আর্জেন্টিনায় যাবার কোনো বিশেষ প্ল্যান ছিলো না আমার । কিন্তু হঠাৎ কাজের সূত্রে সুযোগটা এসে গেলো । আমার আবার পায়ের তলায় সর্ষে । বেড়াবার সুযোগ পেলে লোভ সামলাতে পারি না । সে প্যারিস-লণ্ডনই হোক বা ম্যাডাগাস্কার ।
আর্জেন্ংইটনায় মিটিং-এর কাজ ছিলো রাজধানী বুয়েনস এয়ার্সে । শহরটি দেশের ঠিক মাঝখানে । তাই সেটাকে ঘাঁটি করে দক্ষিণে হিমবাহ, আর উত্তরে জলপ্রপাতে দু'টি সাইডট্রিপ-এর পরিকল্পনা করলাম ।
দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থানের জন্যে আর্জেন্টিনায় ঋতুগুলি উত্তর আমেরিকা বা ভারতের ঠিক উল্টো । (যেমন ক্রিসমাস সেখানে গ্রীষ্মকালে হয় ।) কিন্তু উত্তর আমেরিকার সোজা দক্ষিণে হওয়ার দরুণ দু-এক ঘন্টার বেশি জেট-ল্যাগ হয় না । এটা একটা বিশেষ সুবিধা । আর্জেন্টিনা দেশটি বেশ বড়ো । ব্রাজিলের পরেই এর আয়তন । উত্তরে আর্দ্র ও উষ্ণ রেনফরেস্ট থেকে দক্ষিণে বরফঢাকা আন্দিস পাহাড় সরু হয়ে চলে গেছে প্রায় দক্ষিণমেরু পর্যন্ত । মাঝখানে চাষবাসের সমতল Pampas আর পাহাড়ি উপত্যকা পাটাগোনিয়া -- একদিকে আন্দিস পাহাড় আর অপর দিকে অতলান্তিকে ঘেরা ।
একই রকম রাস্তাঘাট, বাড়িঘরের স্থাপত্য |
রাজধানী বুয়েনস এয়ার্স ( Good wind , মধুর বাতাস) রিও দেল প্লাতার মোহনায়, দক্ষিণ আটলান্টিকের উপকূলে এই শহরটি ইউরোপের যে-কোনো বড়ো শহরের মতোই দেখতে । ঠিক একই রকম রাস্তাঘাট, বাড়িঘরের স্থাপত্য । আবহাওয়াও একই রকম । অবশ্যই এর কারণ আর্জেন্টিনার ৯০% জনসংখ্যা শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ানদের থেকে উদ্ভূত । মাত্র ১০% কৃষ্ণাঙ্গ ও আমেরিকান ইণ্ডিয়ান উপজাতি । শ্বেতাঙ্গরা বেশিরভাগই ইটালি ও স্পেন থেকে আগত । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক জার্মান (পলাতক নাত্সিও) এ-দেশে আশ্রয় নিয়েছে । স্থানীয় উপজাতিদের প্রায় দেখাই যায় না ।
বাঙালিদের ধারণায় আর্জেন্টিনা মানেই ফুটবল, আর ফুটবল মানেই দিয়েগো মারাদোনা -- আর্জেন্টিনার জাতীয় হিরো । তাই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখছি -- আমি কিন্তু একটা ম্যাচও দেখতে যাইনি । দেশটা ফুটবল নিয়ে পাগল হলেও শুনে হয়তো অবাক হবেন যে এদের জাতীয় খেলা ফুটবল নয় -- একটা অখ্যাত খেলা -- নাম পাতো (
Pato ) । এটা পোলোর মতোই ঘোড়ায় চড়ে বাস্কেটবল খেলার মতো । ঘোড়া আর্জেন্টিনীয়দের ভীষণ প্রিয় ; নানারকম ঘোড়দৌড়, পোলো, ইত্যাদি খুবই জনপ্রিয় ।
ফুটবলের চেয়েও লোকেরা পাগল-- ট্যাংগো নাচ নিয়ে । ট্যাংগো আর্জেন্টিনার নিজস্ব নাচ । এর সঙ্গে আর্জেন্টিনার জাতীয় প্যাশন ও মানসিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । আর্জেন্টিনাকে জানতে হলে ট্যাংগো সম্বন্ধে জ্ঞান অপরিহার্য । সারা শহরে শ'খানেক ট্যাংগো ডিনার-থিয়েটার, যেখানে পানীয় ও খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংগো নাচের প্রদর্শনী হয় । সাথে থাকে ছোটো এযাকর্ডিয়ন বাজনা । ট্যাংগো শেখার স্কুলও আছে সব পাড়ায় ।
ফুটবলের চেয়েও লোকেরা পাগল-- ট্যাংগো নাচ নিয়ে |
এ-দেশের খাবারও ইউরোপের মতো । বীফ্স্টেক খুব প্রসিদ্ধ । `প্যাম্পাস'-এর র্যাঞ্চে নাকি অতি উত্তম গোরুর পালন হয় । আমি তিন রকম স্টেক খেয়ে দেখেছি--আমেরিকার ওমাহা স্টেকের তুলনায় কিছুই নয় । ওদেশে মাতে ( Mate ) বলে একটা পানীয় জল আছে । ইয়েরবা ( হৃংশঢছ ) গাছের পাতা শুকিয়ে চায়ের মতো গরম জলে ভিজিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে খায় । কেউ কেউ একটু চিনি বা মধুও মেশায় (কিন্তু দুধ কখনোই নয়) । ছোটো শুকনো কুমড়োর বাটিতে যত্ন করে ভেজানো হয়, তারপর লম্বা স্ট্র দিয়ে ওই `চা'টা খাওয়া হয় । ছাঁকনি ব্যবহার নেই । বাজারে দোকানে হাজার রকম শৌখিন কারুকার্য করা পাত্র ও নল কিনতে পাওয়া যায় । এটা চা-কফির মতোই সামাজিক পানীয়, এবং চা-কফির মতোই নিরাপদ । নেশা-ধরানো কোনো ড্রাগ বা অ্যালকোহল এতে নেই ।
এদের খাবারের মতোই, বুয়েনস এয়ার্স আমার মনে তেমন দাগ কাটেনি । সবকিছুই আধুনিক ইউরোপিয়ানদের অনুকরণ মনে হয়েছে । আসলে দক্ষিণ আমেরিকার বৈশিষ্ট্য তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, তার বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-সমুদ্রে । আধুনিক শহর দেখতে পাই আমেরিকা-ইউরোপেই । তার জন্যে অতদূর যেতে হবে কেন ?
আমার অবশ্য পাখি দেখার নেশা আছে বলে একঘেয়েমির কবলে বিশেষ পড়তে হয় না । দক্ষিণ আমেরিকায় তো হাজার হাজার `নতুন' পাখির ছড়াছড়ি । বুয়েনস এয়ার্সেও ডাউনটাউন থেকে দু' ব্লক হাঁটলেই বিরাট প্রাকৃতিক সংরক্ষণ --
Costanera Sur Wildlife Reserve । একেবারে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে কয়েকমাইল জুড়ে চোখ জুড়োনো সবুজ । অদূরেই দেখা যায় শহরের অট্টালিকা । পার্কটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ, আর হাজার রকমের পাখিতে ভরা । কোনো বড়ো শহরের মধ্যে এতো সুন্দর পার্ক আমি আর কোথাও দেখিনি । বুয়েনস এয়ার্সে বেশিরভাগ সময় আমি এই পার্কেই কাটিয়েছি ।
বুয়েনস এয়ার্সে ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল প্রাসাদ -- রাষ্ট্রপতি, মাননীয় মন্ত্রী বা মিলিটারি নেতাদের আবাস । সামনের রাস্তাগুলোও বিরাট--দশ, বারো লেন চওড়া । শুনেছি তৃতীয় বিশ্বে রাজধানীর রাস্তাগুলি চওড়া করা হয় যাতে গৃহযুদ্ধের সময়ে ট্যাংকগুলি শহরে ঢুকতে পারে । আর্জেন্টিনার ইতিহাসেও এর দরকার পড়েছে অনেকবার । এখনো এখানে ওখানে জনবিক্ষোভচিহ্ন দেখা যায় । বিরোধী আন্দোলনের মিছিলের পাশেই বন্দুকধারী, মুখোশ-পরা মিলিটারির দল ।
`রিকোলেতা' নামে সমাধিস্থান |
সবথেকে জনপ্রিয় সমাধিটি এভা পেরনের |
বুয়েনস এয়ার্সের ঠিক মাঝখানে আছে `রিকোলেতা' (
Le Recoleta ) নামে সমাধিস্থান । এখানে আর্জেন্টিনার সব বিখ্যাত, কুখ্যাত ধনী, বিজ্ঞ, রাজনেতা, রাষ্ট্রপতি, নোবেল-বিজয়ী বা জনপ্রিয় নায়কদের শেষ বিশ্রামস্থান । প্রতিটি কবরের উপর মার্বেল বা পাথর দিয়ে তৈরি ছোটো প্রাসাদ, বাড়ি, গীর্জা--তাতে নানারকম ভাস্কর্যের শতাব্দীব্যাপী বিবর্তন লক্ষ করা যায় । পুরো সমাধিস্থানটি শহরের মতো করে পরিকল্পিত--রাস্তা ও ব্লকে ভাগ করা । সবথেকে জনপ্রিয় সমাধিটি এভা পেরনের । ইনিই সেই মহিলা যার নামে ব্রডওয়ের নাটক ও ম্যাডোনা অভিনীত হলিউডের সিনেমা (`এভিটা') তৈরি হয়েছিলো । বিংশ-শতাব্দীর প্রথম অর্ধে এভা ও তার স্বামী হুয়ান পেরন এক সংকটময় সময়ে কিছুকালের জন্য আর্জেন্টিনার নেতৃত্বে ছিলেন । এভার জন্ম গরীব পরিবারে হলেও নিজের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ববলে তিনি দেশের `প্রথম মহিলা' হয়ে ওঠেন । আর্জেন্টিনার ইতিহাসে তাঁর নাম এখনো অতি আদরের । আর্জেন্টিনীয়দের মতে এভা পেরনই মূর্তিমতী আর্জেন্টিনা ।
গন্তব্য--পাটাগোনিয়া |
বুয়েনস এয়ার্সে কয়েকদিন কাটিয়ে আমরা দক্ষিণমুখী হলাম । গন্তব্য--পাটাগোনিয়া । এটা একটা বিরাট উপত্যকা--একদিকে আন্দিস ও অন্যদিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা । খুব দক্ষিণ বলে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা--কানাডার মতোই--এবং খোলা জায়গা বলে সবসময় ঝোড়ো হাওয়া বইছে । এর দক্ষিণে বিখ্যাত `ড্রেক প্যাসেজ'-- সংকীর্ণ প্রণালী দক্ষিণ আটলান্টিক ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরকে যোগ করেছে । আন্দিস পাহাড় এখানেই শেষ হয়, আর দক্ষিণমেরুর সীমারেখার শুরু । ঝোড়ো হাওয়ার জন্য উঁচু গাছপালা দেখা যায় না । তাই দূর থেকে কোনো গাছ দেখলেই বোঝা যায় আশেপাশে মানুষের বসতি আছে । সমতল জায়গাটা পশুপালন ও র্যাঞ্চের জন্য প্রশস্ত । পূবদিকে সমুদ্রতীরে পেঙ্গুইন, তিমি, সীল প্রভৃতি দেখা যায় । পশ্চিমে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে অসংখ্য হিমবাহ (`গ্লেসিয়ার'), বিশাল বিশাল সরোবর ও নদী সৃষ্টি করে । এখানে বৃষ্টি খুব বেশি হয় না । হাওয়ার জন্য আকাশ সর্বদাই পরিষ্কার এবং পৃথিবীর অন্য জায়গার পরিবেশ-দূষণের জন্য ওজোনের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ফলে ঠিক এই জায়গাতেই সূর্যের অতি-বেগনী রশ্মি সব থেকে প্রখর । তাই সবসময়ে টুপি, কালো চশমা, ও `সান-স্ক্রীন' ব্যবহার করতে হয় ।
লেক ভর্তি ফ্লেমিংগো |
ল্যাপউইং |
আন্দিসের পায়ের কাছে `গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক' । হিমবাহ দেখার জন্য সারা পৃথিবীতে এই পার্কের জুড়ি নেই । পার্কের ঠিক পাশেই ছোট্ট শহর এল কালাফাতে (
El Calafate ) পাহাড়, বরফ ও হিমবাহ-প্রেমী পর্যটকদের ঘাঁটি । বুয়েনস এয়ার্স থেকে সোজা বিমানে তিন ঘন্টার পথ । প্লেন থেকে নামলেই হু হু ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগে । আশেপাশে ছড়ানো ছিটোনো অনেকগুলো লেক ।
কালাফাতে বেরীর ফুল |
আমাদের লজটির ঠিক পাশেই একটা লেক ভর্তি ফ্লেমিংগো এবং অনেক রকম হাঁস, বক, আইবিস, ল্যাপউইং ইত্যাদি । বলা বাহুল্য আমার তো সোনায় সোহাগা । ক্রিসমাসের সময় ওখানে প্রখর গ্রীষ্ম । দিনে আঠারো ঘন্টা রোদ । আলাস্কার মতোই রাত দশটাতেও সূয্যিঠাকুরের পাটে বসার ইচ্ছ নেই । এটাও বেশ অদ্ভূত অভিজ্ঞতা । পাখিদেরও পোয়া বারো ।
সারা পাটাগোনিয়ায় প্রায় ১০০০ জাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়--বিরাট কণ্ডর ( Condor ) থেকে ছোট্ট ফিঞ্চ পর্যন্ত । এল কালাফাতের নাম স্থানীয় ফল `কালাফাতে বেরী ( berry ) থেকে নেওয়া । এই ফলটা এখানে সর্বত্র দেখা যায় । জ্যাম, জেলি, মধু--সব কিছুতেই এর ব্যবহার, এমনকী আইসক্রিম-এও । কথায় বলে, এই বেরী একবার খেলে নাকি আপনাকে আবার এখানে ফিরে আসতেই হবে ।
এর নাম পেরিতো মোরেনো |
কখন বরফের চাঁই ভেঙে পড়ে ! |
ছোটো-বড়ো সাতচল্লিশটা হিমবাহ নিয়ে `গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক' । অনেকগুলোই দুর্গম জায়গায়--অনেক পাহাড়জঙ্গল পেরিয়ে নৌকা বেয়ে তবে ওদের কাছে পৌঁছোনো যায় । রাস্তা তো নেই-ই । শুধু একটি হিমবাহই সোজা রাস্তা থেকে দেখা যায় এবং আরো কাছে যাওয়ার জন্যে পাহাড় কেটে সুগম পথ বানানো হয়েছে । পর্যটকদের জেন্য আছে নৌকা, এমনকী সাহসী পর্বতারোহীরা এই হিমবাহের উপর চড়ে বেড়াতে পারেন । এর নাম পেরিতো মোরেনো (একজন প্রকৃতিবিদের নামে) । এটার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে পৃথিবীর অন্য সব হিমবাহের মতো এটা কিন্তু আয়তনে ছোটো হচ্ছে না । একেবারে একই রকম রয়েছে শতাব্দী ধরে । কেউই এর সঠিক কারণ জানে না । পাহাড় থেকে নেমে এসেছে প্রায় উনিশ মাইল লম্বা বরফের জমাট স্রোত । লেক আর্জেন্টিনায় যেখানে নেমেছে, সেখানে হিমবাহটি চওড়ায় প্রায় তিন মাইল এবং জলের কিনারায় এর উচ্চতা প্রায় আড়াই-শ' ফুট ! এর সামনে স্টিমারটা মনে হয় যেন এক খেলনা নৌকা ।
আরোহীদের মনে হয় পিঁপড়ের দল |
সরোবরে হিমবাহ |
বরফের উপরে আরোহীদের মনে হয় পিঁপড়ের দল । পাশে পাহাড়ের গায়ে কাটা রাস্তা ধরে এগোলে প্রায় দুশ' গজের মধ্যে পৌঁছোনো যায় । সেখান থে গুম গুম, কড় কড়--বাজ পড়ার মতো আওয়াজ শোনা যায় হিমবাহের ভেতর থেকে । মাঝে মাঝে এক একটা বরফের চাঁঙড় প্রচণ্ড শব্দে জলের উপরে পড়ে । হিমবাহের পায়ের কাছে অনেক ছোটোবড়ো হিমশৈল (`আইসবার্গ') ভাসতে দেখা যায় । হিমবাহের বরফের বয়স প্রায় দুশ' বছর । কাছ থেকে অপূর্ব নীল, বেগুনী রং দেখা যায় ফাটলের ফাঁক থেকে । হিমবাহের উপরে চড়া বেশ বিপজ্জনক । চারিদিক পিছল, ধারালো বরফ, গভীর গর্ত ও ফাটলে ভর্তি । তার ওপর থেকে থেকেই ভেতরে বরফ ভাঙছে । কাঁটা-লাগানো জুতো পরে, কোমরে দড়ি বেঁধে সাবধানে এগোতে হয় । নৌকায় কাছাকাছি যাওয়াও বিপজ্জনক । কখন বরফের চাঁই ভেঙে পড়ে !
হিমশৈলের জন্ম |
ঘন নীল জমাট বরফ |
পেরিতো মোরানোর চারিদিকে ট্যুরিস্টদের সুবিধার সব ব্যবস্থা । পার্কে হিমবাহ ছাড়াও আছে হাইকিং, মাছ ধরা, ক্যাম্পিং ইত্যাদির জায়গা । সব মিলিয়ে জায়গাটা সত্যিই দেখবার মতো ।
হিমবাহ ছেড়ে আমরা এবার উত্তরমুখী । ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়ার বদলে আর্দ্র উষ্ণ আবহাওয়া । আমরা চলেছি আর্জেন্টিনার একেবারে উত্তর প্রান্তে ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের সীমানার কাছে, পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত--ইগুয়াসু ফল্স্ (
Iguassu Falls ) দেখতে । তিন দেশের ঠিক মাঝখানে ইগুয়াসু নদী এই প্রপাতে ঢোকে, তারপর নীচে পারানা নদীতে জুড়ে আর্জেন্টিনার দিকে বয়ে যায় । আশ্চর্যের ব্যাপার, আমেরিকায় অনেকেই এর নামও শোনেনি কখনো । প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী এলেনর রুজভেল্ট নাকি ইগুয়াসু দেখে বলেছিলেন এর পাশে তো নায়াগ্রা ফল্স্-কে রান্নাঘরের কলের মতো মনে হয় ! সত্যিই প্রপাতটির বিশাল আকার । শুধু একটাই নয়, ছোটোবড়ো মিলিয়ে ২৭৫টি জলপ্রপাত পর্দার মতো দু'পাশে । মাঝখানে সবথেকে বড়োটির নাম Devil's Throat , যার একার অয়তনই ৫০০ ক্ষ ২৩০০ ফুট ! গর্জনে, বাষ্পে, বুক কাঁপায় সে । ইগুয়াসুর অন্যান্য প্রপাতগুলিও কম যায় না--২১০-২৭০ ফুট উচ্চতা তাদের (তুলনায় নায়াগ্রার হর্স-শ্যু ফল্স্ ১৭৬ ফুট মাত্র) ।
ইগুয়াসু |
ডেভিল'স থ্রোট |
ইগুয়াসু ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, দুই দেশ থেকেই দেখা যায় (অনেকটা কানাডা ও আমেরিকার মাঝখানে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো ) । ব্রাজিলের দিকে ছোট্ট শহর
Foz do Iguacu -- রিও থেকে সোজা প্লেন আর আর্জেন্টিনার দিকে Puerto Iguassu -- বুয়েনস এয়ার্স থেকে সোজা প্লেনে । দু'দিকেই ঘন রেন-ফরেস্ট । দুই দেশই পরিবেশ রক্ষণ করে ট্যুরিস্টদের শহর থেকে প্রপাত-এ যাতায়াতের জন্য সুন্দর ট্রাম ও ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে । ব্রাজিলের দিকে লম্বা পাটাতন বানানো হয়েছে যা ফল্স্-এর একেবারে গা ঘেঁষে ঝুঁকে পড়ে । দু'দিকেই জঙ্গলের পশুপাখিদের দেখাবার জন্য ছোটো পার্কও তৈরি করা হয়েছে । ওপাশের রাজ্য প্যারাগুয়ে অবশ্য তুলনায় গরিব দেশ কিন্তু তাও পারানা নদীটির ওপর এরা ইটাইপু ( Itaipu ) বাঁধ তৈরি করেছে সেটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বাঁধ বিদ্যুত্-উত্পাদক । তিন দেশেই এর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়ে থাকে ।
ইগুয়াসু দেখে সত্যিই অভিভূত হতে হয় । ঘন জঙ্গলের মধ্যে এতো বড়ো বিস্ময় ও সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে ! শয়তানের গলার (
Devil's Throat ) কাছে নৌকায় করে যাওয়া যায় । তা-ও খুব কাছে নয় । জলের ফেনায় ও বাষ্পে চোখ খোলা যায় না, আওয়াজে কানে তালা লাগে । তবু, এই অভিজ্ঞতাটা ভোলবার নয় ।
আর্জেন্টিনায় মাত্র ক'টা দিন কাটিয়েছি । বুড়ি ছোঁওয়ার মতোই এখানে ওখানে একটু সময় দেওয়া । অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেলো । আবার যেতে হবে । অনেকবার ।
তুষারাবৃত আন্দিস |
(পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)