• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কিন্নর দেশে : খাড়াপাথরের গ্রামে : রাহুল মজুমদার

    ছয়ই অক্টোবর - ভোর সাড়ে পাঁচটা

    পুব আকাশে আলোর আভাস । দিগন্তে তুষারশৃঙ্গেরা অবশ্য এখনও সে আলো মাখেনি । গোটা খড়াপথ্থর নিঝুম ঘুমে মগ্ন - শুধু ছোট বড় পাখিরা উঠে পড়েছে দিনমণিকে স্বাগত জানাতে ।

    সকাল সাতটা -

    মেঘেদের চক্রব্যূহ ছিন্ন করে পূষণ তাঁর কিরণাশীর্বাদ পৌঁছে দিলেন খড়াপথ্থরে । মেঘ আর তুষারমৌলীদের দ্বৈরথ জমে উঠেছে । সকালে সোনালী রোদে ঝলমলাচ্ছে গোটা পাহাড় !

    গতরাতে বাংলোর টিনের চালে কাদের চলাফেরার শব্দ ঘুমকে বেশ কিছুক্ষণ সরিয়ে রেখেছিল । আজ তাদের চাক্ষুষ দর্শন হলো - পায়রার ভয়ে বুক ঢিপঢিপ ! হায়রে বীর বাঙালি !

    সকাল দশটা -

    আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি পাড়ি দিচ্ছে রোহড়ুর উদ্দেশে । পাইনবনের ফাঁকে ফাঁকে, বাঁকে বাঁকে অনেকক্ষণ ধরে শ্বেতদেবতারা দর্শন দিতে থাকলেন । পথ উঠছে, নামছে ।

    সকাল এগারোটা -




    হাটকোঠিতে হাটেশ্বরীর মন্দির


    নামতে নামতে এসে গেলাম মা হাটেশ্বরীর বাড়ি হাটকোঠিতে । হিমাচলী শৈলীতে গড়া মন্দির প্রাঙ্গণ । প্রাচীনতার আভাস তার সর্বাঙ্গে । মন্দিরে চামড়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ - তাই গায়ের চামড়া ছাড়া বাকিগুলো বাইরে বর্জন করে প্রাঙ্গণস্থ হওয়া গেল । মায়ের ছবি তোলানোয় ঘোর অনীহা, তাই সেই শখ বাইরে থেকেই মেটাতে হলো । হাটকোঠির শান্ত রূপ মুগ্ধ করার মতোই । গরম চড়া হলেও শান্ত প্রকৃতি আকাশছোঁয়া শরীরে সবুজ মেখে ঘিরে রেখেছে মা-কে ।

    বেলা সাড়েবারোটা -

    রোদে পুড়তে পুড়তে পৌঁছলাম রোহড়ু । যেমন গরম, তেমনই ঘিঞ্জি, তেমনই ভিড় - এককথায় যাচ্ছেতাই । শেষমেষ বেশ খানিকটা পিছিয়ে হিমাচল পর্যটনের শান্ত চানসালে পৌঁছে তবে শান্তি । তবে পর্যটন সংস্থার হাবেভাবে শান্তির সাগরে দু-ফোঁটা চোনা ।

    সাতই অক্টোবর - সকাল পৌনে ন-টা থেকে দুপুর পৌনে দু-টো -




    রামপুরের কদম প্যালেস


    হাজারো সেলাম জানিয়ে রোহড়ুকে বিদায় জানালাম । তেমাথায় এসে গাড়ি বামপন্থী হলো । টাকলেচ হয়ে নোগলিতে ২২নং জাতীয় সড়কের সঙ্গে মোলাকাত হলো । শতদ্রু ওরফে সতলুজের উজানে উড়তে থাকল গাড়ি । উড়তে উড়তে এসে পড়লাম রামপুর । বাপরে কী রাম ভিড় ! উড়ান এখন হামাগুড়ি । রামপুর পেরিয়ে তবে আরাম । ঝাকরি, রতনপুর ফুর্র করে পেরিয়ে এলাম । জ্যুরি (জিওরি) পৌঁছে সতলুজকে আড়ি জানিয়ে গাড়ি হঠাৎ ডাইনে মোচড় মেরে আকাশপানে ধাওয়া করল । মেঘের ফাঁকে ফাঁকে তুষারশৃঙ্গেরা আমাদের এই উর্ধ্বারোহন দেখতে লাগল । ঘরাট পেরিয়ে কয়েকবার ডাইনে বাঁয়ে মোচড় সেরে সারাহান । ২১৬৫ মি. উঁচুতে ৯০০ বছরের প্রাচীন ভীমাকালি মন্দির প্রথম দর্শনেই সমীহ আদায় করে নিল । অসাধারণ তার গঠনশৈলী ! হিমশৃঙ্গতরঙ্গমালা এখন মেঘপ্রাচীরের আড়ালে ।

    সন্ধে ছ-টা -




    সারাহানের ভীমাকালি মন্দির


    ভীমাকালি মাতার মন্দির আমাদের দেখা সেরা মন্দিরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে । তিনধাপ তোরণ আর অসাধারণ কারুকার্যময় চত্বর পেরিয়ে তবে মূল মন্দিরে ঢোকা যায় । আগাগোড়া কাঠ-পাথরে গড়া জোড়ামন্দিরের একটায় এখন মায়ের অধিষ্ঠান । মন্দিরের কাঠের কারুকাজ হাঁ করে গিললাম । তারপর আঁধার হানা দিচ্ছে দেখে ফিরে এলাম হোটেলে ।

    আটই অক্টোবর - `ভোর' ছ-টা -

    ঊষালগ্নেই নয়ন সার্থক । তুষারমৌলিদের কনকসাজ দেখার সৌভাগ্য হলো । সূর্যের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠল সারাহান ।

    বেলা পৌনে দশটা -

    বিদায় সারাহান । আমাদের বিরহে কাতর হয়েই কিনা জানি না, হিমশৃঙ্গেরা মেঘের আড়ালে মুখ লুকোতে শুরু করল ।

    বেলা সোয়া এগারোটা -




    পাথুরে গাড়িবারান্দা


    জ্যুরিতে আমার শতদ্রুর সঙ্গী হওয়া গেল । তাকে সাক্ষী রেখেই চৌরিতে স্পর্শ করলাম কিন্নরভূমি । পাহাড়ের পাথুরে বুক ফাটিয়ে তৈরি হয়েছে পথ । সেই পথের ওপর মাঝেমাঝেই পাথরের গাড়িবারান্দা । তার তলা দিয়েই ছুট ।

    নিগুনসারি, নিচার নাচার হয়ে আমাদের ছুটে চলা দেখল । ভাবানগর নিয়ে ভালো করে ভাবার আগেই কস্থল-য়ে শতদ্রু-লঙ্ঘন করে দক্ষিণপন্থী হওয়া গেল বসপাকে সঙ্গী করে ।

    বেলা দু'টো দশ -




    সুন্দরী সাংলা


    টাপরি টপকে চোলিংয়ের ধসা পাহাড় পেরিয়ে সবজে বসপার ধার ঘেঁষে কামরু দুর্গকে সাক্ষী রেখে পৌঁছে গেলাম সাংলা । দু'পাশে তুষারকিরীটির পাহারা নিয়ে ২৬৮০ মি. উঁচুতে সাংলা সুন্দরীর আসন ।

    সন্ধে ছ'টা -

    বেলা বাড়তেই আকাশের মুখ ভার, শেষে অশ্রুবর্ষণ; পাহাড়চূড়ায় তুষারপাত । নিচে পান্নাসবুজ বসপার বিস্তার, উপরে শ্বেতশুভ্র নিহাররাজি । তাপমাত্রার কথা না বলাই ভালো- ভাল্লুক সেজে বসে আছি ।

    নয়ই অক্টোবর সকাল ছ'টা -




    সুন্দরী সাংলা


    এ কী হেরি নয়ন সমুখে ! চতুর্দিকে শুভ্রতার প্রলেপ । গতকাল আমাদের আসতে দেখে লজ্জায় মেঘে মুখ ঢেকেছিল ন্যাড়া পাহাড়ের দল । তারপর সারারাত আঁধার আর বর্ষার আড়ালে মেজেছে, সেজেছে । আজ সকালে তাই চারধারে আইসক্রীমের বিজ্ঞাপন । ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপনের মতো ধবধবে সাদা পোশাকে মুড়ে হাজির সব । কেউ আপাদমস্তক সাদা, কারও নিচের দিকে সবজে ঘাঘরা, কারও বাদামী সালোয়ার । তাদের কাণ্ড দেখে বসপা হেসে লুটোপুটি । একে একে সকলে গায়ে সোনারোদ মেখে নিল । আজ পরিকল্পনা ছিল ছিত্কুলে থাকার কিন্তু শীতল বাতাসে খবর ভেসে এলো, সেখানে প্রবল তুষারপাত হয়েছে, সকলে নাকি জমে কুলপি হয়ে গিয়েছে । তাই আজ শুধু ছিত্কুলকে বুড়ি ছুঁয়ে আসা ।

    সকাল সাড়ে আটটা বেজে কুড়ি মিনিট -

    চল চল রে নওজোয়ান, ছিত্কুল অভিযান । এই শর্মাকে অবশ্য কোনওমতেই নওজোয়ান তো দূর অস্ত, জওয়ানও বলা চলে না । তবে কিনা, বাকি সব্বাই তো নওজোয়ান ।

    সকাল ন'টা -

    সাংলা বাজারের মিনি-ভিড় পেরিয়ে এলাম । দু'ধারে তুষার-পাউডার মেখে গরবিনীর ভঙ্গিতে অগুণতি পাহাড়ের দল সার বেঁধে পাহারা দিচ্ছে । বাঁদিকে তাদের কোলে নানামাপের সবুজ পরীদের ভিড়ে মাঝেমধ্যে দু'চারটে মানুষে-গড়া দেশলাই বাক্স । ডানদিকে নীলচে সবুজ বসপার ওপারে নিচুতলায় শুধুই সবুজ । মাঝেমধ্যে এঁকেবেঁকে জলের ধারা এসে আত্মসমর্পণ করছে বসপার বুকে । পিচের ছাইরঙা ফিতেটার ওপর দিয়ে গাড়িগুলো ছুটছে সেই সৌন্দর্য মেখে ।

    সকাল দশটা -




    রক-ময় রকছম


    বত্সেরিতে আপেলবাগানকে টা টা করে এসে পড়লাম অপরূপ রকছমে । রকছমকে আগলে রেখেছে শক্ত পাথুরে আকাশছোঁয়া পাহারাদারের । অমন নীরস পাহাড়ের পায়ের কাছে, বসপার কোল ঘেঁষে রকছম একটা নানারঙে বোনা পারস্য-গালিচার মতো বিছানো । কত রং, কত নকশা তাতে ! একেবারে যেন `দুলহন ওহী যো পিয়া মন ভায়ে' ।

    সকাল সোয়া দশটা -

    ফিরতি দলের মুখে গতরাতের তুষারমাখার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা । আমাদের সঙ্গে পথের দু-পাশের গাছপালা, তাদের আড়াল থেকে উঁকিমারা বসপা আর তুষারশৃঙ্গেরা এমনকী নিচের থেকে মাথা উঁচিয়ে সে সব শুনছে পাথরের দল আর ঝোপঝাড়েরা ।

    সকাল এগারোটা -




    ছিত্কুল - যেন এক টুকরো রঙিন ছবি


    পাথুরে পাহাড়েরা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে তুষারদেবতাদের । পথের দু'ধারে, গাছের গায়ে তুষারের আলপনা । মুগ্ধমনের ক্যানভাসে সেই ছবি এঁকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম এই পথে ভারতের শেষ গ্রাম ছিত্কুলে । ৩৬৪০ মিটার উঁচুতে তুষারস্টেডিয়ামের মাঝে ছিত্কুল যেন একটুকরো রঙিন ছবি । নব্যতরুণী বসপা নাচ দেখাছে গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী দেবী মাথী (নাকি মাহি) কে । চারদিক থেকে ধ্যানগম্ভীর হিমবন্ত সস্নেহ নজর রাখছে । হেথা হোথা তুষারের স্তূপ, চমরি গাইয়ের অলস বিচরণ, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে হিমেল হাওয়ার খেলা, মাথার ওপর ঘননীল চন্দ্রাতপ, হাতে গরম কফির কাপ - স্বর্গ কি অন্যরকম কিছু !



    ছিত্কুল


    বেলা একটা -

    দুটো ঘন্টা যেন দু সেকেণ্ডে ফুরিয়ে গেল । এবার স্বর্গ থেকে বিদায় নেবার পালা ।

    বেলা সোয়া দুটো -

    সুশঙ্গ নালা, গঙ্গারঙ্গ নালা পেরিয়ে রকছমে দুটো উজ্জ্বল প্রজাপতির স্বপ্নের কথা শুনে ফিরে এলাম সাংলায় ।

    সন্ধে ছ'টা -

    আকাশ তার লালচে নীল জামাটা সরিয়ে তারার চুমকি বসানো কালো আলখাল্লাটা গায়ে চড়াচ্ছে । বসতির বিজলিবাতির তারাগুলোও জ্বলতে শুরু করেছে । সারাদিনের হইচই থামিয়ে সাংলা আলস্যের হাই তুলছে । শুধু বসপা বয়ে চলেছে নিরলস ।

    দশই অক্টোবর সকাল ন-টা -

    সাংলার মায়া কাটিয়ে আজ পাড়ি জমাচ্ছি কল্পনার কল্পলোকের উদ্দেশে বসপার দৌড়ের সঙ্গী হয়ে ।

    সকাল দশটা -

    রকছম থেকে নতুন পথে শতদ্রুর উজানে দৌড় । প্রকৃতি তার ভোলবদল করেছে । সবুজ ওড়ানাটা সরিয়ে রেখে পাথুরে রুক্ষতার চাদরটা জড়িয়ে নিয়েছে । দামাল শতদ্রু, যার আদরের ডাকনাম সতলুজ, দুরন্ত গর্জনে আমাদের উলটো ছুট দেখছে । দু'ধারে খাড়া নীরস দেওয়াল । ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যেই উঁকি মেরে যাচ্ছে উত্তুঙ্গ ধবল শিখর ।

    সকাল দশটা কুড়ি -

    শংটংপুল টপকে ঢুকে পড়লাম কিন্নরকৈলাসের পাড়ায় ।

    সকাল দশটা চল্লিশ -

    গাড়ি দম নিল পোওয়ারিতে । তার শেষ খাবার ধাবা এখানেই । এখান থেকে কল্পার পথ বামপন্থায় উর্ধ্বমুখী - সেখানে পেট্রল পাম্প নাস্তি । গাড়িও খেল, আমরাও খেলাম - চা ।

    বেলা সাড়ে এগারোটা -




    রেকংপিও


    রেকংপিও - ভারী শহর, ভারী সুন্দর দৃশ্য । সপার্ষদ কিন্নর কৈলাসের আশীর্বাদধন্য রেকংপিও । সদর শহর রেকংপিও ।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা -

    কল্পার কল্পলোকে । চিনি গ্রামকে নিচে ফেলে আপেলবাগান টপকে টংয়ে চড়ে হাজির হলাম কিন্নর কৈলাস কটেজের আঙিনায় । অপূর্ব গঠনশৈলী । আরও অপূর্ব চারদিকের অত্যদ্ভুত দৃশ্য । পাহাড় গড়াতে গড়াতে চিনি গ্রামের গুম্বা ছুঁয়ে, রেকংপিওকে পেরিয়ে নেমে গেছে শতদ্রুর বুকে । তারপর তাকে পেরিয়ে উঠতে উঠতে কিন্নর কৈলাস হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে । কিন্নর কৈলাসের গায়ে সেই আশ্চর্য শিবলিঙ্গ, যে কিনা দিনভর রং পালটায় । পূষণের পুণ্যকিরণে পবিত্র এই কল্পা পাখির কাকলিতে মুখরিত ।

    সন্ধে ছ'টা থেকে সাতটা -

    সারাটা দিন কাটল রাজকীয় আবাসে রাজকীয় আলস্যে । বেলাশেষে মেঘের দল বাড়ি ফিরে কিন্নর কৈলাসদের গলা জড়িয়ে ধরল । তাদের আদরে হিমালয়ের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত । আমরা গোটা কাণ্ডটা দেখছি বুঝে বোধহয় তারা সব শেষবেলার আলোয় লজ্জায়রাঙা হয়ে উঠল । শেষে রাত্রিদেবী এসে তাদের ঢেকে দিয়ে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিলেন ।

    এগারোই অক্টোবর সকাল ছ'টা -

    নবারুণের নবীন কিরণ কিন্নর কৈলাসের কাঁধ ছুঁয়ে এসে তার আশিস মাখিয়ে দিল কল্পার সর্বাঙ্গে । হিমমাখা বাতাসে লাগল উষ্ণতার পরশ । সুনীল আকাশে ডানা মেলে দিল বিহঙ্গের দল । তাদের কাকলির সুর ছড়িয়ে পড়ল বনে বনান্তরে ।

    সকাল ন'টা -

    বিকাশবাবুর বাহন-বাহিত হয়ে দেখতে চলেছি এ পথে ভারতের শেষ গ্রাম রোঘিকে । আপেল বাগানদের দু-পাশে রেখে কিন্নর কৈলাসের নজরদারিতে এঁকে বেঁকে দে ছুট । রোদমাখা সকাল অবাক হয়ে আমাদের দৌড় দেখতে লাগল ।

    সকাল দশটা -

    সরু ধুলোমাখা পথের দুধারে আলস্যে বিছিয়ে রয়েছে রোঘি - ভারতের শেষ গ্রাম । দূরে পাহাড়চুড়োয় সীমান্তরেখা জানিয়ে উড়ছে জাতীয় পতাকা । শান্ত, নির্জন রোঘিতে নি:শব্দে পা বাড়াচ্ছে শহুরে সভ্যতা । রোঘির সর্বাঙ্গে কিন্নর কৈলাসের স্নেহাশীর্বাদ ।

    ভরদুপুর -

    চিনিগ্রামের রূপ চাখতে চাখতে নেমে এসেছি রেকংপিওতে এটিএম বাবার শরণে । প্যাকেজ ট্যুরের পাকে পড়ে এখন প্রাণ আইঢাই । ছাব্বিশ হাজারের ত্রৈরাশিকের ওপর আরও হাজার দশেকের ভগ্নাংশের ধাক্কা । প্রবঞ্চনার এই জ্বালায় স্নিগ্ধ সুধার প্রলেপ দিচ্ছেন কৈলাসপতি ।

    বিকেল পাঁচটা থেকে ছ'টা -

    দিনভর শিবলিঙ্গের রূপবদল দেখলাম । ভোরে ধূসর, তারপর দিনভর উজ্জ্বল হলুদ আর কমলার লুকোচুরি আর শেষবেলার তার রক্তিম রূপ ধরে রাখলাম মন ক্যামেরায় । সূর্য অস্ত যাবার সময় গোটা কিন্নর কৈলাসে আগুন লাগিয়ে গেল ।

    বারোই অক্টোবর সকাল ন'টা -

    ভোরে আবার কিন্নর কৈলাসের দৃষ্টিপূজা । এবার ফেরার পালা । স্বর্গ হতে বিদায় । আজ নারকাণ্ডায় থাকার কথা । তবে, সবই বিকাশবাবু আর তার মালিকদের মর্জি-নির্ভর ।

    সকাল সাড়ে ন'টা -

    একটা ট্রাক পথ জুড়ে আপেল বিছিয়ে নিজে কাত হয়ে ঘুম লাগিয়েছে, তাই পথ বদল । বোকটুর পথে একটু ঘুরে পৌঁছলাম রেকংপিও - এখানকার লোকেদের আদরের পিও ।

    সকাল সাড়ে দশটা -

    বীরসা মুণ্ডার দেশের লোকেরা তাঁর নামেই রেখেছে তাদের লেবার ক্যাম্পের নাম । পথ বিস্তারের কাজে সেই সুদূর অঞ্চল থেকে এই অকরুণ প্রকৃতির মাঝে এসেও নিজেদের প্রিয় `ভগবানের' নাম ভুলতে পারেনি তারা ।

    দুপুর আড়াইটে বাজতে দশ -

    রকছম, টাপরি, ওয়াংটু, জ্যুরি, ঝাকড়ি হয়ে বুশাহার রাজাদের রাজধানী সতলুজ নদীর তীরের রামপুরে এসে পড়লাম বেলা একটায় । রামপুরের পদম প্যালেস চোখ ধাঁধিয়ে দিল । সোয়া ঘন্টাতেই গরম আমাদের হাড় ভাজাভাজা করে দেবার তাল করল । তাই নারকাণ্ডার ঠাণ্ডার ছবি মনে এঁকে লাগালাম দৌড় ।

    বিকেল পাঁচটা পঁচিশ -

    ঠাণ্ডা ঘেরা নারকাণ্ডা । দেখেই লাগল মনে দোলা । তার রূপ যায় না ভোলা । কিন্তু, হা হতোস্মি ! `বিকাশবাণী' হলো - হোটেল বুকিং নেই । সে কী কথা ! সাড়ে তিন মাস আগে বুক করেছি যে ! তাতে কী ? বুকিং নেই, ব্যস । দায়িত্ব ! সেটা আবার কোন ভাষার শব্দ !

    সন্ধ্যা পৌনে সাতটা -

    একে একে ঠিওগ, ফাগু সব জায়গায় গলাধাক্কা খেতে খেতে কুফরিতে পথের ধারে ছোট্ট ঘরে মিলল মাথা গোঁজার ঠাঁই । মনটা বিচ্ছিরি রকম তেতো আর শরীর বিচ্ছিরি রকম ক্লান্ত ।

    তেরোই অক্টোবর বেলা সোয়া দশটা -




    শিমলা স্টেশন (*)


    সব ভালো যার শেষ ভালো । আমাদের বেলায় যদিও শেষটা রীতিমতো খারাপ হলো । বিকাশবাবু কান মলে বেশ কিছু বাড়তি টাকা আদায় করলেন । দিয়ে বাঁচলাম । শিমলা স্টেশন সেই ক্ষতে প্রলেপ দিল ।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা -

    শিমলার দোতলা লিফ্ট চড়া হলো । দিব্যি ।

    বেলা দুটো পঞ্চাশ -




    টয়ট্রেন (*)


    শিমলার টয়ট্রেন আমাদের টানা আরম্ভ করল কালকার দিকে ।

    রাত আটটা কুড়ি -




    কালকা (*)


    ছবির মতো সব স্টেশন, কথায় কথায় টানেল, বাঁকের পরে বাঁক ছবির মতো ট্রেনে চড়ে এসে পড়লাম কালকায় । আজ রাতটা এখানে থেকে কাল ভোরে কালকা ছেড়ে দিল্লী হয়ে ফিরব ঘরে । সুরে বেসুরে কিন্নর ঘুরে, মনে অনেক ছবি পুরে ।

    (শেষ )



    (পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)