• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৯ | অক্টোবর ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ইস্‌তানবুলে কয়েকদিন : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    হঠাৎই কর্মসূত্রে কয়েকদিনের জন্য তুরস্কর প্রাচীনতম শহর ইস্‌তানবুলে ঘুরে আসার অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমিও তক্ষুনি একপায়ে খাড়া। তবে ব্যাগট্যাগ গোছাবার সঙ্গে সঙ্গে একটু তুরস্কর ইতিহাসটাও ঝালিয়ে নিতে হলো। এসব তো আর স্কুল-কলেজে কখনোই পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। শুধু ভাসা-ভাসা একটু যা জানতাম--অটোমান, আতাতুর্ক, বসফরাস সেতু, এই-ই।


    বসফরাস প্রণালী--দুই মহাদেশকে ভাগ করেছে


    তুরস্ক (Turkey) ইয়োরোপের একমাত্র রাজ্য যার বেশিরভাগই এশিয়া মহাদেশে। শুধু পশ্চিম-কোণে ইস্‌তানবুলের অর্ধেক ইয়োরোপে। মাঝখান দিয়ে চলেছে বসফরাস প্রণালী--যা দুই মহাদেশকে বিভক্ত করেছে। ইয়োরোপের ভাগটাই সবাই দেখতে আসে। ট্যুরিস্টদের সাধারণ দর্শনীয় জায়গাগুলো ইয়োরোপে। এশিয়ার ভাগে সাধারণ ঘরবাড়ি।

    প্রায় সতেরো-শ' বছরের পুরোনো শহর এটি। তারও আগে এই জায়গায় ১০,০০০ বছরের বসতির চিহ্ন মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। শতাব্দী ধরে, গ্রীক, আসিরীয়, মিশরের ফারাও, রোমান, আলেকজাণ্ডার, মুসলিম রাজত্ব, মঙ্গোলদের আক্রমণ, ক্রুসেডারদের দখল, এ-সবই শহরের পাথরে লেখা আছে।

    শুধু এক-পা ইয়োরোপে থাকা সত্ত্বেও শহরটিকে পুরোদস্তুর ইয়োরোপীয় বলে মনে হয়। এশীয় পুরোনো শহরের মতো (কায়রো, দিল্লী) ঘিঞ্জি বা নোংরা নয়। আবার ইয়োরোপীয় পুরোনো শহরগুলোর মতো (এথেন্স, রোম) ভাঙাচোরা ধ্বংসাবশেষও নেই। এতো পুরোনো হওয়া সত্ত্বেও এই শহরটি খুব পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল। সব ইমারত যত্ন করে সংরক্ষিত ও সব জায়গায় ট্যুরিস্টদের জন্য সুন্দর বান্দোবস্ত করা। এথেন্সের চেয়েও আমার এই শহরটি অনেক ভালো লেগেছে।

    ইস্‌তানবুলের পত্তন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে। রোমান সম্রাট কনস্টানটিনের নামে প্রথম নাম হলো কনস্টানটিনোপ্‌ল। পরে সেটা বদলে ইসতান্‌বুল। ইয়োরোপ ও এশিয়ার দোরগোড়ায় অবস্থিতির জন্য প্রথম থেকেই এর বেশ প্রতিপত্তি ছিলো। পরে জাতীয় নেতা কামাল আতাতুর্ক রাজাধানী সরিয়ে আঙ্কারায় আনেন।

    এর পরে এক হাজার বছর ধরে (৩০০-১৩০০ শতাব্দী) বিজান্টাইন সাম্রাজ্যে ইসতান্‌বুল ও তুর্কীদের আধিপত্য ছড়িয়েছিলো মধ্য-প্রাচ্য এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব ইয়োরোপ ও উত্তর আফ্রিকায়। এরা ছিলো নব্য-খ্রিস্টান। এদের দৌলতে হাগিয়া সোফিয়ের মতো সুন্দর চার্চ ও ক্যাথিড্রাল তৈরি হয়। এরপর ১৩০০ সাল থেকে সাম্প্রতিক ১৯০০ সাল পর্যন্ত চলে মুসলমান অটোমান সাম্রাজ্য। এরাও তিন মহাদেশে বিশাল প্রতিপত্তি বিস্তার করে। নতুন ধর্ম ইসলামের রক্ষক হিসাবে এরাই প্রথম খ্যাতি অর্জন করে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো তখন বেশ দুর্বল। এরই দৌলতে ইসতান্‌বুলের সম্রাটরা অনেক মনিমুক্তো ও দামী জিনিসের উপহার পান (বা যুদ্ধে জিতে ছিনিয়ে আনেন) যা সব ইসতান্‌বুলের মিউজিয়ামে সযত্নে সাজানো আছে। ইসলামের ও মক্কার 'কাবা'র রক্ষক হিসাবে অনেক ধর্মের কাজে ব্যবহার হয় এমন উপহারও আছে যার দাম আতুলনীয়।

    গত-শতকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর জাতীয় নেতা কামাল আতাতুর্ক (আমাদের গান্ধীর মতো ইনিও জাতির পিতা) তুর্কী-দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন, এবং দেশের রাজনীতি ও শাসনতন্ত্র থেকে ধর্মকে (ইসলাম) আলাদা করে দেন। এরকম ধর্ম-নিরপেক্ষতা মধ্য-প্রাচ্যে এই প্রথম। এখনও তুর্কিরা এই নিয়ম পালন করে এবং এর জন্যে খুব গর্বিতও বটে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, সারা পৃথিবীর মুসলমান-প্রধান দেশগুলির মধ্যে তুর্কি-ই বোধহয় একমাত্র "সেকুলার" দেশ।


    নীল মসজিদ, বা ব্লু-মস্ক


    ইসতান্‌বুলে ঢোকার সময় "ব্লু-মস্ক" বা নীল মসজিদের তোরণ ও মিনার আপনার সব থেকে আগে চোখে পড়বে। হালকা নীলের আভাসের জন্য এই নাম। কিন্তু তুর্কিরা একে বলে সুলতান আহমেদ মসজিদ। আজ থেকে পাঁচ-ছশো বছর আগে অটোমান সম্রাটের সৃষ্টি এটা। পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর ও সংরক্ষিত মসজিদের মধ্যে এটি প্রধান।

    মসজিদ হওয়ার দরুন এর দেয়ালে কোনো মনিমুক্তো নেই। নেই কোনো মানুষ বা প্রাণীর দৃশ্য, কিন্তু শিল্পীরা তার অভাব পূর্ণ করেছেন নিপুণ হাতে আঁকা নিখুঁত টালির কাজে। এগুলি পাথর বা চিনা-মাটির তৈরি। প্রতিটি দেয়াল, ছাদ, দরজা, সব নানা রঙের উজ্জ্বল অঙ্কনে ভরা। ডিজাইনগুলি সব জটিল কিন্তু একেবারে নিখুঁত। তুর্কি-দেশ এইরকম টালির জন্যে প্রসিদ্ধ। নানা জায়গার বিভিন্ন ঘরানা বংশ-পরম্পরায় চলে এসেছে। দেয়ালের টালি থেকে চিনা-মাটির বাসন পর্যন্ত নানারকম ফুল, লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এবং পবিত্র কোরানের বাণী ও আল্লার নাম ক্যালিগ্র্যাফি করে সুচতুরভাবে নক্‌শার সঙ্গে মেলানো। আমার নিজের এইরকম ডিজাইন বা অলংকরণে একটু হাত আছে তাই চোখ ভরে দেখলাম ও ছবি তুললাম। বাইরে এক টালি-শিল্পীর দেখা পেয়েছিলাম--তার কাছেও হাতে-কলমে ডিজাইন আঁকা রপ্ত করেছি একটু।


    নীল মসজিদের অভ্যন্তরে অপূর্ব কারুকার্য


    নীল মসজিদের পাঁচটি মিনার। প্রত্যেকটায় লাউডস্পীকার লাগানো--যাতে প্রার্থনার সময়ে আজানের ডাক সবাই শুনতে পারে। এই মসজিদ নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে। ইসলামের প্রথা অনুয়ায়ী মিনারের সংখ্যা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠাতার নামযশের ওপর। একজন ধনী বণিক বা সেনাপতির মসজিদে শুধু একটি মিনার। রাজমন্ত্রীর মসজিদে দু'টি, রাজা বা সুলতানের মসজিদে তিনটি, এইরকম। পাঁচটি মিনার কোনো মসজিদেই দেখা যায় না। মক্কায় সব থেকে প্রাচীন মসজিদে ছিলো পাঁচটি মিনার। নীল মসজিদকে টেক্কা দিতে এখন নাকি সেখানে আরেকটি মিনার যোগ করতে হয়েছে শুনি।


    হাগিয়া সোফিয়া গির্জা, এখন বদলে মসজিদ


    নীল মসজিদের সামনে একটি বিশাল চত্বর, তার উলটো দিকে বিজান্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যমণি হাগিয়া সোফিয়া মসজিদ। একধারে অটোমান ও অন্যদিকে বিজান্টাইন স্থাপত্যশিল্পের ভারি সুন্দর তুলনা পাওয়া যায়। এই দুটি মসজিদের মধ্যে চত্বরটি রোমান সময় থেকে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে--খেলাধূলা, প্রদর্শনী, জনসমাবেশ সবই হয় এখানে। এর নাম Hippodrome. এর মাঝখানে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে তৈরি মিশরের ফারাওদের জমানার স্মারকস্তম্ভ--obeslik--তাতে নানারকম হায়ারোগ্লিফিক আঁকা। এটাই তুরস্কর সবথেকে পুরোনো স্থাপত্য।


    হাগিয়া সোফিয়ার প্রার্থনাকক্ষে মেরী ও
    যীশুর সঙ্গে কোরানের বাণী আঁকা


    হাগিয়া সোফিয়া (বা সেন্ট সোফিয়া, তুর্কিরা বলে আইয়া সোফিয়া) ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নব্য-খ্রিস্টান জাস্টিনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো ক্যাথিড্রাল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ঠেকা দিয়ে রাখা আছে পুরোনো দেয়াল ও ছাদ। ভিতরে রাঙা কাচের জানালা, দেয়ালে টালি দিয়ে আঁকা খ্রিস্টধর্মের দৃশ্য। ১৫০০ শতাব্দীতে অটোমান মুসলমান সম্রাটরা এটিকে মসজিদে পরিণত করেন। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মুখ আঁকা নিষেধ। তাই দেবদূত ও সন্তদের মুখগুলি খুঁচিয়ে, ঘষে, উচ্ছেদ করা হলো। শুধু মেরী ও যীশুর মুখ বিকৃত করার সময় সম্রাটের একটু দ্বিধা হয়েছিলো। তাই তাঁরা বেঁচে গেলেন। এখন ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন হিসেবে প্রার্থনার সময় মেরী ও যীশুকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্রার্থনার পর ট্যুরিস্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়। ভালোই ব্যবস্থা।


    তোপকাপি প্রাসাদের সদর দরজা


    ইসতান্‌বুলের সমুদ্রঘেরা উত্তর-পূর্ব কোণে বিরাট জায়গা নিয়ে অটোমান সুলতানদের বাসস্থান তোপকাপি প্রাসাদ। তোপকাপি মানে কামান-দুয়ার। বিরাট এই প্রাসাদে আছে অনেক কামান, অনেক অস্ত্রশস্ত্র। ততোধিক বিশাল বাগানে প্রচুর ফুলের সমারোহ। ১৪৫০ সালে এর পত্তন। এখানে আছে তুরকি হামাম, জেনেনাদের হারেম, মসজিদ, এবং বিশাল মিউজিয়াম। এমনকি প্রাসাদের একধারে নবজাত সুলতান-পুত্রদের সুন্নত (circumcision) উপলক্ষে ভোগ উৎসব করার জন্যও আলাদা জায়গা আছে।

    তবে তোপকাপি তার মিউজিয়ামের জন্যই সবথেকে বিখ্যাত। সারা সাম্রাজ্য ছেনে উপহার ও লুঠ করা মণিমুক্তো, গয়না, মুকুট, আসন-বাসন, রত্নখচিত পোষাক সব সুরক্ষিত--সব জায়গায় গর্ব করে লেখা কোন দেশ থেকে কোন সুলতান কবে সেটা ছিনিয়ে এনেছিলেন।

    এর মধ্যে নাদির শাহর রত্নখচিত ছোরা একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। হাঁসের ডিমের মতো সাইজের পান্না ও চুনী খচিত, সোনার হাতল ওয়ালা এই ছোরাটি তুর্কির সুলতান পারস্যরাজ্যে নাদির শাহকে তয়ফা পাঠান। কিন্তু মাঝপথে নাদির শাহর মৃত্যু হয়ে যাওয়ায় ছোরাটি ফিরে আসে তোপকাপিতে। এই ছোরা নিয়ে ষাটের দশকে হলিউডে একটা সিনেমা হয়েছিলো, তাতে পিটার উসতিনভ অভিনয় করে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন।

    বলা বাহুল্য, এইসব জিনিস বুলেট-প্রুফ খাঁচায় রাখা, শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে যার সামনে সশস্ত্র প্রহরী। ছবি তোলাও সখ্‌ৎ মানা। এতো মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি আমি লণ্ডন টাওয়ারেও দেখিনি।

    কিন্তু এগুলোর থেকেও তোপকাপির ধার্মিক জিনিসের প্রদর্শনী আরো বেশি প্রসিদ্ধ। মক্কা ও মদিনার রক্ষক হিসেবে তুর্কী সুলতানরা অনেক দুর্লভ ও মূল্যবান জিনিস সংগ্রহ করেছেন। স্বয়ং মহম্মদের পরা আলখাল্লা, তাঁর দাড়ির গোছা, কাটা নখ পর্যন্ত সযত্নে রাখা আছে। প্রদর্শনীর এই বিভাগে পাহারা আরো কড়া। দিনরাত মাইকে কোরানপাঠ চলছে। আর কাতারে কাতারে দেশবিদেশের মুসলমান পুণ্যার্থীরা লাইন দিয়ে, হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছেন। মক্কা ও মদিনার বাইরে এইখানেই বোধ হয় পুণ্যার্থীদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। আজকাল মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও পূর্ব-ইয়োরোপ থেকেই বেশিরভাগ মুসলমান ট্যুরিস্টদের ভিড় দেখলাম।

    মহম্মদের পোশাক-আষাক ছাড়াও এই প্রদর্শনীতে আছে স্বয়ং মোজেসের বেত-এর ছড়ি, সাধু জোসেফের আলখাল্লা, এমনকি খোদ আব্রাহামের ভোজনপাত্র! দেখে ধর্মহীন আমার মনে প্রশ্ন জাগে কীভাবে এরা প্রমাণ করলো যে এটা আব্রাহামের বাটি? কোথায় সে প্রমাণ--কেউ কি রেডিও কার্বন দিয়ে পরীক্ষা করেছেন এসব জিনিসের বয়স? কিন্তু চারিদিকে এতো ভক্তির স্রোতে এসব প্রশ্ন তলিয়ে যায়। আমিও মুখ খোলবার সাহস পাই না।

    তুর্কিদের জাতীয় নেতা কামাল আতাতুর্ক সংবিধানে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিধান দিয়েছিলেন। ইয়োরোপে NATO-র অন্তর্গত তুর্কিরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে খুব গর্ব করে ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ইসলামি দেশের থেকে নিজেদের আলাদা ও বেশি আধুনিক মনে করে। তুর্কিদের ভাষাও আরবী ও পারসী থেকে আলাদা, ইংরেজি হরফে লেখা তুর্কি ভাষার সঙ্গে পূর্ব-ইয়োরোপীয় ভাষার মিলই বেশি। মহিলাদের পর্দানিশীন থাকার কোনো আইন নেই। আমি অনেক অলপবয়সী টিন-এজারদের মিনিস্কার্ট ও হাতকাটা জামাও পরতে দেখেছি। এদের গায়ের রঙ ফরসা ও চোখ কটা। এসবই দক্ষিণপূর্ব ইয়োরোপে তুর্কি-সাম্রাজ্য ছড়াবার প্রভাব।

    ধর্মনিরপেক্ষ দলেরা আজকাল একটু বিপদে পড়েছে। তুর্কির বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেশ রক্ষণশীল। তাঁর স্ত্রী মাথা-ঢাকা হিজাব পরেন। পর পর তিনবার এঁর নির্বাচনের ফলে তুর্কির রাজনীতিতে একটু ইসলামি রক্ষণশীলতার ছায়া পড়েছে। শিক্ষিত, প্রফেশন্যাল তুর্কিদের মধ্যে এই নিয়ে অনেক চিন্তাও হচ্ছে।

    আমাদের গাইড একদিন ধর্মপিরপেক্ষতার এক উদাহরণ দেখালেন--একই ব্লকে একটি মসজিদ, ঠিক পাশেই একটু পুরোনো কপটিক গির্জা এবং তার সামনেই এক ইহুদি সিনাগগ। তুর্কির লোকেরা ৯৯% মুসলিম। তাই এইরকম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে আর কোনো দেশেই দেখা যাবে না--আমাদের গাইড সেটা বেশ গর্বের সঙ্গেই আমাদের জানালেন।

    আমাদের দলের কয়েকজন ইহুদি ডাক্তার ওই সিনাগগে প্রার্থনায় যাবার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ঢোকার অনুমতি পাওয়া সহজ নয়। পাসপোর্ট জমা দিয়ে, অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর অনুমতি পাওয়া গেলো। তাও সোজাসুজি ঢোকা মানা। অনেকটা ঘুরে, পিছনে এক ছোট্ট খিড়কি দরজা দিয়ে ঢোকা হলো। প্রার্থনার সময়ে চেয়ারে বসে তাঁরা দেখলেন চেয়ারের নিচে সারে সারে হেলমেট সাজানো রয়েছে! শোনা গেলো কয়েকমাস আগে ওই সিনাগগে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ হয়েছিলো। সেইজন্যেই এতো সুরক্ষার ব্যবস্থা। বোঝা যায় এদের সেক্যুলারিজমে কথায় ও কর্মে অনেক তফাত। ভেবে দুঃখ হয় যে এই ইসলামেরই এক অন্যতম অহিংস ও ভাবধার্মিক শাখা--সুফিধর্মের সৃষ্টি এই তুরস্কদেশেই। এঁদের ঘুরে ঘুরে সেই দরবেশ নাচের কথা অনেকেই জানেন। এই সুফিধর্ম ভারতেও অনেক জায়গায় খুব জনপ্রিয়। (আহা, যদি সবাই সুফিদের মতো হতো!)

     
    হাতে আঁকা চিনামাটির টালির শিল্পী ও তাঁর কাজ
    তুরস্কের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষণ করে চলেছেন


    ইসতান্‌বুলে মসজিদ গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আশে পাশে "বাজার" গড়ে উঠেছে। তাই এশহরে অনেকগুলো বাজার--গ্র্যাণ্ড বাজার, মশলা বাজার, বইয়ের বাজার ইত্যাদি। পুরোনো জমানায় মসজিদের প্রভাবশালী ইমামরা এই বাজারের রক্ষণের ভার নিতেন। পরিবর্তে মসজিদের খরচ-বাবদ বাজারের আয়ের কিছু অংশ পেতেন। এভাবেই বাজারগুলো গড়ে উঠেছিলো। এখানে খাবার, স্যুভেনির, পোষাক, হাতে-আঁকা টালি, তুরস্কের বিখ্যাত কিলিম কার্পেট ইত্যাদিতে বাজার ঠাসা।


    নজর বনজুক -- "বুরি নজরওয়ালে, তেরা ..."


    একটা খুব ট্যুরিস্টপ্রিয় জিনিস দেখলাম--নজর বনজুক। এগুলো গোল গোল নীল কাচের চাকতি, ওপরে সাদা কালোয় চোখ আঁকা। এগুলি নানা সাইজে পাওয়া যায়--গলায় মাদুলির মতো ঝোলানো, দোরগোড়ায় ঘন্টির মতো বাঁধা। অপরের খারাপ-নজর এড়ানোর জন্যে এগুলি কাজে লাগে। দুর্ভাগ্য তাড়িয়ে সৌভাগ্য ধরে রাখার জন্যই এদের জনপ্রিয়তা। শুনেছি অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য দেশেও এদের চল খুব। ইসলাম ধর্মে এগুলির স্থান কোথায় আমার তা জানা নেই।

    তুরস্কের খাবার কিন্তু উত্তর-ভারতের লোকেদের খুবই চেনা মনে হবে। অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য দেশের মতোই এদেশেও কাবাব ও দোলমার প্রাধান্য। আঙুর-পাতা দিয়ে জড়ানো দোলমা, ভেতরে ভাত ও মাংসের পুর। কাবাব বেশিরভাগই ছাগল বা ভেড়ার মাংসের। নানারকমের মশলাদার কাবাব বানাতে এদের জুড়ি নেই। তার সঙ্গে ফাউ হিসেবে জুড়ে দেবে বিরাট এবং ঝাল কাঁচা লংকা!

    এছাড়াও আছে ভাত, নান-এর মতো রুটি, দই দিয়ে বানানো নানা পদ আর বেগুন জলপাইএর ব্যবহারও খুব। বেগুন রোস্ট করে তাতে মশলা দিয়ে খুব মুখরোচক খাবার বানায়। যার নাম "ইমাম বইয়ালদি" মানে খাবারটি এতোই স্বাদু যে ইমাম পর্যন্ত খেয়ে আনন্দে জ্ঞান হারান!

    মুসলিম দেশ হলেও এদেশে সুরাপানে কোনো বাধা নেই। এদশের জাতীয় ড্রিংক হলো Raki। খুব কড়া পানীয়, মৌরির এসেন্স দেওয়া। ঠিক গ্রীক পানীয় উজোর (ouzo) মতোই। জল মেশালে ঘন সাদা রঙ হয়। তুরস্কের অনান্য অঞ্চলে আঙুরের চাষ হচ্ছে খুব। কাজেই অনেক ধরনের ওয়াইন বাজারে পাওয়া যায়।

     
    বসফরাস সেতু--ভোরে, ও রাতে


    ইসতান্‌বুলে গিয়ে দুই মহাদেশ জোড়া বসফরাস সেতু না দেখলে যাওয়াটাই বৃথা। বসফরাস প্রণালীর ওপর এই সেতু--স্থানীয় নাম কামাল আতাতুর্ক সেতু। প্রণালীটি পূব-দিকে কৃষ্ণসাগর (Black Sea) ও দক্ষিণে Sea of Marmara (মর্মর সাগর?)-কে যুক্ত করেছে। ওপরে সেতুটি পশ্চিমে ইয়োরোপ ও দক্ষিণপূর্বে এশিয়াকে যুক্ত করেছে।

    সেতুটি দেখলে সান-ফ্রান্সিস্কোর গোল্ডেন গেট-এর কথা মনে পড়বে। সেইরকম কেবল-ঝোলানো নির্মাণ। কিন্তু এটি তুলনায় অনেক বড়ো, প্রতিদিন এর ওপর দিয়ে পঞ্চাশ-লক্ষ গাড়ি যাতায়াত করে। সেতুটির মাঝখানে সাইনপোস্টে লেখা 'Welcome to Asia', আর উলটোদিকে লেখা 'Welcome to Europe'! দেখলেই রোমাঞ্চ হয়। আমার মনে হয় না পৃথিবীতে আর কোথাও এরকম ওয়েলকাম সাইন আছে।

    ব্রিজের মাঝখানে দুই মহাদেশে দুই পা রেখে দাঁড়াবার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সবাই বাধা দিলো। হুমহাম করে গাড়ি চলছে সর্বক্ষণ। দাঁড়াবার জায়গাই নেই।

    পূবে এশিয়ান ইসতান্‌বুলে সাধারণ লোকের বসতি। সমুদ্রের ধারে ইসতান্‌বুলের ধনীরা প্রাসাদ বানিয়েছেন। উঁচু দেয়াল, কুকুর ও সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে সুরক্ষিত। ট্যুরিস্টদের দর্শনীয় বিশেষ কিছু নেই। পশ্চিমে ইয়রোপীয় ইসতান্‌বুলেই সব ঐতিহাসিক, প্রসিদ্ধ ও দর্শনীয় জায়গাগুলো। অফিস-কাছারিও এইদিকে। তাই রোজ সকালে এশিয়ার লোকেরা যায় সেতু পেরিয়ে ইয়োরোপে কাজ করতে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরে। শুনতেই অদ্ভুত লাগে, তাই না? এইরকম সত্যিকারের ইনটার-কন্‌টিনেন্টাল সেতু পৃথিবীতে আর নেই।

    মর্মর সাগর থেকে একটি ছোট্ট নদী চলে গেছে পশ্চিমে ঈজিয়ান সমুদ্রে (Aegean Sea)। এটা বোধ হয় পৃথিবীর সব থেকে ছোটো নদী। এক শহরেই এর শুরু ও শেষ। এর নাম গোল্ডেন হর্ন (Golden Horn)। শিং-এর মতো বাঁকা ও রোদ পড়লে সোনার মতো ঝকঝক করে বলে এই নাম। নদীটি ইয়োরোপীয় ইসতান্‌বুলকে দু'ভাগে ভাগ করেছে--উত্তরে নব্য-বসতি--হোটেল ইত্যাদি, দক্ষিণে পুরোনো আমলের প্রাসাদ, মসজিদ, বাজার প্রভৃতি। নদীর ওপরে দুট সেতু। নিচে জলে চলে গাদাগাদা নৌকা, জাহাজ। এতো দূষণের মধ্যেও কি করে মাছরা বেঁচে থাকে জানি না, কিন্তু মাছের প্রাচুর্য খুব। রোজ নদী ও প্রণালীর ধারে লাইন দিয়ে লোকে মাছ ধরে। কতোরকমের কেমিকাল বিষই যে আছে ওই মাছে তা ভগবানই জানেন।


    মাটির তলায় জলাশয়--ব্যাসিলিকা সিস্টার্না


    ইসতান্‌বুলের মাটির নিচেও আছে দ্রষ্টব্যস্থান। নীল মসজিদ আর হিপোড্রোমের নিচে, প্রায় তিরিশ ফুট গভীরে রোমান কারিগররা একটি বিশাল জলাশয় বানিয়েছিলো প্রায় ১৫০০ বছর আগে। তার নাম Basilica Cisterna। শহরে পানীয় জলের জোগান দিতো এই জলাশয়। ১০০০ বছর আগে অটোমানদের রাজত্বের সময় লোকে ভুলেই গিয়েছিলো এর অস্তিত্ব। সম্প্রতি এটির পুনরাবিষ্কার হয়েছে। এই বিরাট জলাশয়ের ওপরে কাঠের পাটাতন পাতা ও জলের নিচে মৃদু আলো বসানো। জলে মাছ পর্যন্ত আছে। বিরাট জলাশয়ের শুধু একটুখানিই ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা। মৃদু ক্লাসিকাল বাজনা, আলো-আঁধারিতে ভরা নিভৃত এই জায়গাটি স্থানীয় টিন-এজারদের খুব প্রিয়। জোড়ায় জোড়ায় এদের অনুচ্চস্বরে আলাপ চলে।

    ইসতান্‌বুলে আছে আরো শ'খানেক মসজিদ, প্রাসাদ, মিউজিয়াম, দুর্গ, বাজার। সবকিছু দেখতে হলে বছরখানেক লাগবে। এবার এইটুকুতেই সাধ মেটাতে হলো। আগামী বছরের জন্যে কিছু না-দেখা রাখতে হবে তো?



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments