থোড় বড়ি খাড়া---কল্যাণী দত্ত; (পূর্ণেন্দু পত্রী চিত্রিত); থীমা প্রকাশনা, কলকাতা-২৬, প্রথম প্রকাশ ১৯৮২, পঞ্চম মুদ্রণ ২০১১। ISBN 978-81-86017-85-2
না, এ’বই আমি পড়ে শেষ করতে পারিনি।
পারব কী করে,এতবার যদি দু’চোখ জলে ভরে আসে, গলার কাছে কান্না দলা হয়ে জমে ওঠে? এ’বই পড়তে পড়তে বয়স কমে যায় চারদশক, চলে যাই উত্তর-মধ্য কলকাতার ১৯৬০-৭০-দশকের যৌথপরিবারের আবহে—মা-ঠাকুমা-দিদিমারা ভিড় করে আসেন গোলোক হতে—আধ-শ’ জনের দৈনিক আহারের দেড়মনি ভাতহাঁড়ি বাঁধাউনুনে চড়ে ভোর হতে-না-হতেই.......নামী সমাজ-ঐতিহাসিক জুডিথ ফ্লেন্ডার্সের ই-বই ‘দ ভিক্টোরিয়ান হাউজ’ পড়া শেষ করলুম গতমাসেই। বিক্কিরির খতিয়ানে বইটি হামেশাই আমাজনের লিস্টির টপের দিকে থাকে। আমাদের কল্যাণীদির এ’মহাগ্রন্থ মানে জুডিথের থেকে চার আনা এগিয়ে থাকবে (জুডিথ দশে আট পেলে দিদি দশ ছাড়িয়ে....), আর সে-বই-ই কিনা পড়লুম এই বুড়ো বয়সে এসে?
কোনো কোনো লেখককে পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়, তাঁদের প্রচার-খ্যাতি-যশোপ্রাপ্তির সঙ্গে ভাগ্যের যেন এক অমোঘ বিরোধ ছিল, অন্ততঃ তাঁদের জীবদ্দশাতে। কাফকার লেখার প্রায় পুরোটাই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রয়াণের উপান্তে। এই যে আজ আমরা ‘পরবাস’-এর পাতায় দিবাকর ভট্টাচার্য পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি, জীবৎকালে তো কৈ তাঁর নামও শোনা যায়নি? শরদিন্দুও যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, আজকের প্রচারের সিকিও পাননি।
কল্যাণী দত্ত (১৯২৭-২০০৩)কে প্রথম পড়া ‘পরবাস-৫৪’ (জুলাই ২০১৩), তাঁর প্রয়াণেরও এক দশক পরে---কলকাতার বইমেলায় ‘থীমা’-র স্টল থেকে কী-ভাগ্যি আবিষ্কার! বাঙলার অন্তঃপুরিকাদের ইতিহাসে রাসসুন্দরী দেবী-ফৈজুন্নেসা পড়া ছিল, আর কল্যাণীদিকে পড়তে এতো দেরি? নিজগণ্ডে ঠাস্ করে এক.....
কল্যাণী দত্তের সমবয়সী নাতালিয়া ডেভিস বা লিরয় লাদুরির নামই মাত্র শোনা আছে, পড়িনি। এঁরা বিশ্বের নামিদামি সমাজ-ঐতিহাসিক বলে মান্য। কল্যাণী দত্ত কিন্তু আদতে ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, এই ইতিহাসচর্চা তাঁর এসেছে অতি অনায়াসে, আশৈশব চারপাশের দেখা-শোনাগুলোকে পঞ্জীভূত করে। তুলসী চক্রবর্তীর স্মৃতিতর্পণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই বলে, যে ওনার পুঁথিগত শিক্ষা ছিলনা বটে তবে যেটা ছিল তা হল চারপাশটাকে দেখবার অসাধারণ ক্ষমতা এবং তা আত্তীকরণের, যা তাঁকে এক বিশ্বমানের কমেডিয়ানের দর্জা দিয়েছিল। কল্যাণী দত্তের ইতিহাসচর্চা সম্বন্ধে প্রায় এটাই বলা চলে।
কোন্ জিনিসটা বইটিকে দশে এগারো দেয়? তা কি এই নিবন্ধকার নিজে হুগলি/ওত্তর কলকাত্তাইয়া বলে, নাকি শুধু এর বিষয়-নির্বাচনে? না, তার অনেক ওপরে ঠাঁই পাবে লেখিকার এক্কেবারে মৌলিক স্টাইল এবং অসাধারণ পড়াশুনার রেঞ্জ! বাঙলার কৃত্তিবাস-বঙ্কিম-রামেন্দ্রসুন্দর তো অনায়াসে আসেনই, রবার্ট লুই স্টিভেনসন থেকে ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’-র পর্যন্ত কী অবলীলায় সুপ্রযুক্তি! এই ঠিক ঠিক স্থানে ও সময়ে ঠিক ঠিক বিষয়টির উপস্থাপনই কোনো লেখার মান বাড়িয়ে দেয়। ইন্সডকের গ্রন্থাগারিক বন্ধুবর ইরফান আলমের সঙ্গে কিছুদিন পূর্বে ‘ডিজিটাল লাইব্রেরি’ নিয়ে কথা হচ্ছিলঃ এই সঠিক স্থানে স্থানে সুপ্রযুক্ত রেফারেন্সকে কী করে ডিজিটাইজ করা যায়—সেটা একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। এই নিরিখে লেখিকা এক আশ্চর্য উদাহরণ!
অধ্যায় ধরে ধরে গল্প শোনাতে গেলে তো শেষ হবে না, আর কী কী সব অধ্যায়, কোন্ পর্যন্ত তার পৌঁছ্! ইতিহাসের লক্ষ্যই তো হল পুরাতনকে হারিয়ে না যেতে দেওয়া। দিদি না লিখে রাখলে হারিয়ে যেতো না ভাঁড়ার ঘরের ‘অরুচির জারকনেবু’, ‘পোয়াতির ঝালমরিচ’, ‘খোকার কোমরের ঘুনশি’ বা ‘ঘেঁচি কড়ি’? সূচিপত্রের দিকে তাকান একবারঃ ‘ভেতরবাড়ি’, ‘মাছ’, ‘তত্ত্বকথা', ‘গয়নাগাঁটি’, ‘মেয়েমহল’---এমন আরও। শ্রেষ্ঠ অধ্যায় কোন্টি, ‘দোয়াতকলম’ না ‘খাঁচার পাখি’---ভাবতে বসতে হবে। আর সারা বই জুড়ে ছড়িয়ে আছে ওনার অসাধারণ রসবোধঃ যেমন, কোনো বঞ্চিতাবিধবার মনের-মানুষ দেখে মন-উচাটনের প্রতি ঠেস্ দিয়ে তার সই এক ছড়া বাঁধে। শুনিয়েছেন দিদি এখানে সেই ছড়াটি। চমৎকার! শেষে তাঁর সংযোজন, ‘সেই ঘোষাল কিংবা দিদিমণি কিংবা তাঁর শোলোক-বলা সই কেউই আজ আর বেঁচে নেই। কেবল ছড়াখানিই বাঁধানো ছবির মতো মনের পেরেকে টাঙানো রয়ে গেছে!’ অপূর্ব!
বড় কোমল, দুখী স্থানেও আভিজাত্যিক ভদ্রতাবোধ ক্ষুণ্ণ হয়নি। নারীর অগ্রগতি রুদ্ধ করার অপপ্রয়াস তো চলেইছিল, নিজের বড়দি অনন্যা প্রতিভাশালিনী মুরলা বসুর (বইটি এঁকেই উৎসর্গীকৃত) কঠিন জীবনসংগ্রামের কথা শুনিয়ে লেখেন, ‘অথচ এনারা সফল হলে কারও কোনো ক্ষতি ছিল না’। পড়তে পড়তে অবশ্যম্ভাবীভাবে বেগম রোকেয়ার কথা মনে পড়ে। ধর্মের নামটা আলাদা হলেও লড়াইটা ছিল একই।
মেয়েমহলের কথা সে-মহলেরই একজন ভালো শোনাতে পারেন, এতো স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে শুধু ভালো পানসাজা বা কুরুশের কাজ জানাই নয়, আরও কত সুপ্ত প্রতিভা যে হারিয়ে গেছে! যেমন, বিয়ের ছড়া। তত্ত্বতাবাশ-উপহারের ডালিতেও দু-লাইন ছন্দে লেখার চল ছিল। পাশের বাড়ির সেজোমেয়ে রেখার বিয়ে। সপরিবার নেমন্তন্নে যেতে হবে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতামহের হুকুম হল কনিষ্ঠার প্রতি, ‘তোমার বড় বৌদিদিকে বল, চট করে বাক্সের ওপর দু’ছত্তর লিখে দেবেন’:
“প্রীতি-উপহার এনে দিতে চাই,পাত্রের নাম গঙ্গাপ্রসাদ বটে। শ্বশুরের চোখে তারিফ! আজ এই সেলফির যুগে সে তারিফ আর করে কে? হারিয়ে গেছে সে-সব! প্রবীণ লেখক যম দত্তের ডায়েরি (যতীন্দ্রমোহন দত্ত)-র কথা আমরা পরবাস-৫৭তে পড়েছিলাম। কল্যাণীদির লেখায় তাঁর বহু সুপ্রযুক্ত উল্লেখ। যেমন, সেকালের যৌথ-পরিবারের বাড়ি ছিল দাসদাসী বিনা সম্পূর্ণ অচল। দিদি লেখেন, “তাদের আজীবন সেবার বিনিময়ে কী দিয়েছি আমরা? বছরে দুটো করে কাপড়-গামছা, পান-দোক্তা আর হাতেপায়ে হাজা ছাড়া আর কিছু নয়...শ্রাদ্ধকল্পে আছে, পিতৃপুরুষের পিণ্ডদানেরও আগে যাদের নামগোত্র জানা নেই, সেই সব দাসেদেরও পিণ্ডদান করতে হয়ঃ জন্মান্তরে যে মম দাসভূতাঃ তেষাং কৃতে পিণ্ডমহং দদামি”......এ’কথা শুনিয়ে এ’কালের মানুষের হাসির খোরাকই যথেষ্ট জোগালুম। কিন্তু কেমন করে এত ওলটপালট হল, কিছুতেই আর জীবনে জীবন যোগকরা গেল না।"
কী যে দেব শুধু ভাবনা ।
গঙ্গার তটে দেখা হল যবে
রেখা নামে এক ললনা।।”
এ’খানটাতে তো, মা, চোখের জল আর ধরে রাখা গেল না।
এ’তাই গ্রন্থ-সমালোচনা নয়, অপটু হাতের তর্পণ।
পূর্ণেন্দু পত্রীকৃত ছবির মান অসাধারণ, তবু যেন লেখার জ্যোতিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
সুন্দরবন সমগ্র---শিবশঙ্কর মিত্র। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম মুদ্রণঃ ডিসে ১৯৮৮; ISBN 81-7066-139-0
এমনটা সেকালে হতো।
১৯৬০-৭০-এর দশকের কলকাতার গানের জলসার কথা বলছি। প্রিয় শিল্পী, সে প্রতিমা-শ্যামল যে-ই হোন্, তাঁর কাছে পছন্দের গানের চিরকুটখানি পাঠানো। এখন ধাঁচটা বদলেছে। এফ.এম.-এর অনুষ্ঠানে এসেমেস আসে। যেমন বর্তমান ফরমায়েসটি এসেছে ‘পরবাস’-এর এক পাঠকের কাছ থেকে ই-পত্রেঃ---এ’নিবন্ধকার যেন ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’-র কলমে এক শিকারকাহিনির গপ্প শোনান।
তথাস্তুঃ। কিন্তু চাল-কলাবাঁধা ভটচাজ্জি ও বাঘ-শিকার? রামঃ। তবু শোনাইঃ
আমাদের ক্লাস থিরি-ফোরে বাঙলা পাঠ্য ছিল এক অসাধারণ সংকলনঃ ‘কিশলয়’ (এখনও আছে কিনা জানিনা)। সেখানেই প্রথম পড়া---সুন্দরবনে নৌকোয় চলেছে কলিমভাই, একহাতে হুঁকো ও পা দিয়ে আলগোছে হালখানি ঠেক্নো দেওয়া--গল্পের শেষ লাইনঃ “বুঝলে, বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না”। সঙ্গে সাদাকালোয় অসাধারণ ছবি। সোঁদরবনের কাহানি সেই থেকে শিশুমনে প্রোথিত। তখন থেকেই বাঘশিকারের কথা উঠলেই প্রণম্য জিম করবেট বা এন্ডারসন সাহেবের আগে আর্জান সর্দারের নামই মনে আসে।
এর বহুবচ্ছর পরে কলেজপাঠ তখন শেষ, এক বিকেলে গেছি গোর্কিসদন। শীর্ণকায় বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক মশায় চাওয়া-বইটি পেড়ে দিলেন। বাসে ফিরতে ফিরতে বান্ধবী বললো, “জানিস্, উনি কিন্তু মস্ত বাঘশিকারি। শিবশঙ্কর মিত্র!” “কী? কী নাম বললি?” আমি শিহরিত! পারলে তখনই বাস থেকে নেমে পড়ি। আর্জান সর্দারের অমর স্রষ্টাকে প্রণাম করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম!
না, এ’ ধান ভানতে শিবের গীত নয়। শিবের মতই মানুষ ছিলেন শিবশঙ্কর। জাত কম্যুনিস্ট। বহুবার জেল খেটেছেন। অতি সরল জীবনযাত্রা। আর তাঁর স্বপ্নের রাজ্য ছিল সুন্দরবন এবং সাথী শ্রীমান আর্জান সর্দার। তাঁর নিজেরই ভাষায়, “কত যে ঘুরেছি তাঁর সঙ্গে....এই ছোটখাট শান্ত দুর্জয় মানুষটিকে চিনবার চেষ্টা করেছি বছরের পর বছর ধরে...” কুরোসাওয়ার অমরচিত্রে কাপিতেন আর্সেনিভের কাছে যেভাবে সাইবেরিয়ার অরণ্যপ্রান্তর মূর্ত হয়ে ওঠে দেরসুর মধ্য দিয়ে, লবটুলিয়ায় যাঁর নাম রাজু পাঁড়ে, এ’গ্রন্থের পাতায় পাতায় আর্জান নামে তিনি ছেয়ে আছেন।
দোহাই, ফের ঘাট মানি, আমার এ’ তুচ্ছ নিবন্ধকে যেন ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ না বলা হয়। এ’বইয়ের আদ্ধেকটা পাতা সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই; না এ’ কোনো ‘গ্রন্থ-পরিচয়’--কারণ এ’ ইতোমধ্যেই যথেষ্ট পরিচিত এক গ্রন্থ। এ’রচনা কেবলমাত্র সামান্য স্মৃতিচারণা। যাঁরা আর্জানের সঙ্গে ইতোমধ্যেই পরিচিত তাঁদের স্মৃতিকে উস্কে দেওয়া; যাঁরা এখনও নন, তাঁরা যেন শিববাবুর ‘সুন্দরবন সমগ্র’ এক্ষুণি পড়ে ফেলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তখনও বাকি দু’-এক বছর। খুলনার এক ‘স্বদেশি’ যুবক পিতৃপুরুষের জায়দাত খুঁজতে নৌকাযোগে চলল সুন্দরবনের গভীরে। সেখানেই আকস্মিক সাক্ষাৎ জঙ্গুলে সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি সম্পূর্ণ একা একা ঐ গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়ান দিনরাত। ঠিক আর্সেনিভের সঙ্গে দেরসু-মিলনের গল্প মনে পড়ছে, না? আর্জান যদি আকিরা-হেন এক পরিচালকের নজরে পড়ে যেতেন, তাহলে আজ আর এই নিবন্ধ লেখার দরকারই হতো না। যে মমতায় দেরসু এক ভগ্ন কুটীরে ভাবি কোনো অভিযাত্রির প্রাণ বাঁচাতে জল-কাঠ রেখে আসেন, আর্জানের পদে পদেও যে সেই অরণ্যপ্রীতিরই প্রকাশ। হাতে বন্দুক আছে মানেই তো আর সেকালের রাজাগজাদের মত অকারণ পশুহত্যা করা নয়। সুন্দরবনের প্রতি ভালোবাসা যে মিশে আছে আর্জানের ধমনীতে ধমনীতে।
সুন্দরবন, তার মানুষজন, বিশেষতঃ আর্জান সর্দারের গল্প শিবশঙ্করবাবু শোনাচ্ছেন মাঝ-পঞ্চাশের দশক থেকে। ১৯৮৮তে আনন্দ এই ‘সুন্দরবন সমগ্র’টি বের করে, অদ্যাবধি যার পাঁচ-ছ’টি সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। বাঙলাভাষায় মৌলিক ‘শিকার-সাহিত্যে’ এ’ বেজোড়, কারণ কেবল সাহিত্যমানেও এঁর লেখা ‘আরণ্যক’-এর গা-ঘেঁষে চলে। নদীর ধারে মাইলের পর মাইল নাবাল জমি, কোথাও বা ধানক্ষেত, আর বাদা একবার শুরু হয়ে গেলে তো দু’ধারে আকাশছোঁয়া বৃক্ষরাজি। নদী আর খালের দেশ—নাম কী সবঃ ভদ্রা নদী, ঢাকি খাল, শিবসা নদী, হড্ডা নদী। সেসব পথ মুখস্থ আর্জান-কলিমদের। সাইবেরিয়ার অরণ্যে এক ব্যাঘ্রশিকার করে ফেলে দেরসু যেমন কাঙ্গাদেবের কোপের ভয় পায়, এখানেও তেমন বনবিবির থানে সিন্নি চড়ানোর রীতি বাঘ-কুমীর-কামটের কোপ থেকে বাঁচতে। আর বাঘের চালচলন হাবভাব শিকার ধরার ধরন (ও তার থেকে বাঁচবার উপায়) এ’সব বিদ্যে তো তার মজ্জায়! হবে না? মগরিবের নমায পড়ার পাশাপাশি মা উঠোনের ঐ হেঁতাল গাছটায় পিদিম কেন দেন? এর উত্তর পেতে আর্জানকে বিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বাপজান যখন বাদায় মধু কাটতে গিয়ে ‘শেয়ালের’ পেটে গেল, তার দেহাবশেষ আনা যায়নি প্রবল বর্ষায়। প্রাণ বাঁচাতে হাতের কাছে পাওয়া যে লতাপাতা আঁকড়ে ধরেছিল আব্বাজান, তার মধ্যে ঐ হেঁতালের ডালখানিও যে ছিল, যাতে তখনও রক্তছিটে! ও-ই না দাওয়ায় বেড়ে আজ মস্ত মহীরূহ হয়েছে! পিদিম দেবে না মা তাতে? কী অসাধারণ দ্যোতনা!
সুন্দরবন কি শুধু বাঘের? গাছের নয়? জলের নয়? কত কত গাছ, যা মিষ্টি জলের দেশে পাওয়াই যাবে নাঃ সুন্দরী, গরান, গর্জন, গামার, গেঁইয়ো, হেঁতাল, তবলা, হোদো! নদীরও কত নামঃ বিদ্যাধরী, কালিন্দী, মাতলা, হারিয়াভাঙ্গা, রায়মঙ্গল থেকে ওইপাশে পুবে বালেশ্বর। আর পশুর মধ্যে শুধু বাঘ? নেই পাখি বানর শুয়োর কুমীর সাপ? ভয়ংকর বিষধর সর্প পাতরাজ, দুধরাজ, মণিরাজ, ভীমরাজ! আর এ’সবের মাঝে সুন্দরী পরীর মত চপল পায়ে ঘুরে বেড়ানো দলের পর দল হরিণ---বনের বাহার! শিবশঙ্কর পড়েই যাদের সঙ্গে পরিচয়। এই বেশ। নৈলে, আরশোলার ভয়ে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকিনা; সে যাবে সোঁদরবন!
সুন্দরবন বলতে বাঘ-কুমীর-জঙ্গলের কথা প্রথমে মনে পড়লেও এর একটা মস্ত ইতিহাসও আছে, বিশেষতঃ, মধ্যযুগে । যশোররাজ প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলে পর্তুগীজ মার্সিনারির সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, যাদের থেকে পুবভারতে কামানের ব্যবহার শেখা ও মোগলদের সাথে টক্কর। সেকালের কামান-গড়া কামারের কিছু বংশধর নাকি আজও এ’অঞ্চলে আলগোছে ঘোরাফেরা করেন! প্রতাপকৃত দু’একটি বিজয়স্তম্ভ আজও রয়ে গেছে, যার একটির আলোকচিত্র এই বইটিতে উপরিপ্রাপ্তি। আরও আছে স্বয়ং আর্জান ও বেদে-বাউলের বন্দুকধারী ফোটো---ধুতিধারী, আদুড় গা। এবং, সর্বোপরি পাওনা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা এক অনন্য ভূমিকা, কবিতায়ঃ ‘ভৌগোলিক’ ।
উমাপ্রসাদ বলতেন শুধু হিমালয় দেখতে দু’টো জনম লাগে। শিবশঙ্করের তো একটা জীবনেও সুন্দরবনের পুরোটা দেখে ওঠা হয়নি। তাই আগামী তিনটে জনম বুক করা রইল এ’দুটোর জন্য।
এ’জনমটা ফক্কিকারি করেই গেল।
কবীর সাঁইয়ের দোঁহা--বঙ্গানুবাদঃ ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য; ‘দূরত্ব’ পত্রিকা প্রকাশনা; কালিয়াগঞ্জ, উ.দিনাজপুর; প. বঙ্গ; ISBN নেই
বৃদ্ধ কবীরদাস তখন তাঁর আজন্মের বাসভূমি বারাণসী ছেড়ে মগহরে চলে এসেছেন শেষ ডাকের অপেক্ষায়--(বস্তুতঃ, এটাই প্রমাণ করতে যে কাশীতে ম'লে অখণ্ড স্বর্গবাস হয়, এ’ বামনাই মত কত ঠুন্কো)। কেউ এর কারণ শুধোলে নিরক্ষর সাঁইজি গেয়ে উঠলে, “কবীরা মন পঞ্ছি ভয়া ভাওএ তহাঁওয়া জাএ। জো জ্যায়সা সঙ্গতি করে ত্যায়সা ফল খায়।।” [ওরে মনপাখি, যেথায় খুশি যাও। যে যেমন কর্ম করে, তেমত ফল খায়।।---অর্থাৎ আজীবন কুকর্ম করে, কেবল কাশীবাসী হয়েছি বলেই স্বর্গলাভ হবে তা হবার নয়। ]
বা, (ব্রতীন্দ্রের কলমেঃ)
“দশ দ্বারের পিঞ্জিরার মাঝে পরাণপাখি রয়।
এতকাল রহিল পাখি, চকিতে উড়ে যায়।।”
উড়ে কোথায় যায়? আমাদের বাঙলার লালনগীতে অচিনপাখির ছড়াছড়ি, পশ্চিমে পাঞ্জাবে বুল্লের গীতেও তাই। তাই, উড়ে আর যাস্ কোথা, দাঁড়টা তো এই বুকের মাঝেই। যেমন আমাদের ব্রতীন্দ্রের বুকে বসেছে! সাবাস! বুকে বসা এই পাখিকে চিনতে না পারলে এ’হেন কাব্যানুবাদ করা যায় না।
কবীর-দোঁহার অনুবাদ ক্ষিতিমোহন থেকে আজকের নেটে প্রাপ্তব্য কবিতাকোষে কম উপলব্ধ নয়। কিন্তু ছন্দে? আগে পাইনি। কারণ কর্মটি সহজ নয়। ব্রতীন্দ্রের এই কাব্যানুবাদ প্রথম পড়ে, সত্যি বলছি, মনে ধরেনি। কারণ উপরের কবীর পড়েই নিচের বঙ্গানুবাদ পড়েছি কিনা, তাই সেই অবহটঠী ধ্বনিই মনে বাজছে। পরে, ব্রতীন্দ্রের কাব্যানুবাদ প্রথমে পড়তে পৌঁছ্টা বোঝা গেল। কেবল কবিতা হিসেবেই এনার লিখন উৎরেছে, ভালোই উৎরেছে, অন্ততঃ বেশ কয়েকটিতে। অনেকগুলিতে যদিও আশা রয়েই গেল, বিশেষতঃ ছন্দের প্রশ্নে। কয়েকক্ষেত্রে তো বঙ্গানুবাদ চমৎকার মনেধরা হয়েছে, যেমন, পৃঃ ১২, “কবীর এ’ঘর প্রেমের আঙন...” । বাঙলাভাষায় ‘মামাবাড়ির আবদার’ যে অর্থে চলে, হিন্দিতে সেটা ‘নানিহাল’ বা ‘মৌসি/খালা কা ঘর’। ব্রতীন্দ্র সঠিকই ‘পিসির বাড়ি’ না লিখে ‘মামাবাড়ি’ লিখেছেন। অন্য কয়েকটি তো আরও মন ছুঁয়ে যায়ঃ
“নয়নের মাঝে এসো আঁখি মুদে রাখি।
না দিব দেখিতে অন্যে, অন্যে নাহি দেখি।।”
বা,
“মালিক আছেন সবার নিকট চোখের যেমন তারা।
মূর্খ তারে দেখতে নারে, বাইরে খুঁজে সারা।।”
বস্তুতঃ, বিগত পাঁচশো বছর ধরে ভারতীয় সাধনরসের ধারায় যাঁকে নিয়ে সবচেয়ে অধিক চর্চা, তিনি মীরার পরেই কবীরদাসজী। প্রাসঙ্গিক কাহানি মনে পড়েঃ
ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে বাদশাহ্ আকবর তখন প্রতাপের মধ্যগগনে! কিন্তু মহামহিম বিশ্বপতিকে জানবার আকাঙ্ক্ষা সম্রাটের অন্তরে সদাই জাগ্রত ছিল কিনা, তাই তিনি গেলেন সন্ত দাদূ-সকাশে। চল্লিশদিন দাদূ-আকবর বহেস চলেছিল ফতেহ্পুরের সন্নিকটে দাদূর অরণ্য-আবাসে। সম্রাট শুধোন,
“তন মটকী মন মহী প্রাণ বিলোবনহার।
তত্ত্ব কবীরা লে গয়া ছাছ পিয়ে সংসার।।”
মন্থনঘটরূপী তনুতে মন্থনদণ্ডরূপ মন দ্বারা মথিত হয়ে যে নবনীরূপ ব্রহ্মতত্ত্বের উপলব্ধ--সে তো কবীরদাসজীই নিয়ে গেছেন। আমরা তবে কি এখানে তাঁর পরিত্যক্ত ছাছ (ঘোল) খেতেই বসে আছি? দাদূ ছিলেন কবীরপুত্র কামালের শিষ্য, মস্ত কবীরভক্ত। কিন্তু মহাদুখে গাইলেন, “চিড়ী চঞ্চ ভরি লে গঈ, নীর নিঘটি নহি জাই। ঐসা বাসন ন কিয়া, সব দরিয়া মাহিঁ সমাই।।”
চিড়িয়া (পক্ষী) চঞ্চু ভরে নিয়ে গেলে ব্রহ্মসাগরের নীর কমে যায় না। এমন বড় কোনো আধার আজও সৃষ্ট হয়নি, যাতে এই পূর্ণ সাগর আঁটে। বাঙলায় পরমহংসদেব একেই না বলেছিলেন, “ব্রহ্ম এঁটো হয়না?” তিনশতাব্দীর ব্যবধানে অনুভব দুটি একই! ভক্তকবীরের শতাব্দীকাল পরে আকবরের জন্ম। তখনই, দেখ, তাঁর শিক্ষা, তাঁর পদের গভীরতা কতটা মর্মে গেঁথে ছিল, যাতে ‘চিড়ী চঞ্চ ভর লে গঈ’-গাইতে হয় দাদূকে।
নামী ক্ষিতিমোহন থেকে অনামি তুষার পাণ্ডে পর্যন্ত বাঙলাভাষায় যেখানে যা কবীর (অর্থঃ মহান, অতুল) খুঁজে পেয়েছি জড়ো করেছি যত্নে---না জানি কোন্ নুড়িতে তিনি আছেন। যেমন, বর্তমানেরটি। চমৎকার নির্মেদ অবয়ব, তেমন অলংকরণ, টাইপ ও আঁটোসাটো বাঁধাই--- তা আবার বেরিয়েছে কেতাব-ডেন কলেজ স্ট্রিট থেকে নয় উত্তর দিনাজপুর থেকে! শ্রদ্ধা জাগায়; যেমন কয়েক সংখ্যা আগে ‘পরবাস’-এর পাতায় মহা আনন্দে শুনিয়েছিলাম বাগনান থেকে প্রকাশিত এক বইয়ের কথ। বর্তমান লেখক, থুড়ি অনুবাদক, প্যারিসে বসে কবীরদাসকে অনুভবে পান জেনে আরও অনুসন্ধিৎসা জাগে জানার, তাতে ফারাক কিছু হয় কিনা। কেন? সেটা বলেননি মুখবন্ধের স্বল্প পরিসরে। কিছুদিন আগে মোহন সিং খাঙ্গুরা শোনাচ্ছিলেন তাঁর বাল্যে পাঞ্জাবের গুরুদ্বারে শোনা নানকবাণীর সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অদ্ভুত মিলের কথা। এতে আর আশ্চর্য কী, যখন সব ধারাই প্রেমের এক মহাসাগরে গিয়েই মিশেছে!
যাহোক্, এ’প্রকার কিছু বিতর্কিত কথা প্রাক্-কথনের দু’পাতাতেই তুলে ধরেছেন বর্তমান লেখক, যেমন,
(১) রাম প্রসঙ্গঃ ব্রতীন্দ্র, কবীরের রামের সঙ্গে দাশরথি রামের বিরোধ কোথায়? বাল্মীকিমুনি যে দাশরথি রামগান গেয়েছেন, যে রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনার্থ চতুর্দশ বর্ষ বনবাসে গিয়েছিলেন, তিনি কি পুরুষোত্তম নন? তাঁর অতুলনীয় কীর্তির পরিধিই তাঁকে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর, মহৎ থেকে মহত্তর করে সাকার থেকে নিরাকারে উন্নীত করে তুলতে পারেনা? তুলসী-কৃত্তিবাস-কম্বরামায়ণের মধ্যে দিয়ে আজ আড়াই সহস্রাব্দ ধরে অগণিত ভারতীয়ের মনে তিনি কি আজও পূজিত নন? রাম কি ভাজপার না বিজ্ঞাপনদীর্ণ টিভি সিরিয়ালের?
(২) কবীরদাসজী আদতে হিন্দুমুসলিম মিলনে সচেষ্ট ছিলেন না বলেও ব্রতীন শেষাবধি যা বলেছেন, তা এই মতটিকেই পুষ্ট করে । কোনো হাইড পার্কে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে এ’মত ঘোষণা করার না, এ’গান হৃদয় দিয়ে গাইবারঃ
“জৌগী গোরখ গোরখ করৈ হিন্দু রামনাম উচ্চরৈ।
মুসলমান কহৈ এক খুদাঈ কবীর কা স্বামী ঘট ঘট রহা সমাঈ।।”
তাছাড়া, এক কাব্যসংকলনের মুখড়ায় এ’হেন বিতর্কিত প্রসঙ্গ টেনে এনে কী লাভ? এতে কাব্যরস ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
শেষে কবিগুরুতেই ফিরে আসতে হয়ঃ
“......কিন্তু ভারতের একটি স্বকীয় সাধনা আছে; সেইটি তার অন্তরের জিনিস।...এই ধারা শাস্ত্রীয় সম্মতির তটবন্ধনের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, এর মধ্যে পাণ্ডিত্যের প্রভাব যদি থাকে তো সে অতি অল্প।.....যাঁদের চিত্তক্ষেত্রে এই প্রস্রবণের প্রকাশ, তাঁরা প্রায় সকলেই সামান্য শ্রেণীর লোক, তাঁরা যা পেয়েছেন ও প্রকাশ করেছেন তা ‘ন মেধয় ন বহুনা শ্রুতেন’.......”
এই ‘তাঁদের’ মধ্যে রাজমহিষী মীরা বা রাজপুত্র শাহ্ লতিফ (সিন্ধের সুফিসন্ত---এ’প্রকার দু’একটা নামই মাত্র মনে আসে, বাকি আর আর সকলেই কেউ চর্মকার রবিদাস ও দাদূ, শূদ্র কুম্ভনদাস বা অন্ধ সুরদাস! এবং ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’.......ভক্ত জোলা কবীরদাস!!
জোসমনি সন্ত-পরম্পরা ও সাহিত্য--সম্পাদনাঃ সুধীন ঘোষ; সাহিত্য অকাদেমি; নয়া দিল্লি-১১০০০১; প্রথম প্রকাশঃ ২০০৮; ISBN 978-260-2506-0
একই সংখ্যায় পরপর দু’টি একই ধাঁচের বইয়ের কথা পড়তে ভালো লাগবে?
একটু একঘেয়ে লাগার ভয় সত্ত্বেও জোসমনি সাহিত্যের কথা লিখতে প্রবৃত্ত হলুম দু’টি কারণে। এক. কবীরদাসজী যদি ভারতীয় সাধনার ধারায় সবচেয়ে মান্য ও আলোচিত সন্ত হন, নেপাল-সিকিম অঞ্চলের জোসমনি সন্ত-পরম্পরা তবে সবচেয়ে উপেক্ষিত বা অজ্ঞাত। আর দুই. এতদ্সত্ত্বেও সন্ত কবীরদাস ও জ্ঞানদিল দাসের গানে কী মিল!
বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরো বাড়ো আরো বাড়ো নীতিতে অবধারিতভাবে নেপালরাজের সঙ্গে যুদ্ধ ঘনিয়ে এল, ১৮১৩ খৃ. । আর সে-বছরই জন্ম নেপালের আদিকবি আচার্য ভানুভক্তের, যাঁর হাতে নেপালিভাষায় রামায়ণের অনুবাদ। সন্ত জ্ঞানদিল দাসের (১৮২২-১৮৯০ খৃ.) জন্ম তারও প্রায় এক দশক পরে---যাঁকে জোসমনি সন্ত-পরম্পরা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরুষ মানা হয়। সর্বোচ্চ উপাধ্যায় ব্রাহ্মণকুলে জন্ম ছিল জ্ঞানদিলে, কিন্তু তাগাহীনদের (মানে, অব্রাহ্মণ পৈতে-বিন) সাথে বসে পাত পেড়ে খেতেন, দিনের বেলায় মশাল জ্বেলে ঘুরতেন, “আমার জাত হারিয়ে গেছে, তাকেই খুঁজছি......” ব্যাঙ্গসুরে গাইতে গাইতে । আরও গেয়েছেন, “এই জীবদেহকে না জেনে জীব ভ্রমেই থেকে গেল।/ প্রভুকে না চিনে মন ভ্রমেই রয়ে গেল।/ বহু যতনে রতন মিলেছে তাও নিল যে ঠগে/ পথে ঘাটে শুয়ে ধন লুঠ হল আগে....”।
জ্ঞানদিল দাসজীর লেখা ‘উদয় লহরী’ হল নেপালী ভাষার এক প্রতিনিধিস্থানীয় কাব্য, যার সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ এই গ্রন্থে পাই। ‘সাধুক্করি’ এক প্রাচীন নেপালি-উপভাষা, অনেকটা ব্রজবুলির মত, যাতে নেপালি সন্তগণ পদ বাঁধতেন। জ্ঞানদিলজীর বেশিরভাগ পদ এ’ভাষাতেই।
জোসমনি পরম্পরার উৎস যদিও আরো প্রাচীন। নেপালের আদিরাজ পৃথ্বীনারায়ণ শাহ্ (১৭২৩-১৭৭৫ খৃ.)-ও জোসমনি মতে বিশ্বাসী ছিলেন। এ’মত নিরাকার পূজনের মত, নির্গুণ ঈশ্বরের উপাসনা। ভৌগোলিক কারণেই বহুবিধ পারিপার্শ্বিক সাধনপন্থের প্রভাব পড়েছে জোসমনি ধারায়। যেমন, পাশের গোরক্ষপুর অঞ্চলের নাথপন্থীদের হঠযোগ। আবার, তিব্বতি বৌদ্ধগণ যেমন জপযন্ত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম্’ ভজেন, জোসমনিধারাতেও তেমন নাদ-যন্ত্র ঘোরানোর চল। এ’ধারার প্রাচীনতম যে কবির রচনা খুঁজে পাওয়া গেছে, তিনি দীর্ঘজীবি সন্ত শশিধর দাস (১৭৪৮-১৮৫০ খৃ.), এবং শেষতম সন্ত গোবিন্দদাস (১৮৮৮-১৯৪২ খৃ.)। অধুনাকালে নেপালি/হিন্দি কবি শ্রীজনকলাল শর্মার সমনামের বইটি আমাজন বা গুডরিড্সের তালিকায় উপলব্ধ, যেটি থেকেই বর্তমানেরটির বঙ্গানুবাদ।
এ’তো ইতিহাস-পর্ব গেল।
কয়েকটি কাব্য-নমুনা পড়া যাক্ঃ
“সাঁই, মিলনধ্বনি গেয়ে যাই।
নিজ স্বরূপে মিলে যাই
যিনি শুধুই ভুলে যান তাঁর শঙ্কা নাই
যিনি বহু খোঁজেন, তাঁর ভাবনা নাই...”
[‘হরি মিলন ধ্বনি’---শশিধর দাস]
আরেকটিঃ
“কায়াবনের অরূপ পাখিটিকে ধরো
একই বনে ত্রিগুণ বীজ পাঁচ মূলে বাঁধা
পদে পদে শাখা বিরাজে বহু পল্লব ভরে
কায়াবনে.....” [ভজন সংগ্রহ। নির্গুণ ভজন]
আরেকটিঃ
“মন মজেছে মোর রাম ফকিরিতে
গগন-নেবুতে সে রস নেই, যে রস তুমি চাও
......হাতে রামনামের যষ্টি, বগলে চাবি....
মন মজেছে রাম ফকিরিতে...”
আরেকটি শোনাইঃ
“প্রতি দেহে নারায়ণ বিরাজে
দশদ্বারের দেহ এই
পঞ্চতত্ত্বের ভিত এর, ত্রিগুণ দেওয়াল...”
কী পাঠক, মিলে মিশে সব একাকার হয়ে যায়নি? লালনসাঁই তো আমাদের এই বাঙলার, আর কোথায় সিন্ধের লতিফ শাহ্ আর পঞ্জাবের নানকদেব আর কাশীর কবীরদাস আর নেপালের জ্ঞানদিলদাস!! সেই অচিনপাখিরই উড়ে উড়ে আসা, কখনো পশ্চিমে তো কখনো পুবের পাহাড়ে।
‘সাহিত্য অকাদেমির’ পূর্বাঞ্চলীয় অনুবাদ-কেন্দ্রের উদ্যোগে গ্রন্থখানির প্রস্তুতি। সংকলন শ্রী সানু লামার, পাঁচজন অনুবাদকের প্রয়াসে ও শ্রী সুধীন ঘোষের সম্পাদনায় পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া গেছে বইটি। বঙ্গানুবাদের মান নিয়ে রোদন করলে চলবে না, কারণ একাধারে প্রাচীন নেপালী-উপভাষা ও বাঙলায় সমদক্ষতার কবি খুঁজে পাওয়া দুরূহ। সেকারণে প্রস্তুতি ও উপস্থাপনা থেমে থাকেনি, এতেই সাধুবাদ। বইখানি পড়ে আনন্দ পাওয়া গেছে—এটাই ধরা থাক্।