খুব খারাপ, ভীষণ অস্থির, অনেকটা না-ভালোলাগার মধ্যে দিনগুলো কাটাতে কাটাতে আজ হঠাৎ এই মূহুর্তে একটা অসম্ভব ভালো, একদম অন্যরকমের এক বাহনলিপিতে অলকেন্দুর চোখদুটো আটকে গেল, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ।'
অলকেন্দু যে অটোতে বসে, ঠিক তার সামনের গ্রিন অটোটার পিছনে এই বাহনলিপি সুদূর হরফে রক্তিম হয়ে ফুটে রয়েছে, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। মূহুর্তে অলকেন্দুর সমস্ত ভাবনা-চিন্তা কেমন উল্টেপাল্টে গেল। অনেকদিনের অনেক খারাপলাগা, মনের কোণের অনেক গোপন অস্থিরতা, অনেক না-ভালোলাগাগুলো পলকে কেমন নির্ভার, অশক্ত হয়ে ঝুরঝুর করে ঝরে গেল। ঝিমিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। অলকেন্দুর মনের ভেতরটা এখন ভীষণ রকমের শান্ত, সুন্দর হয়ে উঠল। এক কোমল কমনীয়তায় মন-প্রাণ যেন উপচে উঠল।
সামনের গ্রিন অটোটা সিগ্ন্যালে থমকে আছে। ওর অটোটা ঠিক তার পিছনেই। দুটো অটোই এক রুটের। সামান্য দূরেই অটো স্ট্যাণ্ড। স্ট্যাণ্ডে গিয়ে অটোটাকে ধরলে কেমন হয়? অটোর ড্রাইভারকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখলে হয়, ভাই, তুমি এই আশ্চর্য লিপিকথা কোথায় পেলে? কেনই বা লিখলে? তুমি কি বিশ্বাস কর এই দর্শনে? আস্থা রাখো এই সুন্দর কথাটায়? তোমার জীবনযাপন, তোমার এই বেঁচে থাকাকে এই দর্শন কতটা সমৃদ্ধ করছে? কতটাই বা তুমি প্রভাবিত হয়েছো? নাকি এ-এক অভিমানী উচ্চারণ! হতাশ হয়ে যা কখনো সখনো বলে ফেলে ব্যথাতুর মানুষ!
সিগন্যাল ক্লিয়ার। গাড়িগুলো হুশ হুশ করে চলতে শুরু করল। সামনের গ্রিন অটোটা এগিয়ে চলেছে। ঠিক যেন ওকে অনুসরণ করেই ওর অটোটা পিছন পিছন যাচ্ছে। অলকেন্দু ভাবছে, সত্যিই অটো থেকে নেমে ওকে একবার জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? কি বলবে ও? ভীষণ কৌতূহল হল অলকেন্দুর। একধরনের পাগলামিও মনে হল। নিত্যদিনের একই অভ্যাসের বাইরে গিয়ে কিছু করার মত একটা অভিযান করলে তো হয়! অভিযানপ্রিয় অলকেন্দু এই নতুন অভিযানে সত্যিই নেমে পড়ল এবার।
স্ট্যাণ্ডে সারিবদ্ধভাবে অটোগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরই পিছনে এসে দাঁড়াল পর পর ওদের অটোদুটো। অটোর ভাড়া মিটিয়ে ধীরে সুস্থে নেমে এল অলকেন্দু। তারপর সামনের অটোটার কাছে যেতে গিয়েও একটু থমকে দাঁড়িয়ে ভাবল, ওর নিজের চড়ে আসা অটোর পিছনটা একবার দেখে নিলে হয় না? কি লিখেছে ও? কৌতূহল নিয়ে পিছনে গিয়ে দেখল, ওর অটোতে লেখা, 'বন্ধু, ৮০'! বাঃ বেশ তো কায়দা করে লেখা এই বাহনলিপিটাও। এবার মনে মনে সত্যিই যেন ওকে 'বন্ধু ৮০' বলে অলকেন্দু একটু দ্রুত পা চালিয়ে সামনের অটোর ড্রাইভারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
ড্রাইভার ছেলেটি তখন শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে পয়সা গুণছে। অলকেন্দু ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু অপেক্ষার পর বলল, ভাই, একটা কথা বলব?
হ্যাঁ, বলুন। ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ হয়ে ওর দিকে চাইল।
তোমার, মানে আপনার অটোর পিছনের এই লেখাটা আপনি কোথায় পেলেন? কেনই বা লিখলেন!
--ওঃ হো হো। ছেলেটি বেশ সুন্দর করে হাসল। তারপর অটো থেমে নেমে এসে বলল, এ তো মালিকের গাড়ি। মালিক লিখিয়েছে। আমি তো ড্রাইভার মাত্তর!
--অ! অলকেন্দু একটু থমকে যায়। দু'একটা মূহুর্ত গড়িয়ে যায়। তারপর কথা খুঁজে পেয়ে বলে, আপনার নিজের কেমন লাগে এই কথাটা?
--কেমন আবার! হাসি পায়।
--হাসি পায়! কেন?
--সত্যিই সবাই যদি এভাবে ভাবত, তাহলে তো দুনিয়াটা স্বর্গ হয়ে যেত। এত কিচাইন থাকত? সব মানুষগুলো ভগবান হয়ে যেত। ভগবানগুলো বেকার হয়ে যেত। বলে বেশ সুন্দর করে হাসল। তারপর আবার নিজেই বলল, আমার লাইনের গাড়িগুলোতেই তো কতরকমের সব লেখা দেখতে পাবেন।
-- যেমন?
--'দেখলে হবে, খরচা আছে'। কালোর গাড়িতে এটা লেখা। ভাবুন তো কেমন হ্যাটা করা ডায়লগ। শ্যামার গাড়ির পিছনে লেখা, 'হিংসা কোর না, তোমারও হবে'। আহা! যেন চিমটি কেটে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাদলের গাড়িতে লেখা, 'Don't Kiss Me'। মজা বুঝুন। ধাক্কা দিও না তাও কত ঢঙ করে বলা! হাসবেন না কাঁদবেন। সুজয়ের গাড়িতে আবার আরও মজার একটা লেখা, 'R কাছে ৯'। বুঝলেন? পাবলিক যে কত রকমের বুঝুন !....
--সবার গাড়িতেই কি এসব লেখা থাকে নাকি?
-- না। না। সবার গাড়িতে নেই। অনেকের গাড়িতেই কিছু না কিছু এমন লেখা থাকে। এই তো সেদিন লাইনে দুটো গ্যাস অটো নামল। একটাতে লেখা, 'জিন্দেগী এক সফর'। অন্যটাতে লেখা, 'পান্থজনের সখা'।
--বাঃ বেশ সুন্দর তো এই লেখা দুটো। অলকেন্দু হাসছে। মজা পাচ্ছে। ড্রাইভার ছেলেটি বেশ সহজ। প্রাণবন্ত। মন খুলে কথা বলছে। এবার ও মুচকি মুচকি হেসে বলল, সেদিন দাদা আমাদের লাইনের বাবলা বলছিল, কোথায় নাকি অটোর পিছনে লেখা দেখেছে, 'বিয়ে করলে শালী ফ্রি'। এই নিয়ে তো বহুত বাওয়াল হল। হাসাহাসি হল। ও প্রচুর ঢপ মারে। গুল দেয়। তাই কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ও বারবার বলছিল, বিশ্বাস কর, মায়ের দিব্যি, পার্টির দিব্যি, মা কালীর দিব্যি। লেখাটা সত্যি দেখেছি রে!
অলকেন্দু এমন কথার চালাচালিতে মেতে গিয়েও খেই হারায় না। ও লেখাটার উৎসে পৌঁছতে চায়। জানতে চায়, এমন একটা কথা মালিক কেন লিখলেন তাঁর গাড়িতে? মালিক মানুষটা কেমন? তিনি কোথায় পেলেন এই বিনয়ী আত্ম-উপলব্ধি? সত্যিই তিনি কি বিশ্বাস করেন এই দর্শনে? নাকি এ-এক অভিমানী মানুষের নিজস্ব সংলাপ, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। যার কোনও শ্রোতা নেই। যেন নিজেকেই বিড়বিড় করে শুধু বলা। বলে যাওয়া!.....
-- ভাই, তোমার মালিক কোথায় থাকেন? অলকেন্দু ড্রাইভার ছেলেটিকে বেশ বন্ধুসুলভ সখ্যতায় জিজ্ঞাসা করল।
ছেলেটি আগের মতই প্রাণবন্ত, সহজ হয়ে বলল, আমার মালিকের আসল বাড়ি তো বনগাঁ। তবে এখানে গড়িয়ায় ঘরভাড়া করে থাকে। ওর আরও দুটো অটো আছে। একটা নিজে চালায়। অন্যটায় আমার মত ড্রাইভার আছে।
-- তাই! মালিকের আরও দুটো অটো আছে? সে দুটো অটোতেও কি কিছু লেখা আছে? অলকেন্দুর কৌতূহল যেন ফুরায় না।
-- ও দুটোতে সিমপিল লেখা। দুছেলের নামে দুটো গাড়ি। একটায় লেখা - সায়ন। অন্যটায় লেখা - সুমন।
--তোমার মালিকের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আলাপ করিয়ে দেবে?
-- মোবাইল নাম্বার দিচ্ছি কথা বলে নিন।
-- বল।
ড্রাইভার ছেলেটির কাছ থেকে মালিকের নাম ও মোবাইল নাম্বার জেনে নিয়ে অলকেন্দু অটো স্ট্যাণ্ড পার করে এসে একটা চায়ের দোকানে বসল। চা খেল। আপনমনে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর নিজের মোবাইল থেকে ফোন করতেই ও প্রান্তে বেজে উঠল, হ্যালো -
-- নমস্কার দাদা।
-- হ্যাঁ নমস্কার। কে বলছেন?
-- আপনি আমাকে চিনবেন না।
-- কি বলছেন বলুন -
--আমার একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা আছে। কৌতূহল বলতে পারেন। আমি আজ আপনার অটোর পিছনে, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ' লেখাটা দেখে খুব অবাক হয়েছি। বেশ ভালো লেগেছে। তাই জানতে চাইছি, এ লেখাটা আপনি কোথায় পেলেন? আর কেনই বা লিখলেন হঠাৎ?
-- আগে বলুন তো, আপনি আমার নাম্বার পেলেন কি করে?
-- আপনার ওই অটোর ড্রাইভার দিল। ছেলেটি বেশ ভালো।
-- আরে দাদা, ও লেখা আমি লিখতে বলিনি। গাড়িটা সার্ভিসিং করাতে দিয়েছিলাম। রঙ করতেও বলেছিলাম। গ্যারাজের ছোকরাটা দেখি রং-টং করে লেখাটা লিখে দিয়েছে।
-- তাই? আপনি লিখতে বলেননি।
-- না।
-- আপনার গাড়িতে লিখে দিল, আপনি কিছু বললেন না?
-- প্রথমে একটু রাগ হয়েছিল। তারপর দাদা, বিশ্বাস করুন, রাগ দেখাতে পারিনি। মনটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। ভাবলাম, বেশ তো লেখাটা। থাক। সবাই শালা বলে, আমি সৎ। সাচ্চা। এক নম্বর লোক। ঢ্যামনামো করি না। কাউকে কাঠি করি না। এক্কেবারে তুলসিপাতা! কিন্তু এই লেখাটাতো ঠিক উলটো কথাই বলছে, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। এটার মধ্যে বরং একটা নাড়া দেওয়া ব্যাপার আছে। নিজের দিকে আঙুল তুলেও অন্যকে অস্বস্তিতে ফেলা যায়।
-- দারুণ। খুব সুন্দর বললেন তো কথাটা।
-- আপনার বুঝি খুব ভালো লেগেছে?
-- লেগেছে তো! কিন্তু দাদা এবার তো আমার জানতে ইচ্ছে করছে, ওই গ্যারাজের ছোকরাটা হঠাৎ একথা লিখতে গেল কেন? ও কোথা থেকে পেল এই অমৃতবাণী! ওর কেন ভালো লাগল এই লিপিকথা?
-- মহামায়াতলায় ওদের গ্যারাজ। একদম বড় রাস্তার ধারে। চলে যান। অবশ্য মোবাইলেও কথা বলে নিতে পারেন।
-- নাম্বারটা দিতে পারবেন?
-- কেন পারব না!
অলকেন্দু গ্যারাজের ছেলেটির নাম্বার নিল। নামটাও জানল। অটোর মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আপনার দু'ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে? কোথায় স্কুল? এমন আরও দু'চারটে কথা, কুশল বিনিময়ের পর আবার চায়ের অর্ডার দিল।
রাস্তার ধারের চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে আনমনে অলকেন্দু রাস্তার দিকে চইয়ে বসেছিল। হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা অটো হুশ করে চলে গেল। তার পিছনে লেখা, 'আমি ছোট, আমাকে মেরো না'।
বাঃ বেশ তো ছোট্ট অনুরোধ। মজা পেল লেখাটা দেখে। এরকম আরও একটা লেখা ক'দিন আগেই দেখে ও হেসেছিল মনে মনে। সেদিন ট্যাক্সি ধরতে হাত বাড়িয়েছিল অলকেন্দু। ট্যাক্সি এগিয়ে এসেও গন্তব্য অপছন্দ হওয়ার জন্য গেল না। বিনাযাত্রীতে এগিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। সেই ট্যাক্সিটার পিছনে অলকেন্দু লেখাটা দেখেছিল, 'ওরে পেট, তোর জন্য মাথা হেঁট'। সেদিন খুব রাগ হলেও মনে মনে হেসেছিল অলকেন্দু। পেটকে গালিও দেবে আবার প্যাসেঞ্জার না নিয়ে খালি ট্যাক্সি করে নিজে ঘুরে বেড়াবে! আজব তো ট্যাক্সি ড্রাইভারটা!
চা শেষ করে পয়সা দিচ্ছে অলকেন্দু। হঠাৎ রাস্তায় একটা হৈ চৈ। চকিতে তাকাতেই দেখল, দুরন্ত একটা ট্রাক হঠাৎ ব্রেক কষে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এন্তার খিস্তি ঝাড়ছে মোটরবাইকের আরোহীকে। আরোহী নাকি বেমক্কা উল্টোদিকের গলিটা থেকে হুশ্ করে বেরিয়ে এসে বলিকাঠে মাথা দেওয়ার মত ট্রাকের চাকার সামনে চলে এসেছিল।
সবাই বলছে, জোর বাঁচা বেঁচে গেলেন দাদা!
আরোহীদাদা তখন ভয়ে-লজ্জায় কুঁকড়ে মাথা নীচু করে মোটরসাইকেলটা নিয়ে চলে যেতেই ট্রাকটা আবার চলতে শুরু করল। অলকেন্দু তখন অবাক হয়ে দেখল, ট্রাকটার পিছনে বেশ বড় বর হরফে লেখা, 'তাড়া কিসের? স্বর্গে সিট খালি নেই'।
আশ্চর্য সমাপতন! এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পরই এমন একটা বাহনলিপি অলকেন্দুকে মুগ্ধ করে দেয়। বিস্ময় যেন কাটে না। বিভোর হয়ে থাকে। আজকের এই চলার পথের অভিজ্ঞতাগুলো জড়ো করতে করতে অলকেন্দু এক অন্য অলকেন্দু হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের হাজারো কাজে ব্যস্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিরক্ত অলকেন্দু নয়। এ এক অন্য অলকেন্দু হয়ে ওঠা যেন। নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করতে পারছে। ভালো লাগছে। মনের মধ্যে প্রশান্তি ফিরে এসেছে। ভালোলাগা গুলো কিচিরমিচির করছে হৃদ-কুঠুরিতে!....
।। দুই ।।
রিং হচ্ছে। অলকেন্দু গ্যারাজের ছেলেটাকে ধরার চেষ্টা করছে। মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে। অলকেন্দু একটু অস্থির হয়ে প্রতীক্ষা করছে। একদম শেষ মূহুর্তে ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল, হ্যালো?...
-- নমস্কার। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
-- বলুন।
-- আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার নাম্বারটা দিয়েছেন অসিতবাবু। ওর একটা অটো গড়িয়া-গোলপার্ক রুটে চলে। আপনি নাকি ওর অটোর পিছনের লেখাটা লিখে দিয়েছেন।
-- অনেক লেখাই তো লিখতে হয়। কোন লেখাটার কথা বলছেন বলুন তো?
-- 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'।
-- ও হ্যাঁ-হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আপনারও অটো আছে নাকি? লিখে দিতে হবে?
-- না। না। আমি ছাপোষা লোক। ছোট্ট একটা চাকরি করি। আমার আসলে খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এই লেখাটা আপনি কোথায় পেলেন? কেনই বা লিখলেন? নিজের বুঝি খুব ভালো লাগে কথাটা?
-- সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবার মুখে খুব শুনতাম। বাবা কখনো কারও মধ্যে কোনও খারাপ দেখতে পেতেন না। কথায় কথায় বলতেন, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। সেই থেকে শুনতে শুনতে কথাটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
-- বাবা এখনও আছেন?
-- না। অনেকদিন হল চলে গেছেন। আমার বাবা খুব সাধারণ ছাপোষা মানুষ ছিলেন। জানেন, আমাদের অনেক অভাব ছিল সংসারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তবু খুব সুখি ছিলাম আমরা সবাই। আমাদের চার-ভাই বোন, মা-বাবা, ভাই, ভাই এর বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ছিল সে এক বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। বাবা এই সংসারটাকে কি সুন্দর সাজিয়ে রেখেছিলেন। কেবলই বলতেন, 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। এভাবে ভাববে। তাহলে সংসার সুখের হবে। বেশি দোষ ধরবে না অন্যের। নিজের গুলোকে কেবল সংশোধন করে যাবে।'...
-- তাই! এত সুন্দর করে উনি ভাবতেন।
-- আমার বাবার অভাব খুব বোধ করি।
-- আপনি এখন কেমন আছেন?
-- ভালোই। তবে চারপাশের সবাইকে নিয়ে চলতে হয় তো। কতরকম সব মানুষজন। মাঝে-মাঝে খেই হারিয়ে ফেলি। বাবার কথা তখন খুব মনে পড়ে।
অলকেন্দু এই প্রথম একটু যেন থমকে যায়। আসলে ও-ও তো এক খেই হারানো মানুষ। মায়ের সঙ্গে বউ-এর অশান্তি মিটছেই না। ও-ও মেটাতে পারছে না। বউ চারদিন হল ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। বলে গেছে, অন্য সংসার আগে তৈরি কর। তারপর আমাকে নিয়ে আসবে। আমি পারব না এমন দজ্জাল-দুর্মুখ শ্বাশুড়িকে নিয়ে সংসার করতে।
সুজাতাকে অলকেন্দু কিছুতেই বুঝিয়ে শান্ত করতে পারেনি। সুজাতা তোমার মা খুব খারাপ, ভীষণ খারাপ বলে খালি চিৎকার করেছে। কান্নাকাটি করেছে। মাকেও অলকেন্দু বোঝাতে পারেনি। মারও সেই এক অভিযোগ। খোকা, তোর এই বউ সংসার করার মেয়ে নয়। তুই ওকে নিয়ে সুখি হতে পারবি না। ও ভীষণ খারাপ। হাড়ে-বজ্জাত এক ঘর জ্বালানি বউ। .... মাও রাগে গজরাতে গজরাতে মাথার চুল ছিঁড়েছে।
অলকেন্দুর এখন খালি মনে হয় ও একটা তৃতীয় সংসার গড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। সেখানে এই অশান্তি থাকবে না। ও একক জীবন কাটাবে। 'একলা পথের চলা আমার করব রমণীয়'। এরকমভাবেই ভাবে। দুটো চাল ফুটিয়ে যা হোক কিছু খেয়ে নেবে। শান্তিতে ঘুমোবে। চারটে বই পড়বে। অবসরে একটু গান শুনবে। ভালো লাগে না সংসারের এই নিত্য অশান্তি।
--দাদা কি কিছু ভাবছেন? গ্যারাজের ছেলেটির জিজ্ঞাসায় অলকেন্দুর সম্বিৎ ফেরে, না। না। তারপর প্রসঙ্গ পালটে জানতে চায়, আর নতুন কি কথা লিখলেন?
-- এই দেখুন না কালকেই একটা নতুন অটো দিয়ে গেল লিখতে। অটোটা একদম ঝক্কাস। হেভি ডেকরেশন। সিটকভার দারুণ। উঁচু সিট। টুনি দিয়ে লোকনাথ বাবার ছবি সাজানো। দারুণ সাউণ্ড সিস্টেম। এফ এম বাজছে। গ্রিন অটো। কিন্তু লেখাটা লিখতে ইচ্ছে করছে না। একদম ভালো লাগছে না লিখতে।
-- কেন? কি লিখতে বলেছে?
--শুনবেন কি বলেছে! 'দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মত ফুলবি।' - বলুন তো একথা লেখা যায়? এটা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা নয়?
অলকেন্দু শান্ত হয়ে ভাবছে, সত্যিই তো এসব ভাবনা মানুষের মনে কেন আসে? 'আপনার গর্ব, পড়শির ঈর্ষা'। বা 'দেখবি আর জ্বালবি, লুচির মত ফুলবি'। এই অশ্লীল-অসুস্থ মানসিকতা তো ঠিক নয়। বরং কত সুন্দর এই কথা। 'সবাই ভালো, আমি খারাপ'। কত নম্র, কত শান্ত সুন্দর এক বিনয়ী উচ্চারণ। হৃদয় ছুঁয়ে যায়। স্পর্শ করে হৃদয়ের অতলকে!
একটা কল সমানে আসছে অলকেন্দুর মোবাইলে। অলকেন্দু কথা বলতে বলতে বুঝতে পারছিল। তাই এবার কথা শেষ করে দেখল, তিনটে কল পরপর এসেছিল। আশ্চর্য তিনটে কলই সুজাতার!
অলকেন্দু ভাবছে কলব্যাক করবে কিনা! হঠাৎ সুজাতার ফোন কেন? আজ চারদিন হল ও চলে গেছে। একটা ফোনও একদিন করে্ররনি। অলকেন্দুর একধরনের অভিমান হল মনে। কলব্যাক না করার অভিমান। অভিমানী অলকেন্দু এবার হাঁটছে। ধীর শান্ত পায়ে হাঁটছে। অন্যমনস্ক অলকেন্দু একথা-সেকথা ভাবছে। ফোনটা সে-সময়ে আবার বেজে উঠল। ফোন তুলে দেখল মায়ের কল।
-- হ্যাঁ বল।
-- তুই কোথায় খোকা?
-- কেন? কি দরকার!
-- তুই অফিস যাসনি? গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি যেন। রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস নাকি?
-- আঃ বল না কি বলবে? অলকেন্দু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।
-- খোকা আমি বলছিলাম, তুই গিয়ে বউমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। দাদুভাইকে নিয়ে আয়। তোরা সংসার কর। আমি আর কতদিন বাঁচব! আমার জন্য তোরা কষ্ট পাবি কেন? আমারও তো কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে। বউমাকে বুঝিয়ে বলব। তুই গিয়ে নিয়ে আয়। আবার আমরা সবাই মিলেমিশে থাকব।
অলকেন্দু কোনও কথা বলতে পারে না। ঠোঁট দুটো কাঁপছে যেন। চোখের পাতা চিকচিক করে ওঠে। মা হঠাৎ এসব কি কথা বলছে? কেনই বা বলছে? মা তো এসব আগে কোনওদিন বলেনি!
মা, তুমি হঠাৎ এসব বলছো কেন? অলকেন্দু প্রশ্নময় হয়ে ওঠে।
মা এবার আরও শান্ত, আরও গভীর নিবিড় উচ্চারণে বলে যায়, খোকা গুরুদেব আমায় বললেন, তুই ঠিক করছিস না। বউমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। সাজিয়ে-গুছিয়ে সংসার কর। লোকের খারাপ অত দেখবি না। নিজের খারাপগুলো আগে দেখ। দেখবি সংসারে অশান্তি থাকবে না। সুখে থাকবি!
-- তুমি গুরুদেবের কাছে গিয়েছিলে!
-- হ্যাঁরে খোকা, গিয়েছিলাম। মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না রে।
-- কিন্তু ও ফিরে এলে যদি আবার তোমাদের মধ্যে অশান্তি হয়?
-- হবে না রে খোকা। আর অশান্তি হবে না। তুই যা। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। বউমাকে আমার কথা বলবি।
একটু আগের অভিমানী অলকেন্দু এবার ভাবে সুজাতাকে কলব্যাকটা করা দরকার। ও-ও তো একটু আগে তিন-তিনবার ফোন ট্রাই করেছিল। সুজাতাও কি তবে মায়ের মতই এসব কিছু ভাবছে? ভাবতেও তো পারে! দূরত্ব অনেক ভুল বোঝাবুঝির, অনেক জটিল আঁকিবুকির অবসান ঘটায়।
অলকেন্দু ভাবনার ডানায় আশার এক স্বপ্ন রচনা করে। সত্যিই তো ওদের জোড়া লাগানোর দায়িত্ব আমারও অনেকটা। একসময় বিরক্ত হয়ে, ক্ষুন্ন-হতাশ হয়ে, না-ভালোলাগায় ভর করে ওদের থেকে দূরত্ব রচনা করা ভুলই হয়েছিল। আজ এই মূহুর্তে ও যেন ভাবতে পারছে, এ আমারও ভুল, আমিও কিছুটা খারাপ।
সুজাতার ফোনটা বাজছে। অলকেন্দুর বুকের ভেতরটা এখন এক সুন্দর স্বপ্নে থৈ থৈ করছে। সুজাতা, আমি আসছি। তুমি রেডি হয়ে থেকো। রোরোকে রেডি করে রেখো। তোমাদের আনতে যাচ্ছি। মা বলেছে, আর কোনও অশান্তি হবে না। তুমি সব ভুলে যাও সুজাতা! ..... অলকেন্দু হাসতে হাসতে এই কথাগুলোই যেন বলতে চায়। বলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। ওদের কাছে যাওয়ার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু সুজাতা ফোনটা তুলছে না কেন? ফোনটা যে বেজেই যাচ্ছে! সুজাতা ফোনটা ধরো প্লিজ!