• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | সাক্ষাৎকার
    Share
  • সাক্ষাৎকার—সুরমা ঘটক : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়


    প্র: আপনার মেয়েরা তো বোধহয় বম্বেতেই হয়েছেন?

    উ: হ্যাঁ, বড় মেয়ে বম্বেতে। যখনই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখনই আমি দেখলাম এতো আনকম্প্রোমাইজিং শিল্পী, কখনো কাজ থাকবে, কখনো কাজ থাকবে না। কখনো ছবি চলবে, কখনো ছবি চলবে না। সুতরাং আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। বাবা আমাকে একটা চাকরি ঠিক করে দিয়েছিলেন, সেক্রেটারিয়েটে। তখন বাবা বললেন যে তুমি এমন কিছু করতে পারবে না যাতে তোমার চাকরির ক্ষতি হয়। আমি বললাম যে না আমি সেরকম কিছু করব না। না তোমাকে লিখে দিতে হবে। আমি বললাম, লিখে আমি দেব না। সেজন্য আমার চাকরি হল না। তারপরে আমি তখন ঠিক করলাম যে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। কিন্তু আমার এক বছরের ছোট-বড় দুই মেয়ে, মা-বোন নেই। ওদের দেখতে হবে। তারপর যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। ফিফ্‌থ ইয়ার থেকে সিক্সথ ইয়ারে উঠলাম। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সময়। পরে ‘কোমলগান্ধার’ও চলল না। আমার একটা মেয়ের প্যারা-টাইফয়েড আর একটা মেয়ের জ্বর। রান্নার লোক ছুটিতে গেছে। ঘরের কাজ, মানে এত বিভ্রাট, চারটে পেপার দিয়েছি ফিফ্‌থ পেপারের দিন কী লিখব তাই ভাবছি। তখন জানলাম যে বিষ্ণুদে’র স্ত্রী, প্রণতি দে, তিনি নাকি বলেছিলেন ভালো করে পরীক্ষা না দিলে ড্রপ করাই ভালো। আমি ভয়ে ভয়ে ড্রপ করে দিলাম। ফিফ্‌থ পেপারে ফেল করলাম, ৬১-সাল। ৬২-তে ‘সুবর্ণরেখা’ মর্টগেজ দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেছে। তাহলে আরো দুর্দশা। আর ৬৩-তে ছেলের জন্ম। উনি বলতেন ‘লক্ষ্মী আমার ছেলে হলে মাথা ঠিক হয়ে যাবে’। মাথা একদম ঠিক হল! ৬৪ থেকে চোলাই মদ খেয়ে বিছানা ভাসিয়ে শোওয়া। সুতরাং আমার দুই মেয়েকে স্কুলে পাঠানো, ছেলেকে সব করা, তারপর ওনাকে পরিষ্কার করা, বিছানা পরিষ্কার করা। এই আমার জীবন। ৬৫-তে পুনার চাকরি। পুনাতে ভাইস প্রিন্সিপাল। ওনাকে বাবার থেকে টাকা আনিয়ে পাঠিয়ে আমি শিলং চলে গেলাম। শিলং-এ গিয়ে আমি আর কিছু বলতে পারব না। মানে এত শরীর খারাপ, প্রথমে হয়েছিল শিরদাঁড়ায় ব্যথা। তারপর এত ওজন কমে গেল ডিওরাবলিন ইনজেকশন নিতে হতো। আর ওখানে গিয়ে শরীরটা কাঁপত, পারকিনশনস এর মতন। আমার জ্যাঠামশাই বললেন সব ডাক্তারকে আসতে বারণ কর, আমি দেখব। তারপর জ্যাঠামশাই আমাকে ভালো করে তুললেন। উনি আমাকে অক্টোবরে নিয়ে যাবেন। অক্টোবরে এলেন, এর মাঝখানেও এসেছেন, দেখেছেন। অক্টোবরে এসে বললেন আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ ওইসব সই করা ... আমি করতে পারব না।

    প্র: সেবারেই কি খুব অসুস্থ হয়ে ফিরলেন?

    উ: হ্যাঁ। একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। দুদিন দুরাত্রি হ্যালুসিনেশন, ডিলিরিয়াম এই সমস্ত। আচ্ছা, জ্যাঠামশাই তো ভালো করলেন। আমরা শিলং এলাম। শিলং-এ আসার পরে আবার অজ্ঞান। তা ৬৩-তে আমার ভাই এসে মাইসোর নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। ৬৪-তে এসেছিল, আমি চিঠি লিখেছিলাম। ৬৫-তে আবার এল, এসে হসপিটালে ভর্তি করল। দশদিন পর ডাক্তার ছেড়ে দিল, এখন ভালো আছেন। ৬৬-৬৭ আমার ঠিক মনে নেই। ৬৮-তে আমি বিহারীলাল কলেজে বি. টি. পড়ি এবং ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করি। ৬৯-এ ডাক্তার বলায় ওনাকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করি।

    প্র: গোবরা মেন্টাল হসপিটালে ...?

    উ: হ্যাঁ। সেটা জ্যোতি বসুর কাছে গেলাম, উনি ঠিক করে দিলেন। আর হেমাঙ্গদা বললেন, তুমি একদম চিন্তা কোরো না, আমি দেখাশোনা করব।

    প্র: জ্যোতি বসু চিরকালই ঋত্বিক ঘটকের প্রতি একটু সফ্‌ট ছিলেন। তাই না ... ?

    উ: হ্যাঁ। উনিই তো বললেন তোমরা নাটকটা বন্ধ কোরো না।

    প্র: চিঠিটা তো চেপে দিল ...

    উ: হ্যাঁ, চিঠিটা চেপে দিল। তো সেখানে বৌদি (হেমাঙ্গদার স্ত্রী) দু'বেলা প্রতিদিন রান্না করে পাঠাতেন। একদিন খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন, ওঁরা ভয়ে ভয়ে এসেছেন, সেদিন ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে, বৌদি এক টুকরো ইলিশ মাছ দিয়েছেন। উনি বললেন যে আমি এক টুকরো ইলিশ মাছ খাই না, বলে খাবার ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি যখন প্লেটে করে আম কেটে দিতাম, বলতেন আমি এক বালতি আম ছাড়া খাই না। এক বালতি আম আমি কোথায় পাব? তা যাই হোক সে প্রাচুর্যের দিনে সবই ছিল।

    প্র: একটু ৪-৫ বছর পিছিয়ে যাচ্ছি, ৬০ সালে যখন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ রিলিজ করল। ওটা তো সুপারহিট ছবি ছিল তখনকার দিনে। প্রচুর দর্শক দেখেছেন, পরিবারে তার তো একটা এফেক্ট পড়েছিল নিশ্চয়?

    উ: সুপারহিট নয়। কারণ বাঙালভাষাকে তো দর্শক সেইভাবে নিতে পারে না। মোটামুটি ঠিক ছিল।

    প্র: আমি শুনেছি ঋত্বিক ঘটক নাকি একটা গাড়ি কিনেছিলেন সে সময়? একটা অস্টিন গাড়ি, কালো রঙের।

    উ: হ্যাঁ। সেকেন্ডহ্যান্ড একটা গাড়ি কিনেছিল।

    প্র: তারপরের দুটো ছবিতে তো বড় ধাক্কা ...

    উ: ‘কোমলগান্ধার’ ফ্লপ হল, ‘সুবর্ণরেখা’ রিলিজ হল না। তার মধ্যে আমি আমার কোয়ালিফিকেশনটা বাড়িয়েছি। আমার লক্ষ্য হল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সুতরাং আমি 'শিলং জেলের ডায়েরি' লিখি। এখনো জানি না ঠিক করেছি না ভুল করেছি। তারপরে ৭০-এ উনি বেরিয়ে তিনটে ছবি করলেন। একটা বিক্রি হল। আর আমার লেনিন-টা সেন্সর সার্টিফিকেট পায়নি। কিন্তু প্রোডিউসার ওটা মস্কো নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছে, টাকা-পয়সা পেয়েছে সবকিছুই হয়েছে। আর তৃতীয় যে ছবিটা সেটা অন্য প্রোডিউসার, সেই ছবিটা বিক্রি হয়নি। এই অবস্থার মধ্যে ৭০-এর শেষে আমি কালী ব্যানার্জীর স্ত্রীর কাছে গেছি।

    প্র: প্রীতি ব্যানার্জী ...

    উ: প্রীতিদি বললেন আমি তোমাকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ নিয়ে যাব, তোমার চাকরি হয়ে যাবে। তা কোনো খবর আমি পাইনি। সুভাষদার স্ত্রীর কাছে গেছি। গীতাদি বলল, তোমার ছেলে-মেয়েকে আমার স্কুলে দিয়ে দাও, আর তুমি স্যোসাল ওয়েলফেয়ারে সুধাদি’র কাছে যাও। সুধাদি তোমাকে ভ্যাকেন্সি পেলে বলবে। তা সুধাদি আমাকে ক’দিন পরে খবর দিলেন যে বীরভূম সাঁইথিয়ায় হেড-মিসট্রেস আসেন টাকার গ্রান্ট তুলতে, উনি বললেন যে একটা ভ্যাকেন্সি হতে পারে। কিন্তু আমি তখন অ্যাপ্লাই করিনি। কারণ এত দূরে তো, সেজন্য করিনি। আবার কদিন পরে খবর পাঠালেন শীগ্‌গির অ্যাপ্লাই করো, ওটা পার্মানেন্ট পোস্ট। তখন আমি অ্যাপ্লাই করলাম। তারপরে ইন্টারভিউ-এর চিঠি এল, ইন্টারভিউ দিলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এল, পার্মানেন্ট পোস্ট। হায়ার-সেকেন্ডারি স্কুল। তখন আমি মনস্থির করে চলে গেলাম ছেলেকে নিয়ে। আর দুই মেয়ে কে রেখে গেলাম, কারণ ওদের অ্যানুয়াল পরীক্ষা সামনে। তখন ওদের বাবাও কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। মানে অ্যাকচুয়ালি দুই মেয়েকে একা রেখে গেছি। আমার বোনপো (জ্যাঠতুতো দিদির) ছেলে সন্ধ্যার থেকে এসে থাকত, আর সকালে ওদের স্কুলে পাঠিয়ে বাড়িতে গিয়ে খেয়ে অফিস যেত। আর আমার মাসতুতো ভাই শনিবারে নিয়ে যেত, রোববারের রাতে ফেরত দিত। বাবাকে লিখলাম যে আপনি এসে দুই নাতনি, আর জামাইকে নিয়ে থাকুন। তা বাবা এসে এদের নিয়ে থাকল।

    প্র: গঙ্গাপ্রসাদ রোডের বাড়িতে?

    উ: হ্যাঁ, তারপরে আমি তিনমাস পরে এলাম। শীতের ছুটিতে দুই মেয়েকে নিয়ে যাব, আর ওনার একটা ব্যবস্থা করব। তখন তো দেখেই গেছি যে, মেন্টাল হসপিটালে একমাসের মধ্যেই সুস্থ হয়ে গেছিলেন। তারপর একটা নাটক লিখে, নাটকও করেছেন। তারপরে তিনটে ডকুমেন্টারি করেছেন। এর মধ্যে ছোড়দা এসে উপস্থিত, নরেশ ঘটক, উনি একটা ট্রেনিং-এ ছিলেন, জাহাজের চিফ অফিসার ছিলেন তো, ওই ট্রেনিংটা পাশ করলেই ক্যাপ্টেন হয়ে যাবেন। তো উনি ট্রেনিং ছেড়ে দিয়েছেন, চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন। আর দিনরাত্রি ড্রিংক করছেন। সঙ্গে আর দুটো চোলাইখোর, তিনজনে টং হয়ে বসে আছেন। আর ইনিও পরমানন্দে আবার আরম্ভ করেছেন। আর যখন সুস্থ অবস্থা, তখন দেবীর মতো মেয়ে (আমাকে) আর যখন ওই টং অবস্থা, তখন মাগী বেরিয়ে যা এটা আমার বাড়ি। তা আমি তখন দেখলাম যে, আমি যদি সব রেখে যাই তাহলে তো আমার সব যাবে। স্ক্রিপ্ট, রেকর্ড, বই সবকিছু অন্য জায়গায় সরিয়ে দিলাম। আমি বাড়িওলাকে একটা নোটিস দিলাম যে, বাড়ি আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। নোটিস দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি চলে গেলাম। বাবা নিজে বড়দা মনীশ ঘটক, আর সেজো ভাসুর এই দুজনকে লিখলেন যে লক্ষ্মী কাজে যোগদান করতে যাচ্ছে, তোমরা ঋত্বিককে দেখো। ব্যস এই ট্রিটমেন্টে কাজ হল। তারপর উঠে যা আরম্ভ করলেন, প্রথমে ‘দুর্বার গতি পদ্মা’। বিশ্বজিতের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ মুক্তিযুদ্ধের ওপরে। তারপরে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’, স্ক্রিপ্ট লিখে আমাকে এসে শোনালেন। শুনিয়ে বললেন যে আমি তোমাকে প্রোডিউসার করেছি, তবে তোমার একজন পার্টনার আছে। তা ছুটির সময় এসে আমি ওই পার্টনারের বাড়িতে উঠতাম। আর শ্যুটিং-এ চলে যেতাম। তার আগে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘কোমল গান্ধার’-ও আমার নামে লিখে দিয়েছিলেন। এই তিনটে ছবির রাইট দিয়েছিলেন। আবার বাংলাদেশে যোগাযোগ হল। চলে গেলেন বাংলাদেশ। মানে একবার কলকাতায় ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ আর বাংলাদেশে ‘তিতাস’। একবার এসেছেন, খুব জ্বর। তখন আমি বললাম যে সুস্থ হয়ে যাওয়াই ভাল।প প্র: এসেছেন, মানে সাঁইথিয়াতে আপনার ওখানে?

    উ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু বললেন, আমি যদি না যাই, তাহলে বলবে ঋত্বিক ঘটক ছবি শেষ করে না, বলে চলে গেলেন। তা ওরা চিকিৎসা করেছে কি না করেছে আমি জানি না। কোনো খবর নেই, কোনো কিচ্ছু নেই, তার অনেক পরে রাত দুটোর সময় মৃণাল সেন ফোন করেছেন, যে ঋত্বিকের অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে, ছেলেকে দেখতে চাইছে, তুমি শীগ্‌গিরই ছেলেকে নিয়ে এসো। আমি পরদিনই রওনা হয়ে, ... মহেন্দ্র সব করে দিয়েছে। আমি, মহেন্দ্র আর বাবু চলে গেলাম। চলে গিয়ে আমি সারাদিন হাসপাতালেই থাকতাম। আর বাবুকে নিয়ে মহেন্দ্র ঘুরত। উনি যেরকম বলতেন। যে ওখানে নিয়ে যাও, ওখানে আমার জন্ম। ওখানে নিয়ে যাও, ওখানে আমার এই। আর ছেলে-অন্ত প্রাণ। পরে সিদ্ধার্থশংকর রায় আর ইন্দিরা গান্ধী এই দুজনে মিলে হেলিকপ্টার পাঠালেন, সঙ্গে দুজন ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তার আমাকে ডেকে বললেন আপনি সঙ্গে আসবেন না, তাহলে ছেলের ইনফেকশন হয়ে যাবে। সুতরাং পরদিন শুধু আমি এলাম বাবুকে নিয়ে। ওনাকে ভর্তি করা হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজে। এদিকে হয়েছে কি আমাদের মান্টু টেস্ট হল। মান্টু টেস্টে ধরা পড়ল আমার মেয়ের ইনফেকশন হয়ে গেছে। কয়দিন গিয়ে যে সাঁইথিয়ায় ছিলেন তখন। ওর (মেয়ের) সামনে তখন হায়ার-সেকেন্ডারি পরীক্ষা।

    প্র: সংহিতাদি’র?

    উ: হ্যাঁ, সংহিতার। তখন আমি প্রত্যেকদিন মেডিক্যাল কলেজে যেতাম, গিয়ে একজন নার্সদিদি, উনি রান্না করে দিতেন, দিনের বেলাটা দেখতেন, তাকে আমি টাকা দিতাম। আর রাত্রিবেলা একজন অ্যাটেন্ডেন্ট, তাকে টাকা দিতাম। আর মাঝেমাঝে চলে যেতাম সিদ্ধার্থশংকর রায়ের কাছে। যে আপনি টাকা স্যাংশন করুন, আমরা T.R.A টেস্ট করতে চাই, ভর্তি করব। কারণ মেডিক্যাল কলেজে কোনো কেবিন নেই। তখন উত্তমকুমারও এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, শিল্পীসংসদ থেকে। আর আমার এক হাজার টাকা দিয়ে সব করলাম। সিদ্ধার্থশংকর রায় টাকা স্যাংশন করলেন, আমি নিজে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গিয়ে T.R.A চেস্ট হসপিটালে ভর্তি করলাম। ভর্তি করার পরে, ওখানে চাকরি করতেন ডা: অরুণা ব্যানার্জী। আমার দু-মাসিই ডাক্তার। উনি আমাকে ডেকে বললেন, তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি ঋত্বিকের দিকে বিশেষ নজর রাখব। তারপর আস্তে আস্তে ভাল হতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ ভালো হয়নি। তখন উনি বন্ড সই করে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে আবার বম্বে, পুনা। পুনা গিয়ে আবার ড্রিংক ইত্যাদি করে কলকাতা ফিরে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ শেষ করলেন। ‘তিতাস’ তো শেষ করেই ছিলেন। ওরা এডিটিং করে, ওখানে রিলিজ করেছিল। উনি পরে গিয়ে আবার রি-এডিটিং করেছিলেন। রিলিজ হয়েছিল, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। আমরা অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওটা এখানে রিলিজ হল না। তখন আমাকে লিখলেন যে ওই তিনটি ছবি টাকাপয়সা পেলে সম্পূর্ণ তোমার। আমি একটি পয়সাও স্পর্শ করব না। তারপরে আমি নতুন কাজ আরম্ভ করব, তাতে আমি তোমাকে রাখব না। করে ‘রামকিঙ্কর’ আরম্ভ করলেন। তার পরে তো অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। আচ্ছা এইখানে একটা কথা সেটা হল যে উনি দু-একদিন ... আমি হয়ত বললাম যে বাবা তোমার কথা চিন্তা করছেন, বাবাকে তোমার কথা কী লিখব? ‘লিখে দিও যে, হাসপাতালে আগে গেছি, বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এইবার যখন যাব তখন একটা বড় পটলের ক্ষেত দেখে পটল প্লাক করব।’ তো আমি চুপ, আমি কোনো উত্তর দিতাম না। আবার হয়ত একদিন এসে বললেন, আমি মাইকেল মধুসূদন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এদের মতো মারা যাব। আমি কোনো উত্তর দিতাম না। উনি ৬ ফেব্রুয়ারি মারা গিয়েছিলেন, ১২ জানুয়ারি সাঁইথিয়া গেছেন, খুব বিষণ্ণমুখ। বললেন, ছেলের গান শুনতে এসেছেন। তারপরে মেয়েদের কথাও জিগ্যেস করেননি, আমার দিকেও সেরকম তাকাননি। একা এলে আমার ফ্ল্যাটেই থাকতেন। আমি চল্লিশ টাকা দিয়ে ঘরভাড়া করে ওখানে আট বছর চার মাস ছিলাম। সাঁইথিয়াতে। আমরা চারজন টিচার ওইভাবে থাকতাম। দুটো করে ঘর, আর বারান্দায় রান্না। ছেলের গান শুনলেন। শুনে হোটেলে চলে গেলেন। আমি কিচ্ছু বলিনি, খুব গম্ভীর মুখ। তারপরে সকালবেলা আবার এসেছেন। এসে আবার গান শুনেছেন। একটা কালো কোট ... কালো ঠিক নয় একটা কোট পরা আর কি। লক্ষ্মী আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দাও তো। তা আমি বললাম, তুমি যে আমার কাছে টাকা চাও, আমি কি উপার্জন করি? যাইহোক আমি টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরে খুব বিষণ্ণ মুখে আস্তে আস্তে গলি দিয়ে চলে গেলেন। এটাই আমি লাস্ট দেখেছি। পরে আমি ভাবলাম যে, ওনার মন তখন প্রস্তুত এবং ছেলে অন্ত প্রাণ তো। ‘লক্ষ্মী তোমার ছেলে আমাকে পেরিয়ে যাবে’। তাই ছেলের গান শুনেছেন ... তার কিছুদিন পর ৬ই ফেব্রুয়ারি মারা গেলেন। আমার বড়ো মেয়ে ভর্তি করে ব্লাড দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করেছিল। আমি প্রথমে চিঠি পেলাম শান্তিনিকেতন থেকে যে ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি যখন ছেলেকে আনতে গেছি। তখন অধ্যক্ষ বললেন যে মহেন্দ্র এসে নিয়ে গেছে। তো ফিরে এসেছি। ফিরে এসে টেলিগ্রাম পেলাম ঋত্বিক ঘটক সিরিয়াস ইন দ্য হসপিটাল। আর বাবার চিঠি, বাবার এন্টারোটাইটিস হয়েছে। আমি তখন সত্যি কথা বলতে কী ওনার কথা বেশি চিন্তা করিনি। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেছে, এখন নিশ্চিন্ত। আর ছেলেকে মহেন্দ্র নিয়ে গেছে, বাবার কথা চিন্তা করছি। তারপরে আমার মেয়ে বাইরে গেছিল, এসেছে। এসে বেরিয়েছে তারপরে আমি রাত্তির দুটো’র সময় উঠে পড়েছি। উঠে পড়ে খালি ভাবছি যে, এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ বাবার এই খবর আসছে হাসপাতালে, অমুক-তমুক। তা সকালবেলা মৃণাল সেন খবর পাঠিয়েছেন এক্সপায়ার্ড। আমি তখন সত্যিকথা বলতে কী ঋত্বিক ঘটক-টটক সব ভুলে গেছি। আমি শুধু ভাবছি এই তিনটেকে নিয়ে আমি কী করব। আর ছেলেকে আমি কিছু করতে দেব না, আমিই সব করব। যেচে মৃণাল সেন ওঁর বাড়িতে নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে হসপিটালে।

    প্র: অনুপকুমারও সেইসময় পাশে ছিলেন।

    উ: হ্যাঁ। টেকনিসিয়ানস স্টুডিয়োতে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন গীতা ঘটক সাজিয়ে দিয়েছেন। এত সুন্দর মুখ, মানে মনেই হয় না যে প্রাণ নেই।

    প্র: বাচ্চারা সেদিন সব মহেন্দ্রদার ফ্ল্যাটে ছিল?

    উ: বাচ্চারা মানে ওই বাবু ছিল।

    প্র: বাবুদা ছিল মহেন্দ্রদার ফ্ল্যাটে ওই টালিগঞ্জে?

    উ: হ্যাঁ। আর আমাকে মৃণাল সেন শ্মশান থেকে একদম ওনার বাড়িতে নিয়ে গেছিলেন। ওখানেই আমার ভাইয়ের বউ শিবানী, আর তার দাদারা এসে বললেন আমরা শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছি। তো ওখানে গিয়ে শ্রাদ্ধের কাজ করলাম সকালে। আর বিকেলবেলা মৃণাল সেন বললেন আমিই সব ব্যবস্থা করব। তখন ওখানে সিদ্ধার্থশংকর রায়, সত্যজিৎ রায়, তারপর আর একজন খুব বড় আর্টিস্ট, নাম ভুলে গেছি, এসেছিলেন। আর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গদা, গীতা ঘটক, রেবা রায়চৌধুরী সমস্ত আই. পি. টি. এ–র ওরা গান করলেন। আর ছেলেও গান করেছিল। খুব ভালভাবে হয়েছিল।

    প্র: কোথায় হল এই অনুষ্ঠানটা? মৃণাল সেনের বাড়িতে?

    উ: মৃণাল সেনের বাড়ির ছাদে। তার কিছুদিন পরে আমার অ্যাসিস্টেন্ট হেডমিস্ট্রেস এসে বললেন এখন আপনি গিয়ে জয়েন করুন, তারপরে যখন দরকার পড়বে তখন আসবেন। তো গেলাম। তার কয়দিন পরেই কাগজে দেখলাম শ্রী বীণাফিল্মস ইনজাংশন দিয়েছে, ওরা মদ-টদ খাইয়ে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমলগান্ধার’ আরও কীসব সই করিয়ে নিয়েছিল। তারপর সিভিলকোর্ট, হাইকোর্ট। তা সিভিলকোর্টে আমাকে আসতে বলেনি। হাইকোর্টে তো আমাকে বসতেই হবে। বুদ্ধদেববাবু (ভট্টাচার্য) দুজন ব্যারিস্টার, একজন সলিসিটার ঠিক করে দিয়েছিলেন। দুজন ব্যারিস্টারের মধ্যে সোমনাথ চ্যাটার্জী বয়ানটা লিখে দিয়েছেন আর আরেকজন ব্যারিস্টার পি. কে. রায় আর সলিসিটার কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। তারপরে কেস ওঠে না, প্রতিদিন গিয়ে বসে থাকব, তারপরে আমি এখানে (কলকাতা) আসব কী করে। আর দূরে চাকরি, তাহলে কী করে কোর্টে যাব? তখন এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে পোস্ট তৈরি করে টাকী হাউস গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে আমার চাকরি হয়। ওখানে জয়েন করে, আমি কোর্টে গিয়ে বসে থাকতাম। আবার আমার হেডমিস্ট্রেস বলছেন, আপনার তো ছুটি শেষ হয়ে গেছে। এদিকে কোর্টে কেস উঠছে না, এই করতে করতে করতে একদিন কেস উঠল। সেকেন্ড হাফে, ফার্স্টহাফে শ্রী বীণাফিল্মস বসে আছে। আমরা বসে আছি। সেকেন্ড হাফে কেস উঠলো, তখন শ্রী বীণাফিল্মস অ্যাবসেন্ট। এই পয়েন্টে কেস ডিসমিস হয়ে গেল। আমার সলিসিটার, ব্যারিস্টার দুজনেই উপস্থিত ছিলেন। আমি ভাবলাম যাক বাবা বাঁচা গেল, দুটো ছবি রক্ষা হল। তারপরে মহেন্দ্র বলল যে বৌদি, আমার দুটো ফ্ল্যাট আছে, আপনি একটায় থাকবেন, অনেক অনুরোধ করে বলায় আমি এলাম। একটা বাড়ির একতলায় একটা ঘর। আরেকটা বাড়ির দোতলায় একটা ঘর। তো ওখানে আমি থেকে সকালে বাজার-টাজার করে অন্য সব কাজ করে স্কুলে চলে যেতাম। স্কুল থেকে কাজ শেষ করে ফিরতাম। তারপরে আমি গলফগ্রীনে ফ্ল্যাটের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম পাঁচ হাজার টাকা জমাও দিয়েছিলাম। কিছুতেই লটারি হয় না, তারপর অনেকদিন পর লটারি হল, আমার নাম উঠল না। তখন কী করি ভাবছি। এইসময় আমি কিছুদিন আমার মাসতুতো ভাই মনীশের বাড়িতে ছিলাম। ও স্ট্যাটিসটিক্সে ডক্টরেট করেছে। জোকাতে কাজ করত, পরে আমেরিকা চলে যায়। মনীশের একজন বন্ধু বলে দিদিকে বলো (নামটা ঠিক মনে আসছে না) ওই কমরেডকে অ্যাপ্লাই করতে। তা আমি অ্যাপ্লাই করলাম, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। তারপর আমি অন্যত্র চলে যাব, তখন চিঠি পেলাম যে এই বাড়িটা আমার নামে অ্যালটেড হয়েছে। তো আমি গলফগ্রীনে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলাম, সেটা ফিরে এসেছে ওটা দিয়ে এইটা বুক করলাম। বুক করে আমি পাঁচ বছর ভাড়া দিয়েছি। আর পাঁচবছর পরে তিনটে ইনস্টলমেন্টে টাকা দিয়ে এইটা কিনে নিয়েছি। আর এখানে একটা ঘর ছেলে করেছে; ট্রাস্টের কাজ হয়।

    একটা চিঠিতে ঋত্বিক ঘটক লিখেছিলেন আইনজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কোথাও কোন সই করবে না। আমি তখন সোজা ব্যারিস্টার সোমনাথ চ্যাটার্জীর কাছে গিয়ে, সঙ্গে ছিলেন কালী ব্যানার্জীর স্ত্রী, বলেছিলাম স্যার আমি ট্রাস্ট করতে চাই। এই কথাটা বলে আমি চলে এসেছি। আর একটা কথা বলিনি। আমার তো কিছু নেই, সব তো মহেন্দ্রর বাড়িতে। ডকুমেন্ট থেকে আরম্ভ করে সব আমি উদ্ধার করলাম, তখন সুদীপ্ত আমায় সাহায্য করেছে। আমার সঙ্গে কোর্টে গিয়েছিলেন। আমার অ্যাডভোকেট আর একজন অ্যাডভোকেটকে ঠিক করে দিয়েছিলেন। তিনি সিঁথিতে থাকতেন। তারপরে আমার দুই গার্জিয়ান বড় মামা আর মাসতুতো ভাই মনীশ। এছাড়া রামকিঙ্করের ফিনান্সিয়ার মোহন বিশ্বাস, সুদীপ্ত আর আমার ল-ইয়ার এই ছ-জন। মহেন্দ্রর কোনো অ্যাডভোকেট পর্যন্ত নেই। কথা উঠল, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’-তে কত টাকা দিয়েছেন? কোথা থেকে দিয়েছেন? টাকা শুনে না আমার ব্রেন অফ হয়ে গেছে। আমি কী বলেছি না বলেছি জানি না। আসলে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’তে প্রথমত: ও একজন প্রোডিউসার-ও না, ডিস্ট্রিবিউটর-ও না। সুতরাং এ প্রশ্ন কেউ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত: ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র সঙ্গে ওর তো কোন সংযোগ নেই। আর তখন আমারও কোন যোগ নেই। কারণটা হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আমার জন্য এত করেছেন কিন্তু আমাকে না বলে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র জন্য ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশনকে টাকা দিয়ে রাইট নিয়ে নিয়েছেন। আমি বললাম যে এটা আপনি কী করলেন! ইন্দিরা গান্ধীর ওপর ডুকমেন্টারি করছিলেন তো, ইন্দিরা গান্ধী আমাকে চিঠি লিখেছেন, দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। আমি ইন্দিরা গান্ধীকে লিখলে, উনি ব্যবস্থা করতেন। এটা আপনি কী করলেন? না এখন তো আর হবে না। এইসব বললেন, এই করে আমার রাইট চলে গেল। এটা বুদ্ধদেববাবু খুব অন্যায় করেছেন।

    প্র: এই রাইটটা তো এখন রাজ্য সরকারেরই আছে, আপনার তো নেই?

    উ:হ্যাঁ। রাজ্য সরকারের আছে। ওয়ার্ল্ড রাইট আছে কিনা আমি জানি না, বাবু সব জানে। যাইহোক আমার সঙ্গে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র কোন সম্পর্ক নেই। আর ওরা কেউ আসেনি, একমাত্র সীতা মুখার্জীকে নিয়ে এসেছিল। আর আমি থতমত খেয়ে কি বলেছি না বলেছি জানি না।

    প্র: এখন তো ঋতবানই সব দেখেন ...

    উ: হ্যাঁ। সমস্ত করেছে, মানে প্রথমত আনফিনিশড্ যে কাজগুলো সেগুলো পেসারো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখিয়ে এসেছে। আর ‘রামকিঙ্কর’ শেষ ছবি, সেটা শেষ করেছে। সেটা দেখানো হয়েছে। সাতটা বই বের করেছে।

    এখন যেটা হয়েছে আমাদের পরিবারে একটা দুর্যোগ চলল। প্রথমত: আমার ছোট মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মারা গেল। তারপরে আমার স্টোন, আবার ব্রেস্ট অপারেশন। তারপরে ডাক্তারের অনেক চেষ্টায় এখানে এসেছি। ঋতবান তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সংহিতা দেখছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, ঋতবানের সঙ্গেও পরামর্শ করে। এইভাবে চলছে। আর দুই নম্বর হল আমি আমার ফাইলে যে সমস্ত লেখা আছে সেইসব দিয়ে আরেকটা বই বার করবার চেষ্টা করব ‘স্মরণ’ নাম দিয়ে।

    প্র: আপনার 'শিলং জেলের ডায়েরি' বইটা ...

    উ: 'শিলং জেলের ডায়েরি'টা উনি (ঋত্বিক) থাকতে তো আমি লিখলাম না, তারপর ওনার মৃত্যুর একবছর পরেই এত অনুরোধ এল 'ঋত্বিক' বইটা লেখার জন্য বাধ্য হয়ে তখন লিখলাম। তারপরেই আমি শিলং জেলের ডায়েরি পাণ্ডুলিপি লিখে হেমাঙ্গদাকে দেখালাম। দেখিয়ে তারপরে বের করলাম। প্রতিভাস অত্যন্ত বাজে প্রোডাকশন হাউস, বানান ভুল, যত খারাপ হতে পারে আরকি। তারপরে আমি তখন ‘ঋত্বিক পদ্মা থেকে তিতাস’ বইটা লিখছি। অনুষ্টুপের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। যে 'ঋত্বিক' বইয়ের এই অবস্থা। তখন ওরা বলল যে, ওটা তো করতে সময় লাগবে। আমরা ‘ঋত্বিক পদ্মা থেকে তিতাস’ বইটা আগে করব। আমি তখন বললাম ‘ঋত্বিক’ বইটাও তাহলে করতে হবে। কারণ ওর যে প্রকাশক, আশা প্রকাশনী সে উঠে গেছে। কিন্তু 'ঋত্বিক' বইয়ের ডিমান্ড এখনো আছে। এখন ওরা প্রথমে ঋত্বিক পদ্মা থেকে তিতাস করল। তার পরে শিলং জেলের ডায়েরি করল। পরে 'ঋত্বিক' করল। আর ইতিমধ্যে আমি 'সুরমা নদীর দেশে' লিখেছি। কিন্তু 'সুরমা নদীর দেশে' বইটার প্রোডাকশন মোটেই ভাল করেনি। 'শিলং জেলের ডায়েরি'-ও মোটামুটি। কিন্তু এখন যে করেছেন প্রোডাকশন, অপূর্ব। যেমন 'শিলং জেলের ডায়েরি', তেমন 'সুরমা নদীর দেশে'--সবগুলিই ভালো হয়েছে।

    প্র: ‘ঋত্বিক’-এর যে নতুন এডিশন সেটাও খুব সুন্দর হয়েছে।

    উ: হ্যাঁ, খুব ভালো হয়েছে।

    প্র: আমি একটু পুরোনো কথা জিগ্যেস করি, ওই যে খাসিয়াদের গ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে আপনি ৬ মাস ছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাটা কীরকম?

    উ: ওখানে আমরা দেখতাম ওদের জীবনযাত্রাটা কীরকম। আগে ওদের জমিজমা অনেক ছিল, এখন নেই। ওরা এখন দিনমজুরি করতে যায়। ওরা বলে ত্রেইবুল্লা। কিন্তু অনেকের আবার সেই ত্রেইবুল্লা কাজটা করতে ভালো লাগে না। তখন পতিতাবৃত্তি করে। আর আরেকটা কথা অনেকেই ত্রেইবুল্লা করতে করতে আবার ওই লাইনেই চলে যাচ্ছেন। এখন কেন এরকম হচ্ছে আমরা জানি না। এখন আমার সম্বন্ধে যেটা অভিযোগ সেটা হল, প্রথম কথা বইটা তো আমি বেরই করিনি। পরে বেরোল, কেউ জানেও না। বেরোবার পরে কোন সমালোচনা বেরোয়নি। এই কয়দিন আগে আমি দুটো সমালোচনা পেয়েছি। যে জয়া মিত্রের হন্যমান’ প্রথম নয়, তার আগে ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক এই বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু ওই যে আমরা একটা দাবী করেছিলাম যে যারা অত্যন্ত ভায়োলেন্ট তাদের তেজপুরে চালান করা। সেইটা এরা বুঝতে পারেনি। এটা হল নিয়ম যে যারা অত্যন্ত ভায়োলেন্ট ওদের তেজপুরে চালান করা হবে। এবং আমরা যখন এই ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে চলে এলাম তখন ওদের চালান করা হল, দুজনকেই। এই একটা, আর পতিতাদের সম্বন্ধে আমরা বলেছিলাম, যে পারলে ওদের অন্য ওয়ার্ডে রাখা হোক। আরেকটা আমার সম্বন্ধে কিছু জানে না, যেটা আমার খুব দু:খ হয়েছে। যখন নতুন এডিশন বেরলো, তখন তো আমি দেখতে পাইনি, শয্যাশায়ী। যখন উঠে বসলাম, দেখলাম তখন খুব ভাল লাগল। তখন আমি ভাবলাম ঋতুপর্ণ ঘোষকে একটা চিঠি লিখব। যে তুমি এই দুটো বই পড়। প্রথম কথা সাপ্তাহিক রোববারে মহাশ্বেতা দেবী, ওদের মতে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। স্বামী-সন্তানকে ছেড়েছেন। আর তিনজন মহিলা, একজন মীনাক্ষী সেন, ‘পাগলবাড়ি’। ‘হন্যমান’-এর জয়া মিত্র। আর আরেকজন মেরি টেলার। আমার বই সম্বন্ধে জানেই না কিছু।

    প্র: না, আপনার বইটা এই ধরনের বিষয়ের আলোচনাতেই আনা হয় না।

    উ: হয়ত আমিই ভুল করেছি। যদি ঋত্বিক থাকতে থাকতে আমি প্রকাশ করতাম তাহলে ভালো হত। এই যে উনি বলেছিলেন তুমি পাণ্ডুলিপি লেখ, আমি ছাপাব, আমি করিনি। এটা ঠিক করেছি না ভুল করেছি আমি জানি না। হয়ত করলে ভালো হত। যাইহোক ঋতুপর্ণ ঘোষকে লিখব লিখব করে লেখা হয়নি, তারপর তো ও মারা গেল। ঋতুপর্ণ ঘোষকে লিখলে শিলং জেলের ডায়েরির ও সমালোচনা বের করত। আর সুরমা নদীর দেশে পড়েও ও কিছু করতে পারত। যাইহোক আমি গীতার কথা বিশ্বাস করি, যে ফলের দিকে তাকাবে না, তুমি কাজ করে যাও। এটাই হল আসল। আমার যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে হবে, নইলে হবে না।

    প্র: অশোক মিত্ররা একটা কাগজ বার করছেন, ‘আরেক রকম’ নাম। তাতে তোয়া বাগচী নামে একটি মেয়ে আপনার এই বইটি নিয়ে লিখেছে।

    উ: না, আমি দেখিনি।

    প্র:কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছবিটা দেখলেন তো, কেমন লাগল ?

    উ: কমলেশ্বর আমাকে আন্টি ডাকে। আমার মেয়েও দেখলাম খুব রেগে আছে। মানে স্টেটমেন্ট দিয়েছে।

    প্র: দেখেছি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া’তে বোধহয় কিছু বলেছেন ...

    উ: না, আমি এই বইয়ের এগেনস্টে কিছু বলিনি। এই বই সম্বন্ধে আমি কিছু বলিনি।

    প্র: সংহিতাদি বলেছেন।

    উ: সংহিতা বলেছে, সংহিতার ব্যাপার। আমি টিভিতে ছবি দেখেছি। আগে তো দেখিনি। দেখে প্রথম কথা হল, আমি যে স্টেটমেন্ট দেব, এখানে অনেক আর্টিস্ট কাজ করেছে, তাদের এগনেস্টে তো আমি বলতে পারি না। দ্বিতীয় কথা হল যে যাইহোক অনেক কিছুর সমাবেশ এর মধ্যে করেছে। সেটা করা এত সহজ নয়। কিন্তু ভুল হল দুটো, একটা হল ঋত্বিক ঘটক যে শেষ পর্যন্ত কাজ করেই শেষ করলেন জীবন, সেই অধ্যায়টা একদম বাদ।

    প্র: তিতাস নদীটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এইরকম একটা শট আছে। এক ২১ বছর বয়সী তরুণ, সে ঋত্বিক কম দেখেছে, চারটে দেখেছে। এবার কমলেশ্বরের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে আমাকে বলল যে, ঋত্বিক ঘটক কি তিতাস নিয়ে কোনো বই করেছিলেন? মানে ওরও মনে হয়েছে। ও জানত না। তখন ওকে বললাম তিতাস করেছেন, তারপরে ও দেখে নিল। তাতে আমার মনে হয়েছে কমলেশ্বরের ছবির শেষে ওই স্টেটমেন্টটা আছে।

    উ: আচ্ছা। তারপরে আমার ছাত্রী, আমার কলিগ আগে অনেকে আমাকে ফোন করেছে। ওদের ভাল লেগেছে, যদি কোন সমালোচনা থাকে সেটা হয়ত বলেছে। যে তোমার চরিত্রটা আরেকটু ভাল করতে পারত। এইরকম টুকটাক আর কি। আর আরেকটা কথা কমলেশ্বর যেটা করেছে যে মেন্টাল হসপিটালে ওনাকে দেখিয়েছে। প্রথম কথা মেন্টাল হসপিটালে উনি একমাসের মধ্যে ভালো হয়ে গিয়েছিলেন। তারপরে যখন ঠিক করল ওই শক্ দেবে। প্রথম শক্ দেবার পরেই রাইটার্স বিল্ডিং-এ খবর চলে গেল, তখন বিশ্বনাথ মুখার্জী না কে মিনিস্টার ছিলেন সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে ওটা স্টপ কর। তক্ষুনি স্টপ হয়ে গেল। দেওয়াই হয়নি। কিন্তু কমলেশ্বর দেখিয়েছেন যে এর মধ্যেই উনি আছেন, শক্‌ দেওয়া। এইটা আমি একদম সমর্থন করি না।

    প্র: আমি শুনেছি নাকি জ্যোতি বসু এখানেও একটু ইন্টারভেন করেছিলেন। বলেছিলেন যে এটা করার প্রয়োজন নেই।

    উ: জ্যোতি বসু এর মধ্যে ছিলেন না। উনি খালি গোবরা মেন্টাল হসপিটালে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আর আমি বললাম আমি চিকিৎসার টাকা দিতে পারব না। তখন উনি বললেন ঠিক আছে, আমি দেখছি। এই একটা পয়েন্ট, তখন কমলেশ্বর বলল যে শেষদিকটা আর যাইনি। কিন্তু আমি তো এর বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিতে পারি না।

    প্র: ছবিতে মিউজিক-টিউজিক নিয়ে এমন কাণ্ডকারখানা করেছেন কমলেশ্বর যেটা এখন যা ছবি হয় তার থেকে একেবারেই অন্যরকম এটা মানতে হবে।

    উ: অনেক কিছুর সমাবেশ করেছে। দুটো ভুল, বারবার শক্‌ দেওয়া দেখানোটা ঠিক হয়নি।

    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ সুরমা ঘটক ও রাজীব চক্রবর্তীর সৌজন্যে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments