• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫২ | অক্টোবর ২০১২ | গল্প
    Share
  • সংবাদ : হাইনরিষ ব্যোল
    translated from German to Bengali by দেবদত্ত জোয়ারদার


    গল্পটির জর্মন নাম Die Botschaft; প্রকাশকাল ১৯৪৭। লেখক হাইনরিষ ব্যোল (Heinrich Böll, ১৯১৭ - ১৯৮৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির সর্বপ্রধান সাহিত্যিক ও ১৯৭২ সনের নোবেল-বিজেতা। তাঁর জীবনে তিনি প্রত্যক্ষ করেন নাৎসিবাদের উত্থান ও পরিণতি, বিশ্বযুদ্ধ ও স্বজাতির পরাজয়, এবং বিধ্বস্ত দ্বিখণ্ডিত জার্মানির তথাকথিত পুনর্গঠন। এই বেদনা ও গরল থেকে রচিত হয় ‘ভগ্নস্তূপের সাহিত্য’ (Trümmerliteratur); ব্যোল সেই সাহিত্যধারার অন্যতম দিশারী। তাঁর সাহিত্যজিজ্ঞাসা প্রবাহিত হয় গভীর স্রোতে, এবং আধুনিক জীবনে মানবসত্তার নির্বাসন বা alienation তাঁর ভাবনার মূল বিষয় হয়ে ওঠে। তাঁর সাহিত্যরচনার চরিত্র অন্তর্মুখী ও অনুচ্চভাষিত; তাঁর নায়কেরা অনায়কোচিত মানুষ। ব্যোলের সর্বাধিক পঠিত উপন্যাসটি এক ক্লাউনের জীবন নিয়ে, নাম Ansichten eines Clowns।

    বর্তমান গল্পে এক সদ্য-মুক্ত যুদ্ধবন্দী ফিরছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে; দিকে দিকে চিতানল এইমাত্র নিভে গেছে। কয়েকটি বিভীষিকা (বন্দীত্ব, গহ্বর আর ভগ্নস্তূপ) তাকে তাড়া করছে, সামান্য বাধায় জেগে উঠছে দুঃস্বপ্ন। সে ফিরছে বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ ও মামুলি কিছু স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে, পৌঁছে যাচ্ছে এক মানহারা মানবীর দ্বারে, দাঁড়াচ্ছে তার প্রকাণ্ড নৈতিক প্রশ্নের সামনে।

    — অনুবাদক

    পনি সেইসব কোনো ক্ষুদ্র হতশ্রী জায়গা চেনেন কি যেখানে গেলে মানুষ ভেবে কূল পায় না, রেলওয়ে কেন ওখানে একটা স্টেশন বানাতে গেল? - সেখানে নিঃসীম দিগন্ত কয়েকটি জীর্ণ কুটির আর একটি ভগ্নপ্রায় কারখানার ওপর স্তব্ধ হয়ে জমাট বেঁধে থাকে। চতুর্দিকে মাঠ – অনন্ত ঊষরতার অভিশাপে পতিত হয়ে আছে। তাদের মাঝখানে একটা গাছ কি একটা গির্জার চূড়াও চোখে পড়ে না; তাই সহসা মনে হয় তাদের উদ্ধারেরও কোনো আশা নেই। লালটুপি-পরা লোকটি সেখানে - অবশেষে – অতঃপর - ট্রেনটিকে যাবার সিগন্যাল দিয়ে জমকালো নাম-লেখা বোর্ডটার নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়, যেন একঘেয়েমির মোটা চাদরের নিচে বারো ঘণ্টা ঘুমোনোর জন্যেই বুঝি তার মাইনে। একটা বিরাট ধূসর আকাশ সেখানে ঊষর ক্ষেত্রের ওপর বিস্তীর্ণ, - সে খেত কেউ চষে না।

    তাও যখন নামলাম, দেখলাম আমি একা নই। এক বয়স্ক মহিলা একটি বড়ো ব্রাউন প্যাকেট হাতে আমার পাশের কামরা থেকেই নেমেছেন; কিন্তু আমি যখন ছোট্ট নোংরা স্টেশনটা থেকে বেরিয়ে আসছি তিনি কোথায় উধাও হয়ে গেছেন, যেন মাটি তাঁকে গ্রাস করে নিয়েছে। এক মুহূর্ত আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, কাকে জিজ্ঞেস করে পথ চিনব জানি না। সামনে ইটের বাড়ি কয়েকটা, তাদের মৃত জানালা আর হল্‌দেটে-সবুজ পর্দা দেখে মনে হচ্ছিল, এখানে মানুষের বসবাস নিতান্ত অসম্ভব। আর এই রাস্তা-মতন জায়গাটির সঙ্গে সমকোণ সৃষ্টি করে একটা কালো দেয়াল চলে গেছে, সেটাও ভেঙে পড়ছে বলে ধারণা হল। আমি এই দেয়ালটার দিকেই হেঁটে গেলাম, কারণ ওই হৃতপ্রাণ বাড়িগুলোয় কড়া নাড়তে আমার ভয় করছিল। তারপর বাঁক ঘুরতেই মলিন প্রায়-অপাঠ্য ‘সরাইখানা’ লেখাটার ঠিক পাশেই নীলের ওপর স্পষ্ট সাদা হরফে লেখা ‘বড়ো রাস্তা’ (হাউপ্ট্‌ষ্ট্রাসে) কথাটা চোখে পড়ল। আবার কিছু বাড়িঘর – একটা বঙ্কিম রেখায় ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে, তাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে, আর তাদের উলটোদিকে – এই নৈরাশ্যপুরীর বাইরে যেন প্রাচীরের মতো, কোনো কারখানার সুদীর্ঘ জানালাহীন একটা অন্ধ দেয়াল গড়িয়ে গেছে। আমার মনে হল বাঁদিকে ঘুরি, কিন্তু সেখানে জায়গাটা যেন হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আরও প্রায় দশ মিটার দূর অবধি ওই দেয়ালটাই চলে গেছে, তারপর একটা সমতল ধূসর মাঠ শুরু হয়েছে, সেখানে সবুজের কোনো আভাস চোখে পড়ে না; অবশেষে মাঠটা গিয়ে কোথায় পাণ্ডুর সীমাহীন দিগন্তরেখার সঙ্গেই যেন মিলিয়ে গেছে। আমার সেই ভয়ংকর অনুভূতি হল, যেন পৃথিবীর এক প্রান্তে কোনো অতল গহ্বরের কিনারায় শাপগ্রস্ত হয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি, দুর্দৈবের টান আমাকে এই চূড়ান্ত আশাহীনতার অলৌকিক নির্মম নির্বাক ফেনায়িত গর্ভে গ্রাস করে নিতে চাইছে।

    মিস্ত্রিরা ছুটির দিনে যে-ধরনের বাড়ি তৈরি করে, সেই রকমই থ্যাবড়া এক-টুকরো বাড়ি বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি টলতে টলতে, হোঁচট খেতে খেতে ওই দিকে এগিয়ে গেলাম। জংলি গোলাপের একটি নিষ্পত্র ঝাড়ে ঢেকে-যাওয়া করুণ ও জীর্ণ ছোটো গেটটা – সেটা ঠেলে ভিতরে পা দিতেই আমি বাড়ির নম্বরটা দেখতে পেলাম; বুঝতে পারলাম ঠিক জায়গাতেই পৌঁচেছি।

    সব্‌জে শাটারগুলো, তাদের রঙ কতোকাল হল ধুয়ে মুছে গেছে, আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ। নিচু ছাদটা, যার ধারগুলো আমিও হাত দিয়ে ছুঁতে পারি, জং-ধরা টিনের পাত দিয়ে সারানো হয়েছে। পৃথিবীতে তখন অনির্বচনীয় নীরবতা। এ দিনের সেই প্রহর যখন বিলীয়মান গোধূলিবেলাটা – ধূসর, অনিবার্য লগ্ন – দূর দিগন্তের প্রান্তে শেষবার উথ্‌লে ওঠার আগে এক মুহূর্তের জন্যে নিশ্বাস রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছে। আমি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম, মনে হল এ-বাড়িতে ঢুকতে হবে জেনে এখানে এমনি করে দাঁড়াবার চাইতে বরং যদি আমার মৃত্যু হতো তখন, সেই সময় ... ভাবতে ভাবতে যখন হাত বাড়াতে যাব দরজার কড়া নাড়ব বলে, বাড়ির ভিতর থেকে চিকণ বাঁশির আওয়াজের মতো নারীকণ্ঠের এক দমক হাসি ভেসে এল। এই হাসি – দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময়ী – কখনও আমাদের মনের ভার লাঘব করে দেয়, আবার কখনও অন্তরটাকে ছারখার করে ফেলে। যাই হোক, এ-হাসি হাসতে পারে না কোনো একাকিনী নারী ... আবার আমাকে থামতে হল, বুকের মধ্যে আগুনের মতো দুর্দান্ত একটা বাসনা উথ্‌লে উঠেছে – অপসৃয়মাণ গোধূলিলগ্নের ওই বিবর্ণ সীমাহীনতা আদিগন্ত মাঠের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আমি তারই মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। - আমার শেষ শক্তি জড়ো করে দরজায় ঘা দিলাম।

    প্রথমে সব চুপচাপ, তারপর ফিসফাস – তারপরে পদধ্বনি, চটি-পরা পায়ের আলতো শব্দ, তারপর দরজা খুলে গেল, আমি দেখতে পেলাম একজন ব্লণ্ড গোলাপি মহিলাকে, যাঁকে আমার একটি অবর্ণনীয় আলোর ঝলকের মতো মনে হল, যেন নিজের জ্যোতিতে তিনি রেমব্রান্টের কোনো প্রায়ান্ধকার ছবির প্রতিটি কোণকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারেন। কালো আর ধূসরের এই চিরন্তন রাজ্যে একটি রক্তকাঞ্চন দীপশিখার মতো তিনি আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে প্রথমেই অস্ফুট চীৎকার করে তিনি দু’পা পিছিয়ে গেলেন; খোলা দরজাটা কাঁপা হাতে ধরা রইল। আমি মাথা থেকে সৈনিকের টুপিটা খুলে ফেলে ধরা গলায় বললাম, “ ’ন্‌ (গুটেন্‌) আবেন্ট্‌” (শুভসন্ধ্যা), তখন ভয়ের কঠিন রেখাগুলো শিথিল হয়ে গিয়ে একটা আশ্চর্য মুখ ভেসে উঠল – যে-মুখের কোনো আকৃতি নেই, - যে আড়ষ্টভাবে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ’। পেছনে একটা দশাসই পুরুষমূর্তি আকস্মিক ভেসে উঠে সরু প্যাসেজের আলো-আঁধারিতে আবছা হয়ে গেল।

    ‘ফ্রাউ ব্রিঙ্ক্‌-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই’, আমি নিচু গলায় বললাম।

    ‘হ্যাঁ ...’ – আবার সেই স্বরহীন কণ্ঠ; মহিলাটি কাঁপা হাতে একটি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। পুরুষমূর্তি তখন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। আমি একটি শ্রীহীন আসবাবে ঠাসা ছোট্ট ঘরে ঢুকে পড়লাম যেখানে পচা খাবারের গন্ধের সঙ্গে দামি সিগারেটের সুবাস বাসা বেঁধে আছে। তাঁর সাদা হাত গেল আলোর সুইচের দিকে; আলো জ্বলে উঠতেই তাঁকে দেখাল ফ্যাকাসে, আস্বচ্ছ ও নিরাবয়ব, প্রায় একটা শবের মতন, শুধু তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল লালচে চুল উষ্ণ ও জীবন্ত হয়ে ঝল্‌মল্‌ করতে লাগল। গাঢ় লাল জামাটাতে বোতাম আঁটাই ছিল, তবু ভারি বুকের ওপরে জামাটাকে তিনি দু’হাতে খামচে ধরলেন – দু’হাত তখনও কাঁপছে, তাঁর চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি – যেন আমি তাঁর বুকে যে-কোনো মুহূর্তে ছুরি মারতে পারি। তাঁর তরল নীল চোখের চাহনিতে উদ্বেগ আর শঙ্কা, বুঝি নিশ্চিত কোনো অদৃশ্য বিচারকের মুখ থেকে একটা মর্মঘাতী রায় শোনবার প্রতীক্ষায় তিনি উৎকর্ণ। দেয়ালে সস্তা সেন্টিমেণ্টাল রসের পোস্টার আর ছবিগুলো কতোগুলি অভিযোগের মতো ঝুলতে লাগল।

    ‘ভয় পাবেন না’, আমি রুদ্ধশ্বাসে বললাম; বলেই বুঝতে পারলাম, আলাপ আরম্ভ করার এর চাইতে খারাপ উপায় আর হতে পারে না। কিন্তু আর কিছু বলার আগে তিনিই আশ্চর্যরকম শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি সব জানি, - সে আর নেই ... নেই ...।’ আমি কোনোক্রমে শুধু মাথা নাড়লাম। তারপর আমি আমার ব্যাগ খুলে ঘাঁটতে লাগলাম, বন্ধুর শেষ সময়ের টুকিটাকি জিনিসগুলো তাঁর হাতে ফিরিয়ে দেব বলে। তখন বাড়ির ভিতর থেকে একটি আসুরিক চীৎকার শোনা গেল - ‘গি – টা - !’ ফ্রাউ আমার দিকে একবার বেপরোয়া অসহায় ভঙ্গিতে চাইলেন, তারপর দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন – ‘পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে পারছ না, বাবা রে!’ – বলেই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করলেন। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম, লোকটি কেমন কাপুরুষের মতো এক কোনায় যেন উনুনটার পেছনে সরে গেল। ফ্রাউ তখন তাঁর অবাধ্য চোখ দুটিকে প্রায় বিজয়িনীর মতো আমার চোখের ওপর নিবদ্ধ করেছেন।

    বিয়ের আঙটি, হাতঘড়ি, ছাপওয়ালা ফোটোসমেত মাইনের বই – আমি টেবিলের সবুজ ভেলভেটের ওপর এক এক করে ছড়িয়ে দিলাম। তখন অকস্মাৎ তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন – জান্তব, মর্মান্তিক সে-কান্না – কোনো আর্ত পশুর বেদনার মতো তীব্র। তাঁর মুখের রেখাগুলো কান্নায় গলে গেল, নরম হয়ে গেল শামুকের শরীরের মতো, নরম আর আকৃতিহীন; অশ্রুর উজ্জ্বল বিন্দুগুলো ছোটো ছোটো পুরুষ্টু আঙুলের ফাঁক দিয়ে উপচে আসতে লাগল। তিনি সোফায় ভেঙে পড়লেন ডান হাতে টেবিলের ওপর ভর দিয়ে, আর বাঁ হাত সামনে ছড়ানো ওই করুণ জিনিসপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। মনে হল, স্মৃতি যেন সহস্র তরবারিতে তাঁকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। আমি বুঝলাম, এ-যুদ্ধের কোনো শেষ নেই; তার একটি ক্ষত থেকেও যতোদিন রক্ত ঝরবে ততোদিন এ-যুদ্ধ থামবে না।

    আমার বিরক্তি, ভয়, নৈরাশ্য – সমস্ত একটি হাস্যকর বোঝার মতো আমি ঝেড়ে ফেললাম; ফ্রাউয়ের উথ্‌লে-ওঠা কম্পিত কাঁধের ওপর আমি হাত রাখলাম। তিনি চমকে উঠে আমার দিকে মুখ ফেরাতেই আমি প্রথমবার দেখতে পেলাম সেই মুখের আদল – সুন্দরী, জীবন্ত যে-মুখটির ছবি আমাকে অন্ততঃ কয়েকশোবার দেখতে হয়েছে, সেই সময় ...

    ‘কোথায়? – বসুন না – কোথায় ঘটল ঘটনাটা – রুশ ফ্রন্টে, না?’ – আমি তাঁর দিকে চেয়ে দেখলাম; যে-কোনো মুহূর্তে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তে পারেন।

    ‘না, পশ্চিম ফ্রন্টে, বন্দী শিবিরে – আমরা এক লক্ষেরও বেশি সেখানে ছিলাম।’

    ‘কবে?’ – তাঁর দৃষ্টি উদ্‌গ্রীব, সজাগ, অস্বাভাবিক উজ্জ্বল; তাঁর সমস্ত মুখ টানটান, তাজা – যেন তাঁর জীবন-মৃত্যু আমার উত্তরের ওপর নির্ভর করছে।

    ‘উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের জুলাই মাস’ – আমি আস্তে আস্তে বললাম।

    তিনি এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন, তারপর তাঁর মুখে এল একটি মৃদু হাসির রেখা – নির্মল নিষ্পাপ একটি হাসির রেখা। আমি বুঝতে পারলাম, কেন তিনি হাসলেন। সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমার ভয় হল, সমস্ত বাড়িটা যেন আমার মাথায় ভেঙে পড়বে, আমি উঠে পড়লাম। তিনি দরজা খুললেন কোনো কথা না বলে, বোধহয় চাইছিলেন আমার বেরুবার জন্যে দরজাটা খুলে ধরে রাখতে; কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, তিনি আগে বাইরে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি তাঁর ছোট্ট পুষ্ট হাতখানা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে শুকনো-কান্নায়-ধরা গলায় বললেন, ‘আমি জানতাম, যেদিন – আজ প্রায় তিন বছর আগে – তাকে ট্রেনে তুলে দিতে যাই তখনই আমি জানতাম - ’

    তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন – ‘দোহাই আমাকে ঘৃণা করবেন না।’

    কথাটা শোনামাত্র আমার বুকের ভিতর অবধি যেন কেঁপে উঠল – হায় ভগবান, আমাকে কি তাহলে বিচারকের মতো দেখাচ্ছে? আর ফ্রাউ বাধা দেবার আগেই আমি ওই ছোট্ট নরম হাতটাতে চুমু খেলাম। জীবনে সেই প্রথম একটি মেয়ের হাত আমি চুম্বন করলাম।

    বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আতঙ্কের ঘোর কাটে নি এমনিভাবে ওই বন্ধ দরজার বাইরে আমি এক দণ্ড দাঁড়ালাম। তখন শুনলাম ভিতরে তিনি কাঁদছেন, দুর্বার অস্থির কান্নায় খান্‌খান্‌ হয়ে যাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি তিনি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, মধ্যে শুধু একটা মোটা কাঠের ব্যবধান। তখন সত্যি আমার মনে হল, এবারে সমস্ত বাড়িটা তাঁরই ওপর ভেঙে পড়ুক, ভগ্নস্তূপ তাঁকে গ্রাস করে নিক।



    মার ভয় হচ্ছিল, কোনো গহ্বরে আমি এক নিমেষে তলিয়ে যেতে পারি। সেই আতঙ্কে অতি ধীরে অতি সন্তর্পণে স্টেশনের দিকে হাতড়ে হাতড়ে চললাম। ছোটো ছোটো ক্ষীণ আলো মৃত্যুপুরীগুলিতে জ্বলে উঠেছে, আর পাখির নীড়ের মতো ক্ষুদ্র এই জায়গাটি যেন আকারে হঠাৎ দৈত্যের মতো বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ওই কালো দেয়ালটার পেছনেও ছোটো ছোটো আলো, - কারখানার অন্তহীন চত্বরটাকে আলোকিত করে তুলেছে। দিনান্তবেলাটা ঘন আর ভারি হয়ে উঠেছে, কুয়াশার মতো ঝাপসা আর দুর্ভেদ্য।

    ছোটো ওয়েটিং-রুমটায় ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারছে; আমি ছাড়া সেখানে এক প্রৌঢ় দম্পতি কোনায় ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে কাঁপছেন। এখানে দীর্ঘ অপেক্ষা। রেললাইন ধরে কন্‌কনে হাওয়া উঠে আসছে, টুপিটা কানের ওপর টেনে নিয়ে আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাতটা নেমে আসতে লাগল - নামতে লাগল নিচে, আরও নিচে – কোনো দানবীয় বোঝার মতো।

    ‘আরেকটু রুটি আর একটুখানি তামাক যদি থাকতো’, আমার পেছনে পুরুষটি বিড়বিড় করে উঠলেন। আমি ঝুঁকে পড়তে লাগলাম, দূরে যেখানে ম্লান কয়েকটি আলোর মাঝখানে রেলের সমান্তরাল দু’টি রেখা কাছাকাছি আসতে আসতে মিলিয়ে গেছে – সেদিকে তাকিয়ে দেখব বলে।

    তখনই দরজাটা আচমকা খুলে গেল। সেই লালটুপি লোকটা, কর্তব্যগৌরবে উদ্ভাসিত মুখ, জোর গলায় হেঁকে বলল – যেমনভাবে কোনো বড়ো স্টেশনের ওয়েটিং-রুমে ঘোষণা করা হয় – ‘কোলোন-গামী প্যাসেঞ্জার ট্রেন পঁচানব্বই মিনিট দেরিতে আসছে।’

    ... সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, কেউ যেন আমাকে সারা জীবনের জন্যে বন্দী করে ফেলেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ হাইনরিষ ব্যোল-এর ছবিঃ নোবেলপ্রাইজ.অর্গ থেকে।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments