• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৮ | মে ২০১১ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে : সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্য প্রসঙ্গে : নিরুপম চক্রবর্তী

    স্থানাঙ্ক নির্ণয় : সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, এলডোরাডো / দে বুক স্টোর, ক’লকাতা ১৯৭৭ (বর্তমানে অমুদ্রিত)

    দীর্ঘকাল অমুদ্রিত ও অধুনা দুষ্প্রাপ্য এই গ্রন্থটির ফসিল রেকর্ড উন্মোচনের সারবত্তা প্রসঙ্গে পরবাস সম্পাদককে প্রশ্ন করলে তাঁর দ্ব্যর্থহীন উত্তর আসে যে এটি আমাদের কর্তব্যকর্মের অন্তর্গত! দীর্ঘ তেত্রিশ বছর বাদে অতএব আমি আলোচ্য গ্রন্থটির অনুসন্ধানে রত হই, এবং আমার প্রাথমিক তদন্ত অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবশতঃ নির্দেশ করে যে আমার ব্যক্তিগত কীটদষ্ট গ্রন্থ সংগ্রহে একদা বিরাজিত এই অনন্যসুন্দর পুস্তকটির স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে বর্তমানে আমি অসমর্থ। পরিশেষে অবশ্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রণীত এই প্রবন্ধ সংগ্রহটির একটি লোলচর্ম, জরাজীর্ণ কপি আমার সকাশে নিয়ে আসে একটি নব্য যুবক - ভাষা ও ভাবনার দুরূহতা যাকে এই গ্রন্থটির পঠন পাঠনে নিরুৎসাহিত করেছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের এই কপিটি আমার হস্তগত হয় শ্রীযুক্তা সুচিত্রা মিত্রের মহাপ্রয়াণের পরবর্তী দিবসে। ঘটনাচক্রে, ওই একই দিনে, আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর অবিচুয়ারী পাঠান্তে অপর এক নব্যযুবক আমাকে একান্তে জানায় যে শ্রীযুক্তা সুচিত্রা মিত্রের রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রতিভা সম্পর্কে ইতিপূর্বে সে আদৌ অবহিত ছিলো না! যুবকটি অবশ্যই বঙ্গভাষী, এবং যৎকিঞ্চিৎ সাহিত্য পাঠের অভ্যাস আছে। প্রায় জন্মাবধি যে সম্রাজ্ঞীকে বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম কাণ্ডারী বলে মেনেছি - ২০১১ খ্রীষ্টাব্দে নব্যবঙ্গ সম্প্রদায়ে তাঁর এই নিদারুণ বিস্মৃতি আমাকে হতচকিত করে। পরবাস সম্পাদকের মন্তব্যটির সারবত্তা আমি বড় নিদারুণ ভাবে অনুভব করি। শ্রীযুক্তা মিত্রের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নেবার যোগ্য লোকের অভাব ঘটবে না জানি বঙ্গদেশে - তাই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্রাত্যজন প্রসঙ্গে নিজেকে অত্যন্ত বেশী দায়বদ্ধ মনে হয়।

    পাঠকের অবগতির জন্য জানাই যে ১৯৭৭ সালে স্থানাঙ্ক নির্ণয় প্রকাশ কালে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তড়িৎ-প্রযুক্তিবিদ্যার নব্যস্নাতক - গ্রন্থটি তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মোট ন'খানি নিবন্ধের সঙ্কলন মাত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বুদ্ধিজীবী ছাত্রমহলে তিনি ইতিমধ্যেই প্রডিজি হিসেবে গণ্য: তাঁর চিন্তা গভীর ও বামপন্থী দীক্ষান্তেও মুক্তস্রোত, তাঁর পঠনের পরিধি অনন্যসাধারণ, রচনাভঙ্গী অননুকরণীয় - যে প্রসঙ্গে আরও বিস্তৃত বিবরণ পরবর্তী অনুচ্ছেদে প্রাসঙ্গিক হবে। স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের রচনাগুলিতে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বিচরণ করেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্থান ও কালের পটভূমিতে - গদ্যভাস্কর কমলকুমার মজুমদার কিংবা দুঃস্বপ্ন শিল্পী ফ্রানসিস্কো গোইয়া প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তাঁর রচনাগুলির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিরাজ করেন। এই গ্রন্থে মোট তিনটি নিবন্ধ চলচ্চিত্র বিষয়ক: আলোচ্য ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায় ও ব্যতিক্রমী ফরাসী পরিচালক জাঁ - লুক গোদার। প্রযুক্তিবিদ্যার অমনোযোগী ছাত্রটি যে পরবর্তী জীবনে চলচ্চিত্রবিদ্যার সফল অধ্যাপক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন তার অজস্র ইঙ্গিত বুঝি এইসব নিবন্ধে তিনি অবহেলাভরে ফেলে রেখে যান।

    একদা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় দর্প সহকারে উচ্চারিত হয়েছিলো যে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যকে রক্তাল্পতা থেকে মুক্ত করবেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর আশু প্রকাশিতব্য স্থানাঙ্ক নির্ণয় গ্রন্থে। সেই অ্যারোগ্যান্ট বেদবাণীর রচয়িতা আমি - অধুনা প্রায় তেত্রিশ বছর বাদে স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের নব্যপঠন কালেও, ওই মন্তব্য প্রসঙ্গে অনুতপ্ত নই। স্থানাঙ্ক নির্ণয় আমাদের প্রত্যাশা মিটিয়েছিলো - আমরা পাঠকেরা প্রতিশ্রুতি রাখিনি। হোক না বিলম্ব - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্যের কিছু নিদর্শন সাধারণ্যে উন্মোচিত হোক!

    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের রচনাগুলিতে তাঁর ভাষা প্রায় এক অলৌকিক অবলম্বন। তাঁর রচনায় এক নিদারুণ গুরুচণ্ডালির কাকোফেনিতে চেম্বার সংগীতের বিশুদ্ধি ছড়িয়ে যায় গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের সীমারেখা লুপ্ত ক'রে। এই গ্রন্থের সুকান্ত ভট্টাচার্য বিষয়ক প্রবন্ধটি তিনি বস্তুত: কবিতায় রচনা করেন! তাঁর রচনার কিছু সৌরকরোজ্জ্বল পংক্তি আজও বড় নিবিড়ভাবে আমার স্মৃতিতে প্রোথিত আছে। কয়েকটি নিদর্শন উপস্থিত করি।

    "বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ হয়ে গেছে জানবার পর স্তব্ধ প্রায় আমরা প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসি। ওই লঘুছন্দ মুখর ভঙ্গিমা, প্রপাত, গভীর রাত্রির হস্তাক্ষর কিছু নয়। মৃত্যুর পরে কিছু নয়।"
    (জাঁ-লুক গোদারের চলচ্চিত্র নারী-পুরুষ প্রসঙ্গে)

    "তারপর একদিন আমরা জেগে উঠি দীর্ঘ নিদ্রার পর। রূপকথার মতো, নারীর মতো, প্রেমের মতো সেইসব প্রথম ভোরের আলোয় সত্যের মুখ দেখা যায়। সেইদিন সমস্ত চরাচরের স্বর্ণগর্ভ উদ্যানে কুসুমে কুসুমে ফুটে ওঠে ঋত্বিক কুমার ঘটকের চরণচিহ্ন।"
    (অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক প্রসঙ্গে)

    "অভিমান উচ্চশ্রেণীগত। অভিমান উত্তরাধিকারের। অভিমান স্ব-জাতির পাপাগ্নিকুণ্ডে নিজেকে অদাহ্য শিলাখণ্ডের ন্যায় বিশুদ্ধ রাখার কবচ বিশেষ। অভিমান আত্মহননকামী। সুতরাং দেবদূতদের ক্রন্দনের বিষয়।"
    (কমলকুমার মজুমদার প্রসঙ্গে)

    "উপনিষদের পাতাগুলো ডুবে গেলেও - জীবনানন্দ দাশ অক্ষয়: এরূপ দীন সিদ্ধান্তে বর্তমান লেখকের করাঙ্গুলি স্থাণু হয়।"
    (অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে)

    পাঠক, নিবন্ধগুলির একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক হবে।

    স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের প্রথম রচনাটির নাম শতবর্ষের বঙ্গদর্শন। বুদ্ধিজীবী ও নানা প্রশ্ন নামক, বর্তমানে অপ্রাপ্য একটি সংকলন গ্রন্থের মাধ্যমে আমি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের এই রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হই। সেই মুগ্ধতার স্মৃতি আজও দুর্মর। বস্তুত: গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ রচনার আঙ্গিকে সঞ্জয়ের গদ্যরীতি এখানে আছড়ে পড়ে বলদর্পী সুনামীর মতো। বঙ্কিম প্রবর্তিত বঙ্গদর্শন সাময়িকীটির শতাব্দীলগ্নে সঞ্জয়ের হাতে বাংলাভাষা ও সাহিত্য সাবালক ও আন্তর্জাতিক: "অদ্য খ্রীষ্টীয় বিংশ শতকের এক-সপ্ততিতম বর্ষ। সেপ্টেম্বর মাসের পঞ্চবিংশতি দিবস। সময় প্রভাত: ছয় ঘটিকা। স্বয়ম্বর অভ্যস্তা বঙ্গ-সাহিত্যলক্ষ্মী শ্রী কমলকুমার মজুমদার নামক কোনো রূপবান ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করিলেন। আমরাও পুনরায় সংসারে মনোযোগ দিতেছি।" - সঞ্জয়ের এই ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তারিখটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিবস। অতঃপর সঞ্জয় বিচরণ করেন তাঁর সাহিত্য ভাবনার এক অত্যাশ্চর্য ধূসর জগতে যেখানের জয়েসের সঙ্গে ইবসেন বিরাজ করেন, অথবা কাফ্‌কার সকাশে সার্ত্র কিংবা গোর্কী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা জীবনানন্দ অনুপস্থিত থাকেন না। এই অত্যাশ্চর্য পঠন পাঠন জনিত অভিজ্ঞতা সঞ্জয় জারিত করেন তাঁর মার্ক্সীয় প্রত্যয়ে - এক্ষেত্রে তাঁর সেই অমোঘ বিশ্বাস আমার অন্তত আরোপিত অথবা ডগমাটিক মনে হয় না।

    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের রচনার আমি পরিতৃপ্ত পাঠক। তাঁর অধিকাংশ রচনাই আমার প্রিয় - একটি বিরল ব্যতিক্রম এই সংকলনের দ্বিতীয় নিবন্ধটি - গতি তবে স্তব্ধতার মতো। যদিও সঞ্জয়ের কর্বুরিত ভাষা ব্যবহার এই রচনাটিকে আশ্চর্যভাবে প্রাণবন্ত করে, তাঁর সুপঠনের নিদর্শন সম্ভ্রম জাগায়, তথাপি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে স্পেস টাইম কনটিনিউয়াম তথা আপেক্ষিকতার অবতারণা - যে সিঙ্গুলারিটি তথা সোনার পাথরবাটির জন্ম দেয় তা, অন্তত আমার কাছে জীবনানন্দ দাশের প্রতি সুবিচারের নিদর্শন বলে গণ্য হয় না। যদিও এই রচনার শেষ বাক্যটি আমার অতি প্রিয় এবং আমি তা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করেছি।

    সঞ্জয়ের জীবনানন্দ আলোচনায় যে পরিতৃপ্তির অভাব জাগে আমার মনে তার পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ পাই এই গ্রন্থের তৃতীয় রচনা, অভিমান ও সেই শব্দের রহস্য পাঠে - যা কমলকুমার মজুমদারের গল্প সংগ্রহের একটি অনবদ্য বিশ্লেষণ। দুরূহ, দুর্বোধ্য, লেখকদের লেখক ইত্যাদি নানা বিচিত্র বর্ণনায় ভূষিত কমলকুমারের ছোটোগল্প গুলির স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে সঞ্জয় নির্ভুল: এই রচনায় তাঁর শিল্পবোধ এক সম্ভ্রমবাহী পরিমিতি পায়। কমলকুমারের একলব্য উত্তরাধিকার সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখনী চলনে - অথচ জীবন দর্শনে তিনি অবস্থান করেন কমলকুমারের বিপ্রতীপ কোণে। সঞ্জয় যখন লেখেন "কমল মজুমদারের সত্য আকাশচারী। আমরা প্রস্তর, মাংস ও নিশ্বাস চাই ও সেই সত্য যাকে ছোঁয়া যায়" তখন তাঁর সঙ্গে সহমতে বর্তমান সমালোচক নির্দ্বিধ ৷

    তিন দশকেরও বেশী হয়ে গেল, যখন আমার মতো আদার ব্যাপারীদের সঞ্জয় পরিচিত করান স্প্যানিশ চিত্রী ফ্রানসিস্কো গোইয়ার সঙ্গে তাঁর লাবণ্যময় রচনা হীরকে কে রাখে ওষ্ঠর মাধ্যমে। এই আলোচনা নির্মাণের প্রাক্কালে একদা অতিপ্রিয় এই রচনাটি আমি আবার পাঠ করি এবং পাঠান্তে আনন্দিত হই। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে যেহেতু আজ গোইয়ার শিল্পকর্মের প্রতিলিপি তথা বেশ কিছু আলোচনা গ্রন্থ বিদ্যমান - সঞ্জয়ের রচনাটির পুনর্বার পাঠান্তে আমি স্বচ্ছন্দে এ বিষয়ে আরও কিছুটা নাড়া ঘাঁটা করি ও গোইয়ার চিত্র সমুদয় পর্যবেক্ষণে বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করি। স্মরণ রাখা ভালো যে হীরকে কে রাখে ওষ্ঠ রচিত হয় ইন্টারনেট বিহীন প্রস্তর যুগে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মধ্যবিত্ত ছাত্রের পক্ষে গোইয়ার চিত্রদর্শনের জন্য তৎকালে ঠিক কতখানি কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজন হ'তে পারে তা বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে অনুভব করা দুষ্কর। ইদানীং গোইয়া প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ সময় ব্যয় ক'রে - সঞ্জয়ের রচনাটির প্রতি আমি পুনর্বার অনুরক্ত হয়ে পড়ি। যদিও একই সাথে এও আমি অনুভব করি - সঞ্জয় যা আত্মস্থ করেন এই গোইয়া নিবন্ধ রচনাকালে, তা এই অসাধারণ প্রতিভাময় শিল্পীর সমগ্র পরিচিতি নয়। সম্ভবত: ব্যোদলেয়ার প্রভাবে সঞ্জয়ের অবসেশান গড়ে ওঠে গোইয়ার কৃষ্ণচিত্রগুলি প্রসঙ্গে। জানিনা সঞ্জয় অবহিত ছিলেন কিনা যে তার প্রত্যেকটি আদৌ বীভৎসতা তথা বিজারের ধারাবিবরণী দিয়ে, ব্যোদলেয়ার প্রদর্শিত পথে আধুনিকতার সূতিকাগার হয়ে ওঠে না। কৃষ্ণচিত্রে অন্তর্গত গোইয়ার পরিচারিকার প্রতিকৃতিটিতে একটি মুখরা মানডেন নারীকে দেখি লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ। সঞ্জয় বর্ণিত শিশু ভক্ষণরত দানবটি আদতে শয়তান স্বয়ং - শিশুটি তারই আত্মজ। এই চিত্রে যা প্রকাশ পায় তা তৎকালীন খ্রীষ্টিয় পরিমণ্ডলে ব্যাপ্ত ও বিন্যস্ত পেগান মিথ। এই চিত্রের মাধ্যমে "ইয়াংকী সভ্যতার রোগজর্জর মানচিত্র"টির উদঘাটনা প্রসঙ্গে সঞ্জয়ের মন্তব্য মেঠো বক্তৃতায় হাততালি কুড়োতে পারে হয়তো - কিন্তু যুক্তিনির্ভর বক্তব্য হিসেবে হাস্যকর ঠেকে। যে আধুনিকতার সন্ধান করেছেন সঞ্জয়, তাকে তিনি আরও অনায়াসে খুঁজে পেতেন গোইয়ার এচিং গুলির মধ্যে - এ রচনায় যারা আশ্চর্যজনকভাবে অনুল্লেখিত। রাজশিল্পী গোইয়ার শিল্পকৃতিকে উপেক্ষা করেছেন সঞ্জয় তাঁর প্রগতিশীলতার অনুধ্যান থেকে - তাঁকে আমি গোইয়াকৃত সপরিবারে মহামহিম সম্রাট চতুর্থ চার্লসের প্রতিকৃতিটি দেখতে অনুরোধ করবো। যে অসীম দুঃসাহসে স্বয়ং মহারানীকে গোইয়া অঙ্কন করেছেন এই চিত্রে, এখানে যে ভঙ্গিমায় তিনি দণ্ডায়মান তাতে হাস্য সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এই দুঃসাহস আধুনিকতার অঙ্গ, অন্যান্য রাজপটুয়ার থেকে গোইয়া তাই স্বতন্ত্র ও অননুকরণীয়। আমি অবাক হইনা তাই যে পরবর্তীকালে পিকাসো ঝঞ্ঝাযুগে ও প্রাক্তনী গোইয়া পরিপূর্ণ রূপে প্রাসঙ্গিক থাকেন। হীরকে কে রাখে ওষ্ঠের মুখবন্ধে ব্যোদলেয়ারের অনবদ্য অনুবাদটি বুদ্ধদেব বসু কৃত। গ্রন্থে অনুবাদকের নাম অনুল্লেখিত - যদিও স্মরণে আছে সাময়িকপত্রে রচনাটির প্রথম প্রকাশকালে সেটি বিদ্যমান ছিলো। এই ত্রুটি সম্ভবত অনবধানজনিত তবু এর উল্লেখ করা সঙ্গত মনে হ'লো। দীর্ঘ ব্যবধানে সঞ্জয়ের এই রচনাটির নব্যপাঠে আমি বিমোহিত - আলোচিত বিচ্যুতিগুলির বিদ্যমানতা যেহেতু রসাস্বাদনের বিঘ্ন ঘটায় না।

    ন্যুব্জ মেট্রোপলিস ও চাঁদ ওঠেনি সিন্ধু পারে - এই গ্রন্থে সংকলিত আমার অতিপ্রিয় রচনা। লেখাটির আত্মপ্রকাশ অধুনালুপ্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় - ব্যতিক্রমী ফরাসী পরিচালক জাঁ-লুক গোদারের নারী-পুরুষ চলচ্চিত্রটির ধারাভাষ্য হিসেবে। গোদারের এই ছবিটি তৎকালীন নব্য প্যারিসের এক সুদক্ষ নির্মাণ। কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দুটি যুবক যুবতী - পল ও মাদলেইন, রচনাকালে সঞ্জয়ের সমবয়সী, - অস্থির, বিক্ষুব্ধ - জীবনের সাথে একাধারে সংশ্লিষ্ট ও নির্লিপ্ত। যাদের বামপন্থা - স্বয়ং গোদার বর্ণিত “মার্কস ও কোকাকোলার সন্তান”! এই ছবিটির চিত্রনাট্য পরতে পরতে উদঘাটন করেছেন সঞ্জয় এই রচনায়ঃ তাঁর বিশ্লেষণী শক্তি, তাঁর ভাষা ব্যবহার এক মহাসমারোহে আবির্ভূত এখানে। “পারি বলতেই আমার মনে পড়ত প্রথম চুম্বনের পর বালিকার আরক্ত কপোল, এখন এই লোলচর্মা গণিকার কাছে আমি কোন মুক্তির ভিক্ষা রাখবো?” কোন মুক্তির ভিক্ষা রাখবো, সে প্রশ্ন আমারও। কেননা ধর্মগতভাবে হিংস্র হলিউড বিরোধী জাঁ-লুক এই সেদিন সম্মানিত হলেন হলিউডে তাঁর যাবজ্জীবন কৃতকর্মের জন্য। সেই প্রসঙ্গে একদা তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধী সঞ্জয়ের একটি দীর্ঘ পরিশীলিত প্রবন্ধ অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হ'লো আনন্দবাজার পত্রিকায়। আমার পরিচিত ক'লকাতা নামক ন্যুব্জ মেট্রোপলিস নগ্ন অধুনা। মাতৃভাষা নামক মাতৃদুগ্ধের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ফোর্সফিডিং এর কল্যাণে বর্তমান প্রজন্ম ভাষাগত অগ্নিমান্দ্যে ধুঁকছে। প্রসঙ্গত ফরাসীদেশের নব্য নেপলীয় রাজশক্তি দ্বিধাহীনভাবে গোদারীয় চিন্তন বিরোধী। এই পরিবর্তিত প্রতিবেশে পরিচিত নদীগুলি গতিপথ পালটালে আমি আশ্চর্য হবার কারণ খুঁজে পাইনা। শুধু বিগত প্রায় ত্রিশ বৎসর যাবৎ শিল্প ও সংস্কৃতির পটভূমি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনের পরে সুপ্তোত্থিত রিপ ভ্যান উইংকল এর মতো আমার অনভ্যস্ত চোখে এই নব্য আলোকরশ্মিগুলি, হয়তো বা অনভিপ্রেত ভাবে, যৎসামান্য অস্বস্তির সৃষ্টি করে।

    ফিরে আসি সঞ্জয়ের রচনায়। অশনি সংকেত তথা সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে রচিত 'রোমান্টিক মন্বন্তর বনাম হাঘরে রোমান্টিকতা' নামক রচনাটিতে সঞ্জয়ের বিশ্লেষণ সুন্দর। যদিও দীর্ঘদিন বাদে রচনাটির পুনর্পঠনে মনে হ'লো এখানে সত্যজিতের প্রতি তিনি অতিরিক্ত নির্মম। বঙ্গভূমি জায়মান সর্বনাশের চিত্রণ করেছেন সত্যজিৎ রায় প্রায় সেজানের প্রশান্ত ল্যাণ্ডস্কেপের ভঙ্গিমায় - সঞ্জয়ের এই অভিযোগের খণ্ডন করা যায় শুধু এই বলে যে সত্যজিৎ দেখাতে চান যে এ দুর্যোগ মনুষ্যসৃষ্ট, অতএব কৃত্রিম - প্রকৃতি এই দুর্ভিক্ষের দায়ভোক্তা নয়, অতএব অশনি সংকেত পর্বে তার লাবণ্যহানির কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ সত্যজিৎ দেখতে পান না। "রং এ ছবিকে মায়াময় করেছে সাদা-কালোতে হয়তো বিদীর্ণ হতে পারত পর্দা" সঞ্জয়ের এই উক্তি ২০১১ সালে আজ নিতান্তই অ্যানাক্রনিস্টিক ঠেকে। তাছাড়া আমার বুঝতে অসুবিধে হয় ঠিক কি কারণে ডাই হার্ড গোদার ভক্ত সঞ্জয় অশনি সংকেতে সত্যজিতের লিপিচিত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে আপত্তি তোলেন। তবে "এই প্রথম সত্যজিৎ বাবুর নায়িকা নির্বাচন প্রশ্নাতীত হল না - ববিতা বেশ সফিসটিকেটেড" সঞ্জয়ের এই অমোঘ মন্তব্যটি আজও আমার কাছে ও সম্ভবত: আরও বহু পাঠকের কাছে পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বলে গণ্য হবে।

    ঠিক যতটা অসহিষ্ণু সঞ্জয় অশনি সংকেত প্রসঙ্গে, ঠিক ততটাই সহিষ্ণু তিনি ঋত্বিক ঘটকের বিশ্লেষণে। এখানে গ্রন্থিত তাঁর নিবন্ধ ঋত্বিকতন্ত্র পাঠতৃপ্তির নিরিখে অনবদ্য: সঞ্জয়ের আলোচনা ঋদ্ধ, বিশ্লেষণ সুন্দর। শুধু সমস্যা এই যে ঋত্বিক ঘটকের স্বকৃত, প্রায় নৈরাজ্যিক জীবনযাপন প্রণালী সঞ্জয়ের চোখে রোমান্টিক মায়াঞ্জনের মতো: "তিনিই সম্ভবত আমাদের চোখে দেখা একমাত্র বিখ্যাত মানুষ মৃত্যুকালে যার কলকাতায় স্থায়ী বাসস্থান বলতে কিছু ছিল না, ছিল না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কোন অনির্বচনীয় চেক বই" - ঋত্বিক প্রসঙ্গে এই মুগ্ধতা সঞ্জয়ের নিরাসক্ত চলচ্চিত্র বিশ্লেষণের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।

    ঋত্বিকের প্রতিভার অনন্যসাধারণতা নিয়ে সঞ্জয়ের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। যদিও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি অনিয়ন্ত্রিত নব্য-বোহেমীয় জীবনযাপন এই মহাপ্রতিভার পূর্ণসমারোহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে। যিনি স্বতন্ত্র তিনিই মহান নন, বরং যিনি মহান স্বাতন্ত্র্য তাঁর অস্থিমজ্জাগত। যে তীব্র আবেগ ঋত্বিকের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রকে তাড়না করেছে - তাতে বুঝি আরও কিছু সংহতির অনিবার্য প্রয়োজন ছিল - এই উপলব্ধির সঙ্গে দীর্ঘদিন বাদে আমার ঋত্বিকতন্ত্র পুনর্পঠনের আনন্দগান অন্বিত হলো।

    বাদবাকি দু'টি রচনার মধ্যে 'সুকান্তর পঞ্চাশ বছর'এ সঞ্জয়ের গদ্য যেন একটি স্তোত্র নির্মাণে রত। "জেনেছি র‍্যাঁবোর ইতিবৃত্ত, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সমর বা সুভাষের তুলনায় প্রায় গ্রাম্য চারণ; তবু যে কেন সুকান্ত প্রসঙ্গে অনুরাগ রয়ে গেছে" - সঞ্জয়ের এই প্রারম্ভিক বুদ্ধিজীবী সুলভ সংশয় দ্রবীভূত হ'য়ে যায় অনুভূতির বিপুল প্লাবনে: "সবকিছুকে ছাপিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যকে। সেই প্রেম পোয়েটিক্সের খবর রাখে না; নিতান্তই সমর্পণ। তাতে সরলতা ছিল।" পাঠক স্মরণ করুন প্রায় বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে আসা আরও একটি বুদ্ধিজীবী কণ্ঠস্বর: "সুকান্তকে আমি ভালোবেসেছিলুম, যেমন ক'রে প্রৌঢ় কবি তরুণ কবিকে ভালোবাসে; দূর থেকে লক্ষ্য করেছি তাকে, সে একটি ভালো লাইন লিখলে উৎসাহ পেয়েছি নিজের কাজে।" (বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য 'কবিতা' থেকে)। এখানে যেন সেই একই স্বীকারোক্তির অনুরণন বাজে! জানিনা কোন মন্ত্রে সুকান্ত ভট্টাচার্য ছুঁয়ে যান এঁদের - শুধু মনে পড়ে একদা আমাকে ছুঁয়ে যাওয়া তাঁর কিছু অনতিপরিচিত কবিতার স্বপ্নিল পংক্তিগুলি: "আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়, তবুও পড়িবে মনে" - আজ রাতে এক অনভিজ্ঞ বালকের হাতে কবিতার নবজন্ম ঘটবে!

    অবশিষ্ট রচনাটির নাম 'প্রগতির পাঠশালায়', যা কার্ল মার্কসের শিল্পীসত্ত্বা প্রসঙ্গে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা। আন্তর্জাল বিপ্লবের ওভারহোয়েলমিং ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পবিপ্লব প্রভাবিত মার্কসীয় অনুশাসন গুলির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে - যেমন একদা সংশয় জ্ঞাপন করেছিলেন দুর্বিনীত ইতালীয় সমাজতাত্ত্বিক ভিলফ্রেদো প্যারিটো (১৮৪৮-১৯২৩) - সামাজিক অর্থনীতির অঙ্গনের বাইরে বিশুদ্ধ গণিত তথা প্রয়োগধর্মী প্রযুক্তিবিদ্যা আজ যাঁর কাছে চিরঋণী হয়ে আছে। সঞ্জয় যদিও রাজনীতির তন্বিষ্ঠ নিরীক্ষক, তাঁর প্রবন্ধে বর্ণিত মার্কস "আইন পাঠের চেয়ে নন্দনতাত্ত্বিক সমস্যায় অধিক চিন্তিত - তাঁর যাবতীয় মেধা ও সংকল্প নিযুক্ত হয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্য, গ্রীক শিল্প ও পুরাণ বিষয়ে।" সেই তরুণ আজও বড় প্রাসঙ্গিক - এই পোড়া দেশে নব্য তরুণ প্রজন্ম চিনুক তাকে - সেই অন্ধকারে যেখানে সুচিত্রা মিত্র বিস্মৃত হন (যদিও সংবাদপত্রের বর্ণনানুসারে তাঁর শেষ যাত্রায় নাকি মানুষের ঢল নেমেছিলো!)

    সুদীর্ঘ তিনদশক বাদে আবার স্থানাঙ্ক নির্ণয় পাঠ করে আমি স্তব্ধ হ'য়ে বসে থাকি। প্রায় কাকতালীয় ভাবে হঠাৎই খুলে দেখা কোনো একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে আচমকা দেখি একটি পিংখাড়ু কিশোর সাম্প্রতিক কালের 'মন করে তুরুত্তুরু' জাতীয় কোনো চলচ্চিত্রের আলোচনায় টেনে আনছে গোদারের ব্রেথলেস প্রসঙ্গ! আমিও যেন স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের ফসিল রেকর্ড আঁকড়ে থাকার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই। এই গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ হোক, পুনঃপ্রচার ঘটুক। কি ভাবে? ঠিক স্পষ্ট ধারণা নেই আমারঃ হয়তো বা রাষ্ট্রসংঘে দাবীর সনদ পেশ করা যেতে পারে, বিকল্পে করা যেতে পারে পরবাস সম্পাদকের মুণ্ডপাত! তরীকা বাতলানোর দায়িত্ব পাঠক, আপনার। আপাতত: পরবাসের পাতায় আমি শুধু নির্দ্বিধায় লিখতে চাই: স্থানাঙ্ক নির্ণয় বেঁচে থাকুক আমাদের মননে - আমাদের শিল্প চেতনা সম্পৃক্ত হোক।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments