এখান থেকে উত্তর দিকে তাকালেই আকাশে ভাসমান একটা অটল মেঘস্তূপের মতো যেটা চোখে পড়ে তা আসলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্ছার কাছে ওটা হয়তো ঘরের প্রতীক, এবং আকাশস্থ বলে তার অপার মহিমা। কাঞ্ছা গরম রুটি আগুনে উল্টে দিতে দিতে প্রায়ই একটা চার লাইনের গান গায়, যার ধুয়োটা হল: 'গৌরীশংকর নাচেহন্।' তখন তার মন ঐ মেঘমুকুটের হাতছানিতে অবশ হয়ে থাকে। আর ঐ দুর্বোধ্য ভাষায় করুণ পাহাড়িয়া সুরটা বার বার শুনতে ইচ্ছে করে একটা মানুষের। বাবুর নাতি তামনের, যে কোলকাতা থেকে ছুটিতে দাদুর বাড়ি এলে কাঞ্ছার কাছ-ছাড়া হতে চায় না।
এই চার লাইনের সুরটা ছাড়া কাঞ্ছা আর কিছুই বহন করে আনে নি কাঞ্চনজঙ্ঘার দেশ থেকে। সেখানে সে ফেরেও নি কোনোদিন। এ-বাড়িই তার গৃহ হয়ে গেল। সমাজের যে-কোনো স্তরেই ভৃত্যের লক্ষণ মাইনের ব্যবস্থায়। কিন্তু কাঞ্ছার এ-বাড়িতে কোনো মাইনে নেই। অর্থাৎ, সে বাড়ির লোক। বাবুর কাছ থেকে সে প্রয়োজনমতো টাকা চেয়ে নিতে পারে। তার আলাদা ঘর, আলাদা খাট, আলাদা শৌচালয় আছে। আলাদা স্নানাগার নেই, কারণ স্নান সে কুয়োতলাতেই সেরে নেয়। এমনকি, পুজোপার্বণে তার আলাদা জামাকাপড়ও বরাদ্দ আছে। বাবু বাড়ির ফর্দ লেখেন: কাঞ্ছার জামা ২টী প্যান্ট ১টা। সব চাইতে বড়ো কথা, কাঞ্ছার গলার জোর আছে এখানে। বাড়ির লোকেরা যখন চিঠিপত্র লেখেন তার মধ্যে তারও উল্লেখ থাকে। দিদিরা জানতে চায়: 'কাঞ্ছা কেমন আছে? ওর পায়ের চুল্কানিটার খবর কি?' বাবু লেখেন: 'কাঞ্ছা এখন ভালই আছে। সে একটী বিবাহ করিয়াছে।' অথবা তার পরিণতি: 'কাঞ্ছা উহার বউকে তাড়াইয়া দিয়াছে। সে এখন মুক্তপুরুষ। বউটী মাঝে২ আসে। আমি উহাদের বলি বাহিরে গিয়া ঝগড়া কর।'
চার লাইনের সুরটা কাঞ্ছা কবে থেকে গাইছে জানে না। ভারতবর্ষের আর কোনো সংগীতধারা তার ওপর প্রভাব ফেলে নি। বাবু যখন চামেলি বাগানের ফিটারবাবু ছিলেন, কাঞ্ছার বয়স ছিল আঠারো, আদিনাম ধনলাল (মঙ্গর) সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি, এবং সে গোরুবাথানের রাস্তায় বাবুর সঙ্গে সাপ্তাহিক হাটে যেতো, তখনও সে এই গান গেয়েছে। বাবু যখন রিটায়ার করে মলংবাজারে বাড়ি করলেন, তখন সে-ই প্রথমে আদরের লাইকাকে সঙ্গে নিয়ে নতুন বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে এল। তারপর একদিন জগ্দ ড্রাইভারের পাশে বসে বাগানের ট্রাকে করে সামান নিয়ে এল। লাইকা মালপত্তরের মাথায় গিয়ে বসে রইল।
