বাংলা স্ল্যাং: সমীক্ষা ও অভিধান—অভ্র বসু; প্যাপিরাস প্রকাশনা, কলকাতা-৪; প্রথম প্রকাশঃ মে ২০০৫, চতুর্থ সংস্করণঃ মার্চ ২০১৬; ISBN: 81-8175-071-3
না, আমি জানতাম না। আমি ভুল লিখেছিলাম।
পঁয়ষট্টি সংখ্যায় ‘বাংলার প্রবাদ’ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে ‘বাঙলাভাষায় আজও অশিষ্ট শব্দকোষ রচিত হলো না’ লেখাটা আমার ভুল হয়েছিলো, যখন মাতৃভাষায় বর্তমান পুস্তকটির মানের এক প্রামাণ্য কোষগ্রন্থ বারো বৎসর আগেই লেখা হয়ে গেছে। এক আদি-পরবাসী বন্ধু এই দিকে আমার নজর টেনে বিশেষ ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।
প্রথমেই একবাক্যে লিখি, বাঙলা ব্রাত্যশব্দ-সংক্রান্ত হেন দিক নেই, যা এই সাড়ে চারশত পৃষ্ঠার পুস্তকে আলোচিত হয়নি।
সাধু! সাধু!!
প্রশ্ন আসে তাই, কেন পড়বো বাঙলা স্ল্যাং-এর কোষগ্রন্থ? কেন রেখেছি ঘরে কিনে?
বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব ন’টি ভাষায় খিস্তি করতে পারার বড়াই করতেন। বস্তুতঃ, ব্রাত্যশব্দের জ্ঞান ব্যতিরেক কোনো ভাষার শিক্ষা সম্পূর্ণ হতে পারে না। কারণ, শুধু চাঁদ-ফুল-পাখি নিয়ে যেমন একটা গোটা ভাষা নয়, মেহনতী মানুষ আর সংগ্রামী হাতিয়ার নিয়েও নয় কেবল, তেমন ব্রাত্যজনের মুখের স্বাভাবিক ভাষাও যে কোনো ভাষারই ততটাই অঙ্গ যতটা সেই ভাষার প্রধান কবির কবিতা। অর্থাৎ, ভাষার সম্পূর্ণতার জন্যেই তার ব্রাত্যশব্দেরও নৈর্ব্যক্তিক চর্চা হওয়া দরকার। শুধু তা-ই নয়, ব্রাত্যভাষার বিবর্তনের ইতিহাস কি ভাষার পিছনের সমাজ-রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর মুকুরও নয়? অবশ্যই। সাহিত্য পরিষদের অধিবেশনের মত এক সারস্বত সভার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ (যাঁকে কবিগুরু এক শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের মর্যাদা দিতেন) যখন ‘পি কে ডি পি’ (‘পুঁথি কণ্ঠস্থ-করা দিগ্গজ পণ্ডিত’) স্ল্যাং ব্যবহার করেছিলেন, মুহূর্তের মধ্যে কি এটাও প্রমাণিত হয়ে গেলো না যে সেকালেও অন্তঃসারশূন্যতা ছিলো বহাল তবিয়তে এবং তৎসঙ্গে ছিলো তার প্রতি বিদ্রূপ? কী বললেন, এটা ঠিক স্ল্যাং নয়? বেশ, এই ধারাতেই ‘কে এল পি ডি’-র উল্লেখ করলে সেটাকে তো স্ল্যাং বলে মানতেন? হেঁ হেঁ!
অর্থাৎ, যুগে যুগে স্থান ও পাত্র ভেদে ব্রাত্যশব্দের বিবর্তন হয়, হয়ে আসছে, এটা একটা গতিময় ধারা। শতবৎসর পূর্বে স্বামী বিবেকানন্দের মুখে ‘মাগী’ বা ‘রাঁড়’ শব্দ স্বাভাবিক ছিলো, আজ আর নেই, পদস্খলন হয়ে ব্রাত্যের দলে চলে গেছে এগুলি। সংস্কৃতভাষায় স্ল্যাংশব্দ আছে বলে শুনিনি। এটা তার রুদ্ধগতির উদাহরণ। আর ভাষাবিজ্ঞানকে যদি এক নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞান বলে মানতে হয়, তবে নাক-না-কুঁচকিয়ে ব্রাত্যশব্দেরও পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চা করতে হবে, যেটা অতি যত্নে বিপুল সৃজনীর সঙ্গে এক বিরাট ইজেলে করে বর্তমান লেখক আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এটি শ্রীবসুর ইউ জি সি ফেলোশিপের ডক্টোরাল গবেষণা। বাঙলাভাষায় এ এক যুগান্তকারী কাজ। সেলাম জানাই।
*
দুইটি ভাগে বিভক্ত পুস্তকখানি।
দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় সওয়া দুইশত পৃষ্ঠাব্যাপী রয়েছে এক ব্রাত্যশব্দের অভিধান যেটা লিখতে গিয়ে লেখক নিশ্চয়ই তেমন কোনো রেফারেন্স পুস্তক খুঁজে পাননি, কারণ উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-কৃত এমন এক ব্রাত্যশব্দের তালিকা ভিন্ন এক্সক্লুসিভ স্ল্যাং-অভিধান বাঙলাভাষায় এর আগে আর গ্রথিত হয়েছিল বলে জানতাম না। এখন জানলাম, ওনারই এই বই পড়ে (পৃ. ১৮৮-১৯৬)। অর্থাৎ, সিংহভাগটাই শ্রীবসুর কানে-শুনে-লেখা; তাই একে তুলনা করি এক ‘ভাগীরথী-প্রয়াস’ এর সঙ্গে। জানা-অজানা-আধজানা হেন বাঙলাব্রাত্যশব্দ নেই যা এখানে ঠাঁই পায়নি। তবে, ‘সমাস’ বলে যে বহু বহু চালু শব্দ এখানে তিনি ঢুকিয়েছেন, সেগুলি ঠাট্টার পর্যায়ে পড়ে, ব্রাত্যাভিধানিক শব্দ বলে এদের মানতে একটু কিন্তু কিন্তু; যদিও পড়তে পাওয়াটা ইন্টারেস্টিং। এগুলির একটি পৃথক তালিকা তো দিয়েইছেন (পৃ. ১১৮-১২২)।
*
পুস্তকটির প্রথমার্ধের দুইশত পৃষ্ঠার অধিক জুড়ে স্ল্যাং/ স্ল্যাং-এর (১) কী ও কী নয়; (২) বিবর্তন; (৩) বৈশিষ্ট্য; (৪) ব্যবহার; (৫) আভিধানিক স্বীকৃতি; (৬) সামাজিকতা; ও (৭) আরও পাঠ্যতালিকা যা দেওয়া হয়েছে তা ধারে-ভারে-মানে এরিক পার্ট্রিজ সাহেবকে নিশ্চয়ই অতিক্রম করে যায় (ওনার একটি ভিন্ন অভিধান আমি নিজে পড়িনি/দেখিনি, স্বীকার)। তাই বলছিলাম, বাঙলা স্ল্যাং-সংক্রান্ত এক মহাগ্রন্থকে যত দিক থেকে যত ভাবে ঋদ্ধ করা উচিত, করা সম্ভব, সেটা করেছেন গ্রন্থকার। অতুলনীয় কাজ। বাঙলার মতো একটা প্রায় অর্ধসহস্রাধিক বৎসর প্রাচীন ভাষার ব্রাত্যকোষগ্রন্থ রচতে একবিংশ শতাব্দী এসে গেলো, এটাই আক্ষেপ। এর আগে ড. সত্রাজিৎ গোস্বামী মহাশয় এই অভিমুখে উল্লেখ্য কাজ করেছেন, জানা গেলো, কিন্তু ঐ একখানিই (আমি পড়িনি/দেখিনি)। যেখানে, ইঙ্গভাষায় স্ল্যাং এর রেফারেন্স বই-ই দেওয়া রয়েছে এখানে, তা গোটা ত্রিশেক তো হবেই।
*
বইটি পড়তে পড়তে ব্রাত্যশব্দ সম্পর্কিত পুরনো/নতুন কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে চাগিয়ে উঠলো। সবিনয় নিবেদন করিঃ
১) সম্ভবতঃ, যেকোনো ভাষার স্ল্যাং-এ, বাঙলা স্ল্যাং-ও ব্যতিক্রম নয়, যৌনতার এতো আধিক্য কেন (পেশাগত স্ল্যাং-এ ছাড়া)? ভিক্টোরীয় কালচার আসবার পূর্বে তো চেয়ারের পায়ে মোজা পরানোর চল ছিলো না, তা-ও?সর্বশেষে, পুস্তকটির শিরোনামে ইংরেজি ‘স্ল্যাং’ শব্দটিই রেখে দেওয়াতে অ-সহমত পোষণ করলাম (যদিও লেখক আত্মমত সমর্থনে বহু যুক্তি দিয়েছেন)। ‘অশ্লীল’ শব্দ হিসেবে দেগে দিতে না চাইলেও, স্ল্যাং ‘ব্রাত্যশব্দ’ তো বটেই। এইটিই শিরোনামে থাকলে আরও সুপ্রযুক্ত হতো, মনে হয়।২) নারীর সতীত্বকে টেনে ব্যাঙ্গ করা স্ল্যাং-ও সংখ্যায় বহু। এর কারণ? নারীর সতীত্বের পবিত্রধারণাটি কবে থেকে অত্যুচ্চ হলো? এটা কি ধর্মীয় প্রভাবে?
৩) বাঙলা সাহিত্য থেকে দেওয়া খাঁটি স্ল্যাং-এর উদাহরণ বহু নয়। নবারুণ ভট্টাচার্য এর পুরোধা। এ থেকে তাঁর একঘরেপনাই প্রতিষ্ঠিত হয় বোধ হয়। উদাহরণে দেওয়া কেতকী কুশারীর কবিতায় মোটেই স্ল্যাং ভাষা নেই (পৃ. ১৬৪)।
৪) দেশভাগের চাইতে বড়ো ক্রোধের ঘটনা বঙ্গের ইতিহাসে আর হয়নি। স্ল্যাং যদি ক্রোধ বহিঃপ্রকাশের এক পথ হয়ে থাকে তাহলে বাঙলাভাষার দেশভাগ-সাহিত্যে স্ল্যাং-এর উদাহরণ নেই কেন?
৫) উপ-আঞ্চলিক স্ল্যাং নিয়ে একটি উপবিভাগ থাকলে ভালো হতো।
পুনঃ ‘স্ল্যাং-না-হয়েও-স্ল্যাং’ শব্দ আধুনিক বাঙলায় এসে গেছে বেশ কিছুঃ ‘সুধীর ভাই’, ‘পোকাশদা’... ফলানা। লেখক বোধহয় অবগত নন। নৈলে, এর একটা উপ-বিভাগ হয়তো থাকতো, ‘কাকিনাড়া’ ‘অচ্যুতানন্দ’-হেন ‘সমাস’-এর যখন রয়েছে একটা।
পুরনো হাওড়ার কথা—সুকান্ত মুখোপাধ্যায়; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা লি, কলকাতা-৭৩; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১১, পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণঃ মার্চ ২০১৪; ISBN: 978-81-7626-253-15
১৬৮৬ ঈশাইয়ের বিশে ডিসেম্বর। সুবা বাঙলার শাসক আওরঙজীবের মাতুল শায়েস্তা খাঁর দাপটে কাশিমবাজার ছেড়ে হুগলি, তারপর হুগলি ছেড়ে আরও দক্ষিণে গঙ্গার পুবপাড়ের সুতানুটি গ্রামে পালিয়ে এসে কুঁড়ে বাঁধলেন ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান এজেন্ট। এর আগে, তাঁর পাটনাবাসের পূর্বে, চানুকসাহেব হাওড়ার উলুবেড়েতে জাহাজ মেরামতির কারখানা করার অনুমতি পেয়েছিলেন এবং সেখানেই সপরিবার ঘাঁটি গেড়েছিলেন। উলুবেড়ে তখন বর্ধিষ্ণু বন্দর। কে জানে, সেবার সুতানুটিতে না এসে উলুবেড়িয়াতেই ফের ফিরে এলে আজ এই দুয়োরানীর গল্প শোনাতে হতো কিনা? প্রাচীন দিশি বাঙলায় ‘হাবড়’ মানে কাদা-মাটি, যা থেকে ‘হাওড়া’। তবু প্রাচীনত্বে ব্যাতড়, শালিখা, ঘুষুড়ি কলকেতার অনেক আগে। চৈতন্যসাহিত্যে, চণ্ডীমঙ্গলে এ’সকল স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। লন্ডনের পরেই, সূর্য-না-ডোবা সসাগরা বৃটিশ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শহর ক্যালকাটার দুয়োরানী হয়েই হাওড়া বেঁচে আছে আজ কয়েক শতাব্দী। দুয়োরানী তো, তাই শহর কলিকাতা নিয়ে যত গবেষণা যত বইপত্তর তার এক আনাও হাওড়া নিয়ে নেই। হাওড়ার ভূমিপুত্র প্রখ্যাত অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারাপদ সাঁতরা মশায়ের কিছু প্রাসঙ্গিক লেখা পড়া ছিলো। বর্তমানেরটি আরেক ভূমিপুত্রের, এক নামী চিকিৎসকের কলমে।
*
‘পুরনো’ মানে কত পুরনো?
লেখক শুরু করেছেন দ্বাদশ শতকে ওড়িশারাজ অনন্তবর্মণের দক্ষিণবঙ্গবিজয় দিয়ে। ক্রমে যখন ইংরেজ রাজত্বের পত্তন হলো মীরজাফর যে যে পরগণা লিখে দিলেন রবার্ট ক্লাইভকে, তার মধ্যে ছিলো পাইকান পরগণাও। আজকের হাওড়া শহর এই পরগণার মধ্যেই বা পাশে ছিলো। ফার্সিতে লিখিত সেই সনদের ছবি রয়েছে এই বইতে। চমৎকার! তারপর ক্রমে পৃথক এক জেলা হিসেবে হাওড়ার জন্ম, ১৮২২-এ হুগলি জেলা থেকে বেরিয়ে গিয়ে। প্রথম জেলাশাসক নিযুক্ত হলেন উইলিয়ম টেলর, ১৮৪৩... এ’সব তথ্য জানা গেলো এই বই পড়ে। আরও কতো না-জানা তথ্য, যেমন ঘুষুড়ির কাছে তিব্বতি মঠ, ‘পুরণ গিরি মঠ’ নামে যা সমধিক প্রসিদ্ধঃ ওয়ারেন হেস্টিংস ও দলাই লামার সাক্ষর/মোহর মিশে গেছে এর ফার্সি দলিলে। বহু বহু ফার্সি দলিলের ফ্যাক্সিমিলি রয়েছে এই বইয়ে, পাশে ইং-তর্জমাও। বেশ। অনেক অনেক প্রাচীন চিত্রের সাদাকালো রিপ্রিন্টও। শহর হাওড়ার পাশাপাশি বালী, আমতা, উলুবেড়িয়ার মত জেলার আরও কিছু প্রধান প্রধান জনপদ সম্বন্ধে বেশ কিছু মনোজ্ঞ তথ্য! যেমন, ১৮৮০র দশকেও আমতা থেকে হাওড়া শহরে আসবার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো শোচনীয়ঃ কাঁচা রাস্তায় চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করতে পাঁচ-ছয় দিন লেগে যেত, জলপথেও দামোদর হয়ে সে প্রায় সপ্তাখানিকের ধাক্কা! ভাবো!
হাওড়ার বহু বহু বিস্মৃত ভূমিপুত্রের কথা এসেছে। যেমন, ‘মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি...’র শিশুসাহিত্যিক শ্রীনবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মশাই (রবীন্দ্র-সুহৃদ ও বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির গৃহশিক্ষক)। বা, আন্দুলরাজ শিক্ষাব্রতী যোগেন্দ্রনাথ মল্লিক বা, হাওড়ার প্রাচীনতম ইতিহাসকার (১৮৭২) কৃশ্চান চন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বার-এট-ল! এসেছে বর্ধিষ্ণু গ্রাম বালির প্রাচীন টোল-চতুষ্পাঠীর কথা, তার প্রাচীন কাগজকলের প্রসঙ্গঃ ‘কাগজ-কলম-কালি/ এ’ তিন নিয়ে বালি’। বরং, অষ্টম অধ্যায়খানিই বেশ প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছেঃ ‘হাওড়ায় প্রাপ্ত সুলতানী আমলের মুদ্রা’।
*
শেষ করেছেন লেখক (দ্বাদশ অধ্যায়) এক প্রকৃতই বিস্মৃত শিল্পোদ্যোগীর প্রসঙ্গ দিয়ে, নাম যাঁর ছিলো উইলিয়াম জোন্স! না, ‘এশিয়াটিক সোসাইটির’ প্রতিষ্ঠাতা শ্রেষ্ঠ ভারতবিশারদ নন, সমনামী আরেক জোন্স, যিনি ‘গুরু জোন্স’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। সত্যি বলছি, এ’হেন এক উদ্যোগীর সম্বন্ধে কিচ্ছু জানতাম না ভেবে লজ্জিত হচ্ছি। উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে শিবপুর-কেন্দ্রিক যাঁর বহু বহু উদ্যোগের কথা জেনে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। আরও উৎসাহ পেয়ে Indian Journal of History of Science এর এই নিবন্ধটি পাঠ করে ঋদ্ধ হওয়া গেলো। মুখবন্ধে পি টি নায়ার-সাহেবও ওনার ভূয়সী স্মৃতিচারণ করেছেন।
*
শেষে এক মহা-অপ্রাপ্তির কথা না বলা অনুচিত হবেঃ সারা ভারতবাসী হাওড়াকে চেনে কলকাতার গেটওয়ে হিসেবে। কলিকাতা শহরের প্রধান রেলস্টেশন হাওড়ায় অবস্থিত না হলে হাওড়ার এই খ্যাতি হতো না। শুধু হাওড়া রেলস্টেশন স্থাপনার ইতিহাস নিয়েই দীর্ঘ এক মনোজ্ঞ নিবন্ধ পড়েছিলুম বহুদিন আগে। হাওড়ার এক ইতিহাস লিখিত হচ্ছে যাতে রেলস্টেশনের কোনো উল্লেখ নেই, এটা মেনে নেওয়া গেলো না, যেমন মেনে নেওয়া গেলো না জগদ্বিখ্যাত শিবপুর বি ই কলেজের অনুল্লেখও, বা বিশপস্ কলেজের। এ’গুলো কি যথেষ্ট ‘পুরনো’ নয়? লঘু-উদ্যোগে (আজকের ‘এম এস এম ই’) হাওড়া এককালে ভারতশ্রেষ্ঠ ছিলো। তার ইতিহাসও অনুল্লেখিত। বেলুড়মঠও।
হয়তো ডাক্তারবাবু পরের কোনো পর্বে বা সংস্করণে এ’সব গল্পও আমাদের শোনাবেন।
স্বল্পমূল্যের পুস্তক এ’খানি, কিন্তু লেখকের কায়মনোবাক্য প্রচেষ্টা ও নিবেদনখানি সুস্পষ্ট এর সর্বাঙ্গে। সপ্রশংস নিজ পুস্তকভাণ্ডারে স্থান পাবার মতো বই এ’খানি তাই।
তোমার পরশ আসে—বিমোচন ভট্টাচার্য; সৃষ্টিসুখ, বাগনান, হাওড়া; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৭; ISBN 978-1-63535-527-7
এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধ। যদিও সারস্বত পরিমণ্ডলে জন্ম তাঁর, আজীবন লেখনীর চর্চা করেননি কিছুই, শুধু দেখে গেছেন, শুনে গেছেন পুষ্ট হয়ে গেছেন চারিপাশের মানুষ থেকে জীবন থেকে পরিমণ্ডল থেকে।
পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী, অবসরান্তে কলম ধরলেন, থুড়ি, কি-বোর্ড। প্রথমে অর্কুটে, পরে ফেসবুকের মত ‘সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে’। বিগত প্রায় আট বছর ধরে নেটে বাঙলা লেখালেখির এক পুরোধা, যাঁর লেখা নেটে এলেই শ’পাঁচেক লাইক শ’দুয়েক কমেন্ট বাঁধা। আজকের এই ‘ফল্স্ কমেন্ট’ আর পরস্পর পিঠচাপড়ানির যুগেও কিন্ত যেটা বেশ বিরল। আরও কত কত জন তো লেখেন, লিখে চলেছেন বাঙলায় ফেবুতে, কৈ, সকলের লেখা তো এতো নজর কাড়ে না, এমন শেষাবধি পড়ায় না? সেখানেই প্রবীণ শ্রীবিমোচন ভট্টাচার্য মহাশয়ের মুন্সীয়ানা। এঁর প্রায় সব লিখনই স্মৃতিকথাধর্মী, উত্তমপুরুষে লেখা, যেটা সাধারণত পাঠকের বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে (ভাবটা, ‘বাপু, তোমার বাপ-মা বন্ধুদের গপ্প, আমি কেন পড়তে বাধ্য থাকবো?’)। কিন্তু না, বিমোচনবাবুর বলার ভঙ্গিমাতে, উপস্থাপনার গরিমায় পাঠককুল উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়ে চলেছে, দু’চারদিন পোষ্ট না এলে বা কম এলে তাঁদের উশখুশানি। এই নেটজ প্রতিযোগিতার বাজারে আজকাল এটা কিন্তু উপেক্ষণীয় নয় মোটেই। এনার লেখা শিল্পসুষমায় অত্যুচ্চ না হলে, বিষয়চয়ন আকর্ষক না হলে এতো দীর্ঘদিন এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব ছিলো না। সেটা পেরেছেন, পেরে চলেছেন বলেই ইনি বিমোচন ভট্টাচার্যঃ শুধু শহর কলকাতা নয়, ঢাকা-মুম্বাই-নিউজার্সিতে ছড়িয়ে থাকা সহস্র বাঙালি পাঠককুলের অতি প্রিয় ‘বাসুদা’। ওনার এ’হেন শতাধিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখালেখির এক সংকলন বর্তমান পুস্তকখানি। মনকাড়া।
*
লেখকের পিতা ছিলেন কিংবদন্তী নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য, ‘বিশ্বরূপা’-র মঞ্চসফল ‘ক্ষুধা’, ‘সেতু’ নাটকের নাট্যকার; ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘দেয়া নেয়া’-র মত উত্তমকুমারীয় হিট ছবিরও। কিন্তু আট ভাইবোন ও তুতোদের নিয়ে জনাবিশেকের মস্ত সংসার ছিলো তাঁদের। দরিদ্র, কারণ সেকালে বিধায়কবাবুর রোজগার অত্যুচ্চ ছিলো না। এরই মধ্যে এক সাধারণ স্কুলে সাধারণ কলেজে পড়ে বড় হয়েছেন লেখক, মিশেছেন যত বখাটে-অবখাটে ছেলেপুলের সঙ্গে (বন্ধুঅন্তপ্রাণ!), আর খুলে রেখে দিয়েছেন চোখের আর মনের জানলা দুটোঃ মানুষ দেখার মানুষ চেনার আর তাদের ভালোবাসার। এইটে ছিলো, আছে বলেই বিমোচনের লিখন পায় গভীরতা, হয়না পুনরুক্তিদুষ্ট, হয় জনপ্রিয়, অতি জনপ্রিয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনের উপর্যুপরি দুর্যোগ, নিকটাত্মীয়বিয়োগ পাঠকের মনকেও ছুঁয়ে যায়, আর্দ্র হয় আঁখি; এটা তাঁর উপস্থাপনার জোরে, বাচিক সহজতায়, যেখানে ভান নেই কোনো।
*
ছুট্কাহানির (anecdote) ছড়াছড়ি এই বইয়েঃ সে শ্যামল-ধনঞ্জয়ের মান অভিমানের পরিসমাপ্তি দক্ষিণেশ্বরে গিয়েই হোক্ বা, ঠেলাগাড়ি চড়ে সমরেশ বসুর বাড়ি ফেরা বা, ‘অবনী বাড়ি আছো’ (এ’প্রসঙ্গে তো আমরা হালে বড় নিবন্ধ পড়লাম পরবাসের পাতায়!) বা, ‘ধর্ষণে অভিযুক্ত বিধায়ক’! আর অনায়াস উঠে এসেছেন সেকালের কত হারিয়ে যাওয়া শিল্পী, গুণী মানুষের কথাঃ অভিনেত্রী রাণীবালা, লীলাবতী করালী, যাত্রাশিল্পী অভয় হালদার...। পরম মমতায় এ’হেন নমস্যদের কথা শুনিয়েছেন বিমোচন। আর, মেডিক্যাল কলেজের রোগী সেই মীরকাশিমের ভাই? তুম ন জানে কিস্ জহাঁ মেঁ খো গয়ে...
*
সরোজ দত্তের ভক্ত, মনেপ্রাণে বামপন্থী মানুষটির খ্যাত-সঙ্গ কিন্তু কম হয়নিঃ উত্তমকুমার থেকে স্বপনকুমার, নচিকেতা ঘোষ থেকে পীযূষকান্তি, সুভাষ-শক্তি থেকে তারাপদ রায়; আবার পাশাপাশি আছেন হালিমচাচা, সহকর্মী সচিন, জয়দেব, সহপাঠি সহদেবের কথা, মাতৃসমা মেজমায়ের কথা, যাঁদের কথা বাসুদা না লিখলে হারিয়ে যেত কবে কোথায়! বলবে, কী এমন কথা এদের? কী ক্ষতি হতো জগতের এ’সকল ‘also ran’-দের কথা না জানলে? তিপ্পান্ন সংখ্যায় ‘আমার আত্মজন’ পড়েছিলাম, ছাপ্পান্নয় ‘বাজার সরকার’-এর কথা। এঁরাও নিজ নিজ পরিপাশের মুচি-মেথর-সবজীওয়ালা-বাসকন্ডাক্টরদের গল্প শুনিয়ে গেছেন। এইসব মানুষই তো কেকের স্টাফ গো, উপরের টপিংসটা তার কেবল দৃশ্যমান করে রাখা। বিমোচনের কলমেও এঁদের বড়ো বর্ণময় উপস্থিতি। মম-সাহেব লিখলে তো ‘সালভাদোর’ হয়ে উঠতো। বাসুদা লেখেন তাঁর পরমপ্রিয় গানের কলি দিয়ে, ‘আমি অকৃতি অধম, বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি...’! বা, সেই যে বন্ধুমাতার শেষশয্যায় গেয়ে ওঠা, ‘পথে চলে যেতে যেতে...’। হ্যাঁ, পরশ দিয়ে চলে যায় এই সব লিখন, বড় হৃদয়গ্রাহী সে পরশ তোমার!
*
বিমোচন ভট্টাচার্য মহাশয়ের লিখনপ্রসঙ্গে আজকের ‘নেটসাহিত্য’ বিষয়টা চলে আসে অবধারিতভাবে, কারণ, ফেসুবুক-হেন উদার-উন্মুক্ত বিশ্বব্যাপী প্রাঙ্গন না পেলে বিমোচন-রামকৃষ্ণ-প্রকল্প-অমিতাভ প্রামাণিকের মত আজকের কবি-সাহিত্যিকগণ উঠে আসেন না। এঁনারা কোনো প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা বা পত্রিকাগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারালোকে আসেননি। এঁদের প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত প্রতিদিনের, যার মধ্যে দিয়েই এঁদের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত, প্রতিভা বিচ্ছুরিত। এতে প্রতিষ্ঠিত কাগুজে পত্রিকার গাত্রদাহ স্বাভাবিক। তাতে থোড়াই কেয়ার। নেটে বাঙলাসাহিত্য ক্রমবর্ধমান, ক্রমপুষ্টমান। মাভৈঃ। ফুল বিকশিত হৌক শত শত; খোঁজ চলুক, চলতে থাকুকঃ কোন্ নুড়িতে কখন যে তাঁকে পাওয়া যায় কে জানে তা?
*
দুটি প্রসঙ্গ টেনে এই লেখা শেষ করবো। উত্তমকুমারের সুপারহিট ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ছবির প্রসঙ্গ একাধিকবার এসেছে বিমোচনের কলমে, যার কাহিনি-চিত্রনাট্য ইত্যাদি পিতা বিধায়কের। প্রাসঙ্গিক চমৎকার কাহিনি শুনিয়েছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, যেটি এখানে নেই। বিধায়কবাবুর লেখায় আলসেমির কথা সর্বজনবিদিত ছিলো। গাড়ি পাঠিয়ে উত্তমকুমার জবরদস্তি বাড়িতে ধরে এনেছেন বিধায়ককে, স্ক্রিপ্ট শুনতে। দীর্ঘ পাঠাদির পর অকস্মাৎ পুলক দেখে ফেললেন,তাঁর স্ক্রিপ্টের খাতাটি সাদা, সম্পূর্ণ সাদা! সমগ্র স্ক্রিপ্টটি স্মরণ থেকে বলে গিয়েছিলেন বিধায়কবাবু!!
দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত এক অপ্রাপ্তির কথাঃ বাল্যে-কৈশোরে আমরা কিন্তু নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য মশায়কে মঞ্চ বা চিত্রসফল নাট্যকার বলে চিনতুম না। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয় নাট্য-সিরিজ ‘অমরেশ’-চরিত্রের স্রষ্টা, ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর পুজোবার্ষিকীতে যাঁর উপস্থিতি থাকতো প্রতিবছর। বিমোচনের বলা তাঁর প্রখ্যাত পিতার নানা গল্প নানাভাবে স্থান পেয়েছে এই সংকলনটিতে, ‘অমরেশ’ রয়ে গেছেন অনুল্লেখিত।
ভবিষ্যতে কখনো অমরেশ-চরিত্রের নেপথ্যকাহিনি শোনবার আশা রাখি।
INDIAN RAILWAYS: The Weaving of a National Tapestry— Bibek Debroy, Sanjay Chadha & Vidya Krishnamurthi, in Gurcharan Das (Ed) ‘The Story of Indian Business’. Portfolio Penguin publishers, Gurgaon, India; ISBN: 978-0-143-42675-2
দিগন্ত বরাবর সমান্তরাল দুটো লোহার পাত পাতা সড়কে ধোঁয়া ওড়ানো রেলইঞ্জিনের দৌড় দেখা বালক অপুর স্বপ্ন ছিলো। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের এ’গল্প তো ছিলো এক প্রতীক, আধুনিকতার প্রতীক! যদি কোনো একটি ঘটনার হাত ধরে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের উত্তরণ হয় আধুনিকতায়, তো সেটা রেলপথের পত্তন। যুগে যুগে রাজাগজা বদলে বদলে গেছে দিল্লি থেকে তাঞ্জোর থেকে প্রাগ্জ্যোতিষপুরে, কিন্তু আম-ভারতীয়ের জীবনযাত্রার আমূল বদল কিছু হয়নি, যেটা রেলওয়ে এসে করে দিতে থাকলো উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে। তারই কাহানি এ’পুস্তকে, পেঙ্গুইনের ‘স্টোরি অব্ ইণ্ডিয়ান বিজনেস’ সিরিজের দশম গ্রন্থ (চতুর্থটির কথা আমরা পড়েছিলাম একান্ন সংখ্যায়)।
*
বলাই বাহুল্য, ভারতবর্ষের মত এতো বিশাল এক দেশে রেলওয়েজ প্রথম আনয়নের মতো কার্য সহজ ও অনায়াস ছিলো না। খরচাপাতির প্রসঙ্গ ওঠবার আগে প্রথমতঃ তো ছিলো ‘রেলপথ না খালপথ’ এই বিতর্ক, যাতে স্যর আর্থার টমাস কটনের (১৮০৩ - ৯৯) মতো যুগান্তকারী সেচ-ইঞ্জিনিয়র দ্বিতীয়পথের সমর্থক ছিলেন। অপরদিকে, স্যর রাউওল্যাণ্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসনের (১৮০৮ - ৯৫) মতো স্বপ্নদেখা রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়র স্বীয়মতের সমর্থনে জনমত গড়ে তোলেন ও গভর্নর লর্ড ডালহৌসিকে সাথে পেয়ে যান। ১৮৪৩এ কলকাতায় এসে স্টিফেনসন দেখা করলেন ‘কার টেগোর এণ্ড কোং’-এর পুরোধা প্রিন্স দ্বারকানাথের সঙ্গে, যিনি তাঁর রাণীগঞ্জ কয়লাখনি থেকে কলিকাতা বন্দরের সহজ সাপ্লাই চেইন খুঁজছিলেন। বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন (কেশবচন্দ্রের পিতামহ) ও ডিরোজিয়ান বাগ্মী রামগোপাল ঘোষও সমর্থন করলেন এই নতুন পথের। রেলওয়ে, বস্তুতঃ, ছিলো স্টিফেনসনের ধ্যানজ্ঞান, যিনি লন্ডন থেকে কলকাতা হয়ে পিকিং পর্যন্ত রেলপথ বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ’সব গল্প নিয়েই এই বই, যদিও এটা তো বইয়ের মুখপাত মাত্র।
*
এরপর থেকে কীভাবে ধাপে ধাপে ভারতবর্ষে রেলপথের প্রবর্তন ও ক্রমপ্রসার ঘটতে থাকলো, সেই ১৮৩০এর দশকে প্রথম পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার কাল পর্যন্তের গল্প শুনিয়েছেন এই সওয়া দু’শ পৃষ্ঠার গ্রন্থে তিন অর্থশাস্ত্রী, যাঁরা ২০১৪ সাল থেকে এক উচ্চক্ষমতার রেলওয়ে কমিটির সঙ্গে যুক্ত। শ্রীবিবেক দেবরায় প্রধান তন্মধ্যে। সিরিজ-সম্পাদক গুরুচরণ দাসের পূর্ব এক ঘোষণামতো এই কেতাব লেখার কথা ছিলো ঐতিহাসিক অনুরাধা কুমারের। পরিবর্তনের কারণ অজানা। যাহোক্, যে গ্রন্থ হাতে পাওয়া গেছে ও গোগ্রাসে গেলা গেছে সে প্রসঙ্গেই লিখি, কারণ এই সিরিজের পনেরটি বইয়ের মধ্যে চতুর্থটির পরেই বিশেষ আগ্রহ ছিলো বর্তমানটির প্রতি, যেটি সম্প্রতি প্রকাশিত। ১৮৪৫-এ প্রতিষ্ঠা আদিতম ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির’ (পরবর্তীতে, কলকাতা-কেন্দ্রিক ইস্টার্ন রেল), ১৮৪৯-এ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিন্সুলার রেলওয়ে’ (পরে, বম্বে-কেন্দ্রিক সেন্ট্রাল রেল) আর তারপর আসতে থাকে একের পর এক অঞ্চলভিত্তিক রেলওয়ে কোম্পানি, সবই বেসরকারী মালিকানায়, কারণ ভারতের হিন্টারল্যান্ড থেকে তুলো (পশ্চিমে) আর কয়লা (পূর্বে) দ্রুত তুলে আনতে পারলে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব যে ত্বরান্বিত হয় সেটা বৃটিশ প্রভুরা ততদিনে বুঝে ফেলেছেন। আর, ভারতের এই রেলবিপ্লবের টাকা উঠেছে ভারতীয়দেরই শুষে, কোম্পানির বাজেটারি সাপোর্ট অত্যল্প; যেটা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে হয়নি। আর ভারতীয়রা অমানুষিক কষ্টে উচ্চভাড়া দিয়ে তাদের রেল চড়তে পেতো, যেটা অবশ্য শশী তরুর তাঁর সাম্প্রতিক একটি পুস্তকে দেখিয়েছেন, এ’ বইতে সেই দৃষ্টিকোণের আলোচনা কম। বস্তুতঃ, বহু দীর্ঘ দীর্ঘ উদ্ধৃতি বর্তমান কেতাবটির পাঠগতি রুদ্ধ করে, যেটা এই সিরিজের অন্য বইগুলিতে ততটা পাইনি। তথ্য অফুরন্ত ও নির্ভুল, কিন্তু সুখপাঠ্যতা কম, যদিও দু’-একস্থানে যে ঝলক নেই তা নয়। যেমন, ব্রড না মিটার না ন্যারো গেজ প্রসঙ্গে পড়িঃ রোমানরা দ্বিঅশ্ববাহী যে রথ চালাতো তাদের বৃটেনশাসনকালে, তা থেকে পথে চক্রদ্বয়ের দাগ বসে যেতো। তাই সকল রথই সেই প্রস্থে বানানো হতো, নৈলে গতিতে উল্টে যাবার সম্ভাবনা। বহু পরে যখন ট্র্যাম ও রেল এলো বৃটিশ কলিয়ারিতে তখনও ঐ চার ফিট সাড়ে আট ইঞ্চিই মাপ রইলো গেজের। সেই থেকে নববিশ্ব আমেরিকায় গেল রেল। সেখানে পরে যখন স্পেশসাটলের বুস্টার রকেট বানানো হচ্ছে, মনে রাখতে হলো যে তা রেলের টানেলের ঐ মাপ মতো হওয়া চাই (নৈলে কারখানা থেকে বয়ে আনা হবে কী করে সেটা?)। তাই, শেষ বিচারে, দুই রোমক অশ্বের নিতম্বের প্রস্থের সঙ্গে স্পেশসাটলের মাপ মিলে গেলো রেলপথের মাধ্যমে! হি হি হি!!! বর্তমান গ্রন্থমালা আমপাঠকের জন্যে, তাই কেবল ইকনমিক্সের তথ্যভারাক্রান্ত করলে কি চলে? চমৎকার চমৎকার সাদাকালো বহু বহু ছবি, অনেকগুলি দিল্লির রেল মিউজিয়মের সৌজন্যে প্রাপ্ত, অনেকগুলি রেল ফ্যান ক্লাবের (এ’গ্র.স.-টি লেখার আবহ বানাতে গতমাসে দিল্লির রেল মিউজিয়ম ঘুরে এলুম!)। অনেক অনেক অধুনালুপ্ত দেশীয় রাজ্যের রেলের লোগো দেখতে পাওয়া গেলো, বহু পোস্টাল স্ট্যাম্প। শেষ (পঞ্চম) অধ্যায়টি মনোজ্ঞ সর্বাপেক্ষা, যেখানে নানা হলিউডি সিনেমার পোষ্টারে রেলের ছবি থেকে রেলে ঘোরা ছিঁচকে চোরেদের স্ল্যাং নিয়েও বলা হয়েছে। রয়েছে হিগিনবথাম ও উইলারের মতো শতাব্দী+ প্রাচীন রেলবইবিপণীর গল্প। অতি উপাদেয়। রয়েছে রেলবোর্ডের কিংবদন্তী চেয়ারম্যান স্যর উইলিয়ম একওয়ার্থের কথা। মনে পড়লো, এককালে কোনো একটা কাজে ‘একওয়ার্থ কমিটি রিপোর্ট’ খুঁজেছিলাম হন্যে হয়ে দিল্লির লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিতে। সেটা যে নেহ্রু লাইব্রেরিতে উপলব্ধ, এখন জানলাম। অখিলচন্দ্র সেনের ভুলে ভরা ইংরিজি যে অভিযোগপত্র থেকে নাকি রেলে ল্যাট্রিনের শুরু তা কিন্তু দিল্লির রেল-মিউজিয়মে নেই (গতমাসে গিয়ে ঢুঁড়ে পাইনি)। গ্রন্থশেষে অক্ষরভিত্তিক সূচি/পরিশিষ্ট নেই, এটি বড় খামতি।
*
শেষবিচারে ভারতীয় রেল এক মহাসাগর যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতা খুঁজতে টেকনো-ইকনমিক রিপোর্ট থেকে সাহিত্য-এনিকডোট থেকে চলচ্চিত্র কম হয়নি, ভাগীরথিটি বাঙালি নলিনাক্ষ সান্যাল মশায়ের (আজকের সঞ্জীব সান্যালের প্রপিতামহ)। সেই ধারায় বর্তমান পুস্তকটি এক উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ, সন্দেহ নাই।