• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৭ | জানুয়ারি ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • শুভেচ্ছা সফরে পাকিস্তান ভ্রমণ : অজন্তা চৌধুরী



    সময়টা ছিল দু হাজার পাঁচ সালের এপ্রিল মাস-------আটান্ন বত্সর হোল ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে । বৃটিশ শাসনের অবসানের পর সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও বহু রাজনৈতিক উথ্থানপতনের মধ্যে দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে । কাশ্মীর সমস্যা, জল বন্টন, জঙ্গী হানা, সন্ত্রাস, সীমানা লঙ্ঘন ইত্যাদি হাজারো সমস্যা নিয়ে দুই দেশের সরকারপক্ষ একাধিকবার পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন গড়ায় সচেষ্ট হয়েও বিফল হয়েছে । সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে মাঝে মাঝেই যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছে, বিনষ্ট হয়েছে কত অমূল্য প্রাণ ।

    কয়েক বত্সর হোল, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক মতবিরোধ, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার জেরে সামরিক প্রশাসনের অভ্যুথ্থান ঘটেছে । তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরীফের শাসনকালে সামরিক প্রধান ছিলেন জেনারেল মুশারফ । তাঁরই হাতে এখন শাসনদণ্ড এবং তিনিই সমগ্র পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা । রাজনৈতিক কারণে নওয়াজ শরীফ সাহেব দেশছাড়া হয়ে তাঁর পরিবার সমেত জেড্ডায় অন্তরীণ । প্রভাবশালী নেত্রী বেনজির ভুট্টো বহুকাল বিদেশে । সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশ তাঁর স্বামী আসিফ জারদারী জেল হাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন ।

    বছর তিনেক আগে (২০০২ সালে) `ভারতীয় জনতা পার্টি' যখন শাসন ক্ষমতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । তাঁর আমন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট মুশারফ সস্ত্রীক ভারতবর্ষ সফরে আসেন । সৌহার্দ্যপূর্ণ সফর হলেও বরফ আশানুরূপ গলেনি ; তিনি পাকিস্তান প্রত্যাগমন করার অনতিকাল পরেই শুরু হয়ে যায় কারগিলের যুদ্ধ । তার পরিণাম কারো অজানা নয় । কাশ্মীর-সীমান্তে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত চরমপন্থী ও মৌলবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদ আজও অব্যাহত । বর্তমান কংগ্রেস সরকার কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা খেলাধূলার মাধ্যমে মৈত্রীর পথ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে বিরূপ মনোভাব যদি কিছুটা প্রশমিত হয় । সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলাম স্বয়ং মুশারফ সাহেব তাঁর বেগমসাহেবাকে সঙ্গে নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের ফাইনাল ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দিল্লি এসেছিলেন । খেলার মাঠে স্বয়ং মুশারফ এর উপস্থিতি ও পাকিস্তান থেকে আগত কিছু ক্রিকেট প্রেমী ভারতবাসীকে যথেষ্ট উজ্জীবিত করেছিল ।

    অখণ্ড ভারতবর্ষের মানচিত্রটা ছিল বড় সুন্দর, খণ্ডিত হয়ে কেমন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে । সবার অলক্ষ্যে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর । আমরা তো সবাই একত্রেই ছিলাম, ভাষা এক ছিল, চেহারায় মিল ছিল, আচার ব্যবহারেও খুব একটা অমিল নেই-------শুধু ধর্মটাই যা আলাদা । ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেই কি বৈষম্য তৈরি হয় ? সাধারণ মানুষ হয়তো এই বিচ্ছেদকে সমর্থন করেনি । কিছু ধর্মান্ধ, স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা এই বিভেদের বীজ রোপণ করে মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছিল । এই দুরূহ সমস্যা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ আজো চলছে, হয়তো চলবে অনন্তকাল ।

    প্রতিবেশী রাষ্ট্র অথচ সদ্ভাব নেই । জানতে ইচ্ছে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কি ধরণের মনোভাব পোষণ করে । হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ, বৈরী মনোভাব সত্যিই কি তাদের আছে ? বড় সাধ জাগে দেশটাকে একবার স্বচক্ষে দেখি । আকস্মিকভাবে সেই সুযোগ এসে গেল । `বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ' নামে এক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আমি ও আমার স্বামী এক শুভেচ্ছা সফরে সামিল হলাম । ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির সদর দপ্তর কলকাতাতে । বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতা ও আলোচনাসভায় যোগ দিতে দেশের তথা বিদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সংস্থাটির উদ্যোগে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন । শহরের কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত `বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ' বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী রাজ্যে শুভেচ্ছা সফরে গেছে । মূল উদ্দেশ্য সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাতাবরণে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্যিক নানা বিষয়ে মতের আদান প্রদান করা ও যোগাযোগ স্থাপন করা । এবারের পাকিস্তান সফরের প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় ভিসা তৈরি করা, পুলিশের অনুমতি সংগ্রহ করা যাবতীয় কাজ সংস্থার বর্তমান সভাপতি একাই দায়িত্ব নিয়ে সব সমস্যার সমাধান করলেন ।

    নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ সাতাশে এপ্রিল, বুধবার সকাল সাতটায় কলকাতা বিমানবন্দরে আমরা পঁচিশজন দিল্লিগামী উড়ানের জন্য অপেক্ষারত । দলে আছেন প্রাক্তন সাংসদ, ডাক্তার, আইনবিদ, ত্রক্রীড়াবিদ, চিত্রকর, বিধানসভার সদস্য, ব্যবসায়ী, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর কর্ণধার, সাংবাদিক প্রমুখ । কেউ সস্ত্রীক, কেউ একা । দিল্লি থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে প্রথমে লাহোর তারপর ইসলামাবাদ, শৈলাবাস মরী হয়ে পেশোয়ার । প্রত্যেকটি জায়গার নাম মনে রোমাঞ্চ জাগায়, না জানি কেমন দেখতে সেইসব শহর, কেমন হবে তার বাসিন্দারা ? কতখানি গ্রহণযোগ্য হব আমরা ? একরাশ ঔত্সুক্য ও কৌতূহল নিয়ে চড়ে বসলাম দিল্লিগামী উড়ানে ।

    দিল্লি থেকে লাহোর মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের উড়ান, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশানাল এয়ারলাইনস এর বিমান ভূমিতলে গতি নেবার সাথে সাথে শুরু হল আঁধি ও তারপর মুষলধারে বৃষ্টি । পাইলট সাহেব এই দুর্যোগে আকাশবাহী না হবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আমরাও যে যার আসনে বসে আধ ঘন্টা ঝড়ের তাণ্ডব উপভোগ করলাম । অবশেষে আল্লার দুয়া চেয়ে বিমান চালক, কালো মেঘের আস্তরণ ভেদ করে মহাশূন্যের নীলিমায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে এলেন । মনে হল এক রূপকথার দেশে স্থানান্তরিত হলাম যেখানে মেঘের সোনা রোদ্দুরের বর্র্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত, এই পটভূমিকায় রূপসী বিমানসেবিকাদের রাজকন্যার মতই মানানসই লাগছিল ।

    লাহোরের আম্মাল ইক্বাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করলাম স্থানীয় ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা অর্থাৎ আমাদের স্থানীয় ভারতীয় সময় থেকে আধ ঘন্টা পিছিয়ে । বিমান বন্দরের সুসজ্জিত আগমন কক্ষ, চমত্কার আধুনিক স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হলাম । স্থানীয় মানুষজন অধিকাংশই পাঠান জাতীয় পোষাক পরিহিত এবং তাদের উর্দু মেশানো হিন্দি কথায় প্রচ্ছন্ন পাঞ্জাবী টান লক্ষ করলাম । আমাদের আগমন প্রতীক্ষায় যাঁরা ছিলেন দেখা হওয়া মাত্রই সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন । দুটি বড় কোচ বোঝাই করে হোটেলের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হলাম । হোটেল `আভারি লাহোর'-------ঝাঁ চকচকে পাঁচতারা হোটেলের লবিতে প্রবেশ করেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল । হিন্দুস্তান থেকে আগত মেহমানদের বিশেষভাবে স্বাগত জানাল হোটেলের কর্তৃপক্ষ ।




    হোটেল `আভারি লাহোর'


    পঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর `পার্ল অফ পঞ্জাব' নামে খ্যাত । জানা যায় খৃষ্টপূর্ব তিনশো সালে, হিন্দু রাজত্বকালে অযোধ্যাপতি রামের পুত্র `লোহ' অর্থাৎ লবের নামের অনুকরণে লাহোরের নামকরণ হয় । সেই প্রাচীন লব -এর মন্দির আজও লাহোরে বিদ্যমান ।

    সহস্রাধিক বত্সরের ইতিহাসের স্মৃতি ক্ষীণ হয়ে এলেও লাহোর শহরটি ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে । সুদূর হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বত থেকে দুর্ধর্ষ হানাদার ও আফগানী সেনাদের দ্বারা বারে বারে আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছিল লাহোর । শোনা যায় আনুমানিক এক হাজার একুশ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ বীন কাশেম নামে পারস্যের এক সেনাপতি ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে পঞ্জাব প্রদেশে আধিপত্য বিস্তার করে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করে । তার অনতিকাল পরে মাহমুদ গজনী যখন লাহোর আক্রমণ করে তখনো এই প্রদেশটি হিন্দুরাজ্য হিসেবেই গণ্য ছিল । গজনীর রাজত্বকালে ইসলাম ধর্মের প্রচার সমগ্র পঞ্জাব এ বিস্তৃতি লাভ করে । তাঁকেই এশিয়ার এই ভূখণ্ডের প্রথম ইসলাম ধর্মের প্রচারক ও প্রবর্তক বলে অভিহিত করা হয় ।

    ইসলাম ধর্মের ব্যাপ্তির সাথে সাথে মুসলমান সংস্কৃতি ও শিল্পের পীঠস্থান হয়ে ওঠে লাহোর । মোঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন, সম্রাট বাবরের আগমন ও হূমায়ূনের মৃত্যুর পর বাদশাহ আকবরের জমানায় খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে লাহোর । ১৬৭৩ খৃষ্টাব্দে মহীউদ্দিন মহম্মদ ঔরঙ্গজেব আলমগীর নির্মিত বাদশাহী মসজিদ এক আশ্চর্য সুন্দর স্থাপত্যের নিদর্শন । অবাক হয়ে দেখি মসজিদের গায়ে পাথরের কারুকাজ ও রঙিন মারবেলের মীনাকারি-------দক্ষ শিল্পকর্মের নিদর্শন হয়ে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে । মসজিদের অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণের বিস্তৃতি বর্ণনাতীত । মসজিদের বাহারি ঝরোকা থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে চোখে পড়ে `মিনার ই পাকিস্তান' । আল্লামা মহম্মদ ইক্বালের স্মৃতিতে তৈরি মিনারটি শহরের কেন্দ্রস্থলে নির্মিত হয়েছে । তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলামী পাকিস্তানের রূপকার । এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি এক স্বাধীন ও সমৃদ্ধ ইসলামী পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন । তাঁর স্বপ্ন সাকার হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তা দেখে যেতে পারেননি ।




    'The Grand Mosque' (লাহোর), প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ঔরঙ্গজেব আলমগীর


    মসজিদের ঠিক বিপরীতেই বিখ্যাত লাহোর দুর্গ । সম্রাট জাহাঙ্গীর বিশাল এই দুর্গটির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি । পুত্র শাহজাহানের আমলে দুর্গটির কাজ শেষ হয় । নিরেট, দুর্ভেদ্য প্রাচীরের আড়ালে কি আশ্চর্য এক জগত তৈরি করতে সক্ষম হতেন তখনকার দিনের সুলতান বাদশাহেরা । প্রশস্ত উদ্যান, বাঁধানো জলাশয়, দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই খাস-- রাজপ্রাসাদ এক অসাধারণ সংরক্ষিত শহর ।

    হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজনের পর দেখতে যাই লাহোরের বিখ্যাত শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র `আলহামরা সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস' । প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি এক আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন, যেখানে সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয় ও চিত্রকলার অনুশীলন ও গবেষণার কাজ হয় । প্রত্যেকটি বিভাগ ঘুরে দেখবার পর পাকিস্তানের বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা সুদৃশ্য বই উপহার হিসেবে পাই আমরা সবাই ।

    পরবর্তী কর্মসূচিতে লাহোর এর দুটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রের এডিটরদের সাথে সাক্ষাত্কার । প্রথমটি `দি নিউজ' (জঙ্গ) পত্রিকা ও দ্বিতীয়টি `দ্য ইভনিং নিউজ' এর প্রধান সম্পাদক জনাব নাজম শেঠীর বাসভবনে চা পানের নিমন্ত্রণ । দীর্ঘদেহী, ব্যক্তিত্ববান নাজম সাহেব সাদরে তাঁর সুসজ্জিত বসবার ঘরে আমাদের সকলকে আমন্ত্রণ জানালেন । তাঁর ভারতপ্রীতির কথা আমাদের অজানা ছিলনা । ভারতে তিনি একাধিকবার অতিথি হয়ে গেছেন এমনকি কলকাতাকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন । নিবিষ্ট হয়ে তাঁর সাংবাদিক জীবনের নানা কথা আমরা শুনলাম । বুঝলাম এক নির্ভীক সংবাদপত্রের বলিষ্ঠ সাংবাদিক তিনি । নওয়াজ শরীফ এর জমানায় একাধিকবার তাঁকে অন্যায়ভাবে দেশদ্রোহিতার অপরাধে হাজতবাস করতে হয়েছে । কত রকম প্রতিকূলতার মধ্যে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় । জানালেন মুশারফ সাহেবের জীবনও সুরক্ষিত নয়, চরমপন্থীরা তিন বার তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করে বিফল হয়েছিল । কেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ভেবে পাইনা । জনাব শেঠীর সম্ভ্রান্ত, সুন্দরী স্ত্রী জুগ্নু সাহেবা অত্যন্ত সদালাপী এবং সহজেই আমাদের সাথে মিশে গেলেন । তাঁর আন্তরিক আপ্যায়নে আমরা ভিনদেশী পঁচিশ জন অতিথি আপ্লুত হয়ে গেলাম ।

    হোটেলে যখন ফিরে এলাম সন্ধে হয়ে এসেছে । কিন্তু বিশ্রাম নেবার অবকাশ নেই, অথচ ক্লান্তিও তেমন বোধ হচ্ছে না । সারাদিনের কর্মব্যস্ততা আমাদের মতো প্রবীণ প্রবীণাদের ক্লান্তিকেও ভুলিয়ে দিয়েছে । পনেরো মিনিটের মধ্যে বেশভূষা পাল্টে আবার আমরা কোচ্‌ এর সামনে উপস্থিত । এবার গন্তব্যস্থল `পাঞ্জাব হাউস' । আমাদের দেশের বিধানসভার সমতুল । সদস্যদের সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার ও তারপর নৈশভোজ । যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই । সম্ভ্রম জাগানো বিশাল সৌধটির চত্বরে যখন নামলাম ও প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় যখন দুদিকে দাঁড়ানো সশস্ত্র প্রহরীদের সম্মানীয় অভ্যর্থনা পেলাম তখন নিজেকে বেশ অনন্যসাধারণ মনে হচ্ছিল । পাকিস্তান টেলিভিশন ও প্রেস ফোটোগ্রাফারসদের ক্যামেরার চোখ ধাঁধানো আলোয় তখন আমি বিহ্বল, নিজের দেশে এমনধারা সম্মান তো পাইনি । পঞ্জাব প্রদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এযাসেম্বলি হাউস এ একাসনে বসে নিজের দেশের জন্য প্রচ্ছন্ন গরিমা অনুভব করছিলাম । মনে হচ্ছিল আক্ষরিক অর্থেই আমি শান্তির দূত ; বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে পাকিস্তানে এসেছি । ভারতের সাধারণ এক নাগরিক হিসেবে আমার ভূমিকা কতখানি তার মূল্যায়ন হয়তো হবে না তবে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা দিয়ে ওদের মনকে যদি একটুও ছুঁতে পারি তবেই এই দেশে আসা আমার সার্থক হবে ।

    পুরুষপ্রধান সভাকক্ষে দুজন লাবণ্যময়ী সদস্যার সাথে পরিচিত হয়ে অবাক হলাম । একজন সুন্দরী, সুবেশা ও আধুনিকা অন্যজন পর্দার অন্তরালে । দুজনেই এযাসেম্ব্লিতে দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন । বোরখা-পরিহিতা জানালেন তিনি কর্মক্ষেত্রে নকাবের অন্তরাল থেকেই কথোপকথন করে থাকেন । আমাদের মহিলাদের সানুনয় অনুরোধে নকাবের আবরণ ক্ষণিকের জন্য উন্মোচিত হলে দেখলাম তাঁর অপরূপ মুখশ্রী, শুনলাম তাঁর আত্মবিশ্বাসী কন্ঠস্বর । গ্রন্থাগারের দায়িত্বে থাকা সপ্রতিভ ফাকরার সাথে অনেক গল্প হল । লাহোরি খানদানি খানাপিনার ফাঁকে ফাঁকে এই শহর সম্বন্ধে কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম । বিদায় পর্বে সহকারী স্পীকার সর্দার শৌকত হুসেন মাজারি আমাদের সকলকে লাহোরের ওপর লেখা মহার্ঘ বই উপহার দিলেন ।

    পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্কার পর্বটি বাতিল হয়ে যাওয়াতে হাতে কিছুটা সময় পাওয়া গেল । অভিজাত পল্লীর দোকানপাট ঘুরতে বেরোলাম । লক্ষ করলাম এখানকার অল্পবয়সী মেয়েরা এবং মহিলারা পোষাকের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল, পাশ্চাত্যের প্রভাব এদের ওপর আজও পড়েনি, যদিও এরা যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত ও প্রগতিশীল । হিন্দুস্থান থেকে আগত এতজন ক্রেতাকে খুশি করার জন্য দোকানের মালিক এবং কর্মচারীদের ঔত্সুক্য চোখে পড়ার মতো । `কাওয়া' (চা) পানে আপ্যায়িত করে নানা কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছিল আমাদের । হিন্দুস্থানের ঠিক কোথায় আমাদের নিবাস ? পাকিস্তানে কত দিন থাকতে এসেছি ? ইত্যাদি । ওদের আন্তরিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম ।

    হোটেলের প্রধান ফটকে দণ্ডায়মান উর্দিধারী প্রহরীর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম । কলকাতার বাইরে মানুষ হওয়ার কারণে হিন্দি ভাষাটা মোটামুটি রপ্ত আছে আমার এবং প্রচলিত কিছু উর্দু শব্দও অজানা নয়, এই দুইয়ের সংমিশ্রিত ভাষায় কথা বললে এদেশের বাসিন্দারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ।

    লাহোর শহরের উপকন্ঠে পাপেট্রি মিউজিয়াম ওফ থিয়েটার সেন্টার দেখতে যাওয়া হল । ইনস্টিটিউট এর প্রাণপুরুষ জনাব ফৈজান পীরজাদা ও সাদান পীরজাদা সমগ্র মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখালেন । প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য বহু দেশের রকমারি পুতুল বাহারি পোশাকে সুদৃশ্য কাঁচের শো কেসে শোভা পাচ্ছে । খোলা আকাশের নিচে একটা এযাম্ফিথিয়েটার রয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেশের পুতুল নাচিয়েরা কর্মশালা তথা অনুষ্ঠান করে থাকেন । পাপেট্রির মাধ্যমে এহেন মনোরঞ্জনের আয়োজন এবং প্রচেষ্টা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য । চা পানের এলাহি ব্যবস্থা ছিল আমাদের জন্য আর ছিল ফৈজান সাহেবের রচিত `পাপেট্স এফ পীরজাদা' বইটি । গত দুদিন শহর পরিক্রমা করে দিল্লির সাথে লাহোরের কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাই আমি । প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার দু'ধারে ঘন সবুজ গাছপালা, বাগান ঘেরা বসত বাড়ি ও সর্বোপরি প্রাচীন মোঘল আমলের ধ্বংসাবশেষ ।

    লাহোর থেকে ইসলামাবাদ বিমানপথে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট ; ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর আমন্ত্রণে এসেছি । ওদের পক্ষ থেকে কয়েকজন আমাদের আতর ও লালগোলাপের মালায় অভ্যর্থনা করলেন । বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলের লবিতে আমরা ওদের সহৃদয় অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে গেলাম । মুশারফ সাহেবের খাস তালুক ইসলামাবাদ । সমগ্র পাকিস্তানে এখন পুরোদস্তুর সামরিক শাসন জারি রয়েছে । সদা ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে সাক্ষাত্কার অবশ্য আমাদের কর্মসূচিতে নেই, মনে মনে একটু হতাশই হয়েছি ।

    ইসলামাবাদে সারাদিনের যা কর্মসূচি শুনলাম মনে হল এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি দরকার । প্রত্যেকটি সাক্ষাত্কার যথেষ্ট উত্সাহব্যঞ্জক ও তাত্পর্যপূর্ণ । প্রথম যাওয়া হল ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখানকার বিশাল বোর্ডরুমে সহ উপাচার্য এবং বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানদের সাথে আলোচনা হল । জানলাম ছাত্রদের তুলনায় এখানে ছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেশি । কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখা হল, লাইব্রেরি ঘরে কয়েকজন ছাত্র আমাদের সাথে আলাপ করল । কলকাতাবাসী শুনে একজন কৌতুহলী ছাত্র ক্রিকেট খেলোয়াড় সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে আমার পরিচয় আছে কিনা জানতে চাইল-------এবার আমার অবাক হবার পালা । বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে শুধুই সবুজের সমারোহ । কুসুমিত জাকারাণ্ডা ও সিলভার ওক এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত ।




    ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর ও লেখিকার স্বামী অহীন চৌধুরী


    পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইসলামাবাদ শহরটি নয়নাভিরাম । ঝকঝকে শহরটি বড় বড় গাছগাছালির চন্দ্রাতপে ছাওয়া, চওড়া রাস্তার বিভাজনগুলোতে মরসুমী ফুলের রঙিন বিন্যাস । রওয়ালপিণ্ডি থেকে ইসলামাবাদ-এ যখন রাজধানী স্থানান্তরিত হয় সে খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয় । সম্ভবত ষাটের দশকে এই নতুন রাজধানীর জন্ম । বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, সরকারি এবং বেসরকারি ভবনগুলোর আধুনিক স্থাপত্য বেশ দৃষ্টিনন্দন । ফুটপাথে হকার নেই, নেই পথচলা সাধারণ মানুষ, উর্দিধারী সশস্ত্র প্রহরী প্রায়শ চোখে পড়ে । শহরটিকে এক কথায় ইয়োরোপের যে কোনো আধুনিক ছোটো শহরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে ।

    বিকেল পাঁচটায় `ডন' (Dawn) পত্রিকার অফিসে Resident Editor, মহম্মদ জিয়াউদ্দীন এর সাথে সাক্ষাত্কার সমাপ্ত করেই রওনা হলাম পঞ্জাবভবনে শাসক গোষ্ঠী মুসলিম লীগ এর সদস্য সন্দর্শনে । পঞ্জাব হাউস সেনেটের প্রধান কার্যালয় । সুদৃশ্য উদ্যান, চারিদিকে প্রশস্ত অলিন্দর ভেতর পথ দেখিয়ে সদস্যরা সাদরে আমাদের অন্দরে নিয়ে চললেন । প্রকাণ্ড হলঘরে প্রবেশ করা মাত্র কয়েকজন সুন্দরী, সুবেশা আধুনিকা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন । এতজন মহিলাকে একসাথে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম । শুনলাম এঁরা প্রত্যেকেই জন-প্রতিনিধি ও পার্লামেন্টের সদস্যা । পার্লামেন্টে চল্লিশ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত । বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ এর পক্ষ থেকে ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর প্রতীক ছোটো ব্যাজগুলি আমরা ওঁদের পরিয়ে দিলাম । এই মৈত্রীর বন্ধনটুকু পেয়ে দৃশ্যতই ওঁরা খুশি হলেন । তাঁদের আন্তরিক অন্তরঙ্গতায় বিস্মৃত হলাম আমরা অতিথি । মহিলামহলের সাধারণ গল্পগাছায় সমস্ত বৈষম্য নিমেষে উধাও হয়ে গেল ।

    মুসলিম লীগের Secretary General ও সেনেট কমিটি Foreign Affairs এর Chairperson মুসাজিদ হুসেনের দৃপ্ত কন্ঠস্বর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । তারপর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সুজাত হুসেন সাহেব তাঁর বক্তব্য রাখলেন । অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ যে আর নেই সেটা বোঝাতে চাইলেন । বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর মাধ্যমেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব । কিন্তু প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ কে নেবে সে সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা করা গেল না । আমাদের সভাপতি মহাশয় যথোপযুক্ত উত্তর দিলেন । পঞ্জাব ভবনের অন্দরমহল বেশ একটা উত্সবের চেহারা নিয়েছে । লোকে লোকারণ্য, পাকিস্তান রাজনৈতিক মহলের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা অনেকেই উপস্থিত আছেন । আর আছে আমলারা, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা, চিত্র সাংবাদিক ইত্যাদি । আগামীকাল স্থানীয় সংবাদপত্রে ঐ ঐতিহাসিক ক্ষণটির অবশ্যই উল্লেখ থাকবে । দামী সুগন্ধীর সুবাস ছড়িয়ে এক উগ্র আধুনিকা আমাকে ইংরেজিতে নানা প্রশ্ন করলেন । পাশ্চাত্য কেতাদুরস্ত মুসলমান রমণীটিকে দেখে ধারণা হল নিশ্চয়ই পেশায় মডেল হবেন, কিন্তু পরিচয় শুনে খুবই আশ্চর্য হলাম । লণ্ডন শহরের রয়টার নিউজ এজেন্সি থেকে ইসলামাবাদ এসেছেন নানান খবর সংগ্রহ করতে । তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । আরো একটি দম্পতিকে অবশ্যই মনে রাখব জেনারেল আয়ুব খানের পুত্র গওহর আয়ুব খান ও তাঁর বেগম জেব গওহর আয়ুব খান । দুজনেই সেনেটের সদস্য । জেব সুদর্শনা, দীর্ঘাঙ্গী ও মিষ্টভাষী । পাকিস্তানের রাজনৈতিক জগতের একজন উজ্জ্বল ও সক্রিয় তারকা বিভিন্ন স্ট্যাণ্ডিং কমিটির উনি সদস্য । স্বামী, গওহর সৌম্যদর্শন, অমায়িক এবং উচ্চশিক্ষিত । সান্ধ্যকালীন চা জলখাবারের এলাহি আয়োজনে ও আতিথেয়তায় অভিভূত হয়ে গেলাম । ভাবলাম, ভারত থেকে আগত কয়েকজন মৈত্রীর দূতকে দেখতে এই ঐতিহাসিক অট্টালিকায় বহু বিশিষ্ট জন তো এসেছেন, এ প্রাপ্তিও অত্যন্ত মূল্যবান । হলামই না হয় সুদূর পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য সম্মানটুকু তো পেলাম ।

    পঞ্জাব হাউস থেকে বেরিয়ে রওনা হলাম পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী শিবশঙ্কর মেননের বাড়ি । তিনি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হয়েছেন । Diplomatic Enclave এ নিজেদের বাসস্থানের মনোরম উদ্যানে শ্রী মেনন ও তাঁর স্ত্রী আমাদের যথাযথ আপ্যায়ন করলেন । পরিচয় হল সহকারী রাষ্ট্রদূত শ্রীমতী সেনগুপ্তর সাথে । শুনলাম তাঁর পিত্রালয় দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে । এতজন বাঙালিকে একসঙ্গে দেখে খুবই খুশি হলেন । খুশি হল আরো একজন, হাই কমিশনারের বাড়িতে নিযুক্ত মেদিনীপুরের পরিচারকটি । সুদূর সুইডেন ঘুরে ইসলামাবাদে আসার দীর্ঘায়িত ইতিহাস শুনে অবাক হলাম । মনে পড়ল আফ্রিকা ভ্রমণের সময় টানজানিয়ার আরুষা শহরের একটি Curio র দোকানে দুজন বাঙালি স্বর্ণকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল । জীবিকার তাগিদে উদ্যমী বাঙালিদের ঘর ছাড়া করে পৃথিবীর কত প্রান্তেই না নিয়ে যায় ।

    আমাদের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র প্রহরীর ব্যবস্থা প্রথম থেকেই করা আছে । তারা শহরে আমাদের কোচ্টিকে সর্বত্র অনুসরণ করছে ও দিগদর্শনেও সাহায্য করছে । ইসলামাবাদে পৌঁছবার পর কাসিম নামে যে ছেলেটি আমাদের দেখাশোনার ভার নিয়েছে সে Institute of Strategic Studies এর একজন কর্মী । কমিশনার সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এখন আমরা ঐ Institue এর সদর দপ্তরে চলেছি । এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পারমাণবিক গবেষণা, সেনাবাহিনীর গতিবিধি নির্ধারণ, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তত্ত্বানুসন্ধান করা হয়ে থাকে । পৌঁছন মাত্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ কয়েকজন প্রধান ও নবীন বৈজ্ঞানিকরা আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রশস্ত বাগানে নিয়ে এলেন । স্নিগ্ধ পরিবেশ, বাতাসে মৃদু শীতের পরশ, আকাশে হাজার তারার মেলা । ঘাসের গালিচার ওপর ইতস্তত টেবল ছড়ানো, আমরা আসন গ্রহণ করলাম । ডা: পরভেজ ইকবাল চীমা আমার পাশে এসে বসলেন । একজন উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক আমার মতো সাধারণ এক মহিলার সঙ্গে কি আলোচনা করবেন ভেবেই শঙ্কিত হলাম । প্রাথমিক পরিচয়ের পরেই এত সহজ হয়ে গেলেন যে আমার সব জড়তা, কুন্ঠা ও শঙ্কা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল । পরভেজ সাহেব জানালেন কর্মসূত্রে তাঁকে দেশে বিদেশে বহু জায়গায় যেতে হয় । একাধিকবার ভারতবর্ষে গেছেন, এমনকি কলকাতাতেও বার কয়েক তাঁকে যেতে হয়েছে । কলকাতার কোন হোটেলে থেকেছেন, কোন রেঁস্তোরাগুলো তাঁর পছন্দ সবই অকপটে জানালেন ।

    রাতে হোটেলের কামরার নিশ্চিন্ত অবকাশে গত নয় ঘন্টার ব্যস্ততার চিত্রটি রোমন্থন করছিলাম । ইসলামাবাদ পৌঁছেই পর পর পাঁচটি জায়গায় আমন্ত্রিত ছিলাম, বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ ছিল না । সাক্ষাত্কার গুলির বৈচিত্র, প্রতিবেশী রাষ্ট্র সম্বন্ধে কৌতূহল, ঔত্সুক্য এবং সর্বোপরি প্রবল ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে হয়তো অসম্ভবকে সম্ভব করলাম আমরা ।

    একটা দেশের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে হলে সাধারণ মানুষের সাথে সামান্য অন্তরঙ্গতার প্রয়োজন আছে, কিন্তু নিরাপত্তার বেড়াজাল, নানাবিধ পররাষ্ট্র দফতরের বিধিনিষেধ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । তা সত্ত্বেও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী প্রিয় ক্যামেরাটিকে সচল রেখেছি । একটা অচেনা দেশের বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখার নেশা আমার অনেক দিনের । এখানকার কোনো কোনো জায়গায় ছবি তোলার জন্য অনুমতির প্রয়োজন আছে ।

    আজ পয়লা মে, আমার নিজের দেশে গ্রীষ্মের খরতাপ অথচ হিমালয়ের পাদদেশে ইসলামাবাদ শহরে হেমন্তের সকালের আবহাওয়া । আজ যাব শৈলাবাস `মরি' (Muree) , ইসলামাবাদ থেকে কেবল ষাট কিলোমিটার দূরে, গাড়িতে দু ঘন্টার পথ । পাহাড়ি পথ বেয়ে, পপলার, সিডার, পাইনের বন ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছি । দূর দূরান্তের গিরিশ্রেণীর শ্যামল শোভা অজানা আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে মন । লোকালয় থেকে বহুদূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সবাই একটু উন্মনা । কবিতায়, গানে তোলপাড় হচ্ছে গাড়ির অভ্যন্তর । মনের বয়সটা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে ।

    হিমালয়ের কোল ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা বিলাসবহুল হোটেল `পার্ল ইন্টারকন্টিনেন্টাল', আজ আমরা এখানে সারাদিনের অতিথি । পাহাড়ি জায়গায় এমন অভিনব ব্যবহার সচরাচর চোখে পড়ে না । Terrace Garden এর আদলে তৈরি হোটেল এবং সংলগ্ন বাগান ধাপে ধাপে নেমে গেছে । কোনো স্তরে সুইমিং পুল, কোনো স্তরে কফি শপ, একদিকে ছোটখাট amphitheatre এবং বাচ্চাদের খেলার জায়গা । সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জানিনা কোন দক্ষ স্থপতির ছোঁওয়ায় রচিত হয়েছে অসাধারণ এক নন্দনকানন ও প্রমোদ উদ্যান । বাহারি মরশুমী ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারদিক । বিরল প্রজাতির আইরিস ও লিলির সম্ভার, ব্রততী বল্লরীর শাখায় শাখায় গোলাপের অসাধারণ শোভা । আন্দোলিত উইপিং উইলো গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বহু দূরের পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম । জানতে পারলাম কিছু দূরেই মুজফফরনগর এবং তারই ওপারে কাশ্মীর । নির্মল আকাশের নীচে এমন স্বর্গপুরীতে দাঁড়িয়ে মনে হল মানুষের মনে এত বৈরিতা, বিদ্বেষ, হিংসা কেন জন্মায় ? চেতনার গভীরে বন্ধুত্বপূর্ণ মিলনের ইচ্ছা কি তাদের জাগ্রত হয়না ?




    `মরির' হোটেলের বাগানে, চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন ও শিপ্রা ভট্টাচার্য সঙ্গে লেখিকা


    পরের গন্তব্যস্থল পেশোয়ার । হোটেলে প্রাতরাশ সেরে আবার বেরিয়ে পড়া, কেমন এক যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা । পাকিস্তানের সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, আফগানিস্তানের সন্নিহিত এলাকা খাইবার-পাখতুনখোওয়ার রাজধানী, পেশোয়ার, এক পার্বত্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা । পেশোয়ারের অনতিদূরেই বিখ্যাত খাইবার পাস । যে গিরিপথ অতিক্রম করে সহস্র বত্সর ধরে এসেছিল কত শত যোদ্ধা, হানাদার । ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল । সীমান্ত গান্ধী, খান আবদুল গফফর খান পেশোয়ারের বাসিন্দা ছিলেন । নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মুসলমানের ছদ্মবেশে খাইবার পাস দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন । যাঁরা নেতাজীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই আবাদ খানের পরিবার আজও পেশোয়ারে বসবাস করছেন ।

    এ হেন ঐতিহাসিক জায়গাকে চাক্ষুষ দেখবার সুযোগ পেয়ে স্বাভাবিক কারণেই আমরা উজ্জীবিত । স্থলপথেই যাত্রা করেছি । দু ঘন্টার পথ । পেশোয়ার অভিমুখে যতই এগিয়ে চলেছি পারিপার্শ্বিক দ্রুতগতিতে পাল্টে যাচ্ছে । ভূখণ্ড অসমতল, বন্ধুর, চারপাশ রুক্ষ । গাছপালা বিরল । মাঝে মাঝেই বৃক্ষবিহীন পাহাড় চোখে পড়ছে । পেরিয়ে গেলাম ছোট্ট শহরাঞ্চল নৌশেরা । পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় মানুষের চেহারাও রুক্ষ, শুষ্ক অথচ বলিষ্ঠ, দীর্ঘকায় এবং গৌরবর্ণ । সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী পাঠানেরা `পশতুন' ভাষায় কথা বলে ।

    পেশোয়ার শহরে পৌঁছে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে নামলাম এসে পার্ল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে । এখানেও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হল । কেতাদুরস্ত হোটেল কর্মীরা আমাদের আতিথেয়তার আতিশয্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল । নি:শ্বাস ফেলার সময় একেবারেই নেই, ঘড়ির কাঁটা ধরে তিনটে সাক্ষাত্কারপর্ব সারতে হবে । থাকব মাত্র এক দিন । সমগ্র পেশোয়ার দর্শন একদিনে কখনোই সম্ভব নয়, তার ওপর সিংহভাগ দখল করে নিয়েছে সাক্ষাত্কার পর্বগুলি । এই সফরের কর্মসূচির যাঁরা রূপকার তাদের ওপর একটু অভিমানই হল ; যখন শুনলাম খাইবার পাস দেখাও সম্ভব নয়, হতাশা আরো প্রবল হল ।

    পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে চোখ জুড়িয়ে গেল । এমন রুক্ষ দেশে এত সজীব গাছপালা ! প্রবেশদ্বারের পাশে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য লাল জবার গাছ । এত জবাফুল একসাথে গাছের মাথায় সচরাচর দেখা যায় না । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস তো এমনটাই হওয়া উচিত । ইসলামাবাদে এমনই চিত্রটা ছিল । প্রকৃতির সান্নিধ্যে মনের তেজ, প্রফুল্লতা ও সহনশীলতা সব কিছুরই সামগ্রিক বিকাশ ঘটে বলেই আমার ধারণা ।

    বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লেফটেনেন্ট জেনারেল মুমতাজ গুল সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন । শিক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক, কোন কোন বিষয় পড়ানো হয় ইত্যাদি নানা তথ্যে আমরা সমৃদ্ধ হলাম । আমাদের পক্ষ থেকে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের প্রস্তাব দেওয়া হল এর ফলে পাক ভারত মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে । প্রস্তাবটি গুল সাহেবের মন:পুত হয়েছে মনে হল । রীতি অনুযায়ী উপাচার্য সাহেবকে অঙ্গবস্ত্র ও উপহার প্রদান করা হল ।

    এবার চলেছি পেশোয়ারের রাজ্যপাল সন্দর্শনে । বিশাল লৌহফটক অতিক্রম করে রাজপুরীতে প্রবেশ করেই চোখে ঘনায় ঘোর । ছোটখাট পাহাড়ের ওপর রাজভবনটি । অসমতল জমিকে কি অসাধারণ নিপুণতায় ব্যবহার করে মনোরম পুষ্পদ্যান রচিত হয়েছে । গাছগাছালির আড়ালে চোখে পড়ল তিনটি বিশাল গ্রে স্টর্ক, অনতিদূরে পেখম মেলা ময়ূরের কেকাধ্বনি, সম্ভবত মেঘলা আকাশ দেখে তারা চঞ্চল হয়েছে । বাসভবনের কাছেই হেলিপ্যাড ; রাজ্যপালের নিজস্ব হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে । শুনলাম তিনি সবে আকাশপথে ফিরেছেন । রাজ্যপালের রাজকীয় পছন্দের তারিফ করতেই হয় । একরাশ ঔত্সুক্য নিয়ে খাস দরবারে সকলে প্রবেশ করলাম । আসন গ্রহণ করা মাত্র আর্দালীরা সুদৃশ্য ত্রক্রীস্টালের স্টেম গ্লাস এ আমাদের পানীয় বিতরণ করল । রুদ্ধনি:শ্বাসে আমরা রাজ্যপালের প্রতীক্ষায় রইলাম । অনতিবিলম্বে খাঁটি সাহেবি চেহারার রাজ্যপাল সৈয়দ ইফতিখার হুসেন শাহ কক্ষে প্রবেশ করে আদাব জানালেন । আভিজাত্যপূর্ণ, প্রাণবন্ত, প্রৌঢ় মানুষটিকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল ।




    সৈয়দ ইফতিকার হুসেন শাহ, পেশোয়ার এর রাজ্যপাল


    নিছক সৌজন্যমূলক সাক্ষাত্কার, কোনোরকম গূঢ় তত্ত্ব আলোচনায় গেলেন না । বললেন পেশোয়ারকে ভালোভাবে দেখতে হলে অন্তত তিনদিন থাকতে হয়, একদিন নয় । কথোপকথন পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ইফতিকার সাহেব হঠাৎ মহিলাবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলেন তাঁরা এত নীরব কেন ? উত্তরে আমাদের মধ্যে এক সুদর্শনা ডাক্তার রাজ্যপালের চেহারার সুখ্যাতি করলেন, প্রত্যুত্তরে সহজ বাংলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি শোনালেন এবং সখেদে জানালেন রবীন্দ্রনাথের দেশ থেকে এসে আমরা কেন তাঁকে কবির বই উপহার দিলাম না । আমরা যুগপৎ বিস্মিত ও লজ্জিত হলাম । জানালেন পূর্ব পাকিস্তানে খুলনাতে সেনাপ্রধান থাকাকালীন বাংলাভাষা শিখেছিলেন । সুদূর পেশোয়ারে বসে বিশ্বকবি তথা বাংলাভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে গেল ।




    পেশোয়ার চেম্বার অফ কমার্স ভবনের সামনে - বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভের সভ্য সভ্যাবৃন্দ


    শের শাহ নির্মিত গ্রাযাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর দাঁড়িয়ে সারহাদ চেম্বার অফ কমার্স ইমারতটির ছবি তুললাম । সেই বিখ্যাত রাস্তা যা কলকাতা থেকে শুরু হয়ে উত্তর ভারত অতিক্রম করে সুদূর পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে । চেম্বার অফ কমার্সে শহরের প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর সাথে মধ্যাহ্নভোজ ও তারপর আলোচনা সভা । বলা বাহুল্য সাক্ষাত্কারের জেরে একটু ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছে । কোথায় শহর ঘুরে দেখব তার পরিবর্তে কেবল টেবল জুড়ে বসে ওদের আর আমাদের মধ্যে রাশি রাশি কথার জাল বোনা । মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন কথা ছাড়া হবেই বা কি করে ?

    ভোজনের সময়টুকু সদ্ব্যবহার করে এক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করলাম । হিন্দি ভাষাটা আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকাতে এই দেশে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না আমার । এঁরা প্রত্যেকেই উর্দু মেশানো হিন্দি বলেন এবং ভিনদেশী কারো মুখে ওদের ভাষা শুনলে অবশ্যই খুশি হন এবং সহজ হয়ে যান । পারভেজ আহমেদ অত্যন্ত সদালাপী ও অমায়িক, একজন অপরিচিত মহিলার সাথে কথা বলতে তাঁর বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ ছিল না । পেশোয়ারের দোকানবাজার সম্বন্ধে কিছু সুলুক সন্ধান দিলেন । খাইবার পাস দেখার পরিকল্পনা নেই শুনে বেশ অবাক হলেন । মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসাদার মানুষটি খুব যত্ন করে একটি কাগজে পেশোয়ারের কিছু দোকানের নাম লিখে দিলেন । সেই কাগজটি আমার কাছে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে ; তেমনই তাঁর হৃদ্যতাটুকু আমার হৃদয়ে গাঁথা হয়ে আছে ।

    মৈত্রীর পথ সুদৃঢ় করতে বাণিজ্যিক স্তরে আলোচনা এক আবশ্যিক সোপান । অতএব বণিক সভার সভাপতি ও বিভিন্ন ব্যবসায়ে নিযুক্ত কর্ণধারদের সাথে আমাদের দলের ব্যবসায়ীদের আলোচনা শুরু হল, পরিচয় পত্র বিনিময় হল সম্ভবত চুক্তিপত্রও সাক্ষরিত হল । পাঠান সম্প্রদায়ের এতজন মানুষকে একসাথে দেখার এক বিরল অভিজ্ঞতা হল । আমার ভূমিকা মূলত শ্রোতা, দ্রষ্টা এবং অবশ্যই ফোটোগ্রাফারের । মহিলা হওয়ার দরুণ অনেক জায়গাতেই ছবি তোলার সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছি ।

    অবশেষে এলো মুক্তির ক্ষণ অর্থাৎ ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো ও দোকান-বাজার দেখা । আমাদের ইচ্ছানুসারে পেশোয়ারের অপেক্ষাকৃত ঘিঞ্জি এলাকায় চলে এলাম । অগণিত মানুষ, অথচ মহিলা বিশেষ চোখে পড়ল না, যে দু একজনকে দেখলাম প্রত্যেকেই বোরখার আড়ালে । সশস্ত্র প্রহরীদের অনুরোধে আমাদেরও শাড়ির আঁচলে অথবা ওড়নায় মাথা ঢাকতে হল । স্থানীয় দু-তিন জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও আমাদের সাথে রয়েছেন । তাঁরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন । সরু গলিপথ ধরে চলেছি, রাস্তা যথেষ্ট চড়াই । রাস্তার দুধারে শুধুই স্বর্ণালঙ্কারের দোকান ; বাড়িগুলি অত্যন্ত প্রাচীন । এক চারতলা বাড়ির আঙিনায় এসে উপস্থিত হলাম । পুরোনো আমলের ইমারতটির সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার সময় দেখতে পেলাম প্রত্যেকটি ঘরই দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কেমন যেন অন্ধকার ও রহস্যময় । কি কারণে জানিনা হঠাৎ সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে হল । জানিনা পৃথিবীর এই ভূখণ্ডের পটভূমিকায় কোনো গল্প লিখেছিলেন কিনা, বেশ যুত্সই রহস্যঘন উপন্যাসের রসদ তিনি এই ইমারতটি থেকে পেয়ে যেতেন । দিনের বেলায় এমন অদ্ভুত আঁধারে একটু শঙ্কিত চিত্তেই তিনতলা পর্যন্ত উঠে এলাম । দামী কার্পেট বিছানো একটা ঘরে নিয়ে এসে আমাদের মেঝেতেই বসতে বলা হল । ঘরটার চারদিকের দেওয়াল আলমারিগুলো ছাদ ছুঁয়েছে । বহুমূল্য অলঙ্কার ও পণ্যসামগ্রী ঠাসা আলমারিগুলো দেখে ভাবছি না জানি কি ধরনের ক্রেতা ঠাওরেছেন এঁরা আমাদের । দোকানের মালিক রঙিন মীনার কাজ ও বহুমূল্য রত্নখচিত এক সোনার বাতিদান আমাদের পরখ করতে দিয়ে জানালেন জিনিসটির দাম পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার ! শুনে সকলের চক্ষুস্থির । বৃথা সময় নষ্ট না করে মালিকপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হল যে আমরা স্বল্পমূল্যের গহনাতেই সন্তুষ্ট থাকব । এমন কিছুর খোঁজে আছি যা এই দেশের স্মারক হিসেবে নিয়ে যাব । এই এলাকার প্রসিদ্ধ নীল পাথর, ল্যাপিজ ল্যাজুলির গয়না ও আফগানী অলঙ্কার আমরা বেছে নিলাম । প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ছোটো ছোটো পাথর বসানো গয়না আমাদের মহিলাদের ওরা উপহার দিলেন । এটাও এক ধরনের অতিথি সেবা, এমন অভিজ্ঞতা আগে কোথাও হয়নি ।

    এবার আমরা একটু অন্য ধরনের দোকান আবিষ্কারে মেতে উঠলাম । প্রতিবেশী রাজ্য আফগানিস্তান থেকে প্রচুর শুকনো ফলের আমদানি হয় এখানে । আখরোট, খোবানি, কিসমিস, পেস্তা ও বাদামের মেলা একদিকে ; অন্যদিকে গরম মশলার খুশবুতে মাতোয়ারা । ইচ্ছে হয় কোঁচড় ভরে নিয়ে যাই । মশলার দোকানের মালিক, হিন্দুস্তানি মেহমান দেখে এতই অভিভূত যে মশলার বিনিময়ে সে মূল্য নিতে একেবারে নারাজ । কেবলই বলে, "আপ মেরে মেহমান হো, রুপিয়া দেনে কা কোই জরুরত নেহি !" মেহমান ? ভিনদেশী ক্রেতাদের এতই সম্মান জানায় ওরা ? জুতোর দোকানে গিয়েও সেই একই অভিজ্ঞতা । বাবা ও ছেলের আন্তরিকতায় চোখে জল এসে গিয়েছিল আমার । তেরো বছরের ফুটফুটে ছেলেটির ছবি আজও আমার এযালবামে উজ্জ্বল হয়ে আছে ।

    ধীরে ধীরে সন্ধে ঘনিয়ে এলো । জানি আমরা কয়েকজন দলছুট একটু দেরিই করে ফেলেছি, অপেক্ষমান কোচ্‌ এর দিকে দ্রুত পা চালালাম । সারাদিনের হয়রানিতে প্রত্যেকেই পরিশ্রান্ত, অবিলম্বে বিশ্রামের প্রয়োজন । কিন্তু ঝোলা ভরা বাদাম-মেওয়া, গরম মশলা, পেশোয়ারি জুতো ও গয়নার সাথে কিছু স্থানীয় মানুষের যে প্রাণভরা ভালোবাসা পেলাম সেটা একান্তই আমার নিজস্ব সম্পদ হয়ে রইল, এর মূল্যায়ন হয় না ।

    হোটেলের কামরার নির্জনতায় বসে ভাবছিলাম এই আশ্চর্য সুন্দর দেশটার কথা, সত্যিই পেশোয়ারের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে । ভেবেছিলাম অত্যন্ত রুক্ষ ও শুষ্ক দেশটার মানুষজনও এমনতর হবে, কিন্তু আদপেই তা নয় । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাজ্যপালের রাজপাটের বৈভব এবং তার বাংলা প্রীতি, ব্যবসায়ীদের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা আতিথেয়তা তুলনাহীন । ভারতীয়দের ওরা যে কতখানি কদর করে তার প্রমাণ আমার পাওয়া হয়ে গেছে । ওরা চায় ওদের দেশ আমরা দেখি, ওদের সাথে ব্যবসা করি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির আদান প্রদান করি । এই চাওয়াটুকুই আমার কাছে যথেষ্ট মূল্যবান ।

    ফিরতিপথে আবার ইসলামাবাদ, এবার পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কসুরির সঙ্গে বৈঠক । যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ, সন্দেহ নেই । দেশের কাগজে তাঁর ছবি বহুবার দেখেছি, এবার পরিচয় হবে । আশা করে রইলাম আলোচনা সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে । বিশাল সেক্রেটেরিয়েট টেবলের দুধারে আমরা বসলাম । উনি কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র বৈদ্যুতিন এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম তটস্থ হয়ে উঠল । তাঁর অভ্যর্থনায় উষ্ণতার অভাব ছিল না । তাঁর হাঁটা-চলা, কথা বলার ভঙ্গিতে আত্মপ্রত্যয় ও ব্যক্তিত্ব লক্ষ করার মতো । এক অভিজ্ঞ কূটনীতিকের প্রতিফলন তাঁর প্রতিটি উক্তিতে । ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী নদীগুলির জল বন্টন, গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হল । একটা কথা পরিষ্কার জানালেন । দুই দেশের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ তৈরি করে একমাত্র রাজনীতিকরা, এর অবসান না হলে বন্ধুত্বের পথ সুগম হবে না । তাই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ ঘুচিয়ে সৌহার্দ্য ও মৈত্রীর মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় পাক প্রশাসন । আলোচনাপর্ব শেষে হাল্কা মেজাজে আমাদের সাথে গল্প করলেন । আমার স্বামী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছিলেন শুনে জানালেন উনি কেম্ব্রিজ এর ছাত্র এবং আমাদের দেশের মন্ত্রী মণিশঙ্কর আয়ার ওনার সহপাঠী ছিলেন এবং ওঁদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট রয়েছে ।




    পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কসুরি, শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু, শ্রী অহীন চৌধুরী


    বিদেশ-মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত্কার পর্বের পর চললাম রাজদর্শনে অর্থাৎ রাজা ত্রিদিব রায়ের সাথে দেখা করতে । চট্টগ্রাম (অধুনা বাংলাদেশ) পার্বত্য এলাকার চক্মা অধিবাসীদের রাজা তিনি এবং বর্তমান পাকিস্তান ন্যাশনাল এযাসেম্বলির ফেডারেল মন্ত্রীও বটে । সদর দরজায় স্বয়ং উপস্থিত থেকে নমস্কার জানিয়ে সবাইকে সাদরে অন্দরমহলে নিয়ে বসালেন । বাংলা ভাষাতেই কথোপকথন শুরু করলেন । এতজন বাঙালিকে কাছে পেয়ে দৃশ্যতই অভিভূত মনে হল রাজাকে । মানুষটির অকৃত্রিম আন্তরকিতায় আমাদেরও হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে এল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন । রাজবংশের বর্ষীয়ান মানুষটিকে মনে হয় সকলের ভালো লাগল ।




    রাজা ত্রিদিব রায়ের বাসভবনে


    রাজা ত্রিদিব রায়ের সাথে প্রাথমিক পরিচয় আমাদের বই এর মাধ্যমে হয়েছিল । ওনার লেখা `দি ডিপার্টেড মেলডি' বইটি আগাম উপহার হিসেবে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । চট্টগ্রাম থেকে ইসলামাবাদ, এই ঐতিহাসিক উথ্থানের এক চমকপ্রদ তথ্য তাঁর সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারলাম । তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজা ত্রিদিব রায় এযাসেম্বলীর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেল উনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন এবং সংখ্যালঘু মন্ত্রীর মর্যাদায় ক্যাবিনেটে নির্বাচিত হন । পরবর্তীকালে পাকিস্তানের একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে ইউনাইটেড নেশন্স এ যান । প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি । কর্মসূত্রে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন ও সুদীর্ঘ পনেরো বত্সর আর্জেন্টিনাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্ত ছিলেন । বর্তমানে ইসলামাবাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন । `অল পাকিস্তান বুদ্ধিস্ট সোসাইটি' -র উনিই প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি । আনুমানিক হাজারখানেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ইসলামাবাদে বসবাস করছে ।

    `ডিপার্টেড মেলডি' বইটি পড়ে যতটুকু জেনেছিলাম ত্রিদিব রায়ের প্রপিতামহেরা সম্ভবত শাক্যবংশজাত, অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধের বংশধর । আবার এও জানা যায় চট্টগ্রাম এলাকায়, সুদূর আরাকান থেকে এসে উপজাতিরা আধিপত্য বিস্তার করেছিল । চক্মাদের পূর্বপুরুষ ওরাও হতে পারে । এ বিষয়ে মতভেদ আছে । ইতিহাস যা বলে বলুক এক ছোট্ট পার্বত্য এলাকার রাজবংশে জন্মগ্রহণ করে ভাগ্য এবং উচ্চাকাঙ্খা একজন মানুষকে যে কোথায় নিয়ে যেতে পারে রাজার সামনে বসে সে কথাই চিন্তা করছিলাম । সকলের অনুরোধে রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে এই অনন্যসাধারণ মানুষটিকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম ।

    রাজবাড়ি থেকে যখন বেরোলাম সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে । সকালে পেশোয়ার ছেড়ে বেরিয়েছি, গত কয়েক ঘন্টা বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কেটেছে কিন্তু কারওকে বিশেষ ক্লান্ত মনে হল না । শুনলাম আমরা মহিলারা যেটা সবচাইতে বেশি পছন্দ করি সেই ব্যবস্থাই হয়েছে । উল্লসিত চিত্তে পৌঁছে গেলাম ইসলামাবাদের আলো ঝলমলে সুপার মার্কেটে । এই একটা ব্যাপারে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, বিরক্তি নেই ক্লান্তি তো একেবারেই নেই । কয়েকজন মধ্যবয়সিনী তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে শো রুমের অরণ্যে কয়েকঘন্টার জন্য হারিয়ে গেলাম ।

    আজ ৪ঠা মে ২০০৫ । ইসলামাবাদে আমাদের শেষ দিন । পাকিস্তান ন্যাশনাল এযাসেম্বলি-তে আমরা আজ আমন্ত্রিত অতিথি । এই এযাসেম্বলি আমাদের দেশের পার্লামেন্টেরই অনুরূপ । তার আগে এযাসেম্বলির স্পীকার চৌধুরী আমির হুসেন এর সাথে একান্ত সাক্ষাত্কার । এই সাক্ষাত্কার পর্বটি নি:সন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ । পুরোনো শহর রাওয়ালপিণ্ডি থেকে রাজধানীর কার্যালয় যখন ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হয়েছিল তখনই হয়তো এযাসেম্বলি ইমারতটির নবীকরণ হয়েছিল । মূল ফটকটির ওপর মার্বেল পাথরে খোদাই করা রয়েছে সম্ভবত কোরানের বাণী । সশস্ত্র দেহরক্ষীদের ব্যূহ ভেদ করে, অলিন্দের পর অলিন্দ পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম স্পীকার সাহেবের ঘরে । বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবলের চারদিকে আমরা আসন গ্রহণ করলাম ।

    যথাসময়ে মহামান্য স্পীকার মহাশয় তাঁর সহকারীকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রত্যেক সদস্যদের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখা করে পরিচয় জানতে চাইলেন । স্থির করলাম চৌধুরী সাহেবের সাথে উর্দুতে কথা বলব । কাছে এসে যখন আদাব করলেন নমস্কার করে বললাম, "ম্যায় আমন কা পয়গাম লেকর পাকিস্তান আই হুঁ ।" ভদ্রলোক দৃশ্যতই একটু হকচকিয়ে গেলেন । আমার পাশে বসা ডাক্তার বন্ধুটি আশ্চর্য হয়ে বললেন, `উর্দু ভাষাতে বেশ বললেন তো ?' জানালাম উর্দু ভাষাকে কতখানি কদর করি আমি । বছর দুই আগে রীতিমত এক মৌলবি সাহেবের কাছে এই ভাষাটিকে শিখেছিলাম । লিখতেও পারতাম, অনভ্যাসে মর্চে ধরে গেছে ।

    বক্তৃতা শুরু করার আগে চৌধুরী আমির হুসেন ও তার সহকারীবৃন্দ আল্লা তালার দুয়া চেয়ে প্রার্থনা করলেন । পেশোয়ারে সারহাদ চেম্বার অফ কমার্সেও ঠিক একই দৃশ্য দেখেছিলাম । সকলে একসাথে সুর মিলিয়ে যখন প্রার্থনা করেন বড় মধুর শোনায় । কতখানি নিষ্ঠাবান ও ধর্মপ্রাণ এঁরা, সব কাজের সূচনা হয় আল্লার বন্দনায় ।

    পাকিস্তান সংবিধানের নানা তথ্য, সরকার পক্ষের বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে অবহিত হলাম । ধারাভাষ্যটিকে একটু গতানুগতিক প্রাণহীন মনে হল, অন্তত আমার কাছে আমাদের মধ্যে যারা চিন্তাবিদ রয়েছেন তাঁরাই পরে সামগ্রিক তত্ত্বের পর্যালোচনা করবেন, তর্কের ঝড় তুলবেন, দেশে ফিরে সংবাদপত্রে লিখবেন । আমার মনোজগতের পালে অন্য হাওয়া বয় । চিন্তা করি সবাই মিলেমিশে, একত্রে তো বেশ ভালোই ছিলাম, এই বিচ্ছেদ কেন হল ? বৈষম্যের বীজ কারা বপন করল ? শুধুমাত্র ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে আমরা দুই জাতির মধ্যে অদৃশ্য প্রাচীর রচনা করে ফেললাম ?

    নিজের দেশের পার্লামেন্ট হাউসকে দূর থেকেই প্রত্যক্ষ করেছি । শাসক দল ও বিরোধী গোষ্ঠীর তর্ক বিতর্ক, চাপান উতোর ও মহামান্য স্পীকার মহাশয়কে সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখেছি । প্রতিবেশী এক ইসলামিক রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সংসদের কর্ম প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হব আমি, এ আমার কল্পনারও অতীত ছিল ।

    সম্মানিত অতিথির মর্যাদায় আমাদের দর্শকের গ্যালারিতে বসতে দেওয়া হল । অর্ধগোলাকৃতি প্রশস্ত কক্ষে শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষের সদস্যরা যার যার আসনে উপবিষ্ট । পুরুষ সদস্যরা তাঁদের জাতীয় পোশাক পরে নিজেদের ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছেন । মাথায় কারো পাগড়ি, কেউ পরেছেন ফেজ টুপি । মহিলা মহলে বেশ প্রগতির হাওয়া, ট্র্যাডিশনাল পোশাকে তাদের যথেষ্ট আধুনিকতার ছোঁয়া । বোরখার আড়ালে কেউ নেই । মহিলা সদস্য সংখ্যা চোখে পড়ার মতো । কয়েকজন পরিচিত মুখ আমাদের চিনতে পারলেন, পঞ্জাব হাউসে আলাপ হয়েছিল ।

    স্পীকার সাহেব, সংসদের অধিবেশনের প্রারম্ভেই হিন্দুস্তানের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত `বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ' এর সদস্যদের উপস্থিতি ঘোষণা করলেন । প্রত্যেকটি সদস্য টেবল চাপড়ে আমাদের স্বাগত জানালেন । অনাস্বাদিত এক বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন হলাম সবাই । রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে এধরণের সমাদর আশা করিনি হয়তো ।

    বিরোধীপক্ষের গ্যালারির প্রথম সারিতে হঠাৎ পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানকে আবিষ্কার করলেন আমাদের দলের কয়েকজন মহিলা । দুর্ধর্ষ ক্রিকেটার, ধনীকন্যা জেমাইনা গোল্ডস্মিথের প্রাক্তন স্বামী, সুদর্শন ইমরান খান বরাবর সংবাদের শিরোনামে ছিলেন । সেই বহু পরিচিত মানুষটি বেশ কয়েক বছর সক্রিয় রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করেছেন । খেলার দল নিয়ে বহুবার আমাদের দেশে এসেছেন, কলকাতায় আমরা অনেকেই তাঁকে ইডেন গার্ডেনস এ অধিনায়কের ভূমিকায় দেখেছি । কলকাতা থেকে আগত অতিথিদের দিকে একবার অপাঙ্গ দেখলেন মাত্র কিন্তু কয়েকজন বঙ্গললনার হৃদয়ের আকুতি অনুভব করতে পারলেন না ।

    কানে হেডফোন লাগিয়ে অত:পর সংসদের অধিবেশনে মনোনিবেশ করলাম । অধিবেশনের শুরুতেই পাগড়িধারী কয়েকজন উপজাতি শ্রেণীর সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে স্পীকার সাহেবকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানালেন । তাঁদের যিনি মুখপাত্র তিনি বিশুদ্ধ উর্দু ভাষায় কাশ্মীর প্রসঙ্গ উথ্থাপন করলেন । চৌধুরী আমির হুসেন সাহেব জানালেন, আমরা পাকিস্তানের মেহমান এবং শুভেচ্ছা সফরে এসেছি । বিরোধী দলটি কর্ণপাত করলেন না । চৌধুরী সাহেব সবিনয়ে জানালেন বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ কসুরী সভায় উপস্থিত নেই অতএব এই স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা সম্ভব নয় । আমাদের উপস্থিতিতে এহেন অস্বস্তিকর বিতর্কিত প্রসঙ্গ সম্ভবত উনি এড়িয়ে যেতে চাইলেন । এর ফলস্বরূপ ঐ গোষ্ঠীভূক্ত প্রত্যেকটি সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন । আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । ব্যথিত হলাম এই মনে করে যে অনেকের মনেই কাশ্মীর নিয়ে চাপা ক্ষোভ আছে । যতই মৈত্রীর ধ্বজা ওড়াই ও শান্তির বাণী শোনাই -- যাঁরা গোঁড়া ইসলামপন্থী, ধর্মের কালো মেঘ তাঁদের অন্তর থেকে সহজে সরে যাবে না ।

    পাকিস্তান হেরিটেজ মিউজিয়াম ঘুরে আবার বিমানবন্দর । ফিরে যাব লাহোর । ইসলামাবাদ থেকে আধ ঘন্টার উড়ানে উঠব আর নামব । এতদিন একসঙ্গে থাকার ফলে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বটা প্রগাঢ় হয়েছে । বিমানে উঠেই কলেজ পড়ুয়াদের মতো কলরবে চর্তুদিক মুখরিত করে যে যার আসন খুঁজে নিলাম । নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের মাত্রাটা একটু শোরগোলের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল । আমার পাশে বসা সম্ভ্রান্ত চেহারার এক মুসলমান মহিলা আড়চোখে চেয়ে আমাকে একটু জরিপ করে নিলেন । ইতিমধ্যে বিমান সেবিকারা সংবাদপত্র বিলি করে গেল । আপাতদৃষ্টিতে শান্ত পরিবেশ আবার অশান্ত হয়ে উঠল । কারণ বিশেষ কিছুই নয় একটি ছবিকে ঘিরে ঈষৎ উত্তেজনা । আজকের সংবাদপত্রে বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কসুরীর মহিলা পরিবৃত একটি রঙিন ছবি ছাপা হয়ে বেরিয়েছে । আমার পার্শ্ববর্তিনী এই অহেতুক কোলাহলের কারণ জানতে চাইলেন । কিভাবে যে তাকে বোঝাই বিদেশের সংবাদপত্রে নিজেদের ছবি ছেপে বেরোলে মনের অবস্থাটা কেমন হয় ? ধীরে ধীরে মহিলাটির সাথে ভাব জমিয়ে ফেললাম । পেশায় উনি ডাক্তার, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ । লাহোরের এক নামকরা হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত । জানতে চাইলাম মেডিক্যাল প্রোফেশনে মেয়েদের অবদান কতখানি । শুনে অবাক হলাম, পাকিস্তানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি সংখ্যায় ডাক্তারি বৃত্তি বেছে নিচ্ছে । আমার দেশ সম্পর্কে অনেক কৌতুহলী প্রশ্ন করলেন । বিমান থেকে অবতরণ করার আগে ওনার একটি ব্যক্তিগত কার্ড আমার হাতে দিয়ে গেলেন । কার্ডটা হাতে নিয়ে ভাবলাম মাত্র আধ ঘন্টার পরিচয়ে ভদ্রমহিলা কতখানি অন্তরঙ্গ হয়ে গেলেন ।

    হোটেল আভারি লাহোর এ যখন পৌঁছলাম সন্ধে হয়ে এসেছে । চেনা হোটেল, ফ্রন্ট ডেস্কের কর্মরত চেনা ছেলেগুলির উষ্ণ অভ্যর্থনা হৃদয় ছুঁয়ে গেল । যেন কতদিনের চেনা আমরা । ফুরিয়ে এল ঝটিকা সফর । পাকিস্তান ভ্রমণের আজ রাতেই যবনিকা পড়বে শেষ রাতটিকে স্মরণীয় করে রাখার অভিপ্রায়ে আমরা কয়েকজন শহরের বিখ্যাত ফুড স্ট্রীটে কাবাব টিক্কা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । খোলা আকাশের নীচে রাস্ত্যায় বসে আম জনতার সাথে ভোজন, না কোনো অভিজাত রেস্তোঁরায় নৈশভোজ ? এই বিষয়ে দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন হয়ে গেল । অধিকাংশজন রেঁস্তোরা বেছে নিলেন, এক আমি একমাত্র মহিলা, আমার আইনবিদ স্বামী, এক বিখ্যাত ডাক্তার, একজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক, এক বিধানসভার সদস্য এবং একজন জাতীয় স্তরের ত্রক্রীড়াবিদের সঙ্গে ফুড স্ট্রীটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম ।

    কোচ্‌ এসে থমকে গেল এক চৌরাস্তার মোড়ে, নো এন্ট্রি সাইন বোর্ডের সামনে । এই বিশাল রাস্তাটিতে রাত্রে গাড়ি ঢোকা একেবারেই নিষিদ্ধ-------এই হল ফুড স্ট্রীট । রাস্তাটা বেশ চওড়া । রাত সবে সাড়ে নটা । রাস্তার দুপাশের জোরালো আলোয় রাতের অন্ধকার সরিয়ে যেন দিনের আলো নেমে এসেছে । রাস্তার দুধারে আড়াআড়িভাবে টেবিল পাতা, অনেকটা নেমতন্ন বাড়িতে যেমন দেখা যায় । টেবিলের দুদিকে সারি সারি প্লাস্টিকের চেয়ার । রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলমান জনতা পছন্দমতো দোকান বেছে টেবিল অধিকার করছে । আমরাও সেই জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম । রাস্তার শেষ দেখা যায় না এতই তার বিস্তৃতি । দু দিকের কাবাবের দোকান দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি । হোটেলের লবি ম্যানেজারের নির্দেশিত `বাট্স টিক্কা' দোকানটির খোঁজে রয়েছি । প্রত্যেকটি সাইন বোর্ড উর্দু ভাষায় লেখা । নিজের সীমিত উর্দুজ্ঞান ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় অবশেষে কাঙ্খিত জায়গাটিকে আবিষ্কার করা হল । কাবাবখানার কর্মচারীরা অত্যন্ত খাতির যত্ন করে আমাদের বসাল এবং জেনেও নিল আমরা হিন্দুস্তানের বাসিন্দা কিনা ।

    কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে চারদিক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি । রাস্তার দু ধারের ইমারতগুলি বেশ প্রাচীন । চার পাঁচতলা বাড়িগুলির গায়ে বেশ বুদ্ধি করে আলো লাগানো হয়েছে, যার ফলে রাস্তাটি আলোকিত হয়ে আছে । সামনেই একটি বাড়ির ফলকে স্পষ্ট লেখা রয়েছে `রামনিবাস', সন-------১৯৩৬ । সত্তর বছর আগে স্থাপিত ঐ বাড়িটিতে কোনো হিন্দু পরিবার বাস করত, দেশ ভাগ হবার পর তাদের হয়তো চলে যেতে হয়েছে । আশ্চর্য হলাম আমরা । ফলকটি কিভাবে রয়ে গেল ?

    হাসি গল্পে টেবিল সরগরম হয়ে উঠল । যার যার পছন্দের ফরমায়েশি খাবারে টেবিল ভরে উঠতে শুরু হল । যত রাত বাড়ছে খাদ্যরসিকদের ভিড়ও তত বাড়ছে । তাদের সাজ পোশাক কথার ধরনধারণ দেখে আন্দাজ করছিলাম সব স্তরের মানুষ এখানে আসেন । অনেকেই সপরিবারে আসছেন সঙ্গে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে । মহিলাদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো ; তাঁরা যথেষ্ট উদারপন্থী ও সংস্কারমুক্ত বলেই আমার অনুমান ।

    আমাদের টেবিলে দুটি খালি চেয়ার দেখে দুটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে আমাদের সম্মতি নিয়ে পাশে এসে বসল । সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি অত্যন্ত সুদর্শনা এবং ছেলেটি তার স্বামী, পরিচয় দিল আসাদ আহমেদ । মেয়েটির নাম `ইরম' অর্থে ফুল, মাত্র চার বছর ওদের বিয়ে হয়েছে । ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠল । আসাদ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আদি নিবাস বালুচিস্তান । ইরম উচ্চশিক্ষিতা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকত্তর ডিগ্রী আছে তার । আমাদের ফরমায়েশমতো টেবিলে ইতিমধ্যে মুর্গ তন্দুরী, শিক কাবাব, রকমারী টিক্কা, কুলচা, চাঁপ, নান, রায়তা ইত্যাদি রাশি রাশি ভোজ্যবস্তু হাজির হয়ে গেছে । অপত্য স্নেহে নতুন অতিথিদের আমরাই আপ্যায়ন করলাম । ওদের কোনো সঙ্কোচ ছিল না, ভারী খুশি হয়ে আমাদের সাথে খাওয়াদাওয়া করল ।

    ইরম ওর পরিবারের কথা, নিজের জীবনের কথা ও বালুচিস্তানের গল্প শোনাল । আসাদ বালুচিস্তানে ওর বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকবার অনুরোধ জানাল আমাদের । মিষ্টভাষী ও সরল দম্পতিটি কত সহজে আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি এসে গেল । বিদায়ের ক্ষণে ইরম মৃদু হেসে জানাল আমার পরনে শাড়ি দেখে ও আন্দাজ করেছিল আমার নিবাস হিন্দুস্তান, সেই কারণেই এই বিশেষ টেবিলটি বেছে নেওয়া । কথাটা শেষ করেই আমার গলা জড়িয়ে ওর ভালোবাসার পরশটুকু দিয়ে ফুড স্ট্রীটের জনঅরণ্যে হারিয়ে গেল । কোথাকার কোন অচিন দেশের ফুলের মতো মেয়েটির জন্য আমার মায়ের মন ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে এল ।

    (পরবাস ৪৭, জানুয়ারি, ২০১১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments