॥ ১ ॥
পিছনে ফিরে দেখি মোট-বওয়া কুলির দঙ্গল থেকে এক বছর দশেকের বালক আমার দিকে আঙুল তুলে খিক্ খিক্ করে হাসছে, যেন মস্ত মজার কিছু একটা ঘটনা ঘটে গেছে । আমি একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকালুম ওর দিকে । আমাকেই বারণ করছে নাকি সামনের স্টেশনারি দোকানটায় ঢুকতে ? আমাকেই ? কেন ? দোকানটার ভিতরে কোনো গণ্ডগোল আছে নাকি ?
অচেনা নেপালি বালকটির কথায় আমল দেবার কোনো কারণ নেই । শেভিং ব্লেড ফুরিয়েছে । কিনতেই হবে । দোকানটার দিকে দু'-কদম এগিয়ে সিঁড়িতে পা রেখেছি । আচমকা মাথার ওপর গরম-গরম তরল কী যেন.....! যাচ্ছেতাই ! দোকানটার বাইরের শেডে একটা কাক বসেছিল । অপকর্মটির হোতা সে-ই । উ: ম্যাগো ! কী দুর্গন্ধ ! আর ঠিক এমন জায়গায় এসে পড়েছে--- আমার সামনের চুল, চশমার কাঁচ, নাকের ডগা থেকে মায় নোতুন কেনা কালো ব্লেজারটি পর্যন্ত সাদাটে রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেল গো ! দেখতে নিশ্চয় বড্ড খোলতাই হয়েছে । কারণ আচমকা আমার এই নোতুন রূপ দেখে চারপাশের লোকজনও খুক্খুকে হাসতে শুরু করেছে --- অনেকটা, রাস্তায় হঠাৎ এক মস্ত মোটা লোক কলার খোসায় পা-পিছলে পড়লে যেমন লোকে হাসে ।
পুরো ঘটনাটা ঘটে যেতে দেড় মিনিটও লাগেনি । ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলুম । কী নাজেহাল ! কোথ্থেকে এক উটকো কাগ এসে, এতো স্থান থাকতে, ঠিক আমার মস্তকেই যে প্রাত:কালীন কোষ্ঠটি সাফ করবে --- কে জানত ? কী বিড়ম্বনা বলতো ?! দোকানের বাইরে সামনের মেঝেতে হাবিজাবি জিনিসের পশারি বুড়িটি দূরে আঙুল দিয়ে ট্যাপকল দেখিয়ে বলল, "উঁহা পানি হ্যায়, বাবু, ধো লো ।"
আর "ধো লো" । আমি তখন তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে স্নান করে বেশবাস বদলে নিতে পারলে বাঁচি ।
গ্যাংটকের নোতুন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে সফল বিজনেস-ডিল সেরে কালিম্পঙে দু'টো দিন স্রেফ ছুটি কাটাতে এসেছিলাম আমরা, মানে আমি পার্থসারথি মল্লিক ও শ্রীমান সুমিত চট্টরাজ, আমার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসার পার্টনার । দার্জিলিং-এ এতোবার যাওয়া হয়, কাছেই কালিম্পং -এ কোনোবার আসা হয়না সময়াভাবে । এবার তাই ঠিকই করে রেখেছিলুম, দার্জিলিং-এর ভিড়ভাড় নয় । বে-সিজন বর্ষায় কালিম্পং-এই দুটো দিন আমারা যাবো হাঁফ ছাড়তে ।
এসেই বুঝেছি, ভুল করিনি মোটেই । অপূর্ব সুন্দর ছোট্ট শহর কালিম্পং । গাছপালায় ভরা, সবুজ । এ'পাশে দেলো আর ও'পাশে দার্পিন পাহাড় । ছোট্ট ছোট্ট নেপালি ছেলেমেয়েরা য়ুনিফর্ম পরে ইস্কুল যাচ্ছে, আমাদের দেখে হাত নেড়ে টা-টা করল । ঘনিষ্ঠ মানুষজন ।
সকালের ওই কাণ্ডের পর হোটেলের ঘরে ফিরে আর বেরোইনি । বিকেলেও ব্যালকনিতে বসে আমায় একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোতে দেখে সুমিত অধৈর্যে বলে উঠল, "কি রে, সারাদিন ঘরে বসে ম্যাগাজিন পড়বি বলেই কি গঁযাটের কড়ি খরচা করে বেড়াতে এসেছিস নাকি ? চ', একটু হেঁটে আসি ।"
যুক্তির কথা । অতএব বেরোলুম । সুমিতের মেজাজটা আজ একটু বেশিই খিঁচ্ড়ে আছে । শেয়ারবাজারে আজ ভালোই লোকসান করেছে, মনে হয় । পাক্কা ফাটকাবাজ । বেড়াতে এসেও সকাল থেকে টিভির ইনভেস্টমেন্ট চ্যানেলে চোখ রেখে বসে থাকবে, আর হরবখত চলেছে মোবাইলে ব্রোকারকে শেয়ার কেনাবেচার নির্দেশ দেওয়া ও এস এম এসের বন্যা ।
বিকেল থেকে সন্ধে-হয়ে-আসা-আসা সময়ে নির্জন পথ বেয়ে ভুতুড়ে মর্গান হাউজ পরিয়ে অচেনা পাহাড় চুড়োর দিকে হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য এ'সব কথা আর মনে ছিল না । গাছপালা-নির্জনতার এইটাই মাহাত্ম্য, মনটাকে ছোটখাট বিষয় থেকে তুলে নিয়ে আকাশে ছেড়ে দেয় । পথে আমরা দু'জন ছাড়া আর নেইও কেউ । এটা বর্ষার শেষ । পুজোর এখনও দু'-মাস দেরি । তখন অবশ্য এখানে তিলধারণের জায়গা থাকে না ।
আমরা বোধ হয় অন্যমনস্কতায় মূল সড়ক ছেড়ে তার এক শাখা বেয়ে এসে পড়ে ছিলুম । কারণ এ' পথটি সরু এবং আলগা-- শেষ হয়েছে এক সব্জেটে কাঠের বাড়ির সমুখে এসে । চারিভিতে গাছপালা, বোগেনভেলিয়ার ঝোপ । কাঠের বেড়া দেওয়া রয়েছে, "উইকেট" যাকে বলে । চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে মূল বাড়ির দরোজায় ওঠা, তার সামনে এক মলাটে-বারোন্দা । ঢালু ছাদ, তার মাথায় চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে । মানে, শূন্য নয়, এ'বাড়িতে কেউ থাকে । নির্জন, বেশ একটা গা-ছমছমে ভাব । বাড়ির চৌহদ্দিটিও ছোট নয় । ডানধারে একটু এগিয়েই এ'পথের শেষ, একটা খাড়া খাদ নেমে গেছে ।
এবার হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুৎ চমকানিতে সন্ধেটে ঘোর কেটে যেতে সুমিত বলে উঠল, "চ', এবার ফেরা যাক্ । বিষ্টি নামবে, মনে হচ্ছে ।"
"ভয় কী ? ছাতা দুটো কি তবে এমনি বয়ে বয়ে আনলুম নাকি ?" বলি ।
"এই পাহাড়ে-বর্ষা । একবার শুরু হলে ছাতায় আটকাবে ?"
"তা বটে । তবে লাগছে তো বেশ, কী বলিস্ ? নির্জন পাহাড়ে-বর্ষা ,অন্ধকার । এবার টর্চের ব্যাটারিটাও ফুরিয়ে গেলে বেশ হয়, বল্ ? একটা ভুতুড়ে-ভুতুড়ে ভাব ! এডভেঞ্চার !"
"তুই একটা বাচ্চা ছেলে হয়েই রয়ে গেলি, বাপি । ভুতুড়ে-ভুতুড়ে ভাব ! হুঁ : ! চ' ফিরি ।" সুমিত ঘোর সংসারী মানুষ !
হঠাৎ গালে-মাথায় চড়বড় করে ঠাণ্ডা জলের ফোঁটা ! আর দু'-মিনিটের মধ্যে, বলা-নেই-কওয়া-নেই, যাকে বলে, তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল ! আমাদের কথার ফাঁকে কখন যে আকাশে ঘন মেঘ করে এসেছিল খেয়াল করিনি, করলে আগেই ফিরতুম । এটা বৃষ্টির কাল যদিও, তবু সে-বৃষ্টি ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখতে রোমান্টিক লাগে । পথিমধ্যে অসহায় আটকে গেলে আতান্তর ।
হঠাৎ এতো ঝেঁপে এসে গেল বৃষ্টিটা যে ছাতা খুলতে খুলতে আমরা ভিজে একশা ! দৌড়ে গিয়ে সামনের ওই বাড়িটার হাতায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । বৃষ্টিটা ত্রক্রমে বাড়তেই লাগল । চারিদিক ঘুটঘুট্টে অন্ধকার । আমরা মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে হাতঘড়ি দেখছি । আধঘন্টা হতে চলল ।
এমন সময় খুট্ করে ভিতর থেকে দরোজা খোলার শব্দে ফিরে তাকালুম । এক চিনে-লন্ঠন হাতে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন মুণ্ডিতমস্তক কলারহীন-হাফ-হাতা জামা ও লম্বা `ফ্রক' পরা এক বেঁটে খাটো বৃদ্ধ লামা । আর এসেই চিনে-জাপানিদের কায়দায় বারবার সামনের দিকে ঝঁংউকে ঝঁংউকে আমাদের অভিবাদন করতে লাগলেন । আমরাও দু'জনে হাত তুলে তাঁকে প্রতি-নমস্কার জানাই । এবার অচেনা একসেন্টে ইংরিজিতে বললেন ভদ্রলোক, "ওয়েলকাম ! অনেকক্ষণ লক্ষ করেছি, আপনারা গরিবের কুটিরের দ্বারে উপস্থিত হয়েছেন । আপনাদের স্বাগত জানাতে দেরি হয়ে গেল বলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন । আসলে আমি এক জরুরি কাজে ব্যাপৃত ছিলাম কিনা । ঘড়ি ধরে কাজ, তাই মাঝপথে ছেড়ে উঠে আসতে পারিনি । আমি জিগ্মে, দোক্তা পেল্মা জিগ্মে । এই বর্ষার সন্ধ্যায় এক এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না, কী বলুন ? ভিতরে আসতে আজ্ঞা হোক্......... ।"
ক্লাসিকাল ভদ্রতা । আমরাও নিজ নিজ পরিচয় দিতে দিতে অন্দরের বৈঠকখানায় এসে বসলুম । সত্যি বলতে কী, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে গিয়েছিল । বসতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম । সঙ্গে দার্জিলিং টি ! চমত্কার !
সোফায় বসতে বসতে সুমিত জনান্তিকে বলল, "মানুষের নাম আবার দোক্তা-জর্দা হয় এই প্রথম শুনলুম । "পরে, অবশ্য, বুঝেছিলুম এটা ওঁনার উচ্চারণের দোষ । `দোক্তা' নয়, `ডাক্তার' । উনি ডাক্তার, ডক্টর পেল্মা জিগ্মে ।
"আপনারা টুরিস্ট নিশ্চয়ই । কেমন লাগছে আমাদের কালিম্পং শহর ? কবে এসেছেন ?" ডা: জিগ্মের নিছক সময়-কাটানো প্রশ্ন ।
"আমাদের কালিম্পং ? আপনি তিব্বতী নন ?" সুমিতের এ'রকম কেঠো প্রশ্নে মাঝে মাঝেই বিব্রত হই আমি ।
"হে হে হে হে .....। পৈত্রিক সুত্রে তিব্বতী হলেও আমি ভারতেরই নাগরিক । আজ চল্লিশ বছর আছি এই কালিম্পং শহরে । বলছি, দাঁড়ান, আপনাদের সে-গল্প, তার আগে চা হোক্ । ঘেরো......"
ঘেরো ? কোনো মানুষের নাম ? চাকর-বাকর হবে বোধহয় ।
ডাক শুনে ঘরে ঢুকল এক বালক ভৃত্য । ঘরের ম্লান আলোয় আমি চমকে তাকিয়ে দেখলুম এ'-সেই নেপালি বালকটি, যে আজ সকালে কাকের অপকর্মটির ঠিক আগে স্টেশনারি দোকানটায় ঢুকতে আমায় মানা করে ছিল আর মিটিমিটি হেসেছিল । ঘটনাচক্রে আজই এর সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি ।
বিজলি নেই, ঝড়বৃষ্টির কারণে বোধহয় । ঘরের কুলুঙ্গিতে সেই চিনে লন্ঠনখানি এখন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । শিখাটি ওস্কানো । যদিও মস্ত বড় কক্ষটির বারোআনাই তাতে আঁধারে রয়ে গেছে ।
ম্লান আলোয় দেখলুম, সেই নেপালি বালকটির মুখেও পরিচিতির হাসি । চিনতে পেরেছে আমাকে । সকালের ঘটনার খেই ধরে এক ফাঁকে ওকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে, কেন ও' আজ সকালে আমাকে দোকানটায় ঢুকতে বারণ করেছিল আর খুক্খুকে হেসেছিল ?
"ঘেরো", ডা: জিগ্মে এবার এক অচেনা ভাষায় গৃহভৃত্যটিকে কিছু নির্দেশ দিলেন, চা আনতে বোধ হয় । সেও বাধ্য ঘাড় নেড়ে অন্দরে চলে গেল ।
"হঁযা, যে কথা বলছিলাম", খেই ধরে হেসে বলে চলেন ডা: জিগ্মে, "আমরা আদতে ছিলাম ব্রহ্মপুত্রের তীরে তিব্বতের শিগাত্সে শহরের বাসিন্দা । আমরা হলাম গিয়ে বদ্যিবংশ, চোদ্দপুরুষের বৈদ্য । লাসার চকপোরি মেডিক্যাল ইস্কুলে......."
ডা: জিগ্মের বলা শেষ হল না, ঠং করে একটা ধাতব শব্দে আমরা ভিতরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালুম । ঘেরো একখানি মোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল । বোধহয় চৌকাঠে পা বেধে ধাতব বাতিদানটি ছিটকে হাত থেকে পড়ে অন্ধকার হয়ে গেল । সেই অচেনা ভাষায় ডা: জিগ্মে ছেলেটিকে কিছু বললেন, আরও সাবধান হতে বোধহয় ।
আমি সুযোগ খঁংউজছি নেপালি বালকটির সঙ্গে আলাপ করবার । কিন্তু সে-সুযোগ আর হল না । ভদ্রতার চা-পান শেষে বৃষ্টি থামতেই আমরা ডা: জিগ্মেকে ধন্যবাদ জানিয়ে সটান হোটেলের পথে পা-বাড়িয়েছি । রাত তখন ন'টা ।
না, ঘটনার শেষ কিন্তু এখানেও হয়নি !
আসলে, পরে বুঝেছি, তখনও শুরুই হয়নি `ঘটনা'-টা !!
অন্তত:, সে-রকমটাই ঠিক ছিল ।
হঠাৎ উচ্চৈ:স্বরে "মি: মালিক, মি: মালিক" বলে দৌড়তে দৌড়তে সেই কালকের দেখা সেই তিব্বতী লামা-ডাক্তারের প্রবেশ । উদভ্রান্ত বেশবাস, উস্কোখুস্কো চুল । রাতে ঘুমোননি নাকি ?
"আসুন, আসুন, ডা: জিগ্মে । আসুন । কী হয়েছে ? আপনাকে একটু বিভ্রান্ত লাগছে । ভালো আছেন তো ?"
"ও:, মি: মালিক, আই গট য়ু, আই গট য়ু ! জানেন, আজ ভোর হতে-না-হতেই বেরিয়ে পড়েছি । কালিম্পঙের কোনো হোটেল বাকি নেই । সব কটাতেই ঢঁংউড়তে ঢঁংউড়তে আসছি । আসলে, আপনারা কোন্ হোটেলে উঠেছেন, কাল রাতে তো আর সেটা জেনে নেওয়া হয়নি, তাই ...." তাঁর টিপিক্যাল ভাঙা-ভাঙা ইংরিজিতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলেন ডা: জিগ্মে ।
"তা, হলটা কী, ডা: জিগ্মে ? আমাকে হঠাৎ আপনার এতো প্রয়োজন পড়ল কেন ? কাল কিছু ভুলে-টুলে.....।"
"না না, মি: মালিক, কিছু ভুলে-টুলে যাওয়ার বিষয় নয়, বরং মনে-টনে পড়া নিয়েই আমার কারবার ।" এবার একটু লঘুস্বরে বলেন বৃদ্ধ ।
"মনে পড়া নিয়ে আপনার কারবার --- মানে ? কিছুই বুঝলাম না যে", বলি ।
"বুঝবেন, বুঝবেন, মি: মালিক । সে-সব বলতেই তো আজ আমার দৌড়ে আসা আপনার কাছে । আপনি চলে গেলে সব যে মাটি হয়ে যেত । বলছি, বলছি সব আপনাকে । তার আগে আমায় এক গ্লাস জল দিতে পারেন ? দৌড়তে দৌড়তে আসছি । গলাটা ....."
"অবশ্যই, অবশ্যই । আপনাকে কাহিল লাগছে, ডা: জিগ্মে । একটু ব্রাণ্ডি চলতে পারে কি ?" আমি হাত তুলে হোটেলের এক বেয়ারাকে ডাকি ।
"না না, ব্রাণ্ডি না, ব্রাণ্ডি না । কোহলে আরকের প্রভাব নষ্ট হয়ে যায় ।" আঁতকে উঠে বললেন সেই তিব্বতী বৃদ্ধ, "তার চেয়ে বরং আপনি এক কাপ গরম চা বলতে পারেন ।"
"চলুন, লবিতে গিয়ে বসি ।"
"কেন, এই লনই তো ভালো । বেশ খোলা হাওয়া, রোদ্দুর । বৃষ্টিও পড়ছে না এখন ।"
ডা: জিগ্মের উদ্ভ্রান্ত ভাবটা কিন্তু তখনও কাটেনি । চা আসবার আগেই হঠাৎ উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার হাত দুটি চেপে ধরে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে বললেন, "মি: মালিক, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হবেন, আমার ছোট ভাইয়ের মত । আপনার কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি, বলুন, আমায় কথা দিন, বিজ্ঞানের এক মহতি গবেষণার স্বার্থে আপনি আমার মদত করবেন ? আপনাকে দেখে সংবেদনশীল মানুষ বলে মনে হয় ।"
"বিজ্ঞানের গবেষণা ? বিজ্ঞানের আমি কী বুঝি ? ঘোর ব্যবসাদার মানুষ আমি ।"
"না না, মি: মালিক । আপনাকে গবেষণা কিছু করতে হবে না । আপনি কেবল আমাকে একটু সাহায্য করবেন । আমার রিসার্চ সেট-আপ আজ বিশ বছর ধরে হয়ে রয়েছে, চলেছে । আজ এতোদিনে বোধহয় আমি তার ফল পেতে চলেছি । শুধু আপনার একটু সাহায্য চাই ।"
চা এসে গিয়েছিল । হুস্ করে চা টুকু পান করে খালি কাপ রাখতে রাখতে বলে চলেন ডা: জিগ্মে, "আমার এ' গবেষণা সফল হলে মানবজাতির অশেষ মঙ্গল হবে ।"
"মানবজাতির অশেষ মঙ্গল ? আপনি কি ক্যান্সারের ওষুধ-টষুধ........?"
ডা: জিগ্মেকে দেখে অবশ্য আমার কালজয়ী বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী বলে মনে হয়নি । অবশ্য কোন্ জ্ঞানী মানুষকেই আবার শুধু চোখে দেখেই চেনা যায় ?
"না না, কোনো ক্যান্সারের ওষুধ-টষুধ আমি আবিষ্কার করতে যাচ্ছি না । সেটা আমার লাইন নয় । আমার কাজ মানুষের মন নিয়ে ......।"
"মানুষের মন ? আপনি কি সাইকোলজিস্ট ? না, সেই প্যারা-সাইকোলজিস্ট ?" পুছি ।
"আজ্ঞে না । ওই প্যারা-সাইকোলজি-টজি আমি বুঝি না । আমার গবেষণা প্রাচীন তিব্বতী ভেষজবিদ্যার এক ধারায় । মানুষের স্মৃতি নিয়ে এর কারবার ।"
"মানুষের স্মৃতিবর্ধন ? তা বেশ বেশ । আমাদেরও আছে ব্রাহ্মী শাক ..... "
"ধরেছেন ঠিকই । বেকোপা জাতের গুল্ম-লতা নিয়েই আমার কাজ ।"
"ইয়েস, নুট্রপিক ড্রাগে আমার বিশেষ উত্সাহ আছে । আপনি বলুন আপনার কথা । শুনি ।" আমি বলি ।
"তাহলে তো আমায় এক্কেবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয় ।"
"বলুন না, হাতে সময় আছে যখন ।"
"বেশ, বেশ", শুরু করেন ডা: জিগ্মে ।
আমার গুরু ডা: দোনদেন তিব্বত থেকে প্রাচীন চিকিত্সাবিদ্যার এক মস্ত সম্পদ নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন ও ধরমশালায় "টিবেটান মেডিকাল স্কুল"-এর পত্তন করেন । আমি সেখান থেকেই পাশ করি । দলাই লামার ব্যক্তিগত চিকিত্সক ছিলেন আমার গুরুদেব । সত্তরের দশকে আমেরিকা ট্যুর করে মাতিয়ে আসেন । আজকের ডা: এলিয়ট টোকারের মত চিকিত্সকের জন্ম তখনই ।
দেখুন মি: মালিক, মানুষ চিরকালই অজানাকে জানতে চেয়েছে, অচেনাকে চিনতে চেয়েছে । পৃথিবীর সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল শক্তিটাই হল সেখানে । মানুষের ভবিষ্যতই হল সবচেয়ে অজানা, সবচেয়ে অচেনা । যুগে যুগে তাই মানুষ ভবিষ্যত্কে জানতে চেয়েছে । তাই আপনাদের প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রের জন্ম । ইংরিজিতে টাইমমেশিনের গল্প লেখা হয়েছে । প্রাচীন তিব্বতী ভেষজবিদ্যার এক ধারা ছিল যা শুধু পুরনো স্মৃতির বর্ধনই নয়, মনের আয়নায় সে-ছবি এনে দিত যা নিকট ভবিষ্যতে ঘটতে চলেছে ......
চায়ের পেয়ালায় শেষ-চুমুক দিতে গিয়ে নির্ঘাত বিষম খেলুম একটা, বললুম, "এঁযা ! ভেষজবিদ্যার দ্বারা ফরচুন-টেলিং ? বলেন কী ? ওষুধ খেয়ে মানুষ ভবিষ্যত দেখতে পায় ? এমন আজগুবি কথা জীবনে শুনিনি ।"
মিটিমিটি হাসলেন ডা: জিগ্মে, বললেন, "প্রাচীন তিব্বতের বৌদ্ধ সাধুরা এক আরক পান করে ইচ্ছেমত অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতেন, জানেন কী ?"
অকপটে জানালাম যে এ' আজগুবি গপ্পখানিও শুনিনি আগে ।
"আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, মি: মালিক । ওই আরক দেহের তাপমাত্রা আচমকা এমন বাড়িয়ে দিত যে তার দিকে ধেয়ে আসা আলোকরশ্মিকে তা অন্য পথে বাঁকিয়ে দিত । সামনে বসে থেকেও তাই কেউ আর তাকে দেখতে পেত না । এই থিওরিকে কাজে লাগিয়ে জাদুকর মঞ্চে মানুষ ভ্যানিশ করে দেন । সেদিন তো টিভিতে দেখলুম আপনাদের পি সি সরকার খোলা মাঠে একখানি গোটা ট্রেনও ভ্যানিশ করে দিলেন । তিনি অবশ্য এই আলোকরশ্মির পথ টেরিয়ে দেওয়ার কথাটা বলেই দিলেন, শুনলাম ।"
"তা না হয় হল । কিন্তু আপনার গবেষণাটা কী ?" আমি মূল প্রশ্নে ফিরে আসতে চাইছিলাম, "ভেষজবিদ্যা, মানে, গাছপালা বা মাটির তলার শিকড়-বাকড় মানুষ খেলে কী করে তার ভবিষ্যত দেখতে পাবে ? তাহলে তো সে-সব শেকড়-বাকড় খেয়ে গরু-ছাগলও ভবিষ্যত দেখতে পাবে ।" আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করিনি ।
"না মি: মালিক, গরু-ছাগল ভবিষ্যত দেখতে পাবে না । কারণ সে-সব শিকড়-বাকড় এমনি কাঁচা কাঁচা চিবিয়ে খেলে কিচ্ছু হবে না । এক সহস্রাব্দ-প্রাচীন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ করা চাই । তার ওপর, যার ওপর সে ভেষজের প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার শারীরিক গুণাগুণও ধর্তব্য । শুধু তাই নয়, যার ভবিষ্যত সে দেখতে পাবে তার শরীরের বিভিন্ন পরিসংখ্যানও যে জরুরি তার প্রমাণও গতকালই মাত্র আমি পেয়েছি । আর মি: মালিক, ঠিক এই কারণেই আজ আমার আপনার কাছে ছুটে আসা ।"
"আমি কিছুই বুঝছি না ।"
"বলছি, বলছি, মি: মালিক, সবই খুলে বলছি আপনাকে । আপনার সাহায্য চাই আমার । আপনাকে সব খুলে না বললে চলবে কী করে ? স্মৃতিবিজ্ঞানের এই প্রাচীন তিব্বতী ধারা বহুকাল আগে প্রায়-লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, বা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল । আজ থেকে সত্তর বছর আগে, তখনও আমার জন্ম হয়নি, ব্রহ্মপুত্রের তীরে আমাদের প্রাচীন শিগাত্সে শহরের বাড়ির সামনে আমার বড়দাদা অকস্মাৎ মাথায় পাথর পড়ে মারা যান । সেদিন ছিল তাঁর ৫ বছরের জন্মদিন পালনের উত্সব । আমার বাবা এই ঘটনায় মনে অসম্ভব দাগা পান । তাঁর মনে হয়েছিল, বংশে যে প্রাচীন তিব্বতী ভেষজবিদ্যা চর্চার ধারা ছিল তা যদি অব্যাহত থাকত, তাহলে ছেলের এই এক্সিডেন্টের ঘটনা তিনি আগেই জানতে পারতেন ও ছেলের প্রাণটা বেঁচে যেত । সেই থেকেই ফের এই গবেষণার কাজ শুরু হল আমাদের বাড়ির ল্যাবরেটরিতে । সে-ধারাই আমি আজও বহন করে চলেছি । অতি সম্প্রতি এই গবেষণার সুফল আমি পেতে শুরু করেছি । তৈরি আরক নিজের ওপর ও আমার পুত্রবৎ পরিচরটির ওপর প্রয়োগ করায় গতকালই প্রথম ঘেরো বাজারে আপনার জীবনে এক ঘটতে যাওয়া ঘটনা সঠিক প্রত্যক্ষ করেছে বলে আমায় জানিয়েছে । এবং, কাল সন্ধেবেলাতেও আপনাকে আমার বাড়িতে দেখে তার মাথাটা একবার চক্কর দিয়ে ওঠে, হাত থেকে জ্বলন্ত বাতিদানটি পড়ে যায়, এবং হোটেলে ফেরার পথে যে আপনার হাত থেকে খোলা ছাতাখানি হাওয়ায় উড়ে বেরিয়ে যাবে তা ফের স্পষ্ট দেখতে পায় সে । এখন মি: মালিক, আমায় জানতে হবে, কেবল আপনার ক্ষেত্রেই ঘেরোর ভবিষ্যদ্বাণী এমন অমোঘ মিলছে কী করে, অন্য কারোর ক্ষেত্রে নয় কেন ? আরকের প্রয়োগ তো আমি নিজের ওপরেও করেছি, তবে সে-ভবিষ্যদ্বাণী আমি করতে পারছি না কেন ? তাই, মি: মালিক, আরকের প্রভাবকে আরও সঠিক, আরও বিস্তৃততর করতে আপনার শরীরের কিছু মেডিক্যাল তথ্য আমার ডেটা-বেসে ঢোকাতে হবে । এ'কারণেই আপনার সাহায্য আমার চাই ।" শেষের দিকে ফের সেই তিব্বতী বৃদ্ধের গলায় সনির্বন্ধতা ফুটে ওঠে ।
ভদ্রলোকের কথায় একটা মানানো দৃঢ়তা ছিল, অবিশ্বাস করতে তাই মন চাইল না । বিশেষত, কাল রাতে হোটেলে ফেরার পথে দমকা হাওয়ায় আমার হাত থেকে ছাতা উড়ে যাবার ঘটনা তো কোনো মতেই ওনার জানার কথা নয় । তবু, আরক পান করে ভবিষ্যত দেখতে পাওয়ার দাবি এতোই গাঁজাখুরি যে শিক্ষিত মন তা মানতে চায় না । কোনো ভনিতা না করে ওনাকে বলেও দিলুম সে কথাটা ।
চুপ করে রইলেন ডা: জিগ্মে । দেখি, একদৃষ্টে চেয়ে আছেন আমার মধ্যমার নীলা পাথরটির দিকে । গত বছর ব্যবসায় বড় একটা ধাক্কা খাবার পর এক নামী জ্যোতিষির কাছে যাই । তাঁর বিধান অনুযায়ী এই পাথরটি ধারণ করে ব্যবসায় আশাতিরিক্ত লাভ পাচ্ছি । পাথরটির দিকে আঙুল তুলে মৃদু হেসে বলেন ডা: জিগ্মে, " মি: মালিক, ১ গ্রামেরও কম ওজনের এক খণ্ড নীল রঙের পাথর । পড়ে ছিলো কোন্ ইলাকাকা খনির গহ্বরে । সাপ্লায়ার তুলে এনে দিল বম্বের মণিকারের কাছে । গঁযাটের কড়ি খরচা করে আপনি যেই সেটিকে আঙুলে ধারণ করলেন, পঁচাত্তর কোটী মাইল দূরের শনিগ্রহকে তা বশে এনে ফেলল, উন্নতি হতে থাকল আপনার ব্যবসায়ে, আপনার শারীরিক ও পারিবারিক সমস্যারও সমাধান হতে লাগল । এরমধ্যে কী কার্য-কারণ সম্পর্ক খঁংউজে পান, স্যর ? আর আমার গবেষণালবদ্ধ তিব্বতী এই আরক তো ভবিষ্যত বদলায় না, শুধু একটু আগে তা দেখিয়ে দেয় । তা-ও এক দু' বছর পরের ভবিষ্যত নয়, দু-পাঁচ-দশ-বিশ মিনিট পরের ।" সরল স্বীকারোক্তি ডা: জিগ্মের ।
কোনো ঠগের পাল্লায় পডলুম না তো --- হঠাৎ আমার মনে হতে লাগল । এক্ষুনি হয়তো বুঝতে পারছি না, পরে দেখব বড় একটা লোকসান করিয়ে দিয়ে গেল লোকটা ।
না:, হাত ঝেড়ে উঠে পড়লাম আমি, বললুম, "দেখুন ডা: সায়েব, চিনে আকুপাংচার বা জিনসেঙের নাম-টাম শুনেছি বটে, কিন্তু তিব্বতী যে আবার ঔষধও হয় --- তা-ই জানি না । না:, আপনার গবেষণার সাফল্য আমি কামনা করি বটে, কিন্তু তার গিনিপিগ হতে আমি অপারগ ।" ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছি আমি ।
"শুনুন, শুনুন মি: মালিক, আপনি উঠে যাবেন না," হাহাকার করে ওঠেন সেই তিব্বতী বৃদ্ধ, "আমার স্মৃতি-আরক গবেষণাকে আপনি এখনও না মানতে পারেন, কিন্তু বারোশ' বছরের প্রাচীন তিব্বতী চিকিত্সাবিজ্ঞানকে কী করে উড়িয়ে দেবেন ? যে বায়ু-পিত্ত-কফের চর্চার ওপর ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে, তিব্বতেও তাই । আমরা বলি লুং-খৃপা-বদখান । শুধু রোগ নয়, রোগীর মন:চর্চা ও মানসিকতার ওপরেই সমধিক জোর দিই আমরা । আর, রোগির নাড়ি দেখার এমন পারদর্শিতা পৃথিবীর অন্য কোন্ ধারার চিকিত্সাশাস্ত্রে আছে, জানি না ।"
"নাড়ি-টেপা বদ্যির স্থান আজকের আধুনিক চিকিত্সাশাস্ত্রে নেই, হাজারো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এসে গেছে", সরাসরি বলে দিলাম আমি ।
ম্লান হয়ে এলো বৃদ্ধের মুখটি । হঠাৎ তাঁর হাতটা বাড়িয়ে আমার ডান হাতের পাল্স নিতে লাগলেন । কিছুটা কৌতুহল ও মজা পেতে চুপ করে ফের চেয়ারে বসে পড়লাম আমি ।
মিনিট দু'য়েকের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে লাগল ওনার মুখ ।
"স্ট্রেইঞ্জ ! ভুলিনি, আজও ভুলিনি বাপের কাছে শেখা বিদ্যে । না:, মি: মালিক এখানে মন:সংযোগের অভাব হচ্ছে । একটু নিভৃত জায়গা চাই । চলুন আপনার ঘরে গিয়ে বসি । মি: চট্টোর আবার ব্যাঘাত হবে না তো ?"
"তিনি এখন একটু বেরিয়েছেন ।"
কী বলব একে, ম্যাজিক না মিরাক্ল না গভীরতম অধীতবিদ্যার বহি:প্রকাশ ?!
"রিসেপশনে বলে দিন আগামি আধঘন্টা যেন কোনো কল না দেয় এ'ঘরে । আপনার মোবাইল ফোনটিও অফ্ রাখুন । মন:সংযোগে হঠাৎ ব্যাঘাত হলে অসম্ভব কষ্ট হয় ।" ঘরে ঢুকেই বলে দিলেন ডা: পেল্মা জিগ্মে ।
তথাস্তু । আমার তখন কৌতুহল, দেখিই না বুড়ো কী তিব্বতী খেল্ দেখায় ।
এরপর উনি মিনিট পাঁচেক চোখ বুজে চুপচাপ বসে মন:সংযোগ করলেন । তারপর আস্তে আস্তে হাত বাড়ালেন, প্রথমে বাঁ পরে ডান হাত দিয়ে, এক নয়, আমার দুই হাতের নাড়িই এক যোগে `দেখতে' লাগলেন । পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট কেটে গেল । তারপর গভীর শ্বাস নিতে-ছাড়তে লাগলেন । একবার চোখ খুলে ভুরু নাচিয়ে আমাকেও ইঙ্গিত করলেন তেমন গভীর শ্বাস নিতে-ছাড়তে । করলুম ।
মিনিট বিশেক পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে. আমার হাত দুটি ছেড়ে দিলেন ডাক্তারবাবু । মুখে প্রশান্তির হাসি ।
"ফ্যানের স্পিডটা একটু বাড়িয়ে দিন তো", বললেন । ঘামছেন ।
"কী দেখলেন ?"
"নাড়ি সব কথা বলে, মি: মালিক, সব কথা । মেডিক্যালি । দু' বছর আগে আপনার পিলের রোগ হয়েছিল বা আপনার পিতার হার্নিয়ার রোগ ছিল --- এ'সব বলে দেওয়া তো সহজ । কিন্তু যদি বলি চোদ্দ বছর বয়সে কোনো ভারি জিনিস তুলতে গিয়ে পিঠে অসম্ভব ব্যথা পেয়েছিলেন যা এই চোদ্দ বছরেও সারেনি, বা আপনার মা বা বাবার বাবা-মা কেউ মানসিক রোগি ছিলেন --- অবাক হবেন নিশ্চয় । আরও যদি বলে দিই, আপনার পুত্রযোগ নেই, দুটিই কন্যা হবে-- সেটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে যাবে না কী ? কারণ আপনি তো এখনও বিবাহই করেননি । সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর নাড়িও দেখতে হয় ......"
ঘটনা, এর পরে আর তিব্বতী নাড়ি-টেপা বিদ্যেকে অবহেলা করতে পারিনি ।
ক্লাস নাইনে বয়েজ স্কাউট দলের সঙ্গে রাজগীর স্টেশনে নেমে এক ভারি ব্যাগ কাঁধে তুলতে গিয়ে আচমকা পিঠে এক পিন ফোটার মত খঁযাচ্কা-ব্যথা লেগে গিয়েছিল, যা সময়ে সময়ে আমাকে পঙ্গু করে তোলে, আজও । এটা ওই বুড়ো তিব্বতীর কোনো ভাবেই জানার কথা নয়, যদি না আমার নাড়ি সত্যি সত্যি সেই কথা "বলে" । আর, আমার গণিতজ্ঞ ঠাকুর্দা অঙ্ক অঙ্ক করে মাঝ বয়সে উন্মাদ হয়ে কটন কলেজের চাকরি খুইয়ে রাঁচিতে ভর্তি ছিলেন বহুবছর ---এটা সবাই জানে ।
'সেশন' শেষে আমার ভক্তি এক লাফে দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল ।
বললুম, "বলুন ডা: জিগ্মে, কী ভাবে আমি আপনার গবেষণায় সাহায্য করতে পারি ?"
সেদিনের সেই ঘটনার পর আমি ডা: জিগ্মের "গবেষণায় সাহায্য" করতে আরও দু'টো দিন কালিম্পঙে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিই । ওনার অনুরোধে বিষয়টা পাঁচকান করিনি, এমনকি আমার সাথী সুমিতের কাছেও না । ওকে কেবল বলেছিলুম, "তুই শিলিগুড়ি নেমে আমার ট্রেনের টিকিটটা ক্যানসেল করে কলকাতায় ফিরে যা । আমি দু'দিন পরে বাসে ফিরবো । সব বলব তখন তোকে ।"
কালিম্পঙে আমার পরের দু'দিনের ঠিকানা ছিল ডা: জিগ্মের বাড়ি । মস্ত বাংলো । পাঁচ ছ'টা ঘর । ওনার গবেষণাগারই তিনটি প্রমাণ সাইজের ঘর নিয়ে । তাতে এক দিকে যেমন রয়েছে আধুনিক কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে যেমন দেখা যায় --- বিকার, বার্নার, টেস্ট-টিউব, পার্সোনাল কম্প্যুটার ইত্যাদি, অন্য দিকে তেমন রয়েছে প্রাচীন চিনে-তিব্বতী পঁংউথির সম্ভার । আর এক ঠাণ্ডা ঘরে নানা গাছ-গাছালি থরে থরে সাজানো ।
দু'দিন ডা: জিগ্মের আতিথ্যে যত্ন-আত্তির ত্রুটি হল না । আমি নিজের কাজ ফেলে নি:স্বার্থভাবে ওনার গবেষণায় সাহায্য করতে এসেছি --- এতে ওনার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই । বারবার হাত কচ্লে সেটা বলতে লাগলেন । বিস্তারিতভাবে আমার মেডিকাল ডেটা নেওয়া হল, আমার জন্মস্থান-তিথি থেকে ব্লাডপ্রেসার-ব্লাড টেস্ট থেকে এক আই কিউ টেস্টের রিপোর্ট পর্যন্ত নথিভুক্ত করে রাখা হল । পারিবারিক ইতিহাসও ঘন্টা-চারেক ধরে নেওয়া চলল ।
দ্বিতীয় দিনটায় তো সারা দিন ধরে ইউরিনের নমুনা নেওয়া চলল । তিব্বতী চিকিত্সা বিদ্যায় মূত্র-বিশ্লেষণ নাকি এক মহান স্থান নিয়ে আছে । ন' ধরনের মূত্র পরীক্ষা করা হয়ে থাকে । আধুনিক পশ্চিমা চিকিত্সাবিদ্যার জন্মের আগে কোন্ তিব্বতী পাহাড়ের চূড়ায় এতো বিশ্লেষণধর্মী এক চিকিত্সাবিদ্যার চল ছিল --- জেনে শ্রদ্ধা বাড়ল !
বৃষ্টিভেজা দিনে ঘেরোর হাতের চিকেন পকোড়া ও চায়ের সঙ্গে আমার মেডিক্যাল এডভেঞ্চার মন্দ জমলো না । বালকটির সঙ্গে আমার বড্ড সখ্যতা হয়ে গেল এ' দু'দিনে । অনাথ নেপালি বালক । ডা: জিগ্মে তাকে প্রায় পথ থেকে কুড়িয়ে পেয়ে পুত্রস্নেহে লালন করছেন, জানলাম । ছেলেটি আমার পিছনে পিছনে ঘোরে । চকোলেট কিনে দিতে বেজায় খুশি । আর আশ্চর্য, আমার ক্ষেত্রে ঘেরোর ভবিষ্যত্বাণী প্রত্যেকবারই অব্যর্থভাবে মিলে যায় । এই যেমন, এখন আপনি বাথরুমে ঢুকে দেখবেন সাবান নেই, স্নানের মাগটা ঢং করে হাত থেকে পড়ে যাবে, দেওয়ালে টিকটিকিটা টিক্ টিক্ করে উঠবে, ডিনারে ডিমের ডানলায় কামড় দিয়ে বিষম খাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি ।
"এমন খুচরো-খাচ্রা কেন বাপু ? একটা মেগা কিছু ভবিষ্যত্বাণী কর্ না, যে এই নাম্বারের লটারির টিকিটে আপনার ফার্স্ট প্রাইজ উঠবে --- আমি তাহলে ক্রোড়পতি হয়ে যাই ।" আমি হেসে বলি ।
"যদি আপনার ভবিষ্যতে তেমন কিছু না-ই ঘটবার হয় তো ঘেরো বলবে কোথ্থেকে ? এই তিব্বতী আরকে কেবল নিকট ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতাই পাওয়া যায়, বদলানোর নয় ।" ডিনারের শেষে আইসক্রিম খেতে খেতে নিরীহ স্বীকারোক্তি ডা: জিগ্মের ।
"যাক্, নিকট ভবিষ্যতো যদি সঠিক বলা যায়, তাতে যদি এক্সিডেন্ট-টেন্ট রোকা যায়, মানুষের মঙ্গল হয় --মন্দ কী ?" ডা: জিগ্মেকে এই কথা বলে আমি পাহাড় থেকে নেমে আসি । উনি বারবার আমায় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকেন । আমার সহযোগিতায় নাকি ওনার গবেষণার অশেষ উপকার হল । এই আরককে এখন ত্রক্রমে বৃহত্তর পরিধিতে ব্যবহার করা যাবে ।
আমি যদিও বুঝলুম না যে আমি কীই বা এমন করলুম ওনার জন্য ।
যদিও তখনও আমি জানি না, নিজের অজান্তেই কতবড় ক্ষতি আমি করে দিতে চলেছি ওনার ও ওনার গবেষণার !!!
জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কালিম্পং থেকে ফেরার পর আমাদের সাপ্তাহান্তিক খানপানের আসরে সুমিতকে আমি পুরো কাহিনিটা শোনাই --- সেই শুক্রবার সকালে বায়সের কীর্তি থেকে শুরু করে আমাদের হোটেলের ঘরে ডা: জিগ্মের অমোঘ পাল্স্ রিডিং থেকে আমার দু'দিন একস্ট্রা থেকে যাওয়া হয়ে মঙ্গলবার সকালে কালিম্পং বাসস্ট্যাণ্ডে আমার চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যাওয়া পর্যন্ত, যার ভবিষ্যত্বাণীও ঘেরো দশ মিনিট আগেই করে দিয়েছিল । সুমিত হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল এ'সব গাঁজাখুরি গপ্প । ওর নিরুত্সাহ দেখে আমিও এখানেই গল্পের ইতি টানি ।
তখনও জানি না এ'গল্পের শেষ অনেক দূরে !
এরপর থেকেই পার্টনারের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে । তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে সুমিত আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করল, সামান্য পয়সাকড়ির হিসেব নিয়ে ঝগড়া । সুমিত আমার ছোট্টবেলাকার বন্ধু । আমরা একসঙ্গে গলিতে রবারের বলের ক্রিকেট খেলেছি । আমি ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলুম, অনেকভাবে মানিয়ে নিতে চাইলুম । কিন্তু কিছুতেই কিছু হবার নয় । দু'-মাসের মধ্যে ওকে পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে ছেড়ে দিতে হল । মস্ত একটা ধাক্কা খেয়ে গেল ব্যবসাটা । তারপর পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতা থেকেই উধাও হয়ে গেলেন শ্রীমান সুমিতকুমার চট্টরাজ । আর না কোনো খবর, না কোনো পাত্তা । মোবাইল নম্বরও বদলে গেছে ওর ।
তারপর এই দু:সংবাদ ! বাকি ঘটনা এই ওর ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে শঙ্কায় গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠতে লাগল আমার ! পেটে পেটে এযাতো ?
"পুজোর পরে পরেই, অক্টোবর মাসে, হঠাৎ দাদা কোথ্থেকে এসে হাজির আমার এই মালাডের ফ্ল্যাটে, সঙ্গে এক নেপালি চাকর ("নেপালি চাকর" শুনে আমি একটু কান খাড়া করে ফেলেছি) । বলল, কলকাতার ব্যবসা গুটিয়ে এসেছে, এখানে নতুন ব্যবসা ফাঁদবে । সত্যি বলতে কি, আমরা একটু মুশকিলেই পড়লুম । বোঝোই তো, বম্বের এই দেড়রুমের ফ্ল্যাট, জলকষ্ট । সেখানে যদি দু'টো এক্সট্রা লোক এসে থাকে । আর সারাদিন দাদা বেরোতোও না কোথাও । কেবল টিভির ইনভেস্টমেন্ট চ্যানেল খুলে বসে থাকত আর মোবাইলে বকর বকর ।
মাসখানেক এই ভাবে কেটে যাওয়ার পর, এক সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরে নীতার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, কারণ বাথরুমে এক ফোঁটা জল বেঁচে নেই । দাদা সে-রাতে আমায় 'বুঝিয়ে' বলল, সঙ্গের নেপালি চাকরটার নাকি অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী করবার ক্ষমতা আছে । কোন্ এক তিব্বতী আরক তাকে খাইয়ে দিলে সে নাকি ফর্ফর্ করে শেয়ার প্রাইসের ওঠানামা অব্যর্থ বলে দেবে, আর তাতে নাকি দাদা লাভে লাল হয়ে যাবে !
"আমার দাদাকে আমি চিনি । তার এই `রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া'-র গপ্প ছোটবেলা থেকে আমি কম শুনিনি । তাই এ' খানিও বিশ্বাস করলুম না, বললুম, "তা দাদা, এই একমাসে তুমি শেয়ার বেচেকিনে কত লাখ টাকা লাভ করলে শুনি ?"
"আরে তুই বুঝছিস না, টুনু, এ' বেটাচ্ছেলে ইংরিজিটা তো একদম জানে না । তাই কোন্টা রিলায়েন্স আর কোন্টাই বা ইনফোসিস --- তা-ই পড়তে পারছে না । পারলে দেখতিস্"
"তা, তুমি কি এখন ওকে ইংরিজি পড়াতে বসবে না কি ?"
"অন্তত:, ওয়ান-টু-থ্রি-ফোরটা তো ওকে শেখাতেই হবে", দাদার নির্বিকার উত্তর ।
"নেপালি ছেলেটাকে দেখলে, বুঝলে বাপিদা," বলে চলে প্রমিত, "বড্ড মায়া হত আমাদের । নেহাত বাচ্চা ছেলে । গোর্খালী আর একটু একটু বাঙলা ভাষা বলতে পারে । দাদা যে কী ভুজুং ভাজুং দিয়ে কোথ্থেকে ওটাকে ফঁংউসলে এনেছিল, কে জানে ? ওর বাড়ি দার্জিলিং -এর কোথায় যেন, বলত । অনাথ ছেলেটা খালি কাঁদত । নীতারও মায়া হত । একদিন একটা ক্যাডবেরি কিনে দিয়েছিল । কী খুশি ছেলেটা ।"
প্রমিতের এ' গল্প শুনতে শুনতে আমারই চোখে জল এসে যাচ্ছিল ।
"তা, এক সন্ধেয়, বুঝলে বাপিদা, দাদা মহা উত্সাহে আমায় বলল, কাল ছেলেটাকে হরিহরণের কাছে নিয়ে যাবো, বুঝলি, টুনু ।"
"সে আবার কে ?"
"ওমা, হরিহরণকে চিনিস না ? আমার বন্ধু । ডয়েশ ব্যাঙ্কের কারেন্সি ডিলার"
"সেটি আবার কী বস্তু ?"
"তাও জানিস না ? প্রতিদিন ব্যাঙ্কের হয়ে কোটি কোটি ডলার-পাউণ্ড-ইউরো কিনছে আর বেচছে । সেখানে এই ছেলেটা যদি দু'-একটা প্রাইস মুভমেন্ট কারেক্ট বলে দিতে পারে, বেশি না, এক-আধ মিনিট আগে, তাহলেই কোটি কোটি টাকা লাভ ! সেখানে তো ইংরিজিও পড়তে হবে না । কেবল সংখ্যা প্রেডিক্ট করলেই হবে । ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর তো ব্যাটা ভালোই শিখে গেছে এযাদ্দিনে ।
"প্রথম সন্ধেয় দাদা ফিরল এক মস্ত পেস্ট্রি নিয়ে । ছেলেটা "ডিলিং রুম"-এর বাইরে থেকেই কাঁচের দেওয়াল দিয়ে "রয়টার"-স্ক্রিন দেখে দেখে নাকি এমন প্রেডিক্ট করেছে যে এক দিনেই ব্যাঙ্কের কয়েক কোটি টাকা লাভ হয়েছে ! এ'রকম চলতে থাকলে, বুঝলি টুনু, মাসখানেকের মধ্যেই তোকে বেলাপুরের ফ্ল্যাটটা কিনে দেব ।
দাদার এ'হেন আকাশ-কুসুম গল্প অবশ্য আমরা শুনতে অভ্যস্ত । পয়সা রোজগার করা এতো সহজ ? মিছেই তবে কেন এতো খেটে মরি উদয়াস্ত ?
"যদিও সিনটা বদলে গেল দু-দিনের মধ্যেই । পরের সপ্তাহেই দাদা একদিন বেধড়ক পিটলো বাচ্চাটাকে । সে-সন্ধ্যায় অবশ্য আমরা কর্তা-গিন্নি বাড়ি ছিলুম না । রাত ন'টায় আমরা ফিরতে মার বন্ধ হল । আমি কড়া ভাষায় দাদাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললুম, নইলে পুলিশ ডাকবো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ।
"পরেরদিন সকালে থমথমে আবহাওয়া বাড়িতে । আটটা নাগাদ দাদা বেরোচ্ছে । আমিও একটু পরেই বেরোবো, ব্রেকফাস্ট করছি । কাল অত মার খাওয়ার পর বাচ্চাটা ভয়ে ভয়ে নির্ণিমেষ নয়নে চেয়ে আছে দাদার দিকে । শুনি, বিড়্বিড়্ করে বলে চলেছে, "বাবু যাস্ নি, যাস্ নি আজ ।" আমি ভালো শুনতে পাইনি । নীতা জিজ্ঞেস করল, "কী বলছিস্ রে ?" ছেলেটি প্রবলভাবে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বারবার বলতে লাগল, "বাবু যাস্ নি, যাস্ নি আজ । বেরোস নি ।" আর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো । দাদা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে । আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে, ট্রেন মিস হয়ে যাবে । নীতার সেদিন অফ্ । আমি ওকে বললুম, "টিভিটা চালিয়ে দাও । দেখুক ছেলেটা বসে ।" বলে বেরিয়ে পড়লুম আমি ।
এরপর চুপ করে যায় প্রমিত । আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছি । দেখি ওর চোখে জল । চুপ করে থাকি । খানিক পরে ও' নিজেই বলতে থাকে, "বাপিদা, আজকের এই সুমিত চট্টরাজকে চিনি না আমি । আমার চোখে দাদা সেই ছোট্ট বেলাকার রাজা লেনের পানু, ভাইয়ের জ্বর হলে যে ঠনঠনে কালীবাড়িতে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকত । ক্লাস টেনে আমার ডানহাতটা ভেঙে গেছল, মা নয়, দাদা আমায় খাইয়ে দিত । এই ২৪শে নভেম্বার দিনটাকে তাই আমি ভুলব কী করে ? আমি দৌড়ে স্টেশনে ঢুকছি । হৈ চৈ একটা । ট্রেন সব বন্ধ । পাঁচ মিনিট আগেই ঘটে গেছে ঘটনাটা । আটটা বারোর সুপারফাস্টটায় উঠতে গিয়ে পা ফস্কে দাদা আমার ট্রেনের তলায়.......... "
আর বলতে পারে না প্রমিত । ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে । সান্ত্বনা আর কী দেব ওকে, কাঁদতে দিই । পরে ওর পিঠে হাত রেখে আমারও চোখ বাঁধ মানেনি । সুমিত যে আমারও অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল !
"এ' ঘটনার পর থানা-পুলিশ কম হয়নি ।" একটু সামলে নিয়ে ফের বলতে থাকে প্রমিত, "পুলিশ সূত্রেই বোধহয়, খবর পেয়ে কোথ্থেকে এক তিব্বতী লামা এসে সেই নেপালি ছেলেটিকে ফেরৎ নিয়ে যান তাঁর কালিম্পঙের বাসায় । দাদা নাকি ভার্চুয়ালি চুরি করেই নিয়ে এসেছিল ছেলেটিকে ।"
প্রমিতের মালাডের ফ্লাটে বসে এ'সব শুনতে শুনতে আমার নিজেকেই বড্ড দোষী মনে হচ্ছিল । সত্যি হোক্, মিথ্যে হোক্, কোন্ পাহাড়ের কোণে বসে এক বিজ্ঞানসাধক প্রাচীন তিব্বতী ভেষজ নিয়ে গবেষণায় মগ্ন ছিলেন । কোথ্থেকে আমরা গিয়ে হাজির হলুম, গোটা জীবনটাই বদলে গেল পাত্র-মিত্রদের । একেই কি `ভবিতব্য' বলে ? কোথায় চলে গেল সুমিত ? কোথায় যায় মানুষ মৃত্যুর পরে ? আর কোথায়ই বা সেই ছোট্ট ঘেরো ? বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে । আর ডা: জিগ্মে ? তাঁর কাছে যে আমার ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে ।
যদিও গবেষণা তাঁর ফলপ্রসূই হয়েছে । আমার ছাড়া অন্তত: আরও একজনের ক্ষেত্রে আরকের প্রভাবে ঘেরোর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে শত প্রতিশত ।
যদিও বড় নির্মম সে সফলতা ।
(পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর , ২০১০)