নতুন বাড়ির কাছেই ছিল পশু হাসপাতাল। এখানে ঘরে ঘরে গবাদি পশু; সেই কারণেই হয়তো পত্তন। শিল্পাঞ্চলের কাছে যেমন থাকে ই-এস্-আই হাসপাতাল। এই ছোট্ট মাঠওয়ালা, তিন-ঘর ও এক বারান্দা-বিশিষ্ট জায়গাটা হয়ে উঠল লাইকার খুব আগ্রহের। মুমূর্ষু গোরুরা এখানে সকালবেলায় এসে ইঞ্জেকশনের ঠেলায় হাম্বা হাম্বা করতো, লাইকা পালিয়ে গিয়ে সেই গো-কুলের খুরে খুরে ভুলভুলাইয়া খেলে বেড়াতো। হাসপাতালে ওর ছিল নটের মতো সমাদর। তবে নট একবার এল রোগী হয়ে, হাসপাতালের নথিতে প্রথম কুকুর রোগী। সে লাল একটা ওষুধ সাদা ট্রে থেকে চুক্চুক্ করে খেল, মাটিতে মুখ পেতে ছুঁচ নিল, বাড়ি গেল হাঁপাতে হাঁপাতে। তারপর ঘুম থেকে আর উঠল না। বাগানের কিনারায় ডুমুর গাছের নিচে তার সমাধি হল। কাঞ্ছা আর তামন মাটির ওপর চারটে বিস্কুট রেখে এল। ওদের কান্নায় ভেসে লাইকা নভোমণ্ডলে চলে গেল।
ডুমুরতলার ঐ মৃত্যুপূত ভূখণ্ডটা একবার প্রাণোন্মেষেরও সৌধ হয়ে উঠল। তামনের চোখের সামনে একটি গোবৎসের জন্ম হয়। কাঞ্ছা বলল, 'যাও, কোদালি নিয়ে এসো।' তারপর, গোরুটি তেড়ে আসার আগেই তারা দু'জনে মিলে তার গর্ভজাত টক্টকে লাল ফুলটিকে তাড়াতাড়ি মাটিচাপা দিল, একেবারে লাইকার পাশেই। বাছুরটা তখন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
কাঞ্ছা ছিল বাবুর গোশালার কর্তা। চারটে গোরু, তাদের নাম (কাঞ্ছারই দেওয়া), ঘোড়া কালী গাই আর রত্না। তামন আর সে বয়েজ স্কুলের মাঠে ঘাস কেটে বস্তা পিঠে বাড়ি ফিরতো। ঘোড়াটা ছিল কিঞ্চিৎ দামাল। সে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতো না। গোষ্ঠের বদলে সে তখন আশ্রয় পেয়েছে খোঁয়াড়ে। হাহাকার করতে করতে বেরিয়ে পড়তেন বাবু কাঞ্ছা আর তামন। যথাযোগ্য জরিমানা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা হতো। তার ল্যাজ মুচড়ে কান মুলতে মুলতে আসতো কাঞ্ছা। ঘোড়ার পায়ের চাঁট-ফাট তখন বন্ধ।
তামন শৈশব থেকেই কাঞ্ছাকে ডাকে 'তাদি'। শিশুরা যে-বয়সে উদ্ভট শব্দ গড়ার খেলা খেলে - একগাল হেসে বলে 'বাগি', কিম্বা 'লুলু', বা ঐ-জাতীয় অবোধ্য কিছু - হয়তো সেই পর্বেই সে খুঁজে পেয়েছিল এই ডাক। তার যাবতীয় কৌতুক আর অত্যাচারের পাত্র কাঞ্ছা। তাদির খাপসুদ্ধ ভোজালিটা নিয়ে তার নাড়াচাড়া করা চাই। আবার জোড়া-ভোজালির মিনেচার-খচিত কালো টুপিটা লুকিয়ে না রাখলে ভালো লাগে না। সে মাঝে মাঝে দাদুর আলমারি খুলে যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে। বিশেষ পছন্দ নানা সাইজের হ্যাণ্ড-ড্রিল, আর টিন কাটার কাঁচিটা। ড্রিল দিয়ে সে মেঝে দেয়াল ফুটো করে, তাদির হাফপ্যান্টে ছিদ্র তৈরি করে, এবং শেষে তাদির মাথার খুলিতেও ফুটো করতে যায়। কাঞ্ছা ব্যথিত চিত্তে বলে ওঠে, 'তাদি! সে-সেরকম (অর্থাৎ, এরকম) কোরো না।' তামন বলে, 'কেন? এটা ফুটোস্কোপ তো।'
বাড়ির সামনে ডাইনে-বাঁয়ে বাগান, ফুল আর সব্জি। পেছনের বাগানে কাঁঠাল ও অন্যান্য গাছ। কাঞ্ছা ঝারি নিয়ে জল দেয়, খুরপিতে উঠে-আসা মাটির গন্ধে মশগুল হয়ে যায়। বছরের বেশির ভাগ সময় তো বাড়িতে কেবল সে আর বুড়ো বাবু। তখন ঐ চারটে গোরু আর তিনটে বাগানই তার জীবন। মাঝে মাঝে কাঁঠালের সন্ধানে ছিঁচকে চোর আসে। একবার সব্জি বাগানে ডাকাত পড়ল। লক্ষ্মীপুজোর আগের রাত। ওরা বাবুকে তাড়া দিল: 'বুড়া চুপ কর্।' কাঞ্ছাকে শাসাল, 'এই ন্যাপা! বাইর হইলে শেষ কইরা দিব।' সেও 'এই শালা বংগালিকা বাচ্চা' বলে ভোজালি আনতে গেল। ডাকুরা ততোক্ষণে সাতষট্টিটা কপি তুলে নিয়ে গেছে। বাগানের জালের বেড়াটাও দিয়েছে কেটে।
বংগালিকা-বাচ্চা আর নেপালিকা-বাচ্চার বিরোধটা কোথায় যে লুকিয়ে থাকে কেউ জানে না। কাঞ্ছা তো বাঙালি পরিবারেরই স্নিগ্ধপ্রাণ একজন মানুষ। হারানো সব্জির প্রতি মমতায়, বাবুর লোকসানে, সর্বোপরি বাঙালি ডাকাতের মুখে জাত-তোলা বাক্য শুনে তার রাগটা পুষে রাখা রইল। একদিন সেটা প্রকাশ পেল অদ্ভুতভাবে। তামন ছুটিতে এসে মেলার মাঠে ক্রিকেট খেলতে যায়। কাঞ্ছা তার এস্কর্ট। সে লক্ষ্য করে ছেলেগুলোর কী চাপা জিঘাংসা কোলকাতার ছেলের প্রতি। সে রোজ তামনকে বলে, 'তাদি, ওদের সঙ্গে যেয়ো না।' কিন্তু কে শোনে। একবার এল্-বি-ডব্লিউ নিয়ে ঝগড়া বাধল। সুরেনমাস্টারের ছেলে বাচ্চু চট্ করে তামনের চশমাটা খুলে নিল। তামন আবাল্য ক্ষীণদৃষ্টি; বাবা বলেন, চশমাটা ওর কবচকুণ্ডল। তবু তার দুর্বলতম জায়গায় আঘাত করেই তো আনন্দ। এখনও স্ত্রীপুরুষ প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে তাকে বলে, 'শালা অন্ধ!' মাঠে তার লাঞ্ছনা দেখে ছেলেগুলো 'কানাওলার আইজ হইছে' বলে হাসতে লাগল। এ তো শুধু কবচকুণ্ডল খোয়া যাওয়া নয় - একেবারে রথের চাকা যেন মাটিতে বসে গেল, ঘোড়াগুলো শূন্যে পা আছড়ে হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। তামন হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল, আর সকলের কাছে মার খেতে লাগল। ঠিক এই সময় কাঞ্ছা তার ভোজালিটা খুলে ভিড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুখে সেই 'বংগালিকা বাচ্চা!' প্রথমেই ভোজালির বাঁট দিয়ে দু'জনকে মারল প্রচণ্ড রদ্দা। নিমেষে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। অনেকে চটি ফেলে রেখে পালিয়ে গেল।
কাঞ্ছাও আবাল্য ডান পায়ে পোলিও-তে খোঁড়া। তাকেও বিস্তর 'ল্যাংড়া কাঞ্ছা' শুনতে হতো। সে আজ সমস্ত কিছুর শোধ তুলতে যাচ্ছিল। সে-রাত্রে লোকাল কমিটি এল। তখনও পুলিস কোনো দলের হুকুমে খবরদারি করতো না। ধমক শাসন হুঁশিয়ারিতে একটা মীমাংসা হল। সকলে চলে গেলে তামনের মিনতিতে কাঞ্ছা গুন্গুনিয়ে 'গৌরীশংকর' ধরল।
কাঞ্ছা কিন্তু শহরের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। লোকে সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে বাড়ির সামনে হেঁকে বলে, 'ও কাঞ্ছা -।' কুয়োতলা কি গোয়াল থেকে জবাব আসে, 'হো - ও - ওঃ।' স্থানীয় মানুষ বনমন্ত্রী শ্রীবাস মিত্রও তাকে দেখলে বলেন, 'কাঞ্ছা, ভালো আছিস্?' সে কিছু না বুঝেই বলে, 'লাল সেলাম।'
কাঞ্ছার সঙ্গে তামন এমন কিছু অভিজ্ঞতার সীমানায় প্রবেশ করে যা তার বয়সের জন্যে নয়; অথবা যা তাকে আগামীর পুলকে উসকে দেয়। যেমন, নদীর ধারে বস্তির বউদের স্নান ও নিত্যকৃত্য। তারা সহসা পাথরের আড়ালে চলে যায় কেন? ও তুমি বুঝবে না, তামন। নদীই বা ঐটুকু জল নিয়ে কোন্দিকে যায়? ১৯৭৭-এর গ্রীষ্মে রেলের মাঠে বিরাট জনসভা হল। জ্যোতি বাবু এলেন। শ্রীবাস মিত্র সভার সূচনা করলেন। সকলকে লাল আবীরের ফোঁটা পরিয়ে দিল। তামন ভাবল অকাল-হোলি। দড়ি থেকে একটা ফিনফিনে কাগজের নিশান ছিঁড়ে নিয়ে 'জিন্দাবাদ' বলতে বলতে সে আর কাঞ্ছা ফিরে এল। এটা তামনের দ্বিতীয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। অনেক ছোটোবেলায়, কোনো এক অস্ফুট চা-বাগানে, কারা বল্লম নিয়ে মিছিল করতো, বড়োরা জঙ্গল সাঁওতালের নাম বলতো ভয় দেখানোর জন্যে, আর কানে আসতো শতকন্ঠের আওয়াজ 'ধরমবীর বাংলা ছাড়ো', সে শিশুকণ্ঠে তার অনুরণন করতো।
তাদের একটা অভিজ্ঞতার রহস্য তামন আজও ভেদ করতে পারেনি। শীতকালে বাবাজীর মঠে শামিয়ানা খাটিয়ে ভজন হতো। সে-শীত প্রচণ্ড শীত। জায়গাটা আবার ছিল শহরের প্রান্তে, পুরোনো রেল জংশনের ধারে। এই দক্ষিণগামী রেলপথটা নদীর পরিত্যক্ত সোঁতার মতো পড়ে আছে, মূল রেল-ধারা সরে গেছে দূরে ও পুবদিকে। নদী মুখ ঘোরায় ভূতাত্ত্বিক খেয়ালে, রেলপথ চলে রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে। হয়তো একদিন এ-পথে গাড়ি যেতো রংপুর কি ঐদিকে, আজ তার কি প্রয়োজন? বাবাজীর মঠে ভজন চলে সন্ধে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তামন আর কাঞ্ছা দু'টি বকধার্মিকের মতো সেখানে গিয়ে বসে। মাঝে মাঝে মালগাড়ির শান্টিং-এর আওয়াজ আসে। আর সভার ঠিক মাঝখানে জ্বলে একটা বিরাট হোমকুণ্ড। সেটা ঘিরে ঘিরে ভক্ত স্ত্রীপুরুষেরা কখনও কখনও নৃত্য করে। এক রাত্রে হঠাৎ সামনে থেকে এক দীর্ঘকেশিনী মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একটা বিকট আর্তনাদ করে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। নিমেষের মধ্যে তাঁর কেশরাশি জ্বলতে লাগল, আর সেই সময় যেন ঢোলটা বেজে উঠল বিকট শব্দে। কাঞ্ছা চুপিচুপি তামনকে নিয়ে বাইরে চলে এল; অনেকেই তখন দৌড়চ্ছে। কি হল, কি বৃত্তান্ত, কিছু বোঝা গেল না। কাঞ্ছা শুধু বলতে লাগল, 'তোমার সেই কথা বুঝতে হবে না। বাড়ি চলো।'
কিন্তু কাঞ্ছা তো একজন পূর্ণবয়স্ক জোয়ান হৃদয়বান পুরুষ। সে মাঝে মাঝে গুম হয়ে যায় পাথরের মতো, বাবুও তখন তাকে ভয় করে চলেন। একদিন রাত্রে সে বাবুর দাড়ি কামাবার খুর নিয়ে গেল কোষমুক্ত করে; গিয়ে বসল কুয়োর একেবারে কিনারায়। হুংকার ছাড়ল, 'আর থাকব না', দু'চোখে তার খুন জ্বলছে। বৃদ্ধ বাবু ছুটে গেলেন প্রাণভয় উপেক্ষা করে, তার পুত্রসম বালকটির কাছে। ধস্তাধস্তিতে তাঁর শীর্ণ হাত কেটে গেল, পাকা লোমগুলো পাণ্ডুর হয়ে গেল।
এর কিছুদিন পরে কাঞ্ছা আসে মদেশিয়া বউ নিয়ে। বিনা ভূমিকায় সে বাবুর সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অনেক পরে কাঞ্ছা সংক্ষেপে জানায়, 'বউ'। বাবু হেসে বলেন, 'বাসনগুলি এইবার ভালো কইরা ধুইতে কইস্।' এই দাম্পত্য অবশ্য তিন মাসের। এরই সূচনা ও সমাপ্তির কথা বাবু চিঠিতে লিখেছিলেন। কাঞ্ছা একদিন বেল্ট খুলে বউকে মারতে থাকে। 'চোর! চোর! নিকাল্ যা।' বউ নাকি একটা ডিম চুরি করে খেয়েছিল। 'হামরো' ঘরে কেউ কোনোদিন চুরি করে নি। পুরো পর্বটা হ্রস্বতায়, ও সব মিলিয়ে, দাম্পত্যের একটা শিক্ষানবিশির মতো হয়ে উঠল।
কাঞ্ছা কোনোদিন যেটা স্পষ্ট করে ভাবতে পারে নি তা হল বাবুর মৃত্যুর কথা। যেন আকাশের ঐ মেঘপদবীর মতো তিনি প্রাচীন ও মৃত্যুহীন। বাবু অবশ্য মাঝে মাঝে বলতেন কথাটা। কাঞ্ছা শুনলেই বলতো, 'বাবু, সেইরকম বলবেন না।' কিন্তু তিনি বলতেন। এই বাড়িটায় বাস করবার মতো কেউ থাকবে না। সবাই তো এখানে ওখানে। এখানকার প্রাইমারি স্কুলটার ভালো বাড়ি নেই, ভাবছি ওদের দিয়ে দেব। তুই হবি স্কুলের দারোয়ান। দিদিদের কাউরে কইস্ না। কাইলই একবার সুরেশবাবুরে ডাক্ তো। সুরেশবাবু আসেন। কথাবার্তা হয়। তিনি জানান, কমিটিকে বলবেন।
১৯৮২-র গ্রীষ্মে তামন এল। বর্ষার শুরুতে চলে গেল। সে এখন কতো বড়ো! ওরও জীবনকুঞ্জে রঙিন বনচ্ছায়ার সময় হল, কাঞ্ছা বুঝতে পারে। তিন বছর আগে কাঞ্ছাও গিয়েছিল কোলকাতায়, যখন লরিতে করে দাদার সব মাল গেল। সেই লরি! এই যান পথিকের জন্যে, খোলা রাস্তায় উদাস তার গতি। পান্থ, তুমি পথে-দেখা কোনো মুখ মনে রাখো না। তখনও তামন এতো জোয়ান ছিল না। ঐ মহানগরে ট্রাউজার্স-পরা ভদ্রবেশী তার তাদি কী সলজ্জ সশঙ্ক খাপছাড়া! তামন মমতায় গলে গিয়েছিল।
তারপর, ১৯৮২-র পূর্ণবর্ষার এক ভোরে বাবু বাথরুমে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন। মাত্র চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হল। বিকেলে মলং নদীর ধারে, বাবুর দুই কন্যার নির্বন্ধে, কাঞ্ছাই তাঁর মুখাগ্নি করে এল।
তামন এল শ্রাদ্ধে। রইল ১৪-১৭ অগস্ট। সেই তাদের শেষ দেখা।
এর পরে কি হবে? স্কুলের কথাটা একমাত্র কাঞ্ছা জানতো। এতোদিনে তা প্রকাশ পেল। বাঃ, মন্দ কি? দিদিরা ফিরে গেল কোলকাতা আসাম বিলাসপুর। দাদা রয়ে গেল ব্যবস্থা করতে। কিন্তু হায়, একটা ইচ্ছা, আর একটা কর্ম! জানা গেল, স্কুলের কমিটিই অবহিত নয় ব্যাপারটা সম্পর্কে। অগত্যা দু'জন দালালকে বাড়ি বিক্রির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দাদাও ফিরে গেল। কাঞ্ছা রয়ে গেল শূন্য বাড়ি আর গো-পরিবার আগলে।
দু'মাস পরে যখন দাদা ফিরে এল তখন দু'জন ক্রেতা পাওয়া গেছে যারা একযোগে বাড়ির দুটো অংশ কিনতে চায়। তারা নাকি দু'দিকের ঘরের সংযোগকারী দরজায় দেয়াল গেঁথে নিজ নিজ অংশ আলাদা করে নেবে। তাহলে - এই এক অভেদ্য ভিটেটা দু'ভাগ হতে চলল! দাদা বলে, 'কাঞ্ছা, সবই তো শেষ হল। গোরুগুলো তোরই থাক। গোয়ালটা আমরা বিক্রি করব না। পেছনের টালির ঘরটাও থাকবে। তোর বাথরুমটাও থাকবে। আমি বলি কি, তুই থেকে যা। সেইমতোই লেখাপড়া করব।' কিন্তু কাঞ্ছাকে তখন কিছুই স্পর্শ করছে না। তার সরল প্রাণে তখন অন্য টান। সে জানাল, 'না, সেরকম হলে কি করে হবে? আমাকে টাকা দিতে হবে।'
- হ্যাঁ, টাকা তো নিশ্চয়ই দেব। তুই পনেরো হাজার পাবি।
কাঞ্ছা যেন টাকার অঙ্কটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে হন্হন্ করে বেরিয়ে গেল। দুপুরবেলায় ফিরে এসে বলল, পঁচিশের কমে হবে না। ভাষাটা পাল্টে গেছে এর মধ্যেই।
এদিকে ক্রেতারা সব খবর পেয়ে জানাল ঐ অদ্ভুত ব্যবস্থায় তারা রাজি নয়। দিলে পুরো বাড়িই খালি করে দিতে হবে। কাঞ্ছা যেন তৈরিই ছিল। নিশ্চিন্তে বলল, তাহলে পঞ্চাশ লাগবে। এবং প্রত্যাশিতভাবেই deus ex machina-র মতো লোকাল কমিটির পাণ্ডারা হাজির হলেন। মীটিং বসল সামনের ঘরে। ওরা বললেন, 'হ্যাঁ - ও এতোদিনের লোক। ওর একটা দাবি আছে। পঞ্চাশের কমে -'
'না দেখুন, গোরুগুলো দিচ্ছি - ।' অনেক কষ্টে রফা হল ছত্রিশ হাজারে।
বেরিয়ে যাবার সময় ওঁরা একজন দূরে গিয়ে কাঞ্ছাকে কি বললেন। দু'হাতের সব ক'টা আঙুল দিয়ে দেখালেন - 'তাইলে, ফাণ্ডে দশ । মিউচাল কইরা দিছি। বেশি বেগড়বাই করিস্ না কিন্তু। দেখিস্।'
প্রথমেই কাঞ্ছা ঘর বাঁধে। এবারে আর রেবেকা নয়, হেন্রিয়েটা। বিশুদ্ধ নেপালি মেয়ে, শোভা; হিন্দুমতে তাদের বিয়ে হয়। চম্পা সিনেমার পাশে কাঠগোলা, তার পাশে তাদের ভাড়াটে কুঠি। কাঞ্ছা গোরু চরায় নদীর ধারে। আর কিই বা সে জানে। পুরোনো জীবনের শৃঙ্খলা খসে পড়ছে। সে বিকেলবেলায় জুয়ো খেলে, রাত্রে মাঝে মাঝে হাঁড়িয়া খেয়ে ঘরে ফেরে। শোভার তখনও রানির মতো ঠাট। কিন্তু এক রাত্রে কাঞ্ছার কালী গোরুটা হারিয়ে গেল। তারপরে ঘোড়া পড়ল অসুখে। পশু হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই সে ঢলে পড়ে। লাইকার পরে আরও একজন। কাঞ্ছা একবার বাবুর বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে নেয়। বাগানের সমাধিক্ষেত্রটায় যদি একবার যাওয়া যেতো! নাকে আসে নতুন উনুনে নতুন ফোড়নের গন্ধ।
অবশেষে শোভা তেলেভাজার দোকানে চাকরি নেয়। কাঞ্ছা অবশিষ্ট টাকায়, আর গাই আর রত্নাকে বেচে দিয়ে, একটা দোকান কেনে। কিন্তু বিক্রি করবে কি? মূলধন কোথায়? এদিকে শোভারও চাকরি নেই; সে গর্ভবতী। কাঞ্ছা ঘুরে বেড়ায় পথে পথে। একদিন ছোড়দি দেখে ফেলেন, হাটের কাছে কে পাথর ভাঙছে। জন হেন্রি? না, কঙ্কালসার কাঞ্ছা।
এক শুভলগ্নে তাদের মেয়ের জন্ম হল। নাম হল মায়া। তারপর অন্য এক লগ্নে কাঞ্ছা এলিয়ে পড়ল রাস্তায়। ঠিকাদার তাকে পৌঁছে দিয়ে গেল হাসপাতালে। সেখানে নামধাম লিখতে লিখতে গোস্বামীবাবু জানতে চাইলেন, 'গার্জেনের নাম বলো।' কাঞ্ছা পকেট থেকে বার করে স্বেদসিক্ত একটা কাগজ, তাতে দাদার নাম ও কোলকাতার ঠিকানা লেখা। 'কোলকাতা! বাঘা যতীন!' গোস্বামীবাবু কাগজটা হাতে নিয়ে চমকে ওঠেন। 'বলো কি! আমার বাড়ি তো আজাদগড়ে।' সকলেই এখান থেকে কোলকাতার দিকে যায়। শুধু অল্প কিছু মানুষ এখানে এসে বসতি করেন। সুবিমল গোস্বামী এমনই উলটো দিকে আসা একজন।
শেষ নিশ্বাস পৃথিবীর শেষ দায়। তা চুকিয়ে দিয়ে কাঞ্ছা ক'দিন পরে চলে গেল। হয়তো যেখানে গৌরীশংকর নৃত্য করেন, সেইখানে।
এমন জীবনকাহিনির অভাব নেই, কি সাহিত্যে কি জীবনে। ছন্দঃপতন, ভাঙন ও বিলয়। কবির সেই অতিপরিচিত ভৃত্য বনমালীর কি হল? কে যেন খবর এনেছিলেন, সে গ্রামে গিয়ে বাবামশায়ের কিছু বই-টই নিয়ে একটা লাইব্রেরি করেছে, সেখানে সে রোজ ধূপধুনো জ্বালিয়ে বসে। বনমালী কিছুটা আলোকপ্রাপ্ত তাহলে।
আর মলংবাজারের শশাঙ্ক সরকারের একান্ত সেবক কাঞ্ছা -
কাঞ্ছার জীবনরঙ্গ শেষ হল। শোভা অচিরেই বিয়ে করে নিল কাঞ্ছার ঠিকাদার লগনদেওকে। মেয়েকে রেখে গেল দিদিমার কাছে। মায়ার জীবন ক্রমে ক্রমে লীলায়িত হয়ে উঠল। পৃথিবীর রাশি রাশি ধুলো তাকে দুহিতা বলে বরণ করে নিল। সে বাংলা বলতে শিখল বাঙালি মেয়ের মতো। সে স্কুলে গেল কিছুদিন। তারপরে বাঙালি বাড়িতে বালিকা-ঝি হয়ে ঢুকে পড়ল। তার বাবাও নাকি বাঙালি বাবুর ছেলের মতো ছিল। তার তিনটে বাগান ছিল, চারটে গোরু ছিল। বাবুরা তাকে সমস্ত দিতে চেয়েছিলেন, সে গোরু ছাড়া কিছুই নিল না। দিদিমা বলে এসব কাহিনি। মায়া তখন একটা ছবিতে চোখ রাখে। কোনো বাঙালি পরিবারের গ্রুপ ফোটো - কেন্দ্রস্থলে এক বৃদ্ধ, তার বাবা, আর একটি বালক। একদিন সে সুনীল ডাক্তারের নার্সিংহোমে আয়ার কাজ পেয়ে যায়।
এদিকে তাদের দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর ধুলোতে বিস্তর কাদা, মানুষের জটলা, আর অবোধ্য অস্থিরতা। কারা এসে বোঝাচ্ছে, আমরা চা-শিল্পভূমির বিমিশ্র জনগোষ্ঠী। আমাদের আদিভূমি যাই হোক, এই ভূখণ্ডই আমাদের স্বদেশ, এই রাজ্যের পতন-অভ্যুদয়ের আমরা শরিক। সন্ধ্যায় আবার কারা আসছে; বলছে, বংগাল সরকারের দালালদের খুঁজে বার করো, বেংলাদেসিরা আমাদের শত্রু, আমরা পৃথক রাজ্য গড়ব, স্বয়ং 'বারত সরকার' আমাদের সহায়। এই দলটির মেয়েরা কোনো কোনো ঘরেও ঢুকে যায় - মায়ার মায়ের মতো সব মুখ - এরা তার দিদিমার সঙ্গে দেশি বুলিতে গল্প জুড়ে দেয়। সেদিন এরা বলে গেল, স্কুলের মাঠে জমায়েত, এই এখনকার মতো শেষ, তারপরে যা কিছু সব ভোট খতম হলে। বহিন্কে যেতে হবে, বুড়িমাও যেন যায়।
ওরা পায়ে পায়ে চলেছে স্কুলের মাঠের দিকে। কেউ যাচ্ছে সাইকেলে। সামনের ঐ মোড়টায় পৌঁছলেই মাঠ। বাঁদিকের কাঁঠাল গাছটার জন্যে এখনও দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ওদের বুকের মধ্যে শব্দ হচ্ছে ঢিপ্ ঢিপ্ ঢিপ্। এমন সময় দিদিমা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। মায়ার হাত ধরে টানল। 'ওই দ্যাখ, মায়া! তোর বাবার বাড়ি।' দিদিমা হাঁপাচ্ছে। মায়া অবাক হয়ে দেখে। ভাগ-হয়ে-যাওয়া বাড়িটার দুটো গেট, মাঝ-বরাবর একটা বেড়া। দু'পাশে দুটো উপেক্ষিত বাগান একজোড়া অলস চোখের মতো। তাকে কেউ কখনও চিনিয়ে দেয়নি। দিদিমা ছাড়া চিনতোই বা কে। - এই তার বাবার রাজ্যপাট!
সামনের দু'টি ঘরের দুটো দরজায় দুই বাঙালি মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন।
মায়ার কয়েকটি বিহ্বল মুহূর্ত কেটে যায়। সে যেন দ্বিখণ্ডিতা। তারপরেই বাড়িটার দিকে একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে সে সবেগে অখণ্ডচিত্তে পা মেলায় মিছিলে।
কাঞ্চনবর্ণা মেঘশ্রেণী তখন পদাতিকের গতি ও দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে যায়।