প্রযুক্তি ও নারী; তৃষ্ণা বসাক; গাঙচিল, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১১, ISBN 978-81-85479-61-5
বইটা পড়ে মনে হল এরকম একটা বইয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
বইটার কোনো ব্লার্ব নেই - যে আগেই একটু দেখে নেব কি ধরনের বই। তৃষ্ণা বসাককে গল্পকার হিসেবেই জানি। সূচীপত্র দেখে মনে হয়েছিল কয়েকটি নারীবাদী প্রবন্ধ রয়েছে। সুতরাং প্রথম থেকে না পড়ে 'গেরস্থালির গ্যাজেট : গলদ কি গোড়াতেই??? প্রবন্ধটা পড়ি। পড়তে গিয়ে মনে হল আমি তো এক সময় এই বিষয় নিয়েই গল্প লিখেছি। 'লজ্জামুঠি' তে লিখেছিলাম একটি মিক্সি মেশিন কিভাবে কোনো মহিলার সতীন হয়ে ওঠে, প্রতিযোগী হয়ে ওঠে। যন্ত্রের সঙ্গে কি ভাবে লাভ অ্যাণ্ড হেট সম্পর্ক তৈরি হয়। এর পরে 'যন্ত্রপাতি', 'এ জীবন লইয়া কি করিব' এই সব গল্পেও দেখাতে চেষ্টা করেছি যন্ত্রের জন্য মেয়েদেরই তৈরি করতে হচ্ছে ঢাকনা, সেই ঢাকনায় ফোটাচ্ছে সুতোর ফুল। সেলাই মেশিনে তেল ঢেলে, ফ্রীজের বরফ পরিষ্কার করে, ওয়াশিং মেশিনের ড্রয়ার সাফ করে, মাইক্রোওয়েভের কাচ পরিষ্কার করে, ডিফ্রস্ট করে ..। এগুলো এখনো যেন মেয়েদেরই কাজ। এবং এইসব কাজকর্ম করা যেন আধুনিকতার লক্ষণ। যন্ত্রের সঙ্গে নানাবিধ সম্পর্কের তন্তু তৈরি হচ্ছে এমনটাই মনে হয়েছিল ১৯৮৫-১৯৯৫ সালে লেখা গল্পগুলিতে। 'সতর্কতামূলক রূপকথা' বইতে এরকম কয়েকটি গল্প আছে। বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে নিজের লেখা গল্পকে টেনে আনা শোভন নয়, কিন্তু একারণেই বললাম - গল্পের তত্ত্বরূপ পেলাম ঐ প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি পড়ার পর ভূমিকাটি পড়ি। পড়ে বুঝি এই গ্রন্থটি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধসমষ্টি নয়, এটি একটি গবেষণাপত্রই এবং প্রবন্ধগুলি চ্যাপ্টারের নাম। নারীর সঙ্গে যেভাবে যন্ত্র ও যন্ত্রব্যবহার যুক্ত হ'ল, প্রযুক্তি নারীকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে এবং নারীও প্রযুক্তিকে - এই ব্যাপারটাই ধরার চেষ্টা করেছেন তৃষ্ণা বসাক, পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই আমাদের এই দেশ। এই কলকাতাদ-কেন্দ্রিক বাংলা।
আবার ব্যক্তিগত কথা বলি। বাড়িতে যখন রেডিও এলো, ঠাকুরমাকে রেডিও চালাতে দেখিনি। আমার মা চালাতেন। আমার মাকে মাইক্রোওভেন, গ্রীল, কম্বো - এসব বোঝানো কঠিন ছিল, আমার স্ত্রী মোটামুটি বুঝে যান। আমার মেয়ে কম্পিউটার বোঝে, কিন্তু আমার স্ত্রী বোঝেন না।
অথচ রেডিও চালানো তো কোনো ব্যাপার ছিল না। শুধু সুইচ ঘুরিয়ে দেয়া। ঠাকুরমার হাতে কি যন্ত্র ছিল না? কি সুন্দর তক্লি ঘুরিয়ে তুলো থেকে সুতো বার করতে পারতেন, সেই সুতো দিয়ে বড়দের পৈতে হত। ঠাকুরমা ঠিকই সুইচটা ঘুরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু ঠাকু্রমাদের মনের ভিতরে গাঁথা ছিল মেয়েদের এসব করতে নেই, যন্ত্রপাতিতে হাত দিতে নেই। সাঁড়াশি, খুন্তি, কোরানি এগুলোও যে যন্ত্র এবং এসব যন্ত্র চালনা ও নিয়ন্ত্রণে ওদের পারদর্শিতা অসাধারণ - এই বোধটাই ছিলনা। ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনেছিলাম - দাদুর প্রেরণায় ঠাকুরমা শ্লেটে অক্ষর লিখতেন। দাদুর বড় ভাই অক্ষর অলংকৃত শ্লেটপাথর দেখে ফেলে বলেছিলেন 'সব নোড়াই শালগ্রাম হইলে বাটনা বাটবো কিসে?' আন্দাজে বলছি, ঠাকুরমার বিবাহ হয়েছিল ১৮৯৪-৯৫ নাগাদ!
এই সবই মনে পড়ছে তৃষ্ণা বসাকের বইটির সুবাদে। শুরুর প্রবন্ধ - 'যন্ত্র যখন পরপুরুষ'; গঙ্গার ধারে একটা উইণ্ডমিল-এর উপর সমাজ কর্তাদের রাগ। ঐ চাকা উপরে উঠলে তো ঘরের উঠোন দেখা যাবে। তাহলে প্রাচীরের কী লাভ? গোকুল ঘোষ নামে একজন মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। তখন ঘোড়া দেখেও ঘোমটা টানতেন কুলবালারা। পালকি সমেত গঙ্গায় চুবিয়ে গঙ্গাস্নান করানো হত। তৃষ্ণা বসাক সে সময়ের স্বল্প শিক্ষিত মহিলাদের হা হুতাশ শুনিয়েছেন। বন্ধ করে দেওয়া জানালা খোলার আকুতিও দেখলাম। 'বামাবোধিনী', 'ভারতী' এসব পত্রপত্রিকার অবদান উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঢাকা পালকির পথ যখন বেঁকে গেল মেয়ে ইস্কুলের দিকে, তখনো মেয়েদের হাহুতাশ ছিল না - জ্যামিতি, লজিক বা ফিজিক্স পড়ার। মেয়েদের জন্য যে পাঠ্য প্রস্তুত ছিল, তা ছিল আদর্শ গৃহিণী হবার জন্য, যে মুদি দোকানের ফর্দ পড়তে পারবে, স্বামীকে চিঠি লিখতে পারবে শ্রীচরণকমলেষু সম্বোধনে। 'প্রাণনাথ' নভেলে লেখা হলেও আমাদের মেয়েদের কলমে সহজে আসেনি।
তৃষ্ণা বসাক দেখিয়েছেন এরপর কিভাবে পাঠ্যসূচীতে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রবেশ ঘটল। রবীন্দ্রনাথও একসময় ভেবেছিলেন "ঘরেই নারীর সিংহাসন। সেখানেই তাদের রাজত্ব, প্রকৃতিদত্ত কাজের স্থান"। 'প্রকৃতিদত্ত' শব্দটা আণ্ডারলাইন যোগ্য। নারীমস্তিষ্ক বিজ্ঞান ও অঙ্ক শেখার উপযোগী নয় এরকম একটা মত বেশ প্রবল ছিল। মেয়েদের ঘরে থাকাই বিজ্ঞান - এই ধারণার বশবর্তী ছিলেন অভিভাবক সমাজ।
দেশীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রায় শেষ হয়ে যায় মুসলিম আমলে। ধাইদের কাছে কিছু অবশেষ, নাপিতরা ফোঁড়া কাটতেন, নাপতানিরা মেয়েদের আলতা পরাতেন, দরকার হলে পায়ের কড়াও কাটতেন। হয়তো হাজার মলমও দিতেন। বড়ঘরের অন্তঃপুরিকাদের চিকিৎসার জন্য পুরুষ ডাক্তারের প্রবেশাধিকার ছিলনা। এজন্য দরকার হল মহিলা ডাক্তারের। এই যুক্তিতেই, ভারতে মহিলা ডাক্তার সরবরাহ করার জন্যই বিলেতে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার ছাড়পত্র পাওয়া গেল। ১৮৭৪ সালে খুলল - লণ্ডন স্কুল অফ মেডিসিন ফর উয়োমেন। এরপর ভারতেও মহিলারা ডাক্তারি পড়তে পারলো। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ডাক্তার হলেন, কিন্তু ওকে প্র্যাকটিস করতে দেয়া হ'লনা। মহিলা ডাক্তাররা কেবলমাত্র প্রসূতিদের জন্যই নির্দিষ্ট হলেন। পরশুরামের 'চিকিৎসা সংকট' গল্পের শেষ অংশের উদ্ধৃতি দিয়েছেন লেখিকা। নন্দবাবু মহিলা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই ডাক্তারনী বললেন - পেন আরম্ভ হয়েছে!
ক্রমশ নারী প্রযুক্তির উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করল। বিজ্ঞান জানালো - নারী শুধুই ওভারি ধারিণী - জরায়ু ধারিণী নয়। যৌনমিলন ছাড়াও সন্তান উৎপাদন করা যায়। ক্লোনিং শব্দটি নারীর অন্তর্মনে সাড়া ফেলে দিল। মানব ক্লোনিং না হলেও এটা যে অসম্ভব নয় - এই ধারণাটাই অনেকখানি।
চরকা থেকে কম্পিউটার - এই পরিশ্রম কাহিনীতেই শেষ হয়নি এর টেক্স্ট। দেখাচ্ছেন - যন্ত্রের চেহারাতেও কিভাবে ফেমিনিনিটি এসেছে। যন্ত্রগুলির মধ্যে এর রমণীয়কান্তি। যন্ত্র মানেই ম্যাসকুলিন নয়। সেইসঙ্গে এল ইকোফেমিনিজম এর ধারণা। বিশ্বশান্তির জন্য নারীর অন্তর্লীন কোমলতা এবং গোছানো স্বভাবের সুগুণ নিয়ে আসতে হচ্ছে প্রযুক্তিতে।
সেই আদিকাল থেকে মেয়েরা ঘর গুছিয়েছে, পরিষ্কার রেখেছে। ফল-তরকারি শুকিয়ে রেখেছে, পরিত্যক্ত জিনিস পুনর্ব্যবহার করেছে। এটাইতো রিসাইক্লিং, এটাইতো শক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। এটাইতো পরিবেশ রক্ষা। ইকো ফেমিনিজমের পর সাইবার ফেমিনিজম। লেখিকা আগাগোড়া পড়িয়ে নেন। গল্প লেখেন। প্রবন্ধেও কাহিনীর টান। নিজেকে কন্ট্রাডিক্ট করেন নি। বইটি ভাবায়।