• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৯ | অক্টোবর ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মারফির সূত্র : উদয় চট্টোপাধ্যায়


    ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকার মিউরোক ফিল্ড এয়ার বেস-এ (Muroc Field Air Base) পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তীব্রগতিতে দৌড়াতে-থাকা উড়োজাহাজে আকস্মিক ব্রেক প্রয়োগ করলে সেই প্রক্রিয়া-সঞ্জাত বল মানুষের পক্ষে কতদূর সহনীয় হতে পারে, সেটা নির্ধারণের জন্য। সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন একজন ডাক্তার, ক্যাপ্টেন জন পল স্টাপ (John Paul Stapp), আর একজন ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড মারফি (Edward Murphy)। বলের ঠিকমতো পরিমাপের জন্য এডওয়ার্ড একজন সহকারীকে নির্দেশ দিলেন ব্রেকের clamp বা বন্ধনীর গায়ে একটা 'স্ট্রেন গেজ' (Strain Gauge) লাগাতে। এক শিম্পাঞ্জিকে সওয়ারি করে দ্রুত থামানোর একটা পরীক্ষাও করা হল, কিন্তু দেখা গেল পরিমাপ যন্ত্র কোন রিডিং-ই দেখাচ্ছে না। বোঝা গেল তারের সংযোগে সহকারীটি কিছু গোলমাল করে ফেলেছে। রাগ আর ক্ষোভে এডওয়ার্ড মারফি মন্তব্য করেছিলেন কোন কিছু ভুলভাবে করা যেতে পারলে ওই সহকারীটি তা করবেই। প্রকল্পের ম্যানেজার এডওয়ার্ড মারফির এই মন্তব্যকে 'মারফির সূত্র' বা Murphy's Law নাম দিয়ে নথিভুক্ত করে রাখলেন।

    এর পরে অবশ্য ত্রুটি সংশোধন করে পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করা গেছল। তার কিছুদিন পরে এক প্রেস মিটিং-এ ডাক্তার স্টাপ পরীক্ষার সাফল্যের কথা জানালেন, এবং সেই সঙ্গে এটাও জানালেন যে মারফির সূত্রে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ভুল না-করার সতর্কতার জন্যেই তাঁদের এই সাফল্য। এইভাবেই জন্ম নিল 'মারফির সূত্র'; অবশ্য একটু পরিবর্তিত রূপে - 'কোন কিছুতে ভুল হবার সুযোগ থাকলে সেটা হবেই', কিংবা 'অসুবিধা ঘটানোর সুযোগ থাকলে ঘটনা সে দিকেই গড়াবে'। সংবাদপত্র ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে এই সূত্র একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিল।

    মারফির সূত্রের এমন প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি খুবই স্বাভাবিক। কোন সূত্রই তৈরি হয় না, আবিষ্কৃত হয়। মারফির সূত্রের জন্ম বা নামকরণ ১৯৪৯ সালে হলেও এই সূত্রের সত্যতা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে কংবা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে স্মরণাতীত কাল থেকে। শিকারের জন্য চার পাঁচ মাইল দৌড়ে এসে শিকার যখন প্রায় হস্তগত, তখনই সামনের পাথরে কিংবা গর্তে হোঁচট খেয়ে তার ভূমিশয়ন এবং শিকার হাতছাড়া, এরকম ঘটনা আদিম মানুষের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ঘটেছে। আদিযুগ থেকে বর্তমান সময়ের কালানুক্রমিক অভিজ্ঞতার বর্ণনায় যাব না, তবে অনতিসাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কাব্যিক প্রকাশের উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৮৪১ সালে আমেরিকার ওহাইয়োর 'নরওয়াক' (Norwalk) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল টমাস মুরের Lalla Rookh কবিতার লারিকা বা প্যারডি হিসাবে এই চারটি লাইন :

    আমার ভাগ্যে জোটেনি এমন রুটি,
    বিশেষত যেটা বড়োসড়ো আকারেতে
    যা' পড়েনি খসে আমার হাতের থেকে
    মাখন-লাগানো দিকটা সপাট মেঝেতে।

    অর্থাৎ, সুযোগ পেলে রুটি বা পাউরুটির টুকরো হাত থেকে মেঝেতে পড়বেই, বড়োসড়ো আকারের হলে তার সম্ভাবনা আরও বেশি, আর সেটার মাখন-লাগানো দিকটাই পড়বে মেঝের উপর যাতে ধুলোবালি ভালোভাবে মাখামাখি হয়ে গিয়ে খাবার আর কোন উপায় না-থাকে। রুটির টুকরোর এই আচরণ পুরোপুরি মারফির সূত্রের অনুসারী।

    জড় পদার্থের এই আচরণকে বলা যেতে পারে 'জড় পদার্থের দুষ্টুমি', যদিও ই.ভি. লুকাস তাঁর 'হারানো ছড়ি' প্রবন্ধে তাঁর প্রিয় ছড়িটির হারিয়ে যাওয়াকে দুষ্টুমি বলে মানতে পারেন নি। তবু ছড়ি বা চাবির মালিকরা তো মানবেন যে সুযোগ পেলেই তারা মালিকের সঙ্গে কেমন লুকোচুরি খেলা করে। সেই গল্পটার কথা মনে করুন।

    পানশালা থেকে গভীর রাত্রে হোটেলে ফিরে তিনবন্ধু দেখে লিফট বন্ধ। তাদের ঘর নব্বুই তলায়। 'কুছ পরোয়া নেই, এক একজন তিরিশ পর্যন্ত গল্প বলতে বলতে পৌঁছে যাব' এই বলে তারা সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দুই বন্ধুর গল্প বলা শেষ, ষাটতলা অতিক্রান্ত, এবার তৃতীয় বন্ধুর গল্প বলার পালা। সে কিন্তু মুখ খোলে না। অন্য দুই বন্ধুর পীড়াপীড়িতে আর তিনতলা বাকি থাকতে সে গল্প বলতে শুরু করল। তিন বন্ধুর গল্প - যারা লিফট না-পেয়ে গল্প করতে করতেই নব্বুই তলা পাড়ি দিয়েছিল, কিন্তু গল্পের শেষটা নিতান্তই করুণ, কেননা ঘরের সামনে পৌঁছে তাদের মনে হল ঘরের চাবিটা রিসেপশন কাউন্টার থেকে নিয়ে আসতেই তারা ভুলে গেছে। এখানে অবশ্যই বলা যেতে পারে যে চাবিটা তো আর ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করেনি, সে হয়তো রিসেপশন কাউন্টার থেকে চেঁচিয়ে বলতেই চেয়েছিল তাকে ছেড়ে যাওয়া হচ্ছে কেন। বরং ষাট কিংবা সত্তর তলায় ওঠার পর বেসামাল মালিকের হাত ফসকে রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে একতলায় পড়ে গেলে সেটাকেই দুষ্টুমি বলা যেত। তবু একথা তো মানতেই হবে বন্ধুরা চাবিটা নিতে না-ভুলতেও তো পারত। আসল কথা হল, ভুল হবার সুযোগ ছিল, সেটা হল, আর তার সঙ্গে মারফির সূত্রও প্রমাণিত হল।

    চাবির দুষ্টুমির সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় আছে। আমার ব্যাগের কোণে তিনটে চাবির গোছা থাকে - একটা বাড়ির, একটা গাড়ির, আর একটা অফিসের। কিন্তু বাড়ির সামনেই হোক, গাড়ির সামনেই হোক কিংবা অফিসের দরজার সামনেই হোক, ব্যাগে হাত ঢোকালে প্রথম যেটি হাতে আসে শতকরা নব্বুই ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা কাঙ্ক্ষিত গোছাটি নয়; বরং অধিকাংশ সময়েই সেটি আসে একেবারে সর্বশেষ প্রচেষ্টায়।

    জড় পদার্থের দুষ্টুমির হাজার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, এবং সেগুলো সবই মারফির সূত্র অনুসারী। আপনি হয়তো অফিস বা পার্টিতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। পরিপাটি করে দাড়ি কামিয়ে গালে একটু আফটার-শেভ লোশন মাখতে গিয়ে শিশির ঢাকনাটা হাত থেকে পড়ে টক্কর খেয়ে পৌঁছে গেল খাটের তলায় একেবারে অন্যদিকের শেষ প্রান্তে। একটা লাঠি কিংবা ঝাঁটা জোগাড় করে মেঝেতে উপুড় হয়ে অনেক কষ্ট করে সেটাকে উদ্ধার করলেন। তারপর আলমারি থেকে জামা বার করে গায়ে দিয়ে বোতাম লাগাতে গিয়ে বুকের কাছের বোতামটি সুতোর বন্ধনমুক্ত হয়ে খসে পড়ল। আপনার হাঁকডাক শুনে আপনার গিন্নি রান্নাঘর ছেড়ে দৌড়ে এলেন, সেই অবসরে ঊনুনে চাপানো দুধ উথলে গিয়ে পোড়া গন্ধ ছড়াতে লাগল। আপনি এসব অগ্রাহ্য করে কিংবা সামলে নিয়ে রাস্তায় বেরোলেন। হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তাড়াহুড়োতে মোবাইলটা সঙ্গে নিতে ভুলে গেছেন। আবার ফিরতিমুখো হয়ে বাড়ি গিয়ে দেখলেন সেটি টেবিলের উপর মিটমিট করে হাসছে।

    শুধু জড় বস্তুদের আচরণ কেন, নানা ঘটনা, কিংবা বলা ভালো অঘটন, অহরহই সপ্রমাণ করে মারফির সূত্রকে। কোন এক জায়গায় যার সঙ্গে দেখা হওয়া আপনার একেবারেই অভিপ্রেত নয়, ঘটনাচক্রে সেখানে তারই দর্শন মেলে। সেই এক সিনেমার গল্পে আছে না, এক নব বিবাহিত দম্পতি হনিমুনে যাবার ছুটি পাচ্ছে না, অসুখের অছিলায় ছুটি নিয়ে বেড়াতে গিয়ে সেখানেই অফিসের বসের সঙ্গে দেখা। আপনি হয়তো কাজে বেরিয়েছেন, তাড়া আছে, রাস্তায় দেখা হল এক পরিচিতের সঙ্গে। ভদ্রতার খাতিরে আপনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী কেমন আছেন?' তার উত্তরে তিনি সাতকাহন ফেঁদে বসলেন - শরীর মোটেই ভালো যাচ্ছে না, এই এখনই ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছেন; তারপর কী রোগ আর ডাক্তারের কী ব্যবস্থাপত্র তার সবিস্তার ফিরিস্তি। আপনার মনে হবেই 'সে কেন দেখা দিল রে / না দেখা ছিল যে ভালো'। কিন্তু সব সময় কি তাই হয়? বরং হয় উলটোটাই। শিব্রাম চক্রবর্তীর গল্পটা মনে পড়ে? কোন বন্ধু কিছুদিনের জন্যে নিয়ে তাঁকে তাঁর স্কুলে পড়ানোর কাজটা একটু 'ম্যানেজ' করে দিতে বলেছেন। পড়াতে শিব্রামের ভালোই লাগছে, বালখিল্যদের উৎপাতও খারাপ লাগছে না, কিন্তু তিনি যখন একান্তে তারিয়ে তারিয়ে একটু আলুকাবলি খাচ্ছেন তখন 'নমস্কার স্যার' বলে কোন ছাত্র সামনে দাঁড়ালে বাধ্য হয়ে আলুকাবলির ভাগ দিতে হয় বলে এ ধরণের অনভিপ্রেত সাক্ষাৎকারে তাঁর যথেষ্ট আপত্তি। আবার, নজরুলের 'লিচুচোর'-এর কথা মনে করুন। গাছে চড়ে ডাল ভেঙে 'পড়বি পর মালীর ঘাড়ে / সে ছিল গাছের আড়ে'। জ্যামিতিক সংস্থান বা কালের একটু হেরফের হলে সরাসরি মালীর ঘাড়ে পড়ার মতো অঘটন প্রতিরোধ করা যেত।

    আপনার অসুবিধা ঘটানোর জন্যে বহু ঘটনার যেন পরিকল্পনা-মাফিক সন্নিপাত। রাস্তা পার হতে যাচ্ছেন, ডান দিক বাঁদিকে নজর রেখে দ্রুতগতিতে আসা গাড়িগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে পার হবার হিসাব কষছেন, আর ঠিক তখনই আপনার সমনে আসার সময় সওয়ারি প্রত্যাশী শম্বুকগতি ট্যাক্সি, সাইকেল কিংবা ঠেলাগাড়ির। গাড়ি চড়ে যাচ্ছেন, গতি রুদ্ধ হয়ে কোন একটা সারিতে আপনারই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল, অথচ পাশের সারিতে গাড়িগুলো দিব্যি চলমান। লোকাল ট্রেনে উঠে একটা সীট যদিও বা পেলেন দেখলেন সেই বিশেষ জায়গাটাতেই মাথার উপরের পাখা ঘুরছে না। কিংবা বাসে জানালার ধারে সীট পেয়ে মৌজ করে বসলেন বটে, কিন্তু প্রায় সারাটা পথ বোশেখ মাসের রোদ্দুরে পুড়তে থাকলেন। টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখবেন বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছেন। এসে দেখলেন ইলেকট্রিকের লোকজনের সে দিনই কাজ পড়েছে আপনার পাড়াতে লাইন বন্ধ রেখে খোঁড়াখুড়ি করার। সবই আপনাকে মেনে নিতে হয়। হবেই। আপনি জানুন আর না-জানুন, মারফির সূত্র তার কাজ করে চলেছে।

    যে মারফির নামে এই সূত্র, তাঁর মৃত্যুর গল্পটাও তাঁরই সূত্র অনুসরণ করে রচিত হয়েছে। কথিত আছে যে গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়ায় তিনি সাদা পোশাক পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তার ডানধারে দাঁড়িয়ে যখন হিচহাইকিং-এর চেষ্টা করছিলেন তখন এক ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট উলটো দিক থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে তাঁকে ধাক্কা মারে। বলা বাহুল্য, ব্রিটেনের বাঁদিকে ঘেঁষে গাড়ি চালানো সঠিক আইন আমেরিকায় ভুল। আর, ভবিতব্যের মতো সেই ভুল সংঘটিত হল যেন ভুলের সূত্রের জনক মারফির মৃত্যু ঘটানোর জন্যেই।



    অলংকরণ (Artwork) : অলঙ্করণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments