'বুবাই, ওঠ্ ওঠ্ - শিগগিরি ওঠ্। না হলে এই গায়ে জল ঢেলে দিলাম। উঠবি না তো? সাড়ে আটটা বেজে গেছে - মা বলেছে তোকে গানের ক্লাশে ছেড়ে দিতে, আমি মাঠে যাব, ক্রিকেটের প্র্যাকটিস আছে আমার।' বুবাইয়ের তিন বছরের বড়ো দাদা টুবাই ছোটভাইকে ঘুম থেকে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু বুবাইয়ের ঘুম থেকে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে বিছানায়। দাদার উপর খুব বিরক্ত হচ্ছে সে। রাগও হচ্ছে। দাদাটা যেন কী! মনে হচ্ছে উঠে গিয়ে ওর মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিই। এমনিতে দাদাকে খুব ভালোবাসে বুবাই, দাদাকে না দিয়ে কিছু খায় না। সারা দিনের সব কথা দাদাকে না বললে ওর একটুও ভালো লাগে না। পড়াশোনায় নাকি খুব ভালো দাদা, সবাই বলে। ছাই ভালো, বুবাই ভাবল, এই বুদ্ধি! কাউকে ঘুম থেকে তুলতে হলে অত চেঁচামেচি করতে নেই। পড়াশোনায় ভালো ছেলের এটুকুও বোধ নেই যে আস্তে আস্তে ডাকতে হয়, শান্তভাবে কথা বলতে হয়। মা যে কী সুন্দর করে ডাকে - বুবাইসোনা ওঠো, দেখি তো পদ্মফুল ফুটেছে কিনা। দেরি করলে সব কাজে দেরি হয়ে যাবে যে! বুবাই তখন বালিশে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে হাতের পাঁচ আঙুল দেখাবে। বুঝে নিতে হবে আরো পাঁচ মিনিট সময় চায় সে। দাদামশায়ও খুব ভালো করে ডাকেন ঘুম থেকে তোলার সময় - ঘোঁতন কুট্কুট্, ওঠো ওঠো, অনেক বেলা হয়ে গেল যে! কত রোদ উঠেছে। চড়াইপাখিরা চাল খেতে এসে গেছে। বুবাইয়ের দিদুও আরেকজন - ঠিক দাদার মতো করে ডাকেন, জোরে জোরে। বুবাইয়ের রাগ হয় খুব। সে চোখ বুজে বলে, আস্তে দিদু আস্তে। ভোরসকালবেলায় এত চেঁচামেচি করতে নেই। হাঁকডাক বুবাইয়ের একদম ভালো লাগে না। কিন্তু দিদুর উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না সে। দিদুর কত কাজ! তা ছাড়া বুবাইয়ের যত আবদার সব দিদুর কাছে। দিদুর সঙ্গে সে দোকানে বাজারে যায়। দিদুর কষ্ট হয় তাই ভারি জিনিশগুলো বয়ে নিয়ে আসে। গানের ক্লাশে, জাপানী ক্লাশে, সাঁতারে সব জায়গায় দিদুর সঙ্গে যায়। দাদা মা বাবা সবাই ব্যস্ত তাই।
বুবাই বিছানা ছেড়ে নামল। দাদা দাঁড়িয়েছিল সামনে, এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। বেশ জোরে দরজা বন্ধ করল। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল, ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। আকাশের মুখভার, ঠিক বুবাইয়ের মতো। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বাগানে জল দেওয়ার পাইপ দিয়ে বাথরুমের দেয়াল ভেজাতে লাগল। বাবার দাড়ি কামাবার ব্রাশ, শেভিং ক্রিমে জল, মায়ের সাবানের বাক্স থৈ থৈ, তাকের সব জিনিশ ভিজে একাকার, মুখ মোছবার তোয়ালেটাও ভিজে গেল। বাথরুমের সিলিঙে জল ছেটাতে লাগল সে, একটা টিকটিকি ছিল সিলিঙে, টুপ্ করে মাটিতে পড়েই দৌড়ে সিস্টার্নের পেছনে ঢুকে গেল। জায়গামতো পাইপটা রেখে দিয়ে বুবাই ভাবল, দাঁত কি মাজতেই হবে? রোজ রোজ দাঁত মাজবার কী আছে? বাঘেরা কি রোজ দাঁত মাজে? হাতিরা? বেড়াল, কুকুর, সিংহরা? বুবাই দাঁত মাজল না, মুখে চোখে জল দিয়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বেরিয়ে এল।
মা খেতে ডাকলেন। গম্ভীরমুখে একটুখানি খেয়ে এসে বারান্দায় দাদামশায়ের ইজিচেয়ারে বসে সামনের রোদজ্বলা মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইল। দাদামশায় রোজ বাঁদুরে টুপি, সোয়েটার আলোয়ান জুতো মোজা পরে মর্নিং ওয়াকে বেরোন। বুবাইয়ের খুব ইচ্ছে করে দাদামশায়ের হাত ধরে, বাঁদুরে টুপি জুতো মোজা সোয়েটার পরে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু ভোরসকালে ঘুম থেকে ওঠার মন্ত্রটা বুবাই কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারে না। ঐ যা, আবার ভোরসকাল! মা শুনলে এক্ষুনি বলবেন, তোমাকে কতবার বলেছি বুবাই, হয় ভোর বল, নয় সকাল বল - ভোরসকাল আবার কী? কিন্তু বুবাইয়ের যে কী হয় - ভোরসকালই এসে যায় মুখে।
বুবাই দাদামশায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে। সবে ভোর হয়েছে। ওরা বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সোনালি রোদ আর কুয়াশায় মাখা বন প্রান্তর। ভিজে পাতায় সুর্যের আলো। গাছের পাতা থেকে শিশিরের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। কিছুদূর যাবার পর একটা নীল জলের হ্রদ দেখতে পেল ওরা। ওদের চারপাশে অনেক গাছপালা। বড়ো বড়ো গাছ জলের উপরে ঝুঁকে পড়েছে। অনেক দূরে ধোঁয়াটে নীল পাহাড়ের সারি! হ্রদের জল সূর্যের আলোয় টল্টল্ করছে। জলে অনেক পাখি - পরিযায়ী পাখির মেলা বসেছে। দাদামশাই বললেন, এরা এসেছে সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়ার টাক্লামাকান থেকে, কেউ এসেছে ইউরোপ থেকে।
ওরা হ্রদের ধারে শিশিরে ভেজা একটা মসৃণ পাথরের উপর বসল। বনমোরগের ডাক শুরু হয়েছে চারদিকে। একটা ময়ূর ওদের সামনে দিয়ে এসেই বনের মধ্যে ঢুকে গেল। শুকনো পাতায় খচমচ আওয়াজ। বুবাই তাকাল সামনে। বড়ো বড়ো ঘাসের জঙ্গল। ঘাসের আড়ালে আড়ালে হরিণ ঘুরছে, তাদের গেরুয়া গায়ের ওপর শাদা শাদা গোলগোল ফোঁটা। দাদামশাই বললেন, এরা হল চিতল হরিণ। বুবাইদের দেখে হরিণের দল কাজলপরা চোখে অবাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইল। প্রহরী হরিণ ঠক্ করে একটা আওয়াজ করতেই আশপাশের হরিণের দল বড়ো বড়ো লাফ মেরে ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। দাদামশাইয়ের হাত ধরে বনের মধ্যে হাঁটতে আরম্ভ করল বুবাই। গাছপালা কমতে কমতে বন ফুরিয়ে এল প্রায়। বুবাইয়ের খুব ভালো লাগছিল। ভোরের এই ঠাণ্ডা হাওয়া, এই নিঃশব্দ চারদিক। ওরা ক্রমে লোকালয়ে এসে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে বুবাই দেখতে পেল সারি সারি মাটির ঘর, চালে লাউ কুমড়ো হয়ে আছে, আমকাঁঠালের গাছ, আতা গাছ, পেয়ারার গাছ, গাছভর্তি বাতাবিলেবুর ফুল। ফুলের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। বুবাই অনেক ছোট বয়স থেকে দাদামশাইয়ের কাছে গাছপালা চিনতে শিখেছে। কোন্টা আমগাছ কোন্টা কাঁঠালগাছ, কোন্টা জাম আর কোন্টা জামরুল বুবাই বলে দিতে পারে। শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কাঠগোলাপ, কল্কে সবকিছু জানে বুবাই।
আজ খেলতে যাবি না, বুবাই? এই বুবাই - গুড্ডুর ডাকে চমকে জেগে উঠল বুবাই। এ কী, সন্ধে হয়ে এসেছে যে?