• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | সাক্ষাৎকার
    Share
  • সাক্ষাৎকার—সুরমা ঘটক : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়


    প্র: কলেজে এলেন আপনি ...

    উ: আমি যখন মামাবাড়ি থেকে আসি, সিলেট থেকে আর কি। তখন আমরা করতাম মণিমেলা। মণিমেলা বলে একটা ছিল … মণিমেলার মধ্যমণি। আস্তে আস্তে বাবার কাছে ছেলেরা আসতে শুরু করল। ঐ কেউ চাকরী, কেউ অমুক তমুক, এরকম। মহিলা কেউ নয়। সুতরাং ঐ যে কাঞ্চী, যে নেপালি মেয়ে কাজ করে, সে না এলে সব কাজ আমাকে করতে হত। বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, সবই আমাকে করতে হত। সেলাই, সেলাই না করলে জামা কি গায়ে দেব? বুঝতেই পারছ। খুব অসুবিধার মধ্যে পড়াশোনা করেছি।

    প্র: শিলং-এ আপনার কলেজটার কি নাম ছিল?

    উ: লেডি কিন গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। যাইহোক ফাইনাল যখন দেব। তখন আবার টনসিল আর জ্বর। বাবাকে বললাম পাশ করি ফেল করি পরীক্ষা আমি দেব। তো কোনরকমে পরীক্ষা দিলাম। তারপর শুনলাম আঠাশ শতাংশ মাত্র পাশ করিয়েছে। আমি তো রেজাল্ট আনতে যাইনি। এত কম পাশ করেছে, তার ওপর আবার জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। তখন জানা গেল ইংরেজিতে কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছি। তখন সিলেটে গিয়ে ঐ অশোকবিজয় রাহার কাছে কিছুদিন পড়লাম। পরে এসে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম।

    প্র: তাহলে আপনি অশোকবিজয় রাহার ছাত্রী এক অর্থে ...

    উ: হ্যাঁ। ঐ একমাস-দুমাস থেকে পড়লাম। তারপর ফিরে এসে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বি. এ. পরীক্ষা দেব, আমি বাবাকে বললাম যে, বাবা আমি এইরকমভাবে আর পড়াশোনা করতে পারব না। আমাকে হস্টেলে দিয়ে দিন। কারণ আজকে চাপরাশি নেই, রান্না কর। কাল কাঞ্চী নেই, সব কাজ কর। আর এদিকে গুষ্টি খালি বাড়ছে। কেউ চাকরী, কেউ অমুক, কেউ পড়া এই করে করে।

    প্র: গ্রাম-মফস্বল থেকে সদরে লোকজন যারাই আসে ...

    উ: হ্যাঁ। আর আমার জ্যাঠতুতো ভাইরা সবাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তারপর আসত। এসে কলেজে পড়তো এইরকম আর কী। তখন আমার একজন বাল্যবিধবা জেঠিমা, মা মারা গেছেন, তাঁকে বাবা আনলেন। কিন্তু এই যে বাল্যবিধবা, এঁরা মানে সাধিকা। মানে এদের জীবন যে কি! সারা দিনরাত কিচ্ছু খেত না! দুপুরবেলা কোনরকমে নিরামিষ একটু সেদ্ধ ভাত, কি একটু ঝোল-ভাত খেত। আর সকালে না, বিকালে না, রাত্তিরে না। তখন তো বুঝতেও পারতাম না। কোনদিন বলিনি যে জেঠিমা একটু দুধ-ফল খাও। আর সারাদিন কাজ করত। অপূর্ব সুন্দরী। চুল কাটা, থান পরা এরকম ছিপছিপে রোগা। তারপরে শিলং-এর বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল। ওই ভাইরা এল, অমুক এল। আর এক পার্টি এসে বলল মামাবাবু--পরে ওর মা আর দুই বোনকে নিয়ে থাকতে আরম্ভ করল। আবার আর এক পার্টি এল, মানে রিফিউজি ক্যাম্প প্রায়। এই অবস্থা। তা যাইহোক এই করে করে কোনরকমে বি. এ. পাশ করলাম। ইন্টারমিডিয়েট যখন পড়ি তখন তো ওই অবস্থা। তখন কলকাতা থেকে আমার একজন মামা যেত। ওর দিদির বাড়িতে, মানে আমার মাসিমার বাড়িতে। মনোজ মামা। তা উনি এই অবস্থা দেখে আমাকে মুখে মুখে পড়া বলে যেতেন। ওই নিয়ে কোনরকমে পরীক্ষা দিয়েছি। উনি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন, গান করতেন, আরও অনেক কিছু করতেন। কবিতা লিখতেন। তা উনি তখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখতেন। আর আমি তখন বিভূতিভূষণ পড়ছি। আর বিশেষ করে আরণ্যক পড়ে এত মুগ্ধ, আমিও চিঠি লিখতে আরম্ভ করলাম। তখন উনি ‘মা লক্ষ্মী’ সম্বোধন করে ‘আশীর্বাদক কাকাবাবু’ লিখে আমাকে উত্তর দিতেন। তাহলে প্রথমে রবীন্দ্রনাথ তারপরে বিভূতিভূষণ। তো আমিও প্রকৃতিপ্রেমিক। আর বিভূতিভূষণ।

    ঠিক করেছি না ভুল করেছি জানিনা যখন বি. এ. পড়ি ... প্রথমে মণিমেলার মধ্যমণি, তারপরে গার্লস স্টুডেন্ট কমিটির সেক্রেটারি, পরে কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি করতে করতে আমাদের যে নেত্রী অঞ্জলি লাহিড়ী তিনি বি. এ. পড়তে এলেন। তখন আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট পার্টিতে এলাম। তা কমিউনিস্ট পার্টিতে আমার একজন মামা তখন হোলটাইমার, কলকাতায় ছিলেন। আর সিলেটেও কমিউনিস্ট পার্টি আমি দেখেছি। আমার মামিমা, মাসিমা এরাও পার্টি করতেন।

    প্র: আপনার মামিমা, মাসিমা যারা সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন, তাঁদের নাম কী?

    উ: এখানে একটা কথা বলি, আমার দাদামশায় ছিলেন ই. এ. সি বা হাকিম। মা, মাসিমা পড়াশোনা করতেন। পড়াশোনা করতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তখন ছিল বাল্যবিবাহের যুগ। বাল্যবিবাহ। আর 'সরদা' আইন পাশ হয়নি। সরদা আইন মানে চোদ্দ বছরের আগে বিয়ে দিতে পারবে না। সুতরাং মা’র এগারো বছর দুই মাস, আর মাসিমার এগারো বছর নয় মাস, আর মামিমা শিলং-এ পড়তেন, তাঁর চোদ্দ বছর। এ তিনজনের বিয়ে হল। আশ্চর্যের বিষয় আমার মায়ের দিকে তো আমরা দুজন ভাইবোন। আর মাসিমা ও মামিমার তখনো ভাইরা হয়নি। তিনজন তিন জায়গায় থেকে পড়াশোনা করতেন। করে দাদামশায়ের কাছে গিয়ে একসঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। মামিমা ফার্স্ট ডিভিশনে, মা সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেন। মা তো তখন মাত্র নয় দিনের অসুখে মারা গেলেন। টাইফয়েডে। তখন তো টাইফয়েডের চিকিৎসা ছিল না। স্যালাইন চলছিল। হার্টফেল হয়েছিল। আর হার্টফেল হলে তো কিছু করার নেই। মামিমা পরে ইন্টারমিডিয়েটে ১৮তম স্থান পেয়েছিলেন। আর বি.এ. ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেন। চাকরী করেছেন, অনেক কিছু করেছেন। আর মাসিমা চাকরীতে ঢুকতে গিয়ে করলেন না। পরে অনেক দুর্যোগ এসেছিল। অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ভাইটিকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। তারপর ছোটমাসির পালা। ছোটমাসিকেও ওই জোর করে পনেরো বছরের মধ্যে বিয়ে দিলেন। ছোটমাসি বিয়ে করবেন না আর উনি পাত্রকেও না করবেন না। কিন্তু পড়াশোনা করত। বিয়ে পরীক্ষার পরে শিলং-এ এল, এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে বেরিয়ে চলে এল। যে এর সঙ্গে আমি সংসার করব না। তারপরে অনেক স্ট্রাগলিং লাইফ। শেষে ডিভোর্স করে তারপরে পরবর্তী বিয়ে হয়। ভাইবোন হয়। আর তারপরে হল আমার পালা।

    প্র: আপনার মামিমার নাম কি ছিল?

    উ: মামিমার নাম ছিল শরদিন্দুবালা দেবী। আর মা'র নাম হল সুপ্রীতিবালা দেবী। আর মাসিমার সুধা ডাকনাম। ভালো নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। ছোটমাসির নাম ছিল সুমতি।

    প্র: আচ্ছা যে মামা কলকাতা থেকে যেতেন আপনাদের ওখানে। কবিতা লিখতেন, একটু পড়াতেন ... মনোজ মামা, নাম কি ওনার? মনোজ কি ডাকনাম?

    উ: ওনার নাম মনোজ চৌধুরী।

    প্র: যখন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হল শিলং-এ, সিলেটের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও তখন যোগাযোগ ছিল? উ: হ্যাঁ। আমি তো ছোট। সুতরাং আমার সঙ্গে ডিরেক্ট যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু মামিমা আর ছোটমাসি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তখন খালেদ চৌধুরীও সিলেটে ছিলেন।

    প্র: হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন তখন?

    উ: হেমাঙ্গ বিশ্বাস তখন ছিলেন না।

    প্র: অঞ্জলি লাহিড়ীর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন ...

    উ: হ্যাঁ। অঞ্জলি লাহিড়ীর সঙ্গে আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট পার্টিতে এলাম।

    প্র: বাড়িতে সমস্যা হয়নি? বাবার সঙ্গে?

    উ: সমস্যা হয়েছে। কিন্তু বাবা যেমন দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। মনও ছিল খুব উদার। তখন আমি বলতাম যে আপনি চলুন আমার সঙ্গে, গিয়ে মিটিং-এ বক্তৃতা শুনবেন। তখন কংগ্রেস তো অগস্ট আন্দোলনের পর থেকে একটু বিশ্বাসঘাতকতার দিকে গেছে। কারণ ৪৬-এ যে নৌবিদ্রোহ হল, তখন ওরা এগিয়ে গিয়ে বলল যে তোমরা স্ট্রাইক বন্ধ কর, আমরা দেখছি। বিশ্বাসঘাতকতা। সাংঘাতিক ঘটনা ওই নৌবিদ্রোহ। আর একটা হল সুভাষচন্দ্র। সুভাষচন্দ্র বসু এগিয়ে আসছেন। তোমরা আমাদের রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আজাদহিন্দ বাহিনী। সবকিছু। আর চারদিকে খালি জয়হিন্দ ধ্বনি। সেখানে নেহরু কি করলেন? নেহরু আজাদহিন্দ ফৌজের সায়গল, ধিলোন ও শাহনওয়াজ—তিনজনকে লালকেল্লায় বন্দী করে রাখলেন। তখন যা আন্দোলন, সেই আন্দোলন বামপন্থী আন্দোলনই উল্লেখযোগ্য। রামেশ্বর মারা গেলেন।

    প্র: ৪৬-এ কলকাতায়, ধর্মতলার কাছে।

    উ: ভুলোনা ভুলোনা ভুলোনা ডাকে রামেশ্বর, ডাকে মনোরঞ্জন ভুলোনা ভুলোনা ভুলোনা ইত্যাদি। আমরাও শিলং-এ মিছিল বের করেছিলাম। এই করে আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট পার্টিতে চলে এলাম। আরেকটা হল যে তখন আমি আস্তে আস্তে বিভূতিভূষণ মানে কাকাবাবু সমর্থন করবেন কি করবেন না, তাই নিয়মিত চিঠি লিখতাম না। তারপর আমি হায়েস্ট কমিটির মেম্বার হলাম।

    প্র: শিলং-এ, মানে স্টেট কমিটির।

    />
    উ: তখন আমাকে বলল, যে তোমাকে বাড়ি ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হবে। তা আমি বললাম বাবাকে ছেড়ে কি করে যাব? তখন বলল যে কমরেড পা বাড়ালেই বাড়াতে পারবেন। আর না হলে পিছিয়ে যাবেন। আর আমাকেও ওই ১৫-১৬ বছর বয়সে বাবা বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বললাম যে বি. এ. পরীক্ষা পর্যন্ত আমি এইসব বিষয়ে চিন্তাই করব না। বাবা অবশ্য আমায় কিছু বলেননি। কিন্তু ওরা বিয়ে-টিয়ে সব ঠিক করে রেখে দিয়েছিলেন। যে বি. এ. পরীক্ষা দেব আর বিয়ে হবে। ঝপাং ... (হাসি...) তো আমি তো পার্টি করছি।

    প্র: গ্র্যাজুয়েট হবার পরে ...

    উ: গ্র্যাজুয়েট হবার পরে শিলং-এ তো আর এম. এ. পড়তে পারবো না। আর আমি তো হায়েস্ট কমিটির মেম্বার হয়েছি। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতেই হয়েছে। সেই অনেক দূরে খাসিয়া গ্রামে। তারপর তো ধরা পড়লাম। ধরা পড়ার পরে শিলং জেলে। এইখানে একটা কথা, সেটা হল যে আমরা দশ মাস ছিলাম ফিমেল ওয়ার্ডে। চোর, খুনি, পাগলি এবং পতিতাদের সঙ্গে। এদের মধ্যে চারজন ছিল ভায়োলেন্ট। তার মধ্যে একজন রিলিজ হয়ে চলে যায়। ভুটিয়ালি। আর একজন খুব অসুস্থ। খুশ্‌বু নাম। ও সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিত। খাবার জল, কাপড়চোপড় সব কিছু। ওর কথাও বাদ দিচ্ছি। আর একটি এসেছিল নিরুপমা, ও অঞ্জলিরই ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। ওর সঙ্গে ওর দুটো ছেলে আছে। কিন্তু ও অসুস্থ হয়ে ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। আর আরেকজন ছিল পার্বতীর মা। ও দেখতে খুব সুন্দর, ভদ্র, ভালো। ওর মেয়েরা দেখা করতে আসত। কিন্তু পরে এত ভায়োলেন্ট হয় এ দুজন যে সাংঘাতিক অবস্থা। সুতরাং আমরা যখন অনশন ধর্মঘট করতাম তখন আমাদের একটা ডিমান্ড থাকত যে এদের এখান থেকে তেজপুরে চালান কর। তেজপুরে চালান কর কেন? তখন শিলং ছিল সারা আসামের রাজধানী। এবং নিয়ম ছিল যারা অত্যন্ত ভায়োলেন্ট তাদের তেজপুরে চালান করা হবে। আর দুই নম্বর হল পতিতা মেয়েরা আসত। এরা আসত সিফিলিসের চিকিৎসার জন্য। ওদের অসুখের গুরুত্ব বুঝে, কনভিকশন দিয়ে তারপর ছেড়ে দিত। এখন ওদের কাপড় এবং আমাদের কাপড় একই উঠোনে শুকনো হচ্ছে। সেইজন্য এটাও আমাদের একটা দাবী ছিল যে যদি সম্ভব হয় তাহলে যেন ওদের অন্য ওয়ার্ডে রাখা হয়। এখন যেটা ব্যাপার হচ্ছে, হয়তো আমি ঠিক করেছি বা হয়তো ভুল করেছি। সেটা হল যখন অনেক পরে, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে দিয়ে ঋত্বিককুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রথম দিনই আমার মামিমা বলেছিলেন ট্রটস্কাইট। কোনও কথা বলবে না। তারপরে আমি তো শিলং চলে গেছিলাম, সুতরাং কথা তো বলার কোনও দরকারই নেই। ফিরে এসেছি, ফিরে এসে দেখি উনি সব দল থেকে নায়ক নায়িকা নিয়ে ....

    প্র: আপনার এই মামিমা মানে কী সাধনা রায়চৌধুরী?

    উ: হ্যাঁ। সবাইকে নিয়ে উনি 'নীচের মহল' নাটক করছেন। 'লোয়ার ডেপথ্‌' করছেন।

    প্র: গণনাট্য সংঘ কখনো অভিনয় করেনি?

    উ: ওরা তো বন্ধ করে দিল।

    প্র: তখন আপনারা গ্রুপ থিয়েটার বলে, আপনিই বোধহয় নাম দিয়েছিলেন, 'নীচের মহল', আপনি কলকাতায় এলেন।

    উ: শিলং নিয়ে আর একটু বলি। আমরা সবথেকে বড় অনশন ধর্মঘট করেছি ২৪ দিন। আরও ছোট ছোট করেছি। তারপরে শিলং-এর যত রাজনৈতিক মেয়ে বন্দী তাদের শিলং-এ আনা হয়েছে। তখন আমাদের অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে গেছে। সি. পি. আই ও আর. সি. পি. আই মিলিয়ে কুড়ি জন। তারপরে অনেকে রিলিজ হল অনেকে হয়নি। বাকিদের সুপ্রীম কোর্টে নিয়ে গেল। ওদিকের (গভর্নমেন্টের) উকিল হলেন ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ আর আমাদের হলেন কি যেন নাম ভুলে গেছি। কি একটা মিসি ডিক্লেয়ার করল যে একুশ দিন পরে রায় দেবে। তো একুশ দিন পরে রায় দিল। অঞ্জলি থেকে আরম্ভ করে সব রিলিজ হয়ে চলে গেল। আমরা তিনজন রইলাম সি. পি. আই-এর। আমরা তিনজন শিলং জেলে ফিরে এলাম। তার মধ্যে একজন শিলচরের সে শিলচর চলে গেল। বাকি আমরা দুজন। এবং আর. সি. পি. আই এর ছিল তিনজন। সেখানেও আরো দুজন রিলিজ হয়ে গেল, রইল একজন। মোট তিনজন। এই তিনজনকে কিছুতেই ছাড়বে না। আমরা নাকি সাবভার্সিভঅ্যাক্টিভিটি করেছি ইত্যাদি। তা ইংরেজি ১৯৫১-র ১লা জানুয়ারি একদিন বরফ-ঢাকা সকালে আমি লিখতে আরম্ভ করি। ১৯৫১ মানে তোমাদের তখন জন্মই হয়নি। যাইহোক আমি লিখতে আরম্ভ করি। লিখে আমি তিনটে খাতা শেষ করি। এই লেখার বৈশিষ্ট্য হল প্রতিটি চরিত্র বর্ণনা করেছি। প্রতিটি পাগলী, প্রতিটি চোর, একজন খুনী, পতিতা সব। প্রকৃতি তো আছেই।

    প্র: এই বিষয়টা নিয়ে আমার মনে পড়ছে ঋত্বিক ঘটকের একটা চিঠি আছে। যেটা বইয়ের পেছনদিকে ছাপাও আছে, ১৯৫৪ সালে লেখা।

    উ: ঠিক কিনা ভুল আমি জানিনা। আমি তো কথা বলতাম না। উনি আমাকে পার্ট দিয়েছেন। আমি তখন সাউথ স্কোয়াডে। তখন আমার মামিমাকে বলতেন যে আপনাদের এখানে / বাড়িতে কে থাকে দাস ক্যাপিটাল। দাস ক্যাপিটাল মানে, কথা বলি না তো। মামিমা বারণ করে দিয়েছিলেন। ট্রটস্কাইট। আমি লক্ষ্য করলাম যে পড়াশোনা ছাড়া উনি কোন কথা বলেন না। সবসময় বই, পড়াশোনা। লক্ষ্মী তুমি গোর্কি পড়বে, তুমি এই করবে, তুমি অমুক করবে। আমি প্রশ্ন করতাম। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন। এরকম আর কী। তারপরে কী মনে হয়েছে একদিন আমি শিলং জেলের ডায়েরির তিনটি খাতা পড়তে দিয়েছি। পরদিনই চিঠি। মোটামুটি কোনটা বাড়াবো, কোনটা কমাব ওইসব লিখে। তুমি এক্ষুনি পাণ্ডুলিপি লেখ আমি এটা ছাপাবার ব্যবস্থা করব। সত্যি কথা বলতে কী আমি বুঝতেও পারিনি যে এই লেখার কি মূল্য। উনি বলেছেন ঠিকই। তারপরে এই মামিমা (সাধনা রায়চৌধুরী) প্রথমে ট্রটস্কাইট আর তারপরে যেহেতু আমি প্রশ্ন করি, জানতে চাই, একগাদা বই কিনে এনে বলেছেন কালকের থেকে আমি ক্লাশ নেব। উনি রোজ ক্লাস নিতেন। আমার মামিমাও বসতেন। হঠাৎ একদিন এসে বললেন যে দুটো সিনেমার টিকিট কেটে নিয়ে এসেছেন, ‘গুড আর্থ’। মামিমা বললেন তুমি ওর সঙ্গে বেরোবে না, ও পার্টির থেকে এক্সপেল হয়ে যাবে। তখন আমাকে ঋত্বিক বললেন যে তোমাকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। আমার বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম। মানে আমার মামিমাই কিন্তু আমাকে ঠেলে দিচ্ছে। তখন ওনার সঙ্গে আমার শ্বশুর বাড়িতে গেছি। উনি ক্লাস নেবেনই। ওখানে গিয়ে আমার শাশুড়ি-মার সঙ্গে আলাপ হল। ভাসুর-টাসুর সব ছিলেন। ক্লাস নিতেন, ক্লাস নেবার পর চলে আসতাম। এরকম চলত। চলতে চলতে হঠাৎ ওর বিরুদ্ধে কমিশন বসেছে। আর ২৩টা চার্জ। তো ঋত্বিক বললেন আমি তো কিছু জানি না। সেক্রেটারী উমানাথ ভট্টাচার্যকে জিগ্যেস করলেন। উনি বললেন। আমিও তো জানি না। তখন জ্যোতি বসুর কাছে গেলেন। জ্যোতি বসু বললেন যে হ্যাঁ, একটা ওয়ানম্যান কমিশন বসেছে। প্রমোদ দাশগুপ্ত। তারপরে উনি .... মামিমা করলেন কি, মামিমা এবং ওঁর বোন নিবেদিতা দাস এবং আরো যাঁরা তাঁরা চট করে নাটকটা বন্ধ করে দিলেন। জ্যোতি বসু চিঠি লিখেছেন যে নাটক বন্ধ করবেন না। সেই চিঠিটা সাপ্রেস করে দিয়েছে। তারপরে ঋত্বিক গেছেন, গিয়ে উত্তর দিয়েছেন। ২৩টা চার্জ। উত্তর দেবার পরে কমিউনিস্ট পার্টি আর কিচ্ছু বলেনি। একদম চুপ। প্রমোদ দাশগুপ্ত .... সবাই চুপ। তখন হঠাৎ দেখি বালিগঞ্জ ইউনিট আর কসবা ইউনিট, দুটো ইউনিটের মিটিং বসেছে। সেল মিটিং। সেখানে আমার মামিমা চার্জ আনলেন যে ঋত্বিক লক্ষ্মীর সর্বনাশ করে দেবে। আমি তো মানে এত্ত রেগে গেছি! সেই মুহূর্তে কিচ্ছু বললাম না। পরে বললাম ব্যক্তির থেকে তো আদর্শ বড়। কিন্তু ব্যক্তিকে নিয়ে তো আমাদের চলতে হবে। সুতরাং প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমি দেখব। করে আমি সাউথ স্কোয়াড থেকে সেন্ট্রাল স্কোয়াডে চলে গেলাম। মানে ঋত্বিকের গ্রুপে চলে গেলাম। ওরাই কিন্তু আমাকে ঠেলে দিল। আর এই চার্জটা না আনলে আমি কিন্তু কিছুই করতাম না। ওখানে গিয়ে ইন বিটুইন তিনদিনের মধ্যে ঋত্বিক 'কালচারাল ফ্রন্ট'-এর ওপরে একটা থিসিস লিখেছেন। সেটা আমার ছেলে থার্ড এডিশন বের করেছে। মীরা নায়ার কিছু টাকা দিয়েছেন।

    প্র: অন দি কালচারাল ফ্রন্ট ...

    উ: অন দি কালচারাল ফ্রন্ট, থার্ড এডিশন চলছে। এটা একটা বিস্ময়। তা আমি বললাম পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু বলেন না, আর তিনদিনের মধ্যে এই লেখা। তাহলে তো দেখতে হবে, কেন এই লোকটির ওপরে এই অবস্থা / ব্যবহার। তো ওখানে গিয়ে মমতাজ আহমেদ বলে একটি কমরেড, উনি একটা নাটক এনেছেন একটি ছেলের লেখা, সেটাকে তিনটে দৃশ্য রিরাইট করে। আর শেষ তিনটে দৃশ্য নিজে লিখে উনি ওটার নাম দিলেন 'ইস্পাত'। ইস্পাত নাটকের রিহার্সাল আরম্ভ হল। রিহার্সাল চলছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ ওই মমতাজ আহমেদরা আবার কিসব চার্জ আনল। তখন আমরা বেরিয়ে গেলাম। তখন ঋত্বিক বললেন যে তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে? আমি বললাম হ্যাঁ যাবো। তখন আমি বললাম ওই গণনাট্য সংঘ দরকার নেই, কমিউনিস্ট পার্টিরও দরকার নেই। এই গ্রুপ থিয়েটার নাম দিয়ে নাটক কর। গ্রুপ থিয়েটার কেন বললাম, উনি আমাকে প্রথমে স্তানিস্লাভস্কির গ্রুপ অ্যাকটিং কিছুদিন পড়িয়েছিলেন। তার মধ্যে 'সাঁকো' নাটক লেখা হয়ে গেল। অপূর্ব নাটক, তোমরা পড়েছ কিনা জানিনা। মহসীনকে সাগর একটা দাঙ্গায় বাঁচিয়েছিল। আর দ্বিতীয় দাঙ্গায় আর এক সাগর না বুঝে ধরিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং ওরা ক্ষমা চাইতে গিয়েছিল। কিন্তু মাকে বলতে পারেনি। কারণ মা সবসময় বলতেন 'নানান বরণ গাভীরে ভাই, নানান বরণ দুধ। ভুবন ভরিয়া দেখলাম, একই মায়ের পুত'। খুব সুন্দর নাটক, আর সংলাপ এত সুন্দর!

    প্র: শো কোথায় হয়েছিল ?

    উ: একটা তো রঙমহলে হয়েছিল, আর একটা যেন কোথায় হয়েছিল মনে পড়ছে না ঠিক। সব হয়ে গেল। হয়ে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে যখন মন স্থির হল, তখন উনি আমাকে বললেন যে আমি তোমাকে শিলং নিয়ে যাব। কারণ বাবা তোমাকে দেখুন, তুমি একমাত্র মেয়ে। খুব রোগা ছিলেন। তো ওখানে গেলেন। বাবা বললেন যে তোমার শ্বশুরমশায়কে আমি সিলেটে দেখেছি। উনি খুব সুবক্তা, সুপুরুষ এবং বিদ্বান। তারপরে আরও খোঁজখবর দিয়েছিলেন। বললেন সব ওরা (ঋত্বিকরা) যমজ ভাইবোন। ওঁর যে বোন সে স্বামী-সন্তান ফেলে চলে গেছিল। তা আমি মনে মনে বললাম যে ও স্বামী-সন্তান ফেলে চলে গেছে তো আমার কী? আরো এরকম দু-একটা কথা বললেন আমার বাবা। খোঁজ নিলেন সব। ড্রিঙ্ক করার কথা বললেন। ঋত্বিক তো ড্রিঙ্ক করেই না, তুমি যদি ড্রিঙ্ক নিয়ে ঢোক, তোমাকে আউট করে দেবে। সুতরাং সেই বিষয়েও আমি নিশ্চিন্ত। ড্রিঙ্ক করলে আমি বিয়ে করতাম না। বাবা বিয়ে দিলেন। শাশুড়ি-মা খুব আদরযত্ন করেছেন, আর খুব পছন্দ আমাকে। বলতেন নামে লক্ষ্মী, কাজে লক্ষ্মী। আর তখন ওদের পরিবারে নানারকম আর্থিক কষ্ট-টষ্ট ছিল। কিন্তু খুব আদর-যত্ন করেছেন। আশীর্বাদ করেছেন। আর বাপের বাড়িতে দিদিমা এসেছিলেন, বড়-মামা মামিমা এসেছিলেন। দিদিমাও খুব আশীর্বাদ করেছেন। উনি হলেন হাকিম-গিন্নি আর ইনি হলেন ম্যাজিস্ট্রেট-গিন্নী। আর দুজনেই বললেন টাকা-পয়সাটা বড় না, মনের শান্তিটা বড়। খুব আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর তো আমরা বম্বে চলে গেলাম।

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী ও সুরমা ঘটকের সৌজন্যে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments