উৎপল দত্ত / জীবন ও সৃষ্টি, অরূপ মুখোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া
নিজের সম্পর্কে যিনি বলেছিলেন - 'আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগাণ্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।' - সেই বিচিত্র নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তের সৃষ্টিশীল জীবনের পরিশ্রমী প্রতিবেদন এই বই। বহুমুখী প্রতিভাধর, বর্ণময় মানুষটির জীবন ও সৃজনের পরিমাপ করতে বসে লেখক সাহায্য নিয়েছেন উৎপল দত্ত বিষয়ক একশো পনেরোটি প্রাসঙ্গিক পুস্তকের, কুড়িটি প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের। এছাড়া নির্ভর করেছেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত উৎপল দত্ত বিষয়ক সত্তরটি নিবন্ধের উপর। এই তন্নিষ্ঠতার উপরেই স্থিত বইয়ের বারোটি পরিচ্ছেদ - ছেলেবেলা, পারিবারিক পটভূমি ও শিল্পীসত্তার উন্মেষ; সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজপর্ব: নাট্যপ্রতিভার বিকাশ; গুরুলাভ: জেফ্রি কেণ্ডালের পেশাদার নাট্যশালায় দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ; লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠা: থিয়েটারওয়ালার গোত্রান্তর; গণনাট্য সংঘের স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতা: 'জনতার মুখরিত সখ্য', রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রত্যাবর্তন; পথনাটকের অগ্রণী পথিকৃৎ; মিনার্ভার উত্তাল সময়: বিল্পবী থিয়েটারের বোধন, উপর্যুপরি গ্রেপ্তার, কারাবাস ও রাজনৈতিক তৎপরতা; পিপল্স্ লিটল থিয়েটারের গঠন: এক আধুনিক নাট্যব্যক্তিত্বের অভ্যুদয়; রাজনৈতিক যাত্রাপালা রচনার পথপ্রদর্শক; এক মহত্তম চলচ্চিত্র অভিনেতা, ব্যতিক্রমী চিত্রপরিচালক এবং বিদগ্ধ ছবিবোদ্ধা; উৎপলমানস: বহুমুখী প্রতিভা ও দিকপাল পাণ্ডিত্য; জীবনসন্ধ্যায় ব্যাধিজর্জর, অনমনীয় স্রষ্টা এবং মহাপ্রস্থান।
উৎপলরঞ্জন দত্তের জন্ম পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) কীর্তনখোলায় - ২৯ মার্চ ১৯২৯। পড়াশুনা শিলঙের এডমণ্ড্স স্কুল হয়ে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স। কলেজ - সেন্ট জেভিয়ার্স। ১৯৪৮-এ ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন উৎপল। সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তাঁর স্থান পঞ্চম। স্কুল জীবনেই বাবা-মা'র সঙ্গে পেশাদারি থিয়েটার দেখা শুরু। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম - 'সেইসব মহৎ কারবার দেখে মনে হ'ল, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হবার নেই। আমার বয়স তখন তেরো'।
কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করে দেন উৎপল। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলের 'ডায়মণ্ড কাট্স্ ডায়মণ্ড' এবং মলিয়েরের 'দ্য রোগারিজ অফ স্ক্যাপাঁ' দিয়েই তাঁর কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি অ্যাকাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল - 'দি অ্যামেচার শেক্স্পিয়ারিয়ান্স্'। তাদের প্রথম উপস্থাপনা 'রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট' এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই, ১৯৪৭-এর অক্টোবরে, ইংলণ্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেণ্ডাল তাঁর 'শেক্স্পিয়ারিয়ানা' নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেণ্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেক্স্পিয়ারিয়ানা নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হয়। জেফ্রি কেণ্ডালের দলে তখন উৎপল নিয়মিত অভিনয় করেছেন। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। কেণ্ডালের কাছেই শিখেছিলেন - There is no art without discipline and no discipline without sacrifice. তাঁর কাছেই উৎপল পেয়েছেন শেক্স্পীয়রের নাটক অভিনয় করবার বিশেষ শিক্ষা।
এই সময়েই কেণ্ডাল-কন্যা জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের পরিচয়। অচিরেই যার উত্তরণ ঘটে প্রণয়ে। পরবর্তীতে জেনিফারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে তীব্র কষ্ট উৎপলের। সে দহনের রেশ ছিল আজীবন। জেনিফারের সম্পর্ক মনে রেখে একাধিক কবিতাও লিখেছেন নাট্যকার। কবিতা, সহধর্মিণী শোভা সেনের কথন অনুযায়ী, উৎপলের কাছে ছিল ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি অথবা কোনও তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম।
জেফ্রি কেণ্ডালকে 'গুরু' মেনে 'শেক্স্পিয়ারিয়ানা' দলে যোগ দিলেও উৎপল তাঁদের নিজস্ব নাট্যদল 'দি অ্যামেচার শেক্স্পিয়ারিয়ান্স্' তুলে দেননি। বরং মাঝে মধ্যেই শেক্স্পিয়ার, বার্নাড শ, শেরিডান, প্রিস্টলি, নোয়েল কাওয়ার্ডের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন তারা। এবং সেই সময়েই উৎপল দত্ত অভিনেতা হিসাবে কলকাতার নাট্যসমালোচকদের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই পথে চলেই ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে, কবি-গায়ক দিলীপ রায়ের প্রস্তাব মতো, উৎপলরা তাদের দলের নাম বদলে রাখেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ - এল টি জি। ততদিনে কুড়ি বছরের সদ্যযুবা উৎপল ঠিক করে ফেলেছেন তিনি নাটক-অভিনয়ের জগতেই থাকবেন। সমাজের পরিবেশ তখন কেমন? বিশ্বের অঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়ার মতাদর্শের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি। সঙ্গে যোগ দিয়েছে মাও-সে-তুঙের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকারী চীন। এদিকে দেশ স্বাধীন হবার সাতমাসের মাথায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত। পার্টির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও রেহাই নেই। মার্কসবাদী দর্শনে আকৃষ্ট উৎপলের মনোভঙ্গী কলেজ পত্রিকায় প্রকাশিত - 'সময় এগিয়ে চলে, এমন কি শরৎচন্দ্রের যুগও অতিক্রান্ত হতে চলেছে। নতুন প্রজন্মের মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ, তাদের কাব্যলক্ষ্মী হলেন শ, লরেন্স, জয়েস এবং হাক্সলি। ম্যাঞ্চেস্টার এবং স্তালিনগ্রাদ তাদের দুর্গ; ডাস ক্যাপিটাল তাদের নতুন বেদ। তাদের আনুগত্য তথ্যের প্রতি, আঙ্গিকের আতিশয্যের বিরুদ্ধে তাদের চ্যালেঞ্জ। রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে সাহিত্যে, শ্রেণীসংগ্রামে এবং শোষিত বঞ্চিতের মহাক্ষুধায়।'
ইংরেজি নাটক প্রযোজনার পাশাপাশি লিটল থিয়েটার গ্রুপ শুরু করে বাংলা নাটক। পঞ্চাশের দশকে এল টি জি মঞ্চে উপস্থাপিত করে রবীন্দ্রনাথের নাটক - অচলায়তন, কালের যাত্রা, গুরুবাক্য, সূক্ষবিচার, তপতী। ক্রমশ উৎসারিত হয় ঐতিহাসিক সব প্রযোজনা - অঙ্গার, ফেরারি ফৌজ, কল্লোল, অজেয় ভিয়েতনাম, তীর। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ সংকটে এল টি জি ভেঙে যায়। প্রিয় মঞ্চ মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়তে হয়। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল, লেনিনের জন্মদিনে, মিনার্ভায় এল টি জি'র শেষ নাট্যাভিনয় - লেনিনের ডাক। এরপরে জন্ম নেয় পিপল,স, লিটল থিয়েটার - পি এল টি। ১৯৭১ থেকে শুরু হয় তাদের নিয়মিত প্রযোজনা। আবারও মানুষজনকে অভিভূত করে সেইসব অসামান্য নাটক, অভিনয় - টিনের তলোয়ার, সত্যজিৎ রায়ের মতে, ভারতীয় থিয়েটারের সর্বোচ্চ শিখর।
পরম্পরা মেনে, অনুপুঙ্খ সহযোগে উৎপল দত্তের 'জীবন ও সৃষ্টি'-র বিবরণী পেশ করেছেন গ্রন্থকার। এর সমান্তরালে 'নাট্যব্যক্তিত্বের' মননশীলতা - পাণ্ডিত্যের বিস্তৃতিকেও পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। বইটির পরিশিষ্টে সংযোজিত উৎপল দত্ত রচিত, পরিচালিত, অভিনীত নাটক, প্রবন্ধ-পুস্তক, পথনাটিকা, যাত্রাপালা ইত্যাদির তালিকা গবেষকদের নিশ্চয় কাজে লাগবে।
তবে এইসঙ্গে একটি কথা বলে নেওয়া যাক। বইটি পড়ে স্পষ্ট বোঝা যায় লেখক উৎপল দত্তের নাটকীয়তায় মুগ্ধ। 'দিকপাল পাণ্ডিত্যে' অভিভূত। এবং সম্ভবত এই কারণেই লেখক প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিয়েছেন উৎপলের যাবতীয় বক্তব্য। সহজ যুক্তিকে ঢেকে দিয়েছে ভক্তিরসের ঘনঘটা। একটি দৃষ্টান্তঃ
একথা অনেকেরই জানা, এবং এই বইতেও আছে, 'কল্লোল' মঞ্চস্থ হবার পর, বিশেষত উৎপল নকশালবাড়ির সংগ্রামের সমর্থনে পশ্চিমবাংলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবার কারণে, বাজারি সংবাদপত্রগুলি কল্লোলের বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করে দেয়। এমন কী সি পি এমের মুখপত্র 'দেশহিতৈষী'ও একসময় সে বিজ্ঞাপন ছাপেনি। (শেষোক্ত তথ্য অবশ্য বইটিতে নেই)। এরপরে 'তীর' নাটক, যা নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থনে লিখিত, উপস্থাপিত হবার কালে উৎপল দত্তকে বোম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দিন দশেকের মধ্যে মুচলেকার বিনিময়ে ছাড়া পান নাটককার। উৎপল চলে যান রাজস্থান - একটি আন্তর্জাতিক প্রযোজক সংস্থার 'গুরু' চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে। এই ঘটনায় প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত। নকশালপন্থীদের মতে এ উৎপলের বিশ্বাসঘাতকতা। এল টি জি উৎপল এবং তাঁর স্ত্রী শোভাকে বহিষ্কার করে। কিছুকাল পরে উৎপল-অনুরাগীরা বোঝাবার চেষ্টা করেন এ ছিল তাঁর কৌশল। পরবর্তীকালে উৎপল তাঁর 'Towards a Revolutionary Theatre' গ্রন্থে এমন ধারণা গড়বার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছেন। এই বইটির নির্ভরে উৎপল জীবনীকার অরূপ লিখছেন - '... নকশাল আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ পরিবেশে নেতৃত্বের নির্দেশে একটি 'আর্মস ডিল' করতে তিনি বোম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন।' লেখক নকশাল-নেতৃত্বর এই 'অপরিণামদর্শী ও অবিবেচনাপ্রসূত' সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছেন - '... কী কারণে এবং কেন উৎপল দত্তের মতো একজন সর্বজনপরিচিত তারকাকে এই গোপন 'আর্মস ডিল'-এর জন্য আরব সাগরের তীরে পাঠালেন সশস্ত্র বিপ্লবের নেতারা?' প্রসঙ্গত, চারু মজুমদার কোনওদিনই বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে লড়াই করবার কথা বলেননি। ১৯৬৭-৬৮ তে তো নয়ই। তাঁর দর্শনই হল তীর-ধনুক-বল্লম ইত্যাদি সাবেকি অস্ত্র নিয়ে লড়াই করো, গেরিলা আক্রমণে শত্রুর অস্ত্র কেড়ে নাও, সেই অস্ত্র নিয়ে গেরিলা স্কোয়াড লড়াই করুক। ছাত্রযুবকরা গ্রামে যাবার সময় যেন পিস্তল-রিভলবার না নিয়ে যায় - এমনই নির্দেশ ছিল তাঁর। পরবর্তীতে এই দর্শনের প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল দেওয়াল লিখনে - পুলিশ মারো অস্ত্র কাড়ো। যার প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের কোমরে শিকল বাঁধা বন্দুক ! এই যাদের সেসময়ের মতাদর্শ তারা কেন অস্ত্র-চুক্তি করতে উৎপলকে পাঠাবেন বোম্বাইয়ের বিলাসবহুল তাজ হোটেলে? এ সঙ্গত প্রশ্ন লেখক উত্থাপন করেননি। কিন্তু সচেতন পাঠক অবশ্যই করবেন।
এমন কিছু আচ্ছন্নকারী আবেগপ্রবণতা ছাড়া বইটির প্রতিটি পাতায় লেখকের অধ্যাবসায়ের পরিচয়। যা পাঠককে শ্রদ্ধাশীল করে।