তখনকার দিনে অর্থাৎ আমাদের ছোটবেলায় দেব-দেবী উভয় দেবতাকে এখনকার মত একই নামে অর্থাৎ ‘ঠাকুর’ বলে ডাকা হত না। সে সময় স্ত্রী দেবতাকে বলা হত ঠাকুরাইন (ঠাকুরানী) এবং পুরুষ দেবতাকে বলা হত ঠাকুর। দশমীর দিন সকাল থেকেই ধরিত্রীর আকাশে বাতাসে যেন এক বিষাদের সুর বাজত। মনে হত, যেন ‘হারানোর ব্যথা বুকে ভরে নিয়ে/ কাঁদে বার বার শ্যামল ধরা’।
দশমীর দিন পূজার শেষে, দর্পণ বিসর্জনের পর প্রত্যেক ঘরে ঘরে বসানো হত যাত্রার ঘট। ঘটের উপর একটি নারকেল, সোনা, রূপা, ধান ইত্যাদি দেওয়া হত। ফুলমালা দিয়ে ঘটটিকে সাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপধুনো দিয়ে পূজা করা হত। গৃহবধূরা মাটিতে আঁচল পেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে দেবীর কাছে সংসারের সুখসমৃদ্ধির প্রার্থনা জানাতেন। দশমী পূজার ভোগে থাকত সদ্য রান্না করা ভাত, তাতে জল ঢেলে দেওয়া হত, এই ভাবে তৈরি হত পান্তাভাত, আর কচুশাক। বিদায়বেলায় মাকে পান্তাভাত আর কচুশাক উৎসর্গ করা হত। কথিত আছে, দেবী দুর্গা বা শৈলজা উমা শ্বশুরবাড়ি, কৈলাসে ফেরার সময় মা মেনকার কাছে পান্তাভাত আর কচুশাক খাবেন বলে আবদার করেছিলেন। তাই আজও বাংলার ঘরে ঘরে, পারিবারিক পূজায় বিজয়া দশমীর ভোগের আহার্য উপচারের একটি হল পান্তাভাত আর কচুশাক।
দশমীর দিন বিকালে মণ্ডপের বেদী থেকে প্রতিমা নামিয়ে এনে বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে বসানো হত। শঙ্খ, ঘন্টা, বাদ্য সহকারে প্রতিমাকে বরণ করার পর বিসর্জনের প্রস্তুতি শুরু হত। দুখানা নৌকাকে একসঙ্গে জুড়ে, তার উপর প্রতিমাকে তোলা হ্ত। দূরদূরান্তের ঠাকুর নিয়ে চতুর্দিকে অসংখ্য সুসজ্জিত নৌকা ভাসত জলে। প্রতিমার নৌকা আর দর্শনার্থীদের ডিঙির আলোতে নদীর বুকে এক অপরূপ দৃশ্য সৃষ্টি হত। আলোকিত, সুসজ্জিত নানা নৌকার প্রতিবিম্ব বক্ষে ধারণ করে বেত্রবতী নদী সেদিন মনোহর রূপ ধারণ করত। খানিক চলার পর নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের দর্শনার্থে, একবার প্রতিমাশুদ্ধ জোড়ানৌকাকে ধীরে ধীরে চক্রাকারে ঘোরানো হত। তারপর মাঝিরা সুকৌশলে দুটি নৌকাকে ধীরে ধীরে আলাদা করে নিত, আর প্রতিমাকে নামিয়ে দেওয়া হত নদীর জলে। এইসব বিষয় খুবই চিত্তাকর্ষক ছিল। বিসর্জনান্তে ভারাক্রান্ত মনে সবাই ফিরে যেত নিজের নিজের বাড়িতে। একবারের কথা মনে পড়ে। ঠাকুর বিসর্জনের পর বাড়ি ফিরে দিদির আর আমার কী কান্না, সে কান্না কিছুতেই থামে না। শেষে বাবা রেগে গিয়ে পায়ের খড়ম নিয়ে এমন তাড়া করলেন যে ভয়ে কান্না মাথায় উঠে গেল।
বিজয়াকৃত্য সমাপনান্তে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন শুরু হত। ঘরে ঘরে সে এক উৎসব নয় তো, যেন মহোৎসব শুরু হত। ভোর না হতেই প্রত্যেক বাড়িতে শুরু হত ঝাড়পোঁছ, গোবর মাটি দিয়ে ঘরদোর, উঠোন নিকোনো। বাড়িঘর একেবারে ঝকঝকে, তকতকে করা হত। শুদ্ধাচারে মা লক্ষ্মীর আরাধনার আয়োজন শুরু হত। মায়েদের আর বউদের আর অবসর নেই, শুরু হত খৈ ভাজা, চিঁড়ে কোটা। ক্ষীরের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, ইত্যাদি তৈরি করা হত। আমাদের কী আনন্দ! পুরোনো কাপড় দিয়ে ছোট ছোট থলে তৈরি করতাম, পূজার পর বাড়ি বাড়ি থেকে প্রসাদি নাড়ু জমা করার জন্য। দুপুর গড়াতেই শুরু হত আলপনা দেওয়া। লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, ধানছড়া, শঙ্খলতা, ধানের গোলা, পেঁচার ছবি ইত্যাদি আলপনায় ফুটে উঠত। এগুলি সবই লক্ষ্মীর চিহ্ন। বাড়িতে বাড়িতে যেন আলপনার প্রতিযোগিতা শুরু হত। বয়স্করা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই আলপনা দেখতেন আর নিঁখুত আলপনার তারিফ করতেন। এই তারিফটুকুই হত শিল্পী মেয়েদের কাছে বড়ো পাওনা।
আমাদের ঘরটা ছিল পশ্চিমের ভিটেয়, পুবমুখো। লম্বা, খোলা টানা বারান্দা ছিল শুকনো খটখটে। পূর্ণিমার চাঁদ যখন পুব আকাশে উদয় হত, সারা ঘর বারান্দা ধবধবে চাঁদের আলোয় প্লাবিত হয়ে যেত। ঘর বারান্দা নানা নকশার আলপনায়, অদ্ভুত সুন্দর দেখাত। আমাদের দেশে একটি নিয়ম ছিল। লক্ষ্মীপূজায় কাউকে নিমন্ত্রণ করা হত না। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা আসত প্রসাদ খেতে। নদীর ওপার থেকেও আসত মুসলমানদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা, তাদের বাচ্চা বাচ্চা ভাইবোনদের কোলে নিয়ে দুভাঁজ করা কাপড়ে গা-মাথা ঢেকে লাইন করে দাঁড়াত এসে উঠানের একপাশে। এরা এইভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে থলে ভর্তি করে প্রসাদ নিয়ে ফিরে যেত। আমাদের দেশে তখন আশ্বিন মাসে অল্প অল্প ঠান্ডা পড়ে যেত।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার রাতের একটি বিষয় ছিল খুব মজার। কোজাগরীর রাতে সারারাত সবাই জেগে থাকবে (অবশ্য এর কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না) আর কিছু না কিছু জিনিস, কারও বাগান থেকে চুরি করে আনবে, কিন্তু ধরা পড়া চলবে না। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চলত বাচ্চাদের পলামুঞ্জি অর্থাৎ লুকোচুরি খেলা। একবার পাড়ায় আমরা ক’জন মিলে নিশি জাগরণের যুক্তি করলাম। আমাদের মধ্যে দু-তিনজন আমাদের থেকে বয়সে বড়ো মহিলাও ছিলেন।
পূজা, প্রসাদ বিতরণ মিটে গেলে সবাই মিলে একত্রিত হয়েছিলাম পাশের বাড়ির জ্যাঠাইমার উঠোনে। চাটাই পেতে বসে নানারকম গান-গল্পে অর্ধেক রাত কাটানোর পর সকলেরই চোখের পাতায় মৃদু জড়তা দেখা দিয়েছে। মধ্য গগনের চাঁদের বাঁধ-ভাঙা হলদেটে আলোয় উদ্ভাসিত চতুর্দিক। চোখের জড়তা কাটানোর জন্য আবার শুরু করা হল গান।
কোজাগরীর নিশি জাগরণের সাথে খাপ খাইয়ে গাওয়া গানগুলির দু একটি নমুনা দিইঃ
‘জাগরণে যায় বিভাবরী/ আঁখি হতে ঘুম নিল হরি’কোজাগরী রাতে সারারাত জাগার পর ভোরবেলা করা হত চুরির সেই অদ্ভুত নিয়ম পালন। এ নিয়ম পালনে কারও কোন ক্ষতি হলে তার কোন বিচার ছিল না। ক্ষতিগ্রস্তরা হাসি মুখেই মেনে নিত। কোজাগরীর রাতে চুরি করা ছিল পুণ্য কাজ এবং সারারাত জেগে ভোররাতে ধরা না পড়ে চুরি করতে পারলেই হত রাত জাগার সার্থকতা। এক এক সামগ্রী চুরির এক এক পুণ্যফল ছিল বলে জানতাম আমরা। যেমন—আদা চুরি করলে ভবিষ্যত জীবনে খুব আদর পাবে, হলুদ চুরি করলে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের অধিকারী হবে আর রাঁধুনী চুরি করলে হবে ভালো রাঁধুনী।
অথবা
‘আজ নিদ নাই আঁখি পাতে’। ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক, এখন তো আর কারও বাড়ির কাছে আদা হলুদের ক্ষেত নেই। বেড়ার ঘর বাঁশের দরজাও নেই। তাই এখন আর সেই ‘কোজাগরণ’ও নেই, চুরিও নেই। তবে একবারের কোজাগরীর রাতে চুরি করতে বেরিয়ে ভূত দেখার ঘটনাটি আজও স্পষ্ট মনে আছে।
আমাদের পাড়ায় প্রত্যেক বাড়ির সম্মুখ দিয়ে ছিল পায়েহাঁটা পথ। এই পথের পূর্বদিকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল স্কুল মাঠ। ভোর আসন্ন দেখে কোজাগরীর নিশিজাগরণের পুণ্যফল লাভের জন্য চুরির উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে আমরা কয়েকজন বের হয়েছি। বাড়ির সম্মুখভাগের পথ ধরে আমরা হেঁটে চলেছি স্কুলমাঠের শেষের পাড়ার দিকে। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছিল একটি প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছ। দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা মাঠ পূর্ণিমার অস্তগামী চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে, আসন্ন প্রভাতের কুয়াশাবৃত দিগন্ত এক অদ্ভুত মায়াজাল তৈরি করেছে। ক্ষেতের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে শিশিরসিক্ত ধানের চারাগুলি সবে কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। সশীষ কচি ধানগাছের পাতার ডগাগুলি বিন্দু বিন্দু শিশিরের ভারে যেন নববধূর নম্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের কোণের প্রকাণ্ড তেঁতুলের দীর্ঘ ছায়ায় মাঠের কিয়দংশে ছায়ান্ধকার, পূর্ব দিগন্তে কুয়াশাবৃত ধোঁয়াটে প্রভাতের আকাশে হালকা আবির রং দেখা দিয়েছে। শরৎকালের ভোর, ঝিরঝিরে উত্তরের হিমেল হাওয়া। পরনের কাপড়ের কিছু অংশ গায়ে জড়িয়ে, শিউলির ভুরভুরে গন্ধে মৌজ হয়ে পথ চলছি।
‘ভূত আমার পুতবড়োরা রাম রাম জপতে জপতে একসাথে দৌড়। দৌড়ে এসে ঢুকলাম জ্যাঠাইমার একটি ঘরে (ঘরটি কোজাগরীর পুণ্যার্থীদের জন্য খোলা ছিল)। ঘরে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, উপরে টিনের চালের ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে বিন্দু বিন্দু চাঁদের আলো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। ভোরের ঠান্ডা, ভূতের ভয় এবং রাত জাগায় ক্লান্তি, তিনে মিলে আর কারো মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। অস্পষ্ট স্বরেই ‘ভূত আমার পুত, ভূত আমার পুত’ বলতে বলতে দাঁতে দাঁতে ঠকঠক্ আওয়াজ করে চলছি। আমার জেঠতুতো দাদা টের পেয়ে দরজা খুলে বাইরে আসলেন।
পেত্নি আমার ঝি
রামলক্ষ্মণ বুকে আছে
করবি আমায় কী?’
তখনকার দিনে সময় নিরূপণের জন্য ঘড়ির এত বাহুল্য ছিল না, বয়স্করা আকাশের তারা দেখে বুঝতেন রাত কত হল। তাই রাতে প্রহরে প্রহরে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, বাইরে আসতেন আর ডেকে ডেকে বলতেন রাইত (রাত) দ্বিপ্রহর হইল, বা রাইত (রাত) তিন প্রহর হইল, ভোর হইল বইল্যা (ভোর হল বলে)। যাই হোক আমরা ভয় পেয়েছি আন্দাজ করে আমার জ্যাঠতুতো দাদা উচ্চৈঃস্বরে দুর্গা দুর্গা নাম স্মরণ করতে করতে দরজা খুলে গাড়ুগামছা হাতে বের হলেন। আমরাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, সাহস পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দেখলাম ভোরের আলো ফুটেছে। কোজাগরীর পুণ্য সম্পূর্ণ করতে দীঘিতে স্নান সেরে যে যার ঘরে ফিরল।
মনে পড়ে আমরা ছোটবেলায় একটি ব্রত করতাম। ব্রতের নাম ছিল ‘যমপুকুর’। আশ্বিন যায় কার্তিক আসে, এই সংক্রান্তিতে নিতে হত এই ব্রত। যারা এই ব্রত নিত তারা সারা কার্তিক মাস, ঠাকুর আঙিনায় তুলসিমঞ্চের পাশে এই ব্রত করত। মাটিতে ছোট ছোট সুগোল গর্ত করে গোবর মাটি দিয়ে নিকিয়ে পুকুর তৈরি করা হত। ভোরে উঠে স্নান করে মন্ত্র পড়ে সারা মাস প্রতিদিন সেইসব গর্ত পুকুরগুলিতে কিছু কচুরিপানা আর জল দিতে হত। এক একজন ব্রতীর পাঁচটি বা সাতটি করে পুকুর থাকত। এই পুকুরে জল ঢালার মন্ত্র অবশ্য এখন আর মনে নেই। যারা এই ব্রত নিত, তারা প্রথম প্রথম কিছুদিন উৎসাহের সাথে নিয়ম পালন করত, কিছুদিন পর কেউ আর ভোরে ঘুম থেকে উঠতে চাইত না, কার্তিক মাস শেষ হবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। ব্রতও কোনরকমে সাঙ্গ হত।
আশ্বিন যায় কার্তিক আসে, এই সংক্রান্তিতেই হত গারসী পূজা। এই পূজা হত ঠাকুর আঙিনায়, তুলসিমঞ্চের পাশে। মা কাকিমা জ্যাঠাইমাদের ব্রত সারার পর রান্না হত। দুপুরে খাওয়া হত গারসীর ডাল। আটরকম তরকারি দিয়ে রান্না করা খেসারির ডাল আর সঙ্গে থাকত চিনার চালের ভাত (এদেশে এই চিনার চালের নাম কাওনের চাল)। দেখতে সাদা, সরষে দানার আকারের। এই ‘গারসী সংক্রান্তি’ থেকে কার্তিক পূজার দিন পর্যন্ত একমাস বাংলাদেশের প্রতি বাড়িতে দেওয়া হত ‘আকাশ প্রদীপ’। উঠানের এককোণে মস্ত উঁচু একটি বাঁশ পুঁতে, কপিকল তৈরি করে তার সাহায্যে এই বাঁশের মাথায় তুলে দেওয়া হত ‘আকাশবাতি’। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে এই আলো দান করা হত।
কার্তিক মাসও ছিল পার্বণের মাস। দীপান্বিতা কালীপূজা, ভাইফোঁটা ছিল এই মাসের প্রধান উৎসব। বর্তমান সময়ের মত এত বাহ্যিক আড়ম্বর তখনকার দিনে ছিল না, প্যান্ডেল, মাইক, এসবের নামও শুনিনি। তবে হ্যাঁ মণ্ডপের সম্মুখে সারা উঠান জুড়ে নকশা করা বিরাট এক শামিয়ানা টাঙানো হত। যেখানেই দুর্গাপূজা হত সেখানেই হত কালীপূজা। বছরে একবার, চৈত্র মাসে হত সর্বজনীন ‘রক্ষাকালী’পূজা। সারা গ্রামকে কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি রোগব্যাধি আর অমঙ্গলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য হত এই পূজা। কালীপূজার দিন দিনের বেলায় হত ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের পূজা, রাতে হত ডাকিনী যোগিনীর মূর্তিসহ কালী পূজা। যাই হোক দীপান্বিতার পর হত ভাইফোঁটা, ঘরে ঘরে ভাইফোঁটা খুব আনন্দে কাটত। বর্তমান সময়ের এই ব্যয়বহুল ভাইফোঁটার দিনগুলির থেকে পুরানো দিনের ভাইফোঁটায় ক্ষীরের নাড়ু আর নারকেলের নাড়ুতেই যেন বেশি আনন্দ ছিল।
ভাইফোঁটার দিন ভোর না হতেই বোনেরা বের হত শিশিরের জল সংগ্রহ করতে। সারারাত ধরে গাছের পাতায় ফোঁটায় ফোঁটায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু সংগ্রহ করত ছোট ছোট বাটিতে। পারিবারিক নিয়ম অনুসারে, শিশিরের জলে ভাই-এর বাসি চোখ ধুইয়ে বোনেরা মন্ত্র পড়ে ভাইয়ের কপালে চন্দনের টিপ পরাত। মন্ত্র পড়ে ভাইয়ের হাতে দিত ঘি-মাখা ভাত, উপোস থেকে পঞ্চব্যঞ্জন ভাত রান্না করে ভাইদের খাওয়ানো হত। আমাদের দেশে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে পায়েস, সন্দেশ, দই বা ক্ষীর তৈরি হত নিজের ঘরেই। এখনকার মত এত বিভিন্ন রকমের বাহারি মিষ্টি আমাদের গ্রাম দেশে তখনকার দিনে ছিল না। পারিবারিক উৎসবে অনুষ্ঠানে দুগ্ধজাত দ্রব্য নিজ নিজ ঘরে তৈরি হত, কারণ তখনকার দিনে গ্রামের সমাজে জাতিধর্মের ফারাক প্রবলভাবে মান্য ছিল। তের দিন অশৌচ পালনকারী গোয়ালাসমাজের হাতের তৈরি (পাক করা) মিষ্টান্ন, দই এসব চলত না, তবে কাঁচা দুধে কোন দোষ ছিল না। মুসলমানের আনা কাঁচা দুধেও কাজ হত। অতএব পরিবারের প্রাচীনাদেরই এই কাজটি করতে হত, তাঁরা দক্ষ হাতে উৎকৃষ্ট মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি তৈরি করতেন।
কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে হত কার্তিক পূজা। এই কার্তিক পূজা ছিল মহাসমারোহের। সংসারের সমৃদ্ধি বা সন্তানের মঙ্গলকামনায় সংকল্প করে এক একজনে আমৃত্যু পালন করে যেত এই ব্রত। অনেক নিঃসন্তানও সন্তান কামনায় এই ব্রত করতেন। এই ব্রতের আগের দিন সংযম করে থাকতে হত, নিরামিষ খেতে হত। পরদিন পূজা না হওয়া পর্যন্ত উপোস, পূজার পর ব্রতীরা ফলাহার করতেন। ছোট ছোট মাটির কলসিকে বলত ঘট, এক এক ব্রতীর থাকত একুশটি করে ঘট। এই ঘটকে ধুয়ে শুদ্ধবস্ত্র পরে, খড়িমাটি গুলে নানারকম নকশায় চিত্রিত করা হত। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট ছোট তীরধনুক তৈরি করে দেওয়া হত ঘটে। আর ঘটের মধ্যে দেওয়া হত চাল এবং নানারকম আনাজের টুকরো। এই একুশটি ঘটের মধ্যে একটি ঘটে চিত্র করা হত চাঁদ ও সূর্যের ছবি এবং এই ঘটটির মুখের সরায় জ্বেলে দেওয়া হত ঘি-এর প্রদীপ, যা কিনা সারা রাত জ্বলত।
এই কার্তিকপূজা হত মূর্তি দিয়ে। প্রায় সব বাড়িতেই এই পূজা হত। আমাদের দেশে বনজঙ্গলে একরকম কাঁটাগাছ পাওয়া যেত, এগুলির নাম ছিল ‘মনকাঁটা’। এই মনকাঁটা বিভিন্ন রকমের হত। দুমনা, তেমনা বা চৌমনা। গাছের ডালের প্রতি গিটে কাঁটা থাকত। দুমনার দুটো কাঁটা, তেমনার তিনটে কাঁটা আর চৌমনার চারদিকে চারটে কাঁটা থাকত। এই চৌমনার ডাল লাগত কার্তিক পূজায়। মূর্তির দু’পাশে মাটির ডেলার উপর গেঁথে দাঁড় করানো হত চৌমনার ডাল। কাঁটায় গেঁথে দেয়া হত নানারকম ফল, তরকারি। যেমন কচুর টুকরো, মূলো, বেগুন, কাঁচা কলা, পাকা কলা, লঙ্কা ইত্যাদি দিয়ে গেঁথে দেওয়া হত। কাঁটায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত ধানের ছড়া, বোঁটাশুদ্ধ পাকা সুপুরী। আসনে সাজিয়ে দেওয়া হত আস্ত ফল, কুমড়ো, নারকেল ইত্যাদি। এগুলি পরে বাচ্চাদের হাতে দেওয়া হত। পূজার পর সারা পাড়ার মেয়ে-বৌয়েরা আমাদের বাড়িতে একত্রিত হতেন। আমার মা কার্তিকের জন্ম থেকে আরম্ভ করে নানান কীর্তিকাহিনী, লীলাখেলা গীতের মাধ্যমে বর্ণনা করতেন। প্রহরে প্রহরে নানা গীত গাওয়া হত। কার্তিক পূজার রাতে নিম্নজাতির কিছু মানুষ আসত বহুরূপী সেজে তামাশা দেখাতে। এটা ছিল এদের জীবিকা এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিয়ে যেত প্রসাদি খই, চিঁড়ে, নাড়ু এবং ধামা ভর্তি করে চাল। এদিন এদের এসব দেওয়াই নিয়ম ছিল।
একবারের কার্তিক পূজার রাতের কথা মনে পড়ে, পাড়ার সমবয়সীরা ক’জনা মিলে, এক ছোট্ট অভিনয় করেছিলাম। তখন আমার বয়স বারো হবে। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে থেকে “একলব্যের গুরুদক্ষিণা” অভিনয়ের প্রস্তুতি চলছিল পুরোদমে। আমাদের ছোটবেলায় যৌথপরিবারে ভাইদের মধ্যে সম্পর্কে যিনি সবচেয়ে বড়ো ছিলেন তাঁকে বলা হত ঠাকুরদাদা বা বোনেদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো যিনি তাঁকে বলা হত ঠানদিদি, এবং বউদি সম্পর্কিত যারা ছিলেন তাঁদের ডাকা হত বৌঠান বলে। আমাদের এই ঠাকুরদাদা অর্থাৎ আমার জ্যাঠতুতো বড়োদাদা, বয়সে আমার মায়ের থেকেও কিছুটা বড়ো ছিলেন। ঠাকুরদাদা পূর্ববঙ্গের নেত্রকোনায় নামজাদা উকিল ছিলেন। অবসরের পর সপরিবারে বাড়ি চলে এলেন। আমি তখন বেশ ছোট। ওঁর ছোটমেয়ে মণিকা ছিল আমার প্রিয়সখী। আমরা কেউ কাউকে না দেখে একমুহূর্তও থাকতে পারতাম না।
ফিরে যাই কার্তিক পূজার রাতে আমাদের অভিনীত নাটকের কথায়। নাটক নামটি অবশ্য পরে জেনেছি। ‘একলব্যের গুরুদক্ষিণা’ অভিনয়ে মণিকা সেজেছিল দ্রোণাচার্য, রেণু নামে আমার আপন জ্যাঠতুতো দাদার মেয়ে সেজেছিল ভীম। ওর ছিল মোটাসোটা ভীমাকৃতি চেহারা। আমি একলব্যের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। অন্যান্য ভূমিকায় আরো অনেকেই অভিনয় করেছিল।
বৈঠকখানার ফাঁকা ঘরে সকালের দিকে দরজা বন্ধ করে সবাই পাঠ মুখস্থ করতে ব্যস্ত। এমন সময় ঠাকুরদাদা একদিন আমাদের কাছে ডাকলেন। বললেন, তোমরা যে অভিনয় করছ, তো তোমাদের আভূষণ কেমন থাকবে। বললাম, আমরা ভাল ভাল শাড়ি পরে অভিনয় করব। শুনে ঠাকুরদাদা বললেন তা বেশ, তা বেশ, আমরা সবাই কিন্তু তোমাদের অভিনয় দেখতে যাব।
যাই হোক কার্তিক পূজার দিন এগিয়ে এল, অভিনয়ের প্রস্তুতিও প্রায় সম্পূর্ণ। এবার কে, কার কোন শাড়ি পরবে? কোথায় পাওয়া যাবে দ্রোণাচার্যের রুদ্রাক্ষ, কমণ্ডলু? এ’সব নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পাড়ায় এক বাড়ির পিছনে, নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে ছিল একটি রুদ্রাক্ষ গাছ। দলবল নিয়ে সবাই গেলাম ঐ জঙ্গলের রুদ্রাক্ষ তলায়। গাছের ভাঙা ডালের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে কিছু রুদ্রাক্ষ পাড়া হল। খোসা ছাড়িয়ে দেখা গেল অপক্ক সেইসব রুদ্রাক্ষের ভিতরে সুতো ঢোকানোর ফুটো তখনও তৈরি হয়নি। আমার বাবার এক ছড়া রুদ্রাক্ষের জপমালা ছিল। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান গেল যে ওই মালাটি দিয়ে কাজ চালাতে হবে। বাড়ির সবার, বিশেষত মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে, এক রাতের জন্য সেই মালাটি নিয়ে এলাম নাটকের জন্য। সুতো ছিঁড়ে নিয়ে নতুন সুতোয় গাঁথা হল দ্রোণাচার্যের হাতের আর গলার মালা। বাড়িতে ছিল দু’খানা কাঠের মুগুর। দাদারা যখন ছুটিছাটায় বাড়ি আসত তখন এই মুগুর ভাঁজত শরীরচর্চার জন্য। সেই দুখানা এনে হল ভীম আর দুর্যোধনের গদা, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি হল তীর ধনুক। আমাদের দেশে, প্রত্যেক বাড়িতে গোয়ালের মশা তাড়ানোর জন্য সন্ধ্যেবেলায় ‘সাঁজাল’ (ঘুঁটের আগুনের ধোঁয়া) দেওয়া হত। এজন্য গোয়ালের দরজায় বড়ো একটি গর্তে ঘুঁটের আগুনের ধোঁয়া জ্বালাবার ব্যবস্থা থাকত। ঘুঁটেকে বলা হত ‘ঘসি’। সারারাত আগুনে জ্বলে ঘসিগুলি সাদা ধবধবে হয়ে থাকত। ভস্মীভূত এই ঘসিগুলি গোটা গোটা তুলে এনে পিষে ময়দার মত মসৃণ করে সারা গায়ে মাখা হল পাউডার। (তখন দেশগাঁয়ে পাউডার বস্তুটির বহুল প্রচলন বা ব্যবহার ছিল না। যাও ছিল তা আমাদের এই ছেলেখেলায় দুষ্প্রাপ্য ছিল)।
“মাথার উপর প্রচণ্ড সূর্য, বুকে প্রতিহিংসার অগ্নি, কোথায় আমার সেই ব্রাহ্মণের তপস্যা? কোথায় আমার সেই হোম গন্ধামোদিত তপোবন----” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ডায়লগের কথাও এখন আর সম্পূর্ণ মনে নেই। আমাদের দলে যাদের সুরেলা গলা ছিল, প্রথমেই তারা গাইল উদ্বোধনী সঙ্গীত। তার একটু নমুনা দিই—
এস মা শারদেবয়স্ক যারা দর্শক হয়ে এসেছিলেন আমাদের নিজস্ব চেষ্টা আর নিপুণ দক্ষতায় অভিনয়ের তারিফ করেছিলেন খুব।
শুভদা বরদে
এসো মা জননী বাণী গো
এসো মা............
রঙ্গমঞ্চে আজ অভিনয় গীতে
মিলেছি জননী তোমাকে পূজিতে
মরম বাসনা পুরাও জননী
তনয়ে করুণা দানে
এসো মা শারদে......”
আমাদের ছেলেবেলায় প্রসাধনের শৌখিনতা ছিল না বললেই চলে, তবে হ্যাঁ যেটুকু সুযোগ আমরা পেয়েছি তা বারুণী স্নানের পার্বণে। বিভিন্ন পরবে খেলনা, মিষ্টি কেনাকাটার জন্য বাচ্চাদের যে পরবীর (‘পার্বণীর’) পয়সা দেওয়া হত গ্রামে সে পয়সায় ‘বারুণীর মেলা’ থেকে কেনা বিভিন্ন জিনিস যেমন ফিতে, কিলিপ (ক্লিপ), অথবা রংবেরং-এর মাছ সাবান আর কাগজের তৈরি ছোট চৌকো প্যাকেটের পাউডার। এই পাউডার নামক বস্তুটি ছিল একরকম সাদা গুঁড়ো, গন্ধ বলে কিছু ছিল না সেই পাউডারে, কিন্তু সেই পাউডারই আমরা গর্বের সাথে গায়ে মেখে আত্মতৃপ্তি বোধ করতাম। অভিনয়ের দিন রঙ্গমঞ্চে অবশ্য পাউডারের অভাব মিটিয়েছিলাম সাঁজালের পোড়া ঘসির সাদা গুঁড়ো মেখে।
তখনকার দিনে বউদের বা বয়স্ক মেয়েদের কোন উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া, যখন তখন এপাড়া-ওপাড়ায় ঘুরে বেড়াবার রেওয়াজ ছিল না। এই কার্তিক পূজার দিনটিতেই বামুন, কায়েত, যুগী সব জাতির বউরা, মেয়েরা সমাজনির্দিষ্ট ব্যবধানটুকু বজায় রেখে একত্রিত হতে পারত। প্রত্যেকেই সেদিন গৃহের অন্তঃপুরে আবদ্ধ, অবরুদ্ধ সঙ্গীত প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটাত বাহারি বাহারি গীতের মাধ্যমে। বলতে গেলে মেয়েদের একটি মিলনমেলাই জমত সেদিন।
কার্তিক পূজার দিন মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর আসত পূর্বকথিত সেই বোরূপীর (বহুরূপী) দল। সুর, তাল, লয় জ্ঞানহীন এক বাজনদারের দল থাকত তাদের সঙ্গে। একটি ঢোল, একটি কাঁসর আর একটি বাঁশির এলোপাথাড়ি ছন্দহীন বিকট আওয়াজের সাথে ঝমঝম ঘুঙুরের আওয়াজ তুলে বাড়িতে এসে ঢুকত এক বীভৎস মূর্তিধারী বহুরূপী। একজন ছয় ফুট লম্বা মানুষ হাত দুটো জোড়হাত করে উপর দিকে সোজা তুলে থাকত। একখানা লম্বা মত খালুইকে (মাছ রাখার সরুমুখ চুবড়ি) উপুড় করে সেই জোড়-করা হাতের উপর বসিয়ে দেওয়া হত, অর্থাৎ জোড়-করা হাত দুটি খালুইর মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। খালুইয়ের চারকোণা তলাটি থাকত উপরের দিকে। উপুড় করা সেই খালুইয়ের উপর আঁকা থাকত মুখ, নাক চোখ। মনে হত যেন একটি মানুষের লম্বাকৃতি মুখ। তার ওপর একটি শাড়ি দিয়ে ঘোমটা দেওয়া হত। খালুইয়ের চারকোণায় আটকে থাকত শাড়ি কাপড়ের ঘোমটাটি। ছয় ফুট লোকটিকে দশ ফুট উঁচু দেখাত। ঘোমটার উপর দিয়ে খালুই এর ছুঁচেলা চারটি কোণকে চারটি শিং বলে মনে হত। দলের অন্যরাও নানা সাজে সেজে আসত। নাচত, গাইত, নানা হাস্যকর কসরৎ দেখাত। ছেলেপিলেরা হেসেই খুন হত। নাচ দেখানো শেষ হলে ঘুঙুরের ঝমঝম আওয়াজ তুলে দলের কর্তাটি সোজা পূজাঘরের বারান্দায় সামনে চলে আসত। ‘মা ঠাকরুন পেন্নাম’ বলে বিশাল উঁচু চারটে শিংওয়ালা ঘোমটা দেওয়া মাথাটিকে মাটিতে ঠেকাত। ভয়ের ঠেলায় ছোট বাচ্চার দল চিৎকার চেঁচামেচি করে পালাত। প্রথম দর্শনে আমরাও ভয় পেতাম বটে।
হাসি মজায় কার্তিক পূজার রাত ভোর হত। ভোরের দিকে শুরু হত সংসারের অনিষ্টকারী বা শস্য নষ্টকারী বিভিন্ন কীট পতঙ্গের ধ্বংসকারী গীত। যেমন তেলাচোরা (আরশোলা), টিকটিকি, পিঁপড়ে, ইঁদুর, বিছে, বাদুড় এগুলি বধের গীত গাওয়া হত। কার্তিকের হাতে দেওয়া ধনুক দিয়ে ‘বাদুড়া’ মারা হত। এই বাদুড় বা বাদুড়া মারার ব্যাপারটায় ছোটবেলায় আমাদের খুব উৎসাহ ছিল। সবাই বাদুড় সাজার জন্য ব্যস্ত হতাম, কারণ মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠার পর হাতে গোটা গোটা ফল পাওয়া যেত। গাছের ফল ভক্ষণকারী বাদুড়দের গীতের মাধ্যেমে মেরে ফেলে তারপর ঘটের শান্তিজল আর পাখার বাতাস দিয়ে বাঁচিয়ে তুলে সেই চৌমনায় গাঁথা পাকা কলা, ফল ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে দেওয়া হত। বাদুড় মারার পদ্ধতিটিও মজাদার ছিল। বাচ্চারা সব মাটিতে হাঁটু এবং মাথা ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে থাকবে, যেন মাথা নীচের দিকে দিয়ে বাদুড়রা গাছে ঝুলছে। আর ব্রতীরা সব কার্তিকের উদ্দেশ্যে ঘটে দেওয়া ধনুক দিয়ে উপুড় হয়ে থাকা বাচ্চাগুলির মাথায় ঠেকাত আর গীতের মাধ্যমে মনের কামনা ব্যক্ত করত। গীতের কথাগুলি ছিল এই —
কার্তিকের হাতের ধনু দিয়া বাদুড়া মারিলাম গোএই করতে করতেই পুব আকাশে সূর্য দেখা দিতেন। পরিণত বয়সে ভেবেছি কার্তিক পূজার অঙ্গ এই আচরণের বিশেষত্ব কী? ছোটবেলায় এটিকে চিরাচরিত নিয়ম বলে জানতাম আর তা আমাদের কাছে খুব মজার ছিল। বয়ঃপ্রাপ্ত কালের পরিণত মন এই আচারটির মধ্যে যুক্তি খুঁজেছে। বিবেকের আবেদনে বুঝেছি বাদুড় তো প্রকৃতিরই সন্তান, পাকা ফলমূল তো বনের পশুপাখিরাই খাবে, না হলে এরা বাঁচবে কী করে? এদের মেরে ফেললে তো প্রকৃতিতে ভারসাম্য নষ্ট হবে। তা ছাড়া এই পূজা একটি শুভ কাজ। সন্তানের ও সংসারের মঙ্গলকামনার ব্রত। পুত্রকামনার ব্রত। অথচ সেই শিশুসন্তানদেরই দেবমূর্তির সামনে কল্পিত বাদুড় জ্ঞানে মেরে ফেলা, তার মাংস সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়া, ফের শান্তির জল, আর পাখার বাতাস দিয়ে সেই বাদুড়রূপী মৃত সন্তানদেরই আবার বাঁচিয়ে তোলা। এ কাজে আমার মন সায় দেয়নি। ভেবেছি হয়ত এ নিয়মের উৎস চিরাচরিত শাস্ত্রীয় নিয়মের অঙ্গ, বা পরিবর্তনের ধারায় হিন্দু আচারের মধ্যে ধাপে ধাপে ঢুকে পড়া বা প্রক্ষিপ্ত কোন নিয়ম হয়ে থাকবে, যাতে মনুষ্যশিশুর ওপর বাদুড় জ্ঞানে কল্পিত মৃত্যুবান হানা হয়। এই প্রচলিত নিয়মটিকে পরবর্তীকালে আমার সীমিত জ্ঞানে বিবেক বিরুদ্ধ মনে হওয়াতে আমার সন্তানদের ক্রমশঃ বাদুড় মারা অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত রাখা শ্রেয় মনে করেছিলাম। প্রাপ্ত বয়সের চিন্তায় এই ‘বাদুড়মারা’ আচারটিকে মেনে নিতে পারিনি, তাই নিজেও আর পালন করিনি।*
খানিক মাংস পাঠাইয়া দিলাম অমুকের বাড়ি গো (যারা কর্মোপলক্ষে ভিনদেশে থাকত তাদের উদ্দেশ্যে)
অমুকে জিজ্ঞেস করে কিসের মাংস আইসে গো
তোমার মায় খুড়িতে বর্ত (ব্রত) কইরা (করে) আর্শীবাদ পাঠাইছে গো
বাদুড় খাইয়া হইও তোমরা অক্ষয় অমর গো...
কার্তিক পূজার পরদিন হত উপোসী ব্রতীদের ‘পারণ’ (চলতি কথায় পান্না) বা উপবাসভঙ্গের অনুষ্ঠান। সারারাত যে প্রদীপ ঘটের মুখে জ্বলেছিল, সেই প্রদীপের আগুন থেকে আগুন নিয়ে উপোসী ব্রতীদের পারণের রান্নার চুলা ধরানো হত। যারা অন্য বাড়িতে বা বামুন বাড়িতে পূজা দিয়ে যেত তারা পরদিন সকালে নিজেদের ঘিয়ের প্রদীপ হাতে, শুদ্ধ ঘট কাঁখে করে যে যার বাড়ি নিয়ে যেত। যেতে যেতে গীত গাইত, যথা —
কাইল যে আইল ঘট পিরদিমকার্তিকের পর আসে অগ্রহায়ণ, ঋতুতে হেমন্তের মাঝামাঝি। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে আর সবুজের চিহ্ন নাই। যতদূর দৃষ্টি যেত দেখা যেত পাকা ধানের সোনালী রং। মাঠে মাঠে ধান কাটার মরসুম শুরু হত। সার বেঁধে চাষীরা ধানের আঁটি কেউ বা মাথায় কেউ বা বাঁকে করে দিনান্তে ফিরছে গ্রাম অভিমুখে। মালিকের বাড়ির বাইরের উঠানে ধানের আঁটির সারি সারি গাদা পড়ত। যথা সময় ঝাড়াই মাড়াই হয়ে গোলায় উঠবে সেই ধান, যে যার ভাগ পাবে। তার আগে নবান্নের জন্য খানিক ধান ভাঙানো হবে। পূজাপার্বণ, পিঠেপুলি তৈরির মধ্যে দিয়ে হবে নূতনের আহ্বান। ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠে পুলির ব্রতে লক্ষ্মীর আরাধনার শেষে গোলায় গোলায় বোঝাই হত বিভিন্ন জাতের ধান। সারা বছরের খোরাক আর বিপদের সম্বল ভরে রাখা হত গোলায়।
চইল্লা ঘরে যায় রে-- ইত্যাদি ইত্যাদি।
পৌষের প্রথম হত ক্ষেত্রগোপালের পূজা। সে এক মজার পূজা ছিল। এই পূজা হত ঠাকুর আঙিনায় খোলা আকাশের নীচে। পূজার পদ্ধতি এইরকম--কলা পাতার আগার দিকের খানিকটা কেটে নিয়ে ‘আগপাত’ করা হত। এই আগপাতে দেওয়া হত ভোগ। একজন উপোসী ব্রতীর জন্য একটি আগপাত দেওয়া হত। তাতে দেওয়া হত পরিমাণ মত খৈ, চিঁড়ে, কলা, গুড়, আর টক জাতীয় কিছু। তাছাড়া এই আগপাতার উপর দিকে দেওয়া হত সমগুন্তি ছোট ছোট আরো কয়েকটি আগপাত। তাতে দেওয়া হত ‘জরা’। খৈ, চিঁড়েভাজা, চালভাজা, তিলভাজা একত্রিত করে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে সেই গুঁড়ো, গুড় এবং কলা দিয়ে মেখে, হাতে করে জড়িয়ে তৈরি হত ডিমাকৃতি ‘জরা’। মাথার দিকের ছোট আগপাতগুলির প্রতিটিতে পাঁচটি করে ‘জরা’ দেওয়া হত। সঙ্গে সুগন্ধি জল দেওয়া হত পানীয় হিসাবে। নতুন একটি মাটির ছোট ঘটের মুখে কিছু শুকনো কলাপাতা চেপে ঢুকিয়ে দিয়ে তার মধ্যে টিকেয় করে আগুন ধরিয়ে দিত, পাতা পোড়া শেষ হলে ঘটটিকে ধুয়ে ছাই পরিষ্কার করে সেই ঘট জলভর্তি করে পূজার থানে রাখত, এতে করে একটা সোঁদা গন্ধ হত জলে, এ ছিল ক্ষেত্রগোপাল ঠাকুরের প্রিয় পানীয়। একটু মাটির ঢেলা পুড়িয়ে নিয়ে সেই পোড়া সোঁদা গন্ধওয়ালা মাটিটুকু দেওয়া হত ক্ষেত্রগোপাল ঠাকুরের প্রিয় ‘মুখশুদ্ধি’ হিসাবে। ক্ষেত্রের বা ভূমির দেবতা ক্ষেত্রগোপাল, তাই তণ্ডুলজাত ফলারের সঙ্গে মাটির সুঘ্রাণসমৃদ্ধ পানীয় জল আর মাটিপোড়া সুগন্ধি মুখশুদ্ধি পছন্দ করতেন। বিশেষ আড়ম্বরের প্রয়োজন ছিল না তাঁর পূজায়। তখনকার দিনে দেখতে পেতাম অনেকেই একটু গন্ধওয়ালা জল আর পোড়ামাটির ভক্ত ছিল, বিশেষ করে মহিলাকুল। ক্ষেত্রগোপালের পূজা হত দুপুরবেলা।
হরচরণ ছিলেন খুবই রাগী মাস্টার, কিন্তু পড়ুয়াদের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। বাড়িতে পূজা আছে বললে ছুটি দেবেন না, তাই স্লেট দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। ডাকলে কোন সাড়া না দিয়ে কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে যায় দেখে পাশে বসে থেকে দিদি বলল ‘মাস্টার মশাই ওর পেটব্যথা হচ্ছে প্রচণ্ড।’ সঙ্গে সঙ্গেই সুফল মিলল। ছুটি পেলাম পাঠশালা থেকে। এক দৌড়ে পৌঁছে গেলাম বাড়ির ঠাকুর আঙিনায়। লেগে গেলাম প্রসাদ খাওয়ায়।
ভেসে আসা শঙ্খঘন্টার শব্দ আর উলুধ্বনির আওয়াজে সন্দেহ হয়েছিল মাস্টারমশাইয়ের। পাঠশালা থেকে বেরিয়ে মাঠ ছাড়িয়ে, ক্ষেত পেরিয়ে ধীর পায়ে এসে পৌঁছালেন আমাদের ঠাকুর আঙিনায়, দেখলেন তাকিয়ে পেটের ব্যথায় কাতর ছাত্রীর প্রসাদ খাওয়ার বহর। কিছু বললেন না। তারপর, পরদিন পাঠশালায় যা করার তাই করলেন।
পৌষ মাসের শেষ দিনটি ‘পৌষসংক্রান্তি’। এই সংক্রান্তিকে বলত ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি।’ এইদিনে বাস্তুভিটে বা বাস্তুপুরুষের পূজা হত বলে একে ‘মকর বাস্তু’ অথবা ‘মকর সংক্রান্তি’ও বলত। পূর্ববঙ্গে মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত এই সংক্রান্তি। এই মকর সংক্রান্তিতে শিশু, বৃদ্ধ, যুবা প্রত্যেকেই (অবশ্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী) দলবদ্ধ ভাবে প্রাতঃস্নান করত। সে এক আনন্দের উৎসব হত আমাদের। সূর্যোদয়ের পূর্বে, অরুণোদয়ের আলোআঁধারিতে ভোরের প্রাক্কালে পুকুরের জলে ডুব দিয়ে স্নান করা হত, একে বলত ‘মকরি স্নান’। ছোটবেলায় দেখেছি মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে পূজার দু চারদিন আগে থেকে, বাস্তুপূজার আয়োজনে বড়োদের কী ব্যস্ততা! গোবরমাটি দিয়ে ঢেঁকিঘর ধুয়ে লেপেমুছে পরিষ্কার করে, ঢেঁকি ধুয়ে তাতে কোটা হত ভিজানো আতপ চাল, তৈরি হত চালের গুঁড়ো। দুধ শুকিয়ে তৈরি হত নাড়ু, বর্ফি। সংক্রান্তির দিন ভোর রাতে উঠে কেরোসিনের আলো জ্বেলে সারা হত বাসি কাজ, ঘরদোর, উঠান লেপাপোঁছা, ধোয়ামোছা, ছরা, ঝাঁটপাট সারা হত। প্রতি বাড়িতেই এই অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত যে, কোন বাড়ির মেয়েদের কাজ কত নিঁখুত আর পরিষ্কার এবং কে আগে ভোরের পুণ্যস্নান সারতে পারে। যাই হোক, মায়েদের গৃহকর্ম সারা হলে, বাড়ির সব মেয়ে বউরা একত্রিত হয়ে জামাকাপড়, গামছা নিয়ে যেতাম দীঘিতে স্নান সারতে। সঙ্গে থাকতেন একজন পুরোহিত। স্নানের পর পুণ্যার্থীরা কোমর জলে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ নামে সংকল্প করবেন, সেজন্য পুকুর পাড়ে কম্বল জড়িয়ে পুরোহিতমশাই বসে থাকতেন। এবার তিনি উচ্চস্বরে মন্ত্র বলতেন, আর পূণ্যার্থীরা সেই মন্ত্র শুনে বিড়বিড় করে আওড়াত। পৌষের শীতের দীঘির হিমশীতল জলে ঘন্টাখানিক দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়া। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ছিল!
মায়েদের মন্ত্র পড়ে স্নান সমাপ্ত হলে, তাঁদের সঙ্গেই যখন পাড়ে উঠতাম তখন আমাদের মানে ছোটদের আর কারো মুখ দিয়ে কথা বের হত না, হাত পা একদম অসাড় হয়ে যেত। তবুও এটাই কী উৎসাহ আর আনন্দের ব্যাপার ছিল!
স্নানের আগের দিন থেকে পুকুরপাড়ে আগুন পোয়ানোর ব্যবস্থা করা হত। কাঠকুটো জড়ো করা থাকত। পুণ্যার্থীরা স্নানের পর ভিজে কাপড় ছেড়ে, শুকনো কাপড় পরেই বসত ঐ আগুনের ধারে হাত পা গরম করতে। চূড়ান্ত পুণ্যলাভের আশায় আগুনের চারধারে চক্রাকারে বসে শুরু হত কীর্তন, শ্রীকৃষ্ণবিষয়ক নানারকম গান। প্রবীণারা যেসব গান বা গীত গাইতেন তার একটু নমুনা দিই।
(১)নবীনাদের মধ্যে, তখন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। কদাচিৎ গ্রামের কোথাও আর্বিভূত কলের গানের দৌলতে প্রবীণাদের পুরাতনী সুর ও কথার গানের সাথে পাল্লা দিতে শুরু করছিল কলের গান শুনে শেখা নবীনাদের গান।কমল আঁখি তোমায় ডাকি
পড়ি এ ঘোর দুর্দিনে
কমল আঁখি
হেরি চৌদিকে আঁধার
অকুল পাথার
বল পার হব কেমনে
ওগো কমল আঁখি...
জ্ঞান আঁখি দাও গো খুলে
পথে যাব চলে
দগ্ধ হৃদয় শীতল হবে নাম সুধা পানে।(২)
তোরা দেখরে আসি, নগরবাসী
নদীয়ায় চাঁদ উদয় হল
নিতাই বুঝি এদেশে এল
দেশে, এল--রে নিতাই...
