সকাল সাতটা -
মেঘেদের চক্রব্যূহ ছিন্ন করে পূষণ তাঁর কিরণাশীর্বাদ পৌঁছে দিলেন খড়াপথ্থরে । মেঘ আর তুষারমৌলীদের দ্বৈরথ জমে উঠেছে । সকালে সোনালী রোদে ঝলমলাচ্ছে গোটা পাহাড় !
গতরাতে বাংলোর টিনের চালে কাদের চলাফেরার শব্দ ঘুমকে বেশ কিছুক্ষণ সরিয়ে রেখেছিল । আজ তাদের চাক্ষুষ দর্শন হলো - পায়রার ভয়ে বুক ঢিপঢিপ ! হায়রে বীর বাঙালি !
সকাল দশটা -
আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি পাড়ি দিচ্ছে রোহড়ুর উদ্দেশে । পাইনবনের ফাঁকে ফাঁকে, বাঁকে বাঁকে অনেকক্ষণ ধরে শ্বেতদেবতারা দর্শন দিতে থাকলেন । পথ উঠছে, নামছে ।
সকাল এগারোটা -
বেলা সাড়েবারোটা -
রোদে পুড়তে পুড়তে পৌঁছলাম রোহড়ু । যেমন গরম, তেমনই ঘিঞ্জি, তেমনই ভিড় - এককথায় যাচ্ছেতাই । শেষমেষ বেশ খানিকটা পিছিয়ে হিমাচল পর্যটনের শান্ত চানসালে পৌঁছে তবে শান্তি । তবে পর্যটন সংস্থার হাবেভাবে শান্তির সাগরে দু-ফোঁটা চোনা ।
সাতই অক্টোবর - সকাল পৌনে ন-টা থেকে দুপুর পৌনে দু-টো -
সন্ধে ছ-টা -
আটই অক্টোবর - `ভোর' ছ-টা -
ঊষালগ্নেই নয়ন সার্থক । তুষারমৌলিদের কনকসাজ দেখার সৌভাগ্য হলো । সূর্যের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠল সারাহান ।
বেলা পৌনে দশটা -
বিদায় সারাহান । আমাদের বিরহে কাতর হয়েই কিনা জানি না, হিমশৃঙ্গেরা মেঘের আড়ালে মুখ লুকোতে শুরু করল ।
বেলা সোয়া এগারোটা -
নিগুনসারি, নিচার নাচার হয়ে আমাদের ছুটে চলা দেখল । ভাবানগর নিয়ে ভালো করে ভাবার আগেই কস্থল-য়ে শতদ্রু-লঙ্ঘন করে দক্ষিণপন্থী হওয়া গেল বসপাকে সঙ্গী করে ।
বেলা দু'টো দশ -
সন্ধে ছ'টা -
বেলা বাড়তেই আকাশের মুখ ভার, শেষে অশ্রুবর্ষণ; পাহাড়চূড়ায় তুষারপাত । নিচে পান্নাসবুজ বসপার বিস্তার, উপরে শ্বেতশুভ্র নিহাররাজি । তাপমাত্রার কথা না বলাই ভালো- ভাল্লুক সেজে বসে আছি ।
নয়ই অক্টোবর সকাল ছ'টা -
সকাল সাড়ে আটটা বেজে কুড়ি মিনিট -
চল চল রে নওজোয়ান, ছিত্কুল অভিযান । এই শর্মাকে অবশ্য কোনওমতেই নওজোয়ান তো দূর অস্ত, জওয়ানও বলা চলে না । তবে কিনা, বাকি সব্বাই তো নওজোয়ান ।
সকাল ন'টা -
সাংলা বাজারের মিনি-ভিড় পেরিয়ে এলাম । দু'ধারে তুষার-পাউডার মেখে গরবিনীর ভঙ্গিতে অগুণতি পাহাড়ের দল সার বেঁধে পাহারা দিচ্ছে । বাঁদিকে তাদের কোলে নানামাপের সবুজ পরীদের ভিড়ে মাঝেমধ্যে দু'চারটে মানুষে-গড়া দেশলাই বাক্স । ডানদিকে নীলচে সবুজ বসপার ওপারে নিচুতলায় শুধুই সবুজ । মাঝেমধ্যে এঁকেবেঁকে জলের ধারা এসে আত্মসমর্পণ করছে বসপার বুকে । পিচের ছাইরঙা ফিতেটার ওপর দিয়ে গাড়িগুলো ছুটছে সেই সৌন্দর্য মেখে ।
সকাল দশটা -
সকাল সোয়া দশটা -
ফিরতি দলের মুখে গতরাতের তুষারমাখার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা । আমাদের সঙ্গে পথের দু-পাশের গাছপালা, তাদের আড়াল থেকে উঁকিমারা বসপা আর তুষারশৃঙ্গেরা এমনকী নিচের থেকে মাথা উঁচিয়ে সে সব শুনছে পাথরের দল আর ঝোপঝাড়েরা ।
সকাল এগারোটা -
বেলা সোয়া দুটো -
সুশঙ্গ নালা, গঙ্গারঙ্গ নালা পেরিয়ে রকছমে দুটো উজ্জ্বল প্রজাপতির স্বপ্নের কথা শুনে ফিরে এলাম সাংলায় ।
সন্ধে ছ'টা -
আকাশ তার লালচে নীল জামাটা সরিয়ে তারার চুমকি বসানো কালো আলখাল্লাটা গায়ে চড়াচ্ছে । বসতির বিজলিবাতির তারাগুলোও জ্বলতে শুরু করেছে । সারাদিনের হইচই থামিয়ে সাংলা আলস্যের হাই তুলছে । শুধু বসপা বয়ে চলেছে নিরলস ।
দশই অক্টোবর সকাল ন-টা -
সাংলার মায়া কাটিয়ে আজ পাড়ি জমাচ্ছি কল্পনার কল্পলোকের উদ্দেশে বসপার দৌড়ের সঙ্গী হয়ে ।
সকাল দশটা -
রকছম থেকে নতুন পথে শতদ্রুর উজানে দৌড় । প্রকৃতি তার ভোলবদল করেছে । সবুজ ওড়ানাটা সরিয়ে রেখে পাথুরে রুক্ষতার চাদরটা জড়িয়ে নিয়েছে । দামাল শতদ্রু, যার আদরের ডাকনাম সতলুজ, দুরন্ত গর্জনে আমাদের উলটো ছুট দেখছে । দু'ধারে খাড়া নীরস দেওয়াল । ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যেই উঁকি মেরে যাচ্ছে উত্তুঙ্গ ধবল শিখর ।
সকাল দশটা কুড়ি -
শংটংপুল টপকে ঢুকে পড়লাম কিন্নরকৈলাসের পাড়ায় ।
সকাল দশটা চল্লিশ -
গাড়ি দম নিল পোওয়ারিতে । তার শেষ খাবার ধাবা এখানেই । এখান থেকে কল্পার পথ বামপন্থায় উর্ধ্বমুখী - সেখানে পেট্রল পাম্প নাস্তি । গাড়িও খেল, আমরাও খেলাম - চা ।
বেলা সাড়ে এগারোটা -
ঠিক দুপ্পুরবেলা -
কল্পার কল্পলোকে । চিনি গ্রামকে নিচে ফেলে আপেলবাগান টপকে টংয়ে চড়ে হাজির হলাম কিন্নর কৈলাস কটেজের আঙিনায় । অপূর্ব গঠনশৈলী । আরও অপূর্ব চারদিকের অত্যদ্ভুত দৃশ্য । পাহাড় গড়াতে গড়াতে চিনি গ্রামের গুম্বা ছুঁয়ে, রেকংপিওকে পেরিয়ে নেমে গেছে শতদ্রুর বুকে । তারপর তাকে পেরিয়ে উঠতে উঠতে কিন্নর কৈলাস হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে । কিন্নর কৈলাসের গায়ে সেই আশ্চর্য শিবলিঙ্গ, যে কিনা দিনভর রং পালটায় । পূষণের পুণ্যকিরণে পবিত্র এই কল্পা পাখির কাকলিতে মুখরিত ।
সন্ধে ছ'টা থেকে সাতটা -
সারাটা দিন কাটল রাজকীয় আবাসে রাজকীয় আলস্যে । বেলাশেষে মেঘের দল বাড়ি ফিরে কিন্নর কৈলাসদের গলা জড়িয়ে ধরল । তাদের আদরে হিমালয়ের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত । আমরা গোটা কাণ্ডটা দেখছি বুঝে বোধহয় তারা সব শেষবেলার আলোয় লজ্জায়রাঙা হয়ে উঠল । শেষে রাত্রিদেবী এসে তাদের ঢেকে দিয়ে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিলেন ।
এগারোই অক্টোবর সকাল ছ'টা -
নবারুণের নবীন কিরণ কিন্নর কৈলাসের কাঁধ ছুঁয়ে এসে তার আশিস মাখিয়ে দিল কল্পার সর্বাঙ্গে । হিমমাখা বাতাসে লাগল উষ্ণতার পরশ । সুনীল আকাশে ডানা মেলে দিল বিহঙ্গের দল । তাদের কাকলির সুর ছড়িয়ে পড়ল বনে বনান্তরে ।
সকাল ন'টা -
বিকাশবাবুর বাহন-বাহিত হয়ে দেখতে চলেছি এ পথে ভারতের শেষ গ্রাম রোঘিকে । আপেল বাগানদের দু-পাশে রেখে কিন্নর কৈলাসের নজরদারিতে এঁকে বেঁকে দে ছুট । রোদমাখা সকাল অবাক হয়ে আমাদের দৌড় দেখতে লাগল ।
সকাল দশটা -
সরু ধুলোমাখা পথের দুধারে আলস্যে বিছিয়ে রয়েছে রোঘি - ভারতের শেষ গ্রাম । দূরে পাহাড়চুড়োয় সীমান্তরেখা জানিয়ে উড়ছে জাতীয় পতাকা । শান্ত, নির্জন রোঘিতে নি:শব্দে পা বাড়াচ্ছে শহুরে সভ্যতা । রোঘির সর্বাঙ্গে কিন্নর কৈলাসের স্নেহাশীর্বাদ ।
ভরদুপুর -
চিনিগ্রামের রূপ চাখতে চাখতে নেমে এসেছি রেকংপিওতে এটিএম বাবার শরণে । প্যাকেজ ট্যুরের পাকে পড়ে এখন প্রাণ আইঢাই । ছাব্বিশ হাজারের ত্রৈরাশিকের ওপর আরও হাজার দশেকের ভগ্নাংশের ধাক্কা । প্রবঞ্চনার এই জ্বালায় স্নিগ্ধ সুধার প্রলেপ দিচ্ছেন কৈলাসপতি ।
বিকেল পাঁচটা থেকে ছ'টা -
দিনভর শিবলিঙ্গের রূপবদল দেখলাম । ভোরে ধূসর, তারপর দিনভর উজ্জ্বল হলুদ আর কমলার লুকোচুরি আর শেষবেলার তার রক্তিম রূপ ধরে রাখলাম মন ক্যামেরায় । সূর্য অস্ত যাবার সময় গোটা কিন্নর কৈলাসে আগুন লাগিয়ে গেল ।
বারোই অক্টোবর সকাল ন'টা -
ভোরে আবার কিন্নর কৈলাসের দৃষ্টিপূজা । এবার ফেরার পালা । স্বর্গ হতে বিদায় । আজ নারকাণ্ডায় থাকার কথা । তবে, সবই বিকাশবাবু আর তার মালিকদের মর্জি-নির্ভর ।
সকাল সাড়ে ন'টা -
একটা ট্রাক পথ জুড়ে আপেল বিছিয়ে নিজে কাত হয়ে ঘুম লাগিয়েছে, তাই পথ বদল । বোকটুর পথে একটু ঘুরে পৌঁছলাম রেকংপিও - এখানকার লোকেদের আদরের পিও ।
সকাল সাড়ে দশটা -
বীরসা মুণ্ডার দেশের লোকেরা তাঁর নামেই রেখেছে তাদের লেবার ক্যাম্পের নাম । পথ বিস্তারের কাজে সেই সুদূর অঞ্চল থেকে এই অকরুণ প্রকৃতির মাঝে এসেও নিজেদের প্রিয় `ভগবানের' নাম ভুলতে পারেনি তারা ।
দুপুর আড়াইটে বাজতে দশ -
রকছম, টাপরি, ওয়াংটু, জ্যুরি, ঝাকড়ি হয়ে বুশাহার রাজাদের রাজধানী সতলুজ নদীর তীরের রামপুরে এসে পড়লাম বেলা একটায় । রামপুরের পদম প্যালেস চোখ ধাঁধিয়ে দিল । সোয়া ঘন্টাতেই গরম আমাদের হাড় ভাজাভাজা করে দেবার তাল করল । তাই নারকাণ্ডার ঠাণ্ডার ছবি মনে এঁকে লাগালাম দৌড় ।
বিকেল পাঁচটা পঁচিশ -
ঠাণ্ডা ঘেরা নারকাণ্ডা । দেখেই লাগল মনে দোলা । তার রূপ যায় না ভোলা । কিন্তু, হা হতোস্মি ! `বিকাশবাণী' হলো - হোটেল বুকিং নেই । সে কী কথা ! সাড়ে তিন মাস আগে বুক করেছি যে ! তাতে কী ? বুকিং নেই, ব্যস । দায়িত্ব ! সেটা আবার কোন ভাষার শব্দ !
সন্ধ্যা পৌনে সাতটা -
একে একে ঠিওগ, ফাগু সব জায়গায় গলাধাক্কা খেতে খেতে কুফরিতে পথের ধারে ছোট্ট ঘরে মিলল মাথা গোঁজার ঠাঁই । মনটা বিচ্ছিরি রকম তেতো আর শরীর বিচ্ছিরি রকম ক্লান্ত ।
তেরোই অক্টোবর বেলা সোয়া দশটা -
ঠিক দুপ্পুরবেলা -
শিমলার দোতলা লিফ্ট চড়া হলো । দিব্যি ।
বেলা দুটো পঞ্চাশ -
রাত আটটা কুড়ি -
(শেষ )
(পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)