• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • ইতিহাসের সন্দর্ভ, সন্দর্ভের ইতিহাস : হিন্দোল ভট্টাচার্য

    হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত , যোগেশচন্দ্র বাগল, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, সংকলক : অশোক উপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী ; প্রকাশক -- তালপাতা, কলকাতা . ২০০৯। ISBN: নেই

    একবিংশের শুরুর দশকে এসে আমরা যে সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি, সেখানে আমাদের উপর থাবা মারছে বিশ্বায়িত দুনিয়ার সংস্কৃতি ও বাজারব্যবস্থা। ফলত জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে যেমন, তেমন আমাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রেও এই সন্ধিক্ষণটি বিশেষভাবে গুরুত্বের। আজ থেকে দেড়শো বছর আগের ভরতবর্ষ তথা বাংলায় ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার যে বিপুল পরিধি আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার ভালো দিক যেমন নিশ্চয়-ই আছে, তেমনই এও সত্য, যে অনেকের মনে দেশীয় সংস্কারের প্রতি যে প্রতিকূল মনোভাব ছিল, বিদেশি সংস্কারের প্রতি হয়তো সে-রকম ছিল না (প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত)। স্বাধীন মনের পরিচয়ের সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞার যে সংস্কৃতি ঊনবিংশ শতকের বাংলায় গড়ে ওঠে, তার প্রভাবে বাংলা ত্রক্রমশ তার নিজস্ব শিকড়ের মধ্যে আধুনিকতার যে বীজ, তা থেকে ত্রক্রমশ সরে যেতে থাকে (এই সরে যাওয়াটা কবে থেকে শুরু হয়? এর মানে বুঝলাম না --- ঊনবিংশ শতাব্দীতে কি বিদেশী প্রভাব ছাড়া কোনো আধুনিকতার উন্মোচন হচ্ছিল, যেটা থেকে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ তখনকার বাঙালিকে সরিয়ে দিয়েছে? উদাহরণ?)। এই সরে যাওয়ার প্রভাব এখনো আমাদের জীবনে ও জনজীবনে প্রভাববিস্তারকারী। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এখনকার বিশ্বায়িত সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের মৃতপ্রায় আধুনিকতার সংমিশ্রণ। মৃতপ্রায় আধুনিকতার সমস্যাটি আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু বা মধ্যভাগে ছিল না (এই যে বললেন আধুনিকতা শিকড় থেকে সরে গেছে বাঙালি সেই উনিশ শতকেই?)। ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে ইংরেজি শিক্ষার ফলে যুগযুগান্তের মোহনিদ্রা যেমন দূর হয়েছিল, তেমন নতুন মোহাচ্ছন্ন অবস্থারও সৃষ্টি করেছিল (প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, রেফারেন্স?)। ধরনে আলাদা হলেও বিষয়ে তাই সেই যুগের সন্ধিক্ষণের সঙ্গে এ যুগের সন্ধিক্ষণের একটি সম্পর্ক তো আছেই।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর এ হেন অবস্থায় রাজনৈতিক আত্মবিকাশের পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের জন্য তথা আত্মবিশ্বস্ত আত্মবিকাশের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থিক সাহায্যে ও নবগোপাল মিত্রের সম্পাদনায় দি ন্যাশনাল পেপার সাপ্তাহিকটি ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হলে রাজনারায়ণ তাঁর ভাবনাকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য ওই পত্রিকায় যে প্রবন্ধটি লেখেন তা পরে পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয় ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় পুন:-প্রকাশিত হয়। তা থেকেই হিন্দুমেলার জন্ম। ১২৭৩ বঙ্গাব্দে চৈত্রমাসে যে বাত্সরিক মেলাটির প্রবর্তন হয়েছিল, তা-ই জাতীয় মেলা বা হিন্দুমেলা নামে পরিচিত। স্বদেশানুরাগের উন্মেষ ও বৃদ্ধির জন্য রাজনারায়ণ বসু, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সংঘবদ্ধ প্রয়াস চালু করেন তারই প্রকাশ ঘটে ১৮৬৫ সালের ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল পেপারে যার সম্পাদকীয় ভার অর্পিত হয় নবগোপাল মিত্রের উপর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নবগোপাল মিত্রের ভাবনা অনুসারে হিন্দুমেলা তথা জাতীয় মেলা সংস্থাপনের জন্য সহায় হন। ত্রক্রমে এই কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনোমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতি প্রখ্যাত মনীষীরা।

    হিন্দুমেলার বিভিন্ন অধিবেশনের বৃত্তান্ত পড়লেই বোঝা যায় কেবলমাত্র মেলা বা সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ঘটনাই না, সেখানে আলোচিত হত এমন অনেক বিষয়, যেগুলির মাধ্যমে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পায়। যদিও বালগঙ্গাধর তিলককে বলা রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অনুসারে এই মেলা প্রকৃতার্থে বাঙালি তথা ভারতীয় মানসকে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত করতে পারলো না তার কারণ তাহা এই দেশীয় হইলেও এই কথা ভুলিলে চলিবে না, আমাদের দেশে বহু মুসলমান আছেন। তাঁহাদের তো পাওয়া চাই। তাই দেশীয় অথচ সর্ব সম্প্রদায়ের গ্রহণযোগ্য পথ হওয়া চাই। রবীন্দ্রনাথের এই অভীপ্সা থাকা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে হিন্দু মেলার অধিবেশনের বৃত্তান্ত পড়লেও একথা বোঝা যায় না কেন এই মেলা শেষপর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। তবু তালপাতা থেকে প্রকাশিত হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত পড়তে পড়তে আমরা সেই পর্যায়ের ইতিহাসের দিকে আমাদের চোখ রাখতে পারি। আপামর বাংলা সংস্কৃতির একটা যাত্রা ও চরিত্র আছে, যা থেকে আমরা বাঙালির চরিত্র অনুসন্ধানেও রত হতে পারি এই গ্রন্থ থেকে। আজ এক আত্মপরিচয়ের সন্ধিক্ষণে আমরাও দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমাদের নিজস্ব অতীতের দিকে তথ্য ও ঐতিহাসিক বিবরণীসহ অবলোকনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মনে হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল-এর হিন্দুমেলা সংক্রান্ত বিবরণী এবং শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়-এর সংযোজনায় এই গ্রন্থটি পুন:প্রকাশের প্রাক্কথনে ইন্দ্রজিৎ চৌধুরীর বিভাবরূপী (ঠিক মানে কি?) গদ্য এই গ্রন্থে আজকের বাঙালির প্রবেশের কারণ বিশ্লেষণ করে। (কী কারণ? এক উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে বাঙালির স্বদেশচিন্তার গতিপ্রকৃতির উপর অনুসন্ধিত্সা ছাড়া আর কিছু তো চোখে পড়লো না?) বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে এই গ্রন্থ ইতিহাসের এক দলিল হিসেবে আমাদের মধ্যে থাকবে। অসম্পূর্ণতার জায়গাটি বেশ রহস্যাবৃত, কারণ হিন্দুমেলার সমাপ্তির কারণ অনুধাবন করা গেল না। হয়তো উপযুক্ত তথ্যের অভাব। কিন্তু হিন্দুমেলা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ইতিহাসের অনুসন্ধান সম্পর্কে (কৌতূহল?) এই গ্রন্থ আমাদের উস্কে দিয়ে যায়।


    ॥ ২ ॥


    গদ্যসমগ্র (প্রথম খণ্ড) , অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রতিভাস, কলকাতা ; ISBN : নেই

    অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর কবিতার মাধ্যমে আমাদের বহুদিন ধরেই সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর কবিতার বহুস্তরীয় ভাবনার প্রেক্ষাপটে রয়েছে প্রজ্ঞার বিস্তার এবং বিশ্ব তথা ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে আণুবীক্ষণিক পাঠের অভিজ্ঞতা। একজন কবিকে কেবল তাঁর কবিতার মাধ্যমেই নয়, ধরতে হয় তাঁর কাব্যভাবনার ইতিহাস থেকেও। এই চর্চাটি তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ দশকে যেভাবে ছিল, সেভাবে তার পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে আর দেখা গেল না। প্রথাগত পাঠ-অভিজ্ঞতার বাইরে সাহিত্যের ইতিহাসের ভিতর থেকে আমাদের সাহিত্যকে পুনরায় আবিষ্কারের মাধ্যমে যে নিজস্ব ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ ঘটে, (কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস পাঠের ফলে কোন কোন কবির কীভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয়েছে? উদাহরণ ?) তা পরবর্তীকালের বাংলা কবিদের যাপন থেকে হারিয়ে যায়। এর কারণ যদি ধরি অ্যাকাডেমিক অচলায়তনগুলিকে তেমনই সেই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাহিত্যকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস ও প্রজ্ঞার অভাবকেও। শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমাদের কাছে এখনো সেও ঐতিহ্যকে পুনরায় নিয়ে আসেন আর আমরা ত্রক্রমশ সমৃদ্ধ হই তাঁদের সাহিত্য ভাবনার ব্যক্তিত্ব দ্বারা। টি. এস. এলিয়ট তাঁর ট্র্যাডিশন অ্যাণ্ড ইণ্ডিভিজুআল ট্যালেন্ট গ্রন্থে লিখেছেন : No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone; you must set him, for contrast and comparison, among the dead. I mean this as a principle of aesthetic, not merely historical, criticism. The necessity that he shall conform, that he shall cohere, is not one-sided; what happens when a new work of art is created is something that happens simultaneously to all the works of art which preceded it. The existing monuments form an ideal order among themselves, which is modified by the introduction of the new (the really new) work of art among them. The existing order is complete before the new work arrives; for order to persist after the supervention of novelty, the whole existing order must be, if ever so slightly, altered; and so the relations, proportions, values of each work of art toward the wholw are readjusted; and this is conformity between the old and the new. Whoever has approved this idea of order, of the form of European, of English literature, will not find it preposterous that the past should be altered by the present as much as the present is directed by the past. And the poet who is aware of this will be aware of great difficulties and responsibilities. অনেকটা এই জায়গা থেকেই কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের গদ্যগুলি বাংলা সাহিত্যের এক পরম সম্পদের বিষয়। প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত তাঁর গদ্যসংগ্রহ আমাদের কাছে সেই সম্পদকে নিয়ে আসে, যার প্রভাবে আমাদের সাহিত্য-চিন্তন প্রভাবিত হতে বাধ্য। গদ্যসংগ্রহের প্রথম খণ্ডে রয়েছে অলোকরঞ্জনের বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য, শিল্পিত স্বভাব, স্থির বিষয়ের দিকে - এই তিনটি গ্রন্থের পুন:প্রকাশ। বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য গ্রন্থটিতে কবি আদি ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক আলেখ্য এঁকেছেন, যেখানে মাতৃভাষা ও লিরিকের জন্ম, অন্ত্যমিলের জন্ম, লোকযান, লোকত্রাণ ও লোকপুরাণ, উত্তরণ, অবরোহণ ও স্বপ্নপ্রয়াণ, লোকায়তন-প্রভৃতি প্রবন্ধের মাধ্যমে সময় ও চিন্তার সূত্র ধরে নাথ-সাহিত্য থেকে ময়মনসিংহ গীতিকা পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের রূপলেখাগুলি আমাদের কাছে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। বাঙালির মন সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন -"জয়দেব নিখিল ভারতীয় শ্রোতা বা পাঠক খুঁজেছিলেন। এই কারণেই দীক্ষিত ও অদীক্ষিত- এই মিশ্র শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে জনপ্রিয় হবার জন্য তিনি এক নিপুণ মুখচ্ছদ ব্যবহার করেছিলেন। একদিক থেকে তাঁর কবিতা উমাপতি উপাধ্যায়, বিদ্যাপতি প্রভৃতি জীবনরসোজ্জ্বল কবির মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীতে এসে আত্মস্থ হয়েছে, অন্যদিকে তিনি-ই আবার সহজিয়া সম্প্রদায়ের আদিগুরু এবং তার নবরসিকদের অন্যত্ম, বল্লভাচারী সম্প্রদায়ের বল্লভাচার্যের পুত্র বিঠঠলদাসের শৃঙ্গাররসমণ্ডন, শিখদের আদিগ্রন্থ প্রভৃতি নানা ভক্তি-শাখাশ্রিত রচনাকে বিভাবিত করেছেন।" অংশটি এই জন্য উদ্ধৃতির মধ্যে রাখলাম যে এই অংশটির মধ্যে দিয়ে লেখকের বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের লেখার সন্দর্ভটিকে (রেখালেখ্য আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের লেখার সন্দর্ভটিকে---এর মানে কী ---লেখকের লেখার সন্দর্ভ?) স্পষ্ট করা আমার এই আলোচনার একটি উদ্দেশ্য। ঐতিহ্যকে কিভাবে আত্মীকরণ করা যায়, তার উদাহরণ অলোকরঞ্জনের এই গদ্যগুলি। নিজস্ব কাব্যালোকনের জায়গা থেকে কবি এই যুগের কবি ও কবিতাগুলিকে বর্তমান ধারণার প্রেক্ষিতে ধরেছেন। অর্থাৎ আলোচনাগুলিকে কেবলই রেখালেখ্যের ঐতিহাসিক বর্ণনামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি বর্তমানকে নিয়েই আত্তিকরণের দিকে চলে গেছেন। বলা যেতে পারে একধরণের আন্ত:ক্রিয়ার জন্য হচ্ছে এই লেখাগুলিতে। যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমপর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন-"কৃষ্ণকীর্তনে সব সময়েই যে এই সুমিত শিল্পগুণ দেখতে পাওয়া গিয়েছে সে কথা বলা যাবে না, কিন্তু লেখকের কৃতিত্ব প্রধানত সেইখানেই। লেখক সচেতনভাবেই লোকায়ত জীবনের পক্ষ নিয়েছেন, লোকসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সহমর্মিতা সেখানেই। কিন্তু তার দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে তিনি লোকসাহিত্যিক ছিলেন।" বিদ্যাপতির ভাববিশ্বের মধ্যে যে আর্যেতর সমাজের গহন অভীপ্সাগুলি সুন্দরভাবে ধরা পড়েছিল এই আলোচনাও অত্যন্ত সুচারুভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেন তিনি, যেমন তুলে ধরেন সপ্তদশ শতাব্দীতে হিন্দু-মুসলমান যুগ্ম সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত বৈষ্ণব ভাবাপন্ন ঔদার্যগুণই চোখে পড়ে না, এক বিশেষ ধরণের কাব্যগুণও ধরা পড়ে, সেখান থেকে আমরা আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যের মধ্যে নিহিত আধুনিকতার নিজস্ব অভিযাত্রার রাস্তাও পেয়ে যাই।

    এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশ - শিল্পিত স্বভাব -এ আমরা পাই বিভিন্ন সময়ের বিশ্ব ও ভারতের বিভিন্ন ধ্রুপদী, মধ্যযুগীয় আধুনিক (?) কবি, শিল্পী ও গদ্যকারের সম্পর্কে লেখকের কাব্যিক অবলোকন (কাব্যিক অবলোকন মানে? প্রবন্ধগুলি কি কবিতা-ধর্মী গদ্যে লেখা?)। যেমন দান্তে ও আমাদের আত্মপ্রতিকৃতি প্রবন্ধে অতুলনীয় গদ্যে আমাদের সাহিত্য কিভাবে একটা সময়ে দান্তের সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তার শিল্পিত (?) বর্ণনা আমরা পাই। উনিশ শতকে বাংলার সাহিত্যের আবহে দান্তের আবির্ভাব প্রকাশ্যে প্রবলরূপে অভিনন্দিত না হলেও মধুসূদনের প্রতিভার দ্বীপ্তিতে মিল্টন ও দান্তের প্রভাবের তুলনামূলক আলোচনা এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে দান্তের অসীম গুরুত্বের বিষয়টি লেখক তুলনামূলক আলোচনায় এবং তথ্য ও কাব্যিক নীরিক্ষায় তুলে আনেন। দান্তে সম্পর্কে জীবনানন্দ পর্যন্ত ভাবনার ত্রক্রমবিবর্তনটি কবির আলোচনায় উঠে আসে। একই কথা প্রযোজ্য শেক্সপীয়র ও আধুনিক বাংলা কাব্যজিজ্ঞাসা সংক্রান্ত আলোচনার প্রেক্ষিতেও। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ব্লেকের স্বভাব ও কবিস্বভাব প্রবন্ধটি, যেখানে লেখক লিখেছেন -"ব্লেকের বিষয় হলো সমগ্র মানুষ, সম্পূর্ণ মানুষ। তার জন্য, তার প্রাণময় ও মৃত্যুময় জীবন এবং পুনর্জন্ম। মানুষের বিনি:শেষ ধাতুরূপ ও ঈপ্সিত শিল্পরূপের মধ্যে অননূদিত দূরত্বের যন্ত্রণা ও মানবিকতার পুনর্বিচার - ব্লেকের স্থায়ী বেদনা এখানেই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে।" স্বল্প শব্দে ব্লেকের এভাবে মূল্যায়ন সত্যিই অভিনব। উপেন্দ্রকিশোর, আলোর ফুলকি ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য প্রভৃতি প্রবন্ধে লেখক বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিত থেকে আলোচনা করেছেন এঁদের লেখার।

    "শেষপর্যন্ত, অনুবাদের লক্ষ - রবীন্দ্রনাথের কাছে - নিছক ভাব পরিবহন নয়, রূপের একটি পাত্র রচনা; যা ভাবকে আশ্রয় দেবে, প্রশ্রয় দেবে না"-------- লিখছেন লেখক কবিতার অনুবাদ ও রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে। ভিক্টর হুগো থেকে টেনিসন পর্যন্ত যাঁদের কবিতা রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন এবং যাঁদের কবিতা তিনি অনুবাদে প্রবৃত্ত হননি, সেই বীক্ষার (?) ভাবনায় গিয়ে অলোকরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের কেন্দ্রীয় ভাবনায় প্রবেশ করেছেন। এভাবে আমরা রবীন্দ্রনাথের কাব্যব্যক্তিত্বের অন্দরমহলেও প্রবেশ করতে পারি। এর সঙ্গে যে বিষয়টি উল্লেখনীয়, সেটি হলো, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে অনুবাদক্রিয়াও তাঁর লিখনে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

    শিল্পিত স্বভাব এবং বাংলাসাহিত্যের রেখালেখ্য অংশগুলিতে ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিত্বের স্বরূপ যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি স্থির বিষয়ের দিকে অংশটিতে ফুটে ওঠে কবির পাঠ-প্রতিক্রিয়ার অবিস্মরণীয় কিছু অধ্যায়। এই অংশে "যুদ্ধ, যুগমুহূর্ত ও আমরা" প্রবন্ধে (বইতে এই অংশে তো এই নামের কোনো প্রবন্ধই দেখতে পেলাম না?! ) কবি তাঁর আত্মার আকুতি লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিকের এক আন্ত:ক্রিয়ার আঙ্গিকে। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখছেন অভিপ্রায়ের দ্বৈতত্ব নিপুণভাবে রক্ষা করার জন্য কবিকে যেকোন অভিসন্ধিমূলক জায়গায় যেতেই হয়। তিনি বলছেন - এই ছদ্মবেশ এই দিক থেকে মন্দের ভালো, যে টিকে থাকাটাই যেখানে সমস্যা সেক্ষেত্রে চালাকি করে - যেন কিছুই হয়নি, এই ভঙ্গিতে - বেঁচে থাকা এর দ্বারা সম্ভব; কিন্তু এই চাতুর্য, পক্ষান্তরে, আত্মঘ্ন। সুন্দরের তপস্যার কোন শর্ত নেই। এবং দ্বিতীয় সুন্দরকেও সুন্দর বলা চলে না। তাছাড়া, মনুষ্যত্বের অবমাননা থেকে সুন্দর যদি জন্ম নেয়ও, সেই সুন্দর বিকলাঙ্গ। এই পর্যায়েই আমরা পাই আধুনিকতা : একটি প্রস্তাব, জীবনানন্দের একটি স্বদেশ, সুধীন্দ্রনাথের মন, সুধীন্দ্রনাথের হাইনে, প্রাচী ও রিলকের ঋণ, অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা, প্রভৃতি হৃদয়কে উদ্বেলিত করা প্রবন্ধ। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে সন্দর্ভ-এ আমরা যে বীক্ষণের মুখোমুখি হই, সেখানে আমাদের সামনে আশা জাগে এই ভেবে যে কবি আধুনিকতার যে স্বপ্ন দেখেছেন তার পথ ধরে এমন একটা পর্যায় আসুক যেখানে আমরা বলতে পারব - কবি সকল সময়েই তাঁর পাঠকের থেকে বড়ো, কিন্তু ভবিষ্যতের পাঠক এবং যথার্থ আধুনিক নি:সন্দেহে সমান মর্যাদাসম্পন্ন। এই মুহূর্তে পরিসংখ্যাতীত যে কবি জনতা দেখা দিয়েছেন তাঁদের অনেকেই কবিতা পড়বার অভ্যাস আয়ত্ত করে নেওয়ার জন্য কবিতা লিখতে এসেছেন। সময়ের অনিবার্য প্রবর্তনায় এঁরা যখন শমিত হবেন, ভবিষ্যতের পাঠকের আবির্ভাবলগ্ন ত্বরান্বিত হবে। আধুনিক কবিতার আধুনিক লেবেলটি খারিজ করে দিলে কিছুটা উত্তেজনা শান্ত হতে পারে। অত:পর আধুনিক কবিতা বলতে আর সেই শিল্প ঘটনা বুঝব যা ইতিমধ্যে চিরায়ত কবিতার অন্তর্গত হয়ে গেছে।


    (পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)