![]() |
বহুদিন বাদে এমন একটি বই হাতে এলো যাতে মগ্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না । বইটি উপন্যাস নয়, কবিতা নয়, প্রথাগত অর্থে প্রবন্ধ সংকলনও নয় : বুদ্ধদেব বসুর অস্বাক্ষরিত রচনা সংগ্রহ, কবিতা পত্রিকার প্রায় অনাদৃত, অনবলোকিত পৃষ্ঠাগুলির তন্নিষ্ঠ গ্রন্থন এটি, যা তার প্রাথমিক থেকে প্রত্যন্ত অংশ পর্যন্ত আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে দিলো না ।
অথচ পড়তে শুরু ক'রেছিলাম প্রায় নির্বিকল্প অবহেলায় । নিতান্ত নির্বোধের মতো ভেবেছিলাম : কী প্রত্নখনির সন্ধান দিতে পারে এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংলগ্ন, অবহেলিত রচনা সংগ্রহ ? ভেবেছিলাম ঠিক ডাহা আহম্মকের মতো । আমার এই মূঢ়তা খণ্ডন করতে বুদ্ধদেবের একটি কি দুটি নিবন্ধের বেশি প্রয়োজন হলো না : আমার চোখের সামনে তখন বঙ্গলিপির ক্যালাইডোস্কোপে ঘটে চলেছে দৃশ্য এবং দৃশ্যান্তর । কবিতা পত্রিকার নজরুল সংখ্যা প্রকাশিত হয়, ছন্দপতন ঘটে বিষ্ণু দে'র কবিতায়, কাস্তে কবি দিনেশ দাসের আরো রচনা দেখার জন্য উত্সুক থাকেন বুদ্ধদেব, জীবনানন্দের নাগরিক মেটামরফসিস তিরস্কৃত হয় তাঁর কলমে, একদা পরিচিত তথা অধুনা বিস্মৃত সুনীল চন্দ্র সরকারের ঘোড়া শব্দের `ঘোঁড়া' বানান সংগত কারণেই তাঁকে মর্মাহত করে । জানিনা সাম্প্রতিক বাংলা সংবাদ মাধ্যমের `সন্দেহের তির' জাতীয় বহুল প্রচলিত বাক্যবন্ধগুলি বুদ্ধদেব বসুর কোন মর্মে আঘাত করতো ।
একজন কবি লিখে যান শুধু কবিতার কাছে বিশ্বস্ত থেকে । যে কারণে আমি অবনত শিরে বুদ্ধদেব বসুকে সম্মান করি, সেই একই কারণে নাগরিক জীবনানন্দের কবিতা স্রেফ `রোম-বার্লিন' দেখানোর অপচেষ্টা, বুদ্ধদেবের এই অভিমত আমাকে ব্যথিত করে । কেননা, লঘুমুহূর্তের ধোপা আর গাধা শেষ পর্যন্ত যে দেশে পৌঁছয়, আজ পর্যন্ত তা অনধিগম্য থেকে গেছে যে কোনো বঙ্গভাষী কবির কাছে । সঙ্গত কারণেই বিষ্ণু দে'র কবিতার ছন্দপতনের সবকটি নিদর্শন আমি ন্যায্য বলে মানতে পারি না, কয়েকটি উদাহরণ অতি অবশ্যই যথার্থ । ছন্দের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শঙ্খ ঘোষের মতো কান পাতলে বিষ্ণু দে'র ঘোড়সওয়ারে আমিও শুনতে পাই অশ্বক্ষুরধ্বনি । বুদ্ধদেব ছন্দের কদর জানতেন । তাই, বিষ্ণু দে'র আপাদমস্তক রাজনৈতিক `মহিমা' কবিতাটি সম্পর্কে নির্দ্বিধায় তাঁর উল্লেখ করতে বাধেনি `কোনো সনেটের এরকম নিখুঁত ষট্পদী বাংলাভাষায় খুব বেশী পাওয়া যাবেনা ।' বুদ্ধদেবের সমালোচনার সততা আমাদের তাই গর্বিত করে : ক্ষেত্রবিশেষে মতামতের ভিন্নতা বা দ্বৈরথেও কবিতার বিশুদ্ধির প্রতি এক অমোঘ বিশ্বাসে তিনি স্থিত । সুকান্ত ভট্টাচার্য বিষয়ক তাঁর মর্মস্পর্শী লেখাটি আমাকে তাই বারবার পড়তে হয় ।
আরও অজস্র উদাহরণে ভারাক্রান্ত করা যেতো এ নিবন্ধ । আপাতত: সে প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম । শুধু বলি, বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে এই বইটি উপস্থিত করে দময়ন্তী বসু সিং আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করলেন । তাঁর আত্যন্তিক নিষ্ঠার ছাপ এ কেতাবের সর্বাঙ্গে । হে পাঠক, কবিতাকে আমরা যারা `রক্তচলাচলের মত সত্য' বলে জেনেছি এই গ্রন্থ প্রিয় হোক তাদের সবার কাছে ।
পুনশ্চ : আলোচ্য গ্রন্থটির আরো দুটি খণ্ড আশু প্রকাশিতব্য, যাতে বুদ্ধদেব বসুর পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রবীন্দ্রবিষয়ক রচনাগুলি ও এ-পর্যন্ত অগ্রন্থিত তাঁর বিদেশী সাহিত্য বিষয়ক ও অন্যান্য প্রবন্ধের সুসংহত আত্মপ্রকাশ আশা করা যায় । এই তিন খণ্ড রত্ন ভাণ্ডারের একটি সামগ্রিক আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো, বাংলা সাহিত্যের একজন একলব্য পাঠক হিসেবে : গাণ্ডীব টঙ্কারের কলস্বর স্তব্ধ হলে পরে যাদের ভীরু কন্ঠস্বর শ্রুতিগোচর হয়ে ওঠে ।
(পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)