‘আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,/ আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ায় গান!’
বিশ শতকের বঙ্গসমাজের আলো, শিক্ষিত ইলেক্ট্রিসিটির বিচ্ছুরণ। উনিশ শতকের দেওয়ালগিরির বাতির মিটমিটে কমনীয়তাকে সে পিছনে ফেলে এসেছে। এ সমাজে বদল এসেছে আধুনিকতার বহিরঙ্গে নয়, সমাজ মানসের অন্তরঙ্গেও। তাই এসময় দলে দলে দেখা পাই হরিপ্রভা, দুর্গাবতী, শরৎরেণু, সরলা কিম্বা অমলাদের! এঁরা চিরকালই ছিলেন সমাজের আভূষণ হয়ে, শুধু বিশ শতকের প্রায় গোড়ার দিক থেকেই এঁদের প্রতি সমাজ-আচরণের, সমাজ-মানসিকতার বদল দেখতে পাই। দেখতে পাই এঁদের ঈপ্সার বাস্তব প্রতিফলন এবং তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আম এবং মহৎ, মূলত সামগ্রিক বঙ্গচেতনার একটি নব্য বিকাশ।
আমাদের লেখায় নির্দিষ্টভাবে যে হরিপ্রভা তাকেদা, দুর্গাবতী ঘোষ, শরৎরেণু দেবী বা অমলা-অপরাজিতা, সরলা দেবী চৌধুরানীর কথা আমরা বলব, তাঁদের কাউকেই বেড়াতে যাওয়ার জন্য, শুধু ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া বাইরে যাওয়ার কারণে কখনই কৃষ্ণভাবিনীর মতো লাঞ্ছিত হতে হয়নি, উল্টে তাঁরা বেড়িয়ে এসে যখন তাঁদের নতুন চোখে আমেরুপর্বত-সসাগরা এই পৃথিবীকে দেখাশোনার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের ভ্রমণকথায় তখন দিকে দিকে উঠেছে হাততালি, অনেক ক্ষেত্রেই বয়েছে প্রশংসার বন্যা। আবার কিছু ক্ষেত্রে সে উচ্ছ্বাসের ঢেউ কূলপ্লাবী না হলেও অস্বীকৃতির দুর্বিনয় দেখা যায়নি কখনো। বরং তাঁদের ভ্রমণের এই নতুন আনন্দ সঞ্চারিত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে, যারা কিনা চিরকালের পরাধীন এবং অবলা (তখনো পর্যন্ত জীবনে, কর্মে ও ভাবনায়)।
এই মেয়ের দলে বেশিরভাগই ‘মহিলা’, কেউ কমবয়সী তাই স্বামীর সঙ্গিনী, কেউ কর্মক্ষেত্রে স্বামীর সহগামিনী আবার কেউ বা রাজনীতির আঙিনায় একক নেত্রী হিসেবেই সমুদ্রযাত্রার নিশান-বাহিনী। শুধু একটি মাত্র ছোট মেয়ে বিলেত (বড় অর্থে য়ুরোপ ) গিয়েছিল তার বাবার সঙ্গে। বয়সের গণ্ডী নির্বিশেষে এঁদের সকলের এই প্রথম সমুদ্রযাত্রার গল্পে তাই ঘর হইল বাহির, বাহির হইল ঘরের কথা। আর প্রতিবারই সেখানে একটি প্রাথমিক প্রধান স্থান অধিকার করেছে জাহাজের বর্ণনা, সমুদ্রের রূপ-রস-নোনা হাওয়ার নেশা, সমুদ্রপীড়া আর জাহাজের ইংরেজ বা বিদেশী কর্মচারীদের আমাদের দেশীয় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারিক আচরণ।
যেমন প্রথমে হরিপ্রভা তাকেদার (১৮৯০-১৯৭২) কথাই ধরা যাক। হরিপ্রভা বসুমল্লিক ঢাকার মেয়ে। সেখানেই বিয়ে করেন জাপানি মানুষ, ঢাকাপ্রবাসী ওয়েমন তাকেদা-কে। ওয়েমনের সঙ্গে জাপানের বাঙালি বধূর প্রথম জাপান যাত্রা ১৯১২ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছর দুই আগে। হরিপ্রভা পরে জাপান গিয়েছেন বহুবার, মূলত শ্বশুরঘর করতে এবং সঙ্গে বেড়াতেও। এমনকি পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও তিনি জাপানে গিয়েছিলেন পরিবার, সম্পত্তি এবং দেশের অবস্থা নিরীক্ষণে যার বিশ্বস্ত দলিল তাঁর লেখায় রয়েছে। কিন্ত এক্কেবারে প্রথমবার জাপান যাত্রার সময়ে জাহাজি অভিজ্ঞতা তাঁর কেমন ছিল সেটা তাঁর জবানীতেই শোনা যাক: ‘ ৬ই নবেম্বর—ভোর ৫টার সময় জাহাজ ছাড়িল। বোঝা যায় না যে জাহাজ চলিতেছে। ...এই দেশ ছাড়িয়া চলিলাম। বাহিরে ডেকের উপর দাঁড়াইয়া কলিকাতার শেষ দৃশ্যগুলি দেখিতে লাগিলাম। মনটা খুব খারাপ বোধ হইল। ...প্রায় ৬০০ ছাগল ভেড়া এই জাহাজে করিয়া সিঙ্গাপুর যাইতেছে। সেইগুলি আমাদের খুব নিকটে। বাথরুমে ঐগুলির পাশ দিয়া যাইতে হয়। আর আমাদের ঘরের পাশে জাহাজের ভাঁড়ার ঘর। খাদ্যদ্রব্যাদি সব এই ঘরে থাকে। সে ঘরে বোধ হয় শুকনো মাছ আছে। এই দুইয়ের গন্ধে আমরা আর টিকিতে পারি না। ... খাওয়ার পর মুখ ধুইতে যাইবার সময় ক্ষুদ্র জানালা দিয়া দেখি, এখন জল ঘোর সবুজ—নীলাভ। বুঝিলাম এবার সত্যসত্যই সমুদ্রে পড়িয়াছি। ভারী আনন্দ হইল...বৈকালে এস্রাজ বাজাইলাম। বসিবার স্থান নাই। বিছানায় বসিলে উপরে মাথা ঠেকে। উপরের ডেকে অনেক লোক, নীচে ছাগল। ...’ [‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’, হরিপ্রভা তাকেদা, ১৯১৫, ঢাকা] হরিপ্রভা ঢাকা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন জাহাজে আর কলকাতা থেকে জাপান যাওয়ার পথে রেঙ্গুন পেরিয়ে যাওয়ার পর জাহাজের ক্যাবিনে কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করেছিলেন; কিন্তু একথা আপাতত তুলে রেখে পড়া যাক শরৎরেণু রায়-এর জাহাজি দিনের অভিজ্ঞতার কাহিনী।
শরৎরেণু দেবী (রায়) রচিত ‘পারস্যে বঙ্গ-রমণী’ ১৯১৬ সালে লেখা ভ্রমণকথা। এ-কথায় ভ্রমণের চেয়েও বেশি আছে ভ্রমণপথের কথা, জাহাজের কথা, এবং বিশেষতঃ ভ্রমণ সংক্রান্ত সমগ্র ব্যবস্থাটির সামূহিক অব্যবস্থার কথা। শরৎরেণু অত্যন্ত সাধারণ বাঙালি ‘ভদ্রমহিলা’, স্বামীর সঙ্গে যাচ্ছেন পারস্যে (আমাদের এখনকার মিডল্ ইস্ট), যাত্রাপথ তাই অন্য অন্য ভ্রমণকারিণীর থেকে একটু ভিন্ন; করাচী - মাস্কাট – বুশায়ার – মেহোমেরা (আজকের দিনে ইরানের খোর্রামশাহর) - আওয়াজ। এখানেই ‘Persian Oil Company’–র অতি সামান্য কর্মচারীর স্ত্রী-এর স্থিতি। শরৎরেণু বলছেন, ‘আমাদের জাহাজখানি তিনতলা। একতলায় ডেক – যাত্রীগণের ও খালাসীদের থাকিবার স্থান। ... ডেকের যাত্রীগণকে উপরের twin deck–এ hatch–এর উপর বা foredeck-এও যাইতে মানা ছিল না; তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদিগের বসিবার বা বেড়াইবার স্থান একেবারেই ছিল না, কারণ দ্বিতীয় শ্রেণীগুলি এঞ্জিন ঘরের পিছনে বলিয়া ভয়ানক গরম।... দ্বিতীয় শ্রেণীতে একটিও berth খালি ছিলনা। আমাদের নাম লেখা berthগুলিও অন্যলোক আগে হইতে আসিয়া দখল করিয়াছিল। Steward, এমনকি Chief Officer-কে বলিয়াও আমরা আমাদের berth পাইলাম না।…’ পথে আরও নানা বিপত্তির ফিরিস্তি আছে শরৎরেণুর লেখায়। কখনো অসুস্থতা, কখনো গাছতলায় রাত কাটানোর বন্দোবস্ত, কখনো স্বামীর অসুস্থতার, কুলী না থাকায় নিজেদের সমস্ত মালপত্র অসহায়ভাবে বহন করা, চারপাশের নতুন মানুষজনের অল্প ফিরিস্তি এবং আবার মেহোমেরা থেকে আওয়াজ যাত্রাপথে জাহাজের নরক-দর্শন বর্ণনা। সমস্তটাই বিলাস বা আরামবিহীন দুর্ভোগের মর্মান্তিক চিত্র। তবু তারই মধ্যে জেনে নিচ্ছেন এবং জানিয়ে দিচ্ছেন লেখিকা বাজারে নানারকম খেজুরের কথা, মরুভূমির মতো বিশাল মাঠ আর ‘কারূণ’ নদীর কথা, পার্সিয়ান ও আরবী সহনাগরিকের কথা… ‘ … কি ধনী কি গরীব সকলের নিকটেই বন্দুক থাকে। রাস্তায় যখন তাহারা চলাফেরা করিয়া বেড়ায়, তখন বন্দুক তাহাদের সঙ্গেই থাকে।' লেখার দ্বিতীয় পর্বের শেষে আরও পারস্যকাহিনী শোনানোর কথা শরৎরেণু রেখেছিলেন বলে মনে হয়না। তাঁর আর কোনো লেখার সন্ধান মেলেনি; এই একটিমাত্র গরিবানা লজ্জা আর আতঙ্কের ছিটে মাখানো বিদেশ বেড়ানোর গল্প ছাড়া। এর আরও দেড় দশক পরে কাছাকাছি সময়ে (বিশ শতকের তিনদশকে) জাহাজেই য়ুরোপ পাড়ি দিচ্ছেন দুর্গাবতী ঘোষ এবং অমলা নন্দী।
আর জাহাজে চড়ে একা একা বার্মা (মায়ানমার) যাচ্ছেন সরলা দেবী চৌধুরানী। ঘুরতে যাচ্ছেন না কিন্তু লিখে ফেলছেন আস্ত একটি ভ্রমণ কাহিনী ‘বর্ম্মা-যাত্রা’! সরলাদেবী সে সময় জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে এক সুপ্রতিষ্ঠিত নাম। বিদূষী বলে খ্যাতি তাঁর চিরকালই ছিল। তাই তাঁর দেওয়া জাহাজ-যাত্রাপথের অতিবাহিত দিনগুলি সমুদ্রতরঙ্গের দোলায় বা sea sickness-এর কবলে পড়ে খাবি খাওয়ার গল্পই নয় কেবল। জাহাজে সহযাত্রীদের ছোটখাটো আচরণ তাঁর মনকে দোল দিয়ে যায় ... ‘...একটিমাত্র দম্পতি পরস্পর কথোপকথনে নিযুক্ত ছিল। পতিটিকে কিছুতেই য়ুরোপীয় মনে হল না, গৌরাঙ্গ বটে, -- পুরো সাহেবী পোষাক, হাবভাব, উঠা-বসাও বটে। কিন্তু তবু মুখে এমন একটা কি দুর্বলতা মাখানো ছিল, যাতে স্বাধীনচেতা লোক বলে মনে হয়না। পরে জানতে পারলুম যে ইহূদি—রেঙ্গুনে তার অতি নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে তার মেমবধূ পরিগ্রহের ইতিবৃত্তও জানতে পেরেছিলুম। জাহাজে দম্পতির আচরণ একেবারে আদর্শ সদ্য বিবাহিত নূতন প্রেমিক-প্রেমিকার মত। সর্বদাই দুজনে নিরালায় বসে আছে। দুপুর বেলা ‘লাউঞ্জে’ (আরাম গৃহে) মেমবধূ একখানি কৌচে নিদ্রিতা, মাথার কাছে চৌকি টেনে বসে বর খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তার রক্ষকতা করছেন। তাঁদের আশেপাশে অন্য কৌচে বা চেয়ারে অন্য যাত্রীরা স্ব স্ব পাঠে ব্যাপৃত। বউ যদি ডেকে না উঠেন, বরেরও দেখা পাওয়া যায় না।’ চমৎকার সপ্রতিভ ইঙ্গিতময় বর্ণনা। ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতির বহুপ্রচল রসবোধের ধারাটিও অক্ষুণ্ণ। প্রাদেশিক হিন্দু কনফারেন্সের বিধবা, সাবলম্বী সভানেত্রীর মানসপটে প্রতিফলিত অধুনা মায়ানমারের তৎকালীন ধর্ম, মানুষ, জাতিগত দাঙ্গা, বর্মি মেয়েদের রূপসজ্জা-পোশাক, নব্য বর্মি যুব সম্প্রদায়ের রাজনীতি, শিক্ষা, রুচির ধ্যানধারণা এবং বর্মা-স্থিত শিক্ষিত উচ্চবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায়ের মননের ছবি সরাসরি এঁকেছেন সরলা তীক্ষ্ণ লেখনে।
উদাহরণ :
১।‘আমার সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্যে বার্দূন সাহেব সেদিন তাঁদের দেশের চারপাঁচ নব্য যুবতীকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান, আবাল্য মিশনারিদের হাতে মানুষ, কলেজে পাশকরা—নাকে চোখেমুখে কথা কন...এমন হাসিমুখী, জীবন্ত, প্রাণবন্ত মেয়ে উপস্থিত সবাইকেই প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রাচ্য সমাজের আদর্শ তা হয়ত নয়; কিন্তু মনুষ্য সমাজে সেটা সর্বত্র আদরণীয়। মেয়েটি শীঘ্রই গবর্নমেন্টের বৃত্তি নিয়ে বিলেত যাবে — বিলেতের সমাজে সে নিজের মার্কা মারতে পারবে সন্দেহ নেই। ...‘একটি বিবাহিত বর্মিজ মেয়ে স্বামীসহ সে ডিনারে উপস্থিত ছিল। সে একেবারে চুপচাপ। শুনলুম বিবাহের পূর্বে সে খুব চটকদার ও কইয়ে-বলিয়ে ছিল। ভদ্র বর্মিজ পরিবারের রীতি অনুসারে বিবাহের পর তাকে এ রকম মৌন স্থবিরভাব ধারণ করতে হয়েছে।’২। ‘বর্মায় প্রত্যেক পাগোডা বা ‘ফয়া’র সংলগ্ন বিহার বা ‘ফুদিচং’ আছে; সেখানে শতশত ফুঙ্গি বা বৌদ্ধ-সাধু বাস করেন। এই সকল সাধুদের আহারের ব্যয় সমস্ত গৃহস্থেরা বহন করেন। ... অনেক সময় অনেক ডাকাত সাধু-আবাস গুলিতে আশ্রয় গ্রহণ করে; দিনের বেলায় ভিক্ষুর বেশ ধারণ করে ফুদিচঙে লুকিয়ে থাকে, রাত্রে সুযোগ হলেই ডাকাতি করতে বেরোয়।’
৩। ‘রেঙ্গুনে প্রবেশের দ্বারস্বরূপ বন্দরখানা ছোট। এক একজন মানুষের নিরীহ চেহারার পিছনে যেমন কখন কখন একটা প্রচণ্ড জীবন- ইতিহাস প্রচ্ছন্ন থাকে, এই বন্দরের পিছনে সহরখানাও তেমনি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। বাইরে থেকে তার কোন আভাষ পাওয়া যায় না। ডক পেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লেই প্রথমত দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের মতোই কেবল অর্ধ-উলঙ্গ, মাথার সামনেটা কামান, পিছনে বেনে খোঁপা বাঁধা বা ঘাড়-পর্যন্ত-লম্বমান চুল মাদ্রাজী কুলি ও রিক্শ-ওয়ালার দল। এক বৎসর পূর্বে এদেরই সঙ্গে বর্মী কুলিদের ভীষণ দাঙ্গা হয়ে গেছে, যেমন সে বছর ঢাকায় পুলিসের চোখের উপর হিন্দু ও মুসলমানে দাঙ্গা হয়েছিল।’
বলার কথা আর সুচিন্তিত মতামতের ঝুলি ভরে পাঠকের প্রত্যাশা এমনি করেই জাগিয়েছিল দুর্গাবতী ঘোষের লেখা ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী, যা পরে ‘পশ্চিমযাত্রিকী’ নাম নিয়ে বই হয়ে বেরোয় (১৯৩৬)। বাংলার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী- চিকিৎসকএবং অন্যধারার সাহিত্যিক গিরীন্দ্রশেখর বসুর কন্যা দুর্গাবতী। সন্তানহীনা দুর্গাবতী স্বামী রবীন্দ্র চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে ১৯৩২ সালে য়ুরোপ পরিক্রমা করেন। পথের শুরুতে রেল এবং জাহাজ পথে ভ্রমণ। যথারীতি অসুস্থতা এবং MV Victoria জাহাজের ভিতরকার বর্ণনা। দুর্গাবতীর তেজস্বী ভাব তাঁর লেখাকে স্বতঃস্ফূর্ত করেছে : ‘খাওয়া সেরে বাইরে ডেকে এলুম। এসেই সমুদ্রের হাওয়াটায় কেমন একটা আঁসটে গন্ধ ও গরমভাব পেলুম। খাবার ঘরটি সব কুলিং সিস্টেমে তৈরি। ভিতরে খানিকক্ষণ থাকলে বাইরে গরম অনুভব করা যায়না। ডেকে খানিকটা হেঁটে বেড়াব মনে করলুম কিন্তু মাথাটা ঘুরতে লাগলো; বিরক্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে একটা গদিওয়ালা চেয়ারে ব’সে রইলুম। স্টুয়ার্ড সামনে কফির পেয়ালা এনে হাজির। তাকে বলে দিলুম আমার ওসবে দরকার নেই। সে চলে গেলো। যাবার সময় দুবার ফিরে ফিরে আমায় দেখে গেল। বিরক্ত হলুম, আ ম’লো যা, আমি একটা হাতী না ঘোড়া? এত দেখবার কি আছেরে বাপু। মরছি নিজের জ্বালায়! একটু পরেই দেখি যে তার কফির ট্রে রেখে একটা প্লেটে ক’রে কয়েকটি পাতিলেবু ও বরফের টুকরো নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে গেলো ও এবারে ফিরে যাবার সময় সামনের জানালাটা ভালো করে খুলে পর্দ্দা সরিয়ে দিয়ে গেলো যাতে মুখে বেশ হাওয়া লাগে আর বরফের কুচি মুখে রাখবার জন্য ব’লে গেলো। তখন বুঝতে পারলুম আমার যে গা বমিবমি করছে, সেটা ও আগে আগেই টের পেয়েছিল, কাজেই যাবার সময় অত দেখছিল। এসব কাজে এরা খুব তৎপর।’ দুর্গাবতীর ভাবনা মৌলিক, উপমাচয়ন অনন্য। প্যারিসে রাত্রিকালীন নৃত্যশালায় নর্তকীর নাচ দেখে লিখছেন, ‘খুব ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির এক পুরাতন ঝিয়ের মুখে গল্প শুনেছিলুম, পেরথম পক্ষের ইস্তিরি স্বোয়ামীর পাতে ব’সে খায়, দ্বিতীয় পক্ষের সাথে ব’সে খায়, আর তৃতীয় পক্ষের হ’লে একেবারে কাঁধে চড়ে খায়। এখন এই নাচ দেখে মনে হ’ল যে- কোন পক্ষের স্ত্রী হোক, শুধু খাওয়া কেন, এদের মত শরীর সুগঠিত হ’লে বোধ হয় কাঁধে চড়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ করতেও পারা যায়।’ লন্ডনে দুর্গাবতীরা গিরীন্দ্রশেখর বসুর বন্ধু বিখ্যাত মনোবিদ্ ডক্টর আরনেষ্ট জোনস্ এর সঙ্গে দেখা করেন। লন্ডনের সব কিছুই নির্বিচারে ভালো বলতে বারে বারে ভেবেছেন দুর্গাবতী। কৃষ্ণভাবিনীর প্রণোদনা আর দুর্গাবতীর অনুপ্রেরণা যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে, ফল স্বরূপ বিচার ক্ষমতার অপক্ষপাত আত্মপ্রকাশ তাঁর লেখায়, লন্ডনে , ‘ একদিন বাসে করে কোথায় যাচ্ছিলুম। পাশে এক ইংরেজ মহিলা তাঁর ছোট ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলেটি খেলা করতে করতে তার গালে কি রকমে একটু কাদা লাগিয়ে ফেলেছিল। শিক্ষিতা জননী তৎক্ষণাৎ তাঁর রুমাল বার ক’রে নিজের মুখের থুথুর দ্বারা এক কোণ ভিজিয়ে ছেলের গালের কাদা তুলে দিলেন। ...খামের উপর টিকিট মারা, ওভার্কোটের দাগ ওঠান, খাম বন্ধ করা ইত্যাদিতে ভদ্রলোককেও থুথু ব্যবহার করতে দেখেছি। এরাই সভ্য ও শিক্ষিত ব’লে অহঙ্কার করে। আমাদের দেশের ধাঙ্গড় ও মেথর-- যারা অনবরত ময়লা পরিষ্কার করছে—তাদের ভেতরেও বোধ হয় থুথুর দ্বারা ছেলের মুখ মোছান, নিজের হাত ধোওয়ার ইচ্ছা কোন দিন হবে না।’ এমন মণিমুক্ত অনবরত ছড়ানো ‘পশ্চিমযাত্রিকী’র পাতায় পাতায়। এই ভ্রমণকথার আর একটি বড় পাওনা পিতৃবন্ধু ডক্টর সিগ্মুণ্ড্ ফ্রয়েডের সঙ্গে ভিয়েনায় দুর্গাবতীদের মজাদার সাক্ষাৎ। এমনকি সেখানে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে বাঙালি মেয়ের পরিধান বারো হাত শাড়ির তেরো হাত গল্প! ইতালিতে ‘আমরা রাস্তায় বেরলে মেয়ে পুরুষের ভিড় লেগে যেত। সবাই বলত ‘ইন্দিয়ানো’।’
প্রায় একই সময়ে ছোট ছোট এমন একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি কুমারী অমলা নন্দীর রচনায়। অমলা বারো বছর বয়সে ছয় মাসের জন্য তার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল প্যারিসের ‘ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এক্সপজিশন’ শিল্পমেলায় যোগ দিতে ১৯৩১-এ। তার বাবার ছিল তৎকালের বিশিষ্ট গয়না প্রস্তুতকারকের দেশজোড়া পরিচিতি। ১৯৩৩এ দেশে ফিরে এসে কুমারী অমলা তার এই সুদীর্ঘ দু’বছর য়ুরোপ ভ্রমণের উপর যে বই লেখে ‘সাত সাগরের পারে’ নাম দিয়ে, তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু হেন ব্যক্তি (প্রসঙ্গক্রমে আগ্রহী পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণভাবিনী-বিরোধিতার কথা!)। অমলার বাবা অক্ষয় কুমার নন্দী এই বইয়ের ‘গ্রন্থসূত্রে’ লিখছেন, ‘... যাত্রাকালে যে কন্যা প্যারিস বলিতে পারস্য দেশ বুঝিয়াছে, মাত্র ছয়মাস ইয়োরোপবাসের পরেই তাহাকে বলিতে শুনিয়াছি,-- ‘আমি এখন একাকী পৃথিবী ভ্রমণ করিতে পারি।’’ এই য়ুরোপ ভ্রমণের ফলে কুমারী অমলা শুধুমাত্র পৃথিবীর পথে ভয়-রহিত হয়ে চলতে শিখেছিলেন তাই-ই নয়, ছ’মাসের জন্য বেড়াতে গিয়ে দু’বছর পৃথিবীর নানা দেশে কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন সুবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ‘অপরাজিতা’, ভবিষ্যতের শ্রীমতী অমলাশঙ্কর হয়ে। বেড়াতে গিয়ে এমন উত্তরণ ঔপনিবেশিক বাঙালিনীর জীবনে শুধু দুর্লভ-ই নয় অভূতপূর্ব ঘটনা বৈকি। এখানে কুমারী অমলার সারল্যমাখা চোখে দেখা বহিঃপৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ সমকালীন দুর্গাবতীর পরিণত চোখের থেকে ভিন্নমেরুর সুবাতাস বয়ে আনে পাঠকের মনে। অমলার জাহাজ ভাগ্য একটু অন্যরকম খুশিতে মোড়া। তাড়াতাড়িতে টিকিট করতে হয়েছিল তাই টোকিও-ইয়োকোহামা, কোবে-মজি-সাংহাই-হংকং-পেনাং হয়ে একটু ঘুরে কলম্বো আবার সেখান থেকে এডেন- পোর্ট সইদ-নেপল্স হয়ে ট্রেনে প্যারিস। সদ্য কৈশোরক অমলার মনে হয়, ‘...এ সমুদ্রের উপরে নীল আকাশ নীচেয় নীল জল। ...মনে হ’ত এ জল যদি এমন গাঢ় নীল না হ’য়ে স্বচ্ছ হ’ত, তবে আমি অনায়াসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে পারতাম!’ এরপর কিশোরীর সব থেকে বেশি মন টেনেছে যা, তা প্যারিসের কলোনিয়াল এক্সজিবিশন। ভারতীয় বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ‘Pavilion de Hindoustan’ নামক এক অট্টালিকা, যার একদম প্রথম স্টলটি ছিল অমলাদের। ছ’মাস ধরে এই প্রদর্শনীর আলো হাওয়ার ইশারা আঁকড়ে ধরে অমলার মন অভিযোজিত হতে থাকে কতকটা বা মনের অগোচরে। তার দিনরাতের মজা, ভাষাশিক্ষার ক্লাস, প্রথমদিকে ফরাসী না বলতে পারার অসুবিধা এইসব কিছুই কয়েকদিনের মধ্যেই আয়ত্তে চলে আসে। আয়ত্তে আসে ভদ্র বাঙালি লক্ষ্মীমেয়ের দেশ ভ্রমণের, মেধা প্রদর্শনের ঈপ্সা। জগতের হালচাল সম্পর্কেও জ্ঞান হয়েছিল টনটনে। তাই প্রদর্শনী সম্পর্কে অমলা লিখছে, ‘প্রায় প্রত্যেক প্যাভিলিয়নের লোকেরাই আমাকে চিনে ফেলেছিলেন। আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেই, নানারকম উপহার দ্রব্য দিয়ে আমাকে খুশি করতেন। যখন আমাদের স্টলে থাকতাম, তখন অনেক গ্রাহক আমার হাতে জিনিস কিন্তে চাইতেন, তাঁরা বলতেন ভারতীয় এই লক্ষ্মী (lucky) মেয়েটির হাতের দেওয়া জিনিসটি আমার ঘরে থাকবে। … একটি ভারতীয় ছাত্র আমাদের স্টলে এসে, আমাদের স্টলের মেয়েদের সঙ্গে গল্প করে বৃথা সময় কাটাতেন। আমি মিস্ হেলেনের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁকে একদিন এমন জব্দ করেছিলাম যে, তা মনে পড়লে আমার বড় হাসি পায়। ... কাজটি যতই আমাদের মন্দ হোক না কেন, যুবকটির বেশ আক্কেল হয়েছিল। তিনি আর বড় বাজে গল্প করে সময় কাটাতে আসতেন না।’ আবার উদয়শঙ্কর ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা এবং পরিচিত হওয়ার পর যখন নাচের দলে অমলাকে ডেকে নেন উদয়শঙ্কর তখন দু’বছর ধরে শুধু য়ুরোপই নয়, সারা পৃথিবী চষে বেড়ায় কিশোরী অমলা নন্দী, বাবাকে ছেড়ে থেকে যায় নাচের দলের সঙ্গে। মাকে তার মনে পড়ে, চিঠি লেখে। আর চুটিয়ে উপভোগ করে নতুন জীবন। ‘.....কত ফটোগ্রাফার আমাদের ফটো নিল, কত সিনেমাওয়ালা আমাদের গতিবিধি ও ষ্টেশনের জনতার চলচ্চিত্র তুলে নিল। নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছতেই রিপোর্টারগণ এসে আমাদের ঘিরে ধরল। এবার রিপোর্টারগণের ধুমধাম বড় বেশি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে তারা আমাদিগকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল, যা-তা হিজিবিজি প্রশ্ন—আমাদের উত্তরও তেমনি। সে সবই তাঁরা কাগজে বের করলেন।’... ভারতীয় শাড়ি পরার ধরন, সিঁদুর ও আলতার ব্যবহার এসবও কাগজওয়ালাদের প্রশ্নের তালিকায় থাকতো, কুমারী অমলা নন্দীর ভ্রমণ কাহিনী তার সাক্ষ্য দেয়!
উপনিবেশের এই অনন্যা কন্যারা কেবল ভ্রমণ করে কাহিনী লিখেছেন তা মাত্র নয়। হরিপ্রভা তাকেদার মত মানুষ দেশের বিপদে, সাধারণত রাজনীতির থেকে শতহস্ত দূরে থাকা জীবন কাটিয়েও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে গিয়েছেন; থেকে গিয়েছেন সুদীর্ঘ সাত বছর; অসুস্থতা, যুদ্ধবিধ্বস্ততার সঙ্গে লড়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে। বোমাবর্ষণে বাসভূমি চূর্ণ হয়ে গেলে টোকিও শহরে হোটেল ভাড়া করে থেকেছেন, দেখেছেন প্রিয়জনের অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু। আর তারই মধ্যে ‘আজাদ হিন্দ’ বাহিনির রেডিও স্টেশনে গিয়েছেন সংবাদ পড়তে প্রায়ই পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে রাত্রিবেলায়। সঙ্গে থাকতো পাসপোর্ট আর সামান্য কিছু গয়না। এসবই লিখে গিয়েছেন জাপানের অপর একটি আলেখ্যে। সরলা, অমলা, দুর্গাবতী, শরৎরেণু সকলের মধ্যেই এমন অসমসাহসিক না হলেও স্বাজাত্য বোধ প্রখর, তাদের মানসিকতা থেকে লিখিত ভ্রমণকথা--সর্বত্রগামী। তার তীব্র আলো এক শতক পরেও চোখ ধাঁধায়।