(১)
বছর পঁয়তিরিশ আগে, আপনি যদি সন্ধে সাতটা নাগাদ হাওড়া থেকে বোম্বে মেলে (ভায়া নাগপুর) চড়ে বসেন তাহলে সকাল ছ'টা নাগাদ ঘুম ভেঙে উঠে চোখ কচলে জানলা দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন বড় বড় করে হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা স্টেশনের নামটি—চম্পা বা চাঁপা।
আরে:, এটাই তো আপনার জংশন, যেখানে গাড়ি বদলাতে হবে। কাঁধের ব্যাগটি মাথায় দিয়ে শুয়েছিলেন। এবার হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লেন। আর হুশহাশ করে পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেল ডাকগাড়ি।
বছর দুই হল আপনার চাকরি হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকে, সুদূর ছত্তিশগড়ের আদিবাসী এলাকায় নতুন পোস্টিং। এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আপনি খুলে ফেলুন আপনার বাঙালী পোশাক। ভুলে যান কলেজ স্ট্রীট, কফি হাউস, মিনার্ভা থিয়েটার বা গড়িয়ার ঠেক। নইলে স্থানীয় গাঁয়ের লোকের কাছে আপনি হয়ে যাবেন কলকাতিয়া সাহাব। এখন আপনি ভ্যাবাগঙ্গারাম বা শুধু গঙ্গারাম। আপনাকে একটি কয়লার ইঞ্জিনে টানা পাতি ছ'কামরার লোক্যাল ট্রেন ধরে যেতে হবে কোরবা ছাড়িয়ে গেওরা রোড স্টেশনে। এলাকাটিতে নতুন ওপেন কাস্ট মাইন খুলছে। বদলে যাচ্ছে গাঁয়ের জীবন। সেখানে একটি ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়িতে আপনার নতুন ব্রাঞ্চ।
আপাতত আপনার কাজ হল ছোট কাচের গ্লাসে চা খেয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে ক্রমশ: গঙ্গারাম হয়ে ওঠা, ওই যতক্ষণ চার নম্বর প্লাটফর্মে গেওরা-লোক্যাল ট্রেনটি না আসে! খিদেও পেয়েছে। তা কাঁচের বয়ামে রাখা বাসি বিস্কুট না খেয়ে গরম গরম ভাজিয়া খেয়ে নিলেই হয়। ওই তো ইঁটের উনুনে প্রমাণ সাইজ কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে।
ট্রেন এল আর মাথায় পাগড়ি, গায়ে চাদর, চেঁচিয়ে কথা বলা একগাদা দেহাতি লোকজনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে আপনিও উঠে পড়লেন এবং কায়দা করে জানলার পাশের সীটটি হাতিয়ে নিয়ে বসে পড়লেন। কয়লা পোড়ানো কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন ছুটে চলেছে। না, আপনি হুইলারের স্টল থেকে গত রাতে কেনা পুজোসংখ্যাটি বের করেননি। বরং জানলা দিয়ে শহুরে লোকের মুগ্ধ চোখে দেখছেন হাতির পালের মত নীল পাহাড়ের সারি। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে কয়লা খাদানের প্রাথমিক চেহারা।
আবার পাহাড়ের ফাঁকে হঠাৎ করে উঁকি দিচ্ছে ক্ষীণস্রোতা একটি জলধারা, হয়তো বর্ষায় নদী হয়ে ওঠে। পাহাড়ের ঢালের পাশে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে অবাক চোখে রেলগাড়ি দেখছে শীর্ণকায়া কোন কিশোরী, পাশে দিদির হাত ধরে ছোট ভাই। মাঝে মাঝে ট্রেন থামছে ছোট ছোট স্টেশনে, সুন্দর সুন্দর নাম। এই যে, এই স্টেশনের নামটা পড়ুন--মড়োয়ারাণী। প্রত্যেক স্টেশনে নেমে পড়ছে বেশ কিছু লোকজন, আর তেমনি করে লাইন বেঁধে পায়ে চলা পথ ধরে ট্রেনে উঠছে পিলপিল করে।
কিন্তু, কী বিপদ! প্রকৃতির ডাক পেটের মধ্যেও শোনা যাচ্ছে যে! সক্কাল বেলায় দু'গ্লাস গরম চা আর এক প্লেট গরম ভাজিয়া! ধম্মে সইবে? পাশের লোকটিকে ব্যাগটা দেখতে বলে আপনি দৌড়ে ঢুকলেন ল্যাভেটরিতে।
হে ভগবান! এ যে পার্কসার্কাস পাড়ার ধাঙড় বাজারের সার্বজনীন পায়খানার চেয়েও—! কারণ সাত সক্কালে ট্রেনে চড়া গাঁয়ের লোকজনের সংস্কৃতি হল ক্ষেতে যাওয়া, সম্বল একলোটা জল, তাতে শুধু নিজেকে ধোয়া যায়। আর ক্ষেতের মাটি ধোয়ার কথা কোন উজবুকে ভাববে! যাকগে, গাঁয়ের লোকজনকে গাল দিতে দিতে নাক টিপে আপনি বসে পড়ে চটপট খাল্লাস হয়ে গোপাল ভাঁড়ের গল্পের মত পুত্রপ্রাপ্তির চেয়েও বড় সুখ পেলেন। তারপর দম ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক হাসি ও টিটকারির শব্দ ভেসে এল।
কয়েক সেকন্ড লাগলো বুঝতে যে সার্বজনিক উপহাসের লক্ষ্যবস্তু আপনি স্বয়ং। হয়েছে কি---কোলকাতার ছেলে বন্ধ দরজার পেছনে জন্মদিনের পোশাকে প্রাত:কৃত্য সেরে উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু খেয়াল করেনি যে জানলায় শুধু ফ্রেমটি আছে, তাতে কোন কাচ নেই। ইতিমধ্যে পাশের লাইনে দাঁড়িয়েছে উল্টো দিকের লোক্যাল ট্রেন। তার সীট ও পাদানিতে বসা ছেলেবুড়ো-মেয়েমদ্দ ইডেনে গার্ডেনের অ্যাডামকে বিনা টিকিটে দেখতে পেয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগ করছে। এখন একটাই অপশন। মাথা নীচু করে মনে মনে আরতি মুখুজ্জের "'লজ্জা, মরে যাই একি লজ্জা!'' গুনগুন করতে করতে নিজের সীটে এসে বসে পড়া।
(২)
সব কিছুরই একটা শেষ আছে। বেলা দশটা নাগাদ আপনি পৌঁছে গেলেন এই লাইনের অন্তিম স্টেশন গেওরা রোডে। না, স্টেশনে কেউ নিতে আসেনি। স্টেশন থেকে গেওরা গ্রাম অন্তত: তিন কিলোমিটার দূর। একপাশে দুটো ক্রেন কয়লা তুলে তুলে দুটো বিশাল ডাম্পারে ভরে যাচ্ছে। গঙ্গারাম পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের পথ ধরেছেন, কাঁধে এয়ারব্যাগ। ঘন জঙ্গল। আম-জাম-যজ্ঞডুমুর, বট-অশ্বত্থ-পাকুড়। শিরীষ-বাবলা-বাঁশঝাড়। তার মাঝ দিয়ে পায়েচলা পথ বা প্যারডগরি। আর মাঝে মাঝে আল ভেঙে গরুর গাড়ির চাকার দাগে তৈরি রাস্তা, স্থানীয় ভাষায় গাড়ারাবণ। কোথাও কোথাও পথের পাশে উইয়ের ঢিপি, এত বড়! এগুলোকেই বল্মীক বলা হত? খোঁচা দিয়ে ভেঙে দিলে ভেতরে তপস্যারত কোনো রত্নাকর চোখে পড়বে! ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে জুতোর ডগা দিয়ে একটা বড় সড় ঢিপির গায়ে ঠোক্কর মারতেই ফোঁস্! কোথায় বাল্মীকি? ফণা তুলেছে একটি ডোমহি বা কেউটে। মানে মানে কেটে পড় হে! নইলে আজ আর তোমার ব্যাংকের সিন্দুকের তালা খোলা হবে না।
এবার দেখা যাচ্ছে একটা দুটো করে কাঁচা ঘরবাড়ি। মূল গাঁয়ের সীমান্ত বা সরহদ। এগুলো অন্ত্যজদের পাড়া। এখানে আদিবাসীদের মধ্যেও অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া সমাজের, যেমন মঁঝওয়ার বা বিঁঝওয়ারদের বাসস্থান। আর আছে কয়েকঘর সহিস বা ঘসিয়া, যারা চামড়ার কাজ করে, প্রধানত: ঢোল-তবলা-মাদল বানায়, কিন্তু জুতো নয়। আবার খানিকটা জঙ্গল, কিন্তু আগের মত ঘন নয়। এবার একটা বাঁক পেরোতেই জেগে উঠল একটি পাকাবাড়ি, দোতলা, কিঞ্চিৎ জরাজীর্ণ। তার গায়ে লাগা ধানের মরাই, দুজন কামিয়া মোষ সামলাচ্ছে। আর একদিকে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন একতলা দেহাতি বাড়ি। গায়ে ব্যাংকের সাইনবোর্ড। সামনে উবু হয়ে রোদ পোহাচ্ছে ম্যানেজারের ছুটি থেকে ফেরার আশায় সকাল থেকে প্রতীক্ষারত ভিন গাঁয়ের লোকজন।
এদিক-ওদিক থেকে ওঠা হাত ও মৃদু 'জয়রাম সাহাব!' সম্বোধনের মধ্যে মাথা নাড়তে নাড়তে ভ্যাবাগঙ্গারাম ভেতরে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে।
এক গেলাস জল ও এক পেয়ালা চা। ক্রমশ: কমে আসা গুনগুন শব্দের মধ্যে ও জেনে নেয় আজকে ক্যাশ ব্যালান্স কত। স্টেট ব্যাংক থেকে ক্যাশ আনতে কাউকে কোরবা পাঠাতে হবে কি না। হেড অফিস থেকে কোনো নতুন সার্কুলার বা নিদেনপক্ষে কোনো ফোন এসেছে কি না। এইভাবে বেলা গড়িয়ে যায়। ব্যাচেলর ভ্যাবাগঙ্গারামের জন্যে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে ভাত-রুটি-ডাল-তরকারি এসে যায়। এবার ও উঠবে উঠবে করছে এমন সময় একটা খ্যানখেনে চেরা আওয়াজ ওর মনের শান্তি কেড়ে নেয়।
—তঁয় হট্ যা মিঠলবরা! মোলা ম্যানেজারলা মিলে বর অন্দর জায়েকে দে বের্রা!
(তুই সরে যা, মিঠে মিথ্যুক কোথাকার! আমাকে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে হবে, ভেতরে আসতে দে, বদমাশ!)
গঙ্গারাম বিরক্ত হয়ে বকের মত গলা উঁচিয়ে ঝামেলা কিসের বোঝার চেষ্টা করল। চাপরাশিকে ধাক্কা মেরে কাউন্টারের পিছনে ঢুকে পড়েছে একটি মেয়ে। তারসপ্তক ছাড়িয়ে যাওয়া তার গলার আওয়াজ খানিকক্ষণের জন্যে আর সবার যাকে বলে একদম "বোলতী বন্দ্'' করে দিয়েছে।
—কী ব্যাপার! ক্যা হুয়া?
—সাহেব, আমার মা বিমার হয়ে বিছানা নিয়েছে প্রায় সাতদিন হল। ঘরের পয়সা শেষ। আপনার ব্যাংকে ওর টাকা জমা আছে। আজ কিছু টাকা তুলতে এসেছি তো আপনার এই 'রোঘা' চাপরাশি বলছে যে তোমার মাকে নিয়ে এস, ওর টিপসই চাই। কী অন্যায় বলুন তো?
—কিন্তু ও তো ঠিকই বলেছে। এটাই তো ব্যাংকের নিয়ম।
—মতলব?
—মতলব যাকে পয়সা দেবে ভাউচারে বা পয়সা তোলার কাগজে তার দস্তখত নেবে না? তাহলে কি করে বোঝা যাবে যে কাকে পয়সা দেয়া হল?
—বড় মুশকিল! পয়সা তো আমি নিয়ে যাচ্ছি, তাই আমার টিপসই নিলেই তো চলে। আপলোগ জবরন লফরা করতে হ্যাঁয়।
—বাজে কথা বলবে না! কিসের লফরা? অ্যাকাউন্ট তোমার মায়ের নামে, তুমি কি করে পয়সা বের করবে? যার নামে খাতা তার টিপসই ছাড়া সেই খাতা থেকে কি করে অন্যে পয়সা তুলবে?
—বাহ্ সাহাব, বাহ্! হর মাহ্ জব ম্যাঁয় পয়সা জমা করনে আতী থী তব তো নহী বোলে কি তোর দাঈকে খাতে মে ওকর আয়ে বিনা পয়সা কৈসে জমা হোহি! তখন তো দিব্বি দাঁত বের করে টাকা জমা করে নিয়েছেন। আমার টিপসইয়ে যদি মার নামে পয়সা জমা হতে পারে তা হলে পয়সা তোলা কেন যাবে না? ওইটুকু নিয়ম আমিও বুঝি।
—জমা করা আর টাকা তোলা আলাদা। বোকার মত কথা বোল না।
—কিসের আলাদা? জমা মানে টাকা আমার আঁচল থেকে বেরিয়ে ব্যাংকের সিন্দুকে ঢুকবে। আর টাকা তোলার সময় আপনাদের সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আমার আঁচলে ফেরত আসবে। লেখাপড়া জানি না, অংগুঠা ছাপ, কিন্তু এটুকু বুঝি। খামোকা ঘোরাবেন না।
—কেউ ঘোরাচ্ছে না। আমি যা বল্লাম সেটাই হল ব্যাংকের নিয়ম। তোমার মা না আসলে ওর নামে পয়সা তোলা যাবে না।
—আর মা যে সাতদিন ধরে বিছানা নিয়েছে?
—কাঁধে করে নিয়ে এস, গরুর গাড়ি করে নিয়ে এস। কিন্তু আনতে হবে।
—আচ্ছা? যাদি দু'কোশ ধরে গরুর গাড়ি করে আনতে গিয়ে আমার সাতদিনের জ্বরে ভোগা বুড়িমা মরে যায়? তাতে আপনার কিছু আসে যায় না? এই তাহলে আপনার শেষ কথা? আপনি হলেন নিয়মকানুনের পোঙ্গা পণ্ডিত।
তামাশা-দেখা ভীড়ের সামনে রাগে কাঁপতে থাকা গঙ্গারামের ভিতরে কিছু একটা ঘটে যায়। হয়ত মেয়েটির কেমনযেন চাউনি, হয়ত অসুস্থ মায়ের প্রসংগ, ঠিক যে কী ও নিজেই জানে না।
ওর গলার স্বর খাদে নামে। চাপরাশিকে জিগ্যেস করে মেয়েটার নাম কি। ওকে চেনে কি না। ওর গাঁ কতদূর...
—জী সাহাব, ওহ ঘোরাপাট গাঁও কী বুধবারিন বাঈ সতনামী। ইহাঁ লে দু'কোশ দুরিহা মা ওকর গাঁও।
গঙ্গারাম ফরমান দ্যায় যে সেকন্ড অফিসার চাপরাশিকে সঙ্গে নিয়ে বুধবারিন বাঈয়ের বাড়ি গিয়ে শয্যাশায়ী মায়ের টিপসই নিয়ে এসে ওকে ওর খাতা থেকে একশ' টাকা দিয়ে দেবে।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে ওর দিকে আবার সেই কেমনযেন চোখে তাকিয়ে চলে যায়।
ইতিমধ্যে সূর্য ঢলে পড়েছে। চাপরাশি এসে খবর দিল যে মকানমালিক প্রাক্তন জমিদার দাদুসাহাব চা খেতে ডাকছেন।
একটু পরে দাদুসাহেবের বৈঠকখানায় চা আর চিঁড়েভাজা খেতে খেতে ও মেতে ওঠে খোশগল্পে। উঠে আসবে এমন সময় দাদুসাহেব বল্লেন—আরে ভাল কথা, সন্ধের পর কোথাও বেরোবেন না যেন! আজকে ব্যাংকের সামনে খোলা জায়গায় বাঁধানো চাতালে পঞ্চায়েতের বিচারসভা আছে। আপনিও আসুন।
—বিচারসভা? কিসের বিচার? ঝগড়া-ফ্যাসাদ? মারপিট?
—আরে না না, গাঁয়ে শান্তি বজায় আছে। আসলে একটি বিধবা মেয়ে, স্বভাবটা খারাপ। ইধার-উধার ডোরে ডালনে কী আদত। জোয়ানদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের কাছে শিকায়ত এসেছে। জাতধর্ম বলে কিছু থাকলো না। রাত্তির সাতটা নাগাদ খেয়েদেয়ে আসুন। নিজের চোখেই নজারা দেখতে পাবেন।
(৩)
শীতের অন্ধকার একটু তাড়াতাড়িই নামে। বাঁধানো চাতালের চারপাশে একটু একটু করে ভীড় জমতে শুরু করেছে। ব্যাংক ম্যানেজার গঙ্গারামের অবসার্ভর স্ট্যাটাস, তাই চাতালের একটু পিছনে বারান্দার একটি থামের পাশে চেয়ারে বসে উসখুস করছে। ভীড়ের মধ্যে একটি অঘোষিত শৃংখলা আছে। পুরুষেরা একদিকে, মেয়েরা একদিকে। মেয়েদের দলটি অপেক্ষাকৃত হালকা।
বয়স্কদের হাতে হাতে ঘুরছে হুঁকো আর অন্ধকারে এখানে ওখানে জ্বলে উঠছে বিড়ির আগুন, জোনাকিপোকার মত। জনাকয় পঞ্চ এসে চাতালের দুপাশে বসেছেন। কথাবার্তা চলছে মৃদুস্বরে। মেয়েদের দলের গুনগুন স্পষ্ট নয়। চৌকিদার এসে দুপাশে দুটো হ্যাজাকবাতি রেখে গেল।
একজন বুড়ো খোঁজ নিলেন—"গুণাইত (গাঁয়ের প্যাটেল) হাবে কা? যা, দাদুসাব লা বুলাকে লে আ। সব্বোজন আ গয়ে।''
(সবাই এসে গেছে, প্যাটেল যাও, দাদুসাবকে ডেকে আন।)
খাকি হাফ শার্ট আর ধুতি পরা সামারু প্যাটেল গিয়ে ভেতর থেকে একটা পুরোনো কাঠের চেয়ার নিয়ে এল। একটু পরে সবাই উঠে দাঁড়াল। সমবেত কন্ঠে শোনা গেল—জয়রাম হো দাদুসাহাব, প্যার পরথন মালিক!
দাদুসাহেব বসে পরিচিতদের কুশল-মঙ্গল জিগ্যেস করলেন। কে কে আসতে পারেনি জেনে নিলেন। ইশারায় ঘরের ভেতর থেকে ওনার রাউত (ঘরের চাকর, সাধারণত: জাতে গোয়ালা, লেখে যাদব) এসে সবাইকে গুড়ের চা দিয়ে গেল। ইদানীং ধানের কি দর চলছে? তিলহন-দলহন বোনা (তিসি-ডাল) হয়েছে কি না—এইসব নিয়ে কথাবার্তা কিছুক্ষণ চলল। এবার দাদুসাব গলা খাঁকারি দিতেই একদম সন্নাটা!
গৌরচন্দ্রিকা করে উনি যা বল্লেন তার মর্মার্থ হল—আজ সাততাড়াতাড়ি এই বৈঠক ডাকার উদ্দেশ্য হল একটি নালিশের ফয়সালা করা। আমাদের সমাজে নারীদের সম্মান সর্বোপরি। কিন্তু আজকাল কিছু বেয়াড়াপনা বেড়ে যাচ্ছে। এখন গাঁয়ের সিয়ান (বয়োবৃদ্ধরা) যদি কড়া হাতে লাগাম ও চাবুক না ধরেন তাহলে সমাজের গাড়ি রাস্তা ছেড়ে নালায় নেমে পড়বে। কাজেই—উপসরপঞ্চ ঈশ্বরদত্ত তিওয়ারি নালিশের সার কথাটি সংক্ষেপে আপনাদের জানাবেন।
আগের বুড়োটি বিড়ির আগুন নিভিয়ে থুতু ফেলে শুরু করলেন,—পঞ্চ-পরমেশ্বরকে নমস্কার! নালিশ করেছে আমাদের গেবরা গাঁয়ের কিরানা শেঠ (মুদিখানার মালিক) ভাগবত আগরওয়ালের ছেলে বিনোদ। অপরাধী ঘোরাপাট গাঁয়ের বুধবারিন বাঈ। দুজনেই হাজির?
কোতোয়ার (কোতোয়াল) জানাল—দুজনেই এসেছে।
—বিনোদ! বাতাও—কা হৈসে? পুরা পুরা বাতাও গ'।
পরনে শার্ট-পাজামা, গায়ে একটি আলোয়ান—বছর বিশ-বাইশের বিনোদ আগরওয়াল উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে শুরু করে—শনিবারের বিকেল, তখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। আমি সাইকেল নিয়ে কোরবা যাব বলে বেরিয়েছি। ওখান থেকে দোকানের জন্যে মাল বুক করে পেমেন্ট করতে বাবা বলে দিয়েছিলেন। সবে গাঁয়ের সরহদ পেরিয়ে নয়া-বরপালীর ভাটা পেরিয়েছি কি দেখি বড় একটা কোসম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের বুধবারিন বাঈ। মাঝে মাঝে আমাদের দোকানে চাল-গম সাফ করতে আসে, তাই ভিন গাঁয়ের হলেও ওকে চিনি। রকম-সকম দেখে মনে হল দাল-মেঁ-কুছ-কালা-হ্যায়। ছটফট করছে, অস্থির অস্থির। যেন কারো অপেক্ষা করছে। আমিও বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম কি হয়।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কোলিয়ারির দিক থেকে সাইকেলে হাজির হলে আমাদের দুই মাস্টার,—পটোয়া গুরুজি আর মিশ্রগুরুজি।
তারপর কি আর বলব? এমন বেলেল্লাপনা সবার সামনে মুখে আনতে পারি না। শুরু হয়ে গেল তিনজনের রাসলীলা। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যখন হুঁশ ফিরল তখন ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওদের ওপর। দু'ঘা দিতেই দুই গুরুজি সাইকেলে চড়ে হাওয়া। আর এই বাঈ বলল,—তোর প্যার পরথন শেঠ! কোনো লা ঝন বাতাবে, তহুঁ লে লে। পর চুপ ঝা!
(তোর পায়ে পড়ি শেঠ! কাউকে বলিস না। তুই ও নিবি তো নে, কিন্তু চেপে যাস্ রে!)
আমি বল্লাম—কাকে কী বলছিস্! তোর সাহস তো কম নয়? আমি রোজ হনুমান-চালিশা পাঠ করে দোকানে বসি আর—''
ব্যস্, হঠাৎ যেন দীপাবলীর রাতে কালীপটকার লড়ি একসঙ্গে চড়বড় চড়বড় করে ফাটতে লাগল। কারণ আর কিছুই নয়—একটি মেয়ে। একটু দূরে ধানের মরাইয়ের বেড়ার পাশ থেকে আলকেউটের ফোঁস করার মত করে দাঁড়িয়ে উঠেছে একটি মেয়ে। অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু গলার স্বরে ঠাহর হয় বয়েস তিরিশের নীচেই হবে। গলার চেরা আওয়াজে যেন কালীপটকার তীক্ষ্ণতা।
—ঝুট ঝন্ বোলবে শেঠ! ম্যঁয় তোলা বিনতি করে হন? কি তঁয় মোলা?
(মিথ্যে কথা বলিস না শেঠজী! আমি তোকে অনুরোধ করেছি? নাকি তুই আমাকে?)
আচমকা কেউটের ছোবলে ঘায়ল শেঠ মাটিতে গড়াগড়ি খায়। পঞ্চপরমেশ্বরও ঘায়েল! কারণ মেয়েমদ্দর সংযুক্ত বৈঠকে মেয়েদের চুপ করে থাকাই প্রথা। কথা বলতে বল্লে তবে কেউ বলে। আর এমন গলা চড়িয়ে বলা? মেয়েটার নিঘ্ঘাৎ মাথা খারাপ!
শেঠ আত্মপক্ষ সমর্থনে মরীয়া চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথম হাফে আচমকা গোল খাবার পর ওর গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর হারিয়ে গেছে। মওকা পেয়ে মেয়েটির হামলা একেবারে পেনাল্টি বক্সের ভেতরে!
—তোর নানহি লইকার সর মা হাত রাখকে বোল শেঠ! কে সত্যি কে মিথ্যে ফয়সালা হয়ে যাক।
এবার জনতা উত্তেজনায় টানটান। বড় বড় সিয়ান (প্রবীণ)-দের বাক্যি হরে গিয়েছে।
তেঁতুলগাছের নীচে বসে থাকা মেয়েদের ছোট দলটির অনেকে কিচিরমিচির করে কথা বলতে শুরু করেছে, স্বর নীচু গ্রামে। কেউ কেউ ছোট বাচ্চার মাথায় হাত রেখে দিব্যি গেলার বিরোধিতা করে।
—এসবের মধ্যে আবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে টানাটানি কেন? আমরাও লইকা-নোনি নিয়ে ঘর করি। যদি পাপ হয়? যদি বাচ্চাটার কিছু অসুখ-বিসুখ হয়ে যায়?
উৎকন্ঠায় লোকের চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।
এবার গর্জে ওঠেন দাদুসাহেব (খোকাসাহেব)।
—চুপ্! সবাই চুপ কর। এ কি পঞ্চায়েতের বৈঠক না কি মছলী বাজার! আর বুধবারিন বাঈ! তোমার এত সাহস? বড়দের সামনে বিনা অনুমতি মুখ খোল কি করে? আমি যাকে জিগ্যেস করব শুধু সে বলবে।
—শেঠ! কটার সময় তুমি গাঁয়ের সরহদে বুধবারিন বাঈকে দেখতে পাও?
—পাঁচটা বেজে গিয়েছিল।
—কি করে জানলে?
—আমার কোরবা শহরে রেলপুল পেরিয়ে মাল কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। বাবুজী পাঁচটা নাগাদ এসে গদিতে বসলেন, তখন আমি বেরুলাম। তাই মনে আছে। বুধবারিন কিছু একটা বলার জন্যে ছটফট করে। কিন্তু দাদু সাহেবের ধমকে চুপ মেরে যায়।
—পটেওয়া আর মিশ্র গুরুজি হাজির হয়েছে?
—না ঠাকুরসাহাব! আমি ওদের ঘরে ডাকতে গিয়েছিলাম, কিন্তু দরজায় তালা বন্ধ। হয়তো আজ বিলাসপুর গেছে।
—হুঁ:, মনে হয় পালিয়েছে। কিন্তু কদ্দিন আর গা ঢাকা দিয়ে থাকবে? এবার বুধবারিন তুই বল্—কি হয়েছিল?
মেয়েটি এবার সংযত নীচু স্বরে কেমন একটা সিং-সঙ্ ভয়েসে একটানা বলে যায়।
—শেঠোয়া ঝুট বলচে দাদুসাহেব! ওর আগে দুই গুরুজি পৌঁছেছিল। আমার সঙ্গে আগে কোনো কথা হয়নি। আমাকে ভর সন্ধেবেলা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে এল। পাটোয়া গুরুজি দাঁত বের করে বললো—কেইসে ও? দেবে কা?
—আমি বল্লাম,মর্ রোঘা! তোর আঁখি ফুট গয়ে কা?
(মর্ ব্যাটা যমের অরুচি! চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি?)
এবার মেয়েদের দল থেকে একটা চাপা হাসির খিলখিলানি সভার মধ্যে ছড়িয়ে যেতে থাকে। পুরুষেরা বেশ অস্বস্তি বোধ করে। শুধু গঙ্গারাম ব্যাংকে এসে ঝগড়া করে ওর ইজ্জত পাংচার করে দেয়া মেয়েটিকে চিনতে পেরে ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে যায়।
একজন সিনিয়র পঞ্চ বলে—তোলা ইঁহা কহানী শুনায়ে বর নহীঁ বুলায়ে। জলদি কাম কী বাত মেঁ আ!
(এখানে তোর গপ্পো শুনতে কেউ আসেনি। কাজের কথায় আয়।)
—কা বলহুঁ মালিকমন! ওকর বাদ যো হোনা থা হো গিয়া! আমার মিশ্রগুরুজির বিরুদ্ধে কোন শিকায়েত নেই। কারণ উনি ব্রাহ্মণ দেবতা, আমি ওনাকে যা দিয়েছি তা স্বেচ্ছায় দিয়েছি। আমার কোন পছতাওয়া নেই। কিন্তু পটওয়া গুরুজি বড্ড জংলি! আমার সঙ্গে জবরদস্তি করেছে, পিঠ ছিঁড়ে দিয়েছে। ওলা সাজা মিলনা চাহি।
এবার দাদুসাহেব গলা খাদে নামিয়ে কেটে কেটে জিগ্যেস করলেন,
—ছোটা শেঠ কখন পৌঁছেছিলো?
—সব চুকেবুকে গেলে; ওকে দেখেই তো গুরুজীরা সাইকেলে চেপে পালিয়ে গেল।
—তারপর?
—তারপর বিনোদ শেঠ মিচকি হেসে বললো—আমিই বা বাদ যাই কেন? আমি বল্লাম—আরেক দিন। আজ আমার ভাল লাগছে না। পটোয়াগুরুজির নখে পিঠ জ্বালা করছে, গায়ে ব্যথা। তো শেঠ মানতেই চাইছিল না। বলছিল আগাম দেয়া টাকা ফেরত দে, নইলে পঞ্চায়তে নালিশ করব। অব্ অত্তি হো গইস্। হমোমন কহ দিন—যা, করগে যা, ভড়ুয়া! তো আকে ঝুটমুট নালিশ করিস্।
এবার অন্য পঞ্চেরা বল্লেন—ঢের হয়েছে, এবার বসে পড় বুধবারিন বাঈ!
চারদিকে মাছির মত ভনভন শুরু হয়ে গেল।
—বিনোদ শেঠ ! উঠে দাঁড়াও, তুইও উঠে দাঁড়া বুধবারিন। আমি পঞ্চায়েতের ফয়সালা শোনাচ্ছি।
দুই গুরুজি মাস্টারদের নাম ডুবিয়েছে, আমাদের বাচ্চারা শিখবে কী? রেণ্ডিবাজি? আইয়াশী? দুজনকেই জরিমানার ১০০ টাকা করে পঞ্চায়েতকে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার এইসব হলে গাঁ ছেড়ে যেতে হবে। আর বুধবারিন ব্রাহ্মণকে মাপ করে দিয়েছে। কিন্তু পটোয়া গুরুজি জোরজবরদস্তি করেছে। কাজেই পটোয়া গুরুজি বুধবারিন বাঈকে একটি লাল লুগরা (দেহাতি মহিলাদের লাল রঙা খাটো শাড়ি) কিনে দেবে। আর শেঠের ব্যাটা, তুমিও তো কম যাও না! এক মওকা দিচ্ছি,—এবার ২০০ টাকা জরিমানা দাও আর বুধবারিনকে একটি লাল লুগরা কিনে দাও।
এবার বুধবারিন—যদি গাঁ থেকে বার না হতে চাও তো একটু ঠিকঠাক থেকো, আমরা এ গাঁয়ে কোন বেচাল বরদাস্ত করব না। তঁয় এদারে গাঁও কে মন্দির কে জমিন মাঁ সাতদিন বেগারি দেবে।
(তুই গাঁয়ের মন্দিরের দেবোত্তর জমিতে সাতদিন বিনেপয়সায় জন খাটবি।)
সভা শেষ। ভীড় দ্রুত হালকা হয়ে যে যার ঘরের পথ ধরেছে। হালকা কুয়াশার ভাব। গঙ্গারাম উঠে শুতে যায়। ঘুম আসে না। ট্রানজিস্টর চালায়, একটু লো ভল্যুমে। রায়পুর স্টেশন থেকে বাজতে থাকে লোকগীত—"তঁয় একেলা যাবে, হংসা মোর, একেলা যাবে। যায়ে কে বেলা রে, একেলা যাবে।''
(তুই একলা যাবি রে, তুই একলা যাবি। যাবার সময় ওরে তুই, একলা যাবি।
ও আমার হংসরূপী আত্মা, তুই একলা যাবি।)