উনিশ'শ বেয়াল্লিশ । আগস্ট বিপ্লবের রক্তঝরা দিনগুলি ।
সারা ভারতের আকাশে যেন আগুন লেগেছে । `ডু অর ডাই', `করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' । আসমুদ্র হিমাচল শুধু ওই রব । বীর শহীদদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে মাটি ।
বাংলার অখ্যাত এক গ্রাম । স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ নির্জন পল্লী অঞ্চলেও এসে হানা দিয়েছে । শান্ত পরিবেশ হয়ে উঠেছে অশান্ত । এমনই এক সকালে রতন বৈরাগী তার একতারা বাজিয়ে মেঠো পথ ধরে গান গাইতে গাইতে চলেছিল । মুখে মুখেই গান বাঁধে সে, নিজেই সুর দেয় ।
রতন বৈরাগীকে এ অঞ্চলের ছেলে-বুড়ো সবাই চেনে । তার হাসিমাখানো আর মিষ্টি গলার জন্য সবার সে প্রিয় । সব বাড়িতেই তার অবারিত দ্বার । গৃহস্থের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে মিষ্টি হেসে বলে, `জয় রাধে', তারপর একতারায় টুং-টাং আওয়াজ তুলে গান ধরে ।
রতন বৈরাগী শুধু গান গেয়ে ভিক্ষে করে না, লোকের বিপদে-আপদে সে বুক আগলে দাঁড়ায় । কত দু:খী সংসারের যে সে সহায়, তার হিসেব নেই ।
গাঁয়ের সীমানায় নিজের হাতে বানানো ছোট্ট একটা খড়ের চালার ঘরে তার ডেরা । একা মানুষ, কোনো ঝঞ্ঝাট নেই । সারাদিন সে গান গেয়ে ভিক্ষে করে, আর দিনান্তে চাল, ডাল, তরি-তরকারি একসঙ্গে ফুটিয়ে নেয় । একবেলাই সে খায় । রাঁধতে রাঁধতে সে গান ধরে -
সন্সারে যদি রইলো মন
কি ফল তবে ক'রে ভোমন
গয়া, কাশী, বিন্দেবন ।
কিছুদিন ধরেই রতন গাঁয়ে একটা চাপা অশান্তি লক্ষ্য করছিল । নবীন মাস্টারের বাড়িতে সাঁঝের আঁধারে ছেলেরা সব আসে । ফিসফাস কথাবার্তা হয় । যতদিন যায়, একটা চাপা অসন্তোষ যেন ধূমায়িত হয়ে ওঠে । কচি কচি সব ছেলে, তাদের চোখে মুখে যেন আগুনের ঝলক । দেশের হালচাল যেন রাতারাতি বদলে গেছে । কি যে ওরা চায়, ভালো করে বুঝতে পারে না রতন । সে উদাস ভরে গেয়ে ওঠে -
আমি চাইনে সোনা চাইনে ধন,
সাত রাজার মাণিক রতন -
যদি পাই হরির ছি চরণ ।
দিন আসে দিন যায় । গাঁয়ের ছেলেরা দলে দলে শহরে যাচ্ছে, দু'চার দিন পরেই আবার তারা ফিরে আসে । ওরা যে শহরে বেড়াতে যায় না, তা সরল মানুষ রতনেরও বুঝতে কষ্ট হয় না । শহর থেকে যে সব সাঙ্ঘাতিক ঘটনার টুকরো টুকরো কথা তার কানে ভেসে আসে, তা থেকেই সে বোঝে শহরে আগুন লেগেছে, আর সে আগুনের শিখা ত্রক্রমেই এগিয়ে আসছে গাঁয়ের দিকে । নবীন মাস্টারের বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত শলা-পরামর্শ চলে । অন্ধকারে তার দাওয়ায় বসে রতন গুনগুন করে গান গায় -
হরি তোমার এ কি লীলা
ছেলে বুড়ো সবাই মিলে
আগুন খেলায় মেতেছে -
দেখে কাণ্ডকারখানা
ভয়ে আমি আধখানা
দিনে দিনে এ কি হতেছে !
এর মধ্যে একদিন গাঁয়ের সীমানায় পুলিশের তাঁবু পড়ল । গাঁয়ের লোক সাবধান হয়ে গেল । এ অঞ্চলের ওপর যে পুলিশের বিষ নজর পড়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । পুলিশ কয়েকটা বাড়ি তল্লাশ করল, দু'চারজনকে ধরেও নিয়ে গেল । রতন বৈরাগী কিন্তু আগের মতই পথে পথে গান গায়, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে বেড়ায় । তবে আজকাল লোকজন কেমন যেন হয়ে গেছে । রতনের মনে বড় দু:খ হয় । তাকেও যেন এড়িয়ে চলছে গাঁয়ের মানুষ ।
পুলিশের তাঁবুতেও রতন যায় । সেখানে গিয়ে গান ধরে -
আমি সব কিছু দেখি বেসজ্জন
ভোগ বিলাস করেছি বজ্জন ।
যদি পাই হরির দয়ার কণা -
তবে আর কিছু আমি চাইব না ।
তার গান শুনে সেপাইরা খুশি হয় । তার সঙ্গে তারা মন খুলে কথা বলে, গাঁয়ের খবর জানতে চায় । রতন উত্তরে শুধু হাসে, তারপর গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে -
লহ মন হরিনাম, ভজ মন হরি রে
সেই নাম লয়ে যেন সুখে আমি মরি রে ।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে ছিল, বিকেলের দিকে চেপে নামল বৃষ্টি । নবীন মাস্টারের বাড়ির চারদিক ঘুটঘুট্টে অন্ধকার । শুধু একটা বন্ধ ঘরে টিমটিম করে একটা লন্ঠন জ্বলছে । সেই অল্প আলো ঘিরে অনেক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে, অনেকগুলো উত্সুক মুখ নবীন মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । নবীন মাস্টার চাপা গলায় কি সব নির্দেশ দিচ্ছেন । হঠাৎ দরজায় তিন বার টোকা পড়ল । মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল সবাই । একজন দরজা খুলে দিতেই একটি কিশোর বলল, বাড়ির চারপাশে একজন লোক সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল, তাকে তারা ধরে ফেলেছে । লোকটি আর কেউ নয়, রতন বৈরাগী ।
নবীন মাস্টার বিস্মিত হলেন - রতনকে তিনি ভালোমতোই চেনেন । সে কি মতলবে বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল ! পুলিশের তাঁবুতে যে তার যাতায়াত আছে, তাও তিনি জানেন । তবে কি সে পুলিশের গুপ্তচর হয়েছে !
নবীন মাস্টারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল । তিনি রতনকে ভেতরে আনতে বললেন । তাকে আনা হলো । তার দু'হাত পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা । মুখে কিন্তু মিষ্টি হাসিটুকু লেগে রয়েছে ।
রতন ঘরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে চারদিকে একবার চোখ বুলালো, তারপর নবীন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠল, `ম্যাস্টরবাবু, আপনারা সব পাইলে যান, পুলিশ আপনার বাড়ি ঘিইরে ফেলাবে, সবারে ধইরে নে যাবে ।'
নবীন মাস্টার চমকে উঠলেন; রতন কোথা থেকে এ খবর পেল, জানতে চাইলেন । রতন বলল, আজ সে পুলিশ-তাঁবুতে গান শোনাতে গিয়েছিল । সেখানে একটা সাজ সাজ রব চোখে পড়ে । দু'চারটে কথা থেকে সে বুঝতে পারে, আজ রাতেই পুলিশের দল নবীন মাস্টারের বাড়ি ঘেরাও করবে, যাদের পাবে, ধরে নিয়ে যাবে । এই খবরটা দিতেই সে এসেছে ।
নবীন মাস্টার নিজের হাতে রতনের বাঁধন খুলে দিলেন, তারপর দুহাত চেপে ধরে বললেন, `আমাদের তুমি ক্ষমা কর রতন, আজ তুমি যে কাজ করলে, তা দেশের কাজ ।'
পুলিশবাহিনী যখন নবীন মাস্টারের বাড়ি হানা দিল, তখন সে বাড়ি ফাঁকা । ব্যর্থ হয়ে তারা ফিরে গেল । তাদের কাছে খবর ছিল, ওই রাত্রে নবীন মাস্টারের বাড়িতে স্বদেশীদের গোপন বৈঠক হবে । নিশ্চয়ই কেউ তাদের সাবধান করে দিয়েছে । কে সে ?
রতন বৈরাগী সকালেই তাঁবুতে এসেছিল । রতনের ওপরেই সন্দেহ হলো পুলিশের । পরদিন ভোর না হতেই তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে তাঁবুতে আনা হলো । তাকে যতই জিজ্ঞাসা করা হয়, সে হাসিমুখে ঘাড় নাড়ে, না, সে কিছু জানে না । অনেক লোভ দেখানো হলো, কিন্তু রতনের সেই এক জবাব । তখন পুলিশের জমাদার তাকে মারের ভয় দেখাল । রতন হেসে গান ধরল -
আমায় মারো ধরো, যা খুশি করো
আমি হরিচরণ নিয়েছি শরণ -
মরণে ভয় আমি করিনে বড়ো ।
পুলিশ শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে তাকে ছেড়ে দিল । ছাড়া পেয়ে রতন বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন বেলা পড়ে এসেছে । সারাদিন তার মুখে জল পর্যন্ত পড়েনি, কিন্তু এক অপূর্ব আনন্দে ভরে উঠেছে তার মন । মাস্টারবাবু বলেছেন, সে দেশের কাজ করেছে । মিথ্যের আশ্রয় সে নিয়েছে সত্যি, কিন্তু তা ভালোর জন্যে, তাতে পাপ হয় না । ঘরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে গেয়ে উঠল -
সকাল গেল, সন্ঝে হলো
মন পাখি তুমি হরিনাম বলো ।
ও নাম বিনে সুখ নাই আর
হরি বিনে মিছে ভব সন্সার ।
(পরবাস - ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০ )