পৃথিবীর সব থেকে বড় নদী ও জঙ্গলের বর্ণনাটা লিখে বা মুখে বলে ওঠা শক্ত। কোনো বিশেষণেই কুলোয় না। কোথায় যে শুরু করি। প্রথমেই বলতে হয় নদীটার বিষয়ে। সত্যিই বিরাট। আমি যেখানে ছিলাম সেই নামহীন জায়গাটা নদীর মোহনা থেকে ২০০০ মাইল দূরে। তবুও সেখানেই নদীটা প্রায় এক মাইল চওড়া! সমুদ্রের কাছে নাকি ২০০ মাইল চওড়া হয়ে যায়। আর তা-ও শান্ত নদী নয় মোটেই। এখানে সেখানে গভীর, ঘূর্ণিপাক, দুরন্ত স্রোত। তারপর হরেকরকম আজব প্রাণী তো আছেই। বর্ষার সময় জল আরও কুড়ি ফুট বেড়ে ওঠে। গাছপালার অর্ধেকই জলে ডুবে যায়। আসলে এই জঙ্গলে প্রত্যেকদিন বৃষ্টি হয় (তাই নাম রেন ফরেস্ট)। শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণটা বেশী। তবু, এতবড় নদী হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা যানবাহন চলাচল দেখিনি। কোনো বড় নৌকা, স্টিমার বা জাহাজের তো নামই নেই। তারা সবাই পূবে ব্রাজিলের দিকে যাতায়াত করে। এই নদীর তীরে কোনো বিরাট সভ্যতাও গড়ে ওঠেনি। ইজিপ্ট, চীন অথবা ভারতের মত কোনো মহান নগরীও গড়া হয়নি। কারণ এই বিরাট জঙ্গল, যা অনায়াসে অ্যান্ডিস থেকে আটলান্টিক পর্য্যন্ত এত বড় নদীটাকে লুকিয়ে রেখেছে।
আমরা দশ বারোজন যাত্রী আমাদের জু-গার্ডেনের ম্যানেজারের সঙ্গে গেছিলাম—পশ্চিম আমাজনের (পেরুতে) জঙ্গলে। জায়গাটা নামহীন, ম্যাপে পাওয়া যাবে না। পেরুর ছোট্ট শহর ইকিতোস (মায়ামি থেকে সোজা প্লেন যায় ইকিতোস পর্যন্ত), সেখান থেকে ডিঙি নৌকায় নদী বেয়ে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা ৫০ মাইল মোটামুটি পেরু-বলিভিয়া-ব্রাজিলের সঙ্গমস্থলে। ইকিতোস যাবার রাস্তা বা রেললাইন নেই। প্লেন ও নৌকাই সহায়। আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেখানেও নদী ছাড়া গতি নেই। আমাজন ও তার শাখা-প্রশাখাই হাইওয়ে।
সকাল বিকেল একদল ম্যাকাও আসত তাঁবুতে এঁটোকাঁটা খেতে। একটি পাখিকে আমাদের রাঁধুনী কয়েকটা স্প্যানিশ কথাও শিখিয়েছিল। আর আসত একটি বিরাট ঠোঁটওয়ালা ট্যুকান। গেলাসে ঠোঁট ডুবিয়ে কফি খেতে ভালবাসতো। কিন্তু কাঁচের থালাবাসন দেখলেই সেটা ফেলে ভেঙে ছত্রখান করত। এছাড়াও আমাদের মাঝির প্রিয় পশু ক্যাপিবারা—বুনো শুয়োরের মত দেখতে—নদীর ধারে কাদায় গড়াগড়ি করত। মাঝি ওর নাম দিয়েছিল চার্লি।
প্রথম দিন গরম (৮০-৯০ ডিগ্রী ফারেনহাইট) ও আর্দ্রতা (৮০-৯০%) সইয়ে নিতে একটু সময় লাগল। কিন্তু তারপরই জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গেল। টাকাকড়ি, ঘড়ি-গয়না, পাশপোর্ট সব তুলে রেখেছিলাম—জঙ্গলে ওসব চলে না। আমরা সকালে আলো ও পাখির গান শুনে উঠতাম। একটি পাখি ওড়ো-পেনডলা-আমার প্রিয় ছিল। সবার আওয়াজ ছাড়িয়ে ওর গলা শুনতে পেতাম—ঠিক জলতরঙ্গের টুংটাং-এর মত। আমার মশারির বাইরেই হেলিকনিয়ামের ঝোপে মোটাসোটা লাল ফুল দুলছে। তারই লোভে আসতো হামিংবার্ডের দল। সূর্য ওঠার আগেই আমরা পাখির খোঁজে বেরিয়ে পড়তাম—নদীর তীর তখন ভোরের কুয়াশায় মাখা। দু’একজন পরিশ্রমী আদিবাসী (Ribereno-বা নদীর লোক) ডিঙি বাইছে--কাঁচকলা বোঝাই নৌকো। এখানে ওখানে আদিবাসী মেয়ে কাপড় ধুচ্ছে নদীর পাড়ে।
তীরের কাদায় ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি বসে থাকত। হলুদ সাদা রং--মাটিতে নুনের স্বাদেই আসত ওরা। আমাদের ঘামে ভেজা জামাকাপড়ের ওপরও ঝাঁক বেঁধে প্রজাপতির দল দেখেছি নোনতা ঘাম শুষে নিচ্ছে।
সকালে নাস্তা করে তাপমাত্রা বেশি ওঠার আগেই বেরুতাম গাইডের সঙ্গে—জঙ্গলের গাছপালা চেনাত, দেখাত। সঙ্গে দা নিয়ে লতাপাতা সাফ করত—রাস্তা বলে তো কিছুই নেই। আমরা হাঁটতাম গোড়ালি ডুবানো ভিজে নরম মাটি ও পচাপাতার ওপর। ভেঙে-পড়া গাছের গুঁড়িতে ঘন সবুজ শ্যাওলা ও উজ্জ্বল লাল ব্যাঙের ছাতা, জটবাঁধা লতা ওপরের ক্যানপি থেকে দুলছে। তাতেই জড়িয়ে উঠেছে ব্রোমেলিয়াড। জঙ্গলে গাছগুলি বেশ উঁচু। নিচে মাটিতে সবুজ গাছ দেখাই যায় না কারণ সূর্যের আলো খুব কম। উঁচু গাছের ডগা প্রায় দেড়শ ফুট ওপরে। যখন বৃষ্টি নামে ওপরে পাতার ওপর চড়বড় আওয়াজ শুনি কিন্তু ফোঁটাগুলি নিচে আমাদের মাথায় পড়তে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেয়।
জঙ্গলে আমাদের বলা হয়েছিল উজ্জ্বল রঙের জামা পরে থাকতে। ঘন সবুজ বা বাদামী রঙে জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার—জঙ্গল ভর্তি পাখি--ডাকও শোনা যায় সর্বক্ষণ কিন্তু ঘন পাতার আড়ালে এদের দেখা পাওয়া ভীষণ কঠিন। একটু খোলা জায়গায়, যেমন নদীর তীরে—যা একটু দেখা যায়। অন্যান্য জঙ্গলের--যেমন আফ্রিকার বা ভারতে তুলনায় বড় পশু প্রাণী এখানে কম। ঘন জঙ্গল বলেই বোধহয়। কিন্তু পাখি প্রজাপতি আর লক্ষ রকমের পোকামাকড় পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যাবে না। এক একটা পোকা এমন বিরাট যে ছোট্ট হামিংবার্ডকেও হার মানায়। প্রতিদিন সকালে মশারির চাল ভর্তি পোকামাকড় দেখতাম। আমাদের দলের একজন কীটবিশেষজ্ঞ তো দারুণ খুশি। আরও খুশি দলের প্রজাপতি বিশেষজ্ঞরা। আমি পাখি-প্রেমীই একমাত্র হতাশ! দলের একজন ঠিক করলো সে ব্যাঙের ছাতা বিশেষজ্ঞ হবে—কারণ মাটির-দিকে চেয়ে সাবধানে হাঁটতে হলে অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়া যায় না--আর মাটিতে মাশরুম ছাড়া কী-ই বা আছে। তবু প্রজাপতি কে না ভালবাসে—ঘন সবুজ জঙ্গলে বিরাট আট ইঞ্চি পাখাওয়ালা উজ্জ্বল নীল মর্ফো প্রজাপতির ওড়া--সব ক্লান্তি, হতাশা দূর করে দেয়। ছোটখাট নালা পার হতে একটা কাঠের তক্তা পাতা। বেশ ব্যালান্সের দরকার। আমি বারবার পড়ে যেতাম কাদায়। আমার বন্ধুরা আমি তক্তায় পা দিলেই আমার দিকে ক্যামেরা তাক করতো। আমার ক্যামেরা তো প্রথম দিনেই কাদায় ফেলে তার বারোটা বাজিয়েছিলাম।
জঙ্গলের সবকিছুই কিন্তু সুন্দর শান্তিপূর্ণ বা নিরাপদ নয়। হাঁটবার সময় খুব নজর রাখতে হয়—কোনো লাল পিঁপড়ের ঢিবি বা ট্যারানটুলার গর্তে পা না দিয়ে বসি। সত্যিই এক মুহূর্তও মাথা উঁচু করে পাখি খোঁজার জো নেই। কোনো গাছের ডাল ধরার আগে দেখে নিতে হবে শুঁয়োপোকা জড়িয়ে আছে কিনা বা বোলতার চাক। পচা পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বিষাক্ত ব্যাঙ—(poison arrow frog)। দেখতে একটুখানি, উজ্জ্বল, লাল, নীল, হলুদ রং—যেন টিফ্যানির গয়না! কিন্তু ছুঁলেই বিপদ। এদের বিষ দিয়ে স্থানীয় আদিবাসীরা তীর শানায়। কিন্তু এরা দেখতে এত সুন্দর ইচ্ছে হয় পকেটে পুরে নিয়ে যাই।
প্রথম প্রথম জঙ্গল দেখে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম এত সুবিশাল জঙ্গল। প্রথমেই ইচ্ছা করেছিল দা, কুড়ুল দিয়ে সব কেটে পরিষ্কার করতে। পরমুহূর্তেই অবাক হয়েছিলাম এইরকম বিজাতীয় আদিম প্রবৃত্তির জন্য। বুঝতে পেরেছিলাম অশিক্ষিত, গরীব চাষাভূষোরা কেন এই জঙ্গল কেটে ফেলতে চাইবে। এই নিষ্করুণ সবুজ বন ও হাজার বিপজ্জনক, বিষাক্ত জীব খুব সহজেই মানুষের মনে ভয় জাগাতে পারে।
জঙ্গলে আমরা নদীর জল ফুটিয়ে খেতাম। আর ম্যালেরিয়ার ওষুধ ও কীটনাশক মলম ও স্প্রে ব্যবহার করতাম খুব। পুরো হাতা জামা ও প্যান্ট পরে ঘামতাম ও আদিবাসীদের খালি গা ও পা দেখে ঈর্ষান্বিত হতাম। এছাড়াও জলে আছে কুমীর (cayman), পিরানা এবং আনাকোন্ডা পাইথন সাপ। ডাঙায় আছে বিষাক্ত সাপ--বুশ মাস্টার, হুইপ্ সাপ (whip snake), তাছাড়া টারান্টুলা মাকড়শা, শুঁয়ো পোকা, ব্যাঙ ইত্যাদি। ওষুধ লাগানো সত্ত্বেও বেশ কয়েকটা নাম না জানা পোকার কামড় খেয়েছিলাম।
জঙ্গলের খাবার জিনিস প্রচুর—মাছ ছাড়াও আছে ফল-পাকুড়। নভেম্বরে বুনো আম খেয়েছি আর রসালো আনারস—এত মিষ্টি আনারস আগে কোত্থাও খাইনি। এছাড়া পেঁপে, কলা ইত্যাদি তো আছেই। আমরা ইকিতোস থেকে যাওয়ার সময় কয়েক বোতল বিয়ার নিয়ে গেছিলাম—সেগুলি নদীর ধারে কাদায় পোঁতা ছিল। ঠান্ডা রাখার জন্য; কিন্তু প্রথমদিনেই সব শেষ হয়ে গেল। তবে দুপুরে সবথেকে আরাম হ্যামকে বসে ঝিমুনি বা বই পড়া, ডায়েরি লেখা বা হামিংবার্ডের গুঞ্জন শোনা—ম্যাকাওরাও ঐসময় তাদের চেঁচামেচি বন্ধ রাখত।
বিকেলে গরমটা একটু কমলে আবার বেরোনোর পালা। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির মতই এখানেও সূর্য অস্ত গেলেই ঝপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। তখন সম্পূর্ণ অন্য দলের চেঁচামেচি শুরু হয়—প্যাঁচা, ব্যাঙ, ঝিঁঝিপোকা ও আরও হাজার রকমের নাম-না-জানা কোরাস। দূর থেকে টাপির-এর ডাক শোনা যায়। আমাদের ক্যাম্পের আশেপাশে বাঁদর দেখিনি কখনো। জাগুয়ার ইত্যাদি তো স্বপ্নই। রাতে খাওয়ার পর আমরা টর্চ ও ক্যামেরা হাতে গাইডের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। নি:শব্দে পা টিপে টিপে সাবধানে চলেছি—গাইড আলো জ্বেলে দেখায় ঘুমন্ত প্রজাপতি, পাখির বাসা, টারানটুলা, কিংবা সাপ—গাছের ডাল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে—সেই ডালের নিচ দিয়ে হাঁটতে কী ভয়! যদি হঠাৎ জেগে লাফ দিয়ে পড়ে মাথার ওপর! কখনো গাইড আলো নিভিয়ে আমাদের বলে অন্ধকারটা উপভোগ করো। এমন নিরেট, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার পৃথিবীর কোথাও পাবে না।
একদিন রাত্তিরে নৌকায় কুমীর দেখতে যাবার ঠিক হলো। টর্চের আলোয় কুমীরদের চোখ চকচক করে। দু-চোখের ব্যবধান যদি বড় হয়, কুমীরের সাইজও সাধারণত বড় হয়ে থাকে। নদীর মাঝ বরাবর গিয়ে হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি। তা রেন-ফরেস্ট যখন নাম, বৃষ্টি তো হবেই। কিন্তু এ হল তুমুল বৃষ্টি। বান-ডাকানো ধারা। যেন জলপ্রপাতের নিচে বসে আছি। খোলা নৌকায় আমরা মুহূর্তের মধ্যে জলে ভিজে কাদা। একে তো অন্ধকার, তার ওপর এরকম বৃষ্টি। আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে বৃষ্টিই উপভোগ করতে লাগলাম। চারদিকে বৃষ্টির ঘেরাটোপ ঝালর। কুমীর তো দূর অস্ত্, এক হাত দূরেও কিছুই নজরে আসে না। সে এক অপূর্ব, আদিম, বন্য অভিজ্ঞতা, আমি কোনোদিন ভুলব না।
বৃষ্টি হত প্রত্যেক দিনই—বিকেলে ও রাত্রিতে। মশারির ঠিক পাশেই জলের ফোঁটা পড়ছে চালা থেকে। কাদামাটিতে ধারা বয়ে যাচ্ছে মেঝের নিচে। ধারা গিয়ে মিশছে রিও নেগ্রো শাখানদীতে। সেখান থেকে আমাজনে ও সমুদ্রের দিকে।
জঙ্গল থেকে ফেরার পথে আমার কয়েকদিন পেরুর রাজধানী লিমায় কাটাবার প্ল্যান ছিল। লিমা অন্যান্য বড় শহরের মতই ভিড়, ধোঁয়া ও ক্রাইমে ভর্তি। আমাদের গাইড আরি আমায় উপদেশ দিল—ওখানে যেয়ো না। ভীষণ বিপজ্জনক জায়গা। আমার মনে হল আমাজনের গভীর জঙ্গলে বসে আমাকে শহর সম্বন্ধে সাবধান করছে। কী বিচিত্র মনোভাব!
পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু আমাজনের জঙ্গলের অভিজ্ঞতাটা আমার জীবনে সবথেকে অভিনব। এখনও যখন এখানে দুর্দান্ত শীত, আমি চোখ বুঁজে জঙ্গলে ফিরে যাই। দেখি ঘন সবুজ আলোয় নিওন নীল প্রজাপতির নাচন! শীতের অবসাদ দূর হয়ে যায়।
যাত্রা সময়কাল—সেপ্টেম্বর - অক্টোবর ১৯৯২