(১)
রোববারের বাজারটা সারতে এমনিই আমার একটু সময় লেগে যায়। থলেটা একটু ভারি হয়। একটু আমিষের গন্ধ, একটু ফলফুলুরি, পথেঘাটে কিছু চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি, একটু গল্পগাছা, মোড়ের দোকানে কড়িমিঠি চা। ছোটশহর, তার শেষপ্রান্তে গিয়ে পেট্রলপাম্প থেকে মোটরবাইকে এ সপ্তাহের খোরাক লিটারতিনেক তেল ভরানো। তারপর বাড়ি ফিরে ঘেমো জামা ছেড়ে আরো এক কাপ চা খেয়ে ঘরের কাজে একটু হাত লাগানো।
ধরুন, বাগানের গাছগুলোতে জল দেওয়া বা পাইপ দিয়ে মোটরবাইকটা ধোওয়া; আর মাসের প্রথম রোববার হলে মুদির, থুড়ি কিরানা দোকানের থেকে আসা জিনিসপত্তর, চাল ডাল তেল নুন চিনি মশলাপাতি গুছিয়ে তুলতে গিন্নির সাথে একটু হাত লাগানো। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
আজকের রোববারটা বছরের অন্য একান্নটা রোববারের থেকে আলাদা হওয়ার কোন কথা ছিল না। কিন্তু ফিরে এসে বাজারের থলিটা নামিয়ে রাখতেই গিন্নি বললেন— জামাকাপড় ছাড়তে হবে না, তোমাকে শ্মশানে যেতে হবে।
— এত তাড়াতাড়ি! এখনও অনেক কাজ বাকি; মেয়ের বিয়ে দেওয়া, ছেলেকে বড় করা।
— ইয়ার্কি না, তোমার বন্ধু বাচ্চু, মানে বাচ্চু মিশ্রর ফোন এসেছিল। কোন বন্ধু মারা গেছে, চামু না দামু কি যেন নামটা, তোমাকে ডাকছে; দু দুবার ফোন এসেছিল।/p>
আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে পড়লাম। হঠাৎ যেন কোন ভুলে যাওয়া কাজ মনে পড়ে গেছে। ঘরের হাওয়া কিছুটা কমে গেছে। বললাম চামু নয় চাম্মু, কি তাই না?
— কি জানি, অমনিই কিছু হবে।
আমার মুখের চেহারা দেখে গিন্নি পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
— তোমার কোন স্টাফ? তোমার সাথে কাজ করেছিল? একসময় খুব ক্লোজ ছিল?
— ক্লোজ? তা ছিল বইকি! তবে স্টাফ নয় বন্ধু, ছেলেবেলার; যাকে বলে লংগোটিয়া ইয়ার। ও ছিল আমাদের সবার মুশকিল আসান!
— কোনদিন দেখিনি তো? মানে বাড়িতে কখনো আসেননি, তাই বলছিলাম।
— হ্যাঁ, ও নিজেই নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তবে গতবছরে একবার এসেছিল, মাত্র পাঁচমিনিটের জন্যে।
— আলাপ করাওনি!
— সেদিন তুমি বাড়িতে ছিলে না।
সত্যি কথাটা বলা খুব মুশকিল। সে রোববারে আমার বসার ঘরে ভারি গ্যাঞ্জাম। কলোনির মহল্লা বিকাশ সমিতির মাসিক বৈঠক। জল আর বিজলির কানেকশন বাড়ানোর জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মেয়রকে পিটিশন দিতে হবে; মুসাবিদা করা হচ্ছে, চা আর পাঁপড় আসছে, এমন সময় কাজের মহিলা মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইয়া, আপনাকে কেউ বাইরে ডাকছে।
একটু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। বেরিয়ে দেখি চাম্মু, একটা থামের পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— কী ব্যাপার রে? আয়, ভেতরে আয়।
চাম্মু যেন আরও সিঁটিয়ে গেল। কিন্তু কিন্তু করে বলল— জানি, ভেতরে তোদের জরুরি মিটিং হচ্ছে, কিন্তু আমার দরকারটাও এমন যে না এসে পারলাম না।
— আমড়াগাছি ছাড় তো! কাজের কথায় আয়। তার আগে ভেতরে চল, গিন্নির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
ও নড়ল না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল— সরি বেণু, ওটা আরেকদিন হবে। আমাকে নেক্সট প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পেন্ড্রা যেতে হবে। ভায়রাভাই কাল মারা গেছে। ছোটশালিটা অসময়ে বেওয়া হল।
তোর কাছে চারশ টাকা হবে? আগামী মাসের মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
বিনা বাক্যব্যয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাটা বার করে ওর হাতে দিই। বাগানের গেট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে ও ফিরে তাকায়— তাহলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই। আমি মাথা নেড়ে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকে আবার সমিতির তর্কবিতর্কের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই।
চাম্মু আর আসেনি। জানতাম ও টাকা আর ফেরত পাবো না। পথেঘাটে দেখা হয়ে গেলে— কি, ক্যামন? ভাল তো?
ও দ্রুতগতিতে পাশ কাটাতো— হাঁ ইয়ার, সব ঠিক হ্যায়, বা বঢ়িয়া হ্যায়, সবকুছ ঠিকঠাক চল রহা হ্যায়।
কিন্তু সবকুছ তো দুরের কথা, ওর কোনকিছুই ঠিকঠাক চলছিল না। টের পাচ্ছিলাম যে আমাদের চাম্মুর মুশকিল আসান ক্ষমতা, সেই বিশেষ শক্তি দিন দিন কমছে; তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপের মত।
(২)
মুশকিল আসানই বটে!
আজ থেকে বছর কুড়ি আগে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর শহরে চাম্মু বা চমনলাল রোহিদাসকে অনেকেই চিনত, বিশেষ করে উনিশ কুড়ির দল। জাতে মুচি, কিন্তু দুইপুরুষ হল ওরা জাত ব্যবসা ছেড়ে চাকরিপেশা হয়েছে। বাবা কোন মুদি দোকানের কর্মচারি আর ম্যাট্রিকফেল কাকা উকিলবাবুর মুহুরি। পুরনো বস্তিতে ওদের খাপরাছাওয়া মাটির মেঝেওলা কোঠাবাড়ি। স্নানের জন্যে ঘরের লাগোয়া চিলতে জমিতে একটুখানি আয়োজন। প্রাকৃতিক কম্মটি সারতে ওদের মেয়েপুরুষ সবাই যায় লোটা নিয়ে পাশের খোলা মাঠে, ভোরবেলায় আর সাঁঝবেলায়।
এই পরিবারের মেজছেলে চাম্মু ছেলেছোকরাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। পাড়ার পাঠশালা বা বালবাড়ি থেকে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আমাদের নাটের গুরু ছিল বাচ্চু মিশ্র আর চাম্মু ছিল ওর কেলে হাঁড়ি।
হাইস্কুলের সংস্কৃতের টিকিধারি পণ্ডিত রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চুর সঙ্গে মুচির ঘরের চমনলাল রোহিদাসের গলায় গলায় ভাব বড়রা কেউই ভাল চোখে দেখতেন না। ফলে চাম্মু আমাদের অভিজাত পাড়ার শব্দাবলীতে চাম্মু চামার হয়েই রইল, কোনদিন চমনলাল হতে পারল না।
অবশ্যি এ নিয়ে চাম্মুর খুব একটা হেলদোল ছিল না। বাচ্চুর বন্ধু হয়েই ও বেজায় খুশি ছিল। অনায়াসে ঢুকে যেত বাচ্চুদের বাড়িতে, বৈঠকখানা পেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে। ঢুকে কোন বলা-কওয়ার বালাই নেই, সোজা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মেজেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ত— আঃ চাচি! কি ঠাণ্ডা তোমাদের জল গো! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
এদিকে হায় হায় করে উঠেছেন চাচিজী, মানে বাচ্চুর মা।
— গেল, গেল! জাতধর্ম সব গেল। হতভাগা চামার! দিলে সব ছুঁয়ে। নিজের হাতে নিলি কেন? তেষ্টা পেয়েছে তো আমাকে বলতে পারলি না?
— তাতে কি হয়েছে গো চাচি?
চাম্মু একগাল হাসে, বলে— এ কুঁজোটা না হয় আমি নিয়ে যাব, আমাদেরটা গেছে ভেঙে। তোমরা না হয় ঝিকে দিয়ে শনিচরী বাজার থেকে আর একটা আনিয়ে নিও।
— হ্যাঁ রে, আনিয়ে নিও! কত খায়! কিনতে তো আর পয়সা লাগে না? বলি, হরির লুটের বাতাসা পেয়েছিস?
— অনেক তো বকাবকি করলে, ঘরে গরম গরম কিছু থাকলে দাও না! আজ রোববারের সকাল, তায় মাত্র আটটা বেজেছে। মানে, তোমাদের তো এখনও নাস্তা হয়নি।
— বলি, নোলা যে খুব! সকাল সকাল ফন্দি করেই এসেছিস। একটা কাজের সময় তোকে পাওয়া যায় না। নিজের মতলবের বেলায় ঠিক আছিস।
— সে কি চাচি? এ মাসে তোমাদের বিজলি বিলটা শেষদিনে জমা দিল কে? সে কী লম্বা লাইন! অফিসের ভেতরে গিয়ে ভেতরের লোক ধরে আমিই তো ম্যানেজ করলাম। সব ভুলে গেলে! তোমার ছেলেটি তো একটি ধম্মের ষাঁড়। বাপের হোটেলে খায়দায় আর বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়। শেষকালে সব ঝামেলার মুশকিল আসান বলতে এই চাম্মু ছাড়া আর কে?
বাচ্চু কৃত্রিম কোপে ঘুঁষি দেখায়। মিশ্রগিন্নি একটু নরম হন। — বালাই ষাট! ছেলেদের খুঁড়িস না। তুইও আমার ছেলের মত।
চাম্মু একটু হাসে।
— সেই কথাই তো বলছিলাম গো, হিসেব ধরলে আমিও তোমার ঘরের লোক। আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান।
— নে, নে! এই একথালা ভাজিয়া নে, আর মুখটা বন্ধ রাখ। ভরসকালে আমাকে শাস্তর শেখাচ্ছে!
চাম্মু ততক্ষণে ভাজিয়ার থালার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। এনামেলের থালা। খাওয়া হলে ও নিজেই থালাটা আঙিনার কলের জলে ধুয়ে একপাশের দেয়ালে খাড়া করে ঠেকিয়ে রেখে দেবে।
(৩)
আমরা ওকে মুশকিল আসান বলেই জানতাম। যে-কোন লফরা বা সমস্যার কথা শুনলে ওর একটাই জবাব ছিল— হো জায়েগা বা বন্ জায়েগা। — চাম্মুভাই, বড়ী মুশকিল মেঁ ফঁস গয়া হুঁ। নাথানী পরিবারের সুমিত্রা, আরে ওই যে রানী লক্ষ্মীবাঈ স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে; কাল রোববার আমার সঙ্গে বিহারী টকিজে শোলে দেখতে রাজি হয়েছে; অনেক কষ্টে। কিন্তু বাড়ির বা পাড়ার কেউ দেখতে পেলে কেস জন্ডিস। আর, আর দশটা টাকা চাই, জোগাড় হচ্ছে না।
চাম্মু বুঝদারের মত মাথা নাড়ে।
— আজ বিকেলে চারটে নাগাদ দেখা করিস, কিছু একটা হয়ে যাবে।
বিকেল বেলা চাম্মু হাতে ধরায় ইভনিং শোর দুটো টিকেট আর দশটা টাকা। বুঝিয়ে দেয়— সুমিত্রা যাবে রিকশায়, তুই সাইকেলে। ছটাকা রিকশা ভাড়া, চারটাকা চিনেবাদাম। ও আগে ঢুকবে। তুই পরে, ফার্স্ট বেল বাজলে, হল অন্ধকার হলে তবে। বেরোনোর সময় তুই আগে, ও আলাদা, শেষের দিকে।
— ভাই, তোকে যে কী বলে।
— ব্যস, ব্যস! আর অউর চনে কী ঝাড় মেঁ (ছোলাগাছে) চড়াতে হবে না। চাম্মু যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
কলেজের দিনেও চাম্মু আমাদের মুশকিল আসান হয়ে রইল। কে বাবার থেকে সারা বছর কলেজের ফীস নিয়েও হোটেলে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আর পরীক্ষার সময় ফেঁসে গেছে! তার জন্যে টাকা জোগাড় কর রে। কার হাজিরি খাতায় সংখ্যাটা এত কম যে কলেজের নোটিস বোর্ডে নাম বেরিয়েছে। কলেজ সোশ্যালের দিন মারামারিতে কেউ নামজাদা বড়লোকের নাড়ুগোপালের মাথা ফাটিয়ে কেস খেয়েছে। সমস্যা আপাতত— যতই কঠিন হোক চাম্মুর কাছে তার নিদান আছে। বহুদিন বুঝিনি ওর অদৃশ্য জাদুকাঠিটি কী?
ধীরে ধীরে অনেকদিন পরে বুঝেছি যে ও হল আসলে একজন ভাল পাবলিক রিলেশন অফিসার। আর ও সবার থেকেই গুড টার্ন আশা করে। এছাড়া ও একটা ছোট ফান্ড হাতে রাখে। সে টাকাটা ওর জোগাড় হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কমিশন, ওর ভাষায় সার্ভিস চার্জ, আদায় করে।
ধরুন, জগমোহন শেঠের ইঁটভাটায় দুলাখ ইঁট পড়ে আছে। এদিকে বর্ষা প্রায় এসে পড়েছে। লোকসানের ভয় ষোলআনা। চাম্মুর কাছে খবর আছে যে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হিন্দি টিচারের ছোটখাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তাতে লাখ দেড়েক ইঁট কম পড়েছে। কিন্তু স্যারের পকেটেও যে টান পড়েছে! উনি চাইছেন যে ইঁট কোন ব্যাটা শস্তায় দিক, আবার আদ্দেক মাল ধারে দিক! ব্যস্, চাম্মু অবতীর্ণ হল ওর মুশকিল আসান অবতারে।
হিন্দিস্যার দুবেজী প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরেন আর কি! আশীর্বাদ করলেন যে যদিও চাম্মু ভদ্রলোকের মত হিন্দি লিখতে শেখেনি, কিন্তু আজকের পুণ্যকাজের ফলে ওর ছেলেরা নিশ্চয়ই বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠবে। আর শেঠজি বাট্টাখাতায় লিখে রাখা মাল সময়মত উঠে যাওয়ায় এমন খুশি যে দু পাঁচটাকা কমিশন টমিশন? কোন ব্যাপারই না।
আমার কিন্তু, পরন্তু, অধিকম্তু শুনে চাম্মু একগাল হাসত— ওরে, ডাক্তারবাবুরা কোন বিশেষ ওষুধের দোকানের নাম লিখলে, রক্তপরীক্ষা বা এক্স রে করাতে বললে ওরা কিছু দেয় না? তবে? যত দোষ চাম্মুর বেলায়!
(৪)
বাচ্চুর সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব আগের মতই রয়ে গেল। সেবার দূর্গাপুজোর পরে ঈদ। আমরা খবর পেলাম যে মুশায়েরা বা উর্দুকবিতা পাঠের আসরের পরের দিনই কাওয়ালি, মধ্যনগরী চৌকে। আসছে যে-সে নয়, কাওয়ালি সম্রাজ্ঞী শাকিলাবানো ভোপালী! আহা, যেমন হাজিরজবাব, তেমনি আদা, তেমনি নাজনখরা; ব্যস্, বিলাসপুর শহরের যৌবনে আগুন ধরে গেল। টিকিট নিয়ে কাজিয়াকেত্তন, মারামারি, আমরা হাল ছেড়ে দিলাম।
ঠিক দুদিন আগে চাম্মু বিকেলের ঠেকে ঢুকল দাঁত বের করে।
— তিনটে টিকিট জোগাড় করেছি, দুটো তো বেণু আর আমি, তিননম্বরটা কে বাওয়া? আমি অবাক, কেন? বাচ্চু যাবে না?
— জিজ্ঞেস কর। রামখিলাওন মহারাজ জানতে পারলে আমার আর ওর পিঠের চামড়া তুলে নেবে।
— বাবা গেছে রায়পুরে, ছোটকাকার শরীর খারাপ, তাই। ফিরতে সেই সোমবার। তার মানে বুঝলি?
বাচ্চু মিটিমিটি হাসে।
আমি চেঁচিয়ে উঠি— খুব বুঝেছি। তার মানে আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স যাচ্ছি কাওয়ালি কুইন, মালিকা এ তরন্নুম, ভোপাল কী শাকিলার নাজ নখরা, হুস্ন দেখে দাদ দিতে।
— ঈরশাদ! ঈরশাদ!
— তওবা! তওবা!
এবার বাচ্চু বলে উঠল— উঠাও এক জাম, শাকিলাকে নাম!
আর আমরা তিনজনে চায়ের গ্লাস একসঙ্গে ঠেকিয়ে মৃদু ঠুন্ ঠুন্ আওয়াজ তুলি। কাওয়ালি দারুণ জমে উঠল। শাকিলা বানো ফাটাফাটি! প্রায় রাত বারোটায় আমরা বাড়ি ফিরছি, মনে কাওয়ালির রেশ। প্রথমে বাচ্চুর বাড়ি, মশানগঞ্জ পাড়ার শুরুতেই।
বাচ্চু বাড়ি ঢুকতে যাবে, আমি বললাম যে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ, ভেতর থেকে দুগেলাস জল নিয়ে আসুক। এমন সময় চাম্মু কাওয়ালির মিসরা (প্রথম পঙ্ক্তি) গুনগুন করতে করতে বলল,
— হ্যাঁরে বাচ্চু, রামখিলাওনের কী খবর? কবে বাড়ি ফিরবে? তোর বাবার ঘরে ফিরতে মন নেই কেন রে! চাচি একলা আছেন, এটা ভাবতে হয় না?
আমাদের পেটের ভেতর থেকে হাসি সোডার মতন বুড়বুড়ি কেটে বাইরে বেরোনোর আগেই অন্ধকারে গর্জন শোনা গেল— হারামজাদা চামার! বাপের বয়সি লোকেদের নামধরে ইয়ার্কি! জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতে হয়।
রামখিলাওন ফিরে এসেছেন!
আমি আর চাম্মু জলতেষ্টা ভুলে সাইকেল তুলে হাওয়া।
(৫)
যথাসময়ে পরীক্ষা-টরিক্ষা দিয়ে আমি ব্যাংকে ঢুকলাম আর চাম্মুও তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের জোরে স্থানীয় বড় পোস্টাপিসের পিয়ন হয়ে গেল। আমার এদিক ওদিক বদলির মধ্যেও খবর পেতাম বেড়ে আছে চাম্মু। বিয়ে করল বুধওয়ারি পাড়ার পার্বতীকে। শ্বশুর মিউনিসিপ্যালিটির চৌকিদার। আমরা সবাই বরযাত্রী গিয়েছিলাম; তাসাপার্টি, মাংসভাত আর গুলাবজামুন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওর শ্বশুরের মহুয়া খেয়ে নাচ!
সংসার চলল বাঁধা গতে। ও প্রমোশন পেয়ে হেড পিওন হল। ওর বাবা বললেন দুলহন বড় পয়মন্ত। এর কমাসের মধ্যেই বাবা চলে গেলেন। ও সাবেকি ঘরের পাশে খাপরার চাল ছাওয়া দুটো পাকা ঘর তুলে আলাদা হয়ে গেল।
তবে ওর মুশকিল আসান প্রতিভা তখন তুঙ্গে।
আমি তখন কোরবার কাছে বালকোনগর ব্রাঞ্চে বদলি হয়েছি। মাসের শুরুতে এক শনিবারে বিলাসপুরে এসে বাবার হাতে সংসার খরচের টাকা ধরিয়ে রোববারে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সোমবার ভোরে বালকো ফিরে যেতাম।
এমনি এক শনিবারে কাজের চাপ আর বাসের গণ্ডগোলে বিলাসপুর পৌঁছতে একটু রাত হয়ে গেল। বাড়ির সামনে এসে অবাক, দরজায় ঝুলছে বড় তালা, চারদিক বন্ধ। পাশের বাড়ির থেকে জানলাম যে ছোটমামার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে মা তাড়াহুড়ো করে বাবার সঙ্গে নাগপুর রওনা হয়ে গেছেন, ঘরের চাবি ছেড়ে যাননি।
সে তো হল, এখন আমি যাই কোথায়? পাশের বাড়ির ভাড়াটেরা নতুন এসেছে, আমার সঙ্গে নেহাৎ মুখচেনা। গেলাম মুশকিল আসান চাম্মুর ঠেকে।
চাম্মু আগের মতই সহজভাবে বলল— হো জায়েগা। তারপর বলল, এখন রাত্তির সাড়ে এগারোটা। সবার বাড়িতে মেয়েরা উনুন নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। তবে তুই ভাবিস নে বেণু, কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে।
হয়ে যে যাবে সে নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যা হল তার জন্যে আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না বোধহয়।
পোস্টঅফিসের হেড পিওন চাম্মু আমাকে নিয়ে চুপচাপ মেনগেটের তালা খুলল। ভেতরের হলঘরে তিনটে টেবিল জোড়া দিয়ে চাদর বিছিয়ে দিল। সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে বলল— নো টেনশন বেণু! তুই আর আমি পাশাপাশি শুয়ে গল্প করব যতক্ষণ ঘুম না আসে। তার আগে তোর খাবারের জোগাড় করি গে। ততক্ষণ তুই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে লাগোয়া বাথরুমে চান পায়খানা সেরে নে।
আমি বাইরে থেকে শুধু সদর দরজাটায় তালা লাগিয়ে যাচ্ছি। ফিরে এসে থেমে থেমে দুটো টোকা দেব, তবে খুলবি। ভয়ের কিছু নেই।
সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছল। খালি প্রতাপ হোটেলের বেয়ারাদের তখনও খাওয়া শেষ হয়নি।
সেখান থেকে ও নিয়ে এল গোটা আষ্টেক রুটি, কিছুটা মাংসের ঝোল, আলুর চোখা আর স্যালাড। তাই আমরা দুই বন্ধু মহানন্দে সাঁটালাম। তারপর পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছে টের পাইনি।
গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম আমি আর সুমিত্রা রেলওয়ে কলোনির মাঠে চিনেবাদাম খেতে খেতে গল্প করছি। সুমিত্রা বলছে— বেণু, কতদিন পরে এলি! আর এই ফুলপ্যান্টটা পরে তোকে না একদম কার্টুন লাগছে। হাফপ্যান্টেই তোকে বেশি মানায়।
— তোর তাতে কী? বেশি ইল্লি করলে এক ঝাপড় খাবি।
ইতিমধ্যে কোত্থেকে চাম্মু এসে হাজির, সঙ্গে এনেছে একটা ঝাঁ চকচকে হার্কিউলিস সাইকেল। সেটা নিয়ে ও খুব কায়দা করে মাঠের মধ্যে চালাতে লাগল। কখনও দুহাত ছেড়ে দিয়ে, কখনও উল্টো মুখ করে, আর কখনও হ্যান্ডেলবারের ওপর দুপা তুলে দিয়ে। সুমিত্রা কথা থামিয়ে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমার মধ্যে একটা রাগ জন্মাতে লাগল।
ঘুম ভাঙল চাম্মুর হাতের ঠেলা খেয়ে।
— এই বেণু! ওঠ, উঠে পড়। চা এনেছি। হাতমুখ ধুয়ে নে।
ছটা বেজে গেছে। আজ রোববার, পোস্টাফিস বন্ধ। কিন্তু লোকজন দেখতে পাওয়ার আগে আমাদের দুজনকে কেটে পড়তে হবে।
(৬)
বছরকয়েক পেরিয়ে গেছে। আমি প্রমোশন পেয়ে সোহাগপুর ব্রাঞ্চে ম্যানেজার। মাসের শেষে রিজার্ভ ব্যাংকের জন্যে স্টেটমেন্টস্ তৈরি করতে ব্যস্ত, এমন সময়ে পিঠের ওপর থাবড়া খেয়ে মুখ তুলতেই দেখি চাম্মু!
— কি রে বেণু, ম্যানেজার হয়েছিস বলে ইয়ারদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে নেই নাকি?
— কী আজেবাজে বকছিস্, ভাল করে চেপে বোস্। চা খাবি তো?
— শুধু চা? অফিসার হয়ে ভারি কিপটে হয়েছিস দেখছি!
আমি হেসে ফেলে ব্যাংকের চাপরাশিকে নাস্তা আনতে বলি।
অনেকদিন পরে দেখা। খোঁজখবর নিই। তাকিয়ে দেখি আমাদের মুশকিল আসানের কানের পাশে কিছু পাকাচুল। চাম্মু হেসে ফেলে।
— আরে, আমার না হয় দু একটা পাকাচুল, তোর তো আদ্দেক মাথায় চুলই নেই।
কাজের চাপ ভুলে হো হো করে হেসে উঠি। ব্যাংকের অন্য কর্মচারিরা আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়।
— তারপর? এদিকে কোথায় এসেছিলি? পথ ভুলে? আমার প্রেমের টানে নিশ্চয়ই নয়!
— কী করে বুঝলি?
— শালীর বাড়ি নয়তো? আমার জন্যে যে বিলাসপুর থেকে এ্যাদ্দূর আসিসনি সে তো বাজি ধরে বলতে পারি।
— লাগি শর্ত? বাজি ধরিস না বেণু, হেরে যাবি।
— মানে?
— সত্যি কথাটা হল আমি তোর কাছেই এসেছি। হ্যাঁ, একটু হেল্প চাই।
একটু অবাক হই, তারপর হেসে ফেলি।
— আরে ইয়ার! তুই হলি আমাদের মুশকিল আসান। তোর জন্যে তো জান হাজির। এবার ঝেড়ে কাশ!
— বুঝলি বেণু, চাকরির পাশাপাশি একটা সাইড বিজনেস শুরু করেছি, রেডিমেড জামাকাপড়ের। কোলকাতার কাছে মংলাহাট বলে শস্তা রেডিমেড কাপড়ের একটা জবরদস্ত বাজার আছে। সেখান থেকে থোক কিনে বিলাসপুরের আশপাশের ছোট দোকানগুলোতে সাপ্লাই দেওয়া। মাস আষ্টেক হয়ে গেল, ভাল মার্জিন পাচ্ছি। কিছু কিছু সাপ্লায়ার একমাসের জন্যে ধারে মাল দেওয়া শুরু করেছে।
এবার ও একটু দম নেওয়ার জন্যে থামে। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। ও জল খায়। আবার শুরু করে।
— কিন্তু বিজনেস বাড়াতে হলে পুঁজি চাই। বিভিন্ন হাটবাজারে গিয়ে বসার জন্যে জনাদুই ছোকরা আছে। ওদের হাতখরচা আর কমিশন আছে। একটু সাপোর্ট পেলেই। তাই তোর কাছে এসেছি। বেশি না, হাজার বিশেক হলেই চলবে। মাসে মাসে দুহাজার করে ফেরৎ দেব। একবছরের মধ্যেই ক্লিয়ার।
আমি বিষম খাই। আমার জমাটাকা বলতে কিছু নেই। বেশকিছু লোন নেয়া আছে। কেটেকুটে যা পাই তাতে বাবা মাকে পাঠিয়ে নিজের খরচা চলে যায়। আমার মধ্যে একটা হীনমন্যতা কাজ করছে।
আমি ব্যাংক ম্যানেজার আর ও পোস্টঅফিসের পিওন। বোধহয় আমাকে একটা রাজাগজা ভেবে বসে আছে। আমি বুঝতে পারি যে আমি ঠিক মুশকিল আসান নই। ভগবান বলে নাট্যপরিচালক ভদ্রলোক আমাকে ওই রোলটি দেননি।
— চাম্মু, অতটা একসঙ্গে পারবো না। হাজার দুই হলে না হয়; বাকিটা অন্য বন্ধুদের থেকে?
চাম্মু আমার তোতলামি দেখে মিটিমিটি হাসে।
— ধেৎ, আমি কি তোকে পকেট থেকে দিতে বলছি? তোর ব্যাংক থেকে আমাকে বিশহাজার টাকা লোন দে। বিজনেস লোন। রেডিমেড ধান্ধে কে লিয়ে। এরকম তো তোরা হরবখৎ দিয়ে থাকিস।
আবার বিষম খাই। চাম্মু থাকে বিলাসপুরে, কামধান্ধা সব বিলাসপুরের আশেপাশে। আর আমার ব্যাংক হল একশ কুড়ি কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে লোন? না, না, এ হয় না।
চাম্মু যেন আমার মনের কথা পড়ে ফেলেছে। আবার মুচকি হাসে।
— এত ভাবিস না বেণু। তোর অসুবিধা হবে এমন কোন কাজ করতে বলছি না। তোর ঠিকই মনে আছে আমার শালীর এখানেই বিয়ে হয়েছে। ভায়রাভাইয়ের এখানে একটা কাপড়ের দোকান আছে, ছোটমত। লোনটা ওর নামেই হবে, আমি গ্যারান্টর। মাসে মাসে নিয়মিত কিস্তি জমা হবে। তোর কোন প্রবলেম হবে না। আমি যে তোদের মুশকিল আসান, জিন্দগিভর!
চাম্মু লোন পেয়ে যায়। মাসে মাসে ইনস্টলমেন্ট জমা হতে থাকে। আর ছমাস পরে আমি ট্রান্সফার হয়ে বিলাসপুরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রাঞ্চে চলে আসি।
(৭)
একদিন মা কথাটা পাড়লেন। আমার এখন মাইনেপত্তর মন্দ নয়। আমাদের তিনপুরুষে আমিই প্রথম অফিসার হয়েছি। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়িও হয়ে গেছে। এবার বিয়ে থা করে থিতু হওয়ার সময়। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে শুধু আমিই এখনও ব্যাচেলর। আর বাবা মার শরীরের যা অবস্থা!
এরপর আর কোন কথা চলে না।
আমার বিয়েতে সব বন্ধুরা মিলে হেব্বি গ্যাঞ্জাম, কিন্তু চাম্মুর দেখা নেই! ও গেছে হাওড়ার মংলাহাট। ওই কাটাকাপড় আর রেডিমেডের বিজনেস। তা বলে আমার বিয়ের দিনও? একটু অভিমান হল। চাম্মু কি বদলে যাচ্ছে?
বিয়ের পর বৌকে নিয়ে পুরী গেলাম। নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালীর হলিউড। ফিরে এসে অফিস জয়েন করতেই দেখি টেবিলে একটা গোপনীয় মেমো। আমি যেন পত্রপাঠ রিজিওনাল অফিসে গিয়ে দেখা করি। কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। একটা উৎকন্ঠা নিয়ে পরের দিনই রিজিওনাল ম্যানেজারের অফিসে হাজির হলাম। একঘন্টা ভিজিটার্স রুমে বসিয়ে রেখে উনি যখন আমায় ডাকলেন তখন আমার গলায় থুতু শুকিয়ে গেছে। কোন ভণিতা না করে উনি সোজা কাজের কথায় এলেন।
আমাদের সোহাগপুর ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মিঃ চন্দ্রাকর জানিয়েছেন যে একটি কাপড়ের দোকানকে দেওয়া লোন ব্যাড হয়ে যাচ্ছে। কয়মাস ধরে কিস্তি আসছে না। ঋণীকে বলায় সে জানিয়েছে যে সে লোন নেয়নি। আসলে লোনটা আগের ম্যানেজার বেণুবাবু তার বিলাসপুরের বন্ধুকে দিয়েছেন, ও হল ডামি। তবে হ্যাঁ, ও হল আসল ঋণী চমনলাল রোহিদাসের ভায়রাভাই।
— দত্ত, তোমার থেকে এটা আশা করিনি। আগামী সাতদিনের মধ্যে এই লোন এ্যাকাউন্টটি বন্ধ না হলে আমি ইনভেস্টিগেশনের জন্যে নোট পাঠাব।
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। হন্যে হয়ে চাম্মুকে খুঁজে বেড়াই। বিকেলের দিকে গোলবাজারের কাছে ওকে পাকড়াও করি। সব শুনে ও গম্ভীর হয়ে যায়। পিচ্ করে থুতু ফেলে। তারপর বলে যে ওর সাড়ুভাই, মানে ভায়রা, হারামিপনা করেছে।
ঠিক আছে, কিছু খদ্দেরের থেকে বাকি পয়সা আদায় হয়নি, বাজার এখন ঠান্ডা; তা-বলে এমন ব্যাভার! অল রাইট, হারামি কো হম নাপ দেঙ্গে।
— সে তোর ভায়রাকে তুই যা করার করবি; কিন্তু এদিকে এক হপ্তা পরে আমার জি এম আমাকেই নাপ দেঙ্গে।
— ক্যায়সে নাপ দেগা? আমরা কি মরে গেছি নাকি? অভী ভী মুশকিল আসান জিন্দা হ্যায় দোস্ত, তু ফিকর ন কর!
— সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুই করবিটা কী, সেটা আমায় একটু বুঝিয়ে বলবি?
— শোন বেণু, সাতদিন লাগবে না। সামনের বুধবার ক্যাজুয়াল লিভ নে। তুই আর আমি সোহাগপুর যাবো, তোর চন্দ্রাকর ম্যানেজারের সামনে পুরো টাকাটা গুনে ফেলে দিয়ে আসবো। তু ফিকর্ মৎ কর।
আমার মনের মেঘ কেটে যায়। না— মুশকিল আসানই বটে! কিন্তু সত্যি কি এত সহজে ব্যাপারটা মিটে যাবে? এতগুলো টাকা? এত অল্প সময়ে? এবার ও রেগে যায়।
যাহোক, ব্যাপারটা ভালভাবেই মিটে গেল। আমি আর চাম্মু বুধবার বেলা একটা নাগাদ আমাদের ব্যাংকের সোহাগপুর ব্রাঞ্চে একেবারে ম্যানেজারের কেবিনে হাজির। সুদে আসলে প্রায় ন'হাজার আটশ তিরাশি টাকা দাঁড়াল। চাম্মু একশটাকার নোটের একটি বান্ডিল ম্যানেজারের টেবিলে পরম ঔদাসীন্যে নামিয়ে রাখল। গণ্ডগোলটা হল তারপর। ক্যাশিয়ার এসে রসিদ আর খুচরো টাকা পাসবুক সমেত ম্যানেজারকে দেওয়ার পর মিঃ চন্দ্রাকর আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ওগুলো চাম্মুকে ফেরত দিলেন। কিন্তু ও খুচরো টাকা এবং পাসবুক ম্যানেজারের দিকে ঠেলে দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে উঠলো— কীপ দ্য চেঞ্জ!
চন্দ্রাকরের চেহারা লাল হয়ে উঠল। বেগতিক দেখে আমি ওকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসি।
— তুই এটা কী করলি? আজ আমার একেবারে হাতে হ্যারিকেন!
চাম্মু নির্বিকার।
(৮)
সময় দ্রুত রং বদলায়। চাকরির চাপ আর পরিবারের দায়দায়িত্ব বইতে বইতে আমরা সবাই যে যার নিজস্ব বৃত্তে ঘুরতে থাকি। বন্ধুদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমতে থাকে। তবু ছোট শহর, ভালমন্দ খবর হাওয়ায় ভেসে ভেসে কানে ঠিক পৌঁছে যায়।
টের পাই, চাম্মুর সাইড বিজনেস লাটে উঠেছে। প্রায় সব বন্ধুদের কাছেই ধার নেয়া হয়ে গেছে। ইদানীং নাকি বাজার থেকে চড়া সুদে নিচ্ছে।
একদিন ওকে বিকেলের দিকে একা পেয়ে গেলাম, নর্মাল স্কুলের সামনে। ধরে নিয়ে গেলাম অরপা নদীর ওপর নতুন তৈরি ইন্দিরা সেতুর দিকে। আমার জেরার জবাবে অম্লানবদনে বলল যে জলে নেমে একটু হাবুডুবু না খেলে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনি এক আধবার লস্ না খেয়ে কেউ বিজনেসের ঘাঁতঘোত শিখতে পারে না। ওর এখন সেই ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে। চিন্তার কোন কারণ নেই।
কোঈ মুশকিল কী বাত নহী, মামলা আসান হ্যায়।
তারপর এল এক শনিবার। শনিদেবতা সেদিন বোধহয় আমাদের একটু নেকনজরে দেখেছিলেন। অফিস যাব বলে তৈরি হচ্ছি এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে বাচ্চু মিশ্র এসে হাজির।
— শিগগির চল বেণু, থানায় যেতে হবে। চাম্মুকে ধরে নিয়ে গেছে। আর বাড়ির কাগজপত্তর যা আছে নিয়ে চল, ওর জামিন করাতে হবে। আজ অফিস যেতে পারবি না, ফোন করে দে।
মোটরবাইকে ওর পেছনে সওয়ার হয়ে থানার দিকে যেতে যেতে পুরো গল্পটা শুনে নিই।
চাম্মুর টাকার দরকার বেড়ে গেছে। চাইছিল এজমালি বাড়িটি এবং লাগোয়া জমির টুকরোটা বেচে দিয়ে টাকাটা তিনভাইয়ের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে। ভাইয়েরা রাজি নয়।
চাম্মু নাছোড়বান্দা। ওর ভাগ চাইই চাই। ভাইয়েরা ওকে অম্তত— ওর অংশটুকু বিক্রি করতে ছাড়পত্র দিক। কিন্তু ভাইদের এতেও সায় নেই। মামলা শেষ হল আজকের লাঠালাঠিতে। তিনভাইয়েরই অল্পবিস্তর চোট লেগেছে। তবে অন্য দুভাই চাম্মুর নামে আগেভাগে থানায় ডাইরি করেছে, তাই পুলিশ ধরেছে ওকেই।
আজ শনিবার। বিকেলের মধ্যে জামিনে ছাড়া না পেলে সোমবার দুপুরে কোর্টে তোলা অব্দি পাক্কা আটচল্লিশ ঘন্টার হাজতবাস হয়ে যাবে। তাহলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। পোস্টাপিসের চাপরাশি, শত হোক কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি তো বটে!
(৯)
সেই যে জামিন করিয়ে ওকে ওর বাড়িতে ছেড়ে এলাম তারপর থেকে ওর সাথে আর বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হত না। কেন? কেন হত না?
ওই কি আমাদের এড়িয়ে চলছিল, নাকি আমরাই এক হেরে যাওয়া নায়ককে ভুলতে চাইছিলাম, মনের অগোচরে?
আজ বাড়ির বারান্দায় বাঁশের বাখারি আর কঞ্চি দিয়ে বাঁধা চালির ওপর শোয়ানো ওর নিঃস্পন্দ শরীরের দিকে তাকিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। উলটে পালটে দেখছি, হাতড়াচ্ছি মনের এ্যালবামে সাঁটিয়ে রাখা কিছু পুরনো ছবি।
চটকা ভাঙলো বাচ্চু মিশ্রের কথায়— বেণু, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; আর কেউ তো এল না। ওর ভাইয়েরাও না। আমি নিজে ডাকতে গিয়েছিলাম।
সমু বলল— আর কেউ আসবে বলে মনে হয় লা। যা করার আমাদেরই করতে হবে। আমরা কজন মানে আমরা পাঁচজন বন্ধু আর জনা চার ওর পাড়ার ছেলেপুলে।
বুঝতে পারি আমাদের মুশকিল আসান শেষজীবনে কতটা একলা হয়ে গেছল। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ি, হ্যাঁ, বডি আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না।
কেউ একজন জানায় যে মধুবন শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলেই ভাল, পায়ে হেঁটে দুই কিলোমিটারের বেশি নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ডোমের কাছে কাঠ কিনতে পাওয়া যায়। একজন আগে গিয়ে ব্যবস্থা করে রাখলেই হবে।
সব তো হল। কিন্তু নাপিত আর পুরোহিত যে এখনও এল না! খবর এল ওদের কাউকেই পাওয়া যাবে না। বিনোবানগরে শ্যাম আগরওয়ালের বাবা মারা গেছেন, ওরা সেখানে যাবে। তবে হ্যাঁ, চাম্মুর বডি যদি বিকেল অব্দি রাখা হয় আর দক্ষিণাটা একটু, তাহলে দেখা যেতে পারে। হাজার হোক চামারের মুর্দা, দেশে এখনও জাতধম্মো কিছু বেঁচে আছে।
আমরা বোবা মেরে যাই। কমবয়সি ছোকরাদের রাগে দাঁত কিটকিট করে। ওদের শান্ত করি। এখন রাগারাগির সময় নয়। আর দেরি করা যাবে না। এদের সবাইকে হাত লাগাতে হবে। তাড়াহুড়ো করে আনা একটা ফুলের মালা আর কিছু ফুল ওর গায়ের ওপর বিছিয়ে দিই। কেউ অগুরুর সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়। দুজন ছোকরা ওর শরীরটাকে অভ্যস্ত হাতে চালির সঙ্গে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধে।
কত তাড়াতাড়ি আমাদের লংগোটিয়া ইয়ার, চাম্মু ওরফে চমনলাল রোহিদাস, পিতা সমারুলাল, সাকিন বিলাসপুর একটা ডেডবডি হয়ে গেল। এবার রওনা দেওয়া যাক।
(১০)
আমরা এবার কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই। চালির সামনের দিকে দুজন, শেষমাথায় দুজন আর দুজন মাঝখানে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে। একজন খই ছিটোতে ছিটোতে যাবে, আর বাকি চারজন রিজার্ভ, কাঁধ-বদল করার জন্যে।
কিন্তু চালি তুলতে গিয়ে আচমকা কারো ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেলাম। ঘরের ভেতর থেকে আলুথালু পোশাকে বেরিয়ে এসেছে এক মেয়েছেলে, হাতের ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিয়েছে আমাদের দুজনকে, আর দেহের সমস্ত উত্তাপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে চাম্মুর শীতল শরীরের ওপর।
চাম্মুর স্ত্রী পার্বতী। শোকে প্রায় উন্মাদিনী এই নারীর মুখ থেকে ঝরে পড়ছে আমাদের জন্যে অভিশাপবাক্য।
— না, না! আমি ওকে নিয়ে যেতে দেব না। এদের সঙ্গে যেতে দেব না, কিছুতেই না। আমার মুন্নির বাপকে এভাবে যেতে দেব না। আমার গুড্ডুর বাপকে এদের হাতে ছাড়ব না।
আমরা হতবাক; আমরা বোকার মত দাঁড়িয়ে।
সমু পার্বতীকে বোঝাতে চেষ্টা করে— শান্ত হ ভাবী। ঘরের ভেতরে যা। আমাদের কাজ করতে দে। তোদের পরিবারের কেউ না আসুক আমরাই তো ওর পরিবার, ওর বন্ধু।
ফুঁসে ওঠে পার্বতী— বন্ধু? কিসের বন্ধু! সারা শহর ঢুঁড়ে ওর জন্যে একটাও পণ্ডিতপুরুত জোটাতে পারলে না, তোমরা কিসের বন্ধু? সবকটা হারামি, পাক্কা হারামি! পুজো না করে, মন্তর না পড়ে, জল না ছিটিয়ে ওকে এমনি এমনি নিয়ে যাবে? কোনরকমে দায়সারাভাবে পোড়াবে? আজ যদি ও থাকত আর তোমাদের কারো এমন হত? ও হাল ছেড়ে দিত? ও ছিল তোমাদের মুশকিল আসান। আর তোমরা? খুব দেখালে!
কান্নায় ভেঙে পড়ে পার্বতী। মাটিতে লুটিয়ে কাঁদে, হাহাকার করে বুক চাপড়ে কাঁদে।
— কে বলল কোন ক্রিয়াকর্ম হবে না? কে বলল পণ্ডিতপুরুত ছাড়া চাম্মুর শেষকাজ নমোনমো করে হয়ে যাবে?
সবাইকে ঠেলেঠুলে এগিয়ে এসেছে বাচ্চু, চাম্মুর লংগোটিয়া ইয়ার, ন্যাংটো বয়সের বন্ধু।
— আমি শহরের নামজাদা পণ্ডিত স্বর্গীয় রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চু মিশ্র। যজ্ঞোপবীতধারী। এখানে আমার চেয়ে বড় পণ্ডিত কে আছে? আমি করব আমার সাথী চমনলালের সমস্ত বিহিত অনুষ্ঠান। ওঠ ভাবী, উঠে পড়। ওকে এবার যেতে দে। বড় কষ্ট পেয়েছে রে! রাম্তা ছাড়।