ও তার সঙ্গে দুটি ভাই
হরির নামের মালা গলে দুলছে রে সদাই
যত কীটপতঙ্গ আদি যত,
সব কে হরির নাম নেওয়া লো
নিতা--ই বুঝি এদেশে এল।
আমার তখন অনুমান ১২-১৩ বছর বয়স। আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে প্রথম এল বিরাট বড়োসড়ো ধুতুরা ফুলাকৃতি মুখওয়ালা একটি ‘কলের গান’ (গ্রামোফোন)। পাড়াঘরের সাধারণ শ্রেণীর লোকেরা বলত ‘বাক্সের গান’। এই কলের গান যাদের বাড়ি ছিল, তারা বাইর (বাহির) বাড়ির, কাছারি ঘরের (বৈঠকখানা) ফরাসের উপর রেখে কলের গান চালাত। লোকের ভিড় এড়ানোর জন্য বাঁশের বেড়ার মূল দরজা বন্ধ রাখত। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনত অনেক শ্রোতা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও থাকত।
ওই বাড়িতে দিদির আর আমার উপস্থিতি ছিল সর্বক্ষণ। গান বাজতে শোনা মাত্র ছুটে যেতাম, যে পর্যন্ত হুবহু মুখস্থ না হত সে পর্যন্ত আহারনিদ্রা বোধ থাকত না। যখন দু’বোনেরই অনবরত প্রচেষ্টায় কলের গানের শোনা কোন একটি গান হুবহু মুখস্থ হয়ে যেত তখন আমাদের সে কী আনন্দ! সে আনন্দের ঠেলায় বাড়ির লোকের কান ঝালাপালা হত।
আমার দিদির গানের গলা এত মধুর ছিল যে মাঝেমধ্যেই গ্রামে বা পাড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি থেকে আমাদের দুইবোনকে ডেকে নিয়ে যেত গান শুনতে। দিদির গানে মুগ্ধ হয়ে, ‘কমলা ঝরিয়া’ নামে আখ্যায়িত করেছিল দিদিকে। কমলা ঝরিয়া তখন উদীয়মান তরুণী কণ্ঠশিল্পী। কলের গানের দৌলতে সে নামটি তখন গ্রামের লোকেরাও জানতে পেরেছিল।
থাক সেসব কথা, এখন ফিরে যাই সেই মকরিস্নানের কথায়। স্নানের পরে আগুন পোহানোর সময়ের ধর্মীয় গীতের আসরে প্রবীণারা বেশিক্ষণ থাকতে পারত না। সময় কম, কারণ মকর উৎসবের পূজাপাট, ভোগ, নৈবেদ্য, পিঠে, পুলির আয়োজন করতে হবে। তাঁদের গান শেষ হতেই এতক্ষণ উস্খুস্ করতে থাকা নবীনারা তাদের কলের গানে শোনা, শেখা গান গাইবার সুযোগ পেত। তারা শুরু করত গান। সেসব গানের কথাগুলি ছিলঃ
(১)আমি তখন স্থান কাল পাত্র ভুলে, গানের নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়ে শুরু করে দিলাম গান। যথা—যদি গোকুল চন্দ্র
ব্রজে না এলে সখি গো...(২)
মন পাগল হইল রে-এ এ এ এ
গৌরাঙ্গ রূপ দেখে
কী দেখলাম কী দেখলাম সখি
গহুর (গৌর) রূপের ঝিকিমিকি
এই দুই চোখ-এ এ এ এ
আমি ফিরিয়া না দেখলাম তারে নদীর ঘাটে
তখন আমার কলসি গো কাঁখে
মন পাগল... গৌরাঙ্গ রূপ দেখে...অথবা
(৩)
গিরিধারী মন্দিরে নাচিব
প্রেম প্রীতিতে বাঁধিব নূপুর
রূপের বাসরে আমি সাজিব
কৃষ্ণ নামাবলী অঙ্গভূষণ করি
আরতি নৃত্যে আমি নাচিব।
(৪)আমার ছোটবেলায় দেশেগ্রামে বিভিন্ন দর্শনীয়ের মধ্যে আর একটি মজার দর্শনীয় ছিল ‘পটের গান’। কার্তিক মাস থেকে আরম্ভ করে সারা শীতকাল এই পটুয়ারা আসত গ্রামে গ্রামে তাদের পটচিত্র সঙ্গে নিয়ে। তাদের নিজের হাতে আঁকা পটে দেবতাদের সৃষ্টিরহস্য থেকে আরম্ভ করে রামায়ণ, মহাভারতের নানা কাহিনী, পুরাণের গল্প, কল্কি অবতারের চিত্র আঁকা থাকত। লম্বা পটের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত স্তরে স্তরে আঁকা থাকত বিভিন্ন গল্পকাহিনী। তাদের আঁকা দৃষ্টিনন্দন ছবিগুলি দেখিয়ে গানের মাধ্যমে চিত্রিত ঘটনাগুলির বিবরণ দিত। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পটের গান নিয়ে ঘুরে বেড়াত। রামায়ণ, মহাভারতের নানা ঘটনা মানুষ জানতে পারত পটের গানের মধ্য দিয়ে। সমাজে লেখাপড়ার প্রচলন বহুল হয়নি তখনও। সংস্কৃত ছাড়া বাংলায় রামায়ণ, মহাভারত তখনও গ্রামেগঞ্জে পৌঁছোয়নি। মেয়েরা আর সাধারণ পরিবারের পুরুষরাও লেখাপড়া জানত না। তাই পটের গানের মাধ্যমেই ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে পরিচয় ঘটত গ্রামের আপামর জনসাধারণের, লোকশিক্ষাও হত এই পটের গানের মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে টেলিভিশানে মাঝে মধ্যে যেসব পটুয়াদের ছবি দেখতে পাই। তখনকার দিনের পটের ছবি এমন ছিল না।নিশীথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনেঅথবা
(৫)
ওরে সুজন নাইয়া
কোন বা কন্যার দেশে যাও রে
সাধের ডিঙ্গি বাইয়া আ আ আ......
ওরে সুজন নাইয়া...............
কেমন ছিল পটের সে ছবিগুলি দেখতে? যদিও খুব ছোটবেলায় দেখা, যাই হোক সেগুলি ছিল এরকম—
দশ-পনের হাত লম্বা, হাত তিন-চার চওড়া মিহিবোনা একটি মাদুরের উপর বিভিন্ন রং সমাহারে চিত্রগুলি আঁকা হত। চিত্রিত মাদুরের মাথায় ওপরের দিকে একটি সুতো বাঁধা থাকত। সম্পূর্ণ মাদুরটিই থাকত গোটানো। যখন গ্রামগঞ্জে পট দেখিয়ে গানের সাহায্য পটের বিষয়কে বর্ণনা করে বাড়ি বাড়ি থেকে দান চাইতে আসত, তখন তারা বাঁশের লম্বা লাঠির মাথায় জুড়ে নিত মাদুরের উপর অংশের সুতোটি, এবং ধীরে ধীরে মাদুরটিকে নীচের দিকে খুলত আর লম্বা একটি কঞ্চি দিয়ে একে একে এক একটি চিত্রের বিষয়কে দেখিয়ে দেখিয়ে গানের মাধ্যমে মুখস্থ বলে যেত।
পট খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই দেখা যেত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, আর মহামায়ার চিত্র। অর্ধউন্মীলিত-চক্ষু ধ্যানমগ্ন মহাদেব— বামপদ সোজা, দক্ষিণ পা ভাঁজ করে পাতা, ডান হাতে একখানা মস্ত বড়ো বীণা, বাঁ হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। বাঘছাল পরিহিত মস্ত একখানা ভুঁড়ি নিয়ে বসে আছেন মহাদেব। পটুয়ারা ছবি দেখিয়ে যেসব গান গাইত তা এখন আর খুব একটা মনে পড়ে না তবু আবছা একটু মনে আছে। যেমন সৃষ্টির রহস্য কথা।
‘শিবের নিজ অংশেগানের সর্বশেষে আসত কল্কি অবতার। সুন্দর সুরেলা গলায় গানের মাধ্যমে আর কঞ্চির লাঠির সাহায্যে দেখিয়ে দেখিয়ে নানা ঘটনা বলে যেত। পরিবর্তে নিয়ে যেত চাল, ডাল, তেল, আনাজ। গ্রামের যে যা পারত দিত। নানা গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছ’মাস পর ওরা নিজেদের দেশে, ঘরে ফিরে যেত।
শিবের নিজ অংশে
নিজ অঙ্গে সৃজিলেন কায়া
তাহাতে জন্মিল আদ্যাশক্তি মহামায়া
দেবী ত্রিগুণময়ী
দেবী ত্রিগুণময়ী
ত্রিনয়নী তিন দিকে তিন দেব
সত্ত্ব রজঃ তমো গুণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু শিব ইত্যাদি ইত্যাদি