'কাশী বিখ্যাত ক্যান্? তুই ভাবছস্, বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকার ঘাট, চৈৎ সিং-এর বাড়ি আর গোধূলিয়ার রাবড়ির লাইগা। তা নারে। কাশী বিখ্যাত হইল গা, ষাঁড়, গাঁড় আর রাঁড়ের লাইগা। তাও যদি একটা ডব্গা রাঁড়ের লগে ধাক্কা খাইতিস্, তা খালি না, খাইলি একটা ষাঁড়ের লগে। এক অত্থেতো অরে 'হোমো'ই কওন যায়, কারণ ষাঁড় জাত তো পুরুষই। কিন্তু আমাগো বিষয় ষাঁড় না, ষাঁড়ের গোবর, অর্থাৎ আমাগো পিতৃপুরুষ।'
আশুদা বলল, 'যাউক্গা, অরে এবার ছাইড়া দে। তখনেইতো অর বাপের আন্বান্ কইয়া ম্যাজাজটা খাট্টা কইরা দিছস, এ্যার পর আর লাড়াচাড়া করলে ব্যাক্ কিছু ওই ষাঁড়ডার গোবরের লাখানই হইয়া যাইব গা। এবং ধইরা লও আম্গো এই গণপিতৃশ্রাদ্ধের বউনি কালে, ওই তোমাগো যারে কয় বৃষোৎসর্গটা হইয়া গেল গা।' পানু জিজ্ঞেস করল, 'গণ পিতৃশ্রাদ্ধটা হইল কই? আচায্যি তো কিছু বললই না'। আচায্যি জানালো, সে যথাসময়ে তার কর্তব্য করবে। কিন্তু নরেন তো নড়ে চড়ে বসছেই না। তার বৃত্তান্ত কি? বিশেষ দলের মধ্যে একমাত্র তার বাপই জিন্দা আছে। অতএব আমরা আবার গঙ্গার পারে সেই পূর্বস্থানেই গিয়ে বসলাম। পানু বলল, 'দিছি তোরা একেবারে যা ডা। আমাদের বাবারা ষাঁড়ের গোবর?' আশুদা বলল, 'ওই হইল আর কি। দুইটাই পবিত্র ব্যাপার বল্ইয়া ভুল হয় কি না তাই বলা।'
দূরে গঙ্গার বুকে যেখানে যেখানে নির্জলা বালি, সেসব জায়গার এখানে সেখানে চিতা জ্বলছে। শ্মশানযাত্রীদের মনে হচ্ছে যেন প্রেত অথবা ডোম অনুচরদের সহ হরিশ্চন্দ্র। পরলোকে এইসব মৃতদের আত্মারা যাতে মুক্তি পায় বা চিরস্থায়ী স্বর্গবাস, সেই উদ্দেশ্যে তাদের আত্মজনেরা দূর দূরান্তর থেকে দেহগুলো বহন করে এনে এখানে সৎকার করছে। কাশীতে সৎকার হলে সাক্ষাৎ শিবত্ব প্রাপ্তি। বেশিরভাগ দেহই আধপোড়া অবস্থায় গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় এখানে। এই দেহগুলোও আমাদের মতই দোষে, গুণে, পাপে পুণ্যে, ন্যায় বা অন্যায় কাজের মধ্যে বেঁচেবত্তে ছিল। এদের সন্তান বা আত্মজনেরাও দুদিন, দশদিন বা কয়েক বছর পর আমাদের মতই এই রকম নির্বিকার আলোচনা বা সমালোচনা করবে, রঙ্গরসেও মাতবে। সামনের অন্ধকারের মধ্যে ইতস্তত চিতার আগুন, আমাদের এতক্ষণের পিতৃসমালোচনার নির্বিকার ধারাবাহিকতা সবার মধ্যেই অন্যরকম একটা ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে রঙ্গরস চলছিল বটে, কিন্তু নেশা তার স্বাভাবিক চটুলতা হারিয়ে আমাদের যেন ক্রমশ গভীর করে তুলছিল।
নরেন হঠাৎ খুব সহজ সরল নেশামুক্ত কণ্ঠে বলল, 'আমারও একটা ভীষণ দুঃখের ক্ষত আছে জানিস? সারাজীবন সেজন্য বাবাকে দায়ী করে এসেছি, এখনো করি। তোদের ওই দেশ ভাগ, ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট থেকে সেটা অনেকগুণ বেশী কষ্টের বলে আমি কোনোদিন বলিনি।' আশুদা বলল, 'মনে হইতাছে কষ্টটা কইতে তর অসুবিদা হইতে আছে। যদি এমনে কইতে না পারস ল' আর দু ঢক ভাড় মাইরা আহি। তর হয়তো কইতে সুবিদা অইব।' নরেন বলল, 'দরকার মত যাব, এখনো আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। শোনো সবাই।'
আমার মনে হচ্ছিল, নরেন মুখে যা-ই বলুক আসলে ওর বলতে কষ্টই হচ্ছিল। বাবার স্বভাব চরিত্র বিষয় নিয়ে কথা আমাদের মত নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঙাল-উদ্বাস্তু ছেলেদের পক্ষে ওই ষাট সত্তরের দশকেও খুব সহজসাধ্য ছিল না। তখনো আমরা ততটা তথাকথিত আধুনিকতা সম্পন্ন হইনি। বিগত কৌম পরম্পরার পারিবারিক লঘুগুরু মূল্যবোধ তখনো আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সে কারণেই বেড়াতে এসে যেদিন মদ্যপান করি সেদিনের পাপবোধ, ভাঙের সরবত খাওয়ার দিনের চাইতে অনেকগুণ বেশি হয়। সামাজিকভাবে ভাঙটা পান পরবে যদিও গ্রহণযোগ্য এবং নিষ্পাপ বলে গ্রাহ্য মদ হারামস্য হারাম।
কিন্তু যে বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা বা স্মৃতিচারণা তা সাদা মাথায় হওয়া নিতান্তই অসম্ভব। সেটা নরেনের একটা কথায় আমার মনে হয়েছিল। মাঝখানে সে বলেছিল, 'আমার কথা বলতে হলে ভাঙে কুলোবে না। রাম, হুইস্কির সেলার দরকার।' আশুদা বলেছিল, 'না। দুইটা আলাদা জিনিস। গোলমাল অইয়া যাইব গা। বরং দরকার বুজলে আর দুই ভাড় ভাঙ খাওয়া চলতে পারে।'
নরেনের মা ওর ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। ওরা ছিল তিন ভাই। তখন ওর বাবার যা বয়স, ওইসব দিনে বা আজও, আর একবার বিয়ে করা তেমন দৃষ্টি্কটূ বা নিন্দনীয় নয়। কিন্তু তিনি তা করেননি। বলতেন, আবার বিয়ে করলে, একজন সৎমা এসে তাঁর ছেলেদের জীবন বিষময় করে দেবেন। সংসারটা সে যুগের রীতি অনুযায়ী যৌথ পরিবার ছিল। ভাইরা দুজন যতদিন ছোট ছিল, বাড়িতে কাকি, জেঠি, বিধবা পিসি ইত্যাদির তদারকিতে মানুষ হচ্ছিল। দেখাশোনা করার লোকের অভাব ছিলনা। পরে মামা-বাড়িতে থেকে তারা পড়াশোনা করত। বাবাই খরচপত্তর দিতেন।
নরেনের কাহিনীটা বেশ বিস্তৃত। সংক্ষেপে বলি। নরেনের কাছে বাবা সর্বার্থেই আদর্শ মানুষ ছিলেন, যা ওইযুগে সব সন্তানদের কাছে তাদের বাবারা থাকেন। মা মারা যাবার সময় নরেনের বয়স ছিল দশ, মেজ সাত এবং ছোটটা তিন। জেঠিমা, কাকিমারা অনেকে থাকলেও এবং বাবা চাকুরিজীবি হওয়া সত্ত্বেও, সন্তানদের তদারকি তিনি নিজের হাতেই রেখেছিলেন। মায়ের অভাব, তেমনভাবে কোনোদিনই তাদের বোধ করতে দেন নি। অন্তত, ষোল, সতেরো বছর বয়স অবধি। নরেন বলছিল, তাদের বাবার প্রতি কোনো ব্যাপারে সামান্যতম অসন্তুষ্টি বা অভিমানের কারণ সে খুঁজে পায়নি। উপরন্তু তার বয়োসন্ধি কালীন স্পর্শকাতরতার সময়েও, যখন নানা কারণে সন্তানেরা মা বাবার প্রতি ক্ষুব্ধ বা অভিমানী হয়ে থাকে, সে তার বাবার বিষয়ে অসামান্য গর্বই বোধ করত, বিশেষত পাড়ার অন্যান্য বাবাদের সঙ্গে তুলনায়। সদ্য যৌবনে পা-রাখা একজন সন্তানের কাছে যা কিছু আদর্শ বলে মনে হয়, তার কোনো চ্যুতি সে তার বাবার মধ্যে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে নরেনের সম্পর্ক ছিল একেবারেই বন্ধুদের তথা প্রগাঢ় পিতৃস্নেহের। একেবারে আদর্শ বাবা।
নরেন বলে যাচ্ছিল। একটু একঘেয়ে লাগলেও, আমরা ঝিম্ধরা মাথায় শুনে যাচ্ছিলাম। আমাদের ভাঙের নেশা ফিকে হয়ে আসছিল আবার। নরেন বলল, 'এ পর্যন্ত ঠিক আছে। এর পর যা বলব, তার জন্য সবারই চার্জড হওয়া দরকার।' সবাই অতএব আবার সরবতের ঠেকে গিয়ে, এক ভাঁড়, দু ভাঁড় সরবত খেলাম। আচায্যি তিন ভাঁড় খেল। নরেনও। সে আরো এক ভাঁড় নিতে চাইলে আশুদা বাধা দিল। সে দলের গার্জেন এবং এসব ব্যাপারে অসামান্য দায়িত্বশীল। বলল, 'আর না। পরে হয়ত কান্তে আরম্ভ করতে অইব। ভাঙে হাসন কান্দন বড় বাড়ায়। আর থাউক। তয় অহনও কই, তর যদি খুউব কষ্ট অয়, নরেন্যা, আর কওনের দরকার নাই। ল' এবার যাইয়া শুইয়া পড়িগা, রাইতও অইতে আছে।'
'না। বলতে যখন শুরু করেছি, আজ আমাকে বুক খালি করে সব বলতে হবেই। চল, আবার বসি গিয়ে।'
ঘাটে বসে নরেন আবার তার কাহিনী শুরু করল। বাবার সঙ্গে এই সম্পর্ক একদিন খান খান হয়ে গিয়েছিল তার। তখন তার বয়স আঠারো, বাবার বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ। নরেন তখন হবিগঞ্জ কলেজে ইন্টার মিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে বেকার বসে। বাবা তখন চাকুরিসূত্রে জামালপুরে, ময়মনসিং জেলায়। রেল বিভাগে কাজ করতেন তিনি। ভাইয়েরা তখন মামাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করে - কুমিল্লাতে। বাবা জানিয়েছিলেন, বাড়িতে বসে না থেকে ছুটিটা মামাবাড়িতে কাটাতে। নরেন ঠিক করেছিল, সেখানে না গিয়ে সে হঠাৎ বাবার কাছে গিয়ে তাঁকে সারপ্রাইজ দেবে এবং সেখানে কয়েকদিন থেকে কুমিল্লা যাবে। জামালপুরে রেল কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। সুতরাং আগে কখনো না আসলেও রেল কোয়াটার্সে একে তাকে জিজ্ঞেস করে বাবার কোয়ার্টার পেতে কষ্ট হয়নি তার। বাবা তখন আপিসে। নরেন জানত, ইয়ার দেখা শোনার জন্য একজন চাকর সেখানে থাকে। সুতরাং সে নির্ঘাত সেখানে থাকবেই। তার কোনো অসুবিধে হবে না। বাবা যখন সন্ধেবেলা দপ্তরের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরবেন, নরেন তাঁকে মোক্ষম এক সারপ্রাইজ দেবে। তারপর বাপবেটায় যা জমবে না --।
কিন্তু না। বাবার সঙ্গে সেদিন জমা তো দূরস্থান, নরেনকে সেদিন কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তারপর থেকেই সে এপার বাসী। ওর মায়ের এক জেঠ্তুতো দাদা ছিলেন, তাঁকে ওরা আপন মামা হিসেবেই জানত। ভদ্রলোক পোর্ট কমিশনার্স-এ বেশ উচ্চ পদে কাজ করতেন। নরেন এপারে এসে তাঁর কাছেই আশ্রয় নিয়েছিল এবং আর কোনও দিনই বাবার মুখদর্শন করেনি এখনো পর্যন্ত না। তাঁরা পাকিস্তানেই আছেন এখনো।
— কিন্তু কী এমন হইছিল যে তুই এমন একখান বাপরে ত্যাগ দিলি? নাকি, তাইনেই তরে ত্যাজ্য করলেন? - আশুদা জিজ্ঞেস করেছিল।
— সেই কথাই বলছি। না, তিনি আমাকে ত্যাগ করেন নি। বরং মামার কাছে থাকলেও, আমার তাবৎ খরচপত্তর তিনিই বহন করতেন। প্রথমে প্রতিমাসে চিঠিপত্রও দিতেন। কিন্তু আমি উত্তর দিতাম না বলে, টাকাপয়সা, চিঠি মামার কাছেই আসত। মামা প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করতেন, বাবার সঙ্গে আমার কী কারণে বিসংবাদ। আমি পরিষ্কার করে তাঁকে কিছু বলিনি। তিনি বোধহয় তাঁর মত কিছু ভেবে নিয়েছিলেন। এভাবেই চলল।
— ঘটনাটা কইবিতো? খালি তো পাঁচালি গাইয়া যাইতে আছস্?
— বলছি। আচায্যি, কিছু মনে করিস না, আমাকে আর এক ভাড় সরবত এনে দে না। পারলে ধুতরো টুতরো কিছু মিশিয়েও আনতে পারিস।
নরেন একটা সাংঘাতিক কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা নিয়ত তাকে কুরে কুরে খায়, এরকম আমরা সবাই বুঝেছিলাম বলে কেউই তার প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না। আচায্যি সরবত আনতে চলে গেলে, আমরা সবাই আবার গঙ্গার বুকের চিতাগুলো দেখতে থাকলাম। খানিক পরে, আচায্যি একটা ক্যানে করে সবার জন্যই ভাঙের সরবত এবং ভাঁড় নিয়ে হাজির হল। নরেন তার ভাঁড়টা এক চুমুকে শেষ করে বলতে লাগল, 'বাসায় কোনও চাকর ছিল না। দরজায় নক্ করতে ভেতর থেকে একটা মহিলা কণ্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল, কে? -- উত্তর দেবার আগেই দরজা খুলে যে স্ত্রীলোকটি আমার সামনে দাঁড়াল, তাকে ওইখানে, ওই সাজসজ্জায় দেখে আমার পায়ের নীচের মাটি যেন প্রবল ভূ-কম্পের সময়ের মত কাঁপতে থাকল। স্ত্রীলোকটিকে আমি চিনি। সে আমাদেরই এলাকার একটি ভদ্র পরিবারের বিধবা। একসময় আমাকে খুব স্নেহও করত, মা মারা যাবার পর। আমিও তাকে ছোটবেলায় খুবই ভালবাসতাম। তখন আমার বছর বারো তেরো বয়স। কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম সে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় বছর ছয়েক আগে একজন মুসলমান যুবকের সঙ্গে সে গৃহত্যাগ করে। এ নিয়ে পাড়াগাঁয়ে, তখনকার দিনে যা যা হবার সবই হয়েছিল। এককথায় সে ছিল একজন জঘন্য চরিত্রের মেয়েমানুষ। তাকে ওখানে ঐ বেশবাসে দেখার কথা আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। তার নাম ছিল সুতপা। ব্রাহ্মণঘরের বিধবা। তখন তার বেশবাসে বিধবাজনিত কোনও অভিজ্ঞান ছিলনা। যথেষ্ট পরিপাটি সাজগোজ, সিঁথিতে সিঁদুর। এমনিতে সে অসামান্যা রূপসী এবং স্বাস্থ্যবতী। বয়স তখন বছর তেত্তিরিশ চৌত্রিশ। সেও আমাকে ওখানে আশা করেনি। তবু একটু সামলিয়ে বলল, ভেতরে এসো। আমি আমার হতভম্বতা এবং প্রবল ধাক্কাটা কোনওরকমে কাটিয়ে তীব্র ঘৃণায় 'না' শব্দটা ছুঁড়ে দিয়ে, উলটোপথে, প্রায় টলতে টলতে চলা শুরু করলাম।
একটানা অনেকটা কথা বলে, নরেন আবার একবার সরবত চাইল। এবার আশুদা বাধা দিয়ে বলল, আর থাউক। শরীলডা খারাপ কইরা লাভ নাই। তুই বরং চুপ যা। ল, ব্যাকে ধম্মশালায় ফিরি। রাত তখন বেশ এগিয়েছে। হাল্কা পাত্লা চাদর ভেদ করে শীত ছুঁচের মত বিধ্ছিল। কিন্তু নরেন বলল, না, বলতে যখন শুরুই করেছি, সবটা বলেই উঠব। বোস তোরা।
সে বাসা ছেড়ে যখন চলতে শুরু করেছিল, তখন মাথায় কোনো চিন্তাই কাজ করছিল না তার। সময় তখন সন্ধ্যা ছ-ঘড়ি, সাড়ে ছ'ঘড়ি হবে। নতুন অপরিচিত জায়গা। সে কোথায় রাত কাটাবে, কোনো কিছুই তার বোধে ছিল না তখন। খানিকটা চলার পর, রাস্তায় বাবার সঙ্গে দেখা। তিনি আপিস থেকে ফিরছিলেন। নরেনকে দেখে তিনি মুহূর্তে বুঝে গিয়েছিলেন কী ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। তবু ধীরস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'কীরে তুই, এসময়?' - খুবই অসময়ে এসে তোমাকে অসুবিধেয় ফেলেছি, না? - নরেন এরকম কাটা কাটা ভাবে প্রতিপ্রশ্ন করেছিল, যা জীবনে ঐ বোধহয় প্রথম। বাবা তথাপি তার হাত ধরে বলেছিলেন, - চল্, বাসায় চল্। সব বলছি তোকে। ভুল বুঝে তোকে যেতে দিতে পারি না। সবটা না শুনলে বুঝবি কী করে? আগে সুস্থ হয়ে সবটা শোন্? - আমার কিছু বোঝার বাকি নেই, দরকারও নেই - বলে ধরা হাতটা ঝট্কা মেরে ছাড়িয়ে সে আবার চলতে শুরু করেছিল।
বাবা বলেছিলেন, তোর ধারণা মিথ্যে নয়। ঐ মেয়েটির সঙ্গে আমার আসলেই সম্পর্ক আছে। তোর কাছে আমি কিছুই গোপন করতে চাইনা। তবে এর পেছনের সবটা না জেনে চলে যাওয়া তোর আর আমার, দুজনের পক্ষেই জীবনভর দুঃখের কারণ হবে। আমি তাঁকে বিয়ে করেছি। নরেন ঝাঁঝাঁলো উত্তর দিয়েছিল, 'এসব আমার জেনে দরকার নেই। একজন চরিত্রহীন লম্পটকে আমি বাবার আসনে বসাতে চাইনা, একটা নষ্ট মেয়েমানুষও আমার মা হতে পারেনা।'
— 'ব্যাপারটা কী, সেইটা তাইলে আর জানোন হইলো না?' - আশুদা জিজ্ঞেস করল।
নরেন জানালো যে প্রথম চিঠিতেই বাবা সবিস্তার তাকে জানিয়েছিলেন বিষয়টা। কিন্তু তার তাতে মন ভেজেনি। মেয়েটি নাকি ঘর ছাড়ার কিছুদিন পর, সেই মুসলমান যুবকের হাতে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করে শেষে অসহায় অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়। তখন ঐ দেশটা পাকিস্তান। বাড়ি ফেরার প্রশ্ন ছিল না। কপাল ক্রমে তখনও এক বয়স্ক মুসলমান ভদ্রলোক তাকে আশ্রয় দেন। তিনি ছিলেন নরেনের বাবার সহকর্মী। একদিন কথায় কথায় মেয়েটির বৃত্তান্ত বাবার কাছে বলেন এবং তার পুনর্বাসন বিষয়ে সহায়তা চান। তখনকার হিন্দু সমাজে ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাবা মেয়েটিকে নিজের কাছে এনে রাখেন। কিছুদিন পর তিনি তাঁকে রেজিস্ট্রি মতে বিয়ে করেন। এ ব্যাপারে মুসলমান ভদ্রলোকের শর্ত এরকমই ছিল। বাবাও দ্বিমত করেন নি। বাবা পরিষ্কারই লিখেছিলেন যে শুধু রূপমোহ বা যৌনতার প্রয়োজনেই যে তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন এমন নয়। তাঁর এবং মেয়েটির পক্ষে, এছাড়াও অন্য অনেক কারণ ছিল। সব কথা বোঝার বয়স যেদিন নরেনের হবে সেদিন হয়তো তিনি বেঁচে থাকবেন না, তবে মানুষকে চট্জলদি, এক আধটা ঘটনায় বিচার করার, বা গ্রহণবর্জন করার ভুলটা নিশ্চয়ই সে বুঝবে।
আচায্যি বলল, তুই কী অহনও বুঝস্ নাই যে তর বাবার আসল সমস্যাটা কী আছিল?
— 'বুঝে কী করব? ঐরকম একটা নষ্ট চরিত্রের, মুসলমানের এঁটো মেয়েলোককে মা বলে গ্রহণ করব?'
নরেনের কথা শুনে আচায্যি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আশুদাও। আচায্যি বলল, 'ইচ্ছা করতাছে তর পাছায় লাথি মারতে মারতে নিয়া গিয়া ওনাগো দুইজনের পায়ের উপার ফেইলা দি। তুই একটা অত্যন্ত অশিক্ষিত আর নিমক হারাম, বুঝ্ঝস্? অমানুষ একটা তুই। আমার তো ভাবতেই ঘিন্না লাগতাছে যে, এতকাল তরে আমরা বন্ধু ভাবছি।'
— 'তোদের কারুর ক্ষেত্রে এমনটা হলে কি করতিস?'
— 'সেই কথা পরে। আগে ক'ছেন এখানের কার কার বাপের চরিত্তির জানস তুই? আমার কথা আমি কোনোদিন ক্যান্ কই নাই, হেডা জানস্? আমার বাবায় কি আছিল, তরগো কোনোদিন কইছি?
আশুদাও নরেনের কথায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিল। তবুও কোনো চেঁচামেচি বা বিতণ্ডা না করে, শান্তভাবে বলল, দ্যাখ্, সংসারে এইসব ঘটনা কিছু বিচিত্র না, নতুনও না। অবশ্য তখনও যে বয়সে এই ঘটনাটা তর মোকাবেলা করতে অইছিল, সেইটা সামলানো খুবই শক্ত ব্যাপার। কিন্তু পরে বয়স বাড়ার লগে লগে কিন্তু ব্যাপারডা তর তলাইয়া বোজোনের দরকার আছিল। সেইটা যদি না বুজইয়া থাকস্ তো আমাগো কওনের কিছু নাই। আর ওই মহিলারে তুই নষ্ট চরিত্তির, মুসলমানের আইঠা - এইসব কি কইতে আছস? কাউরে বিচার করার এই অধিকারটা আম্গো কাউরই নাই। আমরা কিন্তু কেউই টেস্টেড না। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের গপ্পো উপন্যাস তো অনেকই পড়ছ, কথায় কথায় উদাহরণও দেওস্। তাতে যে তর কোনো উপকার অইছে, এমনতো বাসি না। তর জন্মানো উচিত আছিল সতীদাহের যুগে, বুঝজ্স?
আচায্যি আর আশুদার যুগপৎ আক্রমণে নরেন বেশ বেসামাল হয়ে পড়ল বটে, কিন্তু গোঁ ছাড়ল না। অসংলগ্ন ভাবে, নষ্টচরিত্র, মুসলমানের বজ্জাতি, বিধবার সতীত্ব এবং তার মায়ের স্মৃতির প্রতি বাবার অসম্মান - এইসব নিয়ে বক্বক্ করতে করতে আবার একই প্রশ্ন করল, 'তোদের কারুর বাবা এরকম করলে তোরা কি করতিস?' উত্তরটা আচায্যি দিতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে আশুদাই দিল। সে বলল, 'অন্যদের কথা জানিনা। বিষয়টা মানসিক। আমার মতটা কইতে পারি। আমি আগে চেষ্টা করতাম পুরা ব্যাপারটা বুজইয়া নিতে। সেই মহিলারেও বোঝার চেষ্টাও করতাম, শত অসুবিধা অইলেও, বুজজস? মানি, ব্যাপারটা খুব সোজা অইত না, তয় তর ল্যাখান্ত যে বাপরে বাইল্য কালাবধি অত সম্মান, শ্রদ্ধা করা গেছে, এক কথায় তাইনেরে ছাইরা আইতামও না। হয়তো ঝগড়া, ফাটাফাটি করতাম। ছাইরা আইতাম না।'
আচায্যি বলল, এইসব আড্ডায় যখন দুঃখ দুদ্দশার কথা উঠে, আমি আমার কথা কইনা। সবাইর কথা লইয়া হাসিমশকরা করি। তরা তা লইয়া গোঁসা করস্, দুঃখ পাস, আমি জানি। আমরা সবাই ভাবি যে তার চাইতে বেশি 'সাফার' কেউ করে নাই।
আইজ বিষয়টা একটু ভারী অইয়া গেল গা। ভাবতে আছি, আইজগা নিজের কথাগুলান কইয়াই ফালাই। নরেইন্যা হালায় বড়ো জব্বর হাউড় দিছে, নাইলে কইতাম না। তরা প্রায়ই অনেক দুঃখ কষ্টের কথা কস্। শুনলে মনে অয়, যেন যে যখন কয় তার থিকা বেশি কষ্ট আর কেউ কোনোদিন করে নাই। ভাইরে, এইডাতো মানবি, এসব প্যাচাল পাইরা কোনো লাভ নাই। মাইনষের দুঃখ কষ্টের চূড়ান্ত বইলানি কিছু আছে। অবশ্যই, হয়তো আশুদার ব্যাপারডা আসলেই স্বতন্তর। মরার উপর আর কথা কি? অথবা আছেও বোধ অয়, কি জানি? শ্যাষ কথা বইলা তো কিছু নাই।'
অতঃপর আচায্যি সবার অনুরোধেই তার নিজস্ব অতীতের স্মৃতির ঝাঁপি খুলেছিল। তারা পরিবারে ছিল মাত্র চারজন। বাবা, মা, সে এবং ছোট একটা ভাই। পঞ্চাশের দাঙ্গায় মালখা নগরের সামান্য টিনের চালার গেরস্থালি ছাই হয়ে গেলে, কোনোমতে এপারে এসে শেয়ালদা স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিল তারা। তার বয়স তখনও সাত, ভাইটার তিন। দেশে থাকতে বাবা পুরুতের কাজ করতেন, যদিও আচায্যি বামুন বলে তেমন চাহিদা বা মান্যি ছিল না তাঁর। বাবার বাল্য সহপাঠী এক ভদ্রলোক সাতচল্লিশেই এপারে এসে নারকেল ডাঙ্গায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ক্রমশ মোক্তারি করে বেশ ভাল পয়সাও রোজগার করতেন তখন। মানুষটি খারাপ ছিলেন না। সংসারে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী। সন্তানাদি নেই।
শেয়ালদার স্টেশনে দু'চারদিন সরকারি 'লপ্সি' খাওয়ার পর ভলান্টিয়ারদের সাহায্যে বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন আচায্যির বাবা। ভদ্রলোক নির্দ্বিধায় তৎক্ষণাৎ তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন ওদের। নারকেলডাঙ্গায় তখন বেশ কিছু সংখ্যক রেফিউজির ভিড়। রোজই বাড়ছে তার সংখ্যা। প্রায় জলা অঞ্চল, নোংরা অস্বাস্থ্যকর, মনুষ্যবাসের অযোগ্য। মোক্তারবাবু অবশ্য মোটামুটি অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন জায়গায় ভাল একটি বাড়ি করেই বসবাস করছিলেন। সেটি বস্তির মধ্যে নয়। নিজেদের সন্তানাদি না থাকলেও মোক্তারবাবুদের পোষ্য তখন কম ছিল না। মানুষটি প্রকৃতই মানবিক গুণসম্পন্ন ছিলেন। কিছুদিন নিজের বাড়িতে রাখার পর বস্তিরই একটা খোলার ঘরে আচায্যিদের ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। আর্থিক সহযোগিতা তো করতেনই, পাড়ায় এবং নিজের বাড়িতে পুরুতগিরির ব্যবস্থা করে দিয়ে বন্ধুকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ারও বন্দোবস্ত তিনিই করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর সহযোগিতায় অন্য অজস্র উদ্বাস্তুর চাইতে তাদের দুর্দশা অনেকই কম ছিল।
আচায্যি বলল, 'এত বিত্তাং কওনের দরকার নাই। এইটুকু কই যে, এই সুখ, স্বস্তি, আমগো কপালে সইলো না। কিছুদিন খুঁজখুঁজ, ফুঁসফুঁস শোনা যাইতে আছিল যে বাবার নাকি স্বভাব চরিত্তির ভাল না। মায়রেও মাজে মইদ্যেই কান্তে দ্যাখতাম। ওই ভাবেই বছর তিনেক চলল। বয়স তহন বছর দশেক। এক্কেরে যে কিছুই বুজতাম না, এমন না। এইটুকু অন্তত বোজতাম যে আচাইল কাম কিছু একটা অইতে আছে। একদিন সকালে উইঠা দেখি, বাবায় বাড়ি নাই। মায় কান্তে আছে। শোনলাম, মোক্তারের বৌরে লইয়া বাবায় নাকি চম্পট দিছে। অমন একজন বিপদে আশ্রয়দাতা, উপকারী বান্ধবের লগে যে এমন বেইমানি করন যায়, ওই বয়সে সেইটা ভাবনারো বাইরে। তারপর থানা, পুলিশ, খোঁজখবর অনেক কিছুই অইল, তয় কোনো সুরাহা অইল না। একে উদ্বাস্তু বস্তি, তার উপর ওই যুগে এমন একখান কেস্সা লইয়া কি অইতে পারে, বোজতেই পারস্। মোক্তারবাবু সহ্য করতে না পারইয়া তাঁর দরজায় তালা লাগাইয়া লজ্জায় গা ঢাকা দিয়া কোথায় গেলেন জানিনা। আমরা তহন একদিকে পাড়ার টিটকারি গঞ্জনা, অন্যদিকে উপাস, এইভাবে কিছুদিন নরক ভোগলাম। বাসন-কোশন, অন্যান্য সামগ্রী যা কিছু আছিল, সব বেইচা, মা আমাগো লইয়া এই কাশীর উদ্দেশ্যেই রওনা দিলেন। সে যুগে, বোধহয় আজও কাশী সব অধঃপতিতেরগে আশ্রয়।'
আশুদা জিজ্ঞেস করল, 'বাবার আর কোনো খোঁজ পাওস্ নাই?'
— 'পাইছিলাম। এই কাশীতেই। তয় হেকথা পরে কইতে আছি। আগে তোম্গো এক্কটা কথা জিগাই। তোমরা বেয়াকেই অনেক কষ্ট করছ জীবনে। খুউব লড়াই যুদ্ধ কইরা আইজ একটু পায়ের তলায় মাটি, মাথার উপর ছাউনি বা ছাতের ব্যবস্থা অইছে। মা-বাপেরা, নিজেগো চালার তলায় বা ভাড়া বাড়িতে মরার সুখ পাইছে। কিন্তু একটা কথা জিগাই, কেউ কোনোদিন ভিক্ষা করছ? ভিক্ষা? মা বা বাবায় টিনের বাটির মইদ্যে দুই চাইরটা ফুটা পয়সা নাচাইয়া নাচাইয়া যখন নাঁকি সুরে, একটানা বইলা যাইত, মোরে একটা পয়সা দেন, আম্গো একটু দয়া করেন, পুলাপানেরা উপাস কইরা আছে, সেইসব শুনতে অইছে নি কাউর? কিংবা যে গোধূলিয়ার মোড়ে আমরা নেশা চাড়াবার লাইগা আইজ কাইল রাব্ড়ি খাই, সেইরকম সব জায়গায়, যখন বাবু লোকেরা রাব্ড়ি বা কোনো অন্য মিষ্টি খাইয়া রসমাখা পাতাগুলা ফেলাইয়া দিত, সেই সব তুইলা চাইট্টা দ্যাখছনি কেউ কোনো দিন, মিঠাই এর সোয়াদ কেমন?' কথাগুলো বলতে বলতে আচায্যি কেমন যেন বিকারগ্রস্তের মত হয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে শুধুমাত্র আচায্যি আর আশুদাই কথা বলে যাচ্ছিল। আমরা তিনজন স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম। কিন্তু আচায্যির মূল কাহিনী তখনো শেষ হয়নি। আশুদা বলল, 'তর মা বাবার কথা ক। বাপেরে পাইলি কোথায়?'
— 'এই খানেই। বিশ্বনাথের মন্দিরের যেখানে ভিক্ষুকরা কৌটা বা বাটির শব্দ কইরা উব্বুত অইয়া ভিক্ষা করে, সেইখানে। আমরা ভাইরা চিনতে পারি নাই। পারমু কি কইরা? যক্ষা অইছিল তো। পেরায় শ্যাষ অবস্থা। মায় চিনছিল। উঠাইয়া নিয়া আসলাম সবাই ধরাধরি কইরা। সারা শরীল জ্বরে বেতাবুদ তখনও।'
— 'কোথায় নিলি? মানে থাকতি কোথায়?'
— 'ওই রাব্ড়ির দোকানটার কোনের দিকের গলির এক্কটা পুরাণা ধর্মশালার বাড়ির একতলার এক পাশে। এখানের ভিখারিরা ওখানেই রাইত কাটাইত। তার মইদ্যে আবার বদমাইশ, লম্পট, নেশাখোরদেরও অভাব নাই। দুই ভাই পালা কইরা মায়রে পাহারা দিয়া তার সতীত্ব রক্ষা করতাম। তার মইদ্যেই বাবারে আইনা ফেলাইলাম।'
— 'কথাবার্তা কিছু কইতেস না?' আশুদার প্রশ্ন।
— 'ওই মায় জিগাইলে যতটুকু না কইলে নয় ততটুকুই। কথা কওনের মত অবস্থা আছিল না। কওনেরও কিছুই আছিল না বোধহয়।'
— 'ওই মহিলার কি অইল? কইছিলেন নি কিছু?'