কা দিল কেউ!
এরকম কাঁপতে কাঁপতে, কাঁদতে কাঁদতে শেষ রাতে চোখে নিবিড় ঘুম নেমে এল তাঁর। আর বিনা চেষ্টায়, বিনা মন্ত্রে মাতৃমুখটি আজ তাঁর স্বপ্নে স্পষ্ট উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সাহসে, তেজে গরিমাময়ী মধ্যবয়সিনীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী, সুদূরপ্রসারী ধীর চোখ, কপালে তৃতীয় নয়নটি এত জ্বলজ্বল করছে যেন এখনই আগুন ছুটবে সেখান থেকে।
ঘুম ভেঙেই মনে হল আজ সূর্যোদয় দেখতে পাবেন না। একা, ঘরে ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবেন? অথচ, সারারাত নির্বিঘ্নে কাটিয়ে আর ভোরে ওই অপরূপ মুখের স্বপ্ন দেখে মনটা বড়ই টানছে রোজকার ধ্যানস্থলের দিকে। দোনামনা করতে করতেই তাঁর খেয়াল হল, পানীয় জলও তো অপ্রতুল! এ কাজটি পরিচারিকা করে রাখে, কাল হয়নি।
কাজেই জলপাত্রের সঙ্গে, বাকি উপচার ও ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি নদীর দিকে পা বাড়ালেন।
শিশুটিকে একটা গাছের তলায় শুইয়ে দিয়ে, কলসে জল ভরে তার পাশে রেখে ভাল করে চেয়ে দেখলেন, কেউ নেই কোথাও। কালকের তর্জনে কাজ হয়েছে তার মানে। অভিশাপের ভয় কোন মানুষে না করে!
ধ্যানে বসামাত্র, সেই মুখখানি তাঁর মানসপটে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল সে মুখের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর পুরো চৈতন্য গ্রাস করে নিচ্ছে। অনুভূতি সর্বাংশে মগ্ন হয়ে গেলেন।
কতক্ষণ পরে চোখ মেলে চাইলেন হুঁশ নেই। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেছে মন। প্রাণ ঢেলে শেষ প্রণাম করে সব গুছিয়ে তুলতে হাত বাড়ালেন।
পুষ্পপাত্র। সিন্দূরদানি। ধূপাধার। কোষা-কুষি।
কোষা-কুষি???
মস্তিষ্কে বিপদঘন্টা বেজে ওঠার সময়টুকুও পুরো পেলেন না অনুভূতি। তার আগেই পিঠের দিক থেকে কর্কশ বলিষ্ঠ একটা হাত হ্যাঁচকা টানে তাঁকে শুইয়ে ফেললে চিৎ করে। হতচকিত অনুভূতি বিস্ফারিত চোখে দেখলেন তিনি সেই পাষণ্ডের কোলের ওপর শায়িত, তার একটা পাথরের মত হাত তাঁর গলার ওপর আড়াআড়িভাবে চেপে বসে তাঁর ঠেলে ওঠার চেষ্টায় বাধা দিচ্ছে, অন্য হাত হিংস্র লোলুপভাবে তাঁর ডান বুকে অকথ্য যন্ত্রণাদায়ক ভাবে পীড়ন করছে যেন অঙ্গটিকে খুবলে ছিঁড়ে ফেলবে এক্ষুণি শরীর থেকে।
গলা চিরে চীৎকার করে ওঠেন অনুভূতি। সে শব্দে ঘুম ভেঙে যায় গাছতলায় শয়ান শিশুটির, সেও আর্ত কান্না জোড়ে। কিন্তু এই নির্জনে কে শুনবে তাঁদের গলা? কে আছে এই নরাধম পাপী ছাড়া ধারেকাছে?
উলটে, তাঁর চীৎকারে দুর্বৃত্তের উল্লাস যেন আরো বেড়ে ওঠে। তার উৎকট হাসির আওয়াজ শুনতে শুনতে টের পান গলায় হাতের চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে, আর কোন আওয়াজ বেরোচ্ছেই না তাঁর গলা দিয়ে। হাত পা ছুঁড়ে বাধা দেবার চেষ্টা করামাত্র বিশাল বিকট শরীরটা উঠে এল তাঁর পায়ের উপর। গলায় চাপ আরো বাড়ছে, জলে ডুবে যাওয়া মানুষের মত অন্ধকার নেমে আসছে তাঁর চোখে, অন্ধভাবে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তিনি টের পেলেন দস্যুর অন্য হাত তাঁর বুকের ওপর থেকে সরে গেছে, পরিধেয় ছিন্ন করে তাঁর নিম্নাঙ্গ অনাবৃত করে ফেলতে ব্যস্ত সে হাত এখন।
জ্ঞান হারাতে হারাতে কানে অনুভূতি শেষ শোনেন তাঁর পুত্রের একটানা আর্তনাদ।
দ্রুত পায়ে যমুনাচলের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিগত যুদ্ধ-জনিত ক্ষত সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেছে, মনের ক্লান্তিও বিদূরিত। নবোদ্যমে তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন নিজগৃহে। তিনি অসামান্য দ্রুতগামিনী, হাতে একটি দীর্ঘ পর্বতারোহণ সহায়ক বংশদণ্ড। রাতের অন্ধকার থাকতেই যাত্রা করেছিলেন, ইচ্ছা ছিল আজই তুলিজাপুর পার হয়ে ধারাশিব পৌঁছে যাবার।
যেতেনও। বাদ সাধল দূর থেকে ভেসে আসা এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদ, আর তারপর একটানা এক শিশুর কান্না। দ্রুত গতি দ্রুততর করে কান্নার শব্দ অনুসরণ করে অকুস্থলে পৌঁছতে তাঁর কিছুমাত্র দেরি হলো না।
পৌঁছনোমাত্র মাথায় রক্ত উঠে গেল তাঁর। এক ভীষণদর্শন পুরুষ স্পষ্টতঃ এক ভূলুন্ঠিতা নারীকে বলাৎকারে রত, নারীটি তখনো প্রাণপণে বাধা দিতে চেষ্টা করছে দুইহাতে। ছুটে আসার গতি বিন্দুমাত্র না কমিয়ে সবেগে এক পদাঘাত করলেন ধর্ষকের মাথায়।
ছিটকে পড়ে লোকটা একটুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গেছিল। তার মধ্যেই তিনি হাতের লাঠিটি ঘুরিয়ে ধরেছেন। শুধুমাত্র এক বংশদণ্ড নয় তো, এর একপ্রান্ত লোহা দিয়ে বাঁধানো, তাতে সূচ্যগ্র ধারালো ফলা বসানো। ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়ানো মাত্র সে লাঠি নির্ভুল লক্ষ্যে নেমে এলো তার মাথা বরাবর।
যে অসম্ভব ক্ষিপ্র পায়ে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলো লোকটা তাতে বোঝা গেল এ সহজ প্রতিপক্ষ নয়, রীতিমত যুদ্ধনিপুণ শক্তিশালী দানব কোন। তাঁর চিন্তার প্রতিধ্বনি করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল তাঁর চেয়ে দেড়-মাথা উঁচু চেহারাটা,
"কে হে তুমি সুন্দরী? কুক্কুরাসুরের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছো, দম আছে বলতে হবে, অ্যাঁ? ফালতু যুদ্ধ-ফুদ্ধ না করে চলো কিছু অন্য খেলা খেলি না? এসব ছুঁলেই নেতিয়ে পড়া জড়পদার্থগুলোকে ভোগ করে করে বিরক্তি ধরে গেছে!"
কোন উত্তর না দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে লাঠি চালান আবার তিনি। আবারও পাশ কাটিয়ে যায় কুক্কুরাসুর। কিন্তু পুরোটা কাটাতে পারে না, বাহুতে ক্ষতর দাগ ফুটে ওঠে।
বিধ্বস্ত বিস্রস্ত শরীর বেশবাস সামলে, হামাগুড়ি দিয়ে ছেলের কাছে এতক্ষণে পৌঁছেছিল অনুভূতি। ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরে থর থর করে কাঁপছিল সে। সে জানে না কে এই অকুতোভয় নারী, যে মুহুর্মুহু ক্ষিপ্র লাঠি চালিয়ে রাক্ষসটাকে ক্রমশঃ কোণঠাসা করছে। এমন যোদ্ধা নিশ্চয় কোন রাজপরিবারের কন্যাই হবেন। যে-ই হোন, আজীবন এনার দাসী হয়ে থাকবেন অনুভূতি, শুধু আজ একে জিতিয়ে দাও মা ভবানী! অসুরের বিনাশ হোক! রক্ষা করো মাগো!
কুক্কুরাসুর কি শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল? গতরাত্রের প্রমত্ত সুরাপানের প্রভাব কি তাকে বিবশ করে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে? জানা নেই, কিন্তু ক্ষণেকের জন্য তার একাগ্রতা ভঙ্গ হলো, সরে যেতে গিয়ে ভুল করে উলটো দিকে পা বাড়ালো সে।
শ্বাসরোধকারী শব্দে লৌহদণ্ডের দিকটা তার মাথায় আছড়ে পড়ল। দুহাতে মাথা চেপে হাঁটু মুড়ে বসে পড়তে বাধ্য হলো সে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে তখন গড়িয়ে নামছে ঘন লাল রেখা।
সুবর্ণকঙ্কন শোভিত সুডৌল পিত্তলবর্ণ হাত উঠল আর নামল। সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রক্তমাখা ফলার ডগা, সটান বুক ফুঁড়ে পিঠের দিকে বেরিয়ে এসেছে সেটা।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলেন তিনি নিজের উত্তাল ক্রোধকে সামলে নিতে। তারপর ঘুরে এগিয়ে গেলেন গাছের নীচে বসা মাতাপুত্রের দিকে।
অনুভূতি মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে দেখছিলেন। কপাল বেয়ে, চুলের ধার বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, মুখ এখনো রাগে তপতপে, টিকোলো নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। কপালে ঘষা লেগে এলোমেলো লম্বাটে লাল তিলক জ্বলজ্বল করছে, যেন এখনই আগুন ছুটে বেরোবে সেখান থেকে।
চেনা মুখ। স্বপ্নে, ধ্যানে, আজ এঁকেই দেখেছে সে।
গলদশ্রু হয়ে লুটিয়ে পড়েন অনুভূতি, "রক্ষা কোরো মা, আমার সন্তানকে তুমিই চিরকাল রক্ষা কোরো।"
ক্লান্ত, ধীর, গম্ভীর গলায় উত্তর দেন দেবী ভবানী, "চিরকাল করব। সন্তানের রক্ষা করাই তো মায়ের ধর্ম!"
।। পর্ব - ২ ।।
আদি মায়া আদি শক্তি দেবীর পূজা শেষ করলেন গজানন অভয়ংকর। ভোর তখনো পুরো আকাশ আলোয় আলো করে দেয়নি। বংশপরম্পরায় গজাননরা এই মন্দিরের 'মহন্ত', অর্থাৎ মুখ্য পুরোহিত। কঠিন সময় যাচ্ছে দেশে। মারাঠা রাজ্য সারা ভারতে ক্রমবর্ধমান মুঘল আধিপত্যের দাপটে একে একে দুর্গ, অঞ্চল, স্বগরিমা সকলই হারিয়ে চলেছে, কিন্তু এই তুলিজা ভবানী মাতার মন্দিরের নিয়মরীতির এতটুকু ব্যত্যয় হতে দেননি গজানন। তাঁর অচল বিশ্বাস দেবী ঠিকই মারাঠা গৌরব পুনরুদ্ধার করে নেবেন।
তাঁর বিশ্বাস ইদানিং আরো গভীর, আরো আশাময় হয়ে উঠেছে শিব্বারাও এর কার্যকলাপে। তাঁরা যেমন সেই দেবীমন্দির স্থাপনের সময় থেকে এখানে পুরোহিত, তেমনি তাঁর স্নেহের পাত্র শিব্বারাও, মারাঠী মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়ে তোলা শিবাজী মহারাজের বংশেরও কুলদেবী এই তুলিজা ভবানী মাতা। কথিত আছে মন্দাকিনী নদীতীরে কুকুর নামের এক অসুরকে বধ করে সাধ্বী অনুভূতি ও তাঁর পুত্রকে রক্ষা করেছিলেন দেবী ভবানী। কথা দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের রক্ষা করবেন সর্বদা। সেই মানবীরূপা দেবীর অন্তর্ধানের পর তুলিজা নগরে স্বয়ম্ভূ দেবীমূর্তির আবির্ভাব হয়। অচিরে মন্দির গড়ে ওঠে, শহরের নামে দেবী পরিচিত হন তুলিজা ভবানী বলে।
নগরখানায় চৌঘড়া বেজে ওঠে। ঊষার প্রথম অভিবাদন। আদি মায়া দেবীর অপেক্ষাকৃত ছোট মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন গজানন। এবার তাঁকে মূল ভবানী মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। চরণতীর্থের আয়োজন করতে হবে। এত ভোরেও ভক্ত কেউ কেউ এসে বসে আছে। গজানন আসন গ্রহণ করেন। তাঁর সামনে বেদীতে তিন ফুট উচ্চতার, গ্রানাইটের নিকষ সুন্দর মূর্তি। দেবী অষ্টভুজা, এক হাতে অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, অন্যান্য হাতে অস্ত্রশস্ত্র।
দেবীর হাতের তরবারিটি আজ বেশিই ঝকঝক করছে যেন। কিংবা হয়তো আধো অন্ধকার থেকে এসে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় দেখার জন্য চোখের ভুল। মন দিয়ে উষ্ণ বারি, সুগন্ধী বারি, দুধ ইত্যাদি দিয়ে দেবীর পা ধুইয়ে দেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গজানন।
নদীর ধারে বসে থাকতে বড় ভাল লাগে রঘুবন্তের। তার নামটা যত বীরত্বব্যঞ্জক, মানুষটা ততই ভীরু সুকোমল সে। পনেরো পেরিয়ে ষোলয় পড়ল সে, কিন্তু বয়সোচিত দৌরাত্ম্য, চপলতা, অহং কিছুই তার স্বভাবে নেই। সে পড়তে ভালবাসে, একা একা নির্জনে বসে চিন্তা করতে ভালবাসে। ভীড়ভাট্টায় তার ভারি অস্বস্তি হয়।
তার মা নেই। বাবা গ্রামমুখ্য অম্বাজী পটেল ছোট ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বড় দুটিকে মন দিয়ে তাঁদের ব্যবসা ও জীবনের নানা কূটকচালির পাঠ দিতে লেগেছেন। আজ ভবানী মাতার মন্দিরে শিবাজী মহারাজ আসবেন পূজা দিতে। বাবা দাদাদের নিয়ে সেই উপলক্ষ্যে রওনা হতেই রঘুবন্ত চলে এসেছে তাদের গ্রামের প্রান্তে এই বোর নদীর ধারে। অল্প জঙ্গল পেরিয়ে ভিতরে গেলে একটা অতি সুন্দর ঘাসজমি আছে খোলা। এটা ওর প্রিয়তম জায়গা। এই ঘাসের গালচেতে শুয়ে শুয়ে কত যে অলস দুপুর বিকেল পার হয়েছে ওর সে ইয়ত্তা নেই। শেষে গোরু ছাগলদের ঘাস খাওয়াতে আসা কোন রাখাল ছেলে হয়তো ওকে ডেকে নিয়ে গেছে সুয্যি ডোবার আগে।
আজ কিন্তু ঘাসজমিটা পুরোই ফাঁকা। হবেই, শিবাজী মহারাজ আসা মানে মন্দিরে দীয়তাং ভুজ্যতাং আজ। সবাই নিশ্চয় সেখানেই গেছে।
আয়েস করে একটা শিরীষের ছায়ায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ে রঘুবন্ত। সামনে এই নদীর মতই বিস্তৃত ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে তার। কি করবে সে? বাবা চান সেও তাদের ব্যবসার হালহকিকত বুঝে নিক। তার মন লাগে না। এর ওপর ইন্ধন হল শিব্বারাওয়ের একের পর এক মারাঠাদের সঙ্গে সমান সমান টক্কর দেবার কাহিনী। যত শোনে তত রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু বাবা বলেন এরাও আরেক দস্যুদল। বলেন সর্বত্র খাজনা দিয়ে দিয়েই আমরা ফতুর হয়ে যাব। তার আগে আখের গুছিয়ে নিতে শেখ, বুদ্ধু।
আজ গজাননের বারে বারে বড় চমক লাগছে। চরণতীর্থের শেষে পানপাতা দিয়ে পা মোছাতে গিয়ে গিয়ে হাতে খোঁচা খেলেন। এতকাল দেবীর সেবা করছেন, কখনো খেয়াল করেননি তো পায়ের নখাগ্র এত ধারালো!
পঞ্চামৃত, দধি সহযোগে অভিষেক সেরে যখন তূপ-ভাথ, মানে ঘি-ভাতের নৈবেদ্য সাজিয়ে রেখে দিয়ে বেরোচ্ছেন, তখন দ্বার বন্ধ করার আগে শেষ মুহূর্তে দেখলেন থালাটি যেখানে রেখে এসেছিলেন সেখান থেকে দেবীর অনেকটাই কাছে সরে গেছে। সেই থেকে আতঙ্কে ভুগছেন গজানন, তিনি তো কিছুই টের পাননি, কিন্তু নিশ্চয় অসতর্ক তাঁর পায়ের ধাক্কায়ই হয়েছে এটা। হে মা ভবানী, পাপ নিও না মা!
ঠিক দ্বিপ্রহরে ধূপ আরতি করার জন্য কর্পূর দীপ হাতে মন্দিরকক্ষে ঢুকে স্থানু হয়ে গেলেন গজানন। পিতলের ভোগ নিবেদনের থালা ঝকঝক করছে শূন্য।
বৃদ্ধের হাত কেঁপে দীপ মাটিতে পড়ে গেল। গত কয় মাস ধরেই মন্দিরে ধেড়ে ইঁদুরের উৎপাত বাড়ছে। আজ শিব্বারাওকে সে-নিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবেন ভেবেছিলেনও তিনি। তার আগেই এই অনাচার হয়ে গেল! দেবীর ভোগ চেটেপুটে খেয়ে গেল পাপিষ্ঠগুলো! আজ কী প্রসাদ তিনি তুলে দেবেন সমাগত ভক্ত আর তাদের আদরের শিবাজী মহারাজের হাতে! হায়, কেন যে সময়মত ব্যবস্থা নেননি।
পাপ, পাপ! কি শাস্তি নেমে আসতে চলেছে তাঁদের ওপর এই ঘোর অমঙ্গল আচরণের ফলে!
রঘুবন্ত শুয়ে শুয়ে শিবাজী মহারাজের কথাই ভাবছিল। এমন সেনানায়ক মারাঠারা বহুকাল তাদের পেশোয়া রাজত্বে দেখেনি। রঘুবন্ত শুনেছে দেখে বোঝা মুশকিল ইনি এত সাংঘাতিক, এমনকি মুঘল বাদশারাও এই 'পাহাড়ি ইঁদুর'কে সমীহ করে চলে। বেঁটে মজবুত চেহারা, বলিষ্ঠ কাঁধ, আজানুলম্বিত হাত। নিজের ফ্যাকাশে পাতলা হাতের মুঠো তুলে দেখতে গিয়ে হেসে ফেলে সে।
খুব মৃদু খসখস আওয়াজ হয় কোথাও। ঘাসজমি পেরোলে ওপাশে ঘন বন। হবে কিছু খরগোশ টরগোশ।
রঘুবন্ত চোখ বোজে।
গজানন বৃথাই চিন্তা করছিলেন। শিবাজী মহারাজ দুপুরে এসে পৌঁছতে পারলেন না। কিছু জরুরি মন্ত্রণায় আটকে আছেন বলে খবর এল। বাকি ভক্তদের দ্বিতীয়বার রান্না করা ভাতের সঙ্গে সকালের ভাজি প্রসাদ দিয়ে মানরক্ষা করলেন তিনি। একটু কানাকানি হল এ নিয়ে, রাজার জন্য ভোগপ্রসাদ সরিয়ে রেখে সাধারণ ভক্তজনদের বঞ্চিত করা হল ভাবল হয়তো কেউ কেউ। কি আর করা!
সূর্য যখন ঢলে যাচ্ছে, দীপাভিষেকের সময় সমাগত, তখনো শিবাজী মহারাজ এসে পৌঁছলেন না। গজানন আন্তরিক দুঃখিত হচ্ছিলেন। আজ সকাল থেকে সবই কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এতদিন বর্ষাকাল চলছিল, মুঘলরা যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করে নিজেদের কোটরে চুপ করে বসেছিল। এবার, দশহরা উৎসব আগতপ্রায়। এখনই মাতার মন্দিরে এমন সব অঘটন, কি জানি এ কিসের ইঙ্গিত!
দুশ্চিন্ত হৃদয়ে মন্দিরকক্ষে প্রবেশ করেই এক আর্ত চীৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ।
বেদী শূন্য। দেবীমূর্তির কোন চিহ্নমাত্র নেই।
রঘুবন্ত চোখ খুলেই আঁতকে উঠল। এত আঁধার হয়ে এসেছে, কি সর্বনাশ! আজ তাকে ডাকার কেউ ছিল না বলে সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল! সূর্য প্রায় ডুবে গেছে, শেষ কিছু কিরণের ম্লান লাল আভা নদীর জলে ভেসে আছে। গ্রাম অবধি বেশ অনেকটা জঙ্গলের পথ, সেই পথে এখনই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে দেখা যাচ্ছে।
প্রাণপণে দৌড় লাগাল রঘুবন্ত। হা বাপ্পা, কি করেছে সে এ! এ জঙ্গলে রাখাল, কাঠকুড়ানি সবাই যাতায়াত করে ঠিকই, কিন্তু সে দিনমানে। দিনমণি ডুবলে জঙ্গলের ইজারা হয় বন্যপ্রাণীদের। বাঘ বা ভাল্লুক নাই থাক, শিয়াল নেকড়ে তরক্ষু বিরল নয় এ অঞ্চলে। এবং সাপ। শেষ শব্দটা মনে পড়তে গতি কমাতে বাধ্য হল রঘুবন্ত। যতই অন্ধকার হোক, দেখে দেখে পা ফেলতে হবে।
তেমনই ফেলছিল। সন্তর্পণে, সতর্ক চোখে। চোখের কোণ দিয়ে আবছা একটা ঝলক সরে যাওয়া দেখতে পেল যেন।
কিন্তু কোথায় কি! চারদিক তেমনই খালি, তবে আগের মত নিঃশব্দ নয় যেন আর। অনেক পাখির ডানা ঝটপটানি। কোন গাছের উপরের ডাল থেকে বাঁদরের ব্যস্ত হুপহাপ। রাত হচ্ছে, রাতচরাদের ঘুম ভাঙছে।
আবার এগোতে গেল যশোবন্ত। তখনই, বাজ পড়ার মত আচম্বিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত তার ঠিক সামনের গাছ থেকে একলাফে নেমে এল।
দীর্ঘ, পেশল, সবল হলুদ শরীর। কালো কালো চাকা দাগ। আগুন হলুদ চোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টি নিথর চেয়ে আছে তার দিকে। লেজের ডগাটুকু অবধি নিষ্কম্প, চিতা ঝাঁপ দেবার জন্য তৈরী।
কেন যে ও বাবা দাদাদের সঙ্গে ভওয়ানী মাতার মন্দিরে গেল না! রক্ষা করো মা গো!
রঘুবন্ত টের পেল তার হাঁটু কাঁপছে ভয়ে। এবার আর রক্ষা নেই...
তার মাথার পিছন থেকে একটা পাথর উড়ে এসে লাগল চিতার মাথায়। তার পর আরো একটা। পর পর আরো আসছে যে, মাথা দুহাতে চেপে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে।
চিতাটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল এই অতর্কিত আক্রমণে। কয়েক পা পিছিয়েও গেছিল অনর্গল পাথরের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। তার পরমুহূর্তে সেই বনাঞ্চল যে অপ্রাকৃত হুংকারে কেঁপে উঠল তার জন্য চিতা বা রঘুবন্ত কেউই প্রস্তুত ছিল না। সেরকম ভয়ংকর ক্রুদ্ধ তেজী হুংকার ইহজগতে ক'জন শুনেছে সন্দেহ।
রঘুবন্ত ভয় ত্রাসে দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পাশের গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। চিতাটা পালাল না। কিন্তু তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ঘনঘন ল্যাজ নাড়া বলে দিচ্ছিল যে সেও সন্ত্রস্ত।
মারাঠী ধরনে আঁটোসাঁটো মলিন লাল শাড়ি, রুক্ষ জটা চুল চুড়ো করা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ উল্কিখচিত হাতে ঝকঝক করছে একটা টাঙি গোছের অস্ত্র। এই মধ্যবয়েসী আদিবাসী মহিলা যে এমন হুহুংকার করতে পারেন, বিশ্বাস হচ্ছিল না রঘুবন্তের। কিন্তু তারপর যা দেখল তাতে তার বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখা উড়ে গেল চিরকালের মত। যে বিদ্যুৎগতিতে, যেমন দাপটের সঙ্গে মহিলা চিতাটাকে আক্রমণ করলেন, শিবাজী মহারাজও তেমন পারতেন কিনা সন্দেহ! উদ্ভ্রান্ত চোখে রঘুবন্ত শুধু দেখল হলুদ কালো রঙের আর কালো হাতে টাঙির সোনালী ঝলকের বিস্ফোরণ; কানে শুনল শুধু সেই ভয়াল ভয়ংকর গলায় দুর্বোধ্য উচ্চারণ আর আহত চিতার যন্ত্রণার আঘাত।
কতক্ষণ হবে? হয়তো কিছু মুহূর্ত মাত্র। চিতা হার মেনে যেমন আচমকা এসেছিল তেমনি আচমকা পালিয়ে গেল। আদিবাসী মহিলাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। শাড়ির পাড়ের কিছু অংশ চিতার নখের আঘাতে ঝিলিমিলি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে। পা ধূলিধূসরিত কর্দমলিপ্ত। একটু দম নিয়েই তিনি টাঙিটা কোমরে গুঁজে, রঘুবন্তকে হাত নেড়ে ইশারায় উঠতে বললেন। তারপর দৃঢ় রুক্ষ হাতে ওর হাত চেপে ধরে বড় বড় পা ফেলে চললেন গ্রামের দিকে।
পাহাড়ী ঢাল। গ্রামে পৌঁছবার আগের বাঁক ঘুরতে ঘুরতে রঘুবন্ত দেখল, ঘনায়মান অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে, এক মেঘের পুঞ্জ ছুটে আসছে নীচের সর্পিল পথ বেয়ে। ও পথ গিয়ে থেমেছে ভবানী আঈ এর মন্দিরে। কারা আসছে বুঝতে দেরি হল না রঘুবন্তের। স্থান কাল ভুলে উল্লাস প্রকাশ করে ফেলল সে, "শিব্বারাও!"
যে হাত ধরা টানে এতক্ষণ চলছিল সে, টানটা থেমে গেল ওর কথায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে, ওর দিকে এই প্রথম মুখোমুখি তাকালেন মহিলা।
কালো ত্বক। উল্কির সবুজ দাগ। কানে খুব পুরোনো ঘরানার বিশাল কানবালা। ঘোর লাল চোখ। এগুলো বাদ দিলে, হুবহু তার মরা মায়ের মুখ।
অপার্থিব স্নেহময় একটা হাসি খেলে গেল সে মুখে। মাথার ওপর খুব আলতো একটা স্পর্শ পেল রঘুবন্ত। তারপর সেই পিত্তল-কঙ্কন-শোভিত হাত স্পষ্ট আঙুল বাড়িয়ে সেই অপসৃয়মান মেঘের দিকে দেখাল।
তারপর, সেই মাতৃমূর্তি পিছন ফিরে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল অতি দ্রুত গতিতে।
রঘুবন্তও প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। গ্রামের দিকে না। মন্দিরের দিকে। মনস্থির করা হয়ে গেছে তার। দেশের এ দুর্দিনে, গ্রামের ক্ষুদ্র রাজনীতিতে দাদাদের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে, তার শিব্বারাওয়ের দলেই তাকে যোগ দিতে হবে।
মা পথ দেখিয়ে গেছেন।
শিবাজী ঘোড়া থেকে নেমেই বুঝলেন কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। আজ অবধি কখনো দেখেননি মহান্তজী এমন ম্লান বিষণ্ণ মুখে তাঁকে আপ্যায়ন করছেন। বুদ্ধিমান রাজা, কারো সামনে মুখ খোলা উচিত নয় বুঝে সবাইকে চলে যেতে বললেন, বললেন তাঁর কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে মহন্তজীর সঙ্গে।
নিরিবিলি হতে, ছোট থেকে দেখা, পিতৃব্যতুল্য মানুষটিকে প্রশ্ন করলেন, "কী হয়েছে খুলে বলুন তো!"
"বলব যে কি ভেবে পাচ্ছি না শিব্বা, তুমি নিজে এসে দেখো বরং। মাতা পরম কুপিত হয়ে আমাদের ছেড়ে গেছেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের।"
এতখানি অমঙ্গলজনক কিছু আশা করেননি শিবাজী। দুরু দুরু বুকে গজানন মহান্তজীর পিছু পিছু দেবীমন্দিরে ঢুকে কিন্তু কিছুই অমঙ্গলের চিহ্ন দেখতে পেলেন না। কষ্টিপাথরের মূর্তি বেদীর উপর তেমনি বরাভয় চোখে চেয়ে আছেন, বরং অন্যবারের চেয়ে এবার যেন সে চোখ আরো জীবন্ত, আরো বীরত্বমহিম লাগল তাঁর।
গজাননও হতবাক হয়ে চেয়ে ছিলেন। এ কি আশ্চর্য লীলা! তবে কি তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল? কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব, ভোগের থালা, শূন্য বেদী, পরপর এত বিভ্রম হতে পারে!
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়েছেন ততক্ষণে শিবাজী। বেরিয়ে যাবার আগে লঘুহাস্যে গজাননের বাহু স্পর্শ করে বললেন, "আপনার ভুল হয়েছে কোন মহন্তজী! মা কখনো বিপদকালে ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারেন! যান, নিশ্চিন্তে দেবীমার শয়নের ব্যবস্থা করে নিন, তারপর অনেক কথা আছে।"
তাই হবে। তাই হবে। গজাননের চোখ বোধহয় এবার বার্ধক্যের গ্রাসে পড়ছে, বড় ছেলে চতুরানন তৈরী হয়ে আছে, ওকেই এবার মায়ের মহন্ত করে দেবেন। শিব্বারাওকে আজই বলে রাখবেন কথাটা।
গোমুখ থেকে আনা পবিত্র গঙ্গাবারি দিয়ে প্রক্ষালন পর্ব করতে করতে পায়ের কাছে এসে আবার থমকে যেতে বাধ্য হলেন গজানন। চোখ গেছে সত্যিই, আর কোন সন্দেহ নেই। নইলে, মায়ের পায়ে লেগে থাকা এই এত ধুলমিট্টির টুকরোগুলো সকালে সাফ করে দেননি!
শাড়ির নিচের অংশের অনেকটা জায়গা জুড়ে কারুকার্যও কেমন অন্যরকম লাগছে না? একদিকের পাড়ে এতটা জায়গা জুড়ে এমন সরু সরু বেখাপ্পা এঁকাবেঁকা দাগ ছিল নাকি আগে?
ঠিক যেন, কোন বড় শ্বাপদের নখের আঁচড়?