আমার লনে ঘাসেদের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। বাতাসে বসন্তের ঘ্রাণ। রাত ফুরোতে না ফুরোতে পাখিরা এসে ঘুম ভাঙায় আমার। আমি পর্দা খুলে নতুন দিনের প্রথম আলোকে অভিবাদন জানাই। শিশিরস্নাত আকাশে প্রভাতের অবগুন্ঠন উত্তোলিত হয় ধীরে ধীরে। নববধূর সলাজ মুখ রাঙা আবিরের স্পর্শে সূর্য হয়ে ওঠে।
এপ্রিল, ক্যানাডার চপলা মুখরা এপ্রিল, আমার দুয়ারে উপস্থিত।
একসময় এমন ছিল যে বরফ গলার সাথে সাথে গ্রামবাংলার চাষীদের মত কাস্তে-কোদাল হাতে আমি বেরিয়ে যেতাম বাগানের আবর্জনা সাফসুফো করে নতুন ঋতুর জন্যে তৈরি হতে। সারাদিন ধরে মরা ঘাস নিড়িয়ে গা অবশ হয়ে যেত। সবজির বাগান ছিল আমার শখ, ফুলের বাগান গিন্নির। দুজনে মিলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতাম ওর ফুল আর আমার বেগুন-টমাটো-লঙ্কা-শশার চারা কেনার জন্যে এক নার্সারি থেকে আরেক নার্সারিতে। ফুল ছিল গিন্নির রক্তশিরাতে, সবজি আমার। আমি কাব্যি করে বলতামঃ তুমি হলে বাগানের মালিক, আমি তার মালি।
শনি রোববার হাজার কাজের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কাজ ফেলে ওকে বলতামঃ চল। ভ্রূকুটি করে ও বলতঃ কোথায়? জানিনা কোথায়। গাড়ি যেখানে নিয়ে যায়। ও আমার পাগলামির খবর জানত। ক্যানাডার বসন্তে আমি কাণ্ডজ্ঞান হারাই, এই ছিল ওর বদ্ধমূল ধারণা---এ ধারণা খণ্ডানোর কোনও চেষ্টাই করিনি কোনদিন। কাণ্ডজ্ঞান হারাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার, তবু যেন ক্ষণচর বসন্তের দুটি রঙিন পাপড়ি মিছিমিছি ঝরে না যায় জীবন থেকে। ছেলেদুটিকে খেলার ঘর থেকে তুলে আমরা গাড়ি করে কোথায় কোথায় চলে যেতাম। শহর থেকে দূরে, যেখানে জলের শব্দ শোনা যায়। যেখানে গাছেরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে নগ্ন আলিঙ্গনে। আশেপাশের ছোট ছোট শহরগুলোর একটিও আমাদের অদেখা থাকেনি---আর্নপ্রায়ার, পার্থ, স্মিথ ফল্স্, পেমব্রুক, কর্নওয়াল, আলফ্রেড, ক্যাসেলম্যান, প্রেসকট। ছোট শহর, সরু পথ, ছোট ছোট নদীনালা, খালবিল, পুল, পার্ক, গ্রামের বুনো গন্ধ আর নিশ্চল নীরবতা। এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো নিরীহ চেহারা রেস্টুরেন্ট। মন চাইল, এক জায়গায় থেমে এককাপ কফি খেয়ে নিতাম, ছেলেরা হয়ত খেতে চাইত আইসক্রিম বা পটেটো চিপ। ক্ষিদের কারণে থামা নয়, থামার জন্যে যে আকস্মিক ইচ্ছাটি, সেই ইচ্ছার কারণে। বা একান্ত অকারণে। বসন্ত মানুষের জীবনে অকারণের ঝর্ণাকে স্রোতস্বিনী করে। আকস্মিককে করে অনন্ত।
এপ্রিলের প্রথম থেকেই আমার বাড়ির আঙিনাতে আগন্তুকদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। বরাবরই হয়। প্রতিবেশীদের বেড়ালেরা জানে আমি ওদের বেশি পছন্দ করিনা---বেড়াল আমার প্রিয় প্রাণীদের অন্তর্গত নয়। ওরা আমার শখের বাগানে অত্যন্ত অশখের কাজখানা সেরে আলগোছে সরে পড়ে প্রায় রোজই---যেন আমার বাগানটি এত যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে কেবল মার্জার জাতিটারই সুখসুবিধার কথা ভেবে।
শুধু বেড়াল আসে তা নয়। কাঠবেড়ালিরাও, যদিও ওদের প্রতি কোনও বিরূপ ভাব পোষণ করিনা আমি। বরং ভালোই লাগে ওদের দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে এটাওটা খেতে দেখতে। আমার ব্যাকইয়ার্ডে প্রচুর পাখিও আসে---নানাজাতের নানারঙের পাখি। আমার স্ত্রী বেঁচে থাকাকালে ওরা দল বেঁধে আসত। বিশেষ করে শালিক। কারণ ছিল। গিন্নি ওদের খাবার দিতেন---বিস্কুট বা রুটির টুকরো, চালের গুঁড়ো (যেমন তেমন চাল নয়, একনম্বর বাসমতি চাল)। ও মারা যাবার পরের বছরও ওরা এসেছে---করুণ চোখে তাকিয়ে থেকেছে, খুঁজেছে ওকে এখানে ওখানে। কি আশ্চর্য ওদের স্মরণশক্তি। এতবড় একটা শীত কেটে গেল, অথচ বসন্তের প্রথম আভাস পাওয়ার সাথে সাথে ঠিক একই জায়গায় এসে উপস্থিত। আমার কাছ থেকে তেমন সাড়া পায়নি---এত কাজের মাঝে বসে বসে পাখি খাওয়ানো আমার ধাতে নেই। কিছুদিন এভাবে হতাশ হয়ে হয়ে তারা হয়ত টের পেয়েছিল যে তাদের সেই প্রাণের মানুষটি কোথাও চলে গেছে---এখন যে আছে তার মন বড় শক্ত। শক্ত, হ্যাঁ, বড় শক্ত হয়ে গেছে মন। এছাড়া কি উপায় আছে কোনও বেঁচে থাকার।
তবুও কি জানেন, এপ্রিল এলেই হতভাগা পাখিগুলো আমার ব্যাকইয়ার্ডে এসে আমাকে হ্যালো বলে যায়। গত উইকেণ্ডে একটা অসম্ভব সুন্দর লালরঙা পাখি ফ্যামিলি রুমের জানালায় উঁকি দিয়ে খোঁজ নিয়ে গেল আমি এখনও বেঁচে আছি কিনা। না থাকলেও যে কেউ জানবে না সেকথাটি বোধ হয় পাখিরা জানে। তাই তারা মাঝে মাঝে খবর নিতে আসে---ক্ষুদকুড়ো কিছু খেতে দিই বা দিই। এদেশে তো আজকাল একা মানুষের অভাব নেই---সারা শহরই তো ভরে গেল অবসরপ্রাপ্ত সঙ্গীহারাদের দিয়ে। ওদের খবর তরুণরা জানবে কি করে---তাদের না আছে সময় না আছে সুযোগ। আমার লনের পাখি আর প্রাণীদের সময় আর সুযোগ কোনটারই অভাব নেই।
সময়ের অভাব আমারও নেই---হয়ত সময় ফুরিয়ে গেছে বলেই। আগে সময় ছিল আমার শত্রু, এখন তার মত বন্ধু নেই। যখন তখন তাকে নিয়ে খেলায় বসে যেতে পারি। এই ধরুন আমার পুরনো কর্মস্থল। কোনও প্রয়োজন নেই অফিসে যাবার---লোকে ভাববে লোকটার তো কোন অফিসই থাকবার কথা নয়, তাহলে সে আবার অফিসে যায় কেমন করে। নিশ্চয়ই লোক দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কি বলব, একেবারে অস্বীকার করি কি করে। অফিস তো সত্যি সত্যি আমার থাকবার কথা নয়---আমার কোনও ছাত্র নেই, গবেষণা নেই, কোনো কমিটিতে কেউ ডাকেনা, সেমিনারে টক দিতে হয়না, আমি ক্যাম্পাসে যাই বা না যাই তাতে কারো কিছু আসে যায় না। তাহলে কোন্ দুঃখে আমি ‘অফিসে’ যাব। সত্যি তো, কোন্ দুঃখে? আসলে কি জানেন, যাবার প্রয়োজন নেই বলেই যাই। যাবার আনন্দে যাই। আগে যেতাম যেতে হত বলে। এখন যাই যেতে হয়না বলে। এর নাম স্বাধীনতা---অবশেষে আমি প্রয়োজনের নিয়ম দ্বারা চালিত নই, আনন্দের নিয়ম আমাকে নিয়ন্ত্রিত করে। অবশেষে আমি মুক্ত, সব শৃংখল সব বন্ধন থেকে মুক্ত। অবশেষে আমি একা একা দাওয়ায় বসে নিরিবিলি দুটি গান শুনতে পারি। আমার পছন্দের গান যা আমার হৃদয়ের কোষে কোষে ডোরে ডোরে নাড়া দেয়---রবিঠাকুরের গান, অতুলপ্রসাদের গান, আবার ইচ্ছে হলে কখনও শুনি বেথোফেনের এম্পারার, ব্রামসের কনচার্টো নাম্বার ওয়ান, চাইকোভস্কির বেহালার সুর। গান যখন শুনি সাধারণত চোখ বুঁজেই শুনি---পৃথিবীর আর সব দৃশ্য যখন ঢাকা পড়ে থাকে তখনই বুঝি স্বর্গদুয়ার পুরোপুরি উন্মুক্ত হতে পারে। তারপর যখন চোখ খুলে তাকাই বাইরে তখন দেখি অবাক, অবাক, আমি আর একা নই, পাখিরা এসে যোগ দিয়েছে আমার গানের আসরে। আমার বাড়ির পেছনে ঘাসের গালিচা শ্রোতাদর্শকে ভরে গেছে।
এইভাবেই কাটে আমার প্রয়োজনহীন, দায়দায়িত্বহী্ন, মায়াপারের মায়াময় বিকেলগুলি।
বসন্তের সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা সেখানেই। তীব্র, প্রলম্বিত শীত জীবনকে দখল করে রাখে প্রায় পুরো সাত মাস। মানুষ তার পীড়ন থেকে নিষ্কৃতি চায়, চায় কম্বল ছেড়ে রাস্তায় নেমে বাচ্চাদের সঙ্গে হকি খেলতে। তাই বসন্তের প্রথম আভাসেই তারা ব্যাকুল হয়ে ওঠে কখন পাতাদের কাকলি শুরু হবে গাছে গাছে বনে বনে। কখন তারা শীতের বস্ত্র পরিত্যাগ করে বস্ত্রহীনতার পরম সুখেতে ভাসিয়ে দিতে পারবে তাদের মনপ্রাণ অঙ্গভূষণ। আয়োজন শুরু হয়ে যায় ছুটির, কটেজের, নৌকাবিহার আর মৎস্যশিকারের, বার্বিকিউ আর বনভোজনের। একসময় আমার পরিবারেও ছিল সেসব---যখন ঘরগুলো ভরাট ছিল প্রিয়জনদের কলকাকলিতে, যখন বিছানায় এসেই পেতাম নরম দুটি হাতের ছোঁয়া, বুকের ওপর ধ্বনিত হত জীবিত মানুষের গরম নিঃশ্বাস। এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। ঘরগুলো অনেকদিন থেকেই খালি---সেখানে ধূলো আর স্মৃতিদের রাজত্ব। বিছানাতে অযত্ন আর অবহেলার পদচিহ্ন। বালিশে গেলবছরের তৈলাক্ত স্রাব। তবুও জীবন কেটে যায়। শীত কেটে বসন্ত আসে। বসন্ত এলে স্মৃতিরা কোথা থেকে উড়ে এসে জড় হয় আমার পেছনবাড়ির মরা ঘাসের ওপর। আজকে আমার কটেজ নেই, নৌকাবিহার দূর স্মরণের সারণীতে হারিয়ে গেছে, মৎস্যশিকারের সরঞ্জাম সব ফেলে দিয়েছি এদেশের সুপরিচালিত আবর্জনার স্তূপে---এখন এই ক্লান্ত, দগ্ধ, শতবিদ্ধ ও ভগ্ন দেহটিকে কেউ যদি করুণা করে তুলে দেয় অনুরূপ কোনও সুপরিচালিত বর্জ্যস্তূপে তাহলেই সাঙ্গ হয় এ দীর্ঘ ঋতুর পীড়ন।
প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সূর্যের মুখোমুখি হতেই যে-কথাটি উচ্চারিত হয়ে ওঠে মনেঃ কত ভাগ্য আমার। আরো একটি সকাল তার দ্বারোন্মোচন করে দাঁড়িয়েছে আমার চোখের সামনে। আরো একটি নতুন দিবস যুক্ত হল আমার জীবনপঞ্জীতে। বসন্ত আমার জীবনে তেমনি এক অবাক প্রভাতের মত। এ যেন আরো এক দৈববাণী আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে আশিসবারি হয়ে। গ্রীষ্মের চেয়ে বসন্তই আমার বেশি প্রিয়। বসন্ত আমাকে কৈশোর আর যৌবনের সেই মেঘলা সন্ধিক্ষণে নিয়ে যায়। আমাকে জাগ্রত করে, অনুপ্রাণিত করে পুনরায় পদব্রজী হতে, পুনরায় পার্কের বেঞ্চিতে একাকি আসন গ্রহণ করে হ্রদের জলেতে হাঁসেদের ভেসে যাওয়া দেখতে। ছোটবেলার সেই যে বিপুল রহস্যে ভরা মূঢ় মূর্খ সময়টা সেই মুহুর্তগুলোর পাদমূলে তুলে নিয়ে যায় আমাকে। আমার জীর্ণ দেহের কোষে কোষে জাগ্রত হয় প্রাচীন পিপাসা। আলো নয় তবু আলোর ছায়াতে মোড়া, ঘোমটা নয় তবু আড়ালের চাহনিতে মুখর, ফোটেনি তবু ফোটার আবেগে ফেটে পড়ার বাসনা---এই যে অপরূপ অব্যক্ত অপূর্ণ তৃষ্ণা, অপার তমসাচ্ছন্ন ঘনরহস্য, সেই অনির্বচনীয় মুহুর্তটির পাশে আমার এই শতাব্দীর জীর্ণ ক্লিষ্ট শরীরখানিকে স্থাপন করতে পারার মত সুখ সংসারে আর কিছুতে নেই।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কিজের ছোট উপন্যাস Memories of my melancholy whores (স্মৃতিতে আমার জীবনের যত বিষণ্ণ বারাঙ্গনা)। এর মূল বিষয়বস্তু বলতে গেলে একটি আপাততুচ্ছ এবং আপাত হাস্যকর ঘটনাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাঁর নবতিতম জন্মবার্ষিকীর বিশেষ উপলক্ষ্যটি কিভাবে পালন করবেন সে সম্পর্কে এক অভিনব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তাঁর দীর্ঘকালের পরিচিত গণিকালয়ে ফোন করে জানালেন যে ওই দিনটার জন্যে একটি বিশেষ মেয়ে দরকার তাঁর---পুরো রাতটাই মেয়েটি হবে তাঁর একক ভোগদখলে। ‘বিশেষ’ মেয়ে বলতে কি বোঝায় সেটাও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন মহিলাকে। সে হবে একেবারে নিখাদ নিষ্পাপ, অনাস্বাদি্ত, অনাঘ্রা্ত, অস্পৃষ্ট শিশুর মত সরল সুন্দর চতুর্দশী কুমারী। সব্বনাশ, এমন মেয়ে আমি পাব কোত্থেকে---মহিলা আকাশ থেকে পড়লেন। তাছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ঘরে এনে আমি জেল খাটব নাকি তোমার জন্যে? ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। তিনি জানতেন ওসব চালাকি---টাকা খসাবার মতলব। বললেনঃ আমার যত বিষয়সম্পত্তি সব বন্ধক রেখে হলেও দেব, তবুও এই মেয়ে আমার চাই।
কি অদ্ভূত শখ ‘বুড়ো’র, হয়ত ভাবলেন ভদ্রমহিলা। তবে টাকা দিয়ে সব ‘অদ্ভূত’কেই সম্ভব করানো যায়। ‘অনেক খোঁজাখুঁজি’ (অর্থাৎ মোটা টাকার ব্যাপার এখানে) করে ফরমাসমত একটি পুষ্পকলিকে এনে স্থাপন করা হল বৃদ্ধের জন্মদিনের বাসরঘরে। যথাসময়ে জন্মদিনের নায়ক সুসজ্জিত, সুশোভিত, এবং সুসৌরভ লেবাশে উপস্থিত হলেন গণিকালয়ের সেই সুনির্দিষ্ট কক্ষে। তারপর? না, এটা কামসূত্রের বই নয়, প্রথম যৌবনের হর্মোনবর্ধক, যৌনোত্তেজক বটতলার নোংরা পুস্তিকাও নয়---এটা নব্বুই বছর বয়স্ক এক গভীর মননের অধিকারী বৃদ্ধের আত্নকথনের প্রসংগ নিয়ে আলোচনা। এগ্রন্থ বোঝার সাধ্য ষাটসত্তুরে পৌঁছানোর আগে কারো হবে কিনা সন্দেহ। এগ্রন্থের মর্ম বুঝতে হলে জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় অতিক্রম করে একটা অন্তিম মাত্রায় এসে দাঁড়াতে হবে---দাঁড়াতে হবে এমন এক বিন্দুতে যেখানে সে তার নিজের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক নিস্পৃহতার আঙ্গিকে অবলোকন করতে সক্ষম হবে নিজেকে।
হ্যাঁ তারপর কি হল বলা যাক সেটা। গোড়া থেকেই বুঝা যাচ্ছিল যে মেয়েটি সারাদিন অকথ্য কায়িক পরিশ্রম করে (এক সেলাইর দোকানে তার দিনের চাকরি) নিদারুণভাবে ক্লান্ত---হয়ত ভাল ঘুমও হয়নি বেচারির গত কয়েক রাত। বুড়ো বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখেন মেয়ে বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুম। এবং একেবারে নগ্ন, অনাচ্ছাদিত---মানে শিশু, একেবারেই শিশুরা যেমন করে ঘুমায়। ভদ্রলোক তাকিয়ে থাকলেন সেই ঘুমন্ত শিশুকন্যার দিকে। একবার হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন না তাকে। একবার নাসারান্ধ্রে গ্রহণ করতে চাইলেন না সেই দেবশিশুর ‘অনাঘ্রাত’, নির্মল দেহের বিশুদ্ধ ঘ্রাণ। শুধু দুচোখ মেলে পান করে গেলেন তার রূপ, তার বর্ণ, তার অবর্ণনীয় সারল্য, তার অসামান্য নিষ্পাপতা। তার ঘন, গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ তাঁকে যেন এক অদৃশ্য রথের আসনে করে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কোন সুদূরের রহস্যপুরিতে। সারাটি রাত মেয়ে ঘুমিয়ে থাকল, আর তিনি তাকিয়ে থাকলেন। সকালবেলা কাপড়চোপড় পরে তিনি যখন বেরিয়ে গেলেন রাস্তায় তখনও মেয়ের ঘুম ভাঙেনি।
মূল গল্পটির এখানেই শেষ---বাকিটুকু একহিসেবে এরই পুনরাবৃত্তি। সাধারণ পাঠক, বিশেষ করে সাধারণ তরুণ পাঠক নিদারুণভাবে হতাশ হবেন হয়ত---এ কি গল্প হল কোনও ? বেশ্যাবাড়িতে গিয়ে বেশ্যার নেংটা শরীর দেখেই তুষ্ট---একেই ইংরেজিতে বলে ডার্টি ওল্ড ম্যান। সেজন্যেই বলেছিলাম গোড়াতে, এগল্পের মর্ম বুঝতে হলে বয়সের ভার লাগবে। কারণ বয়স না হলে মানুষ কখনোই তার চামড়ার আবরণ থেকে বের হয়ে নিজের অন্তর্লোকের দিকে তাকাতে পারেনা, পারেনা তার অতীতের সঙ্গে, তার গোপন অতিগোপন প্রেতাত্নাগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি বসে খোলাখুলি আলাপ জমাতে। চতুর্দশী কিশোরীর নগ্ন দেহকে তিনি জীবনে এই প্রথম একজন নিস্পৃহ নিরাসক্ত দর্শক হিসেবে, একজন ভক্ত পূজারী হিসেবে দেখতে পেরেছেন, যা কখনোই সম্ভব হয়নি আগে তাঁর নিজেরই এক নগ্নতর শত্রু, যার নাম রিপু, তার প্রতিবন্ধকতায়। এগল্প যেন তাঁর নিজের অতীতের কাছে প্রেরিত এক বিচিত্র প্রেমপত্